Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সত্যান্বেষী – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 4

সত্যান্বেষী – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

দুই তিনটা দিন কোন রকমে কাটিয়া গেল। মনের আকান্ত অশান্তির উপর সি-আই-ডি বিভাগের বিবিধ কর্মচারীর নিরন্তর যাতায়াতে ও সওয়াল-জবাবে প্রাণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল। মেসের প্রত্যেকেই পালাই পালাই করিতেছিলেন, কিন্তু আবার পালাইতেপ সাহস হইতেছিল না। কি জানি, তাড়াতাড়ি বাসা ছাড়িলে যদি পুলিস তাঁহাকেই সন্দেহ করিয়া বসে।
বাসারই কোন ব্যক্তির চারিধারে যে সন্দেহের জাল ধীরে ধীরে গুটাইয়া আসিতেছে, তাহার ইশারা পাইতেছিলাম। কিন্তু সে ব্যক্তি কে, তাহা অনুমান করিতে পারিতেছিলাম না। মাঝে মাঝে অজ্ঞাত আতঙ্কে বুকটা ধড়াস্‌ করিয়া উঠিতেছিল–পুলিস আমাকেই সন্দেহ করে না তো?
সেদিন সকালে অতুল ও আমি ডাক্তারের ঘরে বসিয়া সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলাম। একটা মাঝারি গোছের প্যাকিং কেস্‌-এ ডাক্তারের ঔষধ আসিয়াছিল, তিনি বাক্স খুলিয়া সেগুলি সযত্নে বাহির করিয়া আলমারিতে সাজাইয়া রাখিতেছিলেন। প্যাকিং কেসের উপর আমেরিকার ছাপ মারা ছিল; ডাক্তারবাবু দেশী ঔষধ ব্যবহার করিতেন না, দরকার হইলেই আমেরিকা কিম্বা জার্মানী হইতে ঔষধ আনাইয়া লইতেন। প্রায় মাসে মাসে তাঁহার এক বাক্স করিয়া ঔষধ আসিত।
অতুল খবরের কাগজের অর্দ্ধাংশটা নামাইয়া রাখিয়া বলিল,–“ডাক্তারবাবু, আপনি বিদেশ থেকে ওষুধ আনান কেন? দেশী ওষুধ কি ভাল হয় না?”
অতুল একটা বড় সুগার-অফ-মিল্কের শিশি তুলিয়া লইয়া তাহার গায়ে লেখা বিখ্যাত বিক্রেতাদের নাম দেখিয়া বলিল,–“এরিক্‌ এণ্ড হ্যাভেল্‌। এরাই বুঝি সবচেয়ে ভাল ওষুধ তৈরী করে?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, হোমিওপ্যাথিতে সত্যি সত্যি রো সারে? আমার তো বিশ্বাস হয় না। এক ফোঁটা জল খেলে আবার রোগ সারবে কি?”
ডাক্তার মৃদু হাসিয়া বলিলেন,–“এত লোক যে ওষুধ নিতে আসে, তারা কি ছেলেখেলা করে?”
অতুল বলিল,–“হয়তো রোগ আপনিই সারে, তারা ভাবে ওষুধের গুণে সারল। বিশ্বাসেও অনেক সময় কাজ হয় কি না।”
ডাক্তার শুধু একটু হাসিলেন, কিছু বলিলেন না। কিয়ৎকাল পরে জিজ্ঞাসা করিলেন,–“খবরের কাগজে আমাদের বাসার কথা কিছু আসে না কি?”
