শবর দাশগুপ্তর মনটা ভাল ছিল না
আজ শবর দাশগুপ্তর মনটা ভাল ছিল না। পরাশর ঘোষালের কেসটা তাকেই দেওয়া হয়েছিল। কাজটা যন্ত্রণাদায়ক। পরাশর ঘোষাল তার সহকর্মী। এক ধাপ নীচের সহকর্মী এবং মোটামুটি বন্ধু মানুষ।
শবর জানে, পরাশরের অপরাধ গুরুতর। লালচাঁদ মার্ডার কেস এবং উলটোডাঙায় ডাকাতির দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পেয়ে ঘোষাল অত্যন্ত বিপজ্জনক জায়গায় চলে যায়। যে ট্রেলটি সে পেয়েছিল তাতে পুরো গ্যাং ধরা পড়ে যেত। কিন্তু মানুষের কিছু কিছু দুর্বলতা থাকেই। ঘোষাল ঘুষ খায় না, অতি সৎ মানুষ। তবে তার দুর্বলতা ছিল অন্য জায়গায়। তার একটি মাত্র সন্তান, তার ছেলে তন্বিষ্ঠ। ছেলের প্রতি দুর্বলতা কোন বাপের না থাকে? কিন্তু ঘোষালকে জব্দ করা হল ওই রন্ধ্রপথেই। গ্যাং থেকেই একজন একদিন ঘোষালকে ফোন করে বলল, স্যার, আমরা জানি, আপনি খুব ভাল একজন পুলিশ অফিসার। হয়তো আমাদের ধরেও ফেলবেন। কিন্তু আপনার ভালর জন্যই বলছি, কেসটা যদি আর এগোয় তা হলে উই উইল কিল–না স্যার, আপনাকে নয়, উই উইল কিল ইয়োর সান তন্বিষ্ঠা।
এই হুমকি রোজ আসত। ঘোষাল ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ল, নিস্তেজ হয়ে গেল। এমনকী গ্যাং-এর নির্দেশে সে কেসটা থেকে জরুরি কাগজপত্র সরিয়ে ফেলল। তদন্ত শুধু থেমেই গেল না, ঘুরেও গেল।
আজ সারা সকাল ঘোষালকে জেরা করতে হল শবরের।
ঘোষাল ঘামছিল, বারবার জল খাচ্ছিল। শেষে ধরা গলায় বলল, বলুন মিস্টার দাশগুপ্ত, আমার জায়গায় আপনি হলে কী করতেন?
শবর গম্ভীর গলায় বলল, আমি বিয়ে করিনি, কাজেই ছেলেপুলেও নেই। আমি আপনার প্রবলেম আপনার মতো করে বুঝতে পারব না। তবে ব্যাপারটা আপনি পুলিশকে জানালে পারতেন।
ঘোষাল রুমালে কপালের ঘাম মুছে বলল, হ্যাঁ পারতাম। জানাইনি, কারণ পুলিশ আমার ছেলেকে চব্বিশ ঘণ্টার প্রোটেকশন দিতে পারত না। হি ওয়াজ ইন মরটাল ডেনজার।
ঘোষালবাবু, পুলিশের চাকরিতে ওরকম কতই তো ফাঁকা হুমকি শুনতে হয়। ভয় পেলে চলে!
