Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra » Page 39

সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra

রূপচাঁদবাবু চলে গেলেন। ভূতনাথের কেমন ভয় করতে লাগলো। আর মাত্র ক’দিন বাকি ছিল জবার বিয়ের। প্রায় সব তোড়-জোড় হয়ে গিয়েছে। বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠি পর্যন্ত তৈরি। ঠিক এই সময়ে সুবিনয়বাবুর অসুখ! ভাউচার মিলিয়ে হিসেব বুঝিয়ে দিতেও দেরি হলে অনেক। টাকা-কড়ির ব্যাপার, অত তাড়াহুড়ো করলে চলে না।

সরকারবাবু বলে—আপনাদের কী মশাই, আপিস থেকে বেরিয়ে গিয়েই খালাস,কিন্তু আমার এখনও বসে-বসে সব মিলিয়ে তবে ছুটি। রাত্রে বাড়ি গিয়েও এক-একদিন ভালো ঘুম হয় না।

ভূতনাথের তখন অত কথা ভাববার সময় নেই। জবার কথাই বার-বার মনে পড়ছিল। যদি ভালোয়-ভালোয় এখন অসুখটা সেরে যায় শীগগির, তবেই বিয়েটা নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হবে। জবার বিয়েতে ভূতনাথেরই কি কম দায়িত্ব! বাইরের কাজগুলো তো সব ভূতনাথকেই করতে হবে।

সুবিনয়বাবু বলেছিলেন—তোমাকেই সব ভার নিতে হবে ভূতনাথবাবু।

জবা বলেছিল—ছুটির জন্যে আপনি ভাববেন না, বাবা রূপচাঁদবাবুকে বলে দেবেন।

তা সত্যি কথা। ছুটির জন্যে বিশেষ ভাবনা তারও ছিল না। সুবিনয়বাবুর কথাতেই মাত্র তার মাইনে বারো টাকা। আর সব বিল ক্লার্ক তো সাত টাকা করেই পায়।

সুবিনয়বাবুর বাড়িতে এই প্রথম বিয়ে। তার অনেক দিনের সাধ। উৎসব অনেকবার সুবিনয়বাবু করেছেন। প্রত্যেক বছরেই মাঘোৎসব হয়। সেদিন জবাই সমস্ত করে। সমাজের প্রত্যেকটি লোকই সেদিন আসে। অত লোকের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন, আপ্যায়ন আর উপাসনা। কতদিন ভূতনাথ সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কাটিয়েছে জবাদের বাড়ি। দলে-দলে ছেলেরা আসে, মেয়েরা আসে। কুড়ি বাইশ বছরের মেয়েরা ঘোমটা না দিয়ে আসে। কোথাও আড়ষ্টতা নেই। ভূতনাথেরই বরং লজ্জা করে তাদের দিকে চোখ তুলে কথা বলতে। দামী দামী শাড়ি পরা, ব্লাউজ পরা। মাথায় সিঁদুর নেই। সেদিন ফুল দেবদারু পাতা দিয়ে সাজানো হতো বড় হ-ঘরটা। ফলাহারী পাঠক তখন ছিল। ‘মোহিনী-সিঁদুর’-আপিস সেদিনটা বন্ধ থাকতো। চাকর দাবোয়ানদের নিয়ে ভূতনাথ বাড়ি সাজাবার ভারটা নিতে। ঢালোয়া খিচুড়ি রান্না হতো সকলের জন্যে। গান হতে কত রকমের। একবার একটা গান হয়েছিল। সবটা বেশ মুখস্ত আছে এখনও।

ভুবন হইতে ভুবনবাসী এসে আপন হৃদয়ে।
হৃদয়মাঝে হৃদয়-নাথ, আছে নিত্য সাথ-সাথ,
কোথা ফিরিছ দিবারাত, হের তাঁহারে অভয়ে।
হেথা চির আনন্দধাম, হেথা বাজিছে অভয় নাম।

হেথা পূরিবে সকল কাম, নিভৃত অমৃত-আলয়ে। সুরটাও বেশ চমৎকার। জবা সামনে বসে সকলের সঙ্গে গাইছিল।

ভূতনাথ পরে জিজ্ঞেস করেছিল—এটা কী সুর জবা, শুনতে বেশ চমৎকার তো!