“আছে” বলিয়া আমি পড়িয়া শুনাইলাম,–“হতভাগ্য অশ্বিনীকুমার চৌধুরীর হত্যার এখনও কোন কিনারা হয় নাই। পুলিসের সি-আই-ডি বিভাগ এই হত্যা রহস্যের তদন্তভার গ্রহণ করিয়াছেন। কিছু কিছু তথ্যও আবিষ্কৃত হইয়াছে। আশা করা যাইতেছে, শীঘ্রই আসামী গ্রেপ্তার হইবে।”
“ছাই হবে। ঐ আশা করা পর্যন্ত।” ডাক্তারবাবু মুখ ফিরাইয়া বলিয়া উঠিলেন,–“এ কি! দারোগাবাবু–”
দারোগা ঘরে প্রবেশ করিলেন, সঙ্গে দুইজন কনেস্টবল। ইনি আমাদের সি পূর্ব-পরিচিত দারোগা; কোনও প্রকার ভণিতা না করিয়া একেবারে অতুলের সম্মুখে গিয়া বলিলেন,–“আপনার নামে ওয়ারেণ্ট আছে। থানায় যেতে হবে। গোলমাল করবেন না, তাতে কোন ফল হবে না। রামধনী সিং, হ্যাণ্ডকফ লাগাও।” একজন কনেস্টবল ক্ষিপ্ত অভ্যস্ত হস্তে কড়াৎ করিয়া হাতকড়া পরাইয়া দিল।
আমরা সভয়ে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। অতুল বলিয়া উঠিল,–“এ কি!”
দারোগা বলিলেন,–“এই দেখুন ওয়ারেণ্ট। অশ্বিনীকুমার চৌধুরীকে হত্যা করার অপরাধে অতুলচন্দ্র মিত্রকে গ্রেপ্তার করা হল। আপনারা দু’জনে একে অতুলচন্দ্র মিত্র বলে সনাক্ত করেছেন?”
নিঃশব্দে অভিভূতের মত আমরা ঘাড় নাড়িলাম।
অতুল মৃদু হাসিয়া বলিল,–“শেষ পর্যন্ত আমাকেই ধরলেন। আচ্ছা, চলুন থানায়।–অজিত, কিছু ভেবো না–আমি নির্দোষ।”
একটা ঠিকা গাড়ী ইতিমধ্যে বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অতুলকে তাহাতে তুলিয়া পুলিস সদলবলে চলিয়া গেল।
পাংশুমুখে ডাক্তার বলিলেন,–“অতুলবাবুই তাহলে–! কি ভয়ানক! কি ভয়ানক! মানুষের মুখ দেখে কিছু বোঝবার উপায় নেই।”
আমার মুখে কথা বাহির হইল না। অতুল হত্যাকারী! এই কয় দিন তাহার সহিত একত্র বাস করিয়া তাহার প্রতি আমার মনে একটা প্রীতিপূর্ণ সৌহার্দের সূত্রপাত হইয়াছিল। তাহার স্বভাবটি এত মধুর যে, আমার হৃদয় এই অল্পকালমধ্যেই সে জয় করিয়া লইয়াছিল। সেই অতুল খুনী! কল্পনার অতীত বিস্ময়ে ক্ষোভে মর্মপীড়ায় আমি যেন দিগভ্রান্ত হইয়া গেলাম।
ডাক্তারবাবু বলিলেন,–“এই জন্যেই অজ্ঞাত-কুলশীল লোককে আশ্রয় দেওয়া শাস্ত্রে বারণ। কিন্তু তখন কে ভেবেছিল যে লোকটা এতবড় একটা–”
আমার কিছুই ভাল লাগিতেছিল না, উঠিয়া গিয়া নিজের ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়িলাম। স্নানাহার করিবারও প্রবৃত্তি হইল না। ঘরের ওপাশে অতুলের জিনিসপত্র ছড়ানো রহিয়াছে–সেই দিকে চাহিয়া আমার চক্ষে জল আসিয়া পড়িল। অতুলকে যে কতখানি ভালবাসিয়াছি, তাহা বুঝিতে পারিলাম।
অতুল যাইবার সময় বলিয়া গিয়াছে,–সে নির্দোষ। তবে কি পুলিস ভুল করিল! আমি বিছানায় উঠিয়া বসিলাম। যে রাত্রে অশ্বিনীবাবু হত হন, সে রাত্রির সমস্ত কথা স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলাম। অতুল মেঝেয় বালিশের উপর কান পাতিয়া ডাক্তারের সহিত অশ্বিনীবাবুর কথাবার্তা শুনিতেছিল। কেন শুনিতেছিল? কি উদ্দেশ্যে? তারপর রাত্রি এগারোটার সময় আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম–একেবারে সকালে ঘুম ভাঙিল। ইতিমধ্যে অতুল যদি–