ফাঁকা! কে জানে ফঁকা কি না। তবে ছেলের জন্য আমি ভারী ভয় পেয়েছিলাম। আমি আপনার মতো সাহসী নই মিস্টার দাশগুপ্ত।
ঘোষালের সাসপেনশন অবধারিত। রিপোর্টের অপেক্ষা শুধু। শবরের তাই মন খারাপ। এক-একটা দিন এমন আসে যে, মনে হয় এ চাকরিটা না করতে হলেই ভাল ছিল।
এনকোয়ারির একদম শেষে ঘোষাল জিজ্ঞেস করেছিল, আমার কী হবে মিস্টার দাশগুপ্ত? চাকরি যাবে? আমার যে ঘুষের টাকা নেই। আমার যে অতি কষ্টেই সংসার চলে। চাকরি গেলে–
আপনি টাকাপয়সায় সৎ আমি জানি। কিন্তু দুর্বলতাও তো এক ধরনের ডেফিসিয়েন্সি। চারিত্রিক ডেফিসিয়েন্সি। ঘোষালবাবু, আমি ভাগ্যবিধাতা নই। আই উইশ ইউ গুড লাক।
স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা–এসব জিনিস কি মানুষকে জরাব করে দেয় নাকি? অন্ধ স্নেহে সাধারণ বুদ্ধি, বিবেচনা, বিবেক বিসর্জন দিতে হলে তো দুনিয়া পিছন দিকে হাঁটতে থাকবে! ঘোষাল বুদ্ধিমান এবং দক্ষ একজন পুলিশ অফিসার। ডিপার্টমেন্টে তার সুনামও বড় কম নয়। পুত্রস্নেহে সে একটা কেস গুবলেট করে দিল এবং মেনে নিতে হল চাকরির ক্ষতিও। শবরের জানতে ইচ্ছে করে, যে ছেলের জন্য ঘোষালের এত দুর্বলতা, সেই ছেলে ভবিষ্যতে ঘোষালকে কী দেবে? আজকালকার ছেলেরা কি পিতৃঋণ কথাটা নিয়ে কখনও ভাবে? বাবা তাদের আইডল নয়, প্রতীক নয়, এমনকী তেমন মান্যগণ্যও কেউ নয়। বাবা শব্দটাই কত হালকা হয়ে গেছে এখন!
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বাংলায় অনেকদিন আগে একটা রচনা এসেছিল, কোনও মহাপুরুষের জীবনী। একটা ছেলে লিখেছিল, আমি একজন মহাপুরুষকে রোজ দেখতে পাই চোখের সামনে। তিনি সামান্য বেতনের একজন কর্মচারী। সংসার চালাতে তাকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। তার একখানা মাত্র জামা, একখানা মাত্র কাপড়। সন্ধেবেলা এসে সেগুলো কাঁচেন, সকালবেলা ফের পরে বেরোন। তিনি কখনও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন না, মিথ্যে কথা বলেন না, ভাগ্যকে দোষ দেন না। উপদেশ দিতেও তিনি ভালবাসেন না। এই মহাপুরুষটি হলেন আমার বাবা। এঁর জীবনী কখনও কোনও ইস্কুলে পড়ানো হবে না, এর কথা কেউ জানতেও পারবে না কখনও, কিন্তু আমার কাছে এমন মহাপুরুষ আর কে?…
দীর্ঘ রচনাটি পড়ে শবরের ইস্কুলমাস্টার জ্যাঠামশাই বাড়িসুদ্ধ লোককে তা পড়ে শুনিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, এমন সোনার টুকরো ছেলেকে কি এক নম্বরও কম দিতে পারি? কুড়িতে কুড়িই পেয়েছিল সেই ছেলেটা।
শবর ভাবছিল, এখনকার কোনও ছেলে কি আর তার বাবার ভিতরে মহাপুরুষ খুঁজে পায়?
দুপুরে ঘোষালের রিপোর্টটাই লিখছিল শবর, এমন সময়ে মধুমিতার ফোন এল।
টুকুদা, একটা প্রবলেম হয়েছে।
কী প্রবলেম?
পাড়ার একটা ক্লাবের কিছু ছেলে আমার শাশুড়ির কাছে টাকা চাইছে। পাড়ায় নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাটে কেউ এলে নাকি ওদের টাকা দিতে হয়।
ক্লাবটার নাম কী?
সবুজ সংঘ।
কত টাকা চাইছে?
সে অনেক টাকা। কুড়ি হাজার।
লোকাল থানায় জানিয়েছিস?
জানানো হয়েছে। তারা এসেছিল। কিন্তু সবুজ সংঘের সেক্রেটারি বলেছে, ক্লাব থেকে টাকা চাওয়া হয়নি। পাড়ার কিছু মস্তান ছেলে এসব করে।
এই প্রথম চাইল, না আগেও চেয়েছে?
শ্বশুরমশাই বেঁচে থাকতেও নাকি একবার এসেছিল। উনি কেমন মানুষ ছিলেন তা তো জানোই। রাগারাগি, চেঁচামেচি করে আর হুমকি দিয়ে ছেলেগুলোকে তাড়ান। কিন্তু শাশুড়ি তো তা পারবেন না। উনি ভয় পাচ্ছেন। তুমি কিছু করতে পারো না?
পারি। কিন্তু তাতে তোর শাশুড়ির প্রবলেম হয়তো বাড়বে।
ছেলেগুলো প্রতিশোধ নেবে বলছ?
সেটাই সম্ভব।
তা হলে?