জবার কাছেই শুনেছিল, সুরটা নাকি—বড়হংস সারঙ্গ।

আর একটা গান ছিল—আশা ভেঁরো—

তোমারি নামে নয়ন মেলিনু, পূণ্য প্রভাতে আজি;
তোমারি নামে খুলিল হৃদয়-শতদল-দলরাজি।
তোমারি নামে নিবিড় তিমিরে ফুটিল কনক-লেখা;
তোমারি নামে উঠিল গগনে কিরণ-বীণা বাজি।…

শেষটা আর মনে নেই ও-গানটার।

এবারেও মাঘোৎসব হবার কথা ছিল জবার বিয়ের পর। কিন্তু অসুখ হয়ে সব যেন গোলমাল হয়ে গেল। এখন কোথায় রইল জবার বিয়ে। সেবারও অসুখ হয়েছিল সুবিনয়বাবুর। সারতে কিছুদিন সময় লেগেছিল, এবারের অসুখটায় যদি তেমনি অতদিন সময় লাগে তো জবার বিয়ে নিশ্চয়ই পেছিয়ে যাবে।

কোথায় ভবানীপুর আর কোথায় বার-শিমলে।

সাইকেল করে যেতে-যেতে ভূতনাথের অনেক কথাই মনে পড়ে। এতক্ষণ রূপচাঁদবাবু নিশ্চয়ই পৌঁছে গিয়েছেন। সেবার সুপবিত্র ডাক্তার আনতে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভূতনাথকেই করতে হয়েছিল সব এবারও করতে হবে নিশ্চয়ই। বাড়ির আত্মীয়স্বজন বলতে তো আর কেউ নেই কোথাও। এক সুপবিত্র আছে। তা সে-ও একটু নিরীহ প্রকৃতির। বেশি কথা বলে না। চুপচাপ শোনে সব। কাজ করবার আগ্রহও আছে তার, কিন্তু একটু লাজুক। এতদিনের প্রতীক্ষার পর তা-ও যদিই বা সমস্ত স্থির, এই সময়ে এমন বাধা।

গলি-ঘুঁজি দিয়ে চলতে চলতে এক-এক জায়গায় নেমে দাঁড়াতে হয়। দু’পাশে নর্দমা, রাস্তার মাঝখানে টিমটিমে আলো জ্বেলে একটা গরুর গাড়ি হয় তো দাঁড়িয়ে আছে। দোকানের সামনে মাল নামাচ্ছে। এ-পাশে একটা বয়া-তবলার দোকান, তার পাশে হরিণের চামড়া, বাঘের চামড়া, ভালুকের চামড়া ঝোলানো। রাস্তার ওপরেই লোহার উনুন জ্বেলে কেউ রান্না চড়িয়ে দিয়েছে। অত রাত্রেও রাস্তার কলের জলের সামনে ভিড় কমেনি। কোনো জায়গায় রাস্তার গ্যাসের আলোর তলায় বসে দাবা খেলা জুড়ে দিয়েছে বুড়োরা। আরো পঞ্চাশজন ঘিরে তাদের হার-জিত লক্ষ্য করছে। খেলার সমালোচনা করছে। দাঁড়িয়েছে রাস্তা জুড়ে, চলবারই উপায় রাখেনি।

সাইকেল-এর ঘণ্টা বাজিয়ে সাবধানে চলতে হয়।

কেল্লায় তোপ পড়লো একটা। তবে তো বেশি রাত হয়নি। কিন্তু এখনও যে অনেকদূর। সাইকেল চালাতে-চালাতে পা ব্যথা করে আসে ভূতনাথের। এই সাইকেলই যখন প্রথম উঠলোহ করে দেখতে লোকে। অবাকও হতো। দুটো চাকার ওপর দিয়ে চালানো, মনে হতো পড়ে তো যায় না। শাশা করে চলতো সব। সাইকেল দেখে ভয়ে দু’পাশে সরে যেতে লোক। ধাক্কা দিয়ে চাপা দিলে আর রক্ষে থাকবে না। ক্রিং-ক্রিং ঘণ্টার বাজনা। শব্দ শুনে বাড়ির ছেলে মেয়েরা কাজকর্ম ফেলে জানালায় এসে দাঁড়াতে একদিন। এখন বদলে গিয়েছে সব। এখন কেউ ফিরেও চায় না।

