সাহেব বিবি গোলাম (Saheb Bibi Golam) : 13
‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে সেদিন সকাল থেকেই বড় কাজের তাড়া। একটা নিঃশ্বাস নেবার পর্যন্ত ফুরসুৎ পাওয়া যায় না। পাঠকজী তারই মধ্যে দুপুরবেলা ছাতু ভিজিয়ে খেয়ে নিলে। ভূতনাথেরও খুব খিদে পেয়েছে। তবে কি আজকে কেউ আর ডাকতে আসবে না!
একটা মনি-অর্ডারের কাগজ নিয়ে সোজা ওপরে চলে গেল। ভূতনাথ। সুবিনয়বাবু তেমনি ভাবে বসেছিলেন। পাশে জবা। আর একটা চেয়ারে জবার মা। বসে বসে বই পড়ছেন।
কাছে যেতেই ভূতনাথ লক্ষ্য করলে সুবিনয়বাবু মেয়ের সঙ্গে কী যেন আলোচনা করছেন। ভূতনাথ কাছে যেতেই জবা উঠছিল।
সুবিনয়বাবু বললেন–না, উঠে যেও না মা, বোসোলজ্জা কি মা?
জবা বললে—ভূতনাথবাবুর খাওয়ার এখনও যোগাড় হয়নি বাবা—আমি যাই।
—কেন? সুবিনয়বাবু অবাক হয়ে গেলেন। ভূতনাথবাবুর খাবার দিতে এত দেরি করা বড় অন্যায় মা।
—কিন্তু উনি কি আমাদের হাতে খাবেন? ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন না বাবা।
-কেন, ও-কথা কেন বলছে মা? বৃদ্ধ যেন কিছু বুঝতে পারলেন না।
ভূতনাথ কী জবাব দেবে বুঝতে পারলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শুধু।
জবার মা আপন মনেই বই পড়ছেন। তাঁর যেন এ-সব কথা কানে যাচ্ছে না।
জবা পরিষ্কার করে বললে—আমরা তত ব্রাহ্মণ নই বাবা।
-ও, তাও তো সত্যি। তা হলে তোমার খাওয়ার বন্দোবস্ত কী হবে ভূতনাথবাবু? এ-কথাটা আগে ভাবিনি তো মা-একটা ঠাকুরের ব্যবস্থা করতে হয়। পাঠককে একবার খবর দিতে হবে। ওরে রতন–
—সে যখন হবে, তখন হবে, কিন্তু এখনি তো আর ঠাকুর আসছে না—আজকে কি উনি উপোস করবেন?
—সে কি একটা কথা হলো? বলে সুবিনয়বাবু হতবুদ্ধির মতো ভূতনাথের দিকে চেয়ে রইলেন।
ভূতনাথেরও এই পরিস্থিতিতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল।
জবা এবার সোজাসুজি ভূতনাথকে প্রশ্ন করলে—আমি হাঁড়িটা চড়িয়ে দিলে, আপনি নামিয়ে নিতে পারবেন না—তাতেও আপনার কিছু আপত্তি আছে?
ভূতনাথ বললে—পারবো।
—এ তো বেশ কথা, খুব উত্তম কথা, যতদিন ঠাকুর না পাই, ততদিন এই রকম একটু কষ্ট করো ভূতনাথবাবু, জবা ঠিক বলেছে।
তা হলে আমি ব্যবস্থা করি গিয়ে। সুবিনয়বাবু বললেন—তা হলে, একটা কথা শুনে যাও মা, ভূতনাথবাবুকে আমি তা হলে রবিবার দিন আসতে বলি? কী বলো?