অর্ক আর বুদ্ধকে বল ছেলেগুলোর সঙ্গে একটা মিটমাটে আসতে। ওদের বলুক যে, ফ্ল্যাটওনাররা সবাই এলে মিটিং করে একটা থোক টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। ইনডিভিজুয়ালি দেওয়া হবে না।
ওরা যে ভয় দেখাচ্ছে। তুমি নেগোশিয়েট করতে পারো না?
শবর একটু ভেবে বলল, পারি, ছেলেগুলোর কারও নাম বলতে পারবি?
একজনের নাম প্রকাশ, আর একজন কালু। প্রকাশ নাকি বড় মস্তান, খুনখারাপিও করেছে।
ঠিক আছে।
আরও একটা কথা।
বল।
শ্বশুরমশাইয়ের একটা এলআইসি পলিসি পাওয়া গেছে, যার নমিনি অজাতশত্রু বসু।
সে আবার কে?
মধুমিতা একটু হেসে বলল, শ্বশুরমশাইয়ের অবৈধ সন্তান।
ওঃ, মাই গড! কত টাকার পলিসি?
পাঁচ লাখ।
হুঁ, তা এ ব্যাপারে তো আর আমার কিছু করার নেই রে।
না, তা নেই। কিন্তু পলিসিটা বেরোবার পর বাড়িতে প্রচণ্ড অশান্তি হচ্ছে।
কার সঙ্গে কার?
সকলের সঙ্গে সকলের, অর্ক আর বুদ্ধ তো ঠিক করে ফেলেছে তারা বাপের শ্রাদ্ধশান্তি করবে না। শাশুড়ি কান্নাকাটি করছেন।
কিন্তু পলিসিটার কী হবে?
সেটাই তোমার কাছে জানতে চাইছি। নমিনি বদল করা যায় না?
আমি কি সবজান্তা? উকিলের সঙ্গে কথা বলতে বল।
আর একটা কথা তোমাকে জানাতে বলেছে অর্ক।
কী কথা?
লিফট কোম্পানির লোক এসেছিল। অর্কই তাদের টেলিফোন করে জানিয়েছিল, লিফট খারাপ ছিল বলেই শ্বশুরমশাই সিঁড়ি ভেঙে উঠতে গিয়ে মারা যান। লিফট কোম্পানির লোকেরা বলে গেছে, সেদিন তাদের সার্ভিসিং-এর কোনও লোক এ বাড়িতে আসেনি।
শবর সংক্ষেপে বলল, ও।
আচ্ছা টুকুদা, তুমি নাকি শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় বলে সন্দেহ করছ?
কে বললে?
অর্কই বলছিল। তুমি নাকি দারোয়ানকে জেরা করে গেছ সেদিন।
ও কিছু নয়।
ফাউল প্লে বলে সন্দেহ হয়?
হতেই পারে। তবে জল ঘোলা করে লাভ নেই। প্রমাণ করা শক্ত।
তুমি তো শক্ত কাজই ভালবাসো।
তোর কি ধারণা আমি সবকিছুর মধ্যেই রহস্য খুঁজে বেড়াই? দারোয়ানকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারণ ঘটনাটার টাইমিং কিছু অদ্ভুত এবং একটু যেন সাজানো। দারোয়ানটা অবশ্য কিছু বলতে পারেনি।
তোমার কী ধারণা?
কোনও ধারণা নেই।
সত্যি করে বলো না টুকুদা, শ্বশুরমশাইকে কি কেউ খুনটুন করতে চেয়েছিল নাকি?
বললাম তো, জানি না।
আচ্ছা, আমরা যদি চাই তা হলে তদন্ত করবে তুমি?
দূর বোকা! এত সহজ নাকি? খুন কি না তার ঠিক নেই, তদন্তের কথা উঠছে কেন?
অর্কও যে সন্দেহ করছে।
তা হলে অর্ককে বল লোকাল থানায় ডায়েরি করতে।
তারপর কী হবে?
আগে লোকাল থানা রিপোর্ট দিক, তারা যদি না পারে তখন গোয়েন্দা পুলিশ কেস হাতে নিতেও পারে। তখন দেখা যাবে।
আচ্ছা, আমি অর্ককে বলছি একটা ডায়েরি করতে। আবার জিজ্ঞেস করছি, ডায়েরি করাই কি ঠিক হবে?
হুঁ।
ভাল করে বলো।
হ্যাঁ, করুক।
তারপর তুমি কেস হাতে নেবে তো?
গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল। ডায়েরি হোক তো।
ফোন ছেড়ে শবর তার রিপোর্ট লিখতে লাগল। ঠিক এই সময়ে ঘোষাল ফের ঘরে ঢুকল।
মিস্টার দাশগুপ্ত?
হ্যাঁ, বলুন।
আই অ্যাম ফিনিশড।
শবর মৃদুস্বরে বলল, আপনি যা করেছেন তাতে ভবিষ্যতে আপনার ছেলেও আপনাকে শ্রদ্ধা করবে না। কাওয়ার্ডরা শ্রদ্ধা পায় না ঘোষালবাবু।
ঘোষাল গুম হয়ে বসে রইল।
শবর সমবেদনার গলায় বলল, আপনাকে হয়তো একটা শশা কজ করা হবে। যদি স্যাটিসফ্যাক্টরি জবাব দিতে পারেন তা হলে সাসপেনশনটা এড়ানো অসম্ভব হবে না।
ঘোষাল তার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলল, ছেলেটাকে আমি বড় ভালবাসি। একটু বেশিই বাসি। বেশি বয়সের সন্তান, আমাদের আর ছেলেপুলে হবেও না।
তাতে কী? একজনকেই মানুষ করুন।
ঘোষাল মাথা নেড়ে বলল, আপনি বুঝবেন না, ছেলেকে ভালবাসি বলেই ওকে নিয়ে আমার সবসময়ে দুশ্চিন্তা আর ভয়। একটু জ্বরটর হলে একটু কেটেকুটে গেলেও আমি অস্থির হয়ে পড়ি। এত উদ্বেগ আর অশান্তি নিয়ে ওকে বড় করব কী করে বলুন তো? এই যে কেসটা খারাপ হয়ে গেল, এর জন্যও তো সেই ভয়টাই দায়ী। বুঝতে পারছেন?
পারছি ঘোষালবাবু।
আমি প্রভিডেন্ট ফান্ড ডিপার্টমেন্ট থেকেই ঘুরে এলাম। যা পাওয়া যাবে তা যথেষ্ট নয়। একটা এলআইসি আছে এক লাখ টাকার। সেটাও বেশি কিছু নয় এই বাজারে। তবু হয়তো চলে যাবে। কী বলেন?
কী সব বলছেন আপনি?
ঘোষাল মাথা নেড়ে বলে, চাকরি তো দূরের কথা বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে দুঃসহ।
কেন এরকম ভাবছেন?
কী জানি! বলে ঘোষাল অসহায়ভাবে হাত ওলটাল। তারপর উঠে টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শবর চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। ভয় দেখানোটা একটা অপরাধ। কারণ ভয় দেখাতে দেখাতে একটা লোককে স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া যায়। ভয় থেকে মানুষ অনেক অন্যায় করে ফেলতে পারে। খুন অবধি। ভয় এক ভয়ংকর জিনিস। আর ভয় একবার পেয়ে বসলে সহজে তাকে ছাড়ানোও যায় না।
রিপোর্টটা আজ শেষ করতে পারল না শবর।
সে উঠে গিয়ে ঘোষালের ঘরে তার খোঁজ করল।
নন্দী বলল, উনি তো স্যার, একটু আগে চলে গেলেন।
ঘোষালের বাড়িতে টেলিফোন আছে, শবর জানে। সে বলল, ওর টেলিফোন নম্বরটা দিতে পারেন?
নিশ্চয়ই। বলে নন্দী একটা কাগজের টুকরোয় নম্বরটা লিখে শবরের হাতে দিয়ে বলল, এই যে স্যার।
শবর ঘরে ফিরে আধঘণ্টা অপেক্ষা করে নম্বরটা ডায়াল করল।
একজন মহিলা ফোন ধরলেন, সতর্ক গলায় বললেন, কে বলছেন?
লালবাজার থেকে বলছি, ঘোষালবাবু ফেরেননি?
না তো! উনি তো ওখানেই গেছেন।
আপনি কি ওঁর স্ত্রী?
হ্যাঁ।
আমি শবর দাশগুপ্ত।
ও আচ্ছা। আপনার কথা ওঁর কাছে শুনেছি। কী ব্যাপার বলুন তো! ওঁর কি চাকরিটা যাবে? উনি খুব ভাবছিলেন।
চাকরি যাবে না। কিন্তু আপনি ওঁকে একটু চোখে চোখে রাখবেন।
কেন বলুন তো!
