সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : ১৫
পঁচিশ দিন বাদে আবার বানারজুলি। বাপী তরফদার নিজের তাগিদে ফেরেনি। অদ্ভুত ভালো কেটেছে এই কটা দিন। সম্ভব হলে আরো দিনকতক থেকে যেত। কাজে ডুবে ছিল। প্রাণের গভীরেও। যে প্রাণের স্পর্শ এখন বানারজুলিতেও তেমন আর নেই। এত দিনের মধ্যেও কর্ত্রী ডেকে পাঠায়নি, ভাগ্য। এরপর তার মেজাজ বিগড়নোর আশঙ্কা।
বাইরে সেই বাপীই। কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু ভিতরে কিছু তফাৎ হয়েছে। নিজের ওপর বিশ্বাস বেড়েছে। পায়ের তলায় মাটি আরো খানিকটা নির্ভরযোগ্য শক্ত মনে হয়েছে। ভিতরে কিছু বাড়তি উৎসাহ উদ্যমের সাড়া মিলছে। জঙ্গলের ন্যাংটো সাধুর সঙ্গে যোগাযোগটা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত কিছু, ভাবছে না। আর, যে-কথা সে বলেছে তারও এমন গম্ভীর কিছু তাৎপর্য নেই যা বাপীর জানা ছিল না। কিন্তু সময় বিশেষে অনেক সাধারণ কথা বা সামান্য কথাও বড় হয়ে ওঠে। ঝঙ্কার তোলে। কলকাতার ব্রুকলিন পিওন রতন বনিকের ভবিষ্যৎ বচনে আস্থা কতটুকু ছিল? তবু ভালো কি লাগেনি? ন্যাংটো সাধুও কিছু না-জেনেই হয়তো বাপীর একাগ্র প্রস্তুতির মুহূর্তে সব সার্থকতার সাদা মন্ত্রটুকু কানে জপে দিয়েছে। কিছু পেতে হলে কিছু করতে হবে। আগে বাড়তে হবে। এই উদ্দীপনা কোনো দ্বিধার দোসর হতে পারে না। নিষ্ক্রিয় তো নয়ই। ভিতরের এই জোরটুকু অনুভবের বস্তু।
কিন্তু ফিরে এসেই টের পেল এখানকার সমাচার কুশল নয়।
গায়ত্রী রাইয়ের বাংলোর দরজা জানালা সব বন্ধ। বারান্দাটাও খাঁ-খাঁ করছে। বেতের টেবিল বা চেয়ার কটারও চিহ্ন নেই। উঠোনের কোণের দিকে মালিটা ঘাড় গুঁজে কাজ করছে।
ঝোলা কাঁধে বাপী বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল খানিক। তারপর গেট খুলে মালির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, সব কোথায়?
মালি কোনো হদিস দিতে পারল না। চার দিন আগে বাংলো তালা-বন্ধ করে সব চলে গেছে। কোথায় গেছে বা কত দিনের জন্য গেছে সে জানে না।
বাপীর শোনা ছিল দূরপাল্লার সফরে বেরুনোর দরকার হলে গায়ত্রী রাই মেয়েকে রেখে যায় না, সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। কিন্তু গত ন’ মাসের যোগাযোগে তাকে এভাবে উবে যেতে আর দেখেনি। গোলযোগের গন্ধ পাওয়া বাপীর স্বভাব কিনা জানে না। তিন দিনের জন্য পাহাড়ের বাংলোয় যাবার নামে যে মেয়ে ফুঁসেছে আর গজরেছে, কিছু একটা না ঘটলে তাকে বগলদাবা করে বেরুনোটা ওই মায়ের পক্ষে খুব সহজ হবার কথা নয়। আরো মনে হল, ব্যবসার তাগিদে তড়িঘড়ি দূরে যাওয়ার দরকার হলে বাপীর কাছে ফেরার এত্তেলা যেত।
ঘরে ফিরে কাঁধের ঝোলা নামিয়েই সাইকেল নিয়ে বেরুলো আবার। আপিসে। পাঁচটা তখনো বাজেনি। অ্যাকাউন্টেন্টকে ডেকে নিজের ঘরে ঢুকল। কিন্তু না। কর্ত্রী কোথায় গেছে বা কত দিনের জন্যে গেছে সে-ও জানে না। চার দিন আগের বিকেলে সে-ও দুটো দরকারী চিঠি সই করাতে গিয়ে দেখে বাংলো তালাবন্ধ। ব্যবসার কাজে বেরুলে অ্যাকাউন্টেন্টের অন্তত না জানার কথা নয়। বাপী স্বস্তিবোধ করছে না।—মিস্টার চালিহা কোথায়?
—এখানেই
—উনি জানেন না মিসেস রাই কোথায় গেছেন?
অ্যাকাউন্টেন্ট তাও জানে না। মিস্টার চালিহা শুধু দরকারী কাগজপত্র সব তাঁকে দিয়ে সই করিয়ে নেবার হুকুম করেছেন।
পরদিন বাপী সকাল দশটার একটু আগেই আপিসে হাজির। চালিহা আসতে তার ঘরে এসে দাঁড়াল। ঘরে এলে এই লোক এখনো তাকে বসতে বলে না। ফর্সা হাসি মুখে সুতৎপর ব্যস্তভাব।—দেখাশুনো হল?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—কত দিন ছিলে?
