সেই অজানার খোঁজে – প্রথম খণ্ড : 04
আমার কোন্নগর যাতায়াতের একটা বছর ঘুরে গেল। যে ছুটি মানুষকে কেন্দ্র করে এখানে অনেক মুখের মিছিল, তাঁদের একজন মাতাজী, অন্যজন অবধূত। অপরের চোখে যাঁরা গড-ম্যান বা গড-মাদার, তাঁদের প্রতি আমার একটা প্রতিকূল মনোভাব ছিল। কারণ নিজের ব্যথার জায়গায় তাদের কারো আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি কোনো কাজে লাগেনি। উল্টে আমাকে হতাশা আর বিভ্রমের অন্ধকারে ঠেলেছে। কিন্তু এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে আসার ফলে আমার মনোভাব কিছুটা বদলেছে।… মনে হয়েছে, এই পথের সকলেই নিজেদের গডম্যান বা গড-মাদার ভাবেন না। কালীকিংকর অবধূত আর মাতাজী অন্তত ভাবেন না। অবধূত তাঁর সাধ্য মতো মানুষের বিপদ আপদ নিরসনের পথ খোঁজেন। ব্যাধির হদিস পেলে ওষুধ দেন। অন্য-রকম আপদ বিপদে যাঁর যাঁর স্বভাব চরিত্র তলিয়ে দেখে নিয়ে আর বুঝে নিয়ে তাকে নিজের মনের ঘরে আর বিশ্বাসের ঘরে ফেরাতে চেষ্টা করেন। ফল যারা পায় তারা যদি তাঁকে গড-ম্যানের আসনে বসিয়ে পুজোই করে—সেটা তাঁর অপরাধ নয়।
…মাতাজীরও তাই! মানুষের মঙ্গল লক্ষ্য। সেই মঙ্গল যদি ভক্তি বিশ্বাসের ভিতর দিয়েই আসে, তাকে তুচ্ছ ভাবার কারণ নেই। নিজে যে তিনি এমন স্থির শান্ত সুন্দর— জীবনের মহিমার এ-ও তো একটা দিক। এত ধৈর্য এত সহিষ্ণুতা তিনি পেলেন কোথা থেকে? পরিপূর্ণতার মধ্যেও এমন সহজাত নির্লিপ্ততার শ্রী হাজারে একজনের মধ্যে কি দেখা যায়? একান্নোতেও অনায়াসে যিনি একত্রিশের রূপ ধরে রাখেন, তাঁর অন্তরের ঐশ্বর্য মানুষকে টানবে এ বেশি কথা কি?
অবধূত হেসেই একদিন বলেছিলেন, আপনার চোখে পড়েনি বলেই এখনো মান বাঁচছে। লেগে থাকলে দেখবেন ভণ্ড জোচ্চোর ঠক-বাজ এইসব ভালো ভালো কথা আমাদেরও শুনতে হয়—আমাদের সব থেকে বড় দোষ আমরা ভগবান নই।
এতটা না হোক, একটা মজার ব্যাপারের সাক্ষী আমি নিজেই। সেদিন কালীপুজো। পথের বাজীর সংকট এড়াতে আমরা বিকেপের মধ্যেই কোন্নগর চলে এসেছি। আমরা বলতে স্ত্রী আর মেয়েও সঙ্গে। আজ রাতে আর ফেরার প্রশ্ন নেই। কারণ পুজো শেষ হতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে। আমি এই পুজো-পার্বণের খুব সমঝদার নই। মাতাজীর বিশেষ অনুরোধে আর স্ত্রীর আগ্রহে এসেছি। তাছাড়া অবধূত বলেছেন, আমিও আপনার মতোই দর্শক এ-দিন, পুজো মাতাজীর —আসবেন, আমরা না হয় গল্প-সল্প করব।
এটুকু লোভনীয়।
মাতাজীর পুজোর এক বিশেষ ব্যতিক্রম দেখলাম। পুজো শুরু হবে রাত এগারোটার পরে। আমন্ত্রিতের সংখ্যা কম করে পঞ্চাশজন। পুজোর আগে সক্কলকেই বেশ করে খাইয়ে দিলেন। খাওয়ার আয়োজন খুবই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু পরম উপাদেয়। পোলাও, মাছ ভাজা, মাংস আর চাটনি। নিরামিষাশীদের পোলাও বেগুন ভাজা ছানার ডালনা আর চাটনি। মাতাজীর যুক্তিটি সুন্দর। মায়ের পুজো, আর তাঁর ছেলে-মেয়েরা সমস্ত রাত মুখ শুকিয়ে পুজোয় অংশ নেবে-এ কি কোনো মা চাইতে পারেন? তাই সকলকেই আগে খেয়ে নিতে হবে।
অবধূত আমার কানে কানে কিছু বললেন। আমি উঠে গিয়ে একটা কথা আছে বলে মাতাজীকে একদিকে ডেকে নিয়ে বললাম, মায়ের এমন পুজোই সর্বত্র চালু হওয়া উচিত—কিন্তু পুজোর আগে সক্কলকে খাইয়ে আপনি নিজেও খেয়ে নিচ্ছেন তো?
হেসে ফেললেন৷—আপনার বন্ধু উসকে দিয়েছেন বুঝি? আর গুণ নেই ছার গুণ আছে—কোনো অমাবস্যা বা পূর্ণিমার রাতে আমি খাই কিনা জিগ্যেস করে আসুন তো!
খেতে বসার আগে অবধূত এক প্রৌঢ় দম্পতীর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। গলা খাটো করে বললেন, একটু খোরাক পেতে চান তো ওঁদের, বিশেষ করে ওই মহিলার ওপর নজর রাখুন—লোকের মধ্যে ওই মহিলাই কেবল আমার স্ত্রীটিকে বরদাস্ত করতে পারেন না—আবার তাঁর ভদ্রলোককে আঁচল-ছাড়াও করতে পারেন না।
বছর ছাপ্পান্ন সাতান্ন হবে ভদ্রলোকের বয়েস, আর তাঁর স্ত্রীটির হয়তো পঞ্চাশ বাহান্ন। মহিলা এককালে বেশ সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়। এখন বয়সের ছাপ একটু বেশি স্পষ্ট। সেটুকু ঢাকার প্রয়াসে পরিপাটি প্রসাধন খুব সুচারু মনে হলো না। শুনলাম তাঁরা শ্রীরামপুরে থাকেন। অবস্থাপন্ন পরিবার। মাতাজীর প্রতি ভদ্রলোকের গদগদ ভক্তি। তিনি একলাই শিষ্য। কারণ তাঁর পরিবারটির বুদ্ধি-বিবেচনা এ-সবের অনেক ঊর্ধ্বে। মাতাজীর প্রতি স্বামীর এত ভক্তিশ্রদ্ধা তিনি খুব সরল চোখে দেখেন না। তাঁর ধারণা, স্বামীর রূপের টানই বড় টান। শুধু স্বামীর কেন, পুরুষ ভক্তদের সকলেরই। নইলে আদিখ্যেতা করে কেউ এখানে দীক্ষা নিতে আসে? বিশ্বস্তজনদের এই নিগূঢ় সত্যটা তিনি স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই বিশ্বস্তজনেরা আবার কানে আঙুল দেবার মতো করে শুনে মাতাজীর গোচরে এনেছেন। তাঁদের মতে স্ত্রী যাঁর এমন, সেই শিষ্যকে মাতাজীর বাতিল করাই উচিত। অবধূতের মন্তব্য, মহিলা ষোল আনা ভ্রান্ত এ-কথা বলা যায় না। সৃষ্টির জগতে ফুলের রূপ আর রমণীর রূপে খুব তফাৎ নেই। যাকে টানার, দুই-ই টানে।
…ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা আমাদের থেকে আট-দশ হাত তফাতে পাশাপাশি খেতে বলেছেন। পেটো কার্তিক আর তার বন্ধুরা যোগান দিচ্ছে। মাতাজী নিজে পরিবেশন করবেন। সেই ভদ্রমহিলা চারদিকে একবার চোখ চালিয়ে নিয়ে সকলের শোনার মতো করেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন, মায়ের পুজোর আগে সকলকে খেয়ে নিতে হবে এটা কি কোনো শাস্ত্রের নির্দেশ না মাতাজীর নিজের নির্দেশ?