উনি স্ট্রেস-এর মধ্যে আছেন।
তার মানে? মানসিক চাপ।
হ্যাঁ, তা তো আছেনই। রাতে ঘুমোত পারেন না। সর্বক্ষণ ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন।
আপনার ছেলে কত বড়?
এই তো, আট বছর। ছেলেও বাপের ভীষণ ভক্ত। কিছু বদমাশ তোক ছেলেকে কিডন্যাপ করবে, মেরে ফেলবে বলে ভয় দেখাত বলে উনি এমন পাগলের মতো হয়ে গেলেন।
আপনিও কি ভয় পেয়েছেন?
পাব না? খুবই ভয় পেয়েছি। তবে আমি ওঁর মতো অতটা ভেঙে পড়িনি।
ভয় পাওয়ারই কথা। যাই হোক, ঘোষালবাবুকে একটু নজরে রাখবেন। আমি পরে খোঁজ নেব।
না, শবরের মন ভাল নেই, ফোনটা রাখার পর আবার তার একটা অস্বস্তি হচ্ছিল।
নিতান্ত ডাইভারশনের জন্যই সে জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে এসে বড় রাস্তায় জিপ রেখে পায়ে হেঁটে পাড়ায় ঢুকল। ভয়–এই শব্দটাই বড় ভয়ংকর। এ যুগে দুটো স্পষ্ট দল দেখা যাচ্ছে। এক দল ভয় দেখায়, অন্য দল ভয় পায়।
‘আকাশ প্রদীপ’ বাড়িটার সামনে সে দাঁড়াল। গ্রিলের গেটের ভিতরে একটা লোক টুলের ওপর বসে হাই তুলছে। দারোয়ান হীরেন। সে ভিতরে ঢুকে হীরেনের সামনে দাঁড়াতেই সে উঠে পড়ে একটা সেলাম গোছের কিছু করে বলল, বলুন স্যার।
তুমি কি এ পাড়ার ছেলে?
আমার বাড়ি লাইনের ওধারে।
প্রকাশ বা কালুকে চেনো?
হীরেনের চোখে একটা ভয় ঘনিয়ে উঠল, চিনি স্যার।
কোথায় পাওয়া যাবে ওদের?
হীরেনের বাঁকবজিতে একটা সস্তা ইলেকট্রনিক ঘড়ি। টাইমটা দেখে নিয়ে সে বলল, এখন স্যার, বিকেল পাঁচটা বাজে। এ সময়ে ওরা থাকে না বড় একটা। তবে একটু এগিয়ে গিয়ে মোড়টা পেরোলে ডানদিকে পন্টুর চায়ের দোকান দেখবেন। এখানেই ওদের আড্ডা।
প্রকাশ থাকে কোথায়? আরও এগিয়ে বাঁয়ে লন্ড্রি দেখবেন, তার পিছনের বস্তিতে। লন্ড্রি ঘেঁষেই ঢোকার গলি।
ঠিক আছে।
আমি চিনিয়ে দিয়ে আসব স্যার?
না, আমি একাই ভাল।
পন্টুর দোকানে কেউ ছিল না। একজন বুড়োমতো লোক গামছা পরে বসে হাওয়া দিয়ে আঁচ তুলছিল। সময় নষ্ট না করে শবর এগিয়ে গেল। লন্ড্রির পাশের গলি দিয়ে ভিতরে ঢুকে একটা বেশ পরিচ্ছন্ন বস্তির উঠোনে পৌঁছল সে।
উঠোনটা পাকা না হলেও ইটে বাঁধানো। বিকেল পাঁচটা বাজলেও এখনও উঠোনে উনুন ধরানো হয়নি। তার মানে হয়তো বেশিরভাগ ঘরেই গ্যাস উনুন আছে। ইলেকট্রিকের কানেকশন যে আছে তা দেখতেই পাচ্ছিল শবর।
তিন-চারটে বাচ্চা খাপরা ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলছিল। এদের নানারকম খেলা আছে। নিত্য নতুন খেলা বানিয়েও নেয়। ওদের মধ্যে বড়জন ফ্রক পরা একটা মেয়ে। শবর তাকেই জিজ্ঞেস করল, প্রকাশের ঘর কোনটা বলো তো?
