Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

একটু নির্জনতা আর প্রতিদিন গঙ্গাস্নান রত্নেশ্বরের অবসরভোগী জীবনের এই ছিল একান্ত বাসনা। খুঁজে খুঁজে কলকাতার কাছেই গঙ্গা থেকে অল্প একটু দূরে মোটামুটি সস্তায় কাঠা ছয়েক পুকুর বোজানো জমি কিনে ফেললেন। আধুনিক কায়দায় একটা বাড়িও তৈরি হয়ে গেল। বাগান করার জন্য চারপাশে বেশ ভালই জায়গা রইল। বাগানে সব থাকলেও এতকাল ভাড়া বাড়িতে টবে একটা তুলসী গাছ ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হয়নি। সবই হল কেবল সীমানা পাঁচিলটা তেমন জুতসই হল না। অর্থের অভাব। ভেবেছিলেন পরে করবেন। কাঁটাতার লাগাবেন তিন থাক। রাবণের স্বর্গের সিঁড়ির মতো মধ্যবিত্তের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় বাড়ি প্রায়ই আধখ্যাঁচড়া থেকে যায়। বাইরে প্লাস্টার হয় না। জানালা দরজায় এক পিঠে রং পড়ে তো আর এক পিঠে কোরা থেকে যায়। কলতলায় ইট পাতা থাকে, সিমেন্ট বাঁধানো হয়ে উঠে না। রত্নেশ্বরের আড়াই তলা বাড়ি সৌন্দর্যের সমস্ত প্রতিশ্রুতি নিয়ে অর্ধসমাপ্তই রয়ে গেল। তবু নিজের বাড়ি।

বাড়ি যেমনই হোক, চারপাশের খোলা জায়গা রত্নেশ্বরের যত্নে গাছে ভরে গেল। কিছু গাছ কিনলেন, কিছু জোগাড় করলেন পাঁচজনের কাছ থেকে, কিছু ধরে আনলেন গঙ্গার জল থেকে, কিছু এল পাখির ঠোঁটে বীজের আকারে। একেবারে জমজমাট বাগান। গাছের ডালে ডালে জড়াজড়ি। গুঁতোগুঁতিও বলা চলে। চারা পোঁতার সময় রত্নেশ্বর বোধহয় ভুলেই গিয়েছিলেন—শিশু গাছেরা প্রকৃতির নিয়মে এক সময় তেজিয়ান যুবক হয়ে উঠবে। পুবদিকে সদর রাস্তার খাটো পাঁচিলে পাশে পাশে বেড়ে উঠল শিউলি, গোলঞ্চ, করবী, মাধবীলতা, কাঁঠালি চাঁপা। পশ্চিম দিকে দক্ষিণের পাঁচিল ঘেঁষে কল্কে, পঞ্চমুখী জবা, যুঁই, রঙ্গন, টগর, ডবল টগর। ছোট গাছের মধ্যে গোলাপ, ক্যানা আর নানা জাতের মরশুমী ফুল।

বাগান এবং বাড়িতে ঢোকার জন্য পাড়ারই এক অভাবী ছেলেকে দিয়ে একটা গ্রিলের গেট করিয়েছিলেন। ছেলেটি দীর্ঘকাল জার্মানিতে ছিল। হাতে-নাতে কাজ শিখেছিল। জলের বদলে বিয়ার খেতে শিখেছিল। দেশের মাটিতে পা দিয়েই সেই জার্মান-মেক মিস্ত্রির জীবনে দুই ভারতীয় আশীর্বাদ নেমে এল, একটি স্বদেশী স্ত্রী এবং দারিদ্র্য, দ্বিতীয় অকৃপণ মদ্যপান। রত্নেশ্বরের হৃদয়টি আবার স্বাভাবিক আকারের চেয়ে একটু বড়ই ছিল। বুক পরীক্ষা করে ডাক্তার একবার বলেছিলেন হার্ট নিয়ে ভাবনার কিছু নেই, আপনার হাতির হৃদয় দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে বিশাল, এক অশ্বশক্তির পাম্পের মতো রক্ত টানছে আর ছাড়ছে। ছেলের বেবিফুড কিনতে পারছে না বলে একটা করুণ মর্মস্পর্শী গল্প ফেঁদে রত্নেশ্বরের ঘাড় ভেঙে প্রচুর টাকা নিয়ে সেই জার্মান ফেরত ছেলেটি এমন একটা গ্রিল-গেট তৈরি করে দিল যা হাওয়ায় দোলে। হাত ঠেকাবারও প্রয়োজন হয় না, ফু দিলেই খুস করে খুলে যায়। একদিকে ম্যাল-নিউট্রিশানের পাঁচিল অন্য দিকে লো-প্রেসার গেট। বাগান প্রায় অরক্ষিতই পড়ে রইল।