জবা মুখ নিচু করে বললে—সে তোমার অভিরুচি বাবা।
-না না, সে কি, তোমার বিয়ে, উৎসবটা তোমাকে কেন্দ্র করে, যাদের যাদের তুমি নিমন্ত্রণ করবে, তাদেরই আমি ডাকবো-আর ভূতনাথবাবু তো আমাদের ঘরের লোক—ব্রজরাখালবাবুর নিজের বিশেষ আত্মীয়।
-আমি ভূতনাথবাবুর রান্নার ব্যবস্থা করি গে বাবা—বলে দ্রুতপায়ে জবা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল এক নিমেষে।
ভূতনাথ এবার হাতের কাগজপত্র সুবিনয়বাবুর সামনে এগিয়ে ধরলে। যেখানে সই করবার, সেখানে সই করলেন তিনি। তারপর বললেন-বোসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে ভূতনাথবাবু।
ভূতনাথ বসলো।
সুবিনয়বাবু বললেন—জবার বিয়ের কথা বলছিলাম, তা আসছে রবিবার দিন একটা ছোটোখাটো উৎসবের দিন স্থির করেছি। পরস্পর কথাবার্তা হবে। পাকাপাকি কথা সেই দিনই হয়ে যাবে। ভেবে দেখলাম আমার আর ক’দিন—আর উনিও–
পাশে-বসা জবার মা’কে নির্দেশ করে বলতে লাগলেন–আর উনিও না-থাকারই মতো। ওদিকে জবারও বিবাহের উপযোগী বয়েস, ভালো পাত্রও পেয়েছি, ছেলেটি মেধাবী, এম-এ পাশ করেছে। এবার আইন পড়ছে—বাপ বেঁচে নেই—তা হোক, এ সব সম্পত্তির ভার তো একদিন জবাকেই নিতে হবে। আমাদের পৈত্রিক কারবার
-বাবা ছিলেন গোঁড়া কালীভক্ত হিন্দু। আমি ধর্ম বদলেছি বটে, কিন্তু বংশের ধারা কোথায় যাবে—নিজের ছেলে নেই, তা না থাক, জামাইকেই ছেলের মতন করে নিতে হবে। তারপর খাওয়াপরার জন্যে চিন্তা করতে হবে না–আমি যা রেখে গেলাম…কী বলো, অন্যায় কিছু বলছি।
খানিকক্ষণ চুপচাপ। ভূতনাথ বললে—আমি আসি এবার।
—না রোসস একটু, তোমাকে সেই গল্পটা বলা হয়নি। প্রথম যেদিন দীক্ষা নিলুম—সে কী কাণ্ড ভূতনাথবাবু—শুনুন তবে
ভূতনাথ বললে—সে-গল্প আপনি আমাকে বলেছেন।
-বলেছি নাকি? তা বলেছি বটে, কিন্তু কেবল মনে হয় বুঝি বলা হলো না কাউকে। কেউ কি মনে রাখবে সে-কথা ভূতনাথবাবু? আমার সময় তো ঘনিয়ে এল-শ্রীমদ্ভাগবতে পড়েছি রন্তিদেবের গল্প, সমস্ত দিন ধরে সব দান করে যখন নিজের খাবার জলটুকুও এক ভিক্ষার্থী চণ্ডালকে দিয়ে দিলেন, তখন নিজের মনে যা বললেন— ভাগবতকার বলছেন তা অমৃত—ইদমাহামৃতং বচঃ—কী বললেন? না, বললেন—আমি ভগবানের কাছে পরম গতি চাই না, অষ্ট সিদ্ধিও চাই না-পুনর্জন্মও চাই না—আমি চাই আমি যেন সমস্ত জীবের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের দুঃখকে পাই, যাতে তাদের দুঃখ না থাকে—আর এক জায়গায় ভাগবতকার বলছেন–
“ন ত্বহং কাময়ে রাজ্যং ন স্বর্গং ন চ পুনর্ভবম
কাময়ে দুঃখপ্তানাং প্রাণিনামার্তিনাশনং”—
—আহা, বাবাকে দেখেছি বাড়ির বিগ্রহের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করছেন “ত্বমেকং জগকারণং বিশ্বরূপং”। বাবা ছিলেন আমার বড়ই গরীব–যজন-যাজন নিয়েই থাকতেন। মনে আছে আমি ছোটবেলায় হুঁকো কল্কে নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতুম, দিনের মধ্যে অন্তত দশ-বারোটা কল্কে ভাঙতুম। মনে আছে বাবা সেই উঠোনের ধারে বসে বসে.. তোমার শুনতে ভালো লাগছে তো ভূতনাথবাবু? খারাপ লাগলে বলবে।