—পঁচিশ দিন।
ফাইল থেকে মুখ তুলল চালিহা। ঠোটের হাসি ধারালো একটু।—পঁচিশ দিন ধরে সেখানে দেখা-শোনার এত কি ছিল?
বাপী নিরুত্তর।
—মিসেস রাইয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথা হয়েছিল। তোমার ফিরতে এত দেরি হবে তিনিও জানতেন না।…ঠিক আছে, এতদিন সেখানে তুমি কি করলে না করলে, কি রকম অভিজ্ঞতা হল তার একটা অফিসিয়াল রিপোর্ট দাও।
ভিতরটা উষ্ম হয়ে উঠছে বাপীর। তবু যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা এবং সংযত। একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, মিসেস রাই কোথায় গেছেন?
হাতের লাল পেন্সিল খোলা ফাইলের ওপর ফেলে আবার মুখ তুলল। খুব মোলায়েম স্বরে জবাব দিল, শিলিগুড়ি। সেখান থেকে আর কোথাও গেছেন কিনা জানি না। কেন—খুব দরকার তোমার?
—আজ্ঞে না। আমার ওপর তাঁর কোন ইনস্ট্রাকশন আছে?
ঠোঁটের ফাঁকে হাসির ছোঁয়া। ধারালো চাউনি মুখের ওপর আটকে রইল খানিক।—তোমাকে ইনস্ট্রাকশন এবার থেকে তাহলে তিনি দেবেন ভাবছ?
বাপী বিনীত অথচ স্পষ্ট জবাব দিল, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। পঁচিশ দিন আমার এখানে না থাকার জন্যে আপনি অফিসিয়াল রিপোর্ট চাইলেন বলেই কথাটা জিজ্ঞেস করার দরকার হল।
—কেন?
—আমি যা শিখতে বা জানতে বুঝতে গেছলাম তার কোনো অফিসিয়াল রিপোর্ট হয় না। আর সেজন্যে পঁচিশটা দিনও কিছুই নয়। আমার ধারণা ছিল মিসেস রাই সেটা জানতেন। নিজে সঙ্গে করে আমাকে যখন সেখানে রেখে এসেছিলেন, ফেরার কথা কিছু বলেননি। আর, ছ’দিন আগে আপনারা দু’জনে যখন সেখানে গেছলেন তখনো ফেরার সম্পর্কে কোনো নোট বা ইনস্ট্রাকশন পাইনি।
ফর্সা মুখে অল্প অল্প করে হাসি ছড়াতে লাগল। তুচ্ছ ব্যাপার ঝেড়ে ফেলার মতো গলার স্বর।
ব্যাপারটা তুমি সিরিয়াসলি আর ইমোশনালি নিয়েছ দেখছি। আই অ্যাম রাদার গ্ল্যাড। অলরাইট, ফরগেট ইট। রিপোর্ট দিতে হবে না—বোসো, তোমার সঙ্গে দরকারী কথা আছে।
বাপী বসল। লোকটার আচরণ এভাবে বদলাতে দেখে সতর্কও একটু।
চালিহা স্বভাবসুলভ ব্যস্ততায় খোলা ফাইলটার ওপর সামান্য চোখ বুলিয়ে সেটা সরিয়ে দিল। পাশের দুটো টাইপ-করা চিঠিতে খসখস করে নাম সই করে টেবিলের বোতাম টিপল। বাইরে প্যাক করে শব্দ হতে পনের সেকেন্ডের মধ্যে অ্যাকাউন্টেন্ট হাজির। চিঠি আর ফাইল নিয়ে সে প্রস্থান করতে খুশি মুখে চালিহা কিছু বলার জন্য প্রস্তুত।
—ওয়েল তরফদার এবারে তাহলে তোমাকে একটা সুখবর দিতে পারি। মিসেস রাইয়ের তোমার ওপর সত্যি খুব ভালো ধারণা। আমারও তাই।…আর ইউ হ্যাপি?