তাঁর ভদ্রলোকটি হাঁসফাঁস করে উঠলেন, মাতাজীর নির্দেশ মানেই শাস্ত্রের নির্দেশ।
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে মহিলা জবাব দিলেন, এত ভক্তি-বিশ্বাস তোমার থাকতে পারে—সকলের না-ও থাকতে পারে।
তক্ষুণি আর এক দিক থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, না থাকলে আমরা খেতে বসে গেলাম কেন?
মহিলা সেদিকে তাকালেন শুধু। জবাব দিলেন না, কিন্তু তাঁর চোখের ভাষা প্রাঞ্জল। অর্থাৎ, কোন্ টানে এসে জুটেছে আর কেন খেতে বসে গেলে তা-ও বলে দিতে হবে?
এবারে আর এক মহিলা হালকা হেসে বললেন, শুধু আমরা কেন—আপনিও তো বসেছেন…।
ঈষৎ ঝাঁঝালো জবাব, আমি ভক্তি বিশ্বাসের কদর বুঝি না তাই অনায়াসে বসতে পেরে গেছি—কিন্তু আপনাদেরও কি তাই? জানতে কৌতূহল হলো তাই মাতাজীকে শাস্ত্রের কথা জিগ্যেস করেছি—তাতে আপনাদের আপত্তি কেন?
যাঁকে নিয়ে কথা সেই মাতাজী কিন্তু হাসছেন আর বেশ মজাই পাচ্ছেন। প্রসঙ্গ একটু তপ্ত হয়ে উঠছে মনে হতে তাড়াতাড়ি বললেন, না মা, এটা কোনো শাস্ত্রের নির্দেশ নয়, মায়ের ছেলে মেয়েরা উপোস করে মাকে ভোগ খেতে দেখবে এ আমার ভালো লাগে না বলেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু ভদ্রমহিলা যেন ফোঁড়ন কাটার আরো বেশি সুযোগ পেলেন।
—মাতাজীদের ব্যবস্থায় তাহলে শাস্ত্রের ব্যবস্থা বদলে যেতে পারে? মাতাজীর সুন্দর মুখ তেমনি সপ্রতিভ।—আপনার যে গোড়াতেই একটু ভুল হয়ে যাচ্ছে মা—শাস্ত্রে খেয়ে পুজোর কথাও নেই, না খেয়ে পুজোর কথাও নেই—মানুষের অভিরুচিটাই সংস্কার আর নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে। আপনি তো নিজেও সংস্কার মানেন না, তাহলে আর আপত্তিটা কি?
মুখ লাল করে ভদ্রমহিলা পোলাওয়ে হাত দিলেন। পাশ থেকে তাঁর ভদ্রলোক বিড়বিড় করে কি বলছেন শুনতে পেলাম না। জবাবে মহিলা রুষ্ট নেত্রে একবার তাঁর দিকে তাকালেন শুধু না, রাত জেগে কালীপুজো কখনো দেখিনি। এই রাতে দেখছি। ভক্তি শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়েছি তা নয়। মাতাজীর পুজোর নিষ্ঠা আর সাবলীল নমনীয়তাটুকুই দেখার মতো।
মাঝের মস্ত হল ঘরে পুজোর আয়োজন। দেয়ালের কাছে ছোট্ট দক্ষিণা কালীমূর্তি। সামনে নানা সরঞ্জাম, ভোগ-সামগ্রি। মাঝখানের লাল আসনে মাতাজী। তাঁর পিছনে বৃত্তাকারের প্রথম দুই সারিতে মেয়েরা বসেছেন। তাঁদের পিছনে তেমনি বৃত্তাকারে পুরুষেরা। ঘরে তিনটে আলো জ্বলছে। অবধূত খুব মিথ্যে বলেন না হয়তো। পুজো দেখতে বেশি ভালো লাগছে কি পূজারিণীকে নিশ্চয় করে বলা শক্ত। অর্চনার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর ক্রিয়াকলাপ, নড়া-চড়া, অর্ঘ্যদান সবই যেন ভারী সুলোলিত ছন্দে বাঁধা। …প্রথম সারিতে শ্রীরামপুরের সেই বিগত যৌবনা রূপসী ভদ্রমহিলাও বসে। লক্ষ্য করছি মাঝে মাঝে তাঁর ঢুলুনি আসছে। পিছনে তাঁর স্বামী রত্নটি যেখানে তদগতচিত্ত বিগলিত—তাঁকে ফেলে তিনি নড়েনই বা কি করে? এক-আধবার পিছন ফিরে তাঁর ভাববিহ্বল মুখখানা দেখে নিচ্ছেন। অবধূতের আধঘণ্টা অন্তর সিগারেটের তৃষ্ণা। তিনি উঠে উঠে যাচ্ছেন। এক-একবার আমিও তাঁর সঙ্গ নিচ্ছি। পাঁচ-সাত-দশ মিনিট দু‘জনে গল্প করে আবার এসে বসছি। শেষ বারে উঠে আসার খানিক বাদে ঘণ্টা বাজার শব্দ কানে এলো। অবধূত বললেন, চলুন, এবারে আরতি হবে…
আপনার ভালো লাগবে।
গিয়ে বসলাম। পেটো কার্তিক ঘরের আলোগুলো সব নিভিয়ে দিল। দু‘দিকে দুটো প্রদীপের আলো টিমটিম করছে। হল ঘর আবছা অন্ধকার। দুটো প্রদীপের আলোয় মাতাজীকেই শুধু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
নিজের ডান হাতে মাতাজী বেশ খানিকটা ঘি বা তেল কি ঢেলে নিলেন জানি না। বাঁ হাতে তাতে এক-ডেলা তুলো ফেলে বেশ করে ভিজিয়ে নিলেন। তারপর সেটা ডান হাতের তালুতে রেখেই টিপে টিপে তুলোর ডেলাটাকে ছোট্ট একটা পিরামিডের আকার দিলেন। প্রদীপটা টেনে নিয়ে ডান হাতে রাখা তুলোর মাথায় আগুন ছোঁয়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে মাথার দিকটা আর একটা প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠল। বাঁ-হাতে মাটির প্রদীপটা জায়গায় রেখে, ডান হাত মায়ের দিকে বাড়িয়ে আর বাঁ হাতে ঘণ্টা বাজিয়ে এই তুলোর প্রদীপে আরতি করতে লাগলেন। সুঠাম বাহু মায়ের দিকে উঠছে নামছে ঘুরছে ফিরছে— হাতের তালুতে তুলোর প্রদীপ জ্বলে জ্বলে ছোট হচ্ছে।
আমার কেন, সকলেরই বোধহয় রুদ্ধশ্বাস। ফিসফিস করে অবধূতকে জিজ্ঞেস করলাম, কি কাণ্ড, ওঁর হাত পুড়ে যাচ্ছে না?
