দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক ওয়ার্ক-আউট
দাদা, একে চিনিস?
অলক দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক ওয়ার্ক-আউটের পর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সটান শুয়ে পড়েছিল। চোখ জুড়ে আসছিল অবসাদে। ঝুমুরের ডাকে চোখ তুলল। ঝুমুরের সঙ্গে একটি মেয়ে।
তো! ও তোর সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
অলক ভাল করে তাকিয়ে বুঝল, বাজে কথা। মেয়েটির চোখে বিস্ময় বা কৌতূহল নেই। আছে একটু অনিশ্চয়তা, দ্বিধা, সংকোচ। তবে মেয়েটি সুন্দরী। বোধহয় নাচে। বেশ ছমছমে শরীর। হান্ড্রেড পারসেন্ট ফিট।
ও। বসুন।
মেয়েটি বসল না। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
ঝুমুর বলল, ওর নাম সুছন্দা। দারুণ নাচে।
অলক মেয়েটিকে দেখছিল। দেখার জন্য নয়, বোঝবার জন্য। কিছু কিছু মেয়ে নিশ্চয়ই আছে যারা অলকের সঙ্গে আলাপ করতে চায়, ভাব করতে চায়, প্রেম-ভালবাসা গোছের কিছু করতে চায়। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখে মনে হয়, এ তাদের দলে নয়। একে ধরে আনা হয়েছে।
অলক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, আমি ভীষণ টায়ার্ড। প্লিজ সুছন্দা, কিছু মনে করবেন না।
সুছন্দা কিছু মনে করল কি না কে জানে, তবে ঝুমুর ভীষণ অপমান বোধ করে বলে উঠল, ও কী রে দাদা! একটু আলাপ কর। তোকে দেখতেই এল!
অলক মুখ তুলে সুছন্দার দিকে মৃদু হেসে বলল, আপনার সঙ্গে আমার আলাপ জমবে না। একটু পরেই কথা ফুরিয়ে যাবে। আলাপ করতে একটা টিউনিং দরকার। আমার সঙ্গে আপনার সেই টিউনিং হবে না।
মেয়েটা লাল হল, কাঁদো কাঁদো হল, তারপর একটিও কথা না বলে চলে গেল।
কী করলি দাদা! ছিঃ!–ধমক দিল ঝুমুর।
অলক কথা খুব কম বলে কিন্তু সুছন্দাকে অত কথা একসঙ্গে বলে সে নিজেই অবাক হয়েছিল। এত কথা তো তার আসে না কখনও। বরং মেয়েটিই একটি কথাও বলেনি।
সুছন্দাকে ভুলে যেতে অলকের বেশি দিন লাগেনি। সারা বছর তার হাজারটা কমপিটিশন, ট্রায়াল, মিট, কোচিং। হাজারটা মুখের সঙ্গে রোজ মুখোমুখি হতে হয়। কত মনে রাখা যায়?
কয়েক মাস আগে লেক-এ একটা ওয়াটার ব্যালের রিহার্সাল চলছিল। অলক জলের ধারে বসে একটা কোল্ড ড্রিংকস খাচ্ছে আর আলগা চোখে রিহার্সাল দেখছে। এমন সময় ব্যালের গ্রুপ থেকে একটা মেয়ে দল ভেঙে উঠে এসে হেড গিয়ারটা খুলে অলকের দিকে চেয়ে বলল, চিনতে পারছেন?
অলক অবাক হল না। একটু হাসল। বলল, আপনি না নাচতেন?
এখনও নাচি। মনীষাদির কাছে। এ বছর ওয়াটার ব্যালেতেও নেমেছি।
বাঃ বেশ!
বলে অলক আবার কোল্ড ড্রিংকসটা মুখে তুলল।
মেয়েটা তার ভেজা কস্টিউম নিয়েই একটা ফাঁকা চেয়ারে মুখোমুখি বসে বলল, আপনি অত ঠোঁটকাটা কেন?
আমি!–বলে অলক খুব ভাবতে লাগল।
মেয়েটি হাসল। বলল, অবশ্য কথাগুলো খুব সত্যি। পরে ভেবে দেখেছি, টিউনিং না থাকলে কথা আসে না।
অলক সংক্ষেপে বলল, হুঁ।
এইভাবে সুছন্দার সঙ্গে আলাপ। আবার আলাপও ঠিক নয়। কারণ অলককে সাঁতার উপলক্ষে দু’দিন বাদেই চলে যেতে হল বোম্বাই। ফিরে এসে পনেরো দিনের মাথায় হুবহু একভাবে দেখা হয়ে গেল।
কোথায় গিয়েছিলেন বলুন তো? অনেক দিন দেখিনি আপনাকে।
বোম্বাই।
সাঁতার দিতে?
ওই আর কী।
সুছন্দা হাসল, আপনার সঙ্গে সত্যিই আমার টিউনিং হচ্ছে না।
জবাবে শুধুই একটু হাসল অলক।
আর তিনদিন বাদে আমাদের প্রোগ্রাম। আসবেন?
দেখি যদি থাকি কলকাতায়।
অলক থেকেছিল। ওয়াটার ব্যালেটা উতরেও গিয়েছিল ভাল। কিন্তু অত রং আর রোশনাইতে একগাদা মেয়ের ভিড়ে সুছন্দাকে সে চিনতেই পারল না।
পরদিন শোওয়ার সময় ঝুমুর রীতিমতো ঝাঁঝালো গলায় বলল, সুছন্দা খুব তোর কথা বলছিল।
ও।
কোথায় আলাপ হল বল তো!’ লেকে সেই ওয়াটার ব্যালেতে, না?
হুঁ।
কী মেয়ে বাবা!
কথাটা কেন বলল ঝুমুর, তা বুঝল না অলক। তবে প্রশ্নও করল না। ঘুমিয়ে পড়ল।
সত্যকাম একদিন রাত্রে ঘোষণা করল, দারুণ প্রোডিউসার পেয়ে গেছি মনীষা! স্টোরিও এসে গেছে। ফাটিয়ে দেব। আই নিড সাম নিউ ফেসেস। হেলপ করবে?
করব না কেন? কেমন রোল?
হিরোইন।
মনীষা নির্বিকার মুখে বলল, ঝুমুরকে নাও না! মানাবে।
আরে যাঃ। ও হয় না।
তা হলে নুপুর?
তোমার সেই ছাত্রীটি সুছন্দা! ওকে বলে দেখোনা!
মনীষা ঠোঁট ওলটাল। তারপর বলল, সুছন্দাকে খুব পছন্দ দেখছি! কখনও ছেলের বউ করতে চাইছ, কখনও নায়িকা।
শি ফিটস দা রিকোয়ারমেন্টস।
মনীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই দেখছি।
সংসারের সম্পর্কগুলো এমন সব সূক্ষ্ম ভারসাম্যতার ওপর নির্ভর করে যে, একটা মাছি বসলেও পাল্লা কেতরে যায়। সুছন্দার প্রতি সত্যকামের এই পক্ষপাত মনীষার সংসারে একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারত। কিন্তু মনীষা আর সত্যকামের সম্পর্ক অত সূক্ষ্ম জিনিসের ওপর নির্ভরশীল নয়। বিভিন্ন কারণে তাদের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে অনেকটা বোদা, ভোতা এবং ঈষৎ নিরুত্তাপ। সত্যকামের নারীঘটিত অ্যাডভেঞ্চারের কথা মনীষা জানে বা আঁচ করে। আবার মনীষারও কিছু পরপুরুষের ব্যাপার ছিল, যা হাতেনাতে ধরেও সত্যকাম তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সম্ভবত সেগুলো সঞ্চয় করে রেখেছে দরকারমতো কাজে লাগাবে বলে। দুজনের কাছেই দু’জনের গুপ্ত কথা সঞ্চিত থাকায় কেউ কাউকে ঘাটায় না বিশেষ।
সুতরাং সুছন্দার কাছে প্রস্তাবটা গেল এবং সে ও তার আধুনিক মনোভাবাসম্পন্ন সংস্কারমুক্ত মা-বাবা উৎসাহের সঙ্গেই সম্মতি দিল। লোকেশন বাঁকুড়া, কালিম্পং আর হরিদ্বার। তিনমাস শুটিং-এর পর সুছন্দা এতটাই বদলে গেল বা প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে উঠল যে চেনা লোকেরাও আর যেন এই অহংকারী, বাচাল, ছলবলে, পাকা ও ন্যাকা মেয়েটাকে চিনে উঠতে পারে না। সেই সিরিয়াস, লাজুক, রোমান্টিক, স্বল্পভাষী মেয়েটা সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ।
বিষাক্ত চোখে মনীষা কয়েকদিন নাচের ক্লাসে সুছন্দাকে খুঁজল। পেল না। সুছন্দা পাকাপাকিভাবে তার স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। হন্যে হয়ে ঘুরছে ছবির কন্ট্রাক্ট পাওয়ার জন্য। পার্টি দিচ্ছে ঘন ঘন। বোম্বে ঘুরে এল কয়েকবার।
শীতের শেষ রাতে লেক-এর জলে কোনও সাঁতারুই থাকে না। যারা রোয়িং করে তারাও আসে আর-একটু পরে। এই শেষ রাতে আসে শুধু অলক। প্রথম কিছুক্ষণ দুরন্ত দু’হাতে বৈঠা মেরে উন্মত্ত গতিতে রোয়িং করে নেয় সে। তারপর কুয়াশায় আধো-আড়াল চারিদিককার এক মোহময়তা ঘনীভূত হতে থাকে জলে। নীল জলে সেই ভোরবেলাকার আবছায়া, কুয়াশা, চঁাদ বা তারা থেকে চুরি করে-আসা মায়াবী আলোয় তৈরি হতে থাকে প্রিয় বিভ্রম। একসময়ে দীর্ঘ ও সরু, তিরের মতো বেগবান নৌকোটিকে সে থামায়। নিঃশব্দে গ্রিজমাখা শরীরে নেমে যায় জলে।
রোজ নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে এইরকম নির্জনতায়, এমনই বিজনে জল থেকে উঠে আসে জলকন্যা।
সেদিনও অলক দু’হাতে জল কেটে শব্দহীন ঘুরে বেড়াচ্ছিল অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। আকস্মিক পিছনে জলের এক মৃদু আলোড়ন টের পেল সে।
অলক জলের মধ্যে লাটিমের মতো একপাক ঘুরল তিরবেগে।
বৈঠক জবাবর সঙ্গে কের। কিছু
সরু একটা সাদা রোয়িং বোটের মুখ কুয়াশা চিরে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার ওপর জলকন্যা। সাদা, পরির মতো পোশাক, বৈঠায় দুই গোলাপি হাত।
জলকন্যা?
জলকন্যা মানুষীর গলায় ডাকল, অলক!
বিভ্রম ভেঙে গেল অলকের। কিছুক্ষণ খুবই হতাশ হয়ে চেয়ে রইল সে।
অলক! তোমার সঙ্গে যে ভীষণ দরকার। প্লিজ!
অলক জবাব দিল না। তবে ধীর হস্তক্ষেপে সাঁতরে এসে নিজের নৌকায় উঠল। কয়েক লহমায় বৈঠা চালিয়ে নৌকো এনে ভিড়িয়ে দিল ক্লাবের ঘাটে, পিছনের দিকে দৃকপাতও না করে ভিতরে ঢুকে ভেজা পোশাক পালটে যখন বারান্দায় এল, তখন সুছন্দা তার জন্য একটা কঁকা টেবিলে অপেক্ষা করছে। শীতের শেষরাতে তার এই অস্বাভাবিক আবির্ভাব নিয়ে অলক কোনও প্রশ্ন করল বলে কেমন অস্বস্তি বোধ করছিল সুছন্দা।
তবে অলক সুছন্দার দিকে শান্ত, গভীর ও প্রায় অপলক এক জোড়া চোখে চেয়ে রইল।
গত কয়েকমাসে পুরুষের চোখের নানাবিধ চাউনিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সুছন্দা। তবু অলকের ওই নিরুদ্বেগ, ভাষাহীন, প্রশ্নহীন চোখ তাকে লেসার বিমের মতো স্পর্শ করেছিল হয়তো। বারবার সে অস্বস্তিতে মাথা নুইয়ে বা অন্যদিকে চেয়ে এড়াতে চাইছিল সেই চাউনি।
অবশেষে সে বলল, আমি শুনেছিলাম জলের মধ্যে থাকলে নাকি তুমি অন্যরকম হয়ে যাও। আজ দেখলাম সত্যি। মনে হচ্ছিল তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সাঁতরাচ্ছ।
অলক একটু হাসল মাত্র। জবাব দিল না। সে জানে এ কথা বলতে সুছন্দা আসেনি।
সুছন্দা তার কার্ডিগানের দুটো বোম খুলল, ফের একটা লাগাল। তারপর নিজের চুলে একটুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলল, তুমি আজ সকালের গাড়িতে দিল্লি যাচ্ছ শুনে ভোরবেলা এখানে এসে তোমাকে ধরেছি। আমার ভীষণ বিপদ।
অলক তেমনি এক অকপট চাউনিতে চেয়ে আছে।
সুছন্দা মাথা নুইয়ে বলল, আমার ভীষণ খারাপ সময় যাচ্ছে জানো তো! ভীষণ খারাপ। কেউ আমাকে চাইছে না। বোম্বে কলকাতার কোনও প্রোডিউসারই কন্ট্রাক্ট দিচ্ছে না। ঘোরাচ্ছে। অথচ ফিল্ম কেরিয়ার ছাড়া আর কিছু আমি ভাবতেও পারছি না।
অলক শান্ত স্বরে বলল, চা খাবে?
খাব।
অলক চায়ের কথা বলে এসে ফের বসল।
সুছন্দা খুব আকুল গলায় বলল, অলক, প্লিজ আমার একটা উপকার করবে? তোমার বাবা একজন বিগ প্রোডিউসার পেয়ে গেছেন। অনেক টাকার প্রোডাকশন। বিগ বাজেট। আমি খবর পেয়েছি একটা ভাল লোল আছে, এখনও কাস্টিং হয়নি।
অলক তেমনি অকপটে চেয়ে থাকল। চা এল, সে একটা চুমুক দিয়ে ফের মুখ তুলল। আবার চেয়ে রইল।
সুছন্দা মুখ নামিয়ে বলল, জানি তুমি কী ভাবছ। তোমার বাবাই আমাকে সিনেমায় নামিয়েছিলেন। সুতরাং তার কাছে আমি নিজেই অ্যাপ্রোচ করতে পারি। কিন্তু তুমি জানো না যে, আমাদের রিলেশনটা ঠিক আগের মতো নেই।
কেন?
সামথিং হ্যাপেনড়। যদি শুনতে চাও তো বলতে পারি। শুনবে?
যদি বলতে চাও।
হি হ্যাড এ ক্রাশ অন মি। ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। আমি বাধা দেওয়ায় খেপে যান।
কথাটা যে মিথ্যে তা সুছন্দার মুখে-চোখেই লেখা আছে। অলক অনেকদিন আগেই টের পেয়েছিল, তার বাবা সত্যকাম প্রায় বিনা চেষ্টাতেই সুছন্দাকে যেমন পেতে চেয়েছিল তেমনই পেয়ে গেছে। কিছু বাকি নেই।
অলক কথা না বলে চায়ে দুটো-একটা মৃদু চুমুক দিল।
সুছন্দা চোখভরা জল নিয়ে বলল, তুমি বোধহয় বিশ্বাস করলে না!
অলক ফের হাসল।
সুছন্দা খানিকক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, আচ্ছা, স্বীকার করলাম উই হ্যাড অ্যাফেয়ার্স।
অলক খুব ধীরে তার চায়ে আর-একবার চুমুক দিল। যখন মুখ তুলল তখন তার উজ্জ্বল মুখ ধূসরতায় মাখা।
সুছন্দা মাথা নিচু করে বসে রইল। চোখ থেকে টপ টপ করে জল ঝরে পড়ছিল টেবিলে। চায়ের কাঁপেও। সুছন্দা তার রুমালে চোখ মুছল অনেকক্ষণ বাদে। নিজের কপালটা টিপে ধরে বসে রইল খানিকক্ষণ।
তারপর বলল, উনি আমাকে বিয়ে করতেও চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। তারপর নানা খিটিমিটি, আমাদের ঝগড়া হয়ে গেল খুব। তারপর থেকেই রিলেশনটা বিটার। কিন্তু আমি সেটা ভুলে যেতে চাই। আমার অবস্থা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। তুমি যদি ওঁকে একটু বলল। একটা চান্স। আমি প্রাণপণে করব। তুমি বললেই হবে। তোমার বাবার কাছে তুমি দেবদূত।
অলক উঠল। একটিও কথা না বলে, বিদায়-সম্ভাষণ না করে বারান্দা থেকে নেমে গিয়ে তার স্কুটারে উঠল। স্টার্ট দিল। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, বলে দেখব।
মানুষের হীনতার কথা অলক জানে। উচ্চাকাঙক্ষার কথাও। মানুষ নিজেকে কতখানি হোট হয়ে যেতে দেয় তা সে দেখেনি কি? তাই সত্যকাম বা সুছন্দার ওপর তার ঘৃণা এল না। শুধু তার মনে হল কোনও কার্যকারণ সুত্রে সুছন্দা তার মা হয়। ভাগ্য ভাল, সত্যকাম তাকে ভোগ করার আগে বা পরে অলকের সঙ্গে তার কোনও দৈহিক সম্পর্ক হয়নি।
বাপ-ব্যাটায় বড় একটা দেখা হয় না, কথা হয় না। দিল্লি যাওয়ার আগে অলক একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে রেখে গেল সত্যকামের টেবিলে, সুছন্দা কিছু প্রত্যাশা করে। ইন রিটার্ন।
সুছন্দা আবার নামতে পারল সিনেমায়। কিন্তু ঘটনা সেটা নয়। সুছন্দা বা সত্যকাম কেউ জানল না, এই ঘটনার পর অলক কেমন শুকিয়ে গেল ভিতরে ভিতরে। মেয়েদের সঙ্গে দৈহিক মিলনের সব সুযোগ সে ফিরিয়ে দিতে লাগল এরপর থেকে। ভীষণ ভয় হত তার। বড় সংকোচ।
নূপুর যথারীতি বিয়ে করল এক ডাক্তারকেই। ঝুমুর অনেক নাচিয়ে অবশেষে পাকড়াও করল এক মোটর পার্টসের ব্যাবসাদারকে। বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। সত্যকাম আজকাল প্রায় সবসময়েই বাইরে। মনীষা একা। বড্ড একা। এই ভ্যাকুয়াম কীভাবে ভরে তোলা যায় ভাবতে ভাবতে সে গান আর নাচ নিয়ে পড়ে রইল অহর্নিশি। তারপর তার মনে হল নির্জনতার ভূতটা বাড়ি থেকে যাচ্ছে না।
সুতরাং একদিন মনীষা তার ঠান্ডা, মূক ছেলের ওপর চড়াও হয়ে বলল, তুই ভেবেছিসটা কী শুনি?
অলক মায়ের দিকে তেমনি অকপটে চাইল, যেমনটা সে সকলের দিকে চায়।
মনীষা বলল, চাকরি তো ভালই করিস।
অলক একটু হাসল।
কী ঠিক করেছিস? বিয়ে করবি না নাকি? মা বাপের প্রতি কর্তব্য নেই?
অলক জবাব দিল না।
কিছু বলবি তো? হ্যাঁ কিংবা না!
অলকের মুখে সেই অর্থহীন মৃদু হাসি। চোখে একইরকম অকপট, প্রশ্নহীন, ভাষাহীন চাউনি। মনীষার মনে হয়, তার এই ছেলেটা মাঝে মাঝে সত্যিই বোবা হয়ে যায়। শুধু মুখে বোবা নয়, ওর মনটাও বোবা হয়ে যায় তখন। আর এইসব সময়ে নিজের ছেলের দিকে চাইলে মনীষার বুকের মধ্যে একটা ভয়ের বল লাফাতে থাকে। ধপ ধপ ধপ। কেবলই মনে হয়, ও একটা ঘষা কাচের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অস্পষ্ট, আবছা, রহস্যময়।
ছেলের সঙ্গে দূরত্বটাকে সত্যকাম জেনারেশন গ্যাপ বলে মেনেই নিয়েছে। নানা কাজকর্ম এবং ধান্দায়, সর্বোপরি নানা গোপন আনন্দে সে একরকম আলাদা করে নিতে পেরেছে নিজেকে। তার মতে, জীবনধারণ এই একবারই। পরজন্ম নেই, কর্মফল-টল সব বাজে কথা। ভগবান-টান নিয়ে সে কখনও ভাবেনি, তাই মানার প্রশ্নই ওঠে না। আর ওইভাবে নিজের ছেলের সঙ্গেও তার দুরত্বটা হয়েছে নিরেট।
কিন্তু মনীষাব তো তা নয়। সত্যি বটে, নূপুর আর ঝুমুরের সঙ্গে তার যে সখীত্ব ছিল, যে সমঝোতা, তার হাজার ভাগের একভাগও অলকের সঙ্গে নেই। কিন্তু সে কখনও হাল ছাড়ে না। মেয়ে দুটো পরের ঘরে চলে যাওয়ায় ফাঁকা বাড়িতে অলককে সে আজকাল অনেক বেশি লক্ষ করে। যত লক্ষ করে তত ভয় বেড়ে যায়।
সত্যকামের রোজগার বাড়ছে, খ্যাতি বাড়ছে, বাড়ছে চারিত্রিক বদনামও। পঞ্চাশ-ছোঁয়া এই বয়সটাও বড় মারাত্মক। ভাটির টান যখন লাগে তখন মানুষ ভোগসুখের জন্য পাগল হয়ে যায়। জানে তো আর বেশি সময় হাতে নেই, বেশিদিন আর নয় শরীরের ক্ষমতা। ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান হারিয়ে তখন সে কেবল খাই-খাই করে খাবলাতে থাকে চারপাশের ভোগ্যবস্তুকে। সত্যকাম চুলে কলপ দিচ্ছে, রংচঙে জামা গায়ে চড়াচ্ছে, সেন্ট মাখছে গায়ে।
মনীষা বিষ-চক্ষুতে নীরবে দেখে যাচ্ছে সব কিছু। দুজনের মধ্যে অসীম ব্যবধান তৈরি হচ্ছে অলক্ষে।
সত্যকাম লাইফস্টাইল পালটাচ্ছে বলে আজকাল সন্ধের পর বাড়িতে থাকলে একটু ড্রিংকস নিয়ে বসে এবং মনীষাকেও ডেকে নেয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে ড্রিংক করা বেশ একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে।
মনীষার ব্যাপারটা খারাপও লাগে না। সে অল্পই খায়। সত্যকাম নেশা করে।
একদিন এরকম ড্রিংক করার মুখে সত্যকাম বলল, তোমাকে আজকাল খুব ব্রুডিং মুডে দেখি।
মনীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দেখো তা হলে? যাক বাবা, বাঁচা গেল! সা
মথিং রং?
না। সবই ঠিক আছে।
অলককে নিয়ে কোনও প্রবলেম নয় তো?
মনীষা কেন কে জানে সত্যকামের সঙ্গে অলকের বিষয়ে কথা বলতে ভালবাসে না। তার মনে হয় এ বিষয়ে আলোচনা করার যথার্থ অধিকার সত্যকামের নেই। কেন যে এরকমটা মনে হয় তার ব্যাখ্যা মনীষা কখনও করতে পারবে না।
সে বলল, না না। অলককে নিয়ে প্রবলেম হবে কেন?
অলক প্রবলেম হলেই বা সত্যকামের কী, না হলেই বা কী? সে তরল আনন্দে ভেসে গেল।
কিন্তু সেই রাতে শোয়ার সময় হঠাৎ সত্যকামের মনে পড়ল, একসময়ে সে সুছন্দার সঙ্গে অলককে ভিড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। এমনকী সুছন্দাকে পুত্রবধু করার প্রস্তাবও দিয়েছিল সে।
অথচ—
একা একা খুব হাসল সত্যকাম আপনমনে। দুনিয়াটা যে কী হয়ে গেল! ওফ! যদি সত্যিই সুছন্দাকে বিয়ে করত অলক? তা হলে কী হত?
মনীষা জিজ্ঞেস করল, ওরকম হাসছ কেন?
খুব নেশা হয়েছে বুঝলে! দুনিয়াটাই অন্যরকম লাগছে।
অন্যরকম লাগানোর জন্যই তো নেশা করো তুমি।
তা ঠিক, তবে এতটাই অন্যরকম হওয়া ঠিক নয়।
অন্যরকম মানে কীরকম তা বুঝিয়ে বলো!
সত্যকাম গম্ভীর হয়ে গেল। আর কিছুই বলল না। সে মনে মনে সুছন্দাকে অলকের পাশে দাড় করাল। সুছন্দার মাথায় ঘোমটা, কপালে সিঁদুর। শিউরে উঠে সত্যকাম ছবিটা মুছে ফেলল।