ওই যে। মেয়েটা আঙুল তুলে দেখাল।
ডানদিকের শেষ প্রান্তের ঘরটার সামনে গিয়ে শবর অনুচ্চ স্বরে ডাকল, প্রকাশ!
অপরাধীদের প্রতিক্রিয়া হয় দ্রুত। শবর ডাকতেই ঘরের জানালা টুক করে খুলে গেল।
কে?
শবর ঠান্ডা গলায় বলল, একটু কথা আছে। বাইরে এসো।
জানালা দিয়ে তাকে বোধহয় আরও একটু জরিপ করে নিল প্রকাশ। তারপর লুঙ্গি-পরা খালি গা যে-ছেলেটা বেরিয়ে এল তার মুখশ্রীতে খুব স্পষ্টই মস্তানির ছাপ। রং কালো, শরীরটা বেশ পেটানো, নাতিদীর্ঘ, পুরু ঠোঁট, ছোট চোখ, কোকড়া চুল। একটু আস্পর্ধার ভাব আছে মুখে চোখে। গলাতেও সেটা প্রকাশ পেল, কে আপনি মশাই?
শবর তার দিকে একটু চেয়ে থাকল নিষ্পলক। শবর বিশেষ লম্বানয়। বরং একটু ছোটখাটোর দিকেই। শরীর ছিপছিপে৷ তবু তাকে দেখে যারা যা বুঝবার তারা ঠিকই বুঝে যায়।
প্রকাশও বুঝল। চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলল, আমিই প্রকাশ।
আমি লালবাজার থেকে আসছি, কিন্তু ভয় পেয়ো না। তোমার সঙ্গে কথা আছে। বাইরে চলো। বরং একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে এসো।
প্রকাশ একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কিন্তু আমি কী করেছি স্যার?
বললাম তো, ভয় পেয়ো না। তোমার কাছে কয়েকটা কথা জানার আছে। ধরপাকড় করতে আসিনি।
প্রকাশ ঘরে গিয়ে গেঞ্জি নয়, পুরো প্যান্ট আর টি শার্ট পরে বেরিয়ে এল।
চলুন স্যার।
শবর তাকে নিয়ে পর দোকানেই এল।
এটা তোমার ঠেক?
হ্যাঁ স্যার।
চলো বসি।
দোকানে এখনও তেমন খদ্দের নেই। গরিব দোকান। বিস্কুট আর চা ছাড়া বোধহয় আর কিছু হয় না। জনা দুই রিকশা বা ঠেলাওলা গোছের লোক চা খাচ্ছে। বুড়ো মানুষটা চা বানাতে বানাতে একবার চোখ তুলে প্রকাশকে দেখল।
চা-টা স্যার আমিই খাওয়াচ্ছি।
খাওয়াও।
চায়ের কথা বলে দিয়ে প্রকাশ এসে পাশে বসল, এবার বলুন স্যার।
গত তেরো তারিখে আকাশ প্রদীপ বাড়ির আটতলার বাসুদেব সেনগুপ্ত মারা গিয়েছিলেন, জানো তো।
হ্যাঁ স্যার। বহুত টেটিয়া লোক।
শবর হাসল, কীরকম টেটিয়া?
আমরা স্যার, পাড়ার বেকার ছেলে। এ পাড়ায় নতুন কেউ ফ্ল্যাটট্যাট করে এলে আমরা কিছু পাই। কিন্তু বাসুবাবু আমাদের কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। উনি নাকি প্লেয়ার ছিলেন, ভিআইপি-দের অনেককে চেনেন, এসব বলে ভয়ও দেখিয়েছিলেন।
আচ্ছা, সেকথা থাক। আমি বলছি তেরো তারিখ সন্ধেবেলার কথা। সন্ধে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে উনি মারা যান হার্ট অ্যাটাকে।
সব জানি স্যার। লিফট খারাপ ছিল বলে উনি হেঁটে উঠতে গিয়ে বুকে খিচ হয়ে গেল। আমাদের গজু তো পুরো ব্যাপারটা দেখেছে।
গজু কে?
ওর নাম গিরিধারী। আমাদের বন্ধু। সন্ধেবেলা আকাশ প্রদীপের গ্যারেজের পিছনে বাথরুমে পেচ্ছাপ করতে গিয়েছিল। তখন দুটো লোক লিফট সারাতে আসে। তার পরেই বাসুদেববাবু এলেন। সব দেখেছে।
গজুকে কি পাওয়া যাবে?
