Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra » Page 20

সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra

বিকেলবেলার দিকে ভূতনাথ বিছানা ছেড়ে ওঠে। একলা একলা শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না। মাসের পর মাস এই শুয়ে থাকা। আরো কত মাস শুয়ে থাকতে হবে কে জানে। প্রায় এক বছর হতে চললল তো। ঘরের বাইরেই একটা সরু চলাচলের পথ। লোক আসা যাওয়া করে না বড় একটা। দক্ষিণ দিকে গেলে রাস্তাটা সোজা নেমে গিয়েছে সিঁড়ি দিয়ে। তারপর বাগান, পুকুর, ধোপাদের বাড়ি, হীরু মেথরের ঘর। আর উত্তর বরাবর চলে গিয়েছে আর একটা পথ সোজা। সে পথটা গিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে একটা দরজার সামনে। দরজাটা বন্ধই থাকে। খিল দেওয়া। ওর ও-পাশেই বুঝি বাড়ির বউদের কথাবার্তা শোনা যায়।

বোঝা যায় এ-জায়গাটা না-দোতলা, না-তেতলা, না-বারমহল, না-অন্দরমহল। কবে এ-বাড়ির খোদ মালিক অতীতে এইখানে এই চোরকুইরির মধ্যে তার কোন নৈশ-অভিযানের খোরাক এনে পুষে রেখে দিয়েছিলেন। রোজ রাত্রে বুঝি গোপনে সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলতো তার অভিসার। আজো ভাঙা দেয়ালের গায়ে তাঁর স্মৃতি তাই জড়িয়ে আছে বুঝি।

বৈদূর্যমণি, হিরণ্যমণি আর কৌস্তুভমণিরা তখন ছোট তিন নাতি। নিমকমহলের বেনিয়ান হয়ে খোদ কর্তা ভূমিপতি চৌধুরী এখানে বাড়ি করেন। ইটালিয়ান সাহেব এসেছিল নতুন বাড়ির দেয়ালে-দেয়ালে ছবি আঁকতে। বর্ধমানের সুখচর মহকুমা থেকে তখন নতুন এসেছেন জমিদারবাবু। পাশের বস্তীতে কুলিরা থাকে— আর সারা দিন খাটে বাড়ির পেছনে। ইটালিয়ান সাহেব থাকে হেস্টিংস হাউসের কাছে খাড়ির ধারের বাগান বাড়িতে।

একদিন সন্ধ্যাবেলা কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে গিয়ে সাহেব দেখে—মেমসাহেব একলা নয়, সামনে বসে কাছে ঘেঁষে গল্প করছেন ভূমিপতি চৌধুরী।

সাহেবের মেজাজ গেল বিগড়ে। কয়েকদিন থেকেই সন্দেহ হচ্ছিলো সাহেবের। মেমসাহেব যেন একটু বেশি সাজে, গুন্ গুন করে গান গায়। একটু অন্যমনস্ক ভাব। আজ হাতে হাতে ধরা পড়ে গেল দুজনেই।

মেমসাহেব সাহেবকে দেখেই চমকে উঠেছে। ভূমিপতি চৌধুরীও কম চমকাননি। এমন দিনে সাধারণতঃ সাহেব বাড়ি ফেরে না। বাড়ি ফেরবার কথা নয় আজকে।

দুজনের ভাব লক্ষ্য করে সাহেব আর থাকতে পারলো না। কোমর থেকে পিস্তলটা বার করে দুজনকে লক্ষ্য করেই গুলী ছুড়লো। ভূমিপতি বেঁচে গেলেন একটুর জন্যে, কিন্তু অব্যর্থ গুলী গিয়ে লাগলো মেমসাহেবের গায়ে। মেমসাহেব ঢলে পড়লো মাটিতে।

ভূমিপতি তখন সামলে নিয়েছেন নিজেকে। একমুহূর্তে উঠে খপ করে হাত ধরে ফেলেছেন সাহেবের।

ভয়ে সাহেবেরও বুঝি মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। বললে—লেট মি গো বাবুলেট মি গো-আমাকে ছেড়ে দাও।

কিন্তু ভূমিপতির বজ্রমুষ্টির চাপে বুঝি পালাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। ক্ষমা চেয়ে সাহেব তো ছাড়া পেল। কিন্তু পিস্তল কেড়ে নিলেন ভূমিপতি। বললেন—তুমি খুন করেছে তোমার বউকে, তোমাকে পুলিশে দেবো।

হাজার হাজার মাইল দূর থেকে শিল্পী এসেছিল জীবিকার জন্যে জলামাটির দেশে। রাস্তায় মেমসাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়ে জাহাজেই তাদের নাকি বিয়ে হয়ে যায়। তারপর ভাগ্যের ফেরে আজ এই অবস্থা। সাহেব খানিক পরে বললে—ফরগিভ মি বাবু, আমি কাউকে কিছু বলবো না। আমায় শান্তিতে দেশে ফিরে যেতে দাও। আমি আর কখনও তোমাদের দেশে আসবে না।

ভূমিপতি বিশ্বাস করে ছেড়ে দিলেন সাহেবকে। সেই রাত্রেই সাহেব কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। আর দেখা যায়নি তাকে। যে লোক এসেছিল এদেশে ছবি আঁকতে, কী ছবি সে একে নিয়ে গেল নিজের চিত্তপটে কে জানে!

কিন্তু মেমসাহেব বুঝি সত্যি সত্যিই মরেনি। একটু জ্ঞান ছিল তখনও। সাহেবের বাড়ির চাকরবাকরদের টাকাপয়সা দিয়ে মুখবন্ধ করে ভূমিপতি সেই রাত্রেই নিজের পাল্কিতে করে তুলে নিয়ে এসেছিলেন মেমসাহেবকে। নিজের বাড়িতে একেবারে। এনে তুলেছিলেন এই চোরকুঠুরিতে। বাড়ির পুরোনো কবিরাজ এসেছিল। দেখে গেল। নাড়ি টিপে বললে—প্রাণ আছে এখনও—বাঁচবে এ রোগী।

সত্যি সত্যি মেমসাহেব বেঁচেও উঠলো একদিন। ঘা শুকিয়ে গেল হাতের। নতুন করে যেন নবজন্ম হলো মেমসাহেবের। নতুন ঘোড়ার গাড়ি কেনা হলো মেমসাহেবের জন্যে। মেমসাহেব ঘরের বৌ হয়ে গেল তারপর থেকে। পান খেতো, তামাক খেতে, শুক্ত, চচ্চড়ি, কুলের অম্বল খেতে। কিন্তু তবু বাড়ির মেয়েরা ছুতো না কেউ তাকে। বলতেও গরু খেয়েছে, ও মেলেচ্ছে–ওর জল চল্ নয় বাছা হিদুর বাড়িতে।

মেমসাহেব ওই ঘরে থাকতো আর এক আয়া ছিল তার কাজ করবার জন্যে।

সারা বাড়ির মধ্যে তাকে ছুঁতেন শুধু ভূমিপতি। বাড়ির মালিক। তা-ও রাত্রে। দেওয়ানি কাজের ঝঞ্চাট এড়িয়ে যখন রাত্রে চোখে তার লাল-নেশা ধরতো। ছেলে—একমাত্র ছেলে—সূর্যমণি চৌধুরী তখন রীতিমতো সাবালক হয়েছে। ওদিকে মেমসাহেবেরও ছেলে হয়েছে একটি। এমন সময় ভূমিপতি মারা গেলেন হঠাৎ। ধুমধাম করে শ্রাদ্ধ হলো জবর। কিন্তু মেমসাহেব তারপর আর এ-বাড়িতে থাকতে চাইলে না। নিজের আর ছেলের আজীবনের ভরণপোষণের মতো নগদ টাকা নিয়ে চলে গেল স্বদেশে। ভূমিপতি তার উইলে সে-ব্যবস্থা করে যেতে ভোলেননি নাকি!