বহুবার শোনা গল্প। অনেকবার বলেছেন। তবু ভূতনাথ বললে—না খুব ভালো লাগছে, আপনি বলুন।
সুবিনয়বাবু দাড়িতে হাত বুলাতে বুলোতে আবার আরম্ভ করলেন—তখন এক পয়সায় আটটা কল্কে—সে পয়সাও খরচ করবার মতো সামর্থ্য ছিল না তার—কোথায় গেল সে-সব লোক। সেই অবস্থার মধ্যেই একদিন ঈশ্বরের কৃপা পেলেন বাবা, ধ্যানে পেলেন ‘মোহিনী-সিঁদুরের মন্ত্র–তাই থেকে চালা ভেঙে পাকা দালান উঠলো, দোতলা কোঠা হলো, মা’র গায়ে গয়না উঠলো। আর আমি এলাম কলকাতায় পড়তে, সেই পড়াই আমার কাল হলো ভূতনাথবাবু, আমি চিরদিনের মতো বাবাকে হারালুম। গল্প। বলতে বলতে চোখ ছল ছল করে ওঠে সুবিনয়বাবুর।
-জানো ভূতনাথবাবু যেবার সেই ডায়মণ্ডহারবারে ঝড় হয়, সেই সময় আমার জন্ম, সে এক ভীষণ ঝড়, বোধহয় ১৮৩৩ সাল সেটা, কলকাতায় সেই প্রথম ওলাউঠো হলো, জন্মেছি ঝড়ের লগ্নে, সারাজীবনটা কেবল ঝড়ের মতনই বয়ে গেল, বাবাকে যা কষ্ট দিয়েছি, বাবা প্রতিজ্ঞা করলেন আমার মুখদর্শন করবেন না—সত্যিই আর করলেনও না। আমি একমাত্র সন্তান, আমার অসুখের সময় বাবা কবিরাজ ডেকে আনলেন, কিন্তু ঘরে ঢুকলেন না, পাছে আমার মুখদর্শন করতে হয়। সেই বাবা আমার প্রেতলোকে এক গণ্ডুষ জলও পেলেন না তাঁর একমাত্র বংশধরের হাতে। তাই সেই পাপেই বোধহয় আমি আজ নির্বংশ—বলে খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ভূতনাথের দিকে।
–কিন্তু কী করবো বলো ভূতনাথবাবু মন বলে অন্য কথা। হৃদয়ের কথা মন শোনে না। বলে–ভুল, ভুল-সব তোমার ভুল ধারণা। তথাগত প্রচার করলেন–জন্মেই বন্ধন, জন্মরহিত হতে পারলেই মুক্তি। তাই তো ভাবি—দ্বৈতের জগতে স্বর্গরাজ্য আসতে পারে না, নিত্য বৃন্দাবনের পরমানন্দ ব্রহ্মের রসোল্লাস যেখানে একত্বের মধ্যে সকল বহুত্বের চির-অবসান তা-ই কাম্য হওয়া উচিত—আমার জীবনের শেষ-দিনটা পর্যন্ত এর মীমাংসা বুঝি আর করতে পারবো না—মন বলে–ঠিক করেছে, হৃদয় বলে-না। অথচ দেখো ভূতনাথবাবু ‘মোহিনী-সিঁদুরের ব্যবসাও ত্যাগ করতে পারলাম না-ও ভড়ংটাও রাখতে বাধ্য হয়েছি।
সে কি! ভূতনাথ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলে। সব তবে ভড়ং। কিছু তবে সত্যি নেই এর পেছনে। খানিকটা দৈবশক্তি বা মন্ত্রশক্তি! ভূতনাথের মনে হলো কিছুটা দৈবশক্তি আছে জানতে পারলে যেন সে তৃপ্তি পায়। অন্তত একবারের জন্যেও সে বৌঠানের কাছে গিয়ে তা হলে এর গুণের কথা বলতে পারে।
সকাল থেকে যে-প্রশ্নটা বারবার মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিলো, এই সুযোগে ভূতনাথ সেই প্রশ্নটাই করলে। বললে—আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, ‘মোহিনী-সিঁদুরে’ কিছু কাজ হয়?
কিন্তু প্রশ্নটা করবার আগেই বাধা পড়লো। হঠাৎ পাশ থেকে বই পড়তে পড়তে জবার মা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন।
সুবিনয়বাবু সচকিত হয়ে উঠেছেন। কি হলো রাণু—কী হলো রাণু?
সুবিনয়বাবু যেন ভুলে গিয়েছেন ভূতনাথ এখানে বসে আছে। সুবিনয়বাবু হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে স্ত্রীর মাথাটা দুই হাতে ধরলেন। জবার মা’র হাত থেকে বইটা পড়ে গেল। আঁচলটা খসে গেল বুক থেকে। ছোট মেয়ের মতো হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
—কী হলো রাণু, কী হলো? বৃদ্ধ অথর্ব শরীর নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়লেন। উঠে স্ত্রীর মাথাটি ধরে রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিতে লাগলেন।
—কী হলো রাণু, বলল আমাকে? বলো—
কাঁদতে কাঁদতে জবার মা বললেন—আমার খিদে পেয়েছে।
—খিদে পেয়েছে, বেশ তো, কান্না কেন, খাও, খাবার আনছি আমি।
—কিন্তু এই মাত্র খেলাম যে—আরো প্রবল বেগে কাঁদতে লাগলেন জবার মা।
—তাতে কী হয়েছে রাণু, আবার খাও।
ভূতনাথ এই পরিস্থিতিতে কেমন বিব্রত বোধ করতে লাগলো। বললে—আমি এখন আসি তাহলে।
সুবিনয়বাবু মুখ ফেরালেন। তুমি যাবে?…তা হঠাৎ এই রকম হয় জবার মা’র, এই-ই অসুখ কি না, কিছুতেই সারলো না আর, আমার খোকার মৃত্যুর পর থেকেই এই রকম হচ্ছে। তোমারও খেতে দেরি হয়ে গেল ভূতনাথবাবু-তুমি যেন রাগ করো না জবার ওপর।
আর বাক্য ব্যয় না করে সোজা নিজের চেয়ারে এসে বসলো ভূতনাথ।
খানিক পরেই রতন খেতে ডাকতে এল।
খাবার সময় প্রথমে বিশেষ কথা হলো না। সারাক্ষণ জবা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
একবার জবা বললে—ভাত নষ্ট করবেন না। ওগুলো সব খেতে হবে কিন্তু আপনাকে।
ভূতনাথ মুখ তুলে চাইলো। বললেপাড়াগাঁয়ের ছেলেরা ভাত একটু বেশিই খায়—কিন্তু তা বলে এত বেশি? চাল একটু কম নিতে বললেই পারতে।
—শেষে পেট না ভরলে, তখন?
জবার মুখ যেন গম্ভীর-গম্ভীর। বেশি কথার আবহাওয়া নেই তার। আবার অনেকক্ষণ চুপ চাপ। এ যেন কেমন বি ব্যাপার। এখানেই রোজ খেতে হবে—অথচ নিজের হাতে সব রান্নার ব্যবস্থা। যতদিন ঠাকুর না আসে, ততদিন! এ-ছাড়া গতিও নেই।
খানিক পরে ভূতনাথ আবার কথা কইলো। বললে–তোমার বাবা রবিবার দিন আমাকে আসতে বললেন, কিন্তু সন্ধ্যেয় না সকালে—কিছু বললেন না তো?
-সেটা বাবাকেই জিজ্ঞেস করবেন।
—কিন্তু তোমারই যখন বিয়ে, তখন তুমিও তো কিছু জানোনা আর হাতের কাছে তুমি থাকতে আবার…
-বিয়েটা আমার বলেই তো, আমার মুখে ও-কথা শোভা পায় না।
—বিয়ে জিনিষটা কি লজ্জার? সময় হলে একদিন সবারই বিয়ে হবে।
–হবে নাকি? আমার কিন্তু সন্দেহ আছে।
ভূতনাথ বললে—পাড়াগাঁয়ের ছেলে, ভাত বেশি খাই বলে কথাও বেশি বলতে পারবে এমন কথা নেই, কিন্তু এটা জানি যে সব মেয়েই আর তোমার মতো নয় জবা।
-ক’টা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় আছে আপনার?
ভূতনাথের মনে হলো—সকলের নাম করে দেয় সে। হরিদাসী, রাধা, আন্না, তাদের ব্যবহারও তো সে দেখেছে। আর কাল রাত্রের বৌঠান। বৌঠানের কথা মনে হতেই যেন সমস্ত মন প্রশান্ত হয়ে এল তার। এক মুহূর্তে যেন এই আপিস-বাড়ি ছেড়ে সে সোজা বড়বাড়ির তেতলায় শেষ ঘরখানায় গিয়ে পৌঁছেছে। হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ভূতনাথ এক নিমেষে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে। বসলো—আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমাকে, তোমাদের ‘মোহিনী-সিঁদুরে’ কাজ হয়?
জবা যেন প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললে—এটাও কি বাবাকে জিজ্ঞেস করলে ভালো হয় না?
মানছি ভালো হয়, কিন্তু তোমাকেই না হয় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কিছু জানো?
—পাঁজির বিজ্ঞাপনে তো সব লেখা আছে।
-সে তো সবাই জানে, তুমিও জানো আমিও জানি—আরো হাজার হাজার লোক জানে।
—আমিও তার বেশি কিছু জানি না, আমার নিজের কখনও ও সিঁদুর ব্যবহার করবার দরকার হয়নি-জবা হাসলো এবার। তারপর হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করলো—আপনার বুঝি দরকার হয়েছে?
ভূতনাথ খাওয়া থামিয়ে বললে–হ্যাঁ।
জবা শাড়ির আঁচলটা নিজের শরীরে বিন্যস্ত করে বললেপ্রয়োগটা কি আমার ওপরে করবেন নাকি? তা হলে কিন্তু ঠকবেন বলে রাখছি!
ভূতনাথ বললে-ঠাট্টা নয়, আমার বিশেষ দরকার, আজকেই জানা দরকার—তা হলে আজই কিনে নিয়ে যাই এক কৌটো। আমায় পাঁচটা টাকা দিয়েছেন কিনতে।
-কে?
—সে আমার এক বৌঠান।
–কী হলো আবার তার?
—সে কি তুমি বুঝবে? বৌঠান বলে–বিয়ে হবার আগে ওসব মেয়েরা বুঝবে না, তা ছাড়া বলতেও বারণ আছে। মেয়েমানুষের অতবড় লজ্জা, অতবড় অপমান নাকি আর নেই।
—বৌঠানটি আপনার কে শুনি?
–বলেছি তো বলতে বারণ আছে।
জবা বললে—ডাক্তারের কাছে লজ্জা করা বিপজ্জনক, রোগ সারাতে গেলে সমস্ত প্রকাশ করে বলতে হবে।
ভূতনাথ কী যেন একবার ভাবলে। তারপর বললে–কিন্তু বৌঠানকে যে আমি কথা দিয়েছি—কথা দিয়েছি, ব্ৰজরাখালকে বলবো না, বৌঠানের চাকর বংশীকেও বলবো না, কাউকেই না, এমনকি, তোমাকেও না।
–আমাকে তিনি চেনেন নাকি?
–আমি বলেছি তোমার কথা। জবা এবার হেসে বসে পড়লো সামনে। বললে—আমার সম্বন্ধে কী বলেছেন শুনি? খুব নিন্দে করেছেন নিশ্চয়।
—নিন্দে তোমার শত্রুতেও করবে না জবা—আর আমি তো তোমার শত্রুও নই—আর তাছাড়া তুমি আমার কে বলে না যে, খামকা তোমার আমি নিন্দে করতে যাবো।
—আপনার সঙ্গে তো আমার মনিব-ভৃত্যের সম্পর্ক, কী বলেন —আর কিছু নয়।
—আমিও তাই-ই বলেছি। কথাটা বলে ভূতনাথ আবার নিচু মুখে খাওয়ায় মনোযোগ দিলে। জবাও খানিক চুপ করে রইল। তারপর বললে—আপনি দেখছি শুধু অকৃতজ্ঞই নন, আপনি মিথ্যেবাদী।
ভূতনাথ খেতে খেতেই জবাব দিলে—আমি তাও বলেছি।
–তার মানে?
ভূতনাথ এ কথার কোনো জবাব দিলে না! যেমন খাচ্ছিলো তেমনি খেতে লাগলো।
—চুপ করে রইলেন যে-জবাব দিন!
ভূতনাথ এবার মুখ তুললে। দেখলে জবার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বললে—আমরা পাড়াগাঁয়ের ছেলে একটু বেশি ভাত খাই, গুছিয়ে বলতে পারিনে বটে কিন্তু মান-অপমান জ্ঞান আমাদেরও আছে।
জবা বললে—শুধু আছে নয়, বেশি মাত্রায়ই আছে, নইলে মেয়েমানুষ বলে অপমান করতে সেদিন আপনার মুখে বাধতো।
ভূতনাথ এক মুহূর্তে বুঝে নিলে আবহাওয়াটা। তারপর বললে—সেদিন আমি অন্যায় করেছিলাম স্বীকার করি—কিন্তু ক্ষমা চাইতে ফিরে আসার পর তুমিই বা কোন্ আমার মর্যাদা রেখে কথা বলেছিলে? তারপর একটু থেমে আবার বললে-তোমাকেও তো দেখছি, আর বৌঠানকেও দেখলাম, অথচ
—অথচ কী বলুন?
ভূতনাথ হাসলো। বললে—না থাক, তুমি রাগ করবে।
-রাগ যদি করিই তো ভাত আপনাকে কম খেতে দেবো না তা বলে।
ভূতনাথ বললে—না, সে কথা হচ্ছে না, তোমাকে রাগালে আমার লোকশানই তো মোল আনা, তা জানি আমি, তোমার বাবা বলছিলেন, এ-সংসারের মালিক তো একদিন তুমিই হবে, তখন? তখন আমার সাত টাকার চাকরিতে টান পড়তে পারে কিম্বা সাত টাকা থেকে সতেরো টাকা হবার আশাতেও জলাঞ্জলি পড়বে হয় তো।
—দেখছি নামে আর চেহারাতেই শুধু ভূতনাথ—কিন্তু কথাগুলোর বেলায় কলকাতার ছোঁয়া লেগেছে এরি মধ্যে।
খাওয়ার পর হাত ধুতে ধুতে ভূতনাথ হাসতে হাসতে বললে—তুমি নিজের মুখে আসতে না বললে রোববার কিন্তু আমি আসবো না জবা।
জবাও হাসলো। বললে—আপনার আশা তো বড় কম নয় ভূতনাথবাবু!
ভূতনাথ জবার মুখের দিকে চেয়ে মনের কথাটা একবার ধরবার চেষ্টা করলো, কিন্তু জবা ততক্ষণে নিজের কাজে স্থানত্যাগ করে চলে গিয়েছে।