যাবে। আপনি বসুন, আমি ডেকে আনছি। কাছেই বাড়ি।
প্রকাশ গেল এবং পাঁচ-ছ’ মিনিটের মধ্যেই একটা পাতলা ছিপছিপে ছেলেকে নিয়ে ফিরে এল।
প্রকাশ বলল, স্যারকে সব বল। লালবাজারের লোক। গজুর মুখটা সবসময়েই একটু হাসিহাসি। বেঞ্চে মুখোমুখি বসে লাজুক গলায় বলল, আকাশ প্রদীপের দারোয়ান হীরেন আমার বন্ধু স্যার। মাঝে মাঝে একতলায় গ্যারেজে দুপুরবেলা আমরা তাসটাসও খেলি। বাথরুম পেলে বাথরুমেও যাই।
বুঝেছি। আকাশ প্রদীপে তোমাদের একটা ঠেক আছে।
এখনও আছে, তবে সব ফ্ল্যাটে লোক এসে গেলে আর থাকবে না।
তুমি সেদিন সন্ধেবেলা ও বাড়িতে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ স্যার। হীরেন চা খেতে গিয়েছিল। আমাকে বলে গিয়েছিল গেটটা একটু দেখতে। আমি টুলে বসেছিলাম। হঠাৎ দুটো নোক এসে বলল, তারা লিফট সারাতে এসেছে।
লোকদুটোর চেহারা কীরকম বলতে পারবে?
হ্যাঁ স্যার। প্যান্ট শার্ট পরা। মাঝারি লম্বা। অর্ডিনারি চেহারা। তা
দের হাতে কোনও যন্ত্রপাতি বা বাক্স গোছের কিছু ছিল?
না স্যার।
ফের দেখলে চিনতে পারবে?
গজু একটু হেসে বলল, বলা মুশকিল স্যার। হয়তো পারব।
তারা কী করল?
লিফটে ঢুকে কীসব করছিল। এরকম সময়ে আমি বাসুদেববাবুকে ফিরতে দেখলাম। উনি আমাদের একদম পছন্দ করেন না। তাই আমি উঠে বাথরুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে দেখলাম উনি হীরেনকে খুঁজছেন। না পেয়ে কী ভাবলেন, তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন।
তারপর কী হল? মিস্ত্রিরা কিছুক্ষণ খুটখাট করে বেরিয়ে এল। একজন সিঁড়িটা দেখে নিয়ে অন্যজনকে বলল, চল। হয়ে গেছে। তারপর দুজনেই বেরিয়ে চলে গেল। তারা লিফটের দরজা বন্ধ করল না।
লিফটের দরজা খোলা রাখলে কী হয় তুমি জানো?
জানি স্যার। ও বাড়ির লিফটে মাঝে মাঝে আমরা ওঠা-নামা করি। দরজা ভালমতো বন্ধ না করলে লিফট চলে না।
দরজাটা কে বন্ধ করল, তুমি?
না স্যার। আমি ভাবলাম, মিস্ত্রিরা বোধহয় কিছু আনতেটানতে গেছে, আবার এসে সারাবে। তাই আমি লিফটের ধারে যাইনি। তবে আরও একটু বাদে চারতলার মৌলিকবাবুরা নেমে এলেন। মৌলিকবাবুই লিফটের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আর কিছু দেখেছ?
না স্যার।
শবর চা খেল। দোকানের চেহারা হতদরিদ্র হলেও চা-টা কিন্তু খারাপ নয়। গুঁড়ো চায়ের একটা বেশ ঝাঝালো গন্ধ আছে, দুধ চিনির মাপ চমৎকার।
শবর প্রকাশের দিকে চেয়ে বলল, বাসুদেববাবুর স্ত্রীর কাছে কত টাকা চেয়েছ?
প্রকাশ একটু ভয় খেয়ে বলল, আমরা একটু বেশিই চাই স্যার, কিন্তু পার্টি কি আর অত দেয়? দরাদরি করে অনেক নামিয়ে ফেলে।
বাসুদেববাবু আমার আত্মীয় হন।
প্রকাশ এক গাল হেসে বলল, তাই বলুন স্যার। উনি বলতেন বটে অনেক ভিআইপিকে চেনেন।
আমি ভিআইপি নই, সাধারণ গোয়েন্দা মাত্র।
আমাদের কাছে আপনিই ভিআইপি। ঠিক আছে স্যার, মাসিমাকে বলে দেবেন, কিছু দিতে হবে না।
আরে না। ছাড়বে কেন? কিছু নিয়ো।
কত নেব স্যার, দু-চারশো টাকা?
অত কম নয়। হাজার টাকা চেয়ে।
ঠিক আছে স্যার।
শবরের মন ভাল নেই। একটা অস্বস্তি হচ্ছে। বাসুদেবের মৃত্যুটা যে ঘটানো হয়েছে এতে তার আর সন্দেহ নেই। ইচ্ছে করলে সে ব্যাপারটা নাড়াঘাটা নাও করতে পারে। দুনিয়ার সব ঘটনার সমাধান কি হয়?
সে উঠল। বলল, আজ চলি। মনে হচ্ছে তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।
গজু হঠাৎ বলল, স্যার বাসুদেববাবুর কেসটায় কি কিছু গড়বড় আছে?
শবর একটা শ্বাস ফেলে বলল, আছে গজু। হয়তো তোমাকে সাক্ষীও দিতে হতে পারে।
সাক্ষী দিলে কি স্যার মালকড়ি কিছু পাওয়া যাবে?
এমনিতে পাওয়া যায় না। তবে তোমার ব্যাপারটা আমি দেখব।
গজু একটু থ্রিল অনুভব করছে। বেশ খুশিয়াল গলায় বলল, কখনও সাক্ষী ফাক্ষি দিইনি স্যার। টিভিতে দেখাবে?
না। তবে কাগজে নাম উঠতে পারে।
উরেব্বাস৷ হেভি কেলো।
শবর বড় রাস্তায় এসে জিপে উঠল।
রাত দশটার পর সে ঘোষালের বাড়িতে ফোন করল।
ঘোষালগিন্নি একটু উত্তেজিত গলায় বললেন, উনি এইমাত্র ফিরলেন। কিন্তু ঘোর মাতাল অবস্থায়। কী হচ্ছে বলুন তো। উনি তো জীবনে কখনও এসব খাননি।
খুব মাতলামি করছেন?
মাতলামি করবে কী, উঠতেই পারছে না। ট্যাক্সিওলা ধরে ধরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল। তারপর একরাশ বমি করে এখন অচৈতন্য।
তা হলে ঘুমোতে দিন। সকালে ঘুম ভাঙলে ভাল করে পেট ভরে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দেবেন। ঠিক হয়ে যাবে।
আমার ভীষণ ভয় করছে। খুব হ্যাপি ফ্যামিলি ছিলাম আমরা, সব যে ভেঙে পড়ছে!
মানুষের খারাপ সময় তো আসে বউদি। কেটেও যায়।
ওঁর কোনও বিপদ হবে না তো? আপনি অভয় দিচ্ছেন?
দিচ্ছি।
চাকরি গেলে বা সাসপেন্ড হলে উনি বোধহয় মনের দুঃখেই মারা যাবেন।
আপনি অত ভাববেন না। সকালে আমি টেলিফোনে ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলব।
বলবেন প্লিজ! উনি ভাল লোক, কিন্তু একটু একগুয়ে।
শবর টেলিফোন রেখে অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে ঘোষালকে নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবল। ভয়? ভয়ের ওপরে ওঠা মানুষের পক্ষে খুব শক্ত ব্যাপার। ভয় এক সাংঘাতিক জিনিস।
শবর ঘুমোল।
সকালে টেলিফোন করতেই ঘোষালগিন্নি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, মিস্টার দাশগুপ্ত, উনি বিষ খেয়েছেন।
বিষ!
হ্যাঁ, সকালে উঠে বাথরুমে গিয়েছিলেন। আমি চা করছিলাম। চা নিয়ে এসে দেখি উনি একটা পোকা-মারা বিষের টিন থেকে ঢকঢক করে খাচ্ছেন।
হাসপাতালে শিট করা হয়েছে?
অ্যাম্বুলেন্স আসছে। কী হবে মিস্টার দাশগুপ্ত?
আমি যাচ্ছি। শক্ত থাকুন। কতটা খেয়েছেন?
তা জানি না। আমি হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলাম।
শবর ফোন রেখে দ্রুত পোশাক পরে নিল। ঘোষালের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ কি সে? শবর ভাবছিল, এও কি এক ধরনের প্যাসিভ মার্ডার? মানুষ যে আসলে কত অসহায় তা ভাবলে অবাক হতে হয়।