সাহেব বিবি গোলাম (Saheb Bibi Golam) : 28
সেদিন সেই ঘটনার পর ভূতনাথ নিঃশব্দে চোরকুঠুরির দরজা দিয়ে নিচের ঘরে এসে খিল লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ বংশীর কথা শুনে যেন অবাক লাগলো। কিসের ঝগড়া হলো ছোটবাবুর সঙ্গে। আবার কেন জানবাজারে যাবে ছোটকর্তা। বৃন্দাবন কি আবার কোনো সূত্রে ফুসলে নিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছে।
বংশী বললে—ওই দেখুন না, ছোটবাবুর ল্যাণ্ডো আবার ধোয়ামোছা সাফ সুতরো হচ্ছে। নতুন আতর বের করতে হবে-সাজগোজ সব করে দিতে হবে—আজকে বড় কাজ শালাবাবু, চললুম।
ভূতনাথ বললে—আচ্ছা বংশী, একটা কথা বলতে পারিস?
–কী! বংশী ফিরে দাঁড়ালো।
—চুনী দাসী বৃন্দাবনের কে হয় জানিস?
বংশী যেন আকাশ থেকে পড়লো। আপনি কেমন করে জানলেন শালাবাবু?
-বৃন্দাবনের সঙ্গে যে আমার দেখা হয়েছিল।
—আপনার কাছেও এসেছিল-খবরদার শালাবাবু, ওকে আমল দেবেন না। ঠনঠনের ছেনি দত্তের বাড়িতে গিয়েও অমনি ক’দিন ঘোরাঘুরি করেছে আজ্ঞে, এখন তো ছেনি দত্ত মারা গিয়েছে, এখন আবার নটে দত্তের পেছনে লেগেছে, এখন যে হাড়ির হাল ওদের, ছোটবাবু তো যায় না, খাবার জোটে না এখন দু’বেলা ভালো করে হুজুর–ছোটবাবুর দেওয়া মোটরগাড়িটা পর্যন্ত বেচতে হয়েছে। হবে না, বাজার যা পড়েছে-মাংস সাত আনা, চৌদ্দ পয়সা সরষের তেল, দশ পয়সা দুধ, এক সের ঘি কিনতে গেলে বারো গণ্ডা পয়সা লাগে। পারবে কোত্থেকে শুনি—এখন কোত্থেকে বরফ সোড়ার খরচ আসে দেখবো। তারপর একটু থেমে বংশী জিজ্ঞেস করলোতা কী বলছিল আপনাকে বিন্দাবন?
-বলছিল, তার নতুন-মা নাকি একবার দেখা করতে বলেছে আমাকে—জানবাজারের বাড়িতে।
বংশী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো।-কী আম্পদ্দা দেখুন বিন্দাবনের, আপনাকে কি না যেতে বলে নতুন-মা’র কাছে, নতুনমা ডেকেছে না ছাই। ওসব বিন্দাবনের চালাকি শালাবাবু, বিন্দাবম আপনাকে কোনো রকমে নিয়ে গিয়ে ফেলতে চায় ওখানে, তারপর খাইয়ে-দাইয়ে ভুজং-ভাজং দিয়ে
—তুমি কি আমাকে তেমনি তোক পেয়েছে। নাকি বংশী–আমাকে যা বলবে, আমি তাই শুনবো!
—তা আর কী-কী বললে শালাবাবু?
–এই সব দুঃখ করছিল আর কি। গাড়ি বেচতে হয়েছে, পেট চলে না, ছোটবাবুকে বলে-কয়ে পাঠিয়ে যদি দিতে পারি এই বোধ হয় মতলব, খুলে কিছু বললে না, কেবল বললে—আমাকে নতুন-মা ডেকেছে।
–খবরদার শালাবাবু, আপনি যাবেন না, ও-মাগী ডাইনি, ছোটবাবুর হাড়মাষ শুষে খাচ্ছে। এখনও আশা ছাড়ে নি, কেন বাপু, কলকাতা শহরে তো আরো বাবু রয়েছে, ওই তত শীলেরা রয়েছে, ছেনি দত্তর ছেলে নটে দত্ত রয়েছে—ওরা গাড়ি দেবে–মেয়েমানুষের পায়ের শুকতলা চাটবে—তাদের কাছে যা না—বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল বংশী।
ভূতনাথ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, চুনী দাসী সত্যি সত্যি বৃন্দাবনের কে রে বংশী?
বংশী মাথা নেড়ে উঠলোনা শালাবাবু, মহাপ্রভুর দিবি করেছি, সে আমি কাউকে বলবো না কিন্তু এও আমি বলে রাখছি, নরকেও ঠাঁই হবে না বিন্দাবনের, চামারের অধম ওই বিন্দা–নইলে…না, না, আমি দিব্বি গেলেছি—সে আমি বলতে পারবো না শালাবাবু।
ভূতনাথ খানিক চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলে—কিন্তু ছোটবাবু তাহলে আবার এতদিন পরে কেন জানবাজার যাচ্ছে?
—কী জানি বাবু, চাকর মানুষ, ভদ্দরলোকের মনের কথা কেমন করে বলবে!
—কিচ্ছু শোনোনি তুমি?
—শুনেছি সব, কিন্তু বুঝতে পারি নি কিছু।
–কী শুনলে শুনি?
বংশী বললে—তবে শুনুন, সেদিন ছোটমা’র কাছে গিয়েছি, তখনও সন্ধ্যে হয়নি, দেখি ভেতরে ছোটবাবু, ছোটবাবুকে দেখে আমি আর ঘরে ঢুকলুম না। খুব ঝগড়া হচ্ছে দুজনে তখন—ছোটমা বলছে-আমার কিছু অন্যায় হয়েছে-সত্যি করে বলো তো তুমি।
ছোটবাবু বললে—সে তুমি ঠিক বুঝবে না ছোটবউ-মন্তর পড়ে যাকে বিয়ে করা যায়—তার সঙ্গে ঠিক ফুর্তি হয় না তাতে পুরুষমানুষের ঠিক তৃপ্তি হয় না—বিশেষ করে বড়বাড়ির পুরুষমানুষের।
ছোটমা বললে—কিন্তু তুমি যা-যা বলেছে, সব তো আমি করেছি, তোমার জন্যে ঠাকুর পূজো পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছি, জানোভেবেছি তুমিই আমার ঠাকুর-দেবতা সব–তুমি ছাড়া আর কোনো ঠাকুর-দেবতাকে তত আমি জানি না। আমার যশোদাদুলাল যে, তুমিও সেকত জন্মের তপস্যার ফলে তোমার মতো স্বামী পেয়েছি আমি। তোমার জন্যে আমার কত গর্ব জানো-এ-বাড়ির কোনো বউ যা পারেনি, আমি তাই-ই পেরেছিলুম—আমি তোমাকে পেয়ে হাতে স্বর্গ পেয়েছিলুম জানো।
ছোটবাবু বললে—স্বর্গ-নরকের কথা চিন্তা করবো বুড়ো বয়েসে। এখন এ-বয়েসে ও-সব মাথায় ঢুকবে না ছোটবউ–এই ক’মাস বাড়িতে থেকে হাঁফিয়ে উঠেছি আমি—সমস্ত দিনটা ছটফট করে মনটা।
ছোটমা বললে তোমার জন্যে আমি আরো দামী মদ আনিয়েছিলাম—একটু খাবে?
ছোটবাবু বললে—আমাকে তুমি ভুলিয়ে রাখবার চেষ্টা কোরো না ছোটবউ।
ছোটমা একবার লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললে—তোমাকে যদি সত্যি-সত্যিই ভোলাতে পারতুম। তারপর মদের বোতলটা খুলতে খুলতে বললে লোকে বলে তোমাকে নাকি বশীকরণ করেছি, তোমাকে যাদু করেছি, কিন্তু মেয়েমানুষের যা কিছু অস্ত্র ভগবান দিয়েছেন, সব তো খাটিয়ে দেখেছি, শিবকে ভোলানো যায়— কিন্তু তোমাকে! তুমি পাথরের দেবতা হলেও বুঝতুম যে, তার তবু একটা মানে আছে, তোমাকে আমি আমার কোলে শুইয়ে তোমার মুখের হাসি দেখেছি—আর কিছু না হোক, যখন কিছু থাকবে না, তখন ওই স্মৃতিটা নিয়েই ভাববো কেবল। তারপর গেলাশে খানিকটা মদ ঢেলে ছোটবাবুর সামনে ধরে ছোটমা বললেনাও-নেবে?