জবাব দিলেন, পুড়ে গেলে আর আরতি করছে কি করে?
তুলো প্রায় দেখা যায় না। এই আরতি শেষ হতে আমিই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
কিন্তু তারপরেই আবার অস্বস্তি। হাত বেশ করে মুছে নিয়ে মাতাজী তেমনি ত্রিকোণ আকারের একখণ্ড কর্পূরের ডেলা নিলেন। তাতে প্রদীপের আগুন ধরিয়ে ডান-হাতের তালুতে রেখে ঘণ্টা বাজিয়ে আবার আরতি শুরু করলেন। এ-ও দু‘চোখ ভরে দেখার মতো, কিন্তু হাত সত্যিই পুড়ে যাচ্ছে না কেন ভেবে না পেয়ে আমার আতঙ্ক!
যাক, খানিক বাদে কর্পূর প্রদীপের আরতিও শেষ হলো। এরপর মিনিট দেড় দুই চামর দোলানোর মতো করে শূন্য হাতে আরতি। শেষে নিজের শূন্য হাতখানা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। খুব আস্তে আস্তে সেই শূন্য হাত আর হাতের আঙুল শঙ্খমুদ্রায় পরিণত হলো। সেই মুদ্রার শঙ্খার তি শেষে আবার এক চমক। শূন্য হাতের সেই মুদ্রা-শঙ্খ নিজের মুখে ঠেকালেন। তারপরেই গমগম করে যেন সত্যিকারের শঙ্খই বেজে উঠল! একবার নয়, দীর্ঘ রবে তিন বার। চোখ চেয়ে থেকেও কারো মনে হচ্ছে না সত্যিকারের শঙ্খ বাজছে না।
আলো-আঁধারিতে এত বড় হলঘরের বিচিত্র গম্ভীর পরিবেশ। মাতাজী ঘুরে বসে ঘট থেকে শান্তি জল ছিটোলেন। শশব্যস্তে সকলে পা ঢেকে বসেছেন। সবশেষে প্রদীপের আশিস সকলের মাথায় ছোঁয়ানো। একহাতে প্রদীপ নিয়ে অন্য হাতের তালু তার শিখার ওপর ধরে মাতাজী সেই হাতখানা এক-একজনের মাথায় রাখছেন। মেয়েরা সামনে। অতএব তাঁদের মাথাতেই আগে।
..কিন্তু প্রদীপ শিখায় তপ্ত হাত শ্রীরামপুরের সেই ভদ্রমহিলার মাথায় রাখতেই এমন এক কাণ্ড ঘটল যা আমি জীবনে ভুলব না। ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন, কি হলো। কি হলো। আমার কি হলো।
তারপরেই পাশের নহিলাদের কোলে ঢলে পড়লেন। প্রথমে হতভম্ব বিমূঢ় সকলে। তারপরেই মাতাজীর তৎপর হাতের শুশ্রূষা। পুজোর ঘটি থেকে জল নিয়ে তাঁর চোখে মুখে জোরে জোরে কয়েকটা ঝাপটা দিলেন।
একটু বাদে ভদ্রমহিলা চোখ মেলে তাকালেন। পেটো কার্তিক ততক্ষণে হলঘরের সব আলো জ্বেলে দিয়েছে। মাতাজী তাঁর মুখের সামনে ঝুঁকলেন।—কি হয়েছে?
ভদ্রমহিলার চোখে মুখে আতঙ্ক। মাতাজীর দিকে চেয়ে আছেন। আরো দু’বার জিগ্যেস করতে আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। ভয়ার্ত গলায় বললেন, আপনি মাথায় হাত রাখতেই আমার ভিতরে মনে হলো বিদ্যুতের মতো কিছু যাচ্ছে। বলেই উপুড় হয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন।
অবধূত আর আমি সামনের বারান্দায় বসে। প্রথমে জিগ্যেস করলাম, আপনার স্ত্রী এ-রকম আরতি শিখলেন কার কাছে?
জবাব দিলেন, জিগ্যেস করিনি কখনও কংকালমালী ভৈরবের কাছ থেকেই হবে।
আবার জিগ্যেস করলাম, শেষে ওই ভদ্রমহিলার ব্যাপারখানা কি হলো? হাসলেন।—কি হলো আমিও তো আপনার মতোই দেখলাম। … কিন্তু কেন হলো? কি করে হলো? কে এমন ব্যাপারখানা করালো?
পরদিন দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার আগে আমি স্ত্রী আর মেয়ে ছাড়া পাইনি। তাই জেরার সুযোগ পেয়েছি। কল্যাণী দেবীকে ডেকে প্রথমে বলেছি, আপনার ডান হাতখানা দেখি?
হাসি মুখে তিনি ভালো হাত আমার দিকে প্রসারিত করলেন।— হাত-টাত দেখা শুরু করলেন নাকি?
অবধূত টিপ্পনী কাটলেন, কেবল মেয়েদের হাত দেখবেন ঠিক করেছেন উনি, তোমাকে দিয়ে শুরু করছেন।
হাতে কোনোরকম পোড়া দাগের চিহ্নও নেই। লালচে কর-পদ্মকমল। বড় নিশ্বাস ফেলে হেসে বললাম, হাত দেখার শেষও ওঁকে দিয়েই করব।…
এবারে বলুন, শ্রীরামপুরের ওই ভদ্রমহিলার এ কি কাণ্ড হলো? হাসতে লাগলেন। —আপনি তো মনস্তত্ত্ববিদ লেখক—আপনিই বলুন না কি কাণ্ড হলো?
—আমার মনস্তত্ত্বের বিদ্যে অতদূর পৌঁছচ্ছে না। আপনি বলুন—
হাসি মুখে যে ব্যাখ্যা দিলেন তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। বললেন, মানুষের মন সবল হতে সময় লাগে, দুর্বল সহজেই হয়। পুজোর সময় এতগুলো মানুষের তন্ময়তার প্রভাবও কিছু আছেই। এই প্রভাতে মন যত দুর্বল হয়েছে, নিজের ভিতরের অপরাধ-বোধ ততো বেড়েছে। এই অবস্থায় স্নায়ু তো স্পর্শকাতর হতেই পারে। আমি মাথায় হাত রাখতে নিজের স্নায়ুর সঙ্গে নিজেই আর যুঝতে পারেননি, এতে আমার কোনো কেরামতির ছিটে-ফোঁটাও নেই।
উনি স্ত্রী আর মেয়ের কাছে চলে যেতে অবধূত হাসি মুখে আমার দিকে তাকালেন।
বললাম, কি হলো?
—কিছু হলো না। আমার সেই এক কথা…ওঁর কোনো কেরামতি নেই, কোনো ব্যাপারে আমাদের কারো কোনো কেরামতি নেই…কিন্তু আমাদের অলক্ষ্যে একেবারে কারোরই কি নেই? কেন এমন হয়…কে করে কে ঘটায়?