বৌবাজারের কাছে আসতেই শেয়ালদ’র মোড়। এখানটায় আললা, লোকজনের চলাচল বেশি। প্রথম যেদিন কলকাতায় এসেছিল ভূতনাথ, এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। তখন হ্যারিসন রোড হয়নি, এ রাস্তাটায় ভিড় ছিল বেশি। কলকাতা শহরের মধ্যেই কত পুকুর ছিল চারদিকে। সব একে-একে বুজিয়ে ফেলছে এখন। যত সব জঞ্জাল এনে ফেলে পুকুরের জলে। আর গন্ধে চলা দায় তার ধার-কাছ দিয়ে। মাছিগুলো টানাপাখার দড়িতে এসে বসে। একেবারে মাছিতে ঢেকে যায় সব। কালো হয়ে যায়। তারপর চো-বোশেখের ঝড়ে সেই ময়লা-ধুলো উড়ে এসে ঘরময় ছড়িয়ে যায়।

বার-শিমলের রাস্তায় পড়ে ভূতনাথ সাইকেল থেকে নামলো। এ-রাস্তাটায় এখনো আলো হয়নি। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। তবু কিছু দূরে হেঁটে গিয়েই মনে হলো যেন কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে জবাদের বাড়ির সামনে। খবর পেয়ে সবাই বুঝি এসেছে।

দরজাটা খোলাই ছিল। ভেতরে একটা থমথমে ভাব। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই নাকে যেন ওষুধের গন্ধ পাওয়া গেল। তীব্র একটা গন্ধ। বড়বাড়িতে ছোটবাবুর ঘরের কাছে গেলেও এই রকম গন্ধ বেরোয় আজকাল। উপাসনা-ঘরের ভেতর ফরাশের ওপর অনেক ভদ্রলোক বসে আছেন। সবার মুখেই দাড়ি। সবাই বেশি বয়েসের লোক। চুপি-চুপি গলা নিচু করে কথা বলছেন। রূপচাঁদবাবুকেও দেখা গেল—একজন ডাক্তারের সঙ্গে কী যেন কথা বলছেন।

আর সুবিনয়বাবুর ঘরে…

ভূতনাথ একবার সুবিনয়বাবুর শোবার ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখলে।

জবা বসে আছে সুবিনয়বাবুর বিছানার পাশে। মাথার দিকে। তার পাশেই সুপবিত্র। সে-ও যেন আজ উদ্বিগ্ন। আর একজন ডাক্তার সুবিনয়বাবুর নাড়ী পরীক্ষা করছেন। সুবিনয়বাবু চিত হয়ে শুয়ে আছেন বিছানার ওপর। চোখ দুটি বোজানো।

টিপি-টিপি পায় ভূতনাথ ঘরের এককোণে গিয়ে দাঁড়ালো।

জবা যেন তার দিকে একবার চাইলে। সুপবিত্ৰও চাইলে একবার। কিন্তু কথা বেরুলো না কারোর মুখ দিয়ে।

মৃত্যু!