—মদে আমার কখনও অরুচি নেই ছোটবউ–দিচ্ছো খাচ্ছি।
ছোটমা বললে-তুমি একে মদ বলো, আর আমি বলি অমৃত। একদিন মনে আছে কী ঘেন্নাই ছিল মদের ওপর-মাতালের ওপর–কিন্তু এই অমৃতই একদিন তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনেছিল
—একথা আমি ভুলবো না। আমি এখাই এখন কেন জানো?
-কেন?
-তোমার জন্যে, নেশা আমার হয়নি, হবেও না কোনো কালে। নেশা যদি হয়েই থাকে, সে মদের নয়, তোমার ওপর আমার নেশা-তোমাকে ছেড়ে আমি বাঁচবো না। এ-ক’মাসে তোমার ওপর আমার নেশা হয়ে গিয়েছে। তোমার পায়ে পড়ছি— তুমি দিনের বেলা যেখানে যাও-যাও রাত্তিরে আমার কাছে থেকো।
ছোটবাবু বললে-ফুর্তি কি দিনের বেলা হয় ছোটবউ?
ছোটমা বললে—তাহলে এক কাজ করে।
-কী কাজ?
—আমাকে তুমি তোমার বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও। বরানগরে কি খড়দ’য়—কিংবা জানবাজারে আর একটা বাড়ি কেনো—সেখানেই আমি থাকবো।
-এ-বাড়ির বউ হয়ে এ-বাড়ির বাইরে থাকবে?
—তা, তুমি রাত্তিরে এ-বাড়িতে না থাকলে এ-বাড়ি যে আমার কাছে অরণ্য-বরং বাইরে থাকলে তবু তুমি রোজ যাবে সেখানে, রাত্তিরে আমার কাছে থাকবে—এমনি করে তোমার সেবা করবো আমি, তুমি না হয় মনে করবে চুনী দাসীর কাছে এসেছো, আমাব নাম বদলে তুমি নতুন নাম রাখবে, যে-নাম তোমার খুশি, তাতেও আমি রাজী।
ছোটবাবু বললে–কিন্তু তুমি যে এ-বাড়ির বউ—তা কি করে হতে পারে। বড়বাড়ির বদনাম হবে তাতে-এ-বাড়ির বউ হয়েছে যখন, তখন চিরকাল এ-বাড়িতেই থাকতে হবে তোমাকে।
–আর তুমি বাইরে বাইরে রাত কাটালে বুঝি বদনাম হবে না!
-–বরং বাড়িতে রাত কাটালেই বদনাম হবে, যেমন এখন হচ্ছে।
—এ কেমন ব্যবস্থা তোমাদের বাড়ির বলো তো?
–ব্যবস্থা নয়, আইন, এ-বাড়ির আইন এই যে, পুরুষরা বাইরে বাগানবাড়িতে রাত কাটাবে বাইরের মেয়েমানুষ নিয়ে, কিন্তু বাড়ির বউদের সতী হতে হবে। একটু পদস্খলন হলে তার আর ক্ষমা নেই, মার্জনা নেই।
—তাহলে আমি কী করি?
ছোটবাবু বললে—কেন, মেজবৌরাণী, বড়বৌরাণী যেমন বাঘবন্দি খেলে, গয়না ভাঙে, গয়না গড়ায়, তেমনি তুমিও করো–ভাবনা কি তোমার?
ছোটমা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। কিন্তু তারপরেই সাপের মতন ফণা তুললো-মেজদি আর বড়দি’র সঙ্গে তুলনা করলে তুমি—কিন্তু…বলে হঠাৎ থেমে গেল ছোটমা।
ছোটবাবু কিন্তু থামলো না। বললে—থামলে কেন, বলল–কিন্তু কী…
ছোটমা হঠাৎ এতক্ষণ পরে গেলাশটা উপুড় করে সমস্তটা টক ঢক করে গিলে ফেললে। আমি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলুম। বিষ খেলে বুঝি মানুষের মুখের চেহারা ওইরকমই হয়। চোখ, মুখ, কান, নাক দিয়ে ছোটমা’র যেন আগুন বেরোতে লাগলো শালাবাবু। ঘোটবাবু আমার মনিব, কিছু বলতে পারিনে, কিন্তু মনিব না হলে কী যে করতুম বলা যায় না।
তারপর খিল খিল করে পাগলের মতন হেসে উঠলো ছোটমা! আমার মনে হলো ছোটমা হাসছে না, যেন কাঁদছে। অন্তত মনে হলো ছোটমা যেন খানিকটা বুক ভরে কাঁদতে পেলেও ঠাণ্ডা হতো। সে কী মজার হাসি। যেন মাতালের মতো, পাগলের মতো হাসি। সে-হাসি আর থামতে চায় না শালাবাবু। হেসে ছোটমা গড়িয়ে পড়লো বিছানার ওপর।
ছোটবাবু তখন ছোটমা’র কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে। মদ খেয়ে মেয়েমানুষের কী রকম নেশা হয়, তা ছোটবাবু খুব ভালো রকমই জানে। তবু ছোটমা’র মতো কাণ্ড যেন আর দেখেনি ছোটবাবু। পালঙ-এর কাছে গিয়ে বললে-কী হলো, হাসছো কেন এত?
ছোটমা মুখ তুললল। ছোটবাবুর চোখে চোখ রাখলে খানিকক্ষণ। তারপর আবার হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বললে —তুমি মেজদিদির সঙ্গে তুলনা করলে আমার—আমি গয়না ভাঙবো আর গয়না গড়াবে আর বাঘবন্দি খেলবে ঘরে বসে!
ছোটবাবু বললে-কেন, কী অন্যায়টা বলেছি—চিরকাল ধরে, ঠাকুরবাবার বাবার আমল থেকে তাই তো হয়ে আসছে, কেউ তো আপত্তি করেনি। কর্তারা মদ খেয়েছে, পায়রা পুষেছে, মেয়েমানুষ রেখেছে, বউদের গয়নাগাটি, শাড়ি, ঝি-চাকর, সব যুগিয়েছে, কেউ আপত্তিও করেনি, আত্মহত্যাও করেনি অপমানে—অপমানও মনে করেনি তাতে—চিরকালই চলে এসেছে তাই–আর আজ হঠাৎ তোমার কথায় সব বদলে যাবে রাতারাতি!
ছোটমা খানিকক্ষণ কিছু কথা বললে না। চুপ করে বিছানায় মুখ গুজে রইল।
ছোটবাবু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ঘর থেকে চলে আসছিল।
ছোটমা পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ তুললো। বললে—তুমি বলে যাও—আমার কথার উত্তর দিয়ে যাও।
ছোটবাবু ফিরে দাঁড়ালো। বললে—কিসের উত্তর?
–ওই যে তুমি কেন অন্য বউদের সঙ্গে তুলনা করলে আমার?
—তা তুমি কি আলাদা? তুমি কি সৃষ্টিছাড়া?
ছোটমা যেন বাঘিনীর মতো চিৎকার করে উঠলোহ্যাঁ, আলাদা-আলাদা না হলে আমার এ কপালের ভোগ কেন? আর কেউ এমন করে সর্বস্ব জলাঞ্জলি দিয়েছে, বিশ্ব-সংসারে? হিন্দুঘরের বউ হয়ে এমন করে আর কেউ মদ খেয়েছে—বলো তুমি, তোমায় বলতেই হবে—উত্তর না দিয়ে যেতে পারবে না।
ছোটবাবু গম্ভীর গলায় শুধু একবার বললে–ছোটবউ!
ছোটমা আবার সাপের মতো মাথা তুললো। বললে—কী বলবে বলে?
—মদ আমরাও খাই—কিন্তু নেশা হলে তোমার মতন এমন মাতাল হই না।
ছোটমা বললে—এই কি আমার কথার উত্তর হলো?
—মাতালের কথার উত্তর দিই না আমি—বলে দরজার দিকে ছোটবাবু পা বাড়ালো।
ছোটমা এবার চিৎকার করে উঠলো। বললে-শোনো, আমার কথার উত্তর আমিই দেবো। অন্য বউ-এর সঙ্গে আমার তুলনা করলে তুমি কোন মুখে, ওদের যা আছে, যা ছিল, আমার কি তাই আছে? আমাকে তুমি কি সংসার দিতে পেরেছো-ছেলে দিতে পেরেছো?
হঠাৎ বোমা ফাটলে যেমন চমকে উঠতে হয়, তেমনি চমকে উঠলো যেন ঘরখানা শালাবাবু। কিন্তু যাকে লক্ষ্য করে বলা, সেই ছোটবাবুর কানেও বোধ হয় গেল না কথাটা। গট গট করে বেরিয়ে গিয়েছে তখন ছোটবাবু। আমি অন্ধকারে পাশ কাটিয়ে লুকিয়ে পড়েছি তখন। ঘরের ভেতরে চেয়ে দেখলুম ছোটমা বিছানার ওপর উপুড় হয়ে তখন ফুলে-ফুলে উঠছে। হয় হাসছে নয় কাঁদছে। ঠিক হাসি কি কান্না, তা কিন্তু বুঝতে পারলুম না।
ভূতনাথ বললে—তারপর?
বংশী বললে—তারপর আর কী! কী করবো বুঝতে পারছিলুম না-হঠাৎ ছোটমা ডাকলে—বংশী–
আমি ঘরের মধ্যে গেলাম। বললাম-আমাকে ডাকছে ছোটমা?
ছোটমা বললে চিন্তা কোথায় রে?
বললুম-চিন্তা রাঙাঠাকমা’র কাছে গিয়েছে তোমার খাবারের বন্দোবস্ত করতে।
ছোটমা বললে-বলে দে, আমি খাবো না আজ—আর চিন্তাকে ডেকে দে—এখুনি, বলবি আমার কাপড়-গয়না বার করে দেবে–আর গাড়ি ঠিক করতে বল আমার–আমি বেরুবো।
জিজ্ঞেস করা অন্যায় হবে কিনা ভাবলাম একবার। কখনও তো বেরোয় না ছোটমা। গঙ্গায় চান করতেও যেতে দেখিনি। বরাবর দেখে এসেছি, মেজমা, বড়মা, যদিও-বা বেরিয়েছে পালা-পাব্বণে পাল্কি করে, নয় তো গাড়িতে, কিন্তু ছোটমা কখনও বেরোয় নি। সেই বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত এ-বাড়ির বাইরে কখনও পা বাড়ায় নি। ছোটমা’র বাবা মারা যাবার পর একবার যেতে হয়, তা-ও যায়নি। কার জন্যেই বা যাবে। আপন বলতে সংসারে শুধু ছিল বাপ, তা, তা-ও তো কেবল গুরুদেব-গুরুদেব করেই নাকি দিন কাটত। সংসার-ধর্ম সব তার চুকে গিয়েছিল ছোটমা’র বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে। তাই ছোটমা’র কথায় যেন অবাক হলাম শালাবাবু। কিন্তু তবু জিজ্ঞেস করলাম—কোথায় বেরুবে ছোটমা?
ছোটমা রেগেই ছিল। বললে—তোর কাছেও কি তার জবাবদিহি করতে হবে নাকি বংশী?
কথাটা শুনে চলে আসছিলাম। ছোটমা’র গাড়ি তো বহুদিন এস্তোক বাইরে বেরোয় না। সাফ-সুফ করতে হবে, খবর দিতে হবে মিয়াজানকে—কিন্তু ছোটমা আবার ডাকলে—বংশী, শোন।
গিয়ে দাঁড়ালাম কাছে।
ছোটমা বললে—আর দেখ তত ভূতনাথ আছে কি না-যদি থাকে বলবি জামাকাপড় পরে যেন তৈরি হয়ে নেয়—আমার সঙ্গে ভূতনাথ যাবে।
ভূতনাথও অবাক হয়ে গেল—আমার নাম করলে নাকি ছোটবৌঠান?
—হ্যাঁ, শালাবাবু, আমিও শুনে কতকটা অবাক হয়ে গেলাম। একে তো ছোটমা কোথাও বেরোয় না, তার ওপর সঙ্গে ঝি-চাকর কেউ যাবে না, এ কেমন ধারা কথা! এ বাড়ির কর্তারা যা করে করুক, গিন্নীরা একটু বে-এক্তিয়ার কিছু করলে সমস্ত মহলে টি-টি পড়ে যায় আজ্ঞে। ছোটকর্তার কানে গেলে কি আর রক্ষে থাকবে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—তা, তারপর?
-তারপর আজ্ঞে, আপনাকে খুজলুম সমস্ত বাড়িময়, মাস্টারবাবুর ঘরে দেখলাম, যেমন তালা দেওয়া, তেমনি তালা লাগানো রয়েছে। বারবাড়ি, ভেতরবাড়ি, আপনার চোরকুটুরি—ছুটুকবাবুর বৈঠকখানা দেখলুম—তা বৈঠকখানা ফাঁকা। ছুটুকবাবুর বিয়ের পর তো আর তেমন আগের মতো গানের আসর বসে না এখন। দেখলাম তোষাখানা, জিজ্ঞেস করলাম শোচনকে—শালাবাবুকে দেখেছিস? কত জায়গায় দেখলাম—কেউ বলতে পারলে না আজ্ঞে। ছুটে গিয়ে আবার বললাম ছোটমাকে–শালাবাবু কোথাও নেই।
ছোটমা বললে—সব জায়গায় দেখেছিস?
বললাম—কোনো জায়গা আর বাকি রাখিনি খুজতে—তা কালকে কোথায় সারাদিন ছিলেন আজ্ঞে আপনি?
ভূতনাথ বললে—চাকরির জন্যে সারাদিনই তো ঘুরি—আর বাড়িতে এসেই বা করবো কী!
—তা রাত তখন দশটা—তখন আবার ছোটমা ডাকলে। বললে—ভূতনাথ এসেছে?
বললাম–না, এখনও আসেনি তো।
ভূতনাথ বললে—তারপর?
—তারপর আর কি? সারারাত ছোটবাবু মদ খেয়েছে নিজের ঘরে। আমার এতটুকু ঘুম হয়নি—আর চিন্তারও সেই দশা, ছোটমাও ঘুমোয়নি সারা রাত—কেবল নাকি মদ গিলেছে। কী যে হলো কে জানে শালাবাবু! কেন যে অত কথা কাটাকাটি, তারও মানে বুঝলুম না। বেশ ছিলো ক’মাস, ছোটমা’র মুখে হাসি সারাদিন লেগেই আছে, বমি করে দু’একবার ঘর ভাসিয়েছে বটে, কিন্তু তবু মনে শান্তি ছিল, ছোটবাবুও যেন বেবাক বদলে গিয়েছিল—নিয়ম করে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছিলো—এখন কী যে হবে?
ভূতনাথ বললে—কিন্তু কেন এমন হলো—বৃন্দাবন কি ছোটবাবুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেছিল ইদানীং?
—কী জানি শালাবাবু, আমি তো বিন্দাবনকে দেখলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি-বলেছি এবার বড়বাড়ির কাছে এলে ঠ্যাং খোড়া করে দেবো তোর, কিন্তু তবু লুকিয়ে চুরিয়ে আসে এদিকে। ওই যে মধুসূদন কাকাকে দেখেন না, ওরা সবাই যে বিন্দাবনের দলেও দলে অনেকে আছে, সবাইকে আমি চিনি, সরকার মশাইও কম যান না, ওই বিধু সরকার—বিন্দাবন যে ওদের হাত করেছে। ভেতরে ভেতরে ওরা কী মতলব আঁটছে কে জানে, আজ সকালে উঠে ছোটবাবু বললে—গাড়ি তৈরি রাখতে বলিস বংশ সন্ধ্যেবেলা জানবাজারে যাবে। তা সেই সকাল থেকে তোড় জোড় করছি আজ্ঞে—গাড়ি ধোয়ামোছার ব্যবস্থা, কাপড় কুঁচোনো, আতর বার করাও সবের পাট তো এতদিন তেমন ছিল না,…অনেকক্ষণ কথা বললাম আপনার সঙ্গে-আজকে ছোটবাবু না বেরোনো পর্যন্ত আমার আর ফুরসত নেই শালাবাবু।
বংশী চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ আবার ফিরলো। বললে—আর একটা কথা
ভূতনাথ বললে—কী?
-আজ কিন্তু ছোটমা সকালবেলাই খবর নিয়েছে আপনার। বললে—ভূতনাথ এসেছে?
আমি বললাম—কাল অনেক রাত্তিরে এসেছিল শালাবাবু দেখা হয়নি আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলবো।
ছোটমা বললে—দেখা হলে নয়, দেখা করবি, বিকেল বেলা যেন কোথাও না বেরোয় আজ—ছোটবাবু জানবাজারে বেরিয়ে যাবার পরই আমি বেরোবো। ভূতনাথ সঙ্গে থাকবে আমার—তা আপনি যেন কোথাও বেরোবেন না হুজুর—তা হলে খেয়ে ফেলবে আমাকে ছোটমা।
ভূতনাথের কেমন যেন ভয় হলো। পটেশ্বরী বৌঠানের সঙ্গে আড়ালে যত ঘনিষ্ঠতাই থাক, তার সঙ্গে প্রকাশ্যে গাড়িতে করে যাওয়া সে কেমন দেখাবে। এ-বাড়ির চোখে অস্বাভাবিক ঠেককে না! তারপর চারিদিকে এত শত্রুতা! কোথাও যদি কোনো কথা ওঠে, ছোটমা হয় তো পার পেয়ে যাবে। আর মাঝখান থেকে আশ্রিত ভূতনাথ, আত্মীয় নয়, স্বজন নয়, বন্ধুবান্ধব কেউ নয়—সে নিজেকে ঠেকাবে কেমন করে? এ-বাড়িতে তার কতটুকু পরিচয়! কীসের অধিকার। ব্রজরাখাল তো কবে কতদিন আগে এ-বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে চলে গিয়েছে। ব্রজরাখাল থাকলে না হয় তবু কথা ছিল। সে যে আশ্রিতের আশ্রিত! কত সুদূর সম্পর্ক। তাও আপন ভগ্নীপতি নয়। শুধু ছোটমা’র কৃপার পাত্র সে! সেইটুকুই যা ভরসা। কিন্তু ভয়ও তো আবার সেই কারণেই। এ-বাড়ির অসূর্যষ্পশ্যা বন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা তো অসামাজিক, অবৈধ, বে-আইনী। তারপর আরো একটা কথা ভাববার আছে। ছোটকর্তার সঙ্গে ছোটবৌঠানেরও সদ্ভাব নেই। তা ছাড়া ছোটবৌঠান হয় তো অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় কী কাণ্ড করে বসবে কে জানে। সেদিন যেমন কাণ্ড করেছিল। টানাটানিতে কাচের বোতল চুরমার হয়ে যাবার পর সেই উন্মাদের মতো হাসি! রাস্তায় গাড়ির মধ্যে যদি তেমন কোনো ঘটনা ঘটে। তখন কেমন করে সে পালাবে! অথচ এতখানি অনুগ্রহ পেয়েছে বলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করাই তো উচিত! যেদিন সে ব্ৰজরাখালের চিঠি পেয়ে বনমালী সরকার লেন-এর ভেতরে বড়বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সেদিন কে ভাবতে পেরেছিল এমন করে এত ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠবে এ-বাড়ির ছোটবউ-এর সঙ্গে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে আবার কিন্তু তোমার কী মনে হয় বংশী—আমার যাওয়া উচিত?
—আপনি লেখাপড়ি শিখেছেন আজ্ঞে—আপনাকে কী বলবো শালাবাবু।
—তবু তুমি তো এ-বাড়ির হালচাল জানো কতকটা?
—আমি শালাবাবু, আমার জন্মে এমন কাণ্ড দেখিনি, শুনিনি। এ-বাড়িতে বউরাণীরা যদি কখনও বেয়োয় তো খিড়কীর দরজা খুলে পাল্কি করে যায় তারা। আগে পেছনে পেছনে ঝি-এর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়তে দৌড়তে যেতো, তা-ও কালে ভদ্রে পালা-পাব্বণে। এদানি গাড়ি হয়েছে, পাল্কি গাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে তবে গিয়েছেযেমন মেজমা বাপের বাড়ি যায়, আগে তাও মানা ছিল—আর গাড়ি থেকে নামবার সময় চারদিকে মশারির মতন চাদরের ঢাকা পড়ে যেতো—কিন্তু এমন কখনও শুনিনি। ছোটমা তো আর মেজমা নয়—ছোটমা এ-বাড়ির আলাদা ধরনের মানুষ আজ্ঞে। অত অভিমানও যেমন কারো নেই, অত ভালোবাসতেও কেউ জানে না এই যে তিন মাস আমরা ভাইবোনে মাইনে পাইনি কেউ, তবু তো আছি এখানে বুক ঠুকে।
ভূতনাথ কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল।-বলে কী বংশী?
—আজ্ঞে, ঠিকই বলছি শালাবাবু।
—পাওনি কেন মাইনে?
—সে-কথা আর জিজ্ঞেস করবেন না শালাবাবু—অনেকেই পায়নি—আমাদের মতো যারা ছোটমা’র দলে।
–ছোটমা জানে সে কথা?
—ছোটমাকে দেবতার মতন ভক্তি করি শাবাবু, আপনি জানেন কি না জানি না, সারাজীবন কষ্ট করতেই আমার ছোটমা’র জন্ম, স্বামী পেলে না, সংসার পেলে না, আর বলতে দুঃখও হয়, এত বড় বাড়ির বউ হয়েও মেয়েমানুষের যা সব চেয়ে বড় সাধ তাই-ই পূণ্য হলো না। এক-এক সময় তাই তো সন্দেহ হয়— মাইরি বলছি শালাবাবু—ভগমান কি আছে! মেজমা বড়মা তবু তো ভাগ্যি করে এসেছিল—ছোটমা’র মনেও তো সাধ আছে।
–কী সাধ বংশী?
–ছেলে! একটা ছেলের সাধ! তা তো হলো না-আর হবেও না। তা ওকে সেই জন্যে মাইনের কথা বলে আর কষ্ট দিতে চাইনে শালাবাবু। দেখলেন না, সেদিন হাওয়া-গাড়িটা নিয়ে কি কাণ্ড হলো?
হাওয়া-গাড়িটার কথা মনে আছে ভূতনাথের। কী চমৎকার গাড়ি। বেছে-বেছে সব চেয়ে বড় গাড়ি কিনেছিল মেজবাবু! সে গাড়ির কী বাহার! শেঠ, শীল, মল্লিকদের বাড়িতেও অমন গাড়ি ওঠেনি! ছেনি দত্ত তখন বেঁচে নেই। থাকলে আর একবার বুক কাটতো বড়বাড়ির ঐশ্বর্য দেখে! সাহেব মেজবাবুর সঙ্গে নাচ ঘরে গিয়ে বসলো। খানাপিনার বন্দোবস্ত হলো। গাড়ি যখন বাড়িতে ঢুকলে তখন সকাল। আর সাহেব যখন গেল তখন ভর সন্ধ্যে। ঠিক সোজা হয়ে আর চলতে পারছে না পা ফেলে। ওদিকে অনেক রাত পর্যন্ত গাড়ির আস্তাবলে ছেলে-পিলে আর লোকজনদের ভিড়! দেখে আর আশ মেটে না কারো।
কে একজন বললে—ঠিক যেন আর্শির মতো মুখ দেখা যায়—না রে?
সবাই মুখ দেখে। আবছা-আবছা চেহারা দেখা যায়।
কে একজন আর বুঝি কৌতূহল না চাপতে পেরে এবারের বেলুনটা টিপে দিয়েছে আর গাঁক করে শব্দ হয়েছে একটা। আর সঙ্গে সঙ্গে হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছে চারিদিকে।
–কে হাত দিচ্ছে গাড়িতে—কে রে?
দৌড়ে এল মধুসূদন। লোচন। বিধু সরকার।
মেজবাবু পই পই করে বলে দিয়েছে—কেউ যেন হাত না দেয়। নতুন গাড়ি, একটু নখের আঁচড় লাগলেই ছাপ লেগে যাবে। এ তোমার ল্যাণ্ডো, ফিটন, হাম নয় যে দাগ লাগলো আর সারিয়ে নিলাম ব্রাইটন কোম্পানীর কারখানা থেকে। এ খাস বিলিতি জিনিষ। এখানে আর সারানো যাবে না। কল বিগড়ে গেলে পাঠাতে হবে খাস বিলেতে। সেখানে সাহেব মিস্ত্রি সারাবে তৰে আবার চলবে।
বিধু সরকার এক ধমক দিলে-বেরো সব এখেন থেকে, বেরো।
ঝি-চাকর আরো অন্য কর্মচারিদের ছেলেমেয়েরা তাড়া খেয়ে পালালো। দাসু মেথরের ছেলেটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। সে ছোঁয়ওনি গাড়ি। ছোঁবার সাহসও তার নেই। দাসু নিজেও ছেলেমেয়ে পরিবার নিয়ে গাড়ি দেখতে এসেছিল। এক সময়ে সবাই আবার ফিরে চলেও গিয়েছে। তার ছোট ছেলেটা কেবল শেষ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে। লোভ সংবরণ করতে পারেনি আর কি?
বিধু সরকার তাকেই ধরতে গেল। কিন্তু ধরতে গিয়েই চিনতে পেরে যেন থমকে দাঁড়ালো। মেথরের অস্পৃশ্য ছেলেকে সন্ধ্যেবেলা ছুলে আবার স্নান করতে হবে। এক ধমক দিলে বিধু সরকার—বেরো ছোঁড়া-হারামজাদদূর হ! ইত্যিজাতের আবার শখ দেখো না!!
দাসু জমাদারের ছেলে সরকারবাবুকে দেখেই যে কেঁদে ফেলেনি তাই যথেষ্ট। তার ওপর আবার ধমকানি। কিন্তু পাশেই ছিল আর একটা ছেলে। সেও পালায়নি। শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। হাতের কাছে তাকে পেয়েই কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে লাগলো বিধু সরকার।-কে রে তুই? কাদের ছেলে?
ছেলেটা জবাব দেয় না তবু।
লোচন পাশ থেকে বললে—ও ইব্রাহিমের ছেলে সরকারবাবু।
এক থাপ্পড় মেরে বিধু সরকার মুখ খিচিয়ে উঠলো—যেমন বাপের ছিরি, ছিলি যোধপুরের রাজার পিলখানার আস্তাবলে, মরতে আর জায়গা পেলিনে—এবার যা আবার মরতে সেখানে এখন তো বাবুদের মোটর এসেছে, এখন কী চাকরি করবি কর।
কিন্তু ছেলেটাও জাহাবাজ বলতে হবে বৈ কি! ওইটুকু এক রত্তি ছেলে। যেন কেউটের বাচ্ছা। কাঁদলে না, কিছু না। গালাগালিও দিলে না প্রাণ ভরে। করলে কি এক দলা থুতু মুখ থেকে থুঃ করে ফেললে বিধু সরকারের মুখে!
আর যায় কোথায়। আগুনে যেন ঘি পড়লো। বিধু সরকারকে তখন দেখবার মতো। ওই তো চিমড়ে শরীর। শুকনো কাঠটি। কী লম্ফ ঝম্ফ! হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা! সারা বাড়ি থরহরি কম্পমান। যারা গাড়ি দেখতে আসেনি সকালে, এবার তারাও এল। না হয় না-ই বা হলো বামুন, তবু মুসলমানের থুতু তো! ধর্মটাই তো গেল চিরকালের মতো। ডাকো ইব্রাহিমকে! ডাকো তার গুষ্টিবর্গকে! ইব্রাহিমের চাকরির তখন টলোমলো অবস্থা। এখন যায় তখন যায়।
শেষে গোলমাল শুনে বদরিকাবাবু পর্যন্ত এসে হাজির। কী হলো রে? মোটা সোটা মানুষ। এতটুকু আসতেই হাঁফিয়ে পড়েছে। খালি গা। টাক ঘড়িটা ট্যাকে নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। সবিস্তারে শুনলে সব। তারপর বললে—গোবর খাও বিধু, জাত ফিরে আসবে।
বিধু সরকার রেগে গেল–তুমি থামো দিকি ঘড়িবাবু, নাস্তিক কোথাকার! মুর্শিদকুলী খাঁ’র এটো খেয়ে মানুষ—জাতের মর্ম তুমি কি বুঝবে শুনি!
বদরিকাবাবু হাসতে লাগলো—আমি তো জাত মানিনে বিধু—সবাই জানে।
-তা আমি জানি, তুমি হি দুও নয়, বেহ্মও নও, মোছলমানও নও, তুমি অধার্মিক, জোচ্চোর।
বদরিকাবাবু শান্ত স্বরে বললেজাত মানিনে বলে ধর্ম মানিনে, তা তো নয় বিধু। তোমার বিদ্যেবুদ্ধি থাকলে বুঝতে পারতে ধর্ম আর জাত দুটো আলাদা জিনিষ।
বিধু সরকার বললে–বিদ্যেবুদ্ধি থাকলে তুমিও আর ঘড়ি দম দিয়ে জীবন কাটাতে না, খাজাঞ্চীখানায় পোদ্দারি করতে আমার মতন।
বদরিকাবাবু এবারও শান্ত কণ্ঠে বললে—ভাগ্যিস খাজাঞ্চীখানার পোদ্দার হইনি।
—তা কেন হবে ঘড়িবাবু, তাতে যে বিদ্যেবুদ্ধির দরকার লাগে।
–তা লাগুক কিন্তু ধর্ম থাকে না।
বিধু সরকার,এবার ক্ষেপে লাল হয়ে উঠলো। বললে—আমার ধর্ম নেই বলতে চাও! বাবুদের ধর্মের পয়সা—আমি অধর্ম করলে বাবুদের জমিদারী কি টিকতো এ্যাদ্দিন?
—এই যে জমিদারী আর টিকছে না, সে তত তোমার জন্যেই বিধু।
—তার মানে? বিধু সরকার মারমুখী হয়ে উঠলো।
–তার মানে ঘড়ি আর চলবে না, আমি হাজার দম দিলেও আর চলবে না, একদিন দেখবে আমার টাক ঘড়িটাও পট করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অত বড় আলমগীর বাদশা তাই-ই রইল না, সীতারাম, আবুতোরাপ, রেজা খাঁ, ঈশা খাঁ কেউ রইল না—তোমার বাবুদের জমিদারী তো কোন ছার তার কাছে—আর তাছাড়া এবার এই তো এসে গিয়েছে–
—কী এসে গিয়েছে শুনি?
-এই যে—বলে মোটর গাড়িখানাকে দেখিয়ে দিলেন বদরিকাবাবু।
—মোটর গাড়ির দাম কত জানো ঘড়িবাবু, এ তোমার ঘড়ি নয়।
—দামী জিনিষ বলেই তো যাবে, দর্পনারায়ণ যখন জেলখানায় তখন একদিন রাত্রে এক সাধু জেলখানার ভেতরে এসে হাজির। চল্লিশদিন না-খাওয়া না-দাওয়া, মুর্শিদকুলী খাঁ তাকে খুন করে তবে শান্ত হবে প্রতিজ্ঞা করেছে। তা সেই সাধু এসে বললে—ধর্ম চাও না জীবন চাও-যা চাও তাই পাবে। দর্পনারায়ণ বললেন-ধর্ম! সাধু চলে গেল! আবার পনেরো দিন পরে সাধু এল। তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন দর্পনারায়ণ। এক ফোটা জল। এক কণা ভাত। সেই অবস্থায় আবার সেই প্রশ্ন। সেবারও দর্পনারায়ণ আবার বললেন—ধর্ম। তারপর যেদিন জেলখানার মধ্যে মারা গেলেন সেই রাত্রে আবার সেই সাধু এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন–ধর্ম চাও, না জীবন। তখন দর্পনারায়ণ সেই একই উত্তর দিয়েছিলেন। আমি সেই দর্পনারায়ণের শেষ বংশধর—কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তুমি বাবুদের ধর্মের পয়সায় ক’টা তৌজি আর কটা তালুক কিনেছে। এ পর্যন্ত বিধু?
এতক্ষণ যাকে নিয়ে এত গণ্ডগোল সে কিন্তু কখন ঘটনাস্থল থেকে সরে গিয়েছে। হঠাৎ ইব্রাহিম সামনে এসে দাঁড়ালো। বললে—যানে দিজিয়ে ঘড়িবাবু।
ইব্রাহিমকে হঠাৎ সামনে দেখে বদরিকাবাবু বললে—এই যে এসে গিয়েছে দেখছি—তুমি ক’মাস মাইনে পাওনি ইব্রাহিম সাহেব—বলল তো?
—দো মাহিনা।
বিধু সরকার হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো—মেজবাবুকে আমি আজই বলছি গিয়ে, ঘড়িবাবু সকলকে ক্ষেপাচ্ছে। আর চাবুক মেরে আজ সবাইকে তাড়াবার ব্যবস্থা করছি।
বদরিকাবাবু বিধু সরকারকে শুনিয়ে বলে উঠলো—তাতে কিন্তু তোমার জাত ফিরবে না—তুমি মুসলমানের থুতু খেয়েছে বিধু, মনে থাকে যেন।
রাগে গরগর করতে করতে চলে গেল বিধু সরকার।
কিন্তু বদরিকাবাবুর কথা ফললো দু’দিন বাদেই।
একদিন সেই সাহেবটা আবার এল। সাহেব আসার খবর শুনে কিন্তু সেদিনকার মতো মেজবাবু আর নেমে এল না। সাহেবকে ওপরের নাচঘরে নিয়ে গিয়ে খানাপিনাও হলো না। সাহেব বুট পায়ে দিয়ে গট গট করতে করতে এসে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে ভোঁ-ভোঁ করতে করতে চলে গেল। আর ফিরে এল না।
যেদিন গাড়ি প্রথম এসেছিল বড়বাড়িতে, সেদিনও ইব্রাহিম কিছু বলে নি। আজও দোতলার বারান্দায় নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো খালি!
আর সন্ধ্যেবেলা যথারীতি বড় গাড়িটা নিয়ে দাঁড়ালে গিয়ে গাড়ি বারান্দার নিচে। ইয়াসিন এসে হাতে চাবুকটা ধরিয়ে দিলে। মেজবাবু উঠলো। বড়মাঠাকরুণ পানের ডিবে হাতে নিয়ে উঠলো। তারপর মেজমাঠাকরুণ উঠলো। হাসিনী উঠলো।
পেছনের গাড়িতে ভৈরববাবু, মতিবাবু, তারকবাবু উঠলো। আর উঠলো গোটাকতক বোতল, খাবারের চাঙারি, বরফ, সোডার সরঞ্জাম, আরো কত কি, ড়ুগি-তবলা, হারমোনিয়ম, ঘুঙুর।
ব্রিজ সিং গেট খুলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো—হুঁশিয়ার–হুঁশিয়ার হো–
ইব্রাহিম লাগাম ধরে গাড়িখানাকে বনমালী সরকার লেন পার করে একেবারে বৌবাজার স্ত্রীটে পৌঁছে দিলো।
গাড়িটা এলই যদি তবে গেলই বা কেন!
মধুসূদন বলে—গাড়িটা পছন্দ হয় নি মেজবাবুর।
লোচন বলে—মেজবাবু বললে আরো বড় গাড়ি কিনবে—
লোচনের ঘরে হুঁকোটা টানতে টানতে ভৈরববাবু বললে-না রে, তা নয়—মেজবাবু বলেছে—ও কালো রংটা পছন্দ নয়, বড় চোখে লাগে-ময়ুরপঙ্খী রং চাই, বিলেত থেকে ময়ুরপঙ্খী রং-এর নতুন গাড়ি জাহাজে করে আসছে–এই এল বলে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—গাড়ি সত্যিই আসবে নাকি বংশী?
–আজ্ঞে, আর এসেছে, দেখেন না রোজ ছুটুকবাবুর শ্বশুর আসে।
—কেন আসে?
ভূতনাথও দেখেছে। বিয়ে হবার পর প্রথম-প্রথম তেমন আসতো না। কিন্তু ইদানীং হাবুল দত্ত বড় আসা-যাওয়া শুরু করেছে। হাবুল দত্তর মোটরগাড়ি নেই। ঘোড়ার গাড়ি করেই আসতত প্রথম-প্রথম। যেবার কনে-বউ পাথুরেঘাটায় যায়, হাবুল দত্তর গাড়িতে যায়। আসে বড়বাড়ির গাড়িতে। আজকাল হাবুল দত্ত ট্রামে চড়েই আসে। লোহাপটি থেকে ঘেমে নেয়ে কাজ সেরে একেবারে এসে হাজির।
ভৈরববাবু বলে—ট্রামে এলেন নাকি বেয়াই মশাই?
-হ্যাঁ, ট্রামেই এলাম বৈ কৈ!
–খুব কষ্ট হলো-পয়সা নিলে?
—সাত পয়সা—তোফ আরামে এলাম।
—কিন্তু ট্রামে—যা-ই বলুন-ইজ্জত তেমন নেই।
মেজবাবু হঠাৎ আসরে ঢুকলেন—সঙ্গে সঙ্গে আতরের গন্ধে ভুর ভুর করে উঠলো ঘরটা। বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নেমেছেন একেবারে। গোঁফজোড়া সরু ছুঁচলো করেছেন মোম লাগিয়ে। লোচন এসে তামাক দিয়ে গেল পাশে। ফুঁ দিয়ে ধোঁয়াও বার করে দিয়ে গেল। নল টানতে টানতে বললেন–ইজ্জতের কথা কী যেন বলছিলে ভৈরববাবু?
–আজ্ঞে, ট্রামের কথা বলছিলাম, হয়েছে ভালো হয়েছে, কিন্তু ইজ্জত নেই ওতে-দশজনের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসা।
হাবুল দত্ত বললে—মোটরগাড়ি কিনলেন নাকি বেয়াই মশাই?
মতিবাবু পাশ থেকে বললে—মোটর না কেনাই ভালো মেজবাবু। হুস করে ছাড়লো আর দেখতে না দেখতে উড়ে গেল কোথায় কেউ দেখতে পেলে না, বাহবা দিলে না–ও যেন কেমন
ভৈরববাবু বললে—আর কলকজার ব্যাপার—বিগড়ে গেল তো গেল-পড়ে থাকো রাস্তায় হা-পিত্যেশ করে।
তারকবাবু বললে—তেমন-তেমন ঘোড়া হলে মোটরকে হার মানিয়ে দেয় মশাই। হীরে, মুক্তো দিয়ে সাজিয়ে দিন না ঘোড়াকে, কোচোয়ান-সহিসকে জরির সাজ-পোষাক পরিয়ে দিন—দু’দণ্ড হাঁ করে চেয়ে দেখতে হবে না!
কথা যেন জমে না। এমনি রোজই হয়।
হাবুল দত্ত বলে—বাবাজীর ঘুম ভেঙেছে নাকি?
মেজবাবু বেণীকে ডাকেন।—দেখে আয় তো বেণী, ছুটুক নিচে নামলো কিনা?
সেদিন ছুটুকবাবুর সঙ্গেও দেখা হয়ে গিয়েছিল। ভূতনাথই জিজ্ঞেস করলে প্রথমে-কেমন আছেন ছুটুকবাবু?
হালচাল এই কয়েকদিনের মধ্যেই বদলে গিয়েছে ছুটুকবাবুর। বৈঠকখানা ঘর থেকে গানের শব্দ আর কানে আসে না। ছুটুকবাবু যেন অদ্ভুত সৃষ্টি এ-বাড়ির। এর আগেও বিয়ে হয়েছে এ-বাড়ির পুরুষদের। কিন্তু বিয়ের আগেও যা বিয়ের পরেও তাই। ছোটকর্তা কৌস্তুভমণি চৌধুরী ফুলশয্যার রাত্রে বাড়ি ফিরেছিল রাত বারোটার সময়। একলা একলা অপেক্ষা করে করে যখন ঘুমিয়ে পড়েছে পটেশ্বরী বৌঠান, তখন সোরগোল তুলে বাড়িতে ঢুকতে লজ্জা হয়নি ছোটকর্তার। মুখে দুর্গন্ধ, টলছে। নতুন-বৌ-এর সঙ্গে একঘরে এক রাত্রি কাটিয়েছে বটে। ঘরে ঢুকে খিল বন্ধও করেছে। কিন্তু কানাঘুষো চলেনি সেজন্যে বড়বাড়িতে। অনুযোগ শুনতে হয়নি দশ বছরের কনে-বউ পটেশ্বরী বৌঠানের কাছে। বৈদূর্যমণি চৌধুরীও কাঁচা বয়েসে কমতি ছিলেন না কিছু। বড়মাকে দেখলে সেদিনকার কনে-বউকে আজ হয় তো চিনতে পারা যাবে না। দুধের মতো শাদা ধবধবে গা। বৌভাতের রাত্রে সবাই হাঁ করে বসে আছে। কখন আসবে বর। তখনও দেখা নেই বৈদূর্যমণির। তারপর খোঁজ পড়লো সারা কলকাতায়। শেষে পাওয়া গেল রামবাগানের এক বাড়িতে। সাহেব বীণার ঘরে। সাহেব বীণা ছিল রামবাগানের মেয়েমানুষ। সাহেবদের মতো গায়ের রং তার। সেখানে পাওয়া গেল বড়বাবুকে অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায়। ভূমিপতি চৌধুরীর বংশের ওপর সেজন্যে বদনাম হয় নি সেদিন। মাথায় বরফ দিয়ে, জ্ঞান ফিরিয়ে তবে ফুলশয্যার আয়োজন হয়েছে তাঁর। বড়মা তখন ছোট। বোঝবার বয়েস না হলেও সেকথা ভেবে চোখের জল পড়ে নি তার কোনো দিন। তারপর যেদিন রাজবাহাদুর হয়েছেন, নাম যশ হয়েছে খুব, সাহেববো এসেছে, খোদ লাটসাহেব নিজে এসেছে খানা খেতে, চীনে-অর্কিড উপহার নিয়ে গিয়েছেন, সেদিন গর্বে বুকটা দশ হাত হয়েছে বড়মা’র। আর মেজবাবু! হিরণ্যমণি চৌধুরী। হিরণ্যমণি চৌধুরীর আর একটাতে কুলোয়নি। একরাশ মেয়েমানুষ নিয়ে রাসলীলা করেছেন, মোসাহেব পুষেছেন, গঙ্গায় পানসি ভাসিয়েছেন দলবল নিয়ে, খড়দ’র রামলীলার মেলায় গিয়ে মাতলামি করেছেন, পায়রা নিয়ে ছেনি দত্তর সঙ্গে মামলা করেছেন, কাশী-লক্ষ্মৌ থেকে বাঈজী আনিয়ে নাচ দেখেছেন, মুজরো দিয়েছেন, আবার খেয়াল হলো তো বরানগরের বাগানবাড়িতে একপাল মেয়েমানুষ নিয়ে গিয়ে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলেছেন কখনও কখনও শ্রীকৃষ্ণের বস্ত্রহরণের আধুনিক অভিনয় করেছেন। এ-সব ব্যাপারে সুনাম বই দুর্নাম হয়নি। বাবু সমাজে তাতে তার খ্যাতি প্রতিপত্তিও বেড়েছে বৈ কমেনি!
কিন্তু ছুটুকবাবু যেন সৃষ্টিছাড়া।
দেখা হতেই ভূতনাথ বললে-আজকাল আপনাকে দেখতে পাই না মোটে—গানের আসরও আর বসে না আপনার।
ছুটুকবাবু গাড়ি থেকে নামছিল। হাতে বই। কলেজ থেকে ফিরছে হয় তো। বললে—সামনে এগজামিন কিনা—একটু পড়াশুনোয় মন দিয়েছি ভূতনাথবাবু। তা আসছে দোলের দিন ভাবছি একটু গান বাজনার ব্যবস্থা করবো।
ভূতনাথ বললে—এখন আবার কীসের পরীক্ষা?
—এ্যাটর্নীশিপটা দিচ্ছি কিনা—বড় শক্ত পরীক্ষা—বিয়েতে অনেকদিন সময় নষ্ট হয়ে গেল, কিছু পড়তে সময় পাইনি।
ওইটুকু মাত্র কথা হয়েছিল একদিন। কোথায় কোন্ ঘরে বসে পড়ে ছুটুকবাবু, কে জানে।
বংশী বলেছিল—আপনি তত আমার ভাইটার একটা কিছু হিল্লে করে দিতে পারলেন না ছুটুকবাবুকে বলে—কী যে করি।
ভূতনাথ বলেছিল-শশীর জায়গাটা এখনও খালি আছে নাকি বংশী, এ্যাদ্দিন বলেনি কেন আমাকে?
—আজ্ঞে, সে-চাকরি আর খালি নেই শালাবাবু, ভর্তি হয়ে গিয়েছে লোক।
—কে ভর্তি হলো শেষ পর্যন্ত?
—সে মধুসূদনের লোক নয় শালাবাবু, ছুটুকবাবুর শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছে। এবার আর এ-বাড়ির লোক রাখবে না ছুটুকবাবু বলেছে।
-এ-বাড়ির লোকের ওপর অত রাগ কেন বলো তো ছুটুকবাবুর?
বংশী বললে—ছুটুকবাবু একটু আলাদা ধরনের লোক শালাবাবু, যা বলবো সত্যি কথা আজ্ঞে। দেখেন না দিন রাত কেবল শ্বশুরবাড়ি যান, আর ছুটুকবাবুর শ্বশুরমশাইও কম নাকি—কেবল এবাড়িতে এসে দিন রাত জামাই-এর সঙ্গে গুজুর গুজুর গল্প—কানে ফুস্ মন্তর দিচ্ছে খালি।
ভূতনাথ বললে—হাবুল দত্তর কথা বলছে!
-আজ্ঞে, দত্ত মশাইরা তো তেমন বনেদী ঘর নয় কলকাতার, মেজবাবুর তাই তেমন ইচ্ছে ছিল না ওখানে বিয়ে দিতে, কিন্তু বড়মা’র মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল। বললে—ওখানেই বিয়ে দিতে হবে—সৈরভী ঘটকী একদিন মেয়ে নিয়ে এসেছিল বড়বাড়িতে পাকা ঘটকী কিনা। ওইটুকু মেয়ে এসেই বড়মাকে একেবারে মা বলতে শুরু করেছে। ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িময়—সব যেন আপন করে নিলে একদণ্ডে।
বড়বাড়ির নিয়মই নাকি এই। বড়মা’র বাপও নাকি এখানে এনে মেয়ে দেখিয়েছে। মেজমা’র বিয়ের আগে তাকে এ-বাড়িতে দেখাতে নিয়ে এসেছিল মেজবাবুর শ্বশুর।
বংশী বলে—চৌধুরীরা তো আজ্ঞে কনের বাড়িতে মেয়ে পছন্দ করতে যায় না কখনও—তা দত্ত মশাই যেদিন নতুন বউকে দেখাতে আনলে—সে এক কাণ্ড শালাবাবু-হাসতে হাসতে মরি আমরা।
বড়মা একবার জিজ্ঞেস করলে—তোমার নাম কি মা।
নতুন কনে এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকতে জানে না, ছটফট করে ঘুরে ঘুরে তখন দেখছে সব। একবার দৌড়ে যায় মেজমা’র ঘরে, বাঘবন্দির ঘুটিতে হাত দেয়, আবার কখনও ছোটমা’র ঘরে গিয়ে পুতুলের আলমারিতে হাত দেয়। ট-উ-উ-উ–করে দম টেনে দৌড়ে যায় বারান্দায় এ-কোণ থেকে ও-কোণ।
মেজমা দেখে শুনে তো হেসে খুন। বলে-এ বউ তোমার স্বগ্যে বাতি দেবে বড়দিদেখে নিও।
বড়মা বলে—তুই নিজে কী ছিলি মেজো, আজ না হয় এত বড় ধিঙ্গি হয়েছিস। চিৎপাত হয়ে মাটিতে শুয়ে-দেয়ালে পা তুলে দিয়ে—’আয় বিষ্টি ঝেপে’ বলে ছড়া গাসনি?
সৈরভী ঘটকী বললে—সবে তো দশে পা দিয়েছে মাঠাকরুণ— মায়ের অষ্টম গত্যের সন্তান কিনা একটু ছটফটে তো হবেই।
বড়মা বললে—গড়ন-পেটন তো ভালোই হবে মনে হচ্ছে আমার।
নতুন রেশমী শাড়ি পড়ে এসেছিল নতুন কনে। দৌড়ঝাঁপের চোটে তখন শাড়ি অঙ্গ থেকে খসে পড়েছে। বারান্দায় লুটোচ্ছে শাড়িটা।
সৈরভী বললে—কেমন ভারী-ভারী ধাচ দেখছে না মাঠাকুরুণ–বয়েসকালে ডাগর হলে ঠিক তোমার মতন দেখতে হবে বউমাকে।
বড়মা ভারী খুশি।
সেইদিনই বিধু সরকারকে ডাকিয়ে আনানো হলো তেতলার সিঁড়ির গোড়ায়। আড়ালে দাঁড়িয়ে বড়মা বললেন—ও সিন্ধু, সরকার মশাইকে বলমেজকর্তা এখানেই কথা দিক—আমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে।
মেজকর্তা সব শুনে বললে—দেখো তো কাণ্ড—লোহার কারবারি—দু’পুরুষ হলো সবে উঠেছে—এখনও বাড়িতে দুর্গোৎসব হয়
ওদের। রাস্তার ধারের ঘরে আবার ভাড়াটে বসিয়েছে—যা বনেদী ঘরে কেউ কখনও করেনি—তাদের কুটম করা…
ভৈরববাবু বললে—আমি সব খবর নিয়েছি মেজবাবু, হাবুল দত্ত মদের নাম শুনলে নাক সিটকোয়।
মেজবাবু জিজ্ঞেস করলেন—খবর নাও তো ভৈরববাবু—মেয়েমানুষ-টানুষ রেখেছে কিনা।
—তা-ও খবর নিয়েছি স্যার।
–কী শুনলে?
—কী যে আপনি বলেন মেজবাবু, হাবুল দত্ত রাখবে মেয়েমানুষ! এ হলো আলাদা কেলাশের লোক স্যার, লোহার কারবার করে আর ঠিকেদারির কাজ আছে। মেয়েমানুষ-টানুষ পুষতে গেলে বনেদী দি থাকা চাই মেজবাবু—শেষকালে জামাইকে না হাত করে ফেলে।
কিন্তু যা ভবিতব্য তা হবেই।
হাবুল দত্ত দোকান বন্ধ করে আসে রোজ একবার করে। কর্তাদের সঙ্গে দেখা হয় ভালো। আর না-দেখা হয় ক্ষতি নেই। সোজা চলে যায় ছুটুকবাবুর ঘরে।
সেদিন দুপুরবেলায় ডাক পড়লো বিধু সরকারের। খাজনা আদায়-পত্তোরের জমা-খরচ, রসিদ বহি, প্রজা-বিলি, সেলামীআদায়ের নথি-পত্ৰ সমেত।
বিধু সরকার ঝড়ের মতো খাজাঞ্চীখানায় এসে ঢুকলো। বললে—সরে দিকিনি সব, হট্টগোল করো না এখন—পরে এসো, এখন বলে মরবার ফুরসত নেই আমার—বলে চার পাঁচ দফা খাতা বই নিয়ে আবার উধাও। কাছাকোঁচার ঠিক নেই। দৌড়তে দৌড়তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
—সরকার মশাই আমার বরফের পাওনাগণ্ডাটা বুঝিয়ে দিলেন, ভোর থেকে যে বসে আছি।
বিধু সরকার রেগে লাল-বেয়াদব কোথাকার—বাবুদের পঞ্চায়েৎ বসেছে—এখন তাদের হুকুম তামিল করবে না তোর হুকুম শুনবো রে। বাঁচি যদি তো পাবি সব কাল।
বেণীকে জিজ্ঞেস করলে ভূতনাথ-কীসের পঞ্চায়েৎ বাবুদের?
–তা জানিনে শালাবাবু।
বেণী জানে না। লোচনও জানে না। মধুসূদন জানলেও কি বলবে! সমস্ত দিনটা কেমন উদাস লাগে, কোথাও যেন কোনো আকর্ষণ নেই। ছোটবৌঠান এতক্ষণ তার নিজের ঘরে হয় তো নেশার ঘোরে ঝিমোচ্ছে। তার কাছে আজ হয় তো ভূতনাথের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। সেদিনের সেই মদের বোতল ভেঙে যাওয়ার পর আর যায়নি ভূতনাথ।
বংশীও বললে—কী জানি বাবু কীসের পঞ্চায়েৎ।
-কে কে আছে নাচঘরে?
—দেখে এলাম, মেজবাবু, ছোটবাবু, ছুটুকবাবু, ছুটুকবাবুর শ্বশুর–এই চারজন, তা একে পঞ্চায়েৎ বলতে চান বলুন—আর আছে খাজাঞ্চীবাবু। খাজাঞ্চীবাবুকে নিয়ে পাঁচজন হলো— তিনি তো দাঁড়িয়েই কথার জবাব দিচ্ছেন।
এমন তো কখনও হয় না। যদিও বা হয়, তা-ও কচিৎ কদাচিৎ। বছরের পর বছর একই বাড়িতে অবশ্য বাস করছে মেজবাবু, ছোটবাবু, ছুটুকবাবু। অথচ পরস্পরের কথা হওয়া দূরে থাক, মুখ দেখাদেখিও নেই। যে-যার নিজের নিজের ঘরে বসে আছেন। অথচ ঝগড়াও নেই কারো সঙ্গে।
—এই একটু আগে মধুসূদন বালকবাবুকে খবর দিতে গেল।
–বালকবাবু কে?
–আজ্ঞে, বড়বাড়ির উকিল—বউবাজারের বালক উকিল, দেখেন নি?
বড়বাড়ির ইতিহাসে এ ঘটনা নতুন বৈ কি! তবু তারপরে কতদিন কেটে গিয়েছে, ফলাফল কিছু জানা যায়নি। ঝাড়া দু’ ঘণ্টা ধরে কথাবার্তা চলেছে। তারপর কখন সন্ধ্যেবেলা সবাই চলে গিয়েছে ভূতনাথ টের পায়নি। ভূতনাথ গিয়েছিল জবাদের বাড়ি। বাড়িতে ফিরে এসে বংশীকে জিজ্ঞেস করেছে—কিছু শুনলে নাকি, কী হলো?
-কীসের কী হলো শালাবাবু?
—এই কর্তাদের পঞ্চায়েত-এ।
–কে জানে শালাবাবু, ছোটবাবু এসে বললে—বরফ ভাঙ। আমি বরফ ভেঙে দিলাম গেলাশে—ছোটবাবুকে যেন খুব ক্লান্ত মনে হলো, গম্ভীর গম্ভীর মুখ—কিছু কথা বললেন না—চুপ-চাপ শুয়ে পড়লেন পালঙ-এর ওপর চিতপাত হয়ে—আমি পা টিপতে লাগলুম আজ্ঞে।
ওই ঘটনার পর থেকেই কেমন যেন সব চুপ-চাপ।
বিধু সরকারের মেজাজ আরো রুক্ষ হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে। বলে—এ তোমার পোস্টাপিস নয় হে, এখানে আইনকানুন দেখিও না, যা পারো করো গে—এ মাসে কিছু মিলবে না, আসছে মাসে এসো।
—আজ্ঞে, পাঁচ মাস হয়ে গেল, বাইশটে মাত্তোর টাকা।
বিধু সরকার লাফিয়ে ওঠে—বাইশটে হোক আর বাষট্টিটেই হোক, পাবে না তো পাবে না, বলেছি যখন পাবে না ব্যস। কাছারি আছে, আদালত আছে, যা পারো করে গে, যাও।
শীতকালে পোষ-মাঘ মাসে একবার করে নান্নেবাঈ কলকাতায় আসে দলবল নিয়ে। কাশীতে বাড়ি। ওই সময়টা বোধ হয় সারা ভারতবর্ষের বড় বড় শহরে মুজরো করতে বেরোয়। খাসা বাঁধুনি চেহারাটার। নাকে হীরের নাকছাবি। গলায় চন্দ্রহার। ডান কাঁধে শাড়ির আঁচলটা ঝুলিয়ে দেয়। কলকাতায় এলে দু’ চারটে বাঁধা ঘরে গিয়ে সেলাম করে আসে। সেবারও এল। কোনোবার বাদ দেয়নি মেজবাবু। এসব ব্যাপারে বড়বাড়ির সুনাম আছে লক্ষ্ণৌ, কাশী, এলাহাবাদের বাঈজী মহলে।
সারেঙ্গীওয়ালা মুন্নালাল দলের সর্দার। তার কাজ মুজরো যোগাড় করা। রেশমী পাগড়ীর ওপর জরির চুমকির কাজ। পায়ে আগ্রার নাগরা।
বিধু সরকার চিনতে পেরেছে। খাতা থেকে মাথা তুলে (চশমাটার ওপর দিয়ে দেখলে একবার।
-সেলাম খাজাঞ্চীবাবু।–কী মুন্নালাল, আবার এসে গিয়েছে।
-আজ্ঞে, দু’রোজ হলো কলকাতাতে এসেছি, কাল মুজরো ছিল হাটখোলার দত্তবাড়ির কোঠিতে, আজ আছে ঠনঠনিয়ার নটে দত্তবাবুর বাড়ি—মেজবাবুকে একবার সেলাম জানাতে এসেছি।
-নান্নেবাঈ কেমন আছে?
—হুজুর আপনাদের মেহেরবানি আর খোদার মরজি, মেজবাবু ফরমায়েশ করেন তো, একদিন এখানে নাচা-গানা করে যাই।
বিধু সরকার ছাড়লে না। বললে—তা অন্যবার কলকাতায় এলে আগে মেজবাবুকে সেলাম করে তবে ঠনঠনের দত্তবাড়িতে যাও—এবার এত পরে এলে কেন মুন্নালাল? মেজবাবু কি ও-বাড়ি থেকে বেশি মুজরো দেয় না?
—ছিয়া—ছিয়া—কি যে বলেন বাবুজী, এবার ননীবাবু নিজে ডেকে এনেছিলেন আমাদের, মেমসাহেবদের খানাপিনা ছিল বাড়িতে, সেখান থেকে তিনদিন ছাড়া পেলাম না, এখানে আসবো আসবো করছি, নটেবাবু ধরলেন গিয়ে—আজকে একটু ফাঁক পেলাম, ভাবলাম সেলাম জানিয়ে আসি মেজবাবুকে—গোস্তাকি মাফ হয় হুজুর
–ননীবাবু! ননীবাবুটা আবার কে! বিধু সরকার ভুরু কেঁচকালো।
—আজ্ঞে, পটলডাঙার ননীবাবু।
তবু চিনতে পারলো না বিধু সরকার। চুলোয় যাক! আজকাল তো সবাই বাবু। দুটো কাঁচা পয়সা হলেই বাবু। ছেনি দত্ত মারা যাওয়ার পর নটে দত্তও টেক্কা দিতে শুরু করেছে। —তা বোসো তুমি, মেজবাবু তো এখন ঘুমুচ্ছেন—উঠলে খবর দেবো।