বাপী সবিনয়ে মাথা নাড়ল। ঠোঁটে একটু হাসিও টেনে আনলো।
—গুড। সো লেট মি গিভ ইউ এ বিট অফ হার মাইন্ড অ্যান্ড মাইন ট্যু— এরপর বাপী কান পেতে তার বক্তব্য শুনল।…অকটোবরের শেষের দিক এটা। ডিসেম্বরের গোড়ায় চালিহা আসাম সাইডে লং টুরে চলে যাচ্ছে। বছরে দু-আড়াই মাসের জন্য এ সময় প্রতিবারই গিয়ে থাকে। সে-সময় এদিকের সবকিছু মিসেস রাই ম্যানেজ করেন। মাসের অর্ধেকটা তাঁকেও নানা জায়গায় টুরের ওপর থাকতে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে এবারে তিনি কতটা পারবেন বলা যায় না। মনে হয় বাপীর ওপর আরো অনেক দায়িত্ব আসবে। সেই সঙ্গে এখানকার কাজের ব্যবস্থা-পত্রও আস্তে আস্তে বদলাবার কথা ভাবতে হবে তাকে। বানারজুলির জঙ্গলের এ সাইডে কিছু কিছু দরকারী জিনিসের চাষ হচ্ছে। সেটা আরো অনেক বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু এ কাজ জঙ্গলের একজন উটকো লোকের সর্দারির ওপর নির্ভর করে চলবে এটা মিসেস রাই বা চালিহা কারোরই পছন্দ নয়। জঙ্গলের রেঞ্জ অফিসার চালিহার বন্ধুস্থানীয়। বাপীকে একদিন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেবে। লুকোচুরির মধ্যে না থেকে চাষের জমি বা লেবার পাবার ব্যবস্থা সরাসরি তার সঙ্গেই করে নিতে হবে। এর জন্য খরচ যা হয় হবে। মোট কথা নতুন লোক নিয়ে নতুন টিম-ওয়ার্কের প্ল্যান মাথায় রাখতে হবে। সাপ চালানের ব্যবসা সম্পর্কেও একই কথা। এও কোনো একজন মুরুব্বির ওপর নির্ভর করে চলবে না। ফি বছর সাপ যারা ধরতে আসে তাঁদের থেকেই লোক বাছাই করে এই টিম-ওয়ার্কের দিকে এগোতে হবে। তবে শীত তো এসেই গেল, এক্ষুনি এ-দিকটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। অন্য দিকের ব্যবস্থাও ধীরেসুস্থে অর্থাৎ খুব কোয়ায়েটলি করে নিতে হবে—কোনোরকম সোরগোল তোলার দরকার নেই।
বক্তব্য শেষ।—ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড মি?
বাপী হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। যা বলতে চায় তার মধ্যে না বোঝার মতো অস্পষ্ট কিছুই নেই। একটা অসহিষ্ণু প্রতিবাদ ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে। বাইরে তাই আরো নির্লিপ্ত। মুখের দিকে চেয়ে থেকে বোঝার ভান করল। তারপর বলল, মোটামুটি টিম-ওয়ার্কের দিকে আমি এগিয়েছি। রেঞ্জ অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিলে সেটা আরো ভালোভাবে অরগ্যানাইজ করা যাবে, তবে দুটো কাজেরই মুরুব্বি বলতে আবু রব্বানী। আপনারা তাকেই বাতিল করতে চান বোধ হয়?
—এক্ষুনি কিছু করতে চাই না বা কিছু বুঝতে দিতে চাই না। কিন্তু ওই লোককে সামনে রেখে তুমি কত আর এগোতে পারো—আফটার অল হি ইজ এ গভর্মেন্ট সারভেন্ট।
কাগজে কলমে আবু রব্বানীর নাম সামনে বা পিছনে কোথাও নেই। এদিকের বাড়তি উপার্জনের সবটুকুই দুলারির নামে। আবুকে নিয়ে কোন তরফেরই বিপাকে পড়ার প্রশ্ন নেই। যে কারণেই হোক ওকে এখন এরা হেঁটেই দিতে চায় বোঝা গেল। মাত্র পঁচিশ ছাব্বিশ দিনের মধ্যে এরকম মনোভাবের কারণ কি ঘটতে পারে বাপী ভেবে পেল না।
একটু চুপ করে থেকে বাপী বলল, সে-রকম বড় প্ল্যানে যদি কাজ শুরু করি আর টাকা খরচ করতেও যদি আপত্তি না থাকে, আবু রব্বানীকে তাহলে সরকারী কাজ ছাড়িয়ে টেনে নেবার চেষ্টা করা যেতে পারে।…ওর মতো বিশ্বাসী কাজের লোক পাওয়া শক্ত, মিসেস রাইও ওকে পছন্দ করেন।
মন বোঝার জন্য বলা। নইলে আবুর সরকারী চাকরির দরুন এদের সুবিধে ছাড়া অসুবিধে কিছু নেই। কিন্তু প্রস্তাবনা শোনামাত্র বিরক্তি—সি ইজ রাদার ডিসগাসটেড নাও, টেক ইট ফ্রম মি। ওদের চালচলনে উনি এখন বিরক্ত।
বাপী সচকিত। ‘ওদের বলতে চালিহা আবু ছাড়া আর কাকে যুক্ত করল?’
এ-প্রসঙ্গ বাতিল করে চালিহা দরকারী আলোচনার উপসংহারে চলে এলো।—আমাদের মোটামুটি ডিসিশান তোমাকে জানিয়ে রাখলাম, নাও গো অ্যাহেড। টাকা ফেললে কাজের লোকের অভাব হবে না। দু’এক দিনের মধ্যে রেঞ্জ—অফিসারের সঙ্গে আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখছি। নাও ফর দি টাইমবিইং এভরিথিং ইজ ভেরি ভেরি কনফিডেনসিয়াল—মাইন্ড ইউ।
রণজিৎ চালিহা এ-দিন লাঞ্চ টাইম অর্থাৎ একটার আগে তার আপিস ঘর ছেড়ে নড়ল না। কর্ত্রী এখানে না থাকার দরুন কিছু বাড়তি দায়িত্ববোধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
নিজের ঘরে বসে বাপী মুহুর্মুহু ঘড়ি দেখছে। তার ওঠার অপেক্ষায় আছে। যে উৎসাহ আর তাজা মন নিয়ে পাহাড় থেকে ফিরেছিল সেটা আচমকা একরাশ কালীবর্ণ মেঘের তলায় চাপা পড়ে গেল। এই কটা দিনের মধ্যে সে-রকম কিছুই ঘটে গেছে। নইলে আবুর ওপর হঠাৎ এত বিরূপ কেন এরা?…শুধু আবুর ওপর নয়, আরো কারো ওপর। দুলারি কারো সাতে-পাঁচে থাকে না। সে নয়।
…তাহলে রেশমা!
একটু চিন্তা করলে পাকা মাথায় সোজা অঙ্কের ফল ঝপ করে সামনে এগিয়ে আসে। বাপীর চোখের সামনেও সেই গোছের একটা নির্ভুল উত্তর দুলতে লাগল। আবু রব্বানী বা রেশমা এদের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছে বটে, কিন্তু বিনিময়ে উপকার এরাও কম পাচ্ছে না। এই লেন-দেনের ফাঁকে উদারতার ঠাঁই নেই। তবু ওদের ছেঁটে দেবার মতলব। ও-দিকে বানারজুলি ছেড়ে নড়ার নামে যে মেয়ের চোখে আগুন নামে, তাকে নিয়ে কর্ত্রী উধাও। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ভিন্ন আর কিছুর যোগ কিছু থাকতে পারে না—পারেই না।
বুকের তলায় মোচড় পড়ছে। ক্ষত-বিক্ষত মন নিয়ে বানারজুলিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে এই আবু রব্বানী খুশিতে আটখানা হয়ে তাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। বলতে গেলে ওর জন্যেই ভাগ্যের ভিন্ন বৃত্তে পা ফেলা সম্ভব হয়েছে। আজ মুরুব্বী হয়ে সবার আগে যদি ওরই বুকে থাবা বসাতে হয় তাহলে বাপী কি করবে? বসাবে?
—কি করবে জানে না।
জঙ্গল ভেঙে বাপী সোজা আবুর ডেরায়। জঙ্গলের এই সোজা পথও লম্বা লাগছিল। এ-সময় আবু খেতে আসে। নিরিবিলিতে পাওয়ার সম্ভাবনা। বাইরের দাওয়ায় দুলারি বসে। ওকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। হাতে চাঁদ নাগাল পাওয়ার মুখ।—তুমি এসে গেছ বাপীভাই! এদিকে যে জান্ ঠোটে নিয়ে তোমার অপেক্ষায় বসে আছে।
ঘরে ঢুকে একটু চেঁচিয়ে জানান দিল, বাপীভাই এসেছে! একটা চাটাই হাতে বেরিয়ে এলো।—দস্যি দুটো ঘুমোচ্ছে, এখানেই বোসো—গোসলে গেছে, বেরুলো বলে।
হালকা শীতের মিষ্টি রোদে পিঠ দিয়ে বাপী চাটাইয়ের ওপর বসল। আর তক্ষুনি প্রায় ভেজা গায়ে আবু হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো। ভালো করে একপ্রস্থ দেখে নিল, তারপর গলার স্বরে ক্ষোভ ঝরল।—আমরা ভাবলাম বিবাগী হয়ে পাহাড় থেকে আর কোথাও চলেটলে গেলে।
বাপীর সাদা-মাটা মুখ।—বিবাগী হতে যাব কোন্ দুঃখে। দুলারিকে বলল, ওকে একটা গামছা এনে দাও, গা-মাথা মুছে ফেলুক—
দুলারি ভিতরে যেতে যেতে বলল, যে রকম তেতে আছে গা-মাথার জল আপনি টেনে যাবে—
পরনের লুঙ্গি কোমরের দু’দিকে একটু গুঁজে আবু চাটাইয়ে বসে পড়ল।— একলা এলে, না ঠাকরোনও এলেন?
—ঠাকরোন কোথা থেকে আসবেন?
—কেন? তারা পাহাড়ের বাংলোয় যায়নি? আবু যথার্থ অবাক।
দুলারি গামছা, ফতুয়া আর আয়না চিরুনি হাতে বেরিয়ে এলো। কিন্তু আবুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, বাপীকেই দেখছে। সন্দিগ্ধ চাউনি।
—উনি পাহাড়ের বাংলোয় গেছেন ভেবেছিলে?
—তাছাড়া আর কোথায় যেতে পারে ভাবব! পাহাড়ে যাননি মোটে?
—না।
—তোমার সঙ্গে দেখাই হয়নি?