মৃত্যুর সঙ্গে মুখখামুখি পরিচয় ভূতনাথের আছে। কঠিন, সাদা, স্পষ্ট মৃত্যু। এত স্পষ্ট করে ভূতনাথ মৃত্যুকে দেখেছে যে একবার দেখলে আর চিনতে ভুল হয় না তার। চেনা যায় তার পুরোনো রূপ। পুরোনো পদধ্বনি। অন্ধকারের অস্পষ্ট আবহাওয়ায় কোথায় যেন আলোড়ন শুরু হয় প্রথমে। তারপর ঘন হয়ে আসে অন্ধকার। সেই ঘন অন্ধকারে তখন স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হয়ে আসে তার চেহারা। ধীরে-ধীরে শ্বাপদ-সতর্ক পায়ে সে নামে এখানে। এখানের এই অবসাদগ্রস্ত ঘরে। তারপর চারিদিকে চেয়েচেয়ে দেখে নেয়। সেবার মানুষের মস্তিষ্কের কোষে-কোষে সে বিষ, ঢুকিয়ে দেয় অজ্ঞাতে। অন্ধ করে দেয় দৃষ্টি। সুস্থ মস্তিষ্ক করে তোলে অসুস্থ! কান্নায় কাতর হয়ে যখন সকলের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, সকলের চিন্তাশক্তি যখন অগোছালো, তখন, সেই সুযোগে সে এসে কাছে বসে। অতি সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে দেয় মুমূর গায়ে। ঠাণ্ডা বরফ-শীতল সে-স্পর্শ। আস্তে-আস্তে হিম হয়ে আসে দেহ। কণ্ঠরোধ হয়ে আসে ধীরে ধীরে। কথা বলতে চেষ্টা করে সে। চোখ মেলতে চেষ্টা করে সে। দু’হাত বাড়িয়ে জাপটে ধরতে চেষ্টা করে সে। চেষ্টার অবধি থাকে না তার। চোখ দুটো বার-বার লক্ষ্যহীন হয়ে আসে। অনুভূতির তীব্র আবেগে সে চিৎকার করতে চেষ্টাও করে। কিন্তু সব চেষ্টা তখন, নিষ্ফল। সব চেতনা তখন নিস্তেজ।

প্রথম মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তার সেই পোষা বেজিটার কাছে।

অবলা জানোয়ার। কিন্তু শেষকালে সে-ও যেন কথা বলতে চেষ্টা করেছিল। স্পষ্ট ভাষায় যেন জানাতে চেয়েছিল তার বেদনার কথা। দাত দিয়ে কামড়ে দিয়ে জানাতে চেয়েছিল তার শেষ ভালোবাসা। কিন্তু নিস্তেজ হয়ে এল ক্রমে। মানুষের কাছে তার নিবেদন ব্যর্থ হলো একটু শক্তির অভাবে।

আর তারপর তার পিসীমা।

প্রথম দিনটি থেকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর পদক্ষেপ সে শুনেছে। প্রতি মুহূর্তের নিঃশ্বাস পতনে মৃত্যুর পরোক্ষ স্পর্শ সে পেয়েছে। কেমন করে শিথিল হয়ে আসে শিরা-উপশিরা, কেমন করে আলো নিবে আসে চোখের, কেমন করে এ জগতের সমস্ত চেতনা সমস্ত অনুভূতি একে-একে লুপ্ত হয়ে যায়, তার হিসেব ভূতনাথের মুখস্ত! বেজিটার মতন পিসীমা’র দেহও তার হাতের ওপর একদিন ঠাণ্ডা কঠিন হয়ে উঠেছে। এই হাতের স্পর্শে এখনও সে-অনুভূতি খুঁজলে পাওয়া যাবে বুঝি। মানুষের সমস্ত চেষ্টা, সমস্ত আবেদন-নিবেদন, মানুষের সমস্ত ভালোবাসা এক সময়ে কেমন করে মূল্যহীন হয়ে যায় ভূতনাথের তা কণ্ঠস্থ!

তা ছাড়া আর একটা অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা নয়, অনুভূতি!

সে রাধার মৃত্যু! মৃত্যু নয়, মৃত্যুর সংবাদ। মৃত্যুর সংবাদ এমন করে যে অসাড় করে দিতে পারে মনকে, সে-ও এক বিচিত্র অনুভূতি! সেদিন মনে হয়েছিল সমস্ত বুকটা যেন খালি ঠেকছে, সমস্ত আবেগ যেন নিথর হয়ে গিয়েছে, সমস্ত জীবন যেন নিঃশেষ!

আজ সুবিনয়বাবুর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে লোকজন, ডাক্তার, বরফ, ওষুধের তীব্র গন্ধের মধ্যেও যেন সেই পুরোনো স্মৃতি ফিরে পেলে ভূতনাথ। সেই কঠিন, সাদা, স্পষ্ট আর নিষ্ঠুর মৃত্যু! অভিযোগহীন, প্রতিকারহীন, অবধারিত এক দুর্ঘটনা!