এ-রকম কথা অবধূতের মুখে অনেকবার শুনেছি। এ নিয়ে আমি কোনো আলোচনার মধ্যে ঢুকিনি। কারণ আমার ধারণা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এ-ও এক ধরনের ঈশ্বর স্তুতি—শক্তির স্তুতি।
মাস দেড়েক পরের কথা। এর মধ্যে আর কোন্নগর যাওয়া হয়নি। রাত প্রায় সাড়ে ন’টার সময় হস্ত-দন্ত হয়ে পেটো কার্তিক আমার বাড়িতে হাজির। আমি তখন খেতে বসার উদ্যোগ করছি।
কলকাতা এলে পেটো কার্তিক আমার বাড়িতে একবার ঢুঁ দিয়ে যায়ই—
আর খাওয়া-দাওয়া করে যেতে বললে এক কথায় রাজি হয়ে যায়। কিন্তু রাতে কখনো আসেনি।
—কি ব্যাপার? এত রাতে তুমি!
—বাবা পাঠালেন, কাল সক্কলের প্রথম ট্রেনে আমাকে নিয়ে যেতে হবে—
ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।—কেন? বাবার কি হয়েছে? আর ট্রেনেই বা কোন্নগরে যেতে হবে কেন?
সর্বদা আমি নিজের গাড়িতেই গিয়ে থাকি এটা অবধূত জানেন।
আমাকে এমন উতলা হতে দেখে পেটো কার্তিক অপ্রস্তুত একটু।—না না, বাবার আবার কি হবে—উনি বহাল তবিয়তে আছেন কোন্নগরে নয়, সকালের প্রথম ট্রেনে আপনাকে নিয়ে যাব তারকেশ্বরে— দু‘দিন যাবত বাবা সেখানেই আছেন, এই নিন বাবার চিঠি কয়েক লাইনের চিঠি।…ঘটনার সাজানো আসরে আমার ভূমিকার সব থেকে তাজ্জব নজির দেখতে চান তো চলে আসুন। আশা করি পস্তাবেন না। দিন চারেক সময় হাতে নিয়ে আসবেন। অবশ্যই আসুন।—অবধূত। আমি অবাক।—চার দিনের সময় নিয়ে যেতে বলছেন কি ব্যাপার বলো তো? দৈব কিছু নাকি?
পেটো কার্তিকের সপ্রতিভ জবাব, দেবতা সহায় যখন বাবার তো সর্ব ব্যাপারই দৈব…কিন্তু বাবা তো চার দিনের কথা আমাকে কিছু বলেন নি —ওনার কি আরো চারদিন সেখানে পড়ে থাকার মতলব নাকি! জিগ্যেস করলাম, তোমাদের মাতাজীও তারকেশ্বরেই নাকি —না, তিনি কোন্নগরে, তারকেশ্বরে কেবল আমি আর বাবা।
একসঙ্গে খেতে বসে এভাবে ডাকার কারণ বুঝতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখা গেল পেটো কার্তিক কিছুই জানে না। পুণ্যার্থীদের ভিড় আর কিছু মেয়ে-পুরুষের ভোলে বাবার থানে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া তার বিশেষ আর কিছুই চোখে পড়েনি।
—তাহলে দু‘দিন ধরে তোমাদের বাবা কি করছেন?
খাচ্ছেন-দাচ্ছেন আর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আজ বিকেলের দিকে একটু ব্যস্ত দেখলাম, এই চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়ে সকালের মধ্যে আপনাকে ধরে আনার জন্য পাঠালেন।
ড্রাইভার ছেড়ে দিয়েছি। অত সকালে তাকে আসতেও বলিনি। খুব ভোরে পেটো কার্তিকই ট্যাক্সি ধরে আনলো। হাওড়া স্টেশনে এসে ছ’টার গাড়ি ধরলাম। পেটো কার্তিককে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কাটার টাকা দিয়েছিলাম। কথায় সময় নষ্ট না করে চার-চার আট টাকা দিয়ে দুটো সাধারণ ক্লাসের টিকিট কেটে বাকি টাকা আমাকে ফেরত দিল। বলল, শেওড়াফুলির পর থেকেই এটা ভোলে বাবার গাড়ি হয়ে যায়, তখন ফার্স্ট ক্লাস থার্ড ক্লাস সমান— মিথ্যে অর্থদণ্ড দেবেন কেন।
যা-ই হোক, গাড়ি মোটামুটি ফাঁকাই। তারকেশ্বর যাত্রীর মৌসুম নয় এটা। জানলার ধারে দু‘জনে মুখোমুখি বসে চলেছি। খানিক বাদে যাত্রীর ভিড় বাড়তে লাগল। হরেক রকমের বেসাতি নিয়ে গাড়ির মধ্যে হকারের উৎপাতও কম নয়। উঠছে, কলে দম দেওয়ার মতো করে গড় গড় করে লেকচার দিচ্ছে—গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে খেয়ে বেসাতি দেখাচ্ছে। কামরায় এক একবার এক জোড়া দেড়-জোড়া করেও হকার উঠছে। একজন থামলে অন্যজন তৎপর।
পেটো কার্তিক দেখলাম অনেক কিছুই কিনে ফেলল। লিমন লজেন্স, রং পেন্সিল, চিরুনি, চাবির রিঙ, চটি বই, বাচ্চাদের মজাদার খেলনা, ছোট রঙিন পিকচার অ্যালবাম, টুকিটাকি আরো কিছু। মনে মনে বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করলাম, এ-সব দিয়ে কি হবে, তোমার হাত আর পকেট যে বোঝাই হয়ে গেল।
লজ্জা পেয়ে জবাব দিল, কিছু হবে না, তারকেশ্বরেই বিলিয়ে দেব। …
ব্যাপার কি জানেন, লোকগুলো কি ভীষণ গরীব, সমস্ত দিন গলাবাজী করে এক একটা জিনিস বিক্রি পিছু বড়জোর দু‘চার পয়সা পায়। দিনের শেষে যা ওঠে তাই দিয়ে ছেলেপুলে নিয়ে আধপেটা খেয়ে সংসার চালায়—ওদের দেখলে আমার বড় কষ্ট হয়, তাই না কিনে পারি না।
এবারে আমি লজ্জা পেলাম? বোমাবাজী করা এই ছেলের বুকের ভেতরটা কি অবধূতই এমন সোনা করে দিয়েছেন?
অবধূত যেখানে আছেন, স্টেশন থেকে সাত আট মিনিটের হাঁটা পথ। তিন ঘরের ছোট এক-তলা বাড়িতে আর দ্বিতীয় প্রাণী দেখলাম না। এখানকার আপাত বাসিন্দা কেবল তিনি আর পেটো কার্তিক। আমাকে দেখে সহাস্যে অভ্যর্থনা জানালেন, আসুন আসুন, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি—
ছোট সুটকেসটা নামিয়ে রেখে বললাম, এভাবে ডেকে পাঠানোর কৈফিয়ত দাখিল করুন আগে আমার তর সইছে না।
হাসছেন।—কি দিন-কাল বুঝুন—উপকার করতে চাইলেও কৈফিয়ত দাখিল করতে হবে..
—উপকার মানে কার উপকার?
—আপনাকে যখন ধরে এনেছি আপনার ছাড়া আর কার!
—কি উপকার?
—উপকার নয়? আপনার লেখা যখন ছাপার অক্ষরে বই হয়ে বেরুবে আমাকে কি তার রয়েলটির ভাগ দেবেন?
থমকালাম। এক বছর ধরে মগজে যে-রূপ আকার নিচ্ছে তার পরিণাম এ-ই বটে। কিন্তু মুখ ফুটে কোনোদিন তা ব্যক্ত করা দূরে থাক—আভাসও দিইনি। অবশ্য, এক বছর ধরে এঁর চঙ্গে লেগে আছি, মতলব বোঝা এই চতুর মানুষের পক্ষে খুব কঠিনও নয়।
হেসেই বললাম, তা বলে সব জায়গা ছেড়ে এই তারকেশ্বরে তলব কেন?
— ক্লাইম্যাক্সের খোঁজে লেখকরা জল জঙ্গল বন-বাদাড় মরুভূমি কত জায়গায় ছোটে—সে তুলনায় তারকেশ্বর তো ভালো জায়গা মশাই!
আবার থমকালাম। অবধূতের কোনো কথা কখনো তাৎপর্যশূন্য মনে হয়নি আমার। পেটো কার্তিক আমাদের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে দেখে আর এগোলাম না। তাঁর সংক্ষিপ্ত চিঠির প্রথম ছত্র মনে পড়ল—ঘটনার সাজানো আসরে আমার ভূমিকার সব থেকে তাজ্জব নজির দেখতে চান তো চলে আসুন।
অতএব বুদ্ধিমানের মতো অপেক্ষা করাই ভালো।
অবধূত জিগ্যেস করলেন, চা-টা কিছু খাওয়া হয়নি তো?
—চা হয়েছে, টা হয়নি। কিন্তু এখানে তো আর কাউকে দেখছি না, এটা কার বাড়ি।
—এক ভক্তকে দিন কয়েকের জন্য থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম, সে-ই জুটিয়ে দিয়েছে।…আপনি স্নান সেরে নিন, সকাল ন’টার মধ্যে আমাদের স্টেজে হাজির হতে হবে—কার্তিক, তুই হোটেলে গিয়ে আমাদের ব্রেকফাস্ট রেডি করতে বল।
পেটো কার্তিক চলে গেল। জিগ্যেস করলাম, স্টেজ বলতে? হাসছেন।—এই নাটকখানা হচ্ছে রিভলভিং স্টেজে। প্রথম ঘটনার মঞ্চ সমস্তিপুর-দ্বারভাঙার-কাকুড়ঘাটি, সেটা ঘুরে কাকুড়ঘাটির মহাশ্মশানে—পাঁচ বছর বাদে এবার সেটা ঘুরে বাবা তারকনাথের মন্দিরে। ব্যস্ত হবেন না, চান সেরে আসুন—
বেশ আগ্রহ নিয়েই স্নান সেরে প্রস্তুত হলাম। অবধূত অযথা বাগাড়ম্বর করেন না। আশা, সে-রকম কিছুই দেখব শুনব বা জানব।
ছ’সাত মিনিটের হাঁটা পথে মন্দির। কাছেই এখানকার সব থেকে বড় যে আমিষ হোটেল তার নাম অন্নপূর্ণা হোটেল। দেখলাম, বড় শুধু নয়, বেশ পরিচ্ছন্নও। কার্তিক সেখানেই অপেক্ষা করছে। হোটেলের মালিক অবধূতকে খুব খাতির করে বসালেন। বেশ ভারী প্রাতরাশই রেডি দেখলাম। অবধূত বললেন, ভালো করে খেয়ে নিন, আবার কখন জুটবে বলা যায় না সহাস্য জবাব, নাটকের নিয়ন্তা তো আর আমি নই মশাই, আর্টিস্টের হাজিরার অপেক্ষায় এখানে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে কি তিন-চার ঘণ্টা, জানব কি করে?
খাবার ফাঁকে পেটো কার্তিক আবার মন দিয়ে তার বাবার মুখখানা দেখছে। মনে হয় কিছু একটা রহস্যের গন্ধ সে-ও পাচ্ছে। অতএব আমি যথাসম্ভব নির্লিপ্ত।
খাওয়া শেষ হতে অবধূত একেবারে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে বেরুলেন। যখনই আমুন, খাবার গরম চাই। ভাত ডাল বেগুনি মাছ মাংস চাটনি দই পেলে ভদ্রলোক আর কমের দিকে যাবেন কেন।
বেরিয়ে আমরা মন্দিরের দিকে চললাম। পিছনে পেটো কার্তিক। সে আর এখন আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না জানা কথাই।
মন্দিরে আর চত্বরে মেয়ে পুরুষের গিসগিস ভিড়। তাদের নিয়ে পুরুত-পাণ্ডারা তৎপর। সক্কলে যেন বিষম কিছু তাড়া খেয়ে এখানে এসেছে। কাকে ঠেলে কাকে ফেলে যেমন ভিতরে যাওয়ার তাগিদ, তেমনিই আবার বেরিয়ে এসে বাঁচার তাগিদ। আমার আতঙ্ক, তিন মাস ছ’মাসের বাচ্চা নিয়েও কিছু মেয়েছেলে ভিতরে ঢুকেছে, মনে হয়েছে পুণ্যির তাগিদে ওদের পরমায়ু শেষ হয়ে এসেছে। বললাম, চলুন, ফাঁকায় গিয়ে দাড়াই, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
অবধূত জবাব দিলেন না। মনে হলো ভিড়ের মধ্যে তাঁর দু‘চোখ কিছু খুঁজছে বা কাউকে খুঁজছে। পায়ে পায়ে দুধকুণ্ডের দিকে তিনি এগিয়ে চললেন। দুধকুণ্ড বলতে মন্দিরের গায়ের বিশাল পুকুর। সেখানে মেয়ে পুরুষের স্নানের সমারোহ। বছর চৌদ্দ পনেরো আগে একবার তারকেশ্বরে এসেছিলাম। তখন এই পুণ্য-পুকুরের জলে হাত দিতেও ঘেন্না করত। পুকুরটার আমূল সংস্কার হয়েছে, পরিষ্কার টলটলে জল।
অবধূত স্নান-রত মেয়ে পুরুষদের একবার দেখে নিয়ে বললেন, এত ভিড়ে আসবে না জানা কথাই, আসুন আমাদের এই দুধকুণ্ডের কাছাকাছি অপেক্ষা করতে হবে।
… অবধূত এধার-ওধার পায়চারী করছেন, একের পর এক সিগারেট ধরাচ্ছেন। পুণ্যার্থী-পুণ্যার্থীনীদের অনেকেই তাঁকে লক্ষ্য করছে। কেউ কেউ বা দু‘হাত জুড়ে তাঁকে প্রণাম জানাচ্ছে। রক্তাম্বর-পরা সাধু-সন্ন্যাসী এখানে আরো চোখে পড়েছে। শুধু পরিচ্ছদে নয় ভিতরেও যেন তাঁরা বিবর্ণ মলিন। দেখলেই মনে হয় প্রাপ্তির আশাটুকুই তাদের বড় আশা। এঁদের মধ্যে সিল্কের লাল চেলি, সিল্কের টকটকে লাল ফতুয়া আর তেমনি সিল্কের লাল উত্তরীয় পরা কালীকিংকর অবধূত ঝকঝকে ব্যতিক্রম। তাঁর এই ব্যক্তিত্ব আর চাল-চলন দেখার মতো সন্দেহ নেই। পাণ্ডারাও অনেকে নত হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছে।
আমার ভিতরটা কৌতূহলে টইটম্বুর। বাইরে এই অবধূতের মতোই শান্ত থাকতে চেষ্টা করছি, মন্দিরের সামনের বাঁধানো মণ্ডপের মেঝেতে অনেক মেয়ে পুরুষ হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। তাদের বেশির ভাগেরই পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। শুনলাম চার-পাঁচ সাত-আট দিন ধরেও অনেকে এমনি হত্যা দিয়ে পড়ে আছে। মাঝে-সাজে বাবার চরণামৃত ছাড়া আর কিছু মুখে ছোঁয়ায় না। এ দৃশ্য দেখে বুকের ভেতরটা থেকে থেকে মোচড় দিয়ে ওঠে। শুনেছি কেউ কেউ এরা বাবা তারকনাথের আদেশ পায়। পেলে মুশকিল আসানও নাকি হয়।…আমিও অনেক হারিয়েছি। বুকের তলার এই বিশ্বাসের ঠাঁই হলে কি সেই সংকট এড়ানো যেত! জানি না। শুধু এটুকু জানি, আমার দ্বারা এভাবে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকা কোনো দিন সম্ভব হতো না। কারণ এই বিশ্বাসের পুঁজি আমার নেই।
…ঘড়ি দেখলাম। বেলা এগারোটা বেজে গেছে। এখনো বেশ ভিড়, কিন্তু আগের তুলনায় কম। একটু বাদে দেখি অবধূত আমাকে আঙুলের ইশারায় ডাকছে। কাছে যেতে চাপা গলায় বলেন, ঘাটের এ-দিকটায় সবে এসে লক্ষ্য করুন, আমরা যার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সে ওই আসছে। খুব ভাল করে দেখে যান।
তাঁর ইশারা-মতো আমি ফিরে তাকালাম। ঘাটের দিকে আসছে একটি মেয়ে। বছর ছাব্বিশ-সাতাশ হবে বয়েস। বাঙালী নয়। ভারী সুন্দরী।
ধপধপে ফর্সা রং, লম্বা, নিটোল স্বাস্থ্য। পাতলা শাড়ির ওপরে কাঁধে বকে জড়ানো একটা গামছা আর কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত জড়ানো আর একটা গামছা। তার মানে আছড় গায়ে শুধু শাড়ি পরে তার ওপর ও ভাবে দুটো গামছা জড়িয়ে স্নানে আসছে। আসতে আসতে চার-দিকে তাকাচ্ছে। মনে হলো, আকৃতি-মাখা উদভ্রান্ত চাউনি। তার সঙ্গে একটি মাঝবয়সী মেয়েছেলে। পরিচারিকা হবে। আর, বছর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে আধা ভদ্রলোক গোছের একজন অবাঙালী পুরুষ। একজন পাণ্ডা শশব্যস্তে তাদের সঙ্গে আসছে। মেয়েটির গায়ে কোনো গয়না, এমন কি হাতে কাচের চুড়িও নেই। তবু দেখামাত্র মনে হয় অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে বা বউ হবে। পাশে তাকিয়ে দেখি অবধূত নেই। মন্দিরের পিছনের মাঝামাঝি জায়গায় দাড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছেন। আমি ভেবে পেলাম না, উনি ওখানে গিয়ে আডাল নিলেন কিনা।
মেয়েটি ধীরে ধীরে ঘাটের সিঁড়ি কটা পার হয়ে আগে দুধ কুণ্ডের জল হাতে তুলে নিজের কপালে মাথায় ছিটিয়ে দিল। তারপর এক-পা এক-পা করে নেমে কোনর জলে দাঁড়ালো। সঙ্গের পরিচারিকাও জলে নেমেছে। লক্ষ্য করলাম, সিড়ির এক পাশে দাঁড়ানো লোকটির হাতেও কোনো শুকনো বসন নেই। অর্থাৎ স্নানের পর অনুষ্ঠান যদি কিছু হয় তো ভিজে কাপড়েই হবে।
স্নান সেরে পরিচারিকা পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে উঠে পড়ল। তার গায়ে পিঠেও একটা বড় গামছা জড়ানো। সঙ্গের লোকটিকে ইশারা করতে পাণ্ডাকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে চলে গেল।
মেয়েটি স্নান করছে। উঠছে, ডুব দিচ্ছে। ডুব দিচ্ছে, উঠছে। না, স্নানবিলাস আদৌ নয়। কিছু একটা তন্ময়তায় বিভোর যেন। শুনিনি, গুনলে হয়তো দেখতাম শতেকের ওপর ডুব দেওয়া হয়েছে। পর পর ডুব দিয়ে যাওয়া নয়। একবার ডুব দিচ্ছে, উঠে দাড়াচ্ছে, মন্দিরের দিকে ফিরে দু‘চোখ বুজে স্থির কয়েক মুহূর্ত—তারপর আবার ডুব দিচ্ছে।
এই স্নান দেখতে এরই মধ্যে ঘাটে বেশ ভিড় হয়েছে দেখলাম। রূপসী যুবতী রমণীর এই স্নান অনেকের চোখের ভোজ তো বটেই। পৃথিবীর কোনো গীর্জা বা মন্দির মসজিদ কি প্রবৃত্তির নিবৃত্তি আনতে পেরেছে? উল্টে যেখানে যত বেশি সমর্পণ সেখানে ততো হাঙর-কুমিরের আমন্ত্ৰণ। মেয়েটি আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে জল পেরিয়ে প্রথম ধাপে উঠে দাড়ালো। দুটো গামছা সিক্ত-বসনা এই রমণীর যৌবন আবৃত করে রাখার মতো যথেষ্ট নয় আদৌ। পরনের ভেজা শাড়ি আর গামছা দুটো দুধ-বরণ অঙ্গে লেপটে যাওয়ার ফলে সর্ব অঙ্গের যৌবন আরো স্পষ্ট, আরো মুখর। জোড়া জোড়া চক্ষু ওই রমণী অঙ্গে বিদ্ধ।
কিন্তু রমণীর কারো দিকে চোখ নেই। এমনি আত্মস্থ তন্ময় যে পারিপার্শ্বিক লোভাতুর জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।
…কিন্তু দর্শকের দৃষ্টি ভোজের আরো অনেকটাই বাকি তখনো। পরিচারিকা এগিয়ে গিয়ে তার হাতে ভিজে মাটির ঢেলার মতো কি একটা দিল। সেটা হাতে নিয়ে রমণী আস্তে আস্তে হাঁটু মুড়ে উপুড় হয়ে বুকের ওপর শুয়ে পড়ে দু‘হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে যুক্ত করল। সিঁড়ির মেঝেতে কপাল রেখে হাত দুটো যে পর্যন্ত পৌছলো সেখানে মাটির ঢেলা দিয়ে একটা দাগ কাটল। এরই নাম দণ্ডি-কাটা। উঠে সেই দাগের ওপর দাঁড়িয়ে আবার বুকের ওপর শুয়ে দু‘হাত টান করে দণ্ডি কাটল। এমনি বার তিনেক দণ্ডি কাটতে সিঁড়ি শেষ। এবার সে সমান মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে। আবার উপুড় হয়ে বুকের ওপর শুয়ে দণ্ডি কেটে কেটে মন্দিরের দিকে এগোতে লাগল। অনেক দর্শক ঘাটেই দাঁড়িয়ে, অনেকে আবার রমণীর সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসছে। রমণী তখনো জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহ, উদাসীন।
মন্দিরের রেলিং পর্যন্ত আসার পর তেমনি দণ্ডি কেটে কেটে বাঁদিক-থেকে বেষ্টন প্রদক্ষিণ শুরু হলো।…হাঁটুর ওপর বসছে, বুকের ওপর টান হয়ে শুয়ে পড়ছে, দু‘হাত যতদূর যায় বাড়িয়ে দিয়ে যুক্ত করছে, মেঝেতে কপাল ঠেকিয়ে কয়েক পলক স্থির হয়ে পড়ে থাকছে, মাটির ঢেলায় দণ্ডির দাগ দিচ্ছে, উঠে দাঁড়িয়ে সেই দাগে পৌঁছে আবার শুরু করছে।
অবধূত এদিকেই দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু এখন নেই।
দণ্ডি কেটে সমস্ত মন্দির প্রদক্ষিণ প্রায় শেষ হয়ে এলো। দণ্ডি কাটতে কাটতে রমণী মন্দিরের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।… দরজার কাছে অবধুত দাঁড়িয়ে। প্রসন্ন প্রশান্ত মুখ।