— না।
হাত বাড়িয়ে আবু দুলারির হাত থেকে ফতুয়াটা টেনে নিয়ে গায়ে চড়ালো। তারপর চিরুনি হাতে নিতে দুলারি একটু ঝুঁকে আয়নাটা তার মুখের সামনে ধরল। পরিপাটি করে মাথা আঁচড়ানো আবুর ছেলেবেলার বিলাস। এখনো সেই গোছের মনোযোগ। কিন্তু আড়চোখে বাপী দুলারির মুখখানা দেখছে। গম্ভীর হলেও শামলা মুখে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া লেগে আছে। কে বলবে এই মেয়ে বানারজুলির পথে পথে ঘুরে সাপ খেলা দেখাতো, হাঁটু মুড়ে বসে ক্রুদ্ধ ফণা তোলা সাপের ছোবল খাবার উত্তেজনায় বারবার ভুঁয়ের ওপর হাত পেতে দিত। কেন যেন তখন রেশমার থেকেও এই দুলারিকেই বেশি ভয়াবহ মনে হত বাপীর। সেই মেয়ে এখন ঘরের লোকের মুখের সামনে আয়না ধরে আছে, আর মন দিয়ে মাথা আঁচড়ানো দেখছে।
আয়না চিরুনি গামছা নিয়ে দুলারি ঘরে চলে গেল। ওর বোধ হয় যেতে দেবার তাড়া এখন। একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে আবু বলল, দুলারি এর পর একহাত নেবে আমাকে।
— কেন?
—বার বার করে ও আমাকে পাহাড়ে তোমার কাছে চলে যেতে বলেছিল।…আমি বুদ্ধুর মতো ভেবে বসে আছি মেয়ে নিয়ে মেমসায়েব ওখানে চলে গেছে, আর তোমার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছে।
—কিসের শলা-পরামর্শ?
—তুমি কিচ্ছু জানো না—না?
—কি করে জানব। কাল বিকেলে ফিরে দেখি তোমার মেমসায়েবের বাংলো তালা-বন্ধ।
—ওই ম্যানেজার তো এখানে আছে, সে কিছু বলেনি?
—তার মেজাজ গরম দেখছি।
আবুর ছোট ছোট চোখ দুটো ছুরির ফলার মতো চকচক করে উঠল।—গরম কার ওপর, শুধু রেশমার ওপর না আমার ওপরেও?
—তোমার ওপরেই বেশি!
শোনামাত্র শিরদাঁড়া সোজা।—আমার ওপরেই বেশি? ও-শালার মেজাজের গরম আমি ছুটিয়ে দেব বলে দিলাম তোমাকে—আমার পিছনে লাগতে এলে ওর টুটি ছিঁড়ে না আনি তো আমার নামে কুকুর পুষো!
দু’হাতে দুটো থালা নিয়ে দুলারি দরজার বাইরে এসে থমকে দাঁড়ালো। তারপর ধমকের সুরে বলে উঠল, থাক, গলা ফাটিয়ে আর বেশি বাহাদুরি করতে হবে না। খেতে খেতে ঠাণ্ডা মাথায় বাপীভাইকে সব বলো আগে কি হয়েছে না হয়েছে—
বড় থালাটা আবুর সামনে রাখল, ছোটটা বাপীর সামনে। আবুর থালায় এককাড়ি গরম ভাত, আর ছোট-ছোট বাটিতে ডাল-তরকারি মাছের ঝোল। বাপীর থালায় তিনখানা পরোটা, একবাটি তরকারি।
আবুকে হাল্কা মেজাজে ফেরানোর জন্য খুশিমুখে বাপী নিজের থালা কাছে টেনে নিয়ে ওর বিবির প্রশংসা করল।—এরই মধ্যে এত সব, তুমি কি ম্যাজিক জানো নাকি!
দুলারি জবাব দিল, ছেলে দুটোর জন্যে করে রাখতে হয়, উঠলেই খাই-খাই করে।…তোমার রুচলে হয়।
শেষের তিন কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন খোঁচা আছে একটু। দুলারির হাতের খাবার এ-যাবৎ অনেক খেয়েছে। শেষের এই কটা মাস সে সুযোগ হয়নি।
তিরিক্ষি মেজাজে আবু ভাতের ওপর ডাল ঢেলে নিয়ে গপাগপ কয়েক গরাস খেয়ে নিল। তারপর দুলারির দিকে চেয়ে অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, আগে খাওয়ার গল্পটাই হোক তাহলে—
দু’হাত দূরে গালে হাত দিয়ে খাওয়া দেখতে বসেছে দুলারি। তেরছা চোখে ওর দিকে একবার তাকালো শুধু। বাপী বলল, সব শুনে আগে মাথা ঠাণ্ডা করো—
রণজিৎ চালিহার সঙ্গে কথা হবার পর থেকে একটা চাপা অস্বস্তি বাপীর ভিতরেও ছেয়ে আছে। শোনার তাগিদেই ছুটে আসা। হেসেই আবুর দিকে ফিরল।—এত গরম হবার কারণটা কি…বিজয় মেহেরা?
খাওয়া ফেলে আবু সাগ্রহে আধখানা ঘুরে বসল।—তবে যে একটু আগে বললে তুমি কিচ্ছু জানো না?
—কেউ কিছু বলেনি। মেয়ে নিয়ে তোমাদের মেমসায়েবকে সরে পড়তে দেখে আর তোমার মেজাজ দেখে সেদিক থেকেই কোনো অঘটন ঘটেছে মনে হচ্ছে।
—তোমার মনের পায়ে গড় করি। ওই শালার ম্যানেজার মেমসায়েবের মেয়ের পিছনে চর লাগিয়ে রাখতে পারে এও তোমার মনে হয়েছিল?
বাপী জবাব দিল, একবার হাতে-নাতে ধরেছে যখন, রাখতে যে পারে মনে হওয়ারই কথা।
—কথা তো আমাকে তুমি একটু সাবধান করে দাওনি কেন, ওই হারামীর বাচ্চার কলে তাহলে এ-ভাবে পড়ি!
দুলারি ধমকে উঠল, ফের গাল পেড়ে কথা!
আবু খেঁকিয়ে উঠল, আমি ভদ্রলোকের ছেলে নই!
—ভদ্রলোকের ছেলের সঙ্গে কথা কইছ!
একটা হাত তুলে বাপী দুলারিকে নিরস্ত করল।—বলতে দাও, অমন ঢের শুনেছি। আবুর দিকে ফিরল।—তুমি এ ব্যাপারে জড়াবে বা তোমাকে সাবধান করার দরকার হবে জানব কি করে?
আমি জড়াইনি। আমাকে জড়ানো হয়েছে।
খাওয়ার ফাঁকে এরপর ঘটনার যে চিত্র সংগ্রহ করা গেল, তার সবটুকু নিখাদ সত্য হলে আবু পাকে-চক্রে জড়িয়ে পড়েছে সন্দেহ নেই।
…বাপী পাহাড়ে চলে যাবার পর রেশমা আবুকে দু’তিন দিন বলেছে, তার মেমদিদি বনমায়ার পিঠে চড়তে চায় লছমনকে বলে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। হাতির পিঠে চেপে একটু-আধটু বেড়ানো নয়, একদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বনমায়াকে চাই মেমদিদির। যতদূর ইচ্ছে যাবে, যতক্ষণ খুশি বেড়াবে। অনেকদিন আগে বাপী ভাইয়ের সামনেই নাকি এরকম বেড়ানোর কথা হয়েছিল। এরপর আবু একদিন কি দরকারে মেমসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে আগে-ভাগে তার মেয়ে এসে জানালো, ওমুক ছুটির দিনে বনমায়াকে চাই-ই তার।
ছুটির দিনে জঙ্গলের হাতির খোঁজ বড় একটা পড়ে না। লছমনের সঙ্গে কথা বলে আবু ব্যবস্থা পাকা করে দিল। আর সেই ছুটির দিনে বনমায়ার পিঠে রেশমা আর মেমদিদিকে তুলে নিয়ে আবুর নিষ্কৃতি।
সন্ধ্যার পর মাথায় বজ্রাঘাত। ম্যানেজার চালিহা সায়েব লোক দিয়ে আবুকে ঘর থেকে তার বাংলোয় ডেকে পাঠাতেও আবুর মনে কোনো কু-ডাক দেয়নি। ভেবেছিল ভালো বোতল-টোতলের খোঁজে ডেকেছে। কিন্তু গিয়ে চক্ষুস্থির। বাংলোর গেটে মেমসায়েবের ভ্যান। বারান্দায় ম্যানেজারের পাশে মেমসায়েব বসে। সাদা পাথরের মতো শক্ত মুখ। আর হাড়-পাঁজরে ছুরি চালানোর মতো চোখ। গিয়ে দাঁড়াতেই ওই ম্যানেজার এমন জেরা শুরু করে দিল যেন আবু খুনের আসামী। জেরায় জেরায় জান জেরবার। ফরেস্টের হাতি কার হুকুমে চলে, বাইরের কোনো পার্টির বেড়ানোর জন্য সেই হাতি বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য কাউকে ছেড়ে দেবার এখতিয়ার হেট বীটম্যান হিসেবে আবু রব্বানীর আছে কি না। না যদি থাকে তাহলে আবু এ-কাজ করল কি করে? হাতি চড়ে বেড়ানোর কথা মিসিসায়েব বলেছে না রেশমা বলেছে, কোথায় বেড়াতে যাবে বলেছে, হাতি নিয়ে কোথায় তারা যাচ্ছে আবু যে করেই হোক আগে থাকতে তা জানত কিনা, রেশমা কোন রকম আভাস তাকে দিয়েছিল কি না—এমনি জেরার পর জেরা। হকচকিয়ে গেলেও আবু মোটামুটি সত্যি জবাব দিয়েছে। আর মেমসায়েব একবারও চোখের পাতা না ফেলে সত্যি-মিথ্যে ওজন করেছে।
মেমসায়েবের মন বোঝা আবুর কম্ম নয়। ম্যানেজার সায়েব যে খুশি হয়নি বা বিশ্বাস করেনি সেটুকু স্পষ্ট বোঝা গেছে। ওকে শাসিয়েছে, সত্যি কথা না বললে ফ্যাসাদে পড়তে হবে, মেমসায়েব বেইমানি বরদাস্ত করবে না।
জবাবে আবু আল্লার কসম খেয়েছে। কিন্তু ওই চালিহার ওকে কলে ফেলে কিছু স্বীকার করিয়ে নেবার মতলব। এভাবে হাতি ব্যবহার করার জন্য ওর নামে জঙ্গলের বড় কর্তার কাছে রিপোর্ট করা হবে বলে হুমকি দিল।
যতই হাঁসফাস দশা হোক আবুর, চাকরির গায়ে কাদা ছোঁড়ার কথা শুনলে তার মেজাজ ঠিক থাকে না। তাছাড়া যা-ই থাক মেমসায়েবের মেয়েকে যে জঙ্গলসায়েবের কাছে এনে দাঁড় করানো যাবে না এটুকু বুদ্ধি আবুর আছে। মেজাজ খারাপ হতে মোলায়েম করে সে-ও তেরছা জবাব দিয়েছে। বলেছে, মিসিসায়েব জানে ও নির্দোষ, রিপোর্ট হলে উনি এসে জঙ্গলসায়েবের কাছে যদি সব স্বীকার করেন তাহলে ওর চাকরির ক্ষতি হবে বটে। তা না হলে কিছুই হবে না। আবু রেশমা বা লছমন মাহুত কিছুই স্বীকার করবে না, আর চেষ্টা করলেও বনমায়াকে দিয়ে কিছু কবুল করানো যাবে না।
মেমসায়েবের সঙ্গে কাজের সম্পর্কের বারোটা বেজে গেছে ধরে নিয়েই আবু রাগের মাথায় আর ঝোঁকের মাথায় অমন কথা বলে এসেছে। সারাক্ষণের মধ্যে মেমসায়েব টুশব্দও করেনি। নড়ে-চড়ে বসেনি পর্যন্ত। কেবল দেখেছে আর দেখেছে।
ছাড়া পেয়ে আবু প্রথমে ছুটে এসেছে লছমনের কাছে। বনমায়া জায়গা মতো বাঁধা ছিল কিন্তু লছমনের টিকির দেখা পেল না। সেখান থেকে সোজা রেশমার ডেরায়। অন্ধকারে ভূতের মতো বাইরে বসে ছিল তার সাপ ধরার সাগরেদ হারমা। সে জানিয়েছে, রেশমা ঘরে নেই। তার খোঁজে মেমসায়েব দু’-দুবার লোক পাঠিয়েছিল।
রাগে জ্বলতে জ্বলতে আবু ঘরে ফিরেছিল। দুলারির সঙ্গে রেশমা দিব্বি খোশগল্প করছে বসে। দাঁত কড়মড় করে আবু ওকে বলেছে, এখানে পালিয়ে থাকলে জান বাঁচবে?
রেশমা পাল্টা চোখ পাকিয়েছে, তুমি বেঁচে থাকতে আমার জান বাঁচবে না, কেমন মরদ!
এই মেয়ে হম্বি-তম্বির ধার ধারে না। আবুর যা জানার ঠাণ্ডা মাথায় জেনে নিল।
…বনমায়ার পিঠে চেপে এখান থেকে ছ’মাইল পথ বানারহাটে গেছল ওরা। সেখানে এক জায়গায় হাতি থামিয়ে মেমদিদি কোথায় নেমে গেছল। ঘণ্টা দুই বাদে ফিরে এসে আবার বনমায়ার পিঠে চেপে চলে এসেছে।
আবু খেঁকিয়ে উঠেছিল, হাতির পিঠ থেকে নেমে মেমদিদি দু’ঘণ্টার জন্য কোথায় গেছল তুই জানিস না?
রেশমা মুখ মুচকে জবাব দিয়েছে, মেমসায়েব জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে কিচ্ছু জানি না।
তারপর রেশমা বলেছে, ম্যানেজার চালিহা মেমদিদির পিছনে চর লাগিয়ে রেখেছে সেটা ও বানারহাটে হাতির পিঠে দু’ঘণ্টা বসে থাকার সময় টের পেয়েছে। সাইকেলে চেপে একটা লোক আশপাশে ঘুরঘুর করছিল আর ওর দিকে চেয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছিল। রেশমা প্রথমে ভেবেছিল ফষ্টিনষ্টির মতলব। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, লোকটাকে বারকয়েক বানারজুলির রাস্তায় আর জঙ্গলে দেখেছে—ওর ডেরার আশপাশ দিয়েও যাতায়াত করতে দেখেছে। তার মিনিট দশেক বাদে মেমদিদি ফিরল যখন, তখন ওই লোকটা পনের গজ দূরে সাইকেলে বসে আর একটা থামে ঠেস দিয়ে এদিকে চেয়ে সিগারেট টানছিল। রেশমা লোকটাকে দেখিয়ে সন্দেহের কথা বলতেই মেমদিদি বিষম চমকে উঠল। মনের মানুষের সঙ্গে যতক্ষণ মেমদিদি বাইরে ছিল, তার প্রায় অর্ধেক সময় ওই লোকটা নাকি তাদের সামনে পিছনে সাইকেলে ঘুরঘুর করছিল! তারা দু’জনেই ওকে দেখেছে আর রসের খোরাক পেয়ে অমন করছে ভেবে বিরক্ত হয়েছে।
বনমায়া চলতে শুরু করতেই লোকটা সাইকেলে সাঁই সাঁই করে আবার বানারজুলির পথে এগিয়ে গেছে।
….রেশমা আর সাহস করে মেমদিদির সঙ্গে বাংলো পর্যন্ত যায়নি। আগেই নেমে অপেক্ষা করছিল। লছমনের মেমদিদিকে ছেড়ে ফিরে আসতে দেরি দেখেই বুঝেছে, ফাঁস যা হবার হয়ে গেছে। লছমন ফিরতে শুনল, ম্যানেজার চালিহা চোখ রাঙিয়ে তাকে অনেক জেরা করেছে। তারপর আর নিজের ঘরমুখো না হয়ে রেশমা গা-ঢাকা দিয়ে আছে। মেমদিদি ওকে সেই পরামর্শই দিয়ে রেখেছিল। আর বলেছিল, ও যেন কিছু জানে বলে কক্ষনো স্বীকার না করে। ওকে হাতির পিঠে বসে থাকতে বলা হয়েছিল, তাই বসেছিল। ও জানে মেমদিদি তার এক মেয়েবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছে—ব্যস। আর কিচ্ছু জানে না।
মেমসায়েবের জেরার মুখে রেশমাকে দাঁড়াতে হয়নি। পরদিনই মেয়ে নিয়ে উনি হাওয়া। ম্যানেজার সায়েব রেশমাকে আপিসে জেরা করেছে। তার বদ্ধ ধারণা, এই ষড়যন্ত্র অনেক দিনের আর এর মধ্যে আবু রব্বানীও আছে। কিন্তু রেশমার মুখ থেকে কোনো কথা বার করতে পারেনি। আপিস ঘরে রেশমাকে প্রায় ঘণ্টা-খানেক আটকে রেখেছিল চালিহা। চোখ দিয়েই ‘সব্ব অঙ্গ’ চেটেছে ওর। মেমসায়েব নাকি এখানকার কাজ থেকে ওকে ছাড়িয়ে দিতে হুকুম করে গেছে। এ হুকুমের আর নড়চড় হবে না। কিন্তু এতবড় ক্ষতি হোক ওর, চালিহা সেটা চায় না। রেশমার মতো সাহসী সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী মেয়ে ইচ্ছে করলে ব্যবসার অন্য কাজে লাগতে পারে। এরকম কিছু মেয়ে দরকার সেটা মেমসায়েবও জানে। রেশমা এ-জায়গা ছেড়ে চলে যেতে রাজী হলে তার আপত্তি হবে না। ডিসেম্বরের গোড়ায় দু’ মাসের জন্য চালিহা আসাম যাচ্ছে। সেখানে কাজের মেয়ে দরকার আপাতত। রেশমা তার সঙ্গে যেতে রাজী হলে ওর সেখানে ভালো থাকার ব্যবস্থা সে-ই করে দেবে। এখানকার থেকে ঢের ভালো থাকতে খেতে পরতে পাবে। টাকা তো বেশি পাবেই। বিলকুল হালকা কাজ। চালিহার যে লোকেরা সেখানে কাজ করছে তাদের যোগসাজশে দোকান হোটেল-রেস্তোরাঁ বা অন্য রইস খদ্দেরদের কাছে মাল পৌঁছে দেওয়া। তারপর হেসে হেসে বলেছে, মালকানের কোপে পড়ার ফলে আখেরে ওর লাভ হবে, দিন ফিরবে। ওর মতো মেয়ের জঙ্গলে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না।
আবুর বলা শেষ। বাপী জিজ্ঞাসা করল, রেশমা কি বলেছে?
—কি আর বলবে। ও কম বজ্জাত? গেলে কাজ দেবে জানে, কিন্তু ও-শালার আসল মতলব কি আর জানে না? চোখের বাণে বাণে ওই দিনে দুপুরেই ওকে যতটা পারে বিঁধেছে, আর বলেছে, এত বড় ম্যানেজার সায়েবের যে এত দয়া ওর ওপর জানত না। তারপর আব্দার করেছে, শীতে ওর সাপ ধরার দিন গেল, আবু রব্বানীর সাগরেদি করে মাসে যে পঞ্চাশটি করে টাকা পায় ডিসেম্বর পর্যন্ত সে—টাকাও না পেলে খুব মুশকিলে পড়ে যাবে। দয়ার অবতার ম্যানেজারের পায়ের ওপর উপুড় হতে গেছল পর্যন্ত ওই পাজি মেযে। শালা তখন ওর দু’কাঁধ খামচে ধরে মজা করে টেনে তুলেছে আর তার দু’চোখ দিয়ে গলগল করে লোভ ঠিকরেছে—
—থামো! হাসি চেপে দুলারি ধমকে উঠল।
—থামব কেন? রেশমা নিজের মুখে তোমাকে এসব কথা বলে যায় নি?…আর ম্যানেজার লোভে গলে-গলে ওকে কথা দেয় নি, চেষ্টা করবে—তবু না যদি পারে দুটো মাস পঞ্চাশটা করে টাকা নিজের পকেট থেকেই দিয়ে দেবে?
সব বলার পর আবুর আর দুলারিরও বাপীভায়ের মন বোঝার ইচ্ছে ছিল। কিছু না বলে উঠে আসায় হয়তো একটু বেজারই হয়েছে। কিন্তু গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে দেখা বা কথা না হওয়া পর্যন্ত বাপী কোন্ আশার কথা শোনাতে পারে ওদের। আবুর সম্পর্কে চালিহার মতলব শুনলে তো ওদের পিত্তি জ্বলবে আর অশান্তি বাড়বে।