ক্রমে রাত অনেক হলো। একে-একে কখন সবাই চলে গিয়েছেন। ডাক্তারও নিজের কর্তব্যের শেষটুকু সমাধা করে খানিকক্ষণের জন্যে বিদায় নিয়েছেন। সুপবিত্র আর জব পাথরের মূর্তির মতো ওপাশে বসে আছে। ভূতনাথ একমনে সুবিনয়বাবুর মাথায় বরফ দিচ্ছিলো। হাতে কাজ করে চলেছে ভূতনাথ, কিন্তু কোথায় যেন রাত্রের অন্ধকারে এক অশরীরী মূর্তির আবির্ভাবের আশঙ্কায় কম্পমান। একটু অসতর্ক হলেই যেন সে আসবে। সমস্ত চেষ্টাকে শিথিল করে দিয়ে চলে যাবে এক মুহূর্তে!

হঠাৎ সুবিনয়বাবুর যে চেতনা হলো। বললেন—কে?

অতি ক্ষীণ শব্দ।

ভূতনাথ মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বললে—আমি, ভূতনাথ।

–জবা, জবা কোথায়?

—বাবা! জবার গলা কান্নায় বড় করুণ শোনালো। ভূতনাথ ঠে দাঁড়ালো। সামনে এসে বসলে জবা।

–মা!

সুবিনয়বাবু যেন আর দুজনের দিকে চাইলেন একবার।

—কিছু বলবেন বাবা?

তবু যেন মুহূর্ষু-দৃষ্টিতে কেমন দ্বিধা প্রকাশ করলেন। একবার চোখ বুজলেন। আবার চোখ খুললেন। চাইলেন সুপবিত্রের দিকে। চোখ দিয়ে তার স্নেহ উথলে উঠলো যেন। কিছু কথা বলতে চেষ্টা করতে গিয়েও যেন থেমে গেলেন একবার।

জবা নিচু হয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে—কিছু বলবেন আমাকে?

সুবিনয়বাবু যেন অপরাধীর মতো একবার চাইলেন জবার দিকে।

–মা!

–বড় কষ্ট হচ্ছে?

–না। সুবিনয়বাবুর চোখ দুটো জলে ভরে এল। এবারও যেন কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। চাইলেন একবার সুপবিত্রর দিকে।

সুপবিত্রও একবার নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করলো-কিছু বলবেন আমাকে?

সুবিনয়বাবু হাত নাড়লেন।—না।

ভূতনাথ ইঙ্গিতে সুপবিত্রকে ডাকলো এবার। জবাকে বললে —আমরা পাশের ঘরে আছি, দরকার হলে ডেকো জবা।

সুবিনয়বাবু এবার যেন খানিকটা স্বস্তি পেলেন। চোখের দৃষ্টি সামান্য সহজ হয়ে এল। চোখ দিয়ে ভূতনাথকে আর সুপবিত্রকে একদৃষ্টে অনুসরণ করতে লাগলেন।

জবা তখনও বাবার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

ভোর তখনও হয়নি ভালো করে। বার-শিমলের বসতি-বিরল পাড়ায় তখনও অন্ধকার জমাট। শুধু জানালা দিয়ে পুব আকাশের দিকে চাইলে দেখা যায় যেখানটায় আকাশ মাটি ছুঁয়েছে, ওখানে যেন অন্ধকার কিছু তরল হয়ে আসছে। ভূতনাথ আবার কান পেতে শুনতে লাগলো। পাশের সুবিনয়বাবুর ঘর থেকে কোনো শব্দ কোনো চেতনার আলোড়ন কানে আসে কিনা।

জবার ঘরের প্রত্যেকটি জিনিষ লক্ষ্য করতে লাগলো ভূতনাথ। জবার টেবিলের ওপর সুপবিত্রের একটা ছবি। প্রত্যেকটি বই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিপাটি করে সাজানো। দেয়ালের আলনায় জবার শাড়িগুলো পর্যন্ত কুঁচিয়ে রাখা। কোথাও এতটুকু অপব্যয় নেই। সমস্ত রাত বসে-বসে ভূতনাথের যেন ক্লান্তি এসেছে। ভূতনাথ সুপবিত্রর দিকে চেয়ে দেখলে একবার। জবার বিছানার ওপর জবার বালিশেই মাথা রেখে সুপবিত্র অকাতরে ঘুমোচ্ছ তখন থেকে। ঘুমোলে সুপবিত্রকে জেগে থাকার মতোই কেমন অসহায় দেখায়। কেমন নিশ্চিন্ত মানুষ সুপবিত্র। এই অবস্থার মধ্যেও ঘুমোতে পারলো!

ঘড়িতে একটার পর একটা বেজে চলেছে। ভূতনাথের মনে হলো কতক্ষণে রাত শেষ হবে কে জানে! প্রতীক্ষার আলস্যে যেন অস্থির হয়ে উঠেছে ভূতনাথ।

ভোরের দিকে হঠাৎ জবা এল।

দরজা খোলাই ছিল। চেহারা দেখে ভূতনাথ যেন চমকে উঠেছে। এ-জবাকে যেন চেনা যায় না আর। সমস্ত রাতের জাগরণের পর জবার যেন হঠাৎ দশ বছর বয়স বেড়ে গিয়েছে।

ভূতনাথ অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করলে—বাবা এখন কেমন আছেন জবা?

জবা কিন্তু সে-প্রশ্নের জবাব দিলে না। বললে—ডাক্তারবাবু এসে গিয়েছেন—কিন্তু সুপবিত্র! সুপবিত্র কই?

–ঘুমোচ্ছন।

–আপনি এক কাজ করুন ভূতনাথবাবু—সুপবিত্ৰকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসুন।

–না-ই বা গেলেন, থাকুন না, এখন তো ঘুমোচ্ছেন, আর বাড়িতে ওঁর মাকে তো খবর দিয়েই এসেছি।

—না, তবু আপনি ওকে জাগান।

জবার গলার আওয়াজ শুনে ভূতনাথও যেন কেমন ভয় পেলো। হঠাৎ এমন সুরে তো কখনও কথা বলে না জবা! রাত্রে এমন কী ঘটনা ঘটলো! সুবিনয়বাবু একান্তে জবাকে কী বলতে চেয়েছিলেন।

ভূতনাথ আবার একবার অনুনয় করবার চেষ্টা করলে। বললে—কিন্তু জাগিয়ে লাভ কি জবা—ঘুমোচ্ছন ঘুমোনো নামিছিমিছি—

জবা যেন এবার কর্কশ-কঠিন হয়ে উঠলো। বললে—যা বলছি আপনি করবেন কিনা?

ভূতনাথ এবার অনুরোধের ভঙ্গীতে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো। বললে—সুপবিত্রবাবুর তত শরীর খারাপ হচ্ছে না, আর তা ছাড়া উনিও কি এই সময়ে তোমাকে একলা ছেড়ে যেতে চাইবেন!

জবা বললে—অত কথা বলবার আমার সময় নেই ভূতনাথবাবু —যেতে না চাইলেও ওকে যেতেই হবে!

—কেন? ও-কথা বলছো কেন জবা? ওঁরও তো একটা কর্তব্য আছে!

জবা এবার যেন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইলো। কিন্তু কান্নার আবেগে গলাটা বুজে এল তার। বললে-না, না, না—ওর কোনো কর্তব্য নেই।

—সে কি?

জবা এবার বাবার ঘরের দিকে চলেই যাচ্ছিলো। কিন্তু একবার ফিরে দাঁড়ালো। বললে-ভূতনাথবাবু, আপনি আর এ-সময় তর্ক করবেন না। আমার সব গোলমাল লাগছে-ওর অার কোনো কর্তব্যই নেই আমাদের ওপর, আমারও আর ওর সঙ্গে মেলামেশা ঠিক নয়।

–কেন?