রমণী দোরগোড়ায় পৌঁছলো। পাণ্ডা আর তার পাশের সেই লোকও দাঁড়িয়ে। পাণ্ডার হাতে মস্ত একটা পুজোর ডালি। তাদের সামনে আরো জনাকতক পাণ্ডা। দু‘দিক থেকে তারা পুণ্যার্থীর ভিড় সামলে রাখছে। মন্দিরের ভিতরেও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বাবা তারকনাথকে দর্শন এবং স্পর্শনের এই স্পেশ্যাল ব্যবস্থা হয়তো রমণীর টাকার জোরে হয়েছে। নইলে পাঁচ সাত মিনিটের জন্যে হলেও এত খাতির কারো পাওয়ার কথা নয়। দরজার সামনেই পাণ্ডারা ছাড়া আর দাঁড়িয়ে কেবল অবধূত। শুধু তাঁকেই তারা বাধা দিচ্ছে না বা সরে যেতে বলছে না। শেষ দণ্ডি কাটা হতেই মন্দিরের দরজা। উঠে দাড়িয়েই টকটকে লাল ধুতি ফতুয়া পরা আর তেমনি চাদর গায়ে অবধূতকে সামনে দেখে রমণী চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো কয়েক পলক। তারপর আমার মনে হলো, হঠাৎই একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সে তার পায়ে আছড়ে পড়তে যাচ্ছে।
কিন্তু তার আগে একখানা হাত তুলে অবধূত বাধা দিলেন। রমণী থমকে দাঁড়ালো। আমার মনে হলো আশা উৎকণ্ঠা উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। পাণ্ডারা আর অদূরে যারা ভিড় করে দাড়িয়ে তারাও বিমুঢ় বিস্ময়ে এই দৃশ্য দেখছে।
অবধূত এবারে দু‘হাত দরজার দিকে বাড়িয়ে মন্দিরের দরজা দেখিয়ে পরিষ্কার হিন্দীতে বললেন, যাও আগে বাবার পুজো দিয়ে এসো। রমণী দিশেহারার মতো ভিতরে ঢুকে গেল। পিছনে তার পরিচারিকা, পুজোর ডালি হাতে পাত্তা আর পুরোহিত। একটু বাদে পুজো শেষ করে রমণী ব্যগ্র মুখে ফিরে এসে আবারও অবধূতের পায়ে পড়তে গেল। অবধূত আবার বাধা দিলেন। গম্ভীর অথচ নরম গলায় স্পষ্ট হিন্দীতে বললেন, এখানে না, ব্যস্ত হয়ো না, তুমি যে-জন্য এসেছ — পাবে। ভেজা জামা-কাপড় বদলে তোমার চটির ঘরেই অপেক্ষা করো—আমি আসছি। রমণী স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে। অবধূত ফিরে চললেন। হঠাৎই আত্মস্থ হয়ে রমণী সেখান থেকে ছুটে বেরুতে চাইলো। সঙ্গে তার পরিচারিকা আর পুরুষটিও।
সে যে-দিকে গেল তার উল্টোদিকের রাস্তার বাঁকে প্রশান্ত মুখে অবধূত দাড়িয়ে। আমি কাছে যেতে হাসলেন একটু। বললেন, চলুন, আগে এক পেয়ালা করে চা খেয়ে নেওয়া যাক।
বেলা তখন বারোটা বেজে গেছে। কাছেই একটা চায়ের দোকানে ভাঁড়ের চা খেলাম। পেটো কার্তিক আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি। সে-ও হাজির। তারও চোখে মুখে আগ্রহ উপছে পড়ছে। তার বাবার ক্ষমতার সে যেন তল-কূল পাচ্ছে না।
একট’ সিগারেট ধরিয়ে অবধূত এক দিকে এগোলেন। আমি পাশে। অবধূত বললেন, এবারে নাটকের পরের দৃশ্য দেখবেন চলুন।
—কিন্তু এই দৃশ্যই তো ভালো করে বুঝলাম না।… মেয়েটি কে?
—পার্বতী প্ৰসাদ।
—কোথাকার মেয়ে?
—সমস্তিপুর-দ্বারভাঙার কাঁকুড়ঘাটির।
কথা বলতে বলতে এগোচ্ছি।—এখানে কবে এসেছে?
—কাল বিকেল তিনটেয় দুধপুকুরে স্নান করে মন্দির প্রদক্ষিণ করতে দেখলাম… কালই এসেছে।
—আপনি জানতেন মেয়েটি আসবে?
অবধূত হাসলেন।— না জানলে কোন্নগর ছেড়ে আমি আগে থাকতে এখানে এসে বসে আছি কেন? আগে এসে পাণ্ডা আর পুরুতদের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি—তাদের বলেছি, বাবার আদেশ পেয়ে একজন বড় ঘরের বিশিষ্ট অবাঙালী মহিলা বিহার থেকে এখানে আসছেন —আর বাবার আদেশে আমারও এখানে আসা। মহিলা যেন নির্বিঘ্নে তাঁর কাজ আর পুজো দিতে পারেন—কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে তিনি এমনিতেই সকলকে অনেক দিয়ে যাবেন। মনে মনে ভাবলাম, প্রাপ্তির আশা ছাড়াও কালীকিংকরের এই ব্যক্তিত্বকে উপেক্ষা বা অবহেলা করার মতো পুরুত বা পাণ্ডা এখানে বোধহয় নেই।
একটা মস্ত পুরনো দালানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এটাই এখানকার সব থেকে বড় যাত্রীনিবাস বোধহয়। নিচের তলাটা নোঙরা। সিঁড়ি ধরে আমরা দোতলায় উঠতে লাগলাম। সেই পরিচারিকা এবং পুরুষটি ছুটে এলো। হাত জোড় করে দু‘জনে এক-সঙ্গে বলে উঠল, আইয়ে মহারাজ, আইয়ে দোতলার কোণের দিকে একটা ছোট্ট ঘর। যাত্রী নিবাসের সব ঘরই এমনি ছোট ছোট। মেঝেতে চাটাইয়ের ওপর একটা সুন্দর পুরু গালচে পাতা। এটার মালিক ঘর যার অধিকারে সেই, বোঝা যায়। যাত্রী নিবাসে চাটাই ছাড়া আর কিছু দেওয়া হয় না। ঘরের কোণে ছোট বড় দুটো সুটকেস, সুটকেসের ওপর চকচকে একটা হোল্ড অম্ল ভাঁজ করা।
সেই রমণী উদগ্রীব মুখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। পরনে চওড়া কালোপেড়ে সাদা জমিনের শাড়ি, গায়ে সাদা ব্লাউস-আধ-ভেজা চুল পিঠে ছড়ানো। রমণীর শুচি সুন্দর আর এক রূপ। প্রত্যাশা আর উৎকণ্ঠায় ফর্সা মুখ লাল।
অবধূতকে দেখেই সসম্ভ্রমে কয়েক পা পিছনে সরে গেল। তিনি ভিতরে এসে দাড়াতে দুই পায়ের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। শুভ্র দুই বাহুতে পা দুটো জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
—আপ হি বাবা তারকনাথ হ্যায়, মিলা দিজিয়ে প্রভুজী—মিলা দিজিয়ে গম্ভীর গলায় অবধূত বললেন, মুঝে ভি বাবা তারকনাথ ইহা ভেজা— ম্যায় উনকো দাস হু—রো মাত পার্বতী, উঠো—জরুর মিল জায়গা। তড়িৎস্পৃষ্টের মতো উঠে বসল, কিন্তু দু‘হাতে পা দুটো ধরাই থাকল। এই লোকের মুখে নিজের নাম আর যে আশার কথা শুনল দুইই বোধহয় এমন চমকের কারণ। কোনো রমণীর চোখেমুখে এমন আর্তি এমন করুণ আকৃতি আর দেখিনি!
হিন্দীতে কথা বেশিরভাগ অবধূতই বললেন। উনি এমন পরিষ্কার হিন্দী বলতে কইতে পারেন জানা ছিল না।
—তুমি পার্বতী প্রসাদ তো?
—হ্যাঁ প্ৰভুজী…!
—রতনলালের মেয়ে?
—হাঁ প্ৰভুজী — হ্যাঁ!
—রতনলালবাবু কোথায় এখন?
একবার ওপরের দিকে চেয়ে জবাব দিল, পিতাজী ওজর গয়া মহারাজ—
—কত দিন হলো মারা গেছেন?
—দো মাহিনা —
—আর বেনারসীলাল? সে কোথায়?
কোনো রমণীর মুখে বিস্ময়ের এমন কারুকার্যও কি আর দেখেছি! ফ্যালফ্যাল করে একটু চেয়ে থেকে জবাব দিল, উও তো বহুত দিনসে কোই জেল্ মে হোগা…এক খুন কা আসামী বন্ গয়ে থে…উন্কা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হো চুকা।
নিজের দু‘হাত জোড় করে একবার কপালে ঠেকালেন অবধূত। গলার স্বর আরো গম্ভীর, গভীর।—তোমার বাবা বা বেনারসীলাল নাগালের মধ্যে পেলে তোমার ছেলে বাঁচত না—এই জন্মেই তোমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বাবা তারকনাথ তাকে রক্ষা করেছেন…আমার কথা তুমি বুঝতে পারছ?
অবধূতের চাউনিতে সত্যিই কি জাদু আছে! উত্তেজনা উৎকণ্ঠা আকৃতি ভুলে পার্বতী তাঁর দিকে চেয়ে আছে। সামান্য মাথা নাড়ল। বুঝতে পারছে। অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, লেকিন মেরা বচ্চা কাঁহা? আপ, কত?
—আমি বাবা তারকনাথের দাস। তোমার ছেলে ভালো আছে। নিজের রিস্ট ওয়াচের ব্যাণ্ডে গোঁজা দুটো কাগজের টুকরো বার করলেন অবধূত।
একটার ভাঁজ খুলে সামনে ধরলেন।—তোমরা আজই কলকাতায় গিয়ে রাতের গাড়িতে নিজের মুলুকে চলে যাও। সেখান থেকে বারো মাইল’ দূরের এই গ্রামে গিয়ে এই ঠিকানার মানুষদের কাছে যাবে। কাগজটা পার্বতীর হাতে দিয়ে দ্বিতীয় কাগজটার ভাঁজ খুললেন। আমরা দরজার কাছে দাড়িয়ে সবিস্ময়ে দেখলাম ওটা একটা পাঁচ টাকার নোটের আধখানা। ঠিক আধখানা করে কেটে নেওয়া। সেটাও বিমূঢ় পার্বতীর হাতে দিয়ে বললেন, গাঁয়ের সেই বাড়ির মালিক বা মালকানের হাতে এটা দেবে। তারা বাকি আধখানা নোটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তোমার ছেলে দিয়ে দেবে।…সেই ছেলের গলায় লাল সুতোয় বাঁধা একটা সোনার লকেট দেখতে পাবে। সেটা ভাঙলে তার মধ্যে তোমার ছেলের জন্মের তারিখ পরিচয় সব পাবে। কিছু খেয়ে আজই যাবার জন্য তৈরি হয়ে নাও।
শুধু পার্বতী নয়, আমরাও চিত্রার্পিত। অবধূত ফিরে দাড়াতে পার্বতীরই প্রথম হুঁশ ফিরল। দু‘হাত জোড় করে আকুল গলায় বলে উঠল, কৃপা করকে আপ সাথ চলিয়ে মহারাজ… মুঝে বহুত্ ডর লাগতা—
—বাবা তারকনাথের কৃপা আছে তোমার ওপর—কিচ্ছু ভয় নেই। আমি তোমার জন্য কয়েকটা দিন এখানেই অপেক্ষা করব—ছেলেকে পেলে তাকে নিয়ে সেই দিনই কলকাতা রওনা হতে চেষ্টা কোরো— এখানে এসে তার কল্যাণে ভালো করে পুজো দিয়ে যাবে—পাণ্ডা পুরুতদেরও খুশি করে যাবে। জয় বাবা!
দু‘হাত কপালে ঠেকিয়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁর পিছনে আমি আর পেটো কার্তিক নিচে নেমে এলাম! রাস্তায় নেমে অবধূত পেটো কার্তিককে বললেন, আমরা হোটেলে গিয়ে বসছি—এরা কখন রওনা হয় দেখে তুই আয়।
হোটেলের টেবিলে মুখোমুখি বসার সঙ্গে সঙ্গে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। বললাম, দেখুন এর পর আমার হার্টের ব্যামো ধরে যাবে—সব মিলিয়ে ব্যাপারখানা কি?
অবধূত বিমনার মতো হাসলেন একটু। বললেন, সব মিলিয়ে একটা ঘটনার শেষ। আমি ভাবছি আবার অন্যমনস্ক দেখে তাড়া দিলাম।—কি ভাবছেন?
—এমন কেন ঘটে? কি করে হয়? কে করে?
অর্ডার মতো আমাদের খাবার এসে গেল। একটু বাদেই পেটো কাতিক হস্তদন্ত হয়ে উপস্থিত। —ওঁরা আর খাবার জন্যও অপেক্ষা করলেন না, সুটকেস আর হোল্ডঅল রিক্সায় তুলে তিন জনেই স্টেশনের দিকে চলে গেলেন।
অবধূত বললেন, ঠিক আছে, তুই বসে যা। খেতে খেতে আমার দিকে মুখ তুললেন একবার। হাসলেন। খাবার বেশ গরম আছে, ব্যস্ত হবেন না, খেয়ে নিন, আপনাকে শুধু নাটকের শেষটুকু দেখা আর শোনার জন্য কলকাতা থেকে ধরে আনিনি।
…রাত্রি। কোপ্রহর উত্তীর্ণ আমার বা পেটো কার্তিকের হুঁশ নেই। দুটো চৌকিতে আমি আর অবধূত মুখোমুখি বসে। পেটো কার্তিক মেঝেতে বসে তার বাবার পা টিপেই চলেছে। হাত চলছে থামছে চলছে, দু‘চোখ তাঁর মুখের ওপর। উদগ্রীব, দু’কান উৎকর্ণ।
আমারও তাই।
একটার থেকে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বড় প্যাকেটের আধখানার ওপরে খালি। ঢিলে তালে ধীরে-সুস্থে অতীতের এক বিচিত্র ঘটনার—যবনিকা তুলেছেন কালীকিংকর অবধূত।