কিন্তু অতুল গোড়া হইতেই বলিতেছে, এ খুন–আত্মহত্যা নয়। যে স্বয়ং হত্যাকারী, সে কি এমন কথা বলিয়া নিজের গলায় ফাঁসী পরাইবার চেষ্টা করিবে? কিম্বা, এমনও তো হইতে পারে যে, নিজের উপর হইতে সন্দেহ ঝাড়িয়া ফেলিবার উদ্দেশ্যেই অতুল এ কথা বলিতেছে, যাহাতে পুলিস ভাবে যে, অতুল যখন এত জোর দিয়া বলিতেছে, এ হত্যা, তখন সে কখনই হত্যাকারী নহে।
এইরূপ নানা চিন্তায় উদ্‌ভ্রান্ত উৎপীড়িত মন লইয়া আমি বিছানায় পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিলাম, কখনও উঠিয়া ঘরে পায়চারি করিতে লাগিলাম। এমনই করিয়া দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গেল।
বেলা তিনটা বাজিল। হঠাৎ মনে হইল, কোনও উকীলের কাছে গিয়া পরামর্শ লইয়া আসি। এরূপ অবস্থায় পড়িলে কি করা উচিত কিছুই জানা ছিল না, উকীলও কাহাকেও চিনি না। যাহা হউক, একটা উকীল খুঁজিয়া বাহির করা দুষ্কর হইবে না বুঝিয়া একটা জামা গলাইয়া লইয়া তাড়াতাড়ি বাহির হইবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়িল। দ্বার খুলিয়া দেখি–সম্মুখেই অতুল!
“অ্যাঁ–অতুল!” বলিয়া আমি আনন্দে তাহাকে প্রায় জড়াইয়া ধরিলাম। সে দোষী কি নির্দোষ, এ আন্দোলন মন হইতে একেবারে মুছিয়া গেল।
রুক্ষ মাথা, শুষ্ক মুখ, অতুল হাসিয়া বলিল,–“হ্যাঁ ভাই, আমি। বড্ড ভুগিয়েছে! অনেক কষ্টে একজন জামীন পাওয়া গেল–তাই ছাড়া পেলুম, নইলে আজ হাজত বাস করতে হত। তুমি চলেছ কোথায়?”
একটু অপ্রতিভভাবে বলিলেন,–“উকীলের বাড়ী।”
অতুল সস্নেহে আমার একটা হাত চাপিয়া দিয়া বলিল,–“আমার জন্যে? তার আর দরকার নেই ভাই। আপাতত কিছু দিনের জন্য ছাড়ান্‌ পাওয়া গেছে।”
আমি দ্বিধা ঠেলিয়া বলিবার চেষ্টা করিলাম,–“অতুল,–তুমি–তুমি–”
“আমি কি? অশ্বিনীবাবুকে খুন করেছি কিনা?” অতুল মৃদুকণ্ঠে হাসিল–“সে আলোচনা পরে হবে। এখন কিছু খাওয়া দরকার। মাথাটা ধরেছে দেখছি। যা হোক, স্নান করলেই সেরে যাবে বোধ হয়।”
ডাক্তারবাবু প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া অতুল বলিল,–“অনুকূলবাবু, ঘষা দোয়ানীর মত আবার আমি ফিরে এলুম। ইংরেজীতে একটা কথা আছে না–bad penny, আমার অবস্থাও প্রায় সেই রকম,–পুলিসেও নিলে না, ফিরিয়ে দিলে।”
ডাক্তার একটু গম্ভীরভাবে বলিলেন,–“অতুলবাবু, আপনি ফিরে এসেছেন, খুব সুখের বিষয়। আশা করি, পুলিস আপনাকে নির্দোষ বুঝেই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার এখানে আর–আপনার–‘ বুঝতেই তো পারছেন, পাঁচজনকে নিয়ে মেস। এমনিতেই সকলে পালাই পালাই করছেন, তার উপর যদি আবার–আপনি কিছু মনে করবেন না, আপনার প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই–কিন্তু–”
অতুল বলিল,–“না না, সে কি কথা! আমি এখন দাগী আসামী, আমাকে আশ্রয় দিয়ে আপনারা বিপদে পড়বেন কেন? বলা তো যায় না, পুলিস হয়তো শেষে আপনাকেও এডিং অ্যাবেটিং চার্জে ফেলবে।–তা, আজই কি চলে যেতে বলেন?”