জবা যেন পাগলের মতো ছটফট করতে লাগলো। বললে–ভূতনাথবাবু, দয়া করে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসুন। ওকে বলবেন—ও যেন আর কখনও এ-বাড়িতে না আসে—কখনও না আসে।

কথাটা শুনে ভূতনাথ যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল।

ততক্ষণে জবা পাগলের মতোই আবার গিয়ে সুবিনয়বাবুর ঘরে ঢুকে পড়েছে।

ভূতনাথও পেছন-পেছন গেল। সমস্ত হিসেবটা যেন গোলমাল হয়ে গেল তার হঠাৎ। জবার মুখে যেন এক অস্বাভাবিক কাঠিন্য। অথচ চোখে যেন সেই আর্দ্রতা। নিজেকে যেন অনেক কষ্টে চেপে রেখেছে সে।

সুবিনয়বাবুর ঘরে তখন নিঃশব্দ ভয়াবহতা, ডাক্তার চুপ করে বসে আছেন সুবিনয়বাবুর দিকে মুখ করে। উদগ্রীব হয়ে আছেন চরমতম মুহূর্তের জন্যে। যেন এখনি শুরু হবে অবশ্যম্ভাবী পদসঞ্চার। ছায়া-ছায়া ভোর। নীলচে অন্ধকার। ভূতনাথ ডাক্তারের দিকে উন্মুখ আগ্রহে চেয়ে দেখলে। সে-মুখে কোথাও কোনো বিরক্তি নেই, ব্যতিক্রম নেই।

আর সুবিনয়বাবু! সুবিনয়বাবুর স্তিমিত চোখ যেন এ-পৃথিবীর উধ্বে অন্য এক লোকে নিবদ্ধ হয়ে আছে। সেখানে জীবন নেই, মৃত্যু নেই, অবাঙমানসগোচর এক অলৌকিক স্বাদ! সুবিনয়বাবুর মুখে যেন সূক্ষ্ম একটা হাসির ক্ষীণ রেখা।

দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভূতনাথের অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো।

একদিন সুবিনয়বাবু বলেছিলেন–আত্মার মধ্যে পরমাত্মাকে, জগতের মধ্যে জগদীশ্বরকে দেখতে হবে, এটা খুব সহজ কথা ভূতনাথবাবু, কিন্তু এর চেয়ে শক্ত কথাও আর কিছু নেই। যেমন দেখো একটা অতি সহজ কথা—স্বার্থত্যাগ করে সর্বভূতে দয়া বিস্তার করে অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় করে ফেললেই মানুষের মুক্তি হয়—এই সামান্য সহজ কথাটার জন্যেই একটি রাজপুত্রকে রাজ্য ত্যাগ করে পথে-পথে ফিরতে হয়েছে।

আর একদিন মাঘোৎসবের শেষে বলেছিলেন—নদী যখন চলে তখন দুই কূলে কেবল পেতে-পেতেই চলে, পাওয়াই তার সাধনা, কিন্তু যখন সমুদ্রে গিয়ে পেীছোয় তখন তার দেবার পালা-দেওয়াই হয় তার ধ্যান! কিন্তু আপনার সমস্তকে দিতে-দিতে সেই যে অন্তহীন দান, সেই তত পরিপূর্ণ পাওয়া, তখন রিক্ত হয়েও আর লোকসান হয় না—আপনাকে ক্ষয় করে করেই সে অক্ষয়কে উপলব্ধি করতে পারে। এইজন্যেই সংসারে ক্ষয় আছে। মৃত্যু আছে বলেই অমৃতকে জানতে পারি, ক্ষয় আছে বলেই অক্ষয়কে বুঝতে পারি।

আজ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও যেন তাই সুবিনয়বাবুর মুখ থেকে হাসি মুছে যায়নি।

ভূতনাথ জবার দিকে চেয়ে দেখলে। জবাকে যেন একফালি চাঁদের মতো দেখাচ্ছে। তেজ নেই। কিন্তু তেমনি স্নিগ্ধ, তেমনি ছায়া-শীতল। সারা রাত জেগেছে। চেহারায় যেন একরাশ বিষণ্ণতা। ঠিক ওমনি করে ওই জায়গায় সারারাত বসে বসে কাটিয়েছে সে। কাছে গিয়ে ভূতনাথ বললে-তুমি একটু শোও গিয়ে জবা, আমি তো আছি।