বড়বাড়ির চারপুরুষ আগের ইতিহাস এ-সব। বাড়ির চাকর থেকে আরম্ভ করে নায়েব গোমস্তা, বদরিকাবাবু সবাই এ-ইতিহাস জানে। তার চাক্ষুষ সাক্ষী আজকের এই চোরকুঠুরির লাগোয়া এই এক ফালি বারান্দা।

রোজ সকালে জানালাটা দিয়ে দেখা যায়—সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মাঝখানের সময়টা কেমন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় দিনের পর দিন। ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে সমস্ত মন। কেবল ওষুধ আর পথ্য। বিশ্রাম আর ঘুম। একঘেয়ে ক্লান্তিকর দিনগুলো যেন আর কাটতে চায় না ভূতনাথের!

কিন্তু ভূতনাথের সেদিন যে কী খেয়াল হলো। উত্তরদিকের দরজাটা খোলা যায় কিনা দেখতে ইচ্ছে হলো একবার! এই দরজা দিয়েই অন্দরমহল পেরিয়ে রাত্রে আসতেন বুঝি ভূমিপতি মেমসাহেবের ঘরে!

একটি দরজা শুধু। কিন্তু ভূতনাথ জানতে কি অন্দরমহলের এত ঘনিষ্ঠ এই একটি মাত্র দরজা তাকে ছোটবৌঠানের এত কাছাকাছি পৌঁছিয়ে দেবে।

কেন যে এ-ঘরে তার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল কে জানে! হয় তো এ-ঘরটা একটু নিরিবিলি বলে। চাকর-দারোয়ান-গাড়িঘোড়া, রান্নাবাড়ি, সমস্ত গোলমাল হট্টগোল থেকে দূরে থাকলে রোগীর পক্ষে সেটা ভালোই। কিন্তু দরজাটা খুলতে গিয়ে যেন রোমাঞ্চ হলো সারা শরীরে। এ যেন নিষিদ্ধ দরজা। তার এলাকার বাইরে সে যাচ্ছে। অধিকার-বোধের চৌকাঠ পেরিয়ে তার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করছে।

ওপার থেকে যেন সিন্ধুর গলা শোনা গেল–ও লো ও গিরিওখান থেকে সরে যা তো।

গিরি বললে-থাম বাছা, সবুর কর একটু-হাতের কাজটা গুছিয়ে নি।

সিন্ধুও ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে—তোর হাতের কাজটাই বড় হলে লা, ওদিকে বড়মা সাজাঘরে যাবে, তোর জন্যে বসে থাকবে নাকি। সর শীগগির, চোখের আড়াল হ’।

মেজবউ-এর গলা কানে আসে। খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলে-ও গিরি তোর সুপুরি কাটা রাখ বাপু–শুনছিস বড়দি সাজাঘরে যাবে।

গিরি গজ গজ করতে করতে বলে—আমি তো আর পুরুষ। মানুষ নই মা যে আমাকে না। সাতজন্মে যেন ছুচিবাই না হয় মানষের—-ছিঃ।

ভেতর থেকে হুড়কো সরাতেই দরজাটা একটু ফাঁক হলো। ভূতনাথ স্পষ্ট দেখতে পেলে সব। বিকেলের ছায়া-ছায়া আলো চারদিকে। একেবারে মাথার ওপরেই অন্দরমহলের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে।

সিন্ধু চিৎকার করে উঠলো—তোর কাপড়টা সরিয়ে নিলিনে গিরি, বড়মা’র ছোঁয়া লেগে যাবে যে, ছুঁয়ে শেষে কি নোংরা হবে নাকি মানুষ।

—হলো, এই নিলাম সরিয়ে—হলো? বলে গিরি দড়ির ওপর থেকে কাপড়খানা সরিয়ে নিলে।

আর চোখের সামনে…আর ভূতনাথের চোখের সামনে এক কাণ্ড ঘটে গেল সেই মুহূর্তে!

বোধহয় এ-বাড়ির বড়বউ। বিধবা বড়বউ। সম্পূর্ণ নিরাবরণ নিরাভরণ অবস্থা। ত্বরিত গতিতে নিজের শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঢুকলেন গিয়ে সাজঘরে। পেছন পেছন চললো সিন্ধু গামছা সাবান নিয়ে।

কাণ্ডটা ঘটলো এক নিমেষের মধ্যে। কিন্তু সমস্তটা দেখবার আগেই ভূতনাথ নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে! ছি-ছি! ছি!!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress