সত্যিকারের রূপকথা
উড়িষ্যায় দলিত তাঁতি পরিবারে জন্মেছিলেন প্রদ্যুম্ন মহানন্দিয়া।ছোটোবেলা থেকেই নানা বঞ্চনার শিকার। স্কুলে ভর্তির পর দলিত বলে ক্লাসে তার পাশে বসত না কেউ। অচ্ছুতের ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়ে যাবে এই কুসংস্কারে আবার চান করতে হত তাদের। ছোটোবেলায় ভুল করে মন্দিরে ঢুকলে তাঁকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল মন্দিরের ব্রাহ্মণেরা।
পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল না প্রদ্যুম্নর। আগ্রহ ছিল ছবি আঁকায়। পড়াশোনা শেষ করে ‘দিল্লি আর্ট কলেজ’-এ ভর্তি হয়। আঁকার হাত চমৎকার তাই স্কলারশিপও পায় সে।
মা হারা পিকে স্বপ্নে দেখত মা এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন ‘ভালো ছেলেরা মন খারাপ করে না কি? এক জ্যোতিষী বলেছে, একদিন বহুদুর থেকে এক রাজকন্যা আসবে এই জঙ্গলে। বৃষরাশির সেই সুন্দরী বাঁশি বাজিয়ে আমার ছোট্ট রাজপুত্রের মন জয় করে নেবে।’ প্রায় রোজ স্বপ্নে মায়ের এই মনভোলানো কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন কিশোর পিকে। পিকে পোট্রের্ট আঁকায় পারদর্শী। আঁকা ছবিগুলোই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রি করত।
একদিন পথেই গাড়ির ভেতরের শ্বেতাঙ্গ ভদ্রমহিলার মুখের একটা পেন্সিল স্কেচ করে মহিলার হাতে দিয়ে অনুরোধ করেন ওনার পোট্রের্ট বানাতে চান। মহিলা খুশি হয়ে তাকে ঠিকানা দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন।
পিকে জানতেন না গাড়ির ভদ্রমহিলা আসলে রাশিয়ার প্রথম নারী মহাকাশচারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। আলাপ হওয়ার পর, তিন-তিনটি ছবি আঁকেন রুশ মহাকাশচারীর।
তার সংস্পর্শে আসায় পিকের নাম ছড়িয়ে পরতে থাকে, পোট্রের্ট আঁকার ডাক আসতে থাকে নানা জায়গা থেকে। শার্লট ভন শেভিন নামে সুইডেনের এক ভদ্রমহিলা ভালো শিল্পীর খোঁজে ছিলেন, যাঁকে দিয়ে তিনি নিজের পোর্ট্রেট আঁকাবেন। ২২ দিনের জন্য সুদূর সুইডেন থেকে ভারতবর্ষ ভ্রমণে এসেছিলেন এই শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী। তখন দিল্লিতে বেশ নামডাক করেছে প্রদ্যুম্ন।কিছুদিন পরই পিকের আলাপ হয় ওই সুইডেনের ভদ্রমহিলার সঙ্গে। প্রথম আলাপেই অচেনা বিদেশিনীর মধুর ব্যবহারে চমকে উঠল পিকে । তাঁর একটা ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে পিকেকে। ছবি আঁকার ছলে দেখাসাক্ষাৎ বাড়ে তাদের। একসঙ্গে সময় কাটানোয় ভালোলাগাও দিনে দিনে বাড়তে শুরু করে। একদিন কথায় কথায়, মজার ছলে শার্লট’কে মা আর জ্যোতিষীর গল্প বলে জানতে চায় জঙ্গলে ঘেরা বাড়ির মালকিন সে হবে?
শার্লট হেসে বলেন, আপত্তি নেই। বাঁশি বাজাতে না পারলেও কিন্তু রাশি বৃষ। পিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে রাজি হয় শ্বেতাঙ্গিনী।
আর্ট কলেজের ডিগ্রি সম্পূর্ণ না হওয়ায় দিল্লিতেই থেকে যান পিকে। শার্লট একাই ফিরলেন সুইডেনে।
চিঠি আর টেলিগ্রামেই ছিল যোগাযোগ। এই দীর্ঘ দূরত্বের সম্পর্কে দুদেশে দুজনেই হাঁপিয়ে উঠেছিল। শার্লট পিকেকে সুইডেন চলে আসার অনুরোধ করেন। প্লেনের টিকিটও পাঠিয়ে দিতে চান। প্রেমিকার থেকে হাত পেতে খরচ নিতে পারেননি পিকে। এই দূরত্ব দুজনকেই বিষণ্ণ করে দিয়েছিল। একদিন মা তাঁকে স্বপ্নে বলে ‘রাজকন্যেকে ধরে রাখিস তুই, চলে যেতে দিস না’। আশঙ্কা আর কষ্টে দুলে উঠল প্রদ্যুম্নর মন।
নিজের সব বেচে কিনলেন সেকেন্ড-হ্যান্ড লড়ঝড়ে সাইকেল। শুরু করলেন সাইকেল-অভিসার। রোদ জল ঝড়ে টানা পাঁচ মাস সাইকেল চালিয়ে শেষমেশ সুইডেনের গোথেনবার্গ পৌঁছে পিকে আটক হলেন সেদেশের অভিবাসন দফতরের হাতে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন শার্লটও। আনন্দে বিস্ময়ে পিকেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। রাজকন্যে কথা দেন, আর কখনও বিচ্ছেদ হবেনা তাঁদের। তার ঠিক করলেন, তাদের বিয়ে হবে কাশ্মীরে। সেই মতো তারা সেখান থেকে কিছুদিনের মধ্যেই কাশ্মীরে পৌঁছে গেলেন।
রাজপুত্র ও রাজকন্যা পক্ষীরাজ ঘোড়া থেকে নেমে অবাক হয়ে গেল। পাহাড়ি উপত্যকায় ফুটে রয়েছে অদ্ভুত সুন্দর সব ব্রহ্মকমল। যেন তাদেরই এই মহালগ্নের জন্য।