কোনো উত্তর দিলে না জবা।

বাইরে আস্তে-আস্তে পুব আকাশটা ফর্সা হয়ে আসছে। ভূতনাথ দোতলার বারান্দাতেই খানিকক্ষণ দাঁড়ালো। আজ জবার সংসার যেন সকাল থেকেই অলস হয়ে পড়ে আছে। কোথাও কোনো শব্দের আড়ম্বর নেই। এখানে আজ মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। তাই সমস্ত পৃথিবী যেন মুহ্যমান। সমস্ত নিখিল বিশৃঙ্খল।

পাশের ঘরে সুপবিত্র তখনও ঘুমোচ্ছিলো।

ভূতনাথ কাছে গিয়ে ডাকতে লাগলো—সুপবিত্রবাবু, সুপবিত্রবাবু–

অসহায় শিশুর মতো সুপবিত্র অকাতরে ঘুমোচ্ছিলো। ঢাকাডাকিতে ধড়ফড় করে উঠে বসলো। চারদিকে চেয়ে দেখে নিয়ে অবস্থাটা মনে পড়লো যেন। চোখ মুছতে-মুছতে বললে—বাবা এখন কেমন আছেন?

ভূতনাথ বললে—ডাক্তারবাবু এসেছেন—তেমনিই অবস্থা এখনও।

যেন খানিকটা লজ্জিত হলো সুপবিত্র মনে-মনে। জামাটা পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিছানার দিকে নজর পড়তেই বললে— আর—আর–

–জবার কথা বলছেন? সে-ও ওখানেই আছে।

–ক’টা বাজলো?

কিছুক্ষণ আগে বলা জবার কথাটা কেমন করে বলবে আর বলবে কি না, সেই কথাটাই ভাবতে গিয়ে ভূতনাথ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। সুপবিত্র তখন নিজের জামা-কাপড় গুছিয়ে নিয়েছে। জবার চিরুণীটা নিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিচ্ছিলো। এই ঘরে এই বাড়িতে একদিন স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করবে সুপবিত্র। এখনও যে পর, দু’দিন পরেই সে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠবে।

সুপবিত্র বললে—আমাকে আগে ডেকে দেননি কেন ভূতনাথবাবু?

ভূতনাথের জবাব দেবার আগেই জবা এসে ঘরে ঢুকলো।

ভূতনাথও যেন জবাকে দেখে ভালো করে চিনতে পারলে না। ঘুমোতে-ঘুমোতে কি হাঁটা যায়! মনে হলো জবার দীর্ঘ দেহটা এখনি অবশ হয়ে পড়বে। যেন ছায়া-শরীর। রক্ত-মাংস-হীন

স্পর্শ-গন্ধ-বর্ণহীন একরাশ বিবর্ণতা।

জবা বললে—ভূতনাথবাবু–

জবার গলার আওয়াজ পেয়ে সুপবিত্ৰও এবার পেছন ফিরেছে। বললে—বাবা এখন কেমন আছেন?

ছায়া-শরীর এবার যেন ঈষৎ স্পন্দিত হলো। বললে—সুপবিত্র, তুমি এখনও যাওনি। সুপবিত্র হঠাৎ এই প্রশ্নে যেন একটু বিচলিত হলো। কী উত্তর দেবে হঠাৎ বুঝতে পারলে না।

জবাই আবার বললে—তুমি এবার বাড়ি যাও সুপবিত্র।

–বাড়ি যাবো?

সুপবিত্ৰ বুঝি এ-প্রশ্নের জন্যে রীতিমতো প্রস্তুত ছিল না।

—হ্যাঁ বাড়ি যাবে।

—কিন্তু আমার তো কোনো কষ্ট হচ্ছে না।

–না হোক, তুমি বাড়ি যাও. সুপবিত্র—আর এ-বাড়িতে কখনও এসে না। যদি পারো তো আমার কথা ভুলতে চেষ্টা কোরো—আর ভূতনাথবাবু, আপনি এবার আসুন—বাবা নেই!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress