সাহিত্যে আগমন আমার
সাহিত্যের নেশা আমার আমার মাথায় ঢোকে স্কুল জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ১৯৬৭ – ৬৮ সালে।
কলেজে পড়ার সময়ই আমি ‘জোনাকি’ নামে একটা মাসিক পত্রিকা বের করি। নামটা সুশীল রায়ের দেওয়া। কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়ে বন্ধু মহলে আলোড়ণ তোলে। কিছুদিন রম-রমিয়ে জ্বলে জোনকি। তারপর স্বাভাবিক নিয়মেই একদিন আলো নিভে যায়।
জোনকির আলো নিভলেও, আমার ভিতরের আলো তখন জাজ্বল্যমান।
তার অল্পদিন পরেই, গল্পকার শ্যামল মজুমদার আর আমি মিলে বের করি – সোনালী বয়স – নামে আর একটি পত্রিকা, সেখানে লিখেছিলেন, বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চ্যাটার্জী, তারাপদ রায়, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখেরা।
সে সময় প্রচুর বই পড়তাম আমি। খুব আনন্দ পেতাম এক একটা বই পড়া শেষ করে। সে আনন্দ উপলব্ধির প্রকাশ আমার পেত,আমার দৈনন্দিন আচরণে। অস্থিরভাবে অকারণে ঘোরাঘুরি করতাম এখানে সেখানে।
শরৎচন্দ্র আর বিভূতিভূষণ পড়ে মানসিক ভাবে ভবঘুরে হয়ে পড়েছিলাম।
সেই সময় আর একটি বই পড়ে ভীষণ আলোড়িত হয়েছিলাম, তা হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। তাঁর লেখা ‘সার্বজনীন’ বইটি পড়ে ভেবেছিলাম, এভাবেও উদ্বাস্তু জীবন সমস্যা নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়? বইটি আমাকে ভীষণ স্পর্শ করে ছিল।
সে সময় তারাশংকরের লেখা গল্প অগ্রদানী, বেদেনী, ডাকহরকরা, রসকলি, কালিন্দি, হারানো সুর, জলসা ঘর, বিপাসা, সপ্তপদী, নিশিপদ্ম পড়েছি।
উপন্যাস – গণ দেবতা, হাঁসুলী বাকের উপকথা, আরোগ্য নিকেতন পড়ে অভিভূত হয়েছি, মুগ্ধতায়। বিমূঢ় বিস্ময়ে ভেবেছি, লেখকরা কি অপরূপ ভাবে চরিত্র চিত্রায়ন করেন।
কি না পড়েছি তখন?
রামমোহন, মাইকেল, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্র ও শরৎ রচনাবলী ছাড়া –
মায়াকোভক্সি, হো চি মিন, গোর্কি, লূ সুন, চেকভ , মোঁপাসা, ও হেনরী, কামু, জাঁ পল সাত্রে, কাফকা, ভাস্কো পোপা, গীয়াম আপোলিনিয়ার, তাদেউজ রুদেভিজ, ও ল্যাটিন আমেরিকান কবিদের কবিতা ।
বাংলায় পড়তাম জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, অশোকবিজয় রাহা, অরবিন্দগুহ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, কৃষ্ণ ধর, সিদ্ধেশ্বর সেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত , আলোক সরকার, শান্তি ঘোষ, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, শান্তি লাহিড়ি, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, মনিভূষণ ভট্টাচার্য, তুলসী মুখোপাধ্যায়, তুষার রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, রত্নেশ্বর হাজরা, মৃণাল বসু চৌধুরী , মানিক চক্রবর্তী দেবাশিস বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ।
এসব পড়তে পড়তে একদিন মনে হল, নিজেদের অভিজ্ঞতা, অনু্ভূতি মনের কথা জানানোর জন্য একটি নিজেদের পত্রিকা প্রয়োজন। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ।
আমি আর এক সহপাঠি মিলে বের করলাম – মেঘদূত – পত্রিকা।
কয়েকটি সংখ্যা বের হবার পর, তা মুখ থুবড়ে পড়ল অর্থাভাবে। কিন্তু আমার সাহিত্যের নেশা আমার কাটলো না তা’তে। দিন দিন বেড়েই চলল।
সিটি কলেজে (সাউথ) কলেজে পড়ার সময়, সুনীল গাঙ্গুলীর বাড়িতে (ঢাকুরিয়া ব্রীজের নীচে তখন ভাড়া থাকতেন) যেতাম মাঝে-সাঝে।
সুনীল দা, কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন (তখন তার প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে দেশ শারদীয়া সংখ্যায় ) উপন্যাস লিখতে হলে দিনে অন্ততঃ কুড়ি পাতা লেখার এলেম তোমায় ধরে রাখতেই হবে।
সুনীল দা একথা মনে প্রাণে বিশ্বাম করতেন বলেই তাঁর বিপুল সাহিত্য সম্ভার আমরা উপহার পেয়েছি।
এই প্রসঙ্গে মনীষ ঘটক ( মহাশ্বেতা দেবীর পিতা) বলেছেন, -” আমার শেষ প্রার্থনা এই যে, যাঁর লিখবার কিছু ক্ষমতা আছে তিনি অন্ততঃ দিনে তিন ঘন্টা আপন মনে লিখে যাবেন, রাতারাতি বড় লোক হবার আশা ত্যাগ করে। “।
প্রথমে কুড়ি বছর বয়সে, ‘মেঘদূত’, তারপর বাইশ বছরে ‘জোনাকি’, পরে ‘সোনালী বয়স’ পত্রিকা বের করি চব্বিশ বছর বয়সে।
তারপর যুক্ত হই ‘আবর্ত’ পত্রিকার সঙ্গে পঁচিশ বছর বয়সে। তারপর বের করি ‘বেদব্যাস’ পত্রিকা ছাব্বিশ বছর বয়সে।
এইভাবে নানা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সে সময়। এ ছাড়া সহযোগী সম্পাদক হিসাবে যুক্ত ছিলাম – ‘অশনি’, ‘দেয়া’, ‘প্রতিশব্দ’, ‘বুলেটিন’, ‘ঋক’, ‘ইন্দানী’ প্রভৃতি সব পত্র পত্রিকার সঙ্গে।
সে সময় অনেকগুলো পত্র পত্রিকার নামকরণও করেছিলাম আমি। যেমন – ‘মেঘদূত’, ‘সোনালী বয়স’, ‘বেদব্যাস’, ‘প্রতিশব্দ’ ও ‘বুলেটিন’ (শৌভিক চক্রবর্তীর), ‘আবর্ত’ (দীপাঞ্জন দ্ত্তর পত্রিকা, আগে বের হতো ‘সোনার তরী’ নামে) , ‘সাহিত্য চিন্তা’ ( রবীন্দ্রপুরুস্কার প্রাপ্ত কবি কিরণশংকর সেনগুপ্তর, আগে বের হতো ‘উত্তরণ’ নামে) , ‘ঋক’ (ব্রজ চট্টোপাধ্যায়ের), ‘ব্যতিরেক’ ( কেদার ভাদুড়ীর, আগে বের হতো ‘সময়ানুগ’ নামে দেবকুমার বসুর সঙ্গে, একসঙ্গে বের করতেন। পরে কেদার ভাদুড়ী একাই বের করতেন ‘ব্যতিরেক’ আমার নামকরণে।
এর ফলে সে সময় সাম্প্রতিক কালের বহু লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেই সব লেখা পড়ে ঋদ্ধ হয়েছি। সেই সব পত্র পত্রিকায় লিখতেন – পেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুশীল রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়,শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপধ্যায় প্রমুখ।
উনিশ’শো সত্তর শুরু থেকেই দেখে এসেছি, দেশপ্রিয় পার্কের সুতৃপ্তি রেস্টুরেন্টে রবিবার সকাল নটা-দশটা থেকে শিল্পী সাহিত্যিকদের চাঁদের হাট বসত। চলত বেলা বারোটা পর্যন্ত। সমকালীন লেখক শিল্পীরা অনেকেই আসতেন।
আসতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বরেন গাঙ্গুলী, শংকর চ্যাটার্জী, দিব্যেন্দু পালিত, পবিত্র মুখোপধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, সমীর রক্ষিত প্রমুখ অনেকেই।
শিল্পিদের মধ্যে আসতেন – শ্যামল দত্তরায়, গনেশ পাইন, সুনীল দাস প্রমুখ।
আমিও নিয়মিত সেই আড্ডার সদস্য হয়ে গেলাম, সেই সব আর্ষণীয় ব্যক্তিত্বদের এক অমোঘ আকর্ষণের ফলে। তখন নিয়মিত সেখানে যেতে না পারলে মনের ভিতর একটা আপসোস বোধ হতো।
সুতৃপ্তি – তে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে অনেকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে তখন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বরেন গাঙ্গুলী, দিব্যেন্ধু পালিত, ফণিভূষণ আচার্য ( পি. আচার্য), রথীন্দ্র ভৌমিক, প্রলয় সেন (মৃত) , নির্মল চট্টোপাধ্যায় ( মৃত) , সত্যেন্দ্র আচার্য়, পুস্কর দাশগুপ্ত ( এখন ফ্রান্সে বসবাস করেন, মেসেঞ্জারে যোগাযোগ আছে এখনও), সর্বপোরি শংকর চট্টোপাধ্যায় (যিনি আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন)।
শংকর চট্টোপাধ্যায় গভীরভাবে পড়াশুনা করতেন। সমকালীন সাহিত্য গুলে খেতেন সরবতের মত।
সমকালীন কার লেখা কেমন? কার লেখার বিশেষ কি বৈশিষ্ট সে’সব আমাদের বুঝিয়ে বলতেন।
মতি নন্দী আর শ্যামল গাঙ্গুলীর লেখার তফাৎ কোথায়? সুনীল গাঙ্গুলী কিংবা শীর্ষেন্দু মুখার্জীর লেখার মধ্যে অমিল কি?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখার ঘরানার সাথে সন্তোষ কুমার ঘোষের লেখার ঘরানার পার্থক্য কি?
তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার ফলে, এ’সব তাঁর কাছে শুনে বুঝতে শিখেছি, দিন দিন তাঁর আলোচনা শুনে কত ঋদ্ধ হয়েছি।
তাঁর অকাল প্রয়াণ, আমাদের অনথ করেছে। তাঁর একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নাম – ‘কেন জন্ম, কেন নির্যাতন’। আজ দুষ্প্রাপ্য সেই বই।
অসাধারণ সব নতুন ভাবনার কবিতা। খুব সম্ভবতঃ ‘এম.সি.সরকার পাবলিশিং হাউজ’ থেকে বেরিয়েছিল।
আর আমাদের তরুণদের মধ্যে ( আমরা তখন তরুন, বয়স ২০ -২৫ এর মধ্যে ) অঞ্জন সেন ( দুই বাংলার কবিতা পত্রিকার সম্পাদনা করত।) , সমরেন্দ্র দাশ (আত্মপ্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক) , অভীক রায়, অজয় সেন ( মৃত) , তপন রায় (মৃত, বিন্দু – মিনি পত্রিকার সম্পাদক) , তরুণ চৌধুরী, স্বপন মন্ডল শংকর দাশগুপ্ত ( মৃত, সহজিয়া – গল্প পত্রিকার সম্পাদক ) অজয় নাগ এমন আরও কত সব প্রতিষ্ঠিত ও যশোপ্রার্থী তরুণ কবি ও সম্পাদক।
“সুতৃপ্তি” ( দেশপ্রিয় পার্ক) থেকে বেলা বারটায় বেরিয়ে, কখনও পবিত্রদার ( পবিত্র মুখার্জী ) সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাসবিহারীতে “অমৃতায়ণ” রেষ্টুরেন্টে আসতাম। সঙ্গে থাকত সত্যেন্দ্র আচার্য, অশোক দত্ত চৌধুরী, তরুণ চৌধুরী প্রমুখ কিংবা অন্য কেউ।
অমৃতায়ণে এসে দেখা পেতাম- সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, বলরাম বসাক, আশিস ঘোষ প্রমুখদের। পঞ্চাশ দশকের লেখকদের থেকে নিজেদের আলাদা করে চিহ্নিত করণের কাজ। এরা সকলে মিলে তখন গল্পের নতুনধারা সৃষ্টিতে ব্যাকুল। এই নতুন ধারার গল্পকাররা আর পুরাতন গল্পকারদের মতো, কোন গোল গল্প বা কাহিনীতে জোর দেওয়া বাতিল করলেন।
তারা তখন প্রকাশ করতেন – ‘এই দশক’ – নামে একটি পত্রিকা। পরে তাদের – ‘গল্প ‘- নামে আর একটি পত্রিকা বের করেন। এখানে তাদের ভাব ধারার উপর লেখা গল্পই প্রকাশিত হত, অন্য রকম কোন গল্প প্রকাশিত হতো না।
তারা মনে করতেন, গল্পকার কারও দাসত্ব করবে না। না দর্শন, না ধর্ম, না রাজনীতি। গল্প হয়ে উঠবে নিজেই একটা মেরুদন্ডবান গল্প, নিজস্ব দৃষ্টি ভঙ্গীর জোরে, প্রকাশ ভঙ্গীর জোরে। গল্প হবে এক বিশেষ শিল্প-রীতি। শিল্প সম্মত নিজস্ব রূপ ফুঠে উঠবে তার অবয়বে, গল্প প্রকাশে, লেখকের লেখার নিজস্ব মুনশিয়ানায়।
এই আন্দোলনের ফলে, আমরা অনেক নতুন কয়েকজন ভাল গল্পকার পেয়েছি। যেমন, রমানথ রায়, আশিস ঘোষ, কল্যান সেন, সুব্রত সেনগুপ্ত, বলরাম বসাক, অতীন্দ্রিয় পাঠক, অমল চন্দ প্রমুখ।
গল্পের মতো কবিতায়ও এ ধারার প্রসারণ ঘটিয়ে ছিলেন, ( শ্রুতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে) মৃণাল বসু চৌধুরী, সজল বন্দোপাধ্যায়, পুষ্কর দাশগুপ্ত, পরেশ মন্ডল, অশোক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখেরা।
এরা কবিতাকে ভার মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এরা কবিতাকে সব রকম শৃঙ্খলের, সব রকম দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি দেবার চেষ্টা করে ছিলেন।
সে সময় পড়েছি, নবারুণ ভট্টাচার্যের (মহাশ্বেতা দেবীর ছেলে) ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কাব্যগ্রন্থটি। তাছাড়া মণিভূষণ ভট্টাচার্য্য, তুলসী মুখোপাধ্যায়, সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এদের কবিতা পেলেই পড়ে ফেলতাম। আর পড়তাম তুষার রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (বরেন্য চিত্র পরিচালক) , শামসের আনোয়ার, দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়, মানিক চক্রবর্তী, যোগব্রত চক্রবর্তী, পবিত্র মুখোপাধ্যায় , রাণা চট্টোপাধ্যায়,সজল বন্দোপাধ্যায়, রত্নেশ্বর হাজরা, ভাস্কর চক্রবর্তী, কালীকৃষ্ণ গুহ, মৃণাল বসু চৌধুরী, পরেশ মন্ডল প্রমুখদের সদ্য প্রকাশিত কবিত। এরা সকলেই ষাট দশকের কবি। এদের মধ্যে অনেকেই আজ আর ইহলোকে নেই।
পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় , সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, শান্তি লাহিড়ী, উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার, অরবিন্দ গুহ, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, শরৎ মুখার্জী, কবিতা সিংহ, বিজয়া মুখার্জী, সমীর রায় চৌধুরী, অরুণ কুমার সরকার( চল্রিশ দশকের কবি), আলোক সরকার, শান্তি ঘোষ, তারাপদ রায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, পূর্ণেন্দু পত্রী, বাসুদেব দেব, মানস রায়চৌধুরী, সামসুল হক, মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, জীবতোষ দাস প্রমুখদের কবিতা হাতে পেলেই পড়ে ফেলতাম। কার লেখা পড়িনি সে সময়? পড়েছি অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, রবীন সুর, দেবী রায়, শম্ভু রক্ষিত, শিবশম্ভু পাল, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনীন্দ্র গুপ্ত, দেবারতী মিত্র, কেতকী কুশারী ডাইসন, শংকর চ্যাটার্জী, ফণিভূষণ আচার্য, লোকনাথ ভট্টাচার্য্য প্রমুখদের কবিতা ছিল প্রায় নিত্য পাঠ্য বিষয়।
কত না পড়েছি তখন, আজ সে সব কথা ভাবলে নিজেই বিস্মিত হই। ভাবি কি করে পড়েছি বোধহয় এতসব।
এই প্রসঙ্গে তরুণ যশঃপ্রার্থী কবিদের একটা কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না , ভাল কবিতা লিখতে হলে পূর্বসূরীদের ভাল ভাল কবিতা, নিজের আগ্রহে, সংগ্রহ করে বারবার পড়।
দেখবে তা’তে লেখার ক্ষমতা বাড়বে। তখন দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই তোমার নিজের মনের ভাব কবিতায় রূপান্তরিত হয়ে, সহজেই বেরিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে।
আধুনিক ভাল কবিতা লিখতে গেলে শুধু মাত্র রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন দত্ত, মোহতলাল, আর সুকান্ত পড়লেই হবে না। পড়তে হবে, জীবনানন্দ দাশ ছাড়াও বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন,বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, অশোকবিজয় রাহা, অরুণ মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, হুমায়ুন কবির, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দিনেশ দাস, মণীন্দ্র রায়, সুভাষ মুখার্জী, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কামাক্ষী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অরুণ ভট্টাচার্য্য, কৃষ্ণ ধর,সিদ্ধেশ্বর সেন, তরুণ সান্যাল, যুগান্তর চক্রবর্তী, শংকরানন্দ মুখোপাধ্যায়, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, আনন্দ বাগচী প্রমুখদের কবিতা।
ভাল কবিতা লিখতে হলে, প্রতিদিন কবিতা পাঠের অভ্যাস বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। আমার তো এখনও , কোনদিন একটাও ভাল কবিতা না পড়তে পারলে, মন খারাপ হয়ে যায়।
সাহিত্যের সঙ্গে পঞ্চাশ বছর সহবাসের পর, একটা কথা বুঝেছি, ভাল কবিতা লিখতে গেলে আগে কবিতাকে ভাল বাসতে শিখতে হয়।
পূর্বসুরীদের লেখা মন দিয়ে পড়তে হয়। একান্ত ভাল পাঠক হতে হয়। প্রতিদিন আহার নিদ্রার মত কবিতা পড়াকেও অভ্যাসে পরিণত করতে হয়।
কবিতার রাজ্যে ইদানিং কিছু ভূঁইফোর কবির দেখা মেলে, যারা পূর্বসুরীদের কোন লেখা পড়ার কোন তোয়াক্কা করে না। রবীন্দ্র নজরুল সুকান্তর কবিতা খামচা খামচা খানিকটা গিলে, কাব্য বিশারদ হয়ে উঠে, কবিতা লিখতে শুরু করে।
তা করুক, আপত্তি করার কিছু নেই। বাস্তবে দেখা যায়, অচিরেই কিছু দিনের মধ্যে লেখার দম ফুরিয়ে আসে। অন্যের লেখা চুরি করে একটু অদল বদল করে নিজের নামে ছাপে, তবু তাদের কবি খ্যাতি চাই। হয়তো তারা ভাবে কবি যেন একটা তকমা, যা গায়ে জড়ালেই সমাজে তার মান বাড়বে।
একদিন কিরণ দা (রবীন্দ্র পুরুস্কার প্রাপ্ত কবি, কিরণশংকর সেনগুপ্ত) তার সম্পাদিত ” সাহিত্য চিন্তা ” পত্রিকা দিতে, আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলেল কবি বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি। সেই প্রথম বুদ্ধদে্ব বসুর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। আগে দূর থেকে দেখতাম তাকে। কাছে গিয়ে পরিচয় করার সাহস হয়নি।
সেই শুরু হল তার কাছে যাতায়াত। কত সময় গিয়ে, অযথা তার কত সময় নষ্ট করেছি, আজ বুঝি। তখন বুঝিনি। কারণ, তিনি তা বুঝতে দেননি। সেখানেই পরিচয় হয় তার স্ত্রী প্রতিভা বসুর (গল্পকার, উপন্যাসিক), মেয়ে মীনাক্ষি দত্ত (জ্যোতির্ময় দত্তর স্ত্রী) , ছেলে শুদ্ধশীল বসু ( দেশ পত্রিকার শিল্প সমালোচক ছিলেন) সকলের সঙ্গে। এক সময় তো তাদের বাড়ির লোক হয়ে পড়েছিলাম। কয়েক দিন না গেলে, খোঁজ খবর নিতেন আমার অন্য কোন লোক মারফৎ।
হুট করে সময় নেই অসময় নেই, চলে যেতাম তাদের বাড়ি। মীনাক্ষি দত্ত সে সময় ” বন জ্যোৎস্না” নামে একটি সিনেমার নায়িকা হয়ে ছিলেন। হুট হাট করে তাদের বাড়ি চলে যেতাম বলে, তাদের কাউকে কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি। আমার ছিল অবাড়িত দ্বার। (অবশ্য সকলের জন্য তা ছিল না।) ফলে তখন বুঝিনি, তাদের কত সময় অযথা নষ্ট করছি। আজ বুঝে, মনে মনে অনুতাপ অনুভব করি।
বুদ্ধদেব বসুর বাড়ির উল্টো দিকেই ভাড়া থাকতেন, দীপক মজুমদার ( সুনীল গাঙ্গুলীর সাথে ‘কৃত্তিবাস’-য়ের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন)। তাঁর বড়িতে চলে যেতাম। আড্ডা হতো গান, কবিতা, নাটক নিয়ে। আসতেন, গৌতম চ্যাটার্জী (‘মহীনের ঘোড়াগুলি’- প্রথম গানের ব্যান্ড), পবন দাস বাউল, অমিত গুপ্ত, দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও অনেকে। দীপকদা তখন তাঁর স্ত্রী ‘ক্যারল’-কে নিয়ে সেখানে থাকতেন। পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়। দীপকদা তারপর গৌতম চ্যাটার্জীর ভাগ্নিকে বিয়ে করেন।