ডাক্তার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া অনিচ্ছাভরে বলিলেন,–“না, আজ রাতটা থাকুল; কিন্তু কাল সকালেই–”
অতুল বলিল,–“নিশ্চয়। কাল আর আপনাদের বিব্রত করব না। যেখানে হোক একটা আস্তানা খুঁজে নেব,–শেষ পর্যন্ত ওড়িয়া হোটেল তো আছেই।” বলিয়া হাসিল।
ডাক্তার তখন থানায় কি হইল জিজ্ঞাসা করিলেন। অতুল ভাসাভাসা জবাব দিয়া স্নান করিতে চলিয়া গেল। ডাক্তার আমাকে বলিলেন,–“অতুলবাবু মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেন বুঝতে পারছি–কিন্তু উপায় কি বলুন? একে তো মেসের বদনাম হয়ে গেছে–তার উপর যদি পুলিসের প্রেপ্তারী আসামী রাখি,–সেটা কি নিরাপদ হবে, আপনিই বলুন!”
বাস্তবিক এটুকু সাবধানতা ও স্বার্থপরতার জন্য কাহাকেও দোষ দেওয়া যায় না। আমি বিরসভাবে ঘাড় নাড়িলাম, বলিলাম–“তা–আপনার মেস, আপনি যা ভাল বুঝবেন করবেন।”
আমি গামছা কাঁধে ফেলিয়া স্নানঘরের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করিলাম; ডাক্তার লজ্জিত বিমর্ষমুখে বসিয়া রহিলেন।
স্নানাহার শেষ করিয়া ঘরে ফিরিতেছি, এমন সময় ঘনশ্যামবাবু অফিস হইতে ফিরিলেন। সম্মুখে অতুলকে দেখিয়া তিনি যেন ভূত দেখার মত চমকিয়া উঠিলেন, পাংশমুখে বলিলেন,–“অতুলবাবু আপনি–আপনি–?”
অতুল মৃদু হাসিয়া বলিল,–“আমিই বটে ঘনশ্যামবাবু। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না?”
ঘনশ্যামবাবু বলিলেন,–“কিন্তু আপনাকে তো পুলিশে–” এই পর্যন্ত বলিয়া একটা ঢোক গিলিয়া তিনি নিজের ঘরে ঢুকিয়া পড়িলেন।
অতুলের চক্ষু কৌতুকে নাচিয়া উঠিল, সে মৃদু কণ্ঠে বলিল,–“বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিসে ছুঁলে বোধ হয় আটান্ন। ঘনশ্যামবাবু আমায় দেখে বিশেষ ভয় পেয়েছেন দেখছি।”
সেদিন সন্ধ্যাবেলা অতুল বলিল,–“ওহে দেখ তো, দরজার তালাটা লাগছে না।”
দেখলাম, বিলাতী তালায় কি গোলমাল হইয়াছে। গৃহস্বামীকে খবর দিলাম, তিনি আসিয়া দেখিয়া বলিলেন,–“বিলাতী তালায় ঐ মুস্কিল; ভাল আছেন তো বেশ আছেন, খারাপ হলে একেবারে এঞ্জিনীয়ার ডাকতে হয়। এর চেয়ে আমাদের দেশী হুড়কো ভালো। যা হোক, কালই মেরামত করিয়ে দেব।” বলিয়া তিনি নামিয়া গেলেন। রাত্রে শয়নের পূর্বে অতুল বলিল,–“অজিত, মাথা ধরাটা ক্রমেই বাড়ছে–কি করি বল তো?”
আমি বলিলাম,–“ডাক্তারের কাছ থেকে এক পুরিয়া ওধুধ নিয়ে খাওনা।”
অতুল বলিল,–“হোমিওপ্যাথি ওষুধ? তাতে সারবে?–আচ্ছা চল, দেখা যাক্‌–হুমো পাখীর জোর।”
আমি বলিলাম,–“চল, আমার শরীরটাও ভাল ঠেকছে না।”
ডাক্তার তখন দ্বার বন্ধ করিবার উপক্রম করিতেছিলেন, আমাদের দেখিয়া জিজ্ঞাসুভাবে মুখের দিকে চাহিলেন। অতুল বলিল,–“আপনার ওষুধের গুণ পরীক্ষা করতে এলুম। বড্ড মাথা ধরেছে-কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন?”
ডাক্তার খুশী হইয়া বলিলেন,–“বিলক্ষণ! পারি বৈ কি! পিত্তি পড়ে মাথা ধরেছে–বসুন, এখনি ওষুধ দিচ্ছি।” বলিয়া আলমারি হইতে নূতন ঔষুধ পুরিয়া করিয়া আনিয়া দিলেন,–“যান, খেয়ে শুয়ে পড়ুন গিয়ে–কাল সকালে আর কিছু থাকবে না।–অজিতবাবু, আপনার চেহারাটাও ভাল ঠেকছে না–উত্তেজনার পর অবসাদ বোধ হচ্ছে–না? শরীর ঢিস-ঢিস্‌ করছে? বুঝেছি, আপনিও এক দাগ নিন–শরীর বেশ ঝরঝরে হয়ে যাবে।”
ঔষধ লইয়া বাহির হইতেছি, অতুল বলিল,–“ডাক্তারবাবু, ব্যোমকেশ বক্সী বলে কাউকে চেনেন?”
ডাক্তার ঈষৎ চমকিত হইয়া বলিলেন,–“না, কে তিনি?”
অতুল বলিল,–“জানি না। আজ থানায় তার নাম শুনলুম। তিনি না কি এই হত্যার তদন্ত করছেন।”
ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন,–“না আমি তাঁকে চিনি না।”
উপরে নিজেদের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া আমি বলিলাম,–“অতুল, এবার সব কথা আমায় বল।”
“কি বল্‌ব?”
“তুমি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছ। কিন্তু সে হবে না, সব কথা খুলে বলতে হবে।”
অতুল একটু চুপ করিয়া রহিল, তারপর দ্বারের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল,–“আচ্ছা, বলছি। এস, আমার বিছানায় বস। তোমার কাছে যে আর লুকিয়ে রাখা চলবে না, তা বুঝেছিলুম।”
আমি তাহার বিছানায় গিয়া বসিলাম, সে-ও দরজা ভেজাইয়া দিয়া আমার পাশে বসিল। ঔষধের পুরিয়াটা তখনও আমার হাতেই ছিল, ভাবছিলাম সেটা খাইয়া নিশ্চিন্তমনে গল্প শুনিব। মোড়ক খুলিয়া ঔষধ মুখে দিতে যাইতেছি, অতুল আমার হাতটা ধরিয়া বলিল,–“এখন থাক, আমার গল্পটা শুনে নিয়ে তারপর খেয়ো।”
সুইচ তুলিয়া আলো নিভাইয়া দিয়া অতুল আমার কানের কাছে মুখ আনিয়া ফিস্‌ফিস্‌ করিয়া তাহার গল্প বলিতে লাগিল, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনিয়া চলিলাম। বিস্ময়ে আতঙ্কে মাঝে মাঝে গায়ে গাঁটা দিয়া উঠিতে লাগিল।
পনের মিনিট পরে সংক্ষেপে গল্প সমাপ্ত করিয়া অতুল বলিল,–“আজ এই পর্যন্ত থাক, কাল সব খুলে বল্‌ব।” রেডিয়ম অঙ্কিত ঘড়ির দিকে চাহিয়া বলিল,–“এখনও সময় আছে। রাত্রি দু’টোর আগে কিছু ঘটবে না, তুমি বরঞ্চ ইতিমধ্যে একটু ঘুমিয়ে নাও, ঠিক সময়ে আমি তোমাকে তুলে দেব।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress