সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : ১৬
রেশমার ডেরার বাইরে হারমা মাটিতে বসে। প্রভুভক্ত কুকুরের মতো সতর্ক চোখ। অবাঞ্ছিত কাউকে দেখলে ঘেউ ঘেউ করে ওঠার ইচ্ছেটা শুধু চোখে প্রকাশ পায়। তবে বাপীকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল বটে।
ওকে একলা দেখে বাপী ধরে নিল রেশমা ঘরে নেই। কেন এলো, কি দরকার ও নিজেও জানে না। আবুর ঘর থেকে বেরিয়ে পা দুটো অনেকটা আপনা থেকেই এই পথ ধরেছে।
—কোথায়?
জবাবে ভাবলেশশূন্য হারমা ঘরের দিকে ফিরে হাঁক দিল, হি রেশমা—!
খুপরি জানলায় রেশমার মুখ দেখে বোঝা গেল ওটার গায়েই শোবার চৌকি। উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর দু’ চোখ ঘা খেল একপ্রস্থ। গায়ে মোটা চাদর থাকা সত্ত্বেও উঠে বসার ফলে কয়েক পলকের জন্য সামনেটা অনাবৃত। গায়ে শুধু আঁট কাঁচুলি। বাপীকে দেখে শশব্যস্তে মাটিতে নেমে দু’তিন মিনিটের জন্য অদৃশ্য। বেরুলো যখন ঘাগরার ওপর চকচকে রঙিন আঁট জামা; ঠোঁটের ফাঁকে আর চোখের কোণে হাসির ছটা।—বাপীভাই যে! কি ভাগ্যি—করে এলে?
—কাল বিকেলে। এই মেয়ে কাছে এসে দাঁড়ালে খুব স্বস্তি বোধ করে না বাপী। নিজেকে সজাগ শাসনে রাখার একটু বাড়তি ধকল পোহাতে হয়।
বাসি সুর্মার দাগ লাগা রেশমার কালো চোখ তার মুখের ওপর উৎসুক।— আবু সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
—সেখান থেকেই আসছি।
কি বলতে গিয়ে হারমার দিকে চোখ গেল রেশমার। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝালো বিরক্তি।—তুই সেই থেকে বসে আছিস কেন—ঘরে যা না!
বাপীর মনে হল ভক্ত অথচ গোঁয়ার কুকুরের মতোই লোকটা নিঃশব্দ রাগে গরগর করতে করতে সামনে পা বাড়াল। রেশমার দিকে ফিরে বাপী হালকা সুরে জিজ্ঞেস করল, তুমি ভিতরে থাকলে ওর বাইরে ডিউটি নাকি?
অস্ফুট শব্দ করে হেসে উঠল। গতরখাটা মেয়ে ডিউটির অর্থ বোঝে। জবাব দিল, ঘরেই ডিউটি দেবার ইচ্ছে, এখন পর্যন্ত অতটা আস্কারা পায়নি।
ওকে দুষবে কি, এই চটুল প্রসঙ্গের জন্য বাপী নিজেকেই দায়ী করল আর চোখ রাঙালো।
উৎফুল্ল মুখে রেশমা বলল, এমন মান্যিগণ্যি মানুষ এলো, কোথায় বা বসাই, ঘরে আসবে?
—না। বাপী গম্ভীর। মেয়েটা তার কাজের ভাবনায় তেমন উতলা মনে হল না।—আবুর মুখে হাতির পিঠে চড়ে তোমাদের বানারহাট বেড়ানোর খবর সব শুনলাম।
—আর বলো কেন। ওই বনমায়াকে সব্বাই দিল-এর রাণী ভাবে, মানুষের ↓ বেলায় যে ওটা এত অপয়া কে জানত! মেমদিদির বরাতটাই খারাপ–
—তোমার বরাতের খবর কি?
রেশমার এবারের হাসি ধারালো মনে হল বাপীর। জবাব দিল, আমার তো বরাত ফিরে গেল! ওই জবরদস্ত ম্যানেজার সাহেব নিজে সঙ্গে করে আমাকে আসামে নিয়ে গিয়ে বেশি টাকায় নির্ঝঞ্ঝাট কাজে বসিয়ে দিচ্ছে, ভাল থাকা খাওয়া পরার ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে—আবু সাহেবের মুখে শোনোনি?
—শুনেছি। তাহলে তুমি যাচ্ছ?
কেন যাব না? মুখের হাসি মিলিয়েছে, চোখের কালোয় আক্রোশ ঠিকরে পড়ছে।—এখানে উপোস করে মরব? মেমসায়েবের মেয়েই শুধু মেয়ে— আমরা কে? তবে
বাপীর মনে হল কিছু বদলার কথা বলতে গিয়ে সামলে নিল। আরো মনে হল উপোস আর অপমানের যন্ত্রণা ও ভালো জানে। তাই সাপ-ধরা মেয়ের চকিতে অমন ছোবল বসানো মূর্তি। তারপরেই আবার সেই ধার-ধার হাসি। বলল, তুমি অবশ্য ইচ্ছে করলেই ম্যানেজারের মুখে ছাই দিয়ে আমার এই বরাতও বরবাদ করে দিতে পারো—
মুখে নয় বাপীর চোখে প্রশ্ন।
—বুঝলে না? আমি তো ওদের কাছে জোর গলায় বলেছি কিচ্ছু জানি না, মেমদিদি আদর করে বেড়াতে নিয়ে গেছে তাই গেছি। হাতির পিঠে যেমন বসিয়ে রেখে গেছল তেমনি বসেছিলাম—মেমদিদিও নিশ্চয় গলা ফাটিয়ে বলেছে আমার কোনো দোষ নেই। তবু ওই ম্যানেজারের কথায় মেমসায়েব শুধু সন্দর ওপর আমাকে সরাতে চাইছে। আর তুমি তো আমাকে হাতে-নাতে ধরেছ মেমদিদির মনের মানুষের সঙ্গে কথা কইতে দেখেছ, আমার মারফৎ, মেমদিদিকে চিঠি চালান দিতে দেখেছ—এ-সব শুনলে ওই মেমসায়েব আমাকে আসামে পাঠিয়ে পয়সা দিয়ে পোষার বদলে দা দিয়ে কেটে মাটিতে পুঁতে রাখতে চাইবে।
দু’হাত কোমরে তুলে বাপীর মনের খবর আঁচ করার চেষ্টা। সুমার দাগ লাগা চোখে সত্যিকারের কৌতুক উছলে উঠল এবার। মুখ কপট-গম্ভীর।—আর মেমসায়েবকে বলে তুমিও যদি আমাকে আর কোথাও নিয়ে গিয়ে ভালো থাকা—খাওয়া-পরার মতো কাজ জুটিয়ে দেবে বলো, তাহলেও ম্যানেজারকে বাতিল করে তোমার দিকেই যেতে হবে।
হাসছে না। কিন্তু ঠোঁটে হাসি টসটস করছে। মুখের কথার সাদা অর্থ, মেমসায়েবকে বলে দেবার ভয়ে তার দিকে না গেলে নয়। কিন্তু রসের অর্থটুকু কান গরম হবার মতো। হচ্ছেও। নিজেকে সজাগ শাসনে রাখার তাড়নায় বাপী দু’চোখে বিরক্তির উষ্ণ ঝাপটা মেরে সোজা ফিরে চলল। মেয়েটা তাইতেই হকচকিয়ে গেছে একটু। দাঁড়িয়ে পিছন থেকে দেখছে আঁচ করেই বাপী আর ফিরে তাকালো না।
ঠাণ্ডা মাথায় এবারে কিছু চিন্তা করার আছে। কর্ত্রীর সম্পূর্ণ সায় ভিন্ন রণজিৎ চালিহা কোমর বেঁধে এই ফয়সলায় নামত না। আজ হোক বা দু’মাস পরে হোক, আবুকে ছেঁটে দিলে বাপীর বুকের খানিকটা খালি হয়ে যাবে তাই নয়, জোরের দিকটাও টান পড়বেই। এই বিশ্বস্ত লোকটাকে সরালে রণজিৎ চালিহার হাত আরো জোরদার হবে, গায়ত্রী রাইয়ের সেটা বোঝার মন নয় এখন।…তাঁর মেয়েই বা শেষ পর্যন্ত কি করবে! আবু বা রেশমাকে সরিয়ে দিয়ে তার মা মেয়েকে ঠেকাতে পারবে? কেউ কখনো পেরেছে? বাবার চাবুকে চাবুকে পিঠের চামড়া ফেটে চৌচির হয়েছিল, ক্ষতবিক্ষত মুখের সেই গা ঘুলনো রক্তের স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে। কিন্তু এক মেয়েকে মন থেকে সরানো গেছে না এতটুকু নড়ানো গেছে?
ঊর্মিলার মতি-গতি বোঝা গেছে। তার মা-ই তাকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। বাপীর ওই পাঞ্জাবী ছেলেটাকে জানতে বুঝতে বাকি। হতে পারে প্রেমে হাবুডুবু দশা তারও। আবার রাজকন্যার থেকে রাজত্বের লোভটাও বড় হওয়া বিচিত্র নয়। যাই-ই হোক, ওদের বিয়েটা হয়ে গেলে গায়ত্রী রাই রেশমা বা আবুর মতো একমাত্র মেয়ে আর জামাইকেও ছেঁটে দেবে? তা হতে পারে না। কখনো হয় না। বরং অর্থের জোরে সামর্থ্যের জোরে আর সব থেকে বেশি নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে মহিলা তাদের আরো কাছেই টেনে নেবে।…তারপর?
সদ্য বিপাকের ধোঁয়ার কুণ্ডলি থেকে তার পরের চিত্রটাই আগে স্পষ্ট করে দেখে নেওয়া বা বুঝে নেওয়া দরকার মনে হল বাপীর।
—আগে বাঢ়। মিল যায়গা!
নাঙ্গা ফকির-টকির নয়, আশ্বাসের গমগমে স্বরটা অনিবার্য ঘোষণার মতো নিজের ভিতর থেকে তখন-তখন ঠেলে ওঠে। যা-ই হোক বা যা-ই ঘটুক বাপী আর বিচলিত নয়। বৃত্ত-বদল আবারও হতে পারে, কিন্তু তাকে আর পুরনো বৃত্তে ফিরতে হবে না। এগোতে হবে। খুঁজতে হবে। পেতে হবে। এটুকুই স্বতঃসিদ্ধ।
মিরিক খুব দূরের পথ নয়। পরদিন বাপী বেলাবেলি সেখানকার চা-বাগানের কারখানায় পৌঁছুলো। বিজয় মেহেরার হদিস পেতে সময় লাগল না। বেয়ারার হাতে স্লিপ পাঠালো। শুধু লিখল, বাপী তরফদার, ফ্রম বানারজুলি।
স্লিপটা হাতে করে লোকটা নিজেই হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বিস্মিত। কিছুটা সন্দিগ্ধ। জঙ্গলে খানিকটা দূর থেকে দেখেছিল। সামনা-সামনি আরো সুশ্রী মনে হল। সপ্রতিভ গাম্ভীর্যে তাকালো—ইয়েস?
অনর্থক দুটো শব্দ খরচ করল বাপী।—বিজয় মেহেরা?
মাথা নেড়ে সায় দিল।
ওর ঘরে আরো দুটো টেবিলে দু’জন অফিসার বসে আছে বাপী আগেই লক্ষ্য করেছে। স্লিপের নাম দেখেই হয়তো ভিতরে না ডেকে নিজে বাইরে চলে এসেছে। ইংরেজিতেই বলল, কিছু কথা ছিল, শোনার সময় হবে?
মুখের দিকে আর এক পলক তাকিয়ে সামনে পা বাড়ালো। বাইরে শেডের নিচে একটা নিরিবিলি বসার জায়গায় নিয়ে এলো।—সীট ডাউন প্লীজ। নিজে মুখোমুখি বসল।
বাপীর মতো অতটা লম্বা না হলেও সমবয়সীই হবে। কিন্তু বাপীর নির্লিপ্ত মুখের হাব-ভাব বয়স্ক জনের মতো। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, বাংলা বোঝো?
—থোরাসে। স্পিক ইন ইংলিশ অর হিন্দী।
সঙ্গে সঙ্গে বাপীর মনে সংশয়ের আঁচড় পড়ল একটু। ঊর্মিলা পাঞ্জাবী ভাষা শিখে ফেলে নি নিশ্চয়। বাংলাই মাতৃভাষার মতো। ইংরেজি বা হিন্দী গড়গড় করে বলতে পারলেও ওতে প্রেম কতটা জমাট বাঁধতে পারে, ধারণা নেই।
হিন্দী বাপী ভালো বলে। লোকটাকে কিছুটা অন্তরঙ্গ আলোচনায় টেনে আনার মতলবে হিন্দীতেই শুরু করল, আমাকে চেনো?
সতর্ক চাউনি। মাথা নাড়ল। চেনে।
কি করে চেনো?
—ডলি বলেছে। জঙ্গলেও দেখেছি।
একটু স্বস্তি বোধ করল। এই লোকের কাছেও ঊর্মিলা তাহলে ডলি।——কি বলেছে। ঘাবড়াবার মতো কিছু?
চোখে চোখ। না বুঝে কোনো ফাঁদে পা দিতে রাজি নয়।—আমি ঘাবড়াবার ছেলে না। আমার সঙ্গে কি দরকার?
ভাবালু প্রেমিকের মতো লাগছে না বাপীর। রয়ে-সয়ে বলল, এর মধ্যে কিছু অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটে গেছে, তুমি খবর রাখো?
—সো হোয়াট? গলার স্বরে স্পষ্ট ঝাঁঝ।
বানারহাটের দুঃসংবাদ এখানে পৌঁছে গেছে বোঝা গেল। বাপী জবাব দিল, এমন কিছু নয়, দুটো নির্দোষ লোকের কাজ চলে যাচ্ছে, একজন আবু রব্বানী আর একজন রেশমা। চেনো?
ভুরু কুঁচকে থমকে রইল একটু।—ডোন্ট গেট দি ম্যান। সে কি করেছে?
—ঊর্মিলার বানারহাটে বেড়াতে যাওয়ার হাতি ঠিক করে দিয়েছিল।
ফর্সা মুখ রাগে লাল হতে লাগল।—কিন্তু এই করে কি হবে? ডলির মা বরাবর তাকে আগলে রাখতে পারবেন না আমাকে ঠেকাতে পারবেন? ক্যান সি স্টপ ইট্?
—পারবেনই না বলছ…?
—সারটেনলি নট! বলে উঠেই থমকালো। ঝাঁঝালো সতর্ক চাউনি।—মিসেস রাই তোমাকে এ-কথা বলার জন্য পাঠিয়েছেন?
—আমি এখানে এসেছি মিসেস রাই জানেন না। আমি তোমাদের অ্যাফেয়ার জানি বলেও তাঁর ধারণা নেই।
এবারে ক্ষোভের মুখেই বিজয় মেহেরা উৎসুক একটু।—ডলি পাঠিয়েছে?
—তোমাদের এই বিভ্রাটের সময় আমি বানারজুলিতে ছিলাম না। এখন পর্যন্ত মা-মেয়ে কারো সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তবে ডলি জানলে খুশি হবে। এই গোলযোগে না পড়লে সে-ই তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিত মনে হয়। এতদিন মুখে সে আমাকে ফ্রেন্ড বলত, ইদানীং ফ্রেন্ড ভাবছে।
বিজয় মেহেরা অনেকটা ঠাণ্ডা। বুকপকেটে দামী সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই উঁচিয়ে ছিল। সে দুটো বার করে প্যাকেট আধখানা খুলে সামনে ধরল। বাপী মাথা নাড়তে একটা সিগারেট বার করে ধরালো। ডান হাতের তিনটে ফর্সা আঙুল সিগারেটের ধোঁয়ায় আর কষে বাদামী হয়ে গেছে। মদ ছেড়ে ওই আঙুল দেখলেও গায়ত্রী রাইয়ের মেজাজ বিগড়বে সন্দেহ নাই।
ধোঁয়া ছেড়ে বিজয় মেহেরা বলল, বানারহাটে ডলি এবারে বিশেষ করে তোমার কথা বলেছিল। বাট আই কুড্ বি ভেরি শিওর। ক্যান ইউ রিয়েলি হেল্প আস?
—কি রকম?
—বাইরে চলে যাওয়ার আগে আমি বিয়েটা করে যেতে চাই। ডলি রাজি হচ্ছে না। ও খুব ভালো কিন্তু এ ব্যাপারে বড় নার্ভাস।
সঙ্গে সঙ্গে বাপীর দু’ কান খাড়া। এ আবার বলে কি! —বাইরে কোথায় যাচ্ছ?
—ডলি বলেনি?
—প্রায় এক মাস আমি বানারজুলিতে ছিলাম না বললাম তো।
এরপর যা শুনল, অপ্রত্যাশিত বটে। সামনের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে দু—আড়াই বছরের জন্যে সে লন্ডন চলে যাচ্ছে। অনেক বড় আশা আকাঙ্ক্ষা তার। এখানে এই চা-বাগানে পড়ে থাকার ইচ্ছে কোনদিনও ছিল না। ডলির কাছে বাঁধা না পড়লে এখান থেকে অন্তত কবেই চলে যেত। এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার আগে থেকেই বাইরের ট্রেনিং আর বাইরের ডিগ্রির স্বপ্ন দেখে এসেছে। অনেক চেষ্টা আর তদ্বির-তদারকের পরে সুযোগ মিলেছে। বাইরের এক ফার্মে মোটামুটি কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। পড়ার ব্যবস্থাও। এখন সমস্যা ডলি আর তার মা! ওই মাকে জব্দ করার জন্যেই বিয়েটা চুকিয়ে ফেলে রওনা হবার ইচ্ছে তার। টের পেলে কি করবে? তাড়িয়ে দেবে? মেহেরা পরোয়া করে না? তার বাবা মা এ বিয়েতে সানন্দে রাজি। ছেলে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে তাতে আপত্তির কি থাকতে পারে? ডলির ফোটো দেখেই কত খুশি তারা। তাড়িয়ে দিলে ডলিকে বড় জোর অমৃতসরে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে হবে। তারা আদর করে রাখবে। ব্যবস্থা যা করার মেহেরা করেই যাবে। কিন্তু ডলির অত সাহস নেই। বানারহাটে এবারে সে এ নিয়ে কম বকাঝকি করেনি, দু’জনার দস্তুরমতো মনকষাকষি পর্যন্ত হয়ে গেছে! ডলির এত ভয় পাবার কি আছে মেহেরা ভেবে পায় না।
বাপী চুপচাপ শুনছিল। আর সোজা মুখের দিকে চেয়েছিল! এখন কিছুটা ছেলেমানুষের মতো লাগছে ওকে। বাপীর বুকের তলার ঝড় কেউ কখনো টের পায়নি। এ-ছেলের থেকে সে অনেক বেশি পোড়-খাওয়া মানুষ।
আবার একটা সিগারেট ধরালো বিজয় মেহেরা। কিছু অনুকূল মতামত বা মন্তব্য শোনার আশায় উন্মুখ। এরই ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে যেন।
বাপী আশার কথা শোনাতে আসেনি। আশ্বাস দিতেও না। নিজে সে কোন ভবিষ্যতের দিকে পা ফেলবে স্থির করার তাগিদে আসা। যতটুকু শুনল, আশাপ্রদ বটে। তবু এটুকুই সব নয়। কোনরকম ভনিতা না করে বলল, এত সব আমি জানতাম না, কিন্তু বড় ভালো লাগল। ডলিও ভাবছে আমি হয়তো সাহায্য করতে পারব, কিন্তু তার মাকে তার থেকে ভালো আর কে জানে। সে যাক, এ বিয়ের নামে মিসেস রাই এমন ক্ষিপ্ত কেন ভেবে না পেয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চলে এসেছিলাম।
—ক্ষিপ্ত হবেন না! বিজয় মেহেরা ঝাঁঝিয়ে উঠল, তাঁর এত টাকা, এতবড় ব্যবসা, এত ক্ষমতা—তিনি শুধু মেয়ের জন্য ঘরে একটি স্বামী পুষতে চান। তাঁর মেয়ে এত ঠুনকো হলে আমার দিকে ঘেঁষত না এ তিনি বুঝতেও চান না, বরদাস্তও করতে চান না।
ছেলের মেজাজ আছে। বাপী অখুশী নয়। নিরীহ মুখে একটু অপ্রিয় উক্তিই করল এবার।—তিনি হয়তো ভাবছেন অত টাকা আর বড় ব্যবসা দেখেই তুমি তাঁর সরল মেয়েটাকে কলে ফেলেছ।
কি! সন্দেহের কথাগুলো গুঁড়িয়ে দেবার মতো করে প্রায় আস্ত সিগারেটটাকে জুতোর তলায় ফেলে পিষল।—ভাববেন না কেন? টাকা ছাড়া আর কি দেখছেন তিনি? কটা মানুষ দেখেছেন? বিলেত থেকে হায়ার ডিগ্রি আর ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসার পর তাঁর এই কাঁচকলার ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকব আমি—না তাঁর টাকার পরোয়া করার দরকার হবে? এ ব্যাপারে তাঁর মেয়ের সঙ্গেই আমার সাফসুফ কথা হয়ে গেছে, তুমি জেনে নিতে পারো। মেয়ের বিয়ে দিয়ে টাকা আর ব্যবসা আগলে তিনি বসে থাকুন—
বাপী অবিশ্বাস করছে না। মেয়েকেও জিগ্যেস করার দরকার নেই। বাংলোর সেই একদিনের কথা মনে আছে। মেয়ে ঠেস দিয়ে বলেছিল মা তাকে চটপট শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর মতলবে আছে, আর মা হালকা মেজাজে জবাব দিয়েছিল, সে-চিন্তা তাকে করতে হবে না, বিয়ে যে করবে তাকেই এসে শ্বশুরবাড়ি থাকতে হবে। শোনামাত্র মেয়ে ফোঁস করে উঠেছিল, আই উইল নেভার এগ্রি–দ্যাট পারসন মাস্ট বি এ ভেড়ামার্কা সামবডি!
বড় করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাপী উঠে দাঁড়াল।—আচ্ছা মেহেরা, তোমার অনেকটা সময় নিয়ে ফেললাম, কিন্তু আলাপ করে খুব ভালো লাগল। কি করতে পারব জানি না, আই অ্যাম অলমোস্ট এ নো-বডি—শুধু বলতে পারি, ডলি ডিজারভস্ কংগ্র্যাচুলেশনস, তার যাচাই বাছাইয়ের চোখ আছে।
—থ্যাঙ্কস। খুশি হলেও সমস্যার দরিয়ায় ডাঙা খোঁজার মুখ।—কিন্তু তোমার কি মনে হয়, যাবার আগে বিয়েটা হতেই পারে না?
বাপীর আলতো চাউনি তার মুখের ওপর পড়ে থাকল একটু।—ডলিকে তুমি অবিশ্বাস করো?
—কক্ষনো না! বাইরে থেকে ঘুরে এলেই বিয়েটা হবে আগে ঠিক ছিল। কিন্তু ওর মায়ের এমন গোঁ দেখে আমারও গোঁ চেপেছে।
—কিন্তু বিয়েটা গোঁয়ের ব্যাপার নয়। এক্ষুনি এ চেষ্টা করতে গেলে ডলিকেই তুমি সব থেকে অসুবিধের মধ্যে ফেলবে। চুপচাপ চলে যাও, বড় হয়ে এসো—মেয়ের মন বুঝে ওই মা-ই তখন এগিয়ে আসবে হয়তো।
নীরস স্বরে বিজয় মেহেরা মন্তব্য করল, ওই মাকে তোমার এখনো চিনতে বাকি আছে।
পা বাড়িয়েও বাপী আর একটু সুড়সুড়ি দেবার লোভ সামলাতে পারল না।— বাই দি বাই, সিগারেটের ধোঁয়ায় আর কষে হাতের আঙুলগুলো তো বেশ লাল করে ফেলেছ—ড্রিঙ্কস্ কেমন চলে? ফ্র্যাঙ্কলি জিগ্যেস করলাম, কারণ জিনিসটা মিসেস রাইয়ের কাছে প্রায় ট্যাবু গোছের…
পিত্তি জ্বালার মতো বিরক্ত মুখ।—আমার নামে এ নালিশও গেছে ডলি আমাকে বলেছে। ট্যাবুর চোরাই কারবার চালাচ্ছে সে-বেলায় লজ্জা করে না? ছেলেমানুষি রাগ দেখেই যেন হাসি পাচ্ছে বাপীর।—তা বলে সব ময়রা কি আর মিষ্টি পছন্দ করে?
তাঁর পছন্দ-অপছন্দের আমি ধার ধারি না। ইট ইজ্ন্ট এনি গুড ফর হেলথ আই নো,–দ্যাটস অল। ইচ্ছে হলে খাই, ইচ্ছে না হলে খাই না। তার জন্যে কারো কাছে আমি দাসখত লিখে দিতে যাব না।
ভবিষ্যতের চিত্র অনেকটাই আঁচ করা যাচ্ছে। পায়ের নিচের মাটি আরো শক্তপোক্ত ঠেকছে। গায়ত্রী রাই এই ছেলেকে ঘরজামাই করে আটকে রাখতে পারবে না। যেমন চায়, টাকার গরমে তেমন বশেও রাখতে পারবে না। ছেলেটার মনের জোর আছে। পুরুষের গোঁ-ও কম নয়। বাপী এমনটা দেখবে আদৌ ভাবেনি।
তবু বুকের তলায় কোথায় একটু চিনচিনে যন্ত্রণার মতো। টের পাওয়া মাত্র নিজেকেই চাবুক কষাবার আক্রোশ। ভালবাসার নিখাদ ছবি দেখে ভিতরে কেউ যদি মাথা খোঁড়ে, তবে সেই মাথাটা বুঝি একেবারে গুঁড়িয়েই দেবে বাপী। দেউলেপনা বরদাস্ত করবে না।
.
একে একে পাঁচ-ছ’দিন কেটে গেল। নভেম্বরের শুরু এটা। শীত এসে গেল। জঙ্গলের সবুজে শুকনো টান ধরেছে। ধূসর গৈরিকের পলেস্তারা পড়ছে। ছেলেবেলায়ও শীতের এই কটা মাস বাপীর ভালো লাগত না। চেঁচিয়ে বলত, শীত বুড়ী থুথুড়ি, যা না—পালা না! শীত মানেই ঠান্ডার গহ্বরে সেঁধিয়ে থেমে যাওয়া। সেই ছেলেবেলার মতোই ভেতরটা অসহিষ্ণু বাপীর। কেউ যেন জোর করে থামিয়ে দিয়েছে তাকে। সামনে এগোনোর পথ আগলে একটা অদৃশ্য দেয়াল গজিয়ে উঠেছে। সকলকে ছেড়ে শুধু সে-ই যেন কে অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি বসে আছে।
চুপচাপ আপিসে যায়। চুপচাপ ফিরে আসে। পারলে চালিহার সামনেও পড়তে চায় না। দেখা হলেই নতুন টিম-ওয়ার্কের প্ল্যান কদ্দুর জিগ্যেস করে। কোন্ কোন্ আইটেম এ-দিকের জঙ্গলে ফলানো যায় তার একটা খসড়া করে রেঞ্জ অফিসারের সঙ্গে দেখা করার তাগিদ দেয়। ফলে সে আসার আগেই বাপী এখন অ্যাকাউন্টেন্টকে জানান দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কাছাকাছি পার্টিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। চালিহা বেরিয়ে পড়ার পর ফেরে।
পাশের শূন্য বাংলোর দিকে তাকালে চোখ দুটো কটকট করে। মেয়ে নিয়ে ঠিক কোথায় গা-ঢাকা দিয়ে আছে মহিলা জানতে পারলে কপাল ঠুকে চলেই যেত। অসুবিধে তো হচ্ছেই। দূরের পার্টিদের সঙ্গে যোগাযোগর বরাদ্দ ভ্যানের চালান বন্ধ। পাহাড়ের বাংলোয় বেরুনোর আগে গোটা মাসের চালান দিয়ে গেছল মাস শেষ, ভ্যান নেই—এখন কি করবে? কিন্তু কপাল ঠুকে গিয়ে উপস্থিত হওয়ার তাগিদ ভিন্ন কারণে। তার ধারণা, মুখোমুখি হলে বাধার অদৃশ্য পাঁচিলটা ভেঙে দিতে পারবে আর ওই মা-মেয়েকেও ফিরিয়ে আনতে পারবে।
কর্ত্রী এখানে নেই জেনেও আবু রব্বানী একটিবার এদিকে আসেনি। বিনা দোষে অপরাধের বোঝা কাঁধে চালানো হয়েছে, ক্ষুণ্ণ হবারই কথা। কিন্তু বাপীর কাছেও না আসার বোধ হয় ভিন্ন কারণ। ম্যানেজারের মেজাজ তার ওপরে বেশী গরম শুনেছে কিন্তু ম্যানেজারের মতলব কি বাপী বলেনি। ওদের মেমসায়েবের রাগ তো বোঝাই যাচ্ছে। আজ হোক, দু’দিন বাদে হোক হেস্তনেস্ত কিছু হবেই। চাকরির দায়ে বাপীও তখন ম্যানেজার আর মেমসায়েবের সঙ্গে হাত মেলাবে ধরে নিয়েছে। ওকেও তাই এখন আর বুকের কাছের একজন ভাবতে পারছে না।
সকাল তখন সাতটাও নয়। চা-টা খেয়ে বাপী একটা বই নিয়ে বারান্দায় বসেছিল। গায়ত্রী রাইয়ের ভ্যান তার ফটকের সামনে এসে থামল। বই ফেলে বাপী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।
ভ্যান থেকে নামল আধবয়সী পাহাড়ী ড্রাইভার বাদশা। আর কেউ নেই।
সেলাম ঠুকে ড্রাইভার জানালো, মেমসায়েব পাঠিয়েছে। যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে বাপী জেনে নিল। পাহাড়ের বাংলোয়। মেমসায়েব সেখানে আছে।
পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর নতুন কেনা বুকখোলা স্লিপওভারটা চড়িয়ে দশ মিনিটের মধ্যে বাপী বেরিয়ে পড়ল। কোটপ্যান্টের টাকা হাতে পেয়েছে কিন্তু শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং গিয়ে এখন পর্যন্ত সে সব করানোর ফুরসত হয়নি। রাতের ঠাণ্ডায় এই পোশাকে কুলোবে না। কিন্তু আন্দাজে কত আর গায়ে চড়াবে।
সকাল আটটার মধ্যেই বাংলোর পাহাড়ের গোড়ায় এসে গেল। কিন্তু চড়াইয়ের রাস্তা ধরার আগেই বাদশা ভ্যান থামালো। গজ বিশ-বাইশ দূরে ঊর্মিলা রাই। পাশে ঝগড়ু। তারা পাহাড় থেকে নেমে আসছে। ঊর্মিলাই হাত তুলে ড্রাইভারকে থামতে ইশারা করেছে।
কাছে এলো। বাপীকে দেখে ঝগড়ুর একমুখ হাসি। এত শিগগীর আবার বাবুটির সঙ্গে দেখা হবে ভাবেনি। ঊর্মিলার পরনে পাহাড়ী মেয়েদের মতো চকমকে ঘাগরা, গায়ে আধাগরম আঁটা জামা। শীতের ছোঁয়ায় লালচে গাল, ছোট মেয়ের মতোই ফোলা ফোলা রাগ-রাগ মুখ। কিন্তু বাপীর মনে হল ওকে দেখে ভিতরে ভিতরে খুশিও একটু।
ড্রাইভার বাদশা ভেবেছে মিসিসায়েব আর ঝগড়ু ভ্যানে উঠবে। বাপীও সেই অপেক্ষায় বসেই আছে। তার দিকে চেয়ে ঊর্মিলা ধমকের সুরে বলে উঠল, কি হল—নামো?
বাপী বলল, আমি নামব না তুমি উঠবে?
—তুমি নামবে। ঝগড়ু উঠবে।
—এ ঊর্মি! ঝগড়ুর তখনি আপত্তি। মালকান গোঁসা হোবেন।
তার দিকে ফিরে ঊর্মিলা অসহিষ্ণু ভেঙচি কেটে উঠল।—মালকান গোঁসা হোবেন তো তুমি ওপরে গিয়ে মূর্ছো যাও! বাপীর দিকে ফিরল, নেমে এসো বলছি!
অগত্যা বাপী নেমেই এলো। চোখ পিটপিট করে ঝগড়ু বলল, মালকানের মেজাজ গরম আছে বাপীভাই, খবরদার দেরি কোরো না—
ঊর্মিলা তেড়ে যেতে সে চটপট ভ্যানে উঠে পড়ল।
পায়ে হেঁটে লাল কাঁকরের চড়াইয়ের পথ ভাঙতে কম করে পঁচিশ মিনিট লাগে। আস্তে হাঁটলে আরো বেশি। ঊর্মিলার এতটুকু তাড়া আছে মনে হল না। ঢিমেতালে পা বাড়ালো।
বাপী বলল, ভ্যানে উঠে গিয়ে আগে তোমার মায়ের সঙ্গে দেখাটা করে নিলেই হত, এরপর আমাকেও হয়তো আবু আর রেশমার দলে ফেলবেন তিনি। ঊর্মিলা থমকে দাঁড়িয়ে চোখ পাকালো।—মায়ের সঙ্গে আগে দেখা করার জন্যে তোমার আসার সময় ধরে আমি নেমে এসেছি?
—ও…! বাপী হেসে ফেলল, ঠিক আছে চলো—
—যাব না, এইখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে তোমাকে আরো দেরি করাবো। বাপীর ভালো লাগছে। এই কটা দিন যেন মরু-বাসে ছিল। মা ছেড়ে মেয়েরও মেজাজ গরম, কিন্তু এই পোশাকে আগের থেকেও তরতাজা লাগছে বাপীর। হাতজোড় করে বলল, ঘাট হয়েছে দেবী, আর বিপাকে ফেলো না— চলো।
হাসতে-মানা মুখ করে ঊর্মিলা আবার সামনে পা বাড়ালো। আজ কেন যেন বন্ধুর মতোই অনায়াসে একটা হাত ওর কাঁধের ওপর রাখতে পারল বাপী। এটুকু অন্তরঙ্গ হতে ঊর্মিলার দিক থেকেও আপত্তির লেশমাত্র নেই। কিন্তু আপাতত মন পড়ে আছে অন্যদিকে।
—আবু আর রেশমার কি শাস্তির ব্যবস্থা হল?
—হয়নি এখনো। তোড়জোড় চলছে।
রাগে মুখ লাল।—ওদের কোনো দোষ নেই, আমার জন্য শুধুমুদু ওদের শাস্তি হবে কেন? আর তুমিই বা তা বরদাস্ত করবে কেন?
—আমি কারো দণ্ডমুণ্ডের মালিক নই।…তাছাড়া একেবারে দোষ নেই বলতে পারো না—চক্রান্তকারীর সঙ্গে থাকাটাই দোষের।
দেখো, রাগিও না বলছি! এই করে কেউ আমাকে রুখতে পারবে ভেবেছ! …এমনি তেতে উঠে বিজয় মেহেরাও একই কথা বলেছিল মনে আছে। তেমনি ঝাঁঝের মুখে ঊর্মিলা আবার জানান দিল, রেশমাকে আমি বলে এসেছি, শাস্তি যদি হয় তো তার খেসারত আমি দেব। কিন্তু কেন হবে শাস্তি? তোমার— বাধা দিতে এত কি ভয়? মনে পড়ল কিছু।—তোমার কিচ্ছু ভয় নেই, বুঝলে? এতদিন একলা এই পাহাড়ের বাংলোয় কাটিয়ে মায়ের মন তুমি আরো কত কেড়ে ফেলেছ জানো না–ঝগড়ু বার বার করে মাকে শুনিয়েছে, ঠিক আমার বাবার মতোই কাজের ঝোঁক আর বই পড়ে শেখার ঝোঁক তোমার—নাওয়া—খাওয়া জ্ঞান থাকে না। মন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে না থাকলে শুধু এই জন্যেই তোমার আর এক দফা মাইনে বেড়ে যেত—
বিরস মুখ করে বাপী বলল, তুমি তাহলে শুধু আবু আর রেশমার ক্ষতি করোনি, আমারও করেছ—
—বাজে বোকো না! সত্যি কারো ক্ষতি হলে মাকে আরো বেশি পস্তাতে হবে জেনে রেখো!
—বুঝলাম। তোমরা কবে এসেছ এখানে?
—পরশু।
—তোমার মা আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন কেন?
—জানি না। সেই থেকে মায়ের সঙ্গে আমার কথা বন্ধ। মা বন্ধ করেনি, আমি করেছি।
বাপী মন্তব্য করল, বড় ঠাণ্ডা মেয়ে।
তেমনি ঝাঁঝের মুখে এরপর এ ক’দিনের সমাচার শোনালো ঊর্মিলা … ওকে আর কোয়েলাকে নিয়ে শিলিগুড়ির এক বড় হোটেলে গিয়ে ওঠা হয়েছিল। সেখানে গিয়ে মা বড় বড় দুটো ইংরেজি কাগজের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আঙ্কল চালিহাও তখন মায়ের সঙ্গে ছিল। দু’জনে শলাপরামর্শ করে উত্তর ভারতের সেই দুটো নামী কাগজে এই এজেন্টদের মারফৎ ঊর্মিলার জন্য পাত্রের খোঁজে চটকদার বিজ্ঞাপন পাঠিয়েছে। পাঁচ ছ’দিনের মধ্যে দুটো কাগজে সেই বিজ্ঞাপন ছেপে বেরিয়েছে। তিন-চারখানা করে সেই দুটো কাগজ কেনা হতে ঊর্মিলার সন্দেহ হয়েছিল, মা তাকে বলে নি। সেই দু’ কাগজের বিজ্ঞাপন নিজেই বার করে পড়েছে। ভেঙচে ভেঙচে বিজ্ঞাপনের সার জানালো ঊর্মিলা।…মস্ত বিজনেস অধীশ্বরীর একমাত্র মেয়ে। মেয়ে রূপসী বিদুষী গুণবতী কলাবতী। (ব্যঙ্গোক্তি একেবারে যেন আকাশের চাঁদ খসে নেমে এসেছে) চব্বিশ—পঁচিশের মধ্যে ভালো ঘরের সুশ্রী উচ্চশিক্ষিত সুস্বাস্থ্য পাত্র পাই। জাত-বিচার নেই তবে নেপাল বা ভুটানের ছেলে হলে ভালো হয়। ছেলের ব্যবসার অভিজ্ঞতা বা ব্যবসার দিকে ঝোঁক থাকা চাই। বিয়ের পর ছ’মাস এক বছরের জন্য বিদেশে বেড়ানোর যাবতীয় খরচ মেয়ের মায়ের। বিয়ের প্রধান শর্ত, ব্যবসায় সাহায্যের প্রয়োজন ছেলেকে বরাবর মেয়ের ঘরে এসে থাকতে হবে।…এদিকে ছেলেগুলো যে এত হ্যাংলা ঊর্মিলার ধারণা ছিল না। তিনদিন না যেতে সেই এজেন্টদের মারফৎ হোটেলে গাদা গাদা চিঠি! সবাই বিয়ে করতে চায়, সবাই ঘরজামাই হয়ে থাকতে চায়। অবশ্য তার আগে একবার চোখের দেখা হিসেবে মেয়েও সবাই দেখতে চায়। এ-রকম তিনপাঁজা চিঠি নিয়ে ওর মা আরো চিঠির প্রত্যাশায় ওই এজেন্টদের এই পাহাড়ের বাংলোর ঠিকানা দিয়ে এখানে এসে বসেছে।
ঊর্মিলা সাফ জানিয়ে দিয়েছিল আসবে না। পাহাড়ের শীত তার ভালো লাগে না। বানারজুলিতে থাকবে। জবাবে মা জানিয়েছে, বেশি শীতে পাহাড় থেকে নেমে আসা হবে। এখন তার শরীর অসুস্থ স্বাস্থ্যের জন্যেই কিছুদিন পাহাড়ের নিরিবিলিতে থাকা দরকার। অসুস্থ না ছাই। ঊর্মিলার বুঝতে বাকি নেই তাকে ভোলানোর জন্যেই শিলিগুড়ির বড় হার্ট স্পেশালিস্ট ডেকে নিজেকে দেখানো হয়েছে। মায়ের যা হার্ট! স্পেশালিস্ট তা খুঁজে পেয়েছে কিনা মেয়ের সন্দেহ। এখন মায়ের শুধু কাজ নাকে চশমা এঁটে ওই হ্যাংলা হবু জামাইয়ের চিঠি যাচাই—বাছাই করা আর খাওয়া আর শুয়ে থাকা। ওকে দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছে। ওষুধ খাচ্ছে কি জল খাচ্ছে কে জানে। তবে ঊর্মিলার একটু ভরসা, অত চিঠির গাদা থেকে এখন পর্যন্ত তিনটে চিঠি মাত্র আলাদা করে রাখা হয়েছে, তাও খুব পছন্দ হয়েছে বলে মনে হয় না—হলেও ঊর্মিলা পরোয়া করে না। সব চিঠির গাদা উনুনে দেবার ফাঁক খুঁজছে
আগেভাগে পাহাড় থেকে নেমে আসার উদ্দেশ্যও ব্যক্ত করল। বাপীর মারফৎ মায়ের সঙ্গে সোজাসুজি একটা পাকা বোঝাপড়া করার মতলব ঊর্মিলার। সামনের বছরের গোড়া থেকে ও আবার পড়াশুনা শুরু করবে। দু’বছর প্রায় কেটেই গেছে, আর দুটো বছর পড়ে বি.এ. পরীক্ষা দেবে। মায়ের কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই, কলেজে পড়বে না, হোস্টেলেও থাকবে না—বাড়িতে মায়ের কাছেই থেকে প্রাইভেট বি.এ. পরীক্ষা দেবে। পড়াশুনা শুরু করার পর থেকে মাকে না জানিয়ে কোথাও যাবে না কারো সঙ্গে দেখাও করবে না। তার বদলে মাকে কথা দিতে হবে, বি.এ. পরীক্ষা আর তার রেজাল্ট বেরুনো পর্যন্ত, অর্থাৎ দুটো-আড়াইটে বছর তার বিয়ের নামও মুখে আনবে না। তারপর যা হয় হবে। কিন্তু এখন মায়ের যা মতলব তা যদি না ছাড়ে তাহলে আর ওকে ঘরে রাখতে পারবে না—পারবেই না।
মেয়ে চতুর বটে। মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে সময় কাটিয়ে দেবার রাস্তাটা মন্দ বার করেনি। সাদা মুখ করে বাপী জিগ্যেস করল, দু’আড়াই বছর বাদে মা যেখানে বিয়ে ঠিক করবেন নির্ঝঞ্ঝাটে সেখানেই বিয়েটা করে ফেলবে সে কথাও দিচ্ছ?
ঝাপটা মেরে জবাব দিল, আমি তা বলিনি, সে যখনকার কথা তখন দেখা যাবে—আমি বলেছি এই দু’আড়াই বছর বিয়ের কোনো কথাই হবে না।
—বেশ। তোমার মা না তুললে এসব কথা আমি নিজে থেকে তুলব?
—মা বেশ ভালো করেই জানে তোমার মতো ঝানু ছেলের জানতে কিছু বাকি নেই—বিশেষ করে এবারে এ ব্যাপারটার পর। তুমি ফাঁকতালে কথাটা তুলবে, আমিই তোমাকে এই বলছি বলবে।
—দেখা যাক। হাসল, মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ানোর আগেই কাঁপুনি ধরিয়ে দিলে দেখছি।
কথায় কথায় অনেকটাই উঠে এসেছে। সামনের ওই উঁচু বাঁকটা ঘুরলেই রাস্তা শেষ। সামনে বাংলোর গেট। কি ভেবে বাপী জিগ্যেস করল, তোমার আঙ্কলের খবর কি?
—কেন, বানারজুলিতে নেই?
—আছেন। এখানে আসেন?
—শিলিগুড়িতে একদিন পরে-পরেই আসত। এখানে পরশু এসেছি—পরশুই এসেছিল একবার!
—ব্যবসার অভিজ্ঞতা বা ব্যবসার ঝোঁক থাকা পাত্রর জন্য বিজ্ঞাপনও কি তাঁর পরামর্শে দেওয়া হয়েছিল?
ঊর্মিলা ঠোঁট উল্টে দিল।—কাগজে দেবার আগে বিজ্ঞাপনের কথা জানতামই না। তক্ষুনি কি মনে পড়তে চলতে চলতেই ঘুরে তাকালো।—ভালো কথা মনে করেছ। স্পাই লাগিয়ে ওই আঙ্কলই বানারহাটের ব্যাপার মায়ের কাছে ফাঁস করেছে, এদিকে আমার সঙ্গে ভারী দরদী মানুষের মতো কথাবার্তা। শিলিগুড়িতে সেদিন আমাকে চুপিচুপি বলছিল, মায়ের কথা মতোই আমার ওপর চোখ রাখা হয়েছিল, কিন্তু বিজয় মেহেরাকে আমার যখন এত পছন্দ তাকে সে খারাপ লোক বলে ভাবে না। এই রাগে মুখে মা-কে এখন কিছু বলা যাবে না—কিন্তু একটু ঠাণ্ডা হলে সে তার সাধ্যমতো মাকে বোঝাতে চেষ্টা করবে।…কি ব্যাপার বলো তো? ভাঁওতা দিয়ে আমাকে ভোলাবার মতলব?
—তা না-ও হতে পারে।
খবরটা শোনার পর বাপীর নিজের ভিতরেই একটা নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাপীর চিন্তার হিসেবে একটুও ভুল হয়নি। প্রথমেই আবু রব্বানীকে ছেঁটে দিতে চাওয়ার পিছনে রণজিৎ চালিহার পাকা-মাথার অঙ্কটা জল-ভাতের মতোই ধরা পড়েছে।
বাঁকটা ঘোরার আগেই ঊর্মিলার কাঁধ থেকে হাত নামালো। রাগ আর ভাবনা ভুলে ফাজিল মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল।—নামালে কেন? বেশ তো এইভাবেই মায়ের চোখের ওপর দিয়েই বাংলোয় ঢুকে যেতাম। তুমি আচ্ছা কাওয়ার্ড—
বাঁকটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর দু’চোখ বড় রকমের হোঁচট খেল একপ্রস্থ। ঊর্মিলারও মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।
বাংলোর গেটের বাইরে এসে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে গায়ত্রী রাই। পরনে পাড়-ছাড়া ধপধপে সাদা শাড়ি। গায়ে দুধ-সাদা গরম জামা। পায়ে সাদা চপ্পল।
সব মিলিয়ে সাদার ধাক্কা একখানা
হাত দশেকের মধ্যে এসে বাপী কি করবে বা কি বলবে ভেবে না পেয়ে দু’ হাত কপালে তুলে একটা নমস্কার সেরে ফেলল। কিন্তু সুফল কিছু হল না। জবাবে গায়ত্রী রাই সামান্য মাথাও নাড়ল না। উল্টে আলগা তোষামোদের চেষ্টা ভাবল বোধ হয়। আর দু’পা এগোতে ওই সাদা পাথুরে মুখ থেকে ঠাণ্ডা চাবুকের মতো কথা।—এক ঘণ্টা ধরে আড্ডা দেবার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে এখানে ডেকে আনা হয়েছে তোমাকে?
বাপী কি জবাব দেবে। বিপন্ন মুখে তার মেয়ের দিকে তাকালো শুধু। মায়ের সঙ্গে কথা বন্ধ বলেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে চোখেমুখে আগুন ছুটলো একপশলা।—তুমি কি আশা করেছিলে, আমি আটকাতে চাইলে তোমার তাঁবের এই বিশ্বাসী মানুষ আমাকে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়ে তোমার কাছে ছুটে চলে আসবে?
এক ঝটকায় মায়ের পাশ কাটালো। দুহাতের ধাক্কায় লোহার গেট দুটো দু’দিকে ছিটকে খুলে গেল। পায়ের তলার লাল কাঁকরের মাটি আছড়ে আছড়ে বাংলোর দিকে চলল।
বাপীর মনে হল, পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চলে আসার ঝাঁঝালো উক্তিটা মহিলার মুখের ওপর ঠাস করে গিয়ে লাগল। পলকের মধ্যে আবার যে-কে সেই। ঘুরে মেয়েকেই দেখছে। কঠিন, অপলক
ভিতরে পা বাড়ালো। পাশে দু’হাত ফারাকে বাপী। বাগানের ভেতর দিয়ে বাংলো পর্যন্ত লাল কাঁকরের পথটুকু খুব কম নয়। আধা-আধি এসে সামনের দিকে চোখ রেখেই গায়ত্রী রাই জিগ্যেস করল, আগেভাগে তোমাকে কি বলার জন্য নেমে গেছল?
গুরুত্ব না দেবার মতো করে বাপী জবাব দিল, বিশেষ কিছু না, হঠাৎ আমাকে দেখে ভ্যান থেকে টেনে নামিয়েছে মনে হল।
গায়ত্রী রাই এবারও তাকালো না তার দিকে। কিন্তু গলার স্বর আরো ঠাণ্ডা কঠিন।—হঠাৎ নয়। ও জানত তুমি আসছ। কি বলে…আমাকে গোপন করার মতো কিছু?
অধৈর্যের আঁচ পেয়েই বাপী তাড়াতাড়ি জানান দিল, তা না… রেশমা বা আবু রব্বানীর কোনো শাস্তি হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল, আর ওদের যে কোনো দোষ নেই সেটাই বোঝাতে চেষ্টা করল।
—তুমি বুঝলে কি হবে, তোমার কাজ করছে ওরা?
এই প্রসঙ্গের ফয়সলাই বাপীর কাছে সব থেকে বড় ব্যাপার। তবু হালকা করেই জবাব দিল, আপনার মেয়েকে বলেছি যে আমি ওদের দণ্ড-মুণ্ডের মালিক নই।
চুপচাপ একটু। তারপর আবার প্রশ্ন।
—শুধু এইজন্যেই নেমে গেছল, না আরো কিছু আছে?
—ওর বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজে আপনি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, কিরকম পাত্রের খোঁজ করছেন—এইসব বলছিল।…এইজন্যেই খুব রাগ মনে হল।
—রাগ করে কি করবে। বিয়ে ঠিক হলে বিয়ে করবে না?
—আমাকে বলতে বলেছে, আপনি এই চেষ্টায় এগোলে তাকে আর ঘরে রাখতে পারবেন না।
বাপী লক্ষ্য করল, রাগে সাদাটে মুখ আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এবারে ওর দিকে চোখ।—তোমাকে বলতে বলেছে? কেন বলেছে তুমি তাহলে জানো?
বাপী মাথা নেড়ে স্বীকার করল জানে। ভিতরে ভিতরে শঙ্কিত। মিথ্যের মধ্যে যেতে চায় না, কিন্তু কেমন করে জানে জিজ্ঞেস করলে আবুর নাম মুখেও আনা চলবে না। জিজ্ঞেস করল না। বানারহাটের ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেছে ধরে নিল হয়তো। হয়তো বা ভাবল মেয়ে নিজেই বলেছে।
সিঁড়িতে পা রেখে থামল।—বেশ, তুমিও তাহলে ওকে জানিয়ে দিও আমি বলেছি, আমার অবাধ্য হলে বা আমার অমতে বিয়ে করলেও ওকে ঘরে রাখতে পারব না। মা নেই ধরে নিয়ে যা করতে চায় করুক।
দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে গেল। বাপী পিছনে। ভাবছে, রণজিৎ চালিহার কান বিষনোর কলা-কর্ম এমনি নিখুঁত যে অবাধ্য হলে একমাত্র মেয়েকেও মহিলা ত্যাগ করতে রাজি। খেলার মোড় হঠাৎ এভাবে ঘুরবে জানলে ভদ্রলোক নিশ্চয় কান-বিষনোর ব্যাপারে এতটা তৎপর হত না।
গায়ত্রী রাই বারান্দার চেয়ারে বসল। একটু যেন হাঁপাচ্ছে মনে হল। রাগ বা অসহিষ্ণুতার কারণেও হতে পারে। ইশারায় সামনের চেয়ারটায় বাপীকে বসতে বলল।
বাপী জিজ্ঞাসা করল, আপনার শরীর তেমন সুস্থ নেই শুনলাম।
সঙ্গে সঙ্গে একটু টান হয়ে বসল গায়ত্রী রাই। গলার স্বরও চড়ল।—কে বলেছে আমার শরীর সুস্থ নেই?
বাপীর ভেবাচেকা মুখ
—আমি অসুস্থ হলে কার কি আসে যায়? আমি মরে গেলেও কারো ক্ষতি বেশি না লাভ বেশি?
সামনের দরজা দিয়ে পিছনের ঘরের কাউকে দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু বাপীর নিশ্চিত ধারণা তাদের চোখের আড়ালে ও-ঘরে কারো পদার্পণ ঘটেছে। আর, মহিলাও সেটা জানে।
মিনিট খানেক বাদে গায়ত্রী রাই সংযমে বাঁধল নিজেকে।—ওদিকের কাজ—কর্মের খবর কি?
—চলছে।…তবে আমার একটু অসুবিধে হচ্ছে। আমি যেদিকটা অর্গ্যানাইজ করেছি, ভ্যান না থাকতে সেসব জায়গায় মালের চালান এখনও যায়নি।
মুখের দিকে চেয়ে ভুরু কুঁচকে ভাবল একটু।—তুমি ড্রাইভিং জানো?
বাপী বুদ্ধিমানের মতোই জবাব দিল, না…আপনি বললে শিখে নিতে সময় লাগবে না।
—বাদশা ভালো ড্রাইভার। সবরকম গাড়ি চালাতে জানে। আমরা ফিরে গেলে সে শেখানোর ব্যবস্থা করে দেবে।
বাপী মাথা নাড়ল শুধু। তেমন উৎফুল্ল হবার কারণ নেই। বরাত এখনো অনিশ্চয়তার গহ্বরে। সেই ফয়সলার দিকেই এবারে এগোলো গায়ত্রী রাই। বলল, রেশমাকে এখানকার কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনেছ?
মুখ দেখলে বোঝা যাবে না…কিন্তু ভিতরে ভিতরে বাপী প্রস্তুত হয়েই এসেছে।—শুনেছি।…তবে আমার বিশ্বাস ব্যাপারটা আপনি আর একবার বিবেচনা করবেন।
ঠাণ্ডা সাদাটে মুখে মেজাজের আঁচড় পড়ল।—কেন? ওর কোনো দোষ নেই ডলি বলেছে বলে? আর একবারও ওই রকম ধরা পড়েছিল বলে মিস্টার চালিহার মুখ বন্ধ করার জন্য ও মদের বোতল ভেট নিয়ে গেছল—সে-খবর রাখো?
..খুব নরম গলায় বাপী বলল, রাখি। ও যায়নি, ওকে পাঠানো হয়েছিল। …এতে ওর নিজের তো কোনো স্বার্থ নেই, আদর দিয়ে আপনার মেয়েই ওকে বাধ্য করেছে।
মুখের ওপর অসহিষ্ণু ঝাপ্টা মারার মতো করে গায়ত্রী রাই বলে উঠল, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। এত বাধ্য হবার সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না। আমি ওকে তাড়িয়েই দিতে চেয়েছিলাম, চালিহা বলল আসামে কাজের মেয়ের দরকার আছে—আমি আপত্তি করিনি। সেখানে গেলে টাকাও বেশি পাবে। তোমার আপত্তি কেন?
প্রায় আবেদনের সুরে বাপী জবাব দিল, আপনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হচ্ছেন বুঝতে পারছি…আসামে মেয়ের অভাব নেই, তবু এত দূর থেকে রেশমার অজানা-অচেনা একটা জায়গায় উনি কেন তাকে নিয়ে যেতে চাইছেন, আপনাকে সেটা বলার দরকার হবে ভাবিনি।
রাগের মুখে ভদ্রমহিলা থতমত খেল একপ্রস্থ। একটা অনাবৃত সত্য তার মুখের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। তবু ঝাঁঝালো গলায় বলল, ডলির কাছ থেকে ওকে সরিয়ে দেবার জন্যেই এই ব্যবস্থা হয়েছে।
—এভাবে সরাতে চাইলে ও সরবে কিনা জানি না, তার আপনার জনেরা ভাবছে, নিজের মেয়েকে সামলাতে না পেরে নিজের স্বার্থে মিস্টার চালিহাকে খুশি করার জন্য একটা অসহায় জঙ্গলের মেয়েকে আপনি বলি দিতে যাচ্ছেন।
গায়ত্রী রাইয়ের মুখে কথা নেই। গুম হয়ে বসে রইল। তেমনি নরম আবেদনের সুরে বাপী আবার বলল, মেয়েদের কাজ বলতে এতদিনে আমি যতটুকু বুঝেছি, এই পাহাড়ী এলাকাতেই তার স্কোপ বেশি—এদিকে রেখেই ওকে দূরে সরানো যেতে পারে।
প্রস্তাব অনুমোদন করল কিনা মুখ দেখে বোঝা গেল না। দো-টানায় একটু পড়েছে বোঝা গেল। নইলে অন্য মূর্তি দেখা যেত।
খানিক চুপ করে থেকে হঠাৎ রুক্ষস্বরেই জিজ্ঞাসা করল, বানারজুলির রেঞ্জ অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছ?
এইটেই ফয়সলার প্রসঙ্গ। শান্ত মুখে বাপী জবাব দিল, না। তার আগে এই ব্যাপারে আমার কিছু কথা ছিল।
শোনামাত্র আগের মতো উগ্র মুর্তি।—কোনো কথা আমার শোনার দরকার নেই—মিস্টার চালিহা তোমাকে যা বলেছেন সেটাই আমার কথা—আমার ডিসিশন। কেন দেখা করোনি?
এখনো বাপী বিনীত, কিন্তু জবাবে কোনো জড়তা বা দ্বিধা নেই।—তাহলে আমাকে আপনার ছেড়ে দিতে আপত্তি নেই বুঝতে হবে।
হঠাৎ যেন বড়রকমের একটা ধাক্কা খেল মহিলা। প্রথমে চোখ, পরে গলা দিয়ে সাদা আগুন ঠিকরলো।—তার মানে সবকিছুর কন্ট্রোল নিয়ে আবু রব্বানীকে সরাতে চাইলে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে না?
—থাকব না নয়, মিস্টার চালিহা আমাকে থাকতে দেবেন না, তাই সময় থাকতে নিজের ব্যবস্থার তাগিদে আমাকে আগেই সরে যেতে হবে। তার লক্ষ্য আবু রব্বানী নয়, তার টারগেট আমি।
অপলক গোল দু’-চোখ ওর মুখের ওপর স্থির খানিকক্ষণ।—কি বলতে চাও খোলাখুলি বলো।
চাউনি আর গলার স্বর দুইই অকরুণ।
—আপনার মন-মেজাজ ভালো থাকলে কিছু বলার দরকার হত না। মিস্টার চালিহা সেই সুযোগই নিচ্ছেন। আবু রব্বানী আমার ডান হাতের মতো কাজ করছে, গোড়াতেই তাই তাকে ছেঁটে দেওয়া দরকার তাঁর। বিজয় মেহেরা সম্পর্কে আপনাকে তিনি বিষিয়ে রেখেছেন, ওদের মেলামেশা দু’দুবার হাতে—নাতে ধরেছেন, কিন্তু এখন তিনি দেখছেন আপনার বিজ্ঞাপন অনুযায়ী কোনো ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হলে তাঁর আরো ক্ষতি—এঞ্জিনিয়ার ছেলে আর যাই হোক এই ব্যবসা নিয়ে জঙ্গলে পড়ে থাকবে না। তাই বিজয় মেহেরাকে এখন আর তাঁর অত পছন্দ নয়। তাই আপনার মেয়েকে তিনি চুপিচুপি ভরসা দিয়েছেন, একটু ঠাণ্ডা হলে সাধ্যমতো আপনাকে বোঝাতে চেষ্টা করবেন। সত্যি কি মিথ্যে আপনার মেয়েকে ডেকে জিগ্যেস করুন—
মহিলার স্তব্ধ রুক্ষ মুখের দিকে চেয়ে বাপী আবার বলে গেল, মিস্টার চালিহা জানেন, মেয়ে যদি ওখানে বিয়ে করেই, ওদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলাই ভালো, আপনি তাদের শেষ পর্যন্ত ফেলে দেবেন না—আর দিলেও তাঁর লাভ ছেড়ে লোকসান কিছু নেই। তাই সবার আগে আমার জোর কাড়ার ব্যাপারে তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন।…আপনার মনের এই অবস্থায় এত সব আমি বলতাম না—কিন্তু তিনি এই সুযোগটাই বেছে নিয়েছেন।…এখন আপনি বিবেচনা করুন।
গায়ত্রী রাই পাথরের মূর্তির মতো বসে। মিনিট দুই চুপচাপ। চেয়ে আছে। তারপর গলার স্বর তেমনি ঠাণ্ডা তেমনি অকরুণ। বললে, বিবেচনা করব। যা বললে, সবই আমার অভ্রান্ত বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে তোমারও এমন ভাবার কোনো দরকার নেই। তুমি বরং মনে রেখো, এক বছরও হয়নি তুমি আমার কাছে এসেছ—তার আগে পর্যন্ত তোমাকে ছাড়াই আমার চলেছে—তাই ছেড়ে যাবারও কোনো হুমকি দেবার দরকার নেই—সে-জন্যে আমার বিবেচনার হেরফের হবে না।
কথাগুলো কানের পর্দায় ঘা দিয়ে গেল, ভিতর থেকে একটা অসহিষ্ণু ক্ষোভ ঠেলে উঠল। কথা শেষ। মহিলা এবার চেয়ার ছেড়ে উঠবে মনে হচ্ছে।
ফয়সলা চেয়েছিল। নিষ্পত্তি যা হবার হোক। বাপী চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে বলল, আমাকে যদি আপনাদের শুভার্থী মনে করেন তো সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপারে দুই-একটা কথা বলব।
মুখের দিকে চেয়ে থেকে তেমনি কঠিন সুরে গায়ত্রী রাই জবাব দিল, বাজে কথা ছেড়ে যা বলবার বলো।
অর্থাৎ শুভার্থী ভাবাটা বাজে কথা। এটুকুও হজম করে ঠাণ্ডা মুখে বাপী বলল, সামনের জানুয়ারির শেষ থেকে প্রায় তিন বছরের মতো মেয়ের জন্য আপনার খুব দুশ্চিন্তা করার দরকার হবে না, তার মধ্যে ঊর্মিলা আপনার কাছে ঘরেই থাকবে, তার ওপর নজর রাখতেও হবে না—হায়ার স্টাডিজ-এর জন্য বিজয় মেহেরা লন্ডন চলে যাচ্ছে—সেখানকার একটা ফার্মে কাজও পেয়েছে।
এই প্রসঙ্গে কথা হবে গায়ত্রী রাই কল্পনাও করেনি। কঠিন মুখে বিস্ময়ের আঁচড় পড়ছে। নড়েচড়ে বসল। সত্যি হলে অনেকখানি স্বস্তি, তাই উৎসুকও একটু।—তুমি জানলে কি করে, ডলি বলেছে?
—না। আমার সঙ্গেই সামনাসামনি কথা হয়েছে।
—কোথায়?
—মিরিকে।
আরো অবাক।—তুমি সেখানে গেছলে?
—হ্যাঁ।
—কবে?
—দিন-সাতেক আগে।
—কেন গেছলে? এবারে সন্দিগ্ধ।
—যাকে নিয়ে এত ব্যাপার তাকে একটু ভালো করে জানা বা চেনা দরকার ভেবেছিলাম। তার সম্পর্কে আপনার ধারণার সঙ্গে আমার ধারণা মিললে তাকে হটানোর রাস্তা বার করা যায় কিনা সে চিন্তাও মাথায় ছিল।
মহিলার আগ্রহ আরো স্পষ্ট এবার।—কি বুঝলে?
—বোঝাবুঝির কথা থাক, প্রায় তিন বছরের জন্য সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে এটাই বড় কথা। যাওয়ার আগে ওর বিয়ে করে যাবার ইচ্ছে ছিল, আপনার মেয়ে রাজি হয়নি। বিজয় মেহেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি বলেছি সে-চেষ্টা করতে গেলে ডলিরই সব থেকে ক্ষতি করা হবে।
—স্কাউনড্রেল!
—আমি?
থতমতো খেল। কিন্তু তেমনি উষ্ণ।—তোমাকে কে বলেছে? তিন বছরের জন্য তার যাওয়া একেবারে ঠিক?
—ঠিক।
মুখের দিকে চেয়ে বাপী অনুভব করতে পারে মহিলার অনেক দিনের টান-ধরা স্নায়ুগুলো আস্তে আস্তে শিথিল হচ্ছে। মুখের সাদাটে ভাবও এরই মধ্যে একটু কম।
—বুঝলাম। তোমার কি বক্তব্য?
নিরুত্তাপ গলায় বাপী জবাব দিল, শুভার্থীও ভাবেন না যখন, বলে কি লাভ হবে জানি না। তবু নিজেকে আমি শুভার্থী ভাবি বলেই বলছি।…তিনটে বছর অনেক সময়। ছেলে-মেয়ে দু’দিকেরই মত বা মন বদলাবার পক্ষে যথেষ্ট সময়। যেখানে যাচ্ছে ছেলের পক্ষে তো বটেই। এর মধ্যে মেয়ের মনের দিকে না তাকিয়ে আর যথেষ্ট সময় হাতে পেয়েও সে সুযোগ না নিয়ে আপনি যদি এমনি ঝোঁকের মাথায় ওর বিয়ের তোড়জোড় করেন—আমার ধারণা সব থেকে বড় ভুলটা সেইখানে হবে। শুধু এই ব্যাপারই নয়, সব দিকেই যেমন চলছে চলতে দিলে আপনার খুব অশান্তির কারণ থাকবে না।
গায়ত্রী রাই বেশ মন দিয়েই শুনল কথাগুলো। আর রুক্ষ নয়, উগ্র নয়। অশান্তি অনেকটা কমেই গেছে বোঝা যায়। এখন শুধু গম্ভীর।—ঠিক আছে, ভাবব। আর দেরি না করে তুমি ভ্যান নিয়ে চলে যাও। আজ আর কালকের মধ্যে যেখানে যেখানে মাল চালান দেওয়া দরকার কালকের মধ্যে দিয়ে পরশু গাড়িটা পাঠিয়ে দিও।
বাপী উঠে দাঁড়াতে গায়ত্রী রাই ঈষৎ নীরস সুরে আবার বলল, আর একটা কথা, এক্সপ্যানসনের জন্যও ফরেস্ট রেঞ্জ-অফিসারের সঙ্গে আমাদের ডাইরেক্ট যোগাযোগ করা দরকার!
নিরুত্তাপ গলায় বাপী জবাব দিল, আপনার বিবেচনা শেষ হলে বলবেন…করব।
অদূরে ভ্যানটা দাঁড়িয়েই আছে। আর অপেক্ষা না করে সিঁড়ির দিকে এগলো।
—বাপী। হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাধা দিল ঊর্মিলা।—ওয়েট্ তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
বাপী ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল তাকে। এই মুখে খুশী যেমন রাগও তেমনি। বাপী বলল, তোমার মায়ের বিশ্বাস বা বিবেচনা বোঝা গেলে তখন কথা। এখন থাক।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা ভ্যানে।
জঙ্গলের পাশ-ঘেঁষা পাহাড়ী রাস্তা ধরে ভ্যান ছুটছে! বাপী প্রথমে গুম খানিকক্ষণ। আগে বাড়ল, কি আপাতত কিছুটা পিছে হটল জানে না। এতক্ষণের সব কথা আবার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। মন বলছে, পিছনে নয়, সামনেই পা ফেলেছে। দেখা যাক। হাসিই পেল হঠাৎ। বেলা সাড়ে ন’টা এখন। নিজে রান্না করে খায়। এরপর বাড়ি পৌঁছে সে পাটের সময় থাকবে না। কিন্তু এমনি মেজাজের হাল এখন ভদ্রমহিলার, যে মনেই পড়ল না। বাপীর ছেলেমানুষের মতো ভাবতে ভালো লাগছে নিজে যখন লাঞ্চে বসবে তখন মনে পড়বে আর খারাপ লাগবে।
সমস্ত দিন ব্যস্ত ছিল। বিকেলের দিকে আবুর খোঁজে জঙ্গলের পথ ধরল। এবারে ওর সঙ্গে কথা বলা আর পরামর্শ করার দরকার হয়েছে। গায়ত্রী রাইয়ের বিবেচনার মোড় কোন্ দিকে ফেরে বলা যায় না। রণজিৎ চালিহা অপরিহার্য ব্যাধির মতো তার স্নায়ুর ওপর চেপে আছে—থাকতে চাইবেও।
এ সময় চন্দ্রার বেডের কাছেই আবুকে পাবে ভেবেছিল। নেই। কেউ নেই। অনিশ্চয়তার দরুন উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে হয়তো। ওর ডেরার দিকে চলল। সেখানে পেল। সামনের দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছে। আশপাশ দিয়ে ছেলে দুটো ছোটাছুটি করছে।
ওকে আসতে দেখে আবু হাসল বটে, কিন্তু হাসিটা বুক ছুঁয়ে যাবার মতো নয়। ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে দুলারিকে ডাকল।
কাছে এসে বাপী আবুর পাশে দাওয়ার ওপরেই বসে পড়ল।—কি খবর?
বিড়িটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে নির্লিপ্ত গলায় আবু বলল, তোমার কাছে খবর পাব বলে তো দিন গুনছি।
দুলারি এসে ছেলে দুটোকে ঘরে পাঠিয়ে পাশের থাম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আবু ওর মাথায়ও অবাঞ্ছিত কিছু ঢুকিয়েছে মনে হয়।
—চন্দ্রার বেড়ে কাজ হচ্ছে না কেন?
আর একটা বিড়ি ধরিয়ে আবু জবাব দিল, তোমাদের বিচার শেষ হোক। —ওটা যে তোমাদের মেমসায়েবের কাজেই লাগবে তোমাকে কে বলল? নষ্ট কোরো না, যেমন বাড়িয়ে যাচ্ছ বাড়িয়ে যাও।
আবু ঠিক বুঝল না। চেয়ে আছে।
বাপী বলল, মেমসায়েব এখন পাহাড়ের বাংলোয়। আজ সকালে গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে গেছলেন।
আবুর ছোট চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠল।—আমার ওপর হুকুম হয়েছে কিছু?
—ম্যানেজার আর মেমসায়েবের হুকুম, জঙ্গলের বড়সাহেবের সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা বলে তোমাদের বাদ দিয়ে নতুন টিম-ওয়ার্ক করতে হবে।
—সব দোষ তাহলে আমার আর রেশমার?
মোলায়েম গাম্ভীর্যে বাপী জবাব দিল, রেশমার কথা ছাড়ো।…সত্যি কথা বলো দেখি। আগে থাকতে বলে রেখে ছুটির দিনে লম্বা সময়ের জন্য তোমার মেমসায়েবের মেয়ে বনমায়াকে নিয়ে গেল—তোমার এতটুকু সন্দেহ পর্যন্ত হয়নি?
আবুর ছোট চোখের রাগ ঠিকরে বেরুচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিল, সন্দেহ হয়েছিল। আর সে-কথা রেশমাকে বলেও ছিলাম।…এবার তোমার কর্তব্য করতে সুবিধে হবে?
হাসি মুখে বাপী এবার দুলারির দিকে তাকালো। বলল, আবুর কর্তব্য-জ্ঞান সাংঘাতিক। নতুন বীম্যান হবার পর জঙ্গলের বড়সাহেবের হুকুমে আমাকে জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে গেছল। ওর চোখের সামনে তারপর কি হয়েছিল ওর মুখেই শুনো।
দুলারির শোনা আছে বোধহয়। দু’জনেই হতচকিত হঠাৎ। আবুর দিকে ফিরে ঠাণ্ডামুখে এবার বাপী বলল, আমার কর্তব্যজ্ঞান-টানগুলো একটু অন্য রকমের।…মেমসায়েবকে বলে এসেছি, তোমাকে ছেড়ে দিলে আমাকেও ছেঁটে দেবার কথা ভাবতে হবে। কেন ভাবতে হবে তাও বলেছি। আমি আশা করছি অতদূর গড়াবে না, যেমন চলছে তেমনি চলবে। তা যদি না হয়, আমার বিশ্বাস আমি তুমি দুলারি আর রেশমা একত্র হয়ে ওষুধ আর সাপের ব্যবসা গোড়াতেই অত বড় করে না হোক ছোট করে অন্তত চালাতে পারব। টাকারও অভাব হবে না, বাড়ি বিক্রি করতে চাইলে মিসেস রাই কিনতে বাধ্য। কিন্তু আমার ওপর তোমার বিশ্বাসের এত উন্নতি দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছি—
বিড়ি ফেলে আবু তার মুখটা বাপীর কোলে গুঁজে দিল—বাপী—বাপীভাই, তুমি আমাকে ধরে মারো—আমার মুখটা মাটিতে থেঁতলে দাও। না বাপীভাই, আমার জন্য তোমাকে কাজ ছাড়তে হবে না—আল্লার দিব্বি বলছি, মেমসায়েব আমাকে ঝাঁটা মেরে তাড়ালেও আর আমি তোমাকে অবিশ্বাস করব না।
বাপী ওকে ঠেলে তুলল। ওর চোখে সত্যি জল। দুলারি হাসছে। বাপীর সঙ্গে চোখাচোখি হতে বলল, আর অবিশ্বাস করলে আমি চ্যালা-কাঠ নিয়ে কুকুর তাড়া করব!
বেশ কপট গাম্ভীর্যে বাপী উঠে দাঁড়াল।—আমি চলে গেলে এই বুড়ো খোকাকে একটু আদর-টাদর কোরো? আবুকে বলল, আমার বিশ্বাস আর গণ্ডগোল কিছু হবে না। কিন্তু যাই হোক, আপাতত তুমি বা রেশমা ওই ম্যানেজারকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা কোরো
পরের পনেরটা দিনের মধ্যেও পাহাড় থেকে কোনরকম নির্দেশ এলো না। এলো না বলেই বাপীর ধারণা বিবেচনার ফল অনুকূল! নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ ওটা। ডিসেম্বরের শীতের কামড়ে পাহাড়ে থাকা সম্ভব হবে না। মেয়েসহ এই নভেম্বরের শেষেই মিসেস রাই নেমে আসবে আশা করছে। শুধু আশা করছে না, তাদের আসার অপেক্ষায় ভিতরে ভিতরে উদ্গ্রীব হয়ে আছে।
এখনো বাপী রণজিৎ চালিহাকে পাশ কাটিয়ে চলেছে। কাজের অছিলায় কাছাকাছির মধ্যে বাইরে বাইরে ঘুরছে দিন-কতক। এখানে থাকলে চালিহা আপিস থেকে যাবার পরে আসে। পরপর দুদিন তাকে অ্যাকাউন্টেন্ট খরচ দিল, চিফ একডিকিউটিভের মেজাজ গরম। আপিসে এসেই বাপীর খোঁজ করেছে। না পেয়ে রেগেই গেছে।
সেই দিনই সন্ধ্যার পর রণজিৎ চালিহার জিপ তার বাংলোয় হাজির। ড্রাইভার জানালো সাহেব এক্ষুনি যেতে বলেছেন।
গেল। বাংলোর ভিতরের ঘরে ডাক পড়ল। সামনের টেবিলে মদের গেলাস, মদের বোতল। লাল মুখ আর ঘোলাটে চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে জঠর ইতিমধ্যে অনেকটাই রসস্থ হয়েছে। ওকে দেখামাত্র গর্জন করে উঠল, হোয়াট্ দা হেল্ আর ইউ ডুইং অল টাইম? অ্যান্ড হাউ ডেয়ার ইউ ডিসওবে মি?
একটু দূরে চেয়ার টেনে বসল বাপী।—কি হয়েছে বলুন।
—রেঞ্জ-অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছ?
—না।
—ফ্রেশ স্কিম করার কথা বলেছিলাম—করেছ?
—না।
ফেটে পড়ল।—কেন করোনি? আমি তোমাকে স্পেয়ার করব ভেবেছ? সাবমিট ইওর রিটন এক্সপ্লানেশন টুমরো!
ধীর গম্ভীর গলায় বাপী জবাব দিল, মিসেস রাই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এ-ব্যাপারে যা বলার তিনি ভেবে বলবেন জানিয়েছেন।
—হু ইজ্জ্ সি? আই অ্যাম ইওর বস্। ইউ ইনসাবরডিনেট লাউজি ফুল! চেয়ার ঠেলে উঠে বাপী সোজা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। যে-রকম মত্ত অবস্থা, কিছুই এখন মাথায় ঢুকবে না।
পরের সন্ধ্যায় ফটকের সামনে আবার চালিহার জিপ। একই খবর! সাহেব ডাকছে।
বাপী ড্রাইভারকে বলল, আজ যেতে পারছি না। কাল আপিসে দেখা করব বলোগে।
কিন্তু ড্রাইভার এবারে নিজে থেকেই জানান দিল, মেমসায়েবের ভ্যান এসেছে পাহাড় থেকে, বোধ হয় জরুরি দরকারেই সাহেব ডাকছেন।
অগত্যা। জিপে উঠতে হল। ভ্যানটা সত্যি চালিহার বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে। ভিতরের ঘরে আজ সবুজ আলো জ্বলছে। ভিতরে পা দিয়েই বাপীর মনে হল আজ আরো মত্ত অবস্থা। গেলাস ভরতি। বোতল প্রায় খালি। ওকে দেখেই জড়ানো গলায় হাঁক দিল, কাম্ অন্ ইউ চিনির বলদ—একবস্তা চিনি তোমাকে এক্ষুনি পাহাড়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে! ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসতে লাগল।— নিজেকে একটি মহারানী ভেবে বসে আছেন তোমাদের লেডি, বাট আই আম নট দ্যাট ব্লাডি সোয়াইন অফ এ সারভেন্ট—আই হ্যাভ নো টাইম, আই অ্যাম ওয়েটিং ফর এ গেস্ট। গো অ্যান্ড টেল হার দ্যাট অ্যান্ড ডাম্প অল দি মানি অন হার ল্যাপ। আবার হাসি।—বুঝতে পারছ না? আজ সন্ধ্যার মধ্যেই টাকা যাবার কথা ছিল, দেরি দেখে লোক পাঠিয়েছে। এবারে হাসি আরো তির্যক, আই ওয়ান্ডার হোয়াট সি উইল ডু উইথ ইট অ্যাট দিস আওয়ার অফ দি নাইট!
গেলাসের অর্ধেক এক চুমুকে সাবাড় করে দিল। তারপর উঠে টলতে টলতে খাটের ওপর ধুপ করে বসে পড়ল। একটানে বালিশটা সরাতেই বাপীর চক্ষু স্থির।
মস্ত দুই বান্ডিল একশ টাকার নোট। নম্বর করা নতুন নোটের বান্ডিল নয়। তার থেকে ঢের বড়। গাদা করে ফিতেয় বাঁধা।
বান্ডিল দু’টো টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল।—দেখে নাও একুশ হাজার সাতশ টাকা আছে এখানে। হার হাইনেসকে দিয়ে এসো অ্যান্ড দেন গো টু হেল!
বাপী নির্বাক দাঁড়িয়ে।
এক চুমুকে গেলাসের বাকিটুকু শেষ করে রণজিৎ চালিহা গজরে উঠল, ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম—হারি আপ্।
বাপী এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। নোটের বান্ডিল দুটো সামনে টেনে নিল।
রণজিৎ চালিহাও উঠল। ইংরেজি গান ধরে বোতলের বাকি মদ গেলাসে ঢেলে জল মেশালো। তারপর খোশমেজাজে দুলে দুলে ঘরের মধ্যে হাঁটতে লাগল। বাপী টাকা গুনছে তো গুনছেই। আর যত এগোচ্ছে মুখে ততো বিস্ময়ের আঁচড় পড়ছে।
রণজিৎ চালিহা টলতে টলতে বেরিয়ে গেছল। চাকরের সঙ্গে তার চেঁচামেচি কানে আসছে। ডিনার সার্ভ করতে দেরি হলে তার গর্দান নেবে বলে ধমকাচ্ছে। এদিকে বাপীর কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। প্রথম বান্ডিলেই চৌদ্দ হাজার সাতশ’ টাকা! এখন দ্বিতীয় বান্ডিলের মাঝামাঝি এসেছে।
ফিরে এসেই রণজিৎ চালিহা হুঙ্কার দিয়ে উঠল, আর বেশি দেরি করলে আমি তোমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেব বলে দিলাম!
গেলাসটা তুলে নিয়ে থলথলে মুখ করে হাসছে। ঘড়ি দেখছে। বাঞ্ছিত কারো আসার প্রতীক্ষায় সময় দেখছে হয়তো
দ্বিতীয় বান্ডিল গোনা হল। এতে পনের হাজার একশ! দুটো মিলিয়ে ঊনত্রিশ হাজার আটশ। চালিহা মুখে বলেছে, একুশ হাজার সাতশ।
—ফিনিসড্?
বাপী মাথা নাড়ল।
কোণের ছোট টেবিলটার সামনে বসে প্যাড টেনে রণজিৎ চালিহা খসখস করে লিখল কি। তারপর নাম সই করে সেটা সামনে ছুঁড়ে মারল। ইংরেজিতে লেখা আছে, শরীর অসুস্থ। এই ঠাণ্ডায় যেতে পারছি না। বাপী তরফদারের হাত দিয়ে একুশ হাজার আটশ’ টাকা পাঠানো হল।
এবার নেশার ঝোঁকে দুই বান্ডিলের শেষের সাতশ’ আর একশ’ জুড়ে আটশ’ লিখেছে। বাপীর হাতে এখনো কড়কড়ে আট হাজার বেশি। এরই মধ্যে দ্রুত চিন্তা সারা তার। গড় হিসেবের এই আট হাজার টাকা হয়তো তার নিজের গায়েব করার সংকল্প ছিল। নেশার ঝোঁকে সেটা আর মনে নেই।
টলতে টলতে এগিয়ে এসে চালিহা একটা কালো থলে ছুঁড়ে দিল। অর্থাৎ টাকাগুলো ওতে ভরে নিতে হবে।
—হার হাইনেসকে বলবে, সতের জায়গায় ঘুরে যা জোটানো গেছে সব দিয়ে দিলাম—সি এক্সপেকটেড মোর। কোথা থেকে কত পাওয়া গেছে আই ডোন্ট রিমেম্বার নাও—অ্যান্ড আই ডোন্ট কেয়ার টু। পরে দেখা যাবে। এ কোনো হিসেবের টাকা নয়, স্টিল অ্যাম আই এ থিফ? একটা রাত এ-টাকা আমার কাছে থাকলে আমি মেরে দিতাম? নাও গেট আউট!
বাইরের অন্ধকার ফুঁড়ে ভ্যান ছুটেছে। ঠাণ্ডা বেশ। গায়ে গরম জামা যা আছে খুব যথেষ্ট নয়। তবু বাপীর খুব একটা শীত করছে না। স্থাণুর মতো বসে আছে। টাকার থলে কোলের ওপর শক্ত মুঠোয় ধরা। আবার নতুন করে ভাবছে কিছু।
পাহাড়ের কাছে পৌঁছুল। বাংলোর জোরালো আলোগুলো দেখা যাচ্ছে নিচের থেকে সুন্দর লাগছে। পাহাড় পেঁচিয়ে ভ্যানটা উঠতে লাগল। আধাআধি ওঠার পর পাশের জানলা দিয়ে বাপী নিচের দিকে তাকালো। শুধু জমাটবাঁধা অন্ধকার। আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেন যেন ঊর্মিলার বাবা বীরেশ্বর রাইয়ের কথা মনে পড়ল বাপীর। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে নিচে পড়ে সব শেষ। ওই খোলা দিকটায় তখন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। গায়ত্রী রাই সবটা জুড়ে পরে লাগিয়েছে।
ভ্যান গেট দিয়ে ঢুকল। সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।
টাকার থলে হাতে বাপী সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। ভ্যান থামিয়ে ড্রাইভার বাদশা দু’বার হর্ন বাজিয়েছে। সেই কারণেই হয়তো বারান্দার পিছনের কাঁচের দরজা দুটো খুলে গেল। গায়ত্রী রাই দাঁড়িয়ে। মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত গরম চাদরে মোড়া। রাইয়ের বারান্দায় হ্যাসাক জ্বলছে। ভিতরেও জোরালো আলো। স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে গায়ত্রী রাই ওকে ভালো করে দেখে নিল এক দফা। তারপর ডাকল।ভিতরে এসো।
বাপী সামনের ঘরে ঢুকল। ভিতরের অন্য দরজা দিয়ে ঊর্মিলা গলা বাড়ালো। তারপরেই খুশিতে আর বিস্ময়ে উদ্ভাসিত।—রাপী! তুমি এ সময়ে, কি ব্যাপার?
মুখ দেখে মনে হল মায়ের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া হয়েছে। বাপী জবাব দিল না। গায়ত্রী রাইয়ের মুখোমুখি একটা সোফায় বসল। অবাক মুখে ঊর্মিলা মায়ের পাশের সোফাটা দখল করল।
গায়ত্রী রাই হাতের কালো থলেটা একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওতে টাকা?
—হ্যাঁ।
—মিস্টার চালিহা কি করছেন?
—ঘরে সবুজ আলো জ্বেলে ড্রিঙ্ক করছেন। একজন গেস্ট-এর জন্য অপেক্ষাও করছেন।
বলার ধরনে সাদাটে ভুরুজোড়া একটু কোঁচকাতে দেখা গেল।—ইজ হি ড্রাঙ্ক?
—ঠিক বলতে পারব না। দেখলে তাই মনে হবে। উঠে টাকার থলে আর চিঠি তার সামনে সেন্টার টেবিলে রেখে আবার ফিরে এলো।
চিঠিটা তুলে নিয়ে নিতে গায়ত্রী রাই জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা পাঠিয়েছে? —উনি মুখে বলেছেন একুশ হাজার সাতশ’ টাকা। চিঠিতে লিখেছেন একুশ হাজার আটশ’ টাকা।
—এখানে কত আছে তুমি গুনে আনোনি?
—এনেছি। আছে ঊনত্রিশ হাজার আটশ’ টাকা।
ঊর্মিলা লাফিয়ে উঠল।—মাই গড! হি ওয়জ ডেড ড্রাঙ্ক দেন!
ওর দিকে না তাকিয়ে বাপী বলল, টাকাটা গুনে নিন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে—এরপর আরো ঠাণ্ডা পড়বে।
ঊর্মিলা উদ্বিগ্ন মুখে মায়ের দিকে তাকালো। গায়ত্রী রাইও এ-রকম শুনবে আশা করেনি। বলল, এই ঠাণ্ডায় আর তোমাকে যেতে হবে না। কাল সকালে যাবে।
সোজা মুখের দিকে চেয়ে বাপী বলল, কিন্তু আমার ফিরতে পারলে ভালো হয়…কিছু চিন্তা করার আছে।
শুধু মেয়ে নয়, মায়ের মুখেও বিস্ময়ের আঁচড় পড়েছে।—কি চিন্তা?
—আপনার কাছে আর আমার থাকা নিরাপদ হবে কিনা সেই চিন্তা।
মেয়ের ভেবাচাকা মূর্তি। মায়ের সাদাটে ভুরুতে ভাঁজ পড়ল আবার।— হোয়াট ডু ইউ মিন?
বাপীর মুখে কোন রকম আবেগের লেশমাত্র নেই। জবাব দিল, একটু পিছন থেকে বলতে হবে তাহলে।…সাত মাস আগে আপনি আমায় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে শিলিগুড়ি আর মালদহের দু’জন বড় পাইকিরি খদ্দেরের সঙ্গে রিজিওন্যাল ম্যানেজার হিসেবে আমার পরিচয় করে দিয়েছিলেন। ওই দু’জনেই আপনার অনেক দিনের ক্লায়েন্ট, আপনাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করে দেখেছি।
গায়ত্রী রাই অসহিষ্ণু ঈষৎ—সো হোয়াট, তাঁদের কথা কেন?
—তার কারণ দ্বিতীয়বার তাঁদের কাছে যেতেই দু’জনেই তাঁরা ব্যক্তিগত লাভের টোপ ফেলে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন।…আমার ধারণা, আমার সততা পরীক্ষা করার জন্য আপনি এই টোপ ফেলতে তাঁদের বলে দিয়েছিলেন।
ঊর্মিলার দু’ চোখ বিস্ফারিত। একবার মা-কে দেখছে একবার বাপীকে। এই প্রথম বোধ হয় বিড়ম্বনার ছায়া দেখা যাচ্ছে গায়ত্রী রাইয়ের মুখে
স্পষ্ট ঠাণ্ডা গলায় বাপী বলে গেল, কিন্তু মিস্টার চালিহার মতো মানুষকে দলে টেনে আবার সেই পরীক্ষার টোপ ফেলে আপনি আমাকে তার দশগুণ রিক্স—এর মধ্যে ফেলেছিলেন। আমার ধারণা, আপনি জানতেন টাকা নিয়ে মিস্টার চালিহা আসবেন না, আমি আসব। আমার ধারণা, কত টাকা আমি পাব—আপনি আর মিস্টার চালিহা দু’জনেই তা জানতেন। দেদার মাতাল হয়ে মিস্টার চালিহা আপনাকে গালাগালি পর্যন্ত করছিলেন।…আমার ধারণা, করবেন যে তাও তিনি আপনাকে বলেই রেখেছিলেন। কাউকেই বিশ্বাস করা আপনার ধাতে নেই, তাই এত বড় রিস্ক-এর মধ্যে আপনি আমাকে ঠেলে দিতে পেরেছেন।
গায়ত্রী রাইয়ের চোখে মুখে ঠোঁটে হাসি ছড়াচ্ছে। এমন একটা ব্যতিক্রম দেখে ঊর্মিলা আরো হতভম্ব।
গায়ত্রী রাই দেখছে। হাসছে। দু’ চোখে প্রশংসা উপচে পড়ছে।—রিস্ক কেন?
—অত মদ না খেলে আর আরো একটু মাথা খাটালে মিস্টার চালিহা আট হাজার টাকা কম দিয়েই আমাকে আপনার কাছে পাঠাতেন। তখন আপনি কি করতেন? কাকে বিশ্বাস করতেন? তিনি তো জোর দিয়ে বলতেন, প্ল্যান-মতো ঊনত্রিশ হাজার আটশ’ টাকাই আপনাকে পাঠিয়েছেন!
সাদা মুখ বিস্ময় আর উদ্বেগে ভরাট হতে লাগল। অস্ফুট স্বরে বলল, আমি অতটা ভাবিনি…সত্যি তো সর্বনাশ হত তাহলে!
বাপীর গলার স্বর এবারে শুধু ঠাণ্ডা নয়, কঠিনও। আপনার কিছু হত না, আমার হত। চোর নাম নিয়ে আমাকে এখান থেকে যেতে হত। মুখের ওপর দু’ চোখ বিঁধিয়ে থামল একটু। অনেক দিনের মোক্ষম গোপন অস্ত্রটা ছুঁড়ে দেবার এই বুঝি সময়। গলার স্বর আরো নির্দয়।—এবারে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করি? গায়ত্রী রাই চেয়ে আছে। ভালো লাগছে। অবাক লাগছে। নিজের অগোচরে সামান্য মাথা নেড়েছে।
আঙুল তুলে ঊর্মিলাকে দেখিয়ে বাপী বলল, চার বছর আগে ওর বাবার সেই অ্যাকসিডেন্টের রাত থেকে যে লোককে আপনি সব থেকে বেশি সন্দেহ করেন আর ঘৃণা করেন—সব দিক বজায় রাখার তাগিদে আপনি তাকে আরো কত প্রশ্রয় দেবেন?
মুখের ওপর কেউ যেন আচমকা আঘাত করল। গায়ত্রী রাই নির্বাক নিস্পন্দ বিমূঢ় খানিকক্ষণ। একটা যন্ত্রণার স্মৃতি ভেতর থেকে ঠেলে উঠতে লাগল। বিড়বিড় করে বলল, অ্যাক্সিডেন্টের সেই রাত থেকে আমি সব থেকে বেশি সন্দেহ করি ঘৃণা করি…কাকে?
—আপনার চিফ একজিকিউটিভ রণজিৎ চালিহাকে।
—তোমাকে কে বলল?
—কেউ বলেনি। আমার এই রকমই ধারণা।…বড় কাজ শেষ করার আনন্দে দু’জনে প্রচুর ড্রিঙ্ক করে বৃষ্টির রাতে বন্ধুকে পাশে নিয়ে মিস্টার রাই জিপ ড্রাইভ করে ফিরছিলেন…বন্ধুরও সেই রাতে আপনার এখানেই থাকা খাওয়ার কথা… কিন্তু পাহাড়ে ওঠার আগেই কিছু কাজ সেরে আসার জন্য তিনি নেমে গেলেন আর দু’ ঘণ্টা বাদে অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনলেন। সেই অ্যাক্সিডেন্ট যে কারণেই হোক, তাঁর প্রত্যাশিত ছিল কিনা আর সেই জন্যেই কাজের অজুহাতে তিনি নেমে গেছলেন কিনা—সেই সন্দেহ আপনার মনে আসা স্বাভাবিক…আর মিস্টার চালিহা তাঁর কাজ সেরে ফিরে আসার পর সত্যি কতটা মত্ত অবস্থায় তাঁকে দেখা গেছে তা-ও আপনিই সব থেকে ভালো জানেন।
ঘরের বাতাসও বুঝি স্তব্ধ হয়ে থেমে আছে। গায়ত্রী রাইয়ের মুখ কাগজের মতো সাদা। স্মৃতির নিঃশব্দ যন্ত্রণায় নিঃশ্বাস নিতে ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে মনে হয়।
ঊর্মিলা পুতুলের মতো বসে।