সেই গেট যা হাওয়ায় খুলে যায়, ম্যালেরিয়া রুগির মতো কাঁপে, সেই গেটের মনস্তাত্ত্বিক বাধা পেরিয়ে তিন ডজন ছেলেপুলের মা পাড়ার কাল্লু কুকুর রত্নেশ্বরের সাধের এবং সাধনার বাগান প্রাতঃকৃত্য মধ্যাহ্নকৃত্য সান্ধ্যকৃত্য করে ভরিয়ে দিল। সব পাড়াতেই যেমন কিছু মস্তান থাকে তেমনি কিছু মস্তান কুকুরও থাকে যাদের কোনও মতেই বাগে আনা যায় না। কাল্লু এন্ড হার ফ্যামিলি সেই গোষ্ঠীর জীব। রত্নেশ্বর একা কত লড়বেন। তাঁর প্ল্যান্ডফ্যামিলির সভ্য সংখ্যা কম। অন্য দিকে কাল্লুর আনপ্ল্যান্ড। কাল্লু যায় তো তার বড় ছেলে আসে, বড়র পর মেজো, সেজো, ন, রাঙ্গা, ছোট, ফুল, কুসুম অগুন্তি ব্যাপার। প্ল্যান ভার্সাস আনপ্ল্যান কিম্বা ননপ্ল্যানের যুদ্ধে রত্নেশ্বর ডাহা হেরে গিয়ে সারমেয়-কৃত্যকে উদ্যানের শোভা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হলেন।

এর পর আছে প্রতিবেশির ছাড়া গরু। দুধের সময় তার জামাই আদর। শুকনোর সময় চরে খাও। কোথায় আর চরবে। রত্নেশ্বরের বেওয়ারিশ বাগান। সারাদিনে বারসাতেক ঢুকবেই। গরুর মালিকের টনটনে মান-অপমান জ্ঞান থাকলেও গরুর নেই। মাথামোটা জীব। রত্নেশ্বর মাঝে-মধ্যে খড়মপেটা করে বিপদে পড়েছেন। গরুর মালিক ভূধর চক্রবর্তী একপাশের পাঁচিলের পিঠেই সশব্দে বাস করেন। রজোগুণী মানুষ। অ-সর্বংসহা। মাথার চুল টান টান করে ব্যাক-ব্রাশ করা। চুলের মতো স্নায়ুও সব সময় টান। গরুর গায়ে খড়ম পড়লেই ওপাশের খাটো পাঁচিলে তাঁর বুকের ওপরের অংশ যাত্রার নিয়তির মতো আবির্ভূত হয়। রে রত্নেশ্বর! পামর। তোমার কবে জ্ঞান হবে—ব্রাহ্মণায় গোহিতায় তোমার খড়ম পেটা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। শ্লোকটির কী অর্থ কোন শাস্ত্রের বাক্য রত্নেশ্বরের জানা নেই তবে পাদপূরণটি তিনি সহজেই করে নিয়েছেন উড়ো খৈ গোবিন্দায় নম। অথচ মজা এই গরুর দুধ হলে রত্নেশ্বরই তার প্রথম খদ্দের। পাঁচিলের ওপাশ থেকে এপাশে ফেনা ফেনা গরম দুধ আর অর্থের আদানপ্রদান। খাঁটি দুধ, আহা! তার কোনও তুলনা নেই। রাতে গোঁফ থেকে দুধের ফেনা মুছতে মুছতে রত্নেশ্বর বলেন, কমপ্লিট ফুড, ছাব্বিশটি মিনারেল সল্টের তরল অধ্যায়। ধৃতি পুষ্টি, মেধা বৃদ্ধি। সব গরুর নামই মঙ্গলা। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন দেখেন মঙ্গলা ইজ ফলোড বাই এ বিগ ষাঁড়, আনন্দে হাততালি বাজিয়ে একটু কুঁজো হয়ে নাচতে নাচতে নিজের মনেই বলেন, জয় ভগবান, দুধ ইজ কামিং। ইফ এ বুল কামস ক্যান মিল্ক বি ফার বিহাইন্ড! দুধের কালে রত্নেশ্বর আর ভূধর গুড-স্যামারিটান। মঙ্গলা তখন গোয়ালে অষ্টপ্রহর বাঁধা। শুকনোর সময়েই যত শত্রুতা।

সেবারে কিন্তু দুধের সময়েই দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেল। মঙ্গলার চনমনে মেয়ে লক্ষ্মী সাত সকালেই রত্নেশ্বরের বাগানে প্রবেশ করল। লক্ষ্মী সবে পৃথিবীতে এসেছে। সংসার-ধর্ম করার বয়স তখনও হয়নি। বোটানির জ্ঞান একেবারেই নেই। সটান ঢুকেই রত্নেশ্বরের সাধের ডায়ার্ফ-ক্যানা দিয়ে ব্রেকফাস্ট শুরু করল। তিনের চার ভাগ গাছই যখন শেষ তখন রত্নেশ্বরের পুত্রবধূ খুন্তি হাতে এসে হাজির। পুত্রবধূর সঙ্গে সামনের আর পিছনের বাগানে গোল হয়ে চোর চোর খেলতে খেলতে বাছুর এসে ঢুকল রত্নেশ্বরের কার্পেট মোড়া বৈঠকখানায়। গোয়াল সে দেখেছে। আধুনিক বৈঠকখানা একেবারে অপরিচিত জায়গা। ভয়ে সেই কার্পেটের ওপরেই একনাদা গোবর, এক কলসি জল বিয়োগ করে দোতলায় ওঠার প্যাঁচালো সিড়ির তলায় বিষম কোণে বদখতভাবে আটকে গেল। না পারে এগতে না পারে ঘুরতে, না পারে ভাল করে দাঁড়াতে, না পারে শুতে। কেলেংকারি কাণ্ড। দুরূহ একটা ধাঁধার মতো সেই গরুকে উদ্ধার করা যার তার কর্ম নয়। রত্নেশ্বর রেগে গিয়ে বললেন, থাক শালা ওখানে আটকে, গরুর স্ট্যাচু হয়ে। লোকে পুতুল দিয়ে ঘর সাজায়, আমি সাজাব বকনা বাছুর দিয়ে। রত্নেশ্বরের বোন তো মহা খুশি। আহা কেমন কল হয়েছে। নাদা নাদা গোবর ফ্রি, বিনা পয়সায় টাটকা ঘুঁটে। এরপর গাভীন হলে বালতি বালতি দুধ। রত্নেশ্বর রেগে গিয়ে মুখ খারাপ করে ফেলছিলেন, অনেক কষ্টে সামলে নিলেন।

গরুটা তিনদিন সেই খাঁজে আটকে ছিল। শেষে সিঁড়ির আধখানা ধসিয়ে লক্ষ্মীর মুক্তির ব্যবস্থা হল। হই হই ব্যাপার। উদ্ধার পর্ব দেখার জন্যে বুড়ো, আধবুড়ো, ছেলেমেয়ে কাচ্চাবাচ্চা প্রায় শ পাঁচেক জুটে গেল। ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে গরু একটা ভয়াবহ ডাক ছাড়ল। প্রবীণরা বললেন, মা ভগবতী অভিশাপ দিলেন। বাবা রত্নেশ্বর প্রায়শ্চিত্ত করো। রত্নেশ্বর পর পর সাত কাপ চা খেয়ে, গামছা পরে বৈঠকখানার গোময় জড়ানো কার্পেট আর গোমূত্র সাফ করে প্রায়শ্চিত্ত করলেন। বোতল বোতল ফিনাইল ঢাললেন কিন্তু খাটাল খাটাল গন্ধটা বৈঠকখানা থেকে কিছুতেই গেল না।

প্রথম রাতে রত্নেশ্বর ঘুমোতে পারেন না। বয়স হয়েছে। ঘুম কমে আসছে। শেষ রাতে একটু তন্দ্রার মতো আসে। সকালে উঠতে দেরি হয়ে যায়। ইদানীং ভোরের ঘুমটাও যেতে বসেছে। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে একদল ক্ষুদে শয়তান রাস্তার দিকের পাঁচিলে উঠে ফুল চুরি করে। যত না ফুল তোলে, তার চেয়ে বেশি ডাল ভাঙে, গাছের সর্বনাশ করে।

ফুল তোলার অধিকার নিয়েও মাঝে মাঝে দু দলে ধুম ঝগড়া বেধে যায়। লোহার একটা বড় আঁকসি নিয়ে এক বৃদ্ধা নাকি গত চার বছর ধরে ফুল তুলে আসছে। রত্নেশ্বরের ফুল গাছে তার অধিকার জন্মে গেছে। যাকে আইনের ভাষায় বলা যায় ইজমেন্ট-রাইট। অথচ পাঁচিলের বাঁদরগুলো সেই অধিকার কেড়ে নেবার উপক্রম করেছে। মোক্ষদাকে তোরা চিনিস না। সাতসকালে রোজ খেস্তাখেস্তি। বুড়ির মুখে সাবেক আমলের গালাগাল। ছেলেদের মুখে হাল আমলের। রোজ সকালে রত্নেশ্বরের ঘুম ভেঙে যায়। নিত্য অশান্তি। রত্নেশ্বর একদিন কাটারি হাতে রণক্ষেত্রে নেমে এলেন। সমস্ত গাছ এক এক করে নিজের হাতে কেটে সাজানো বাগান শ্মশান করে ফেলে দেবেন। নো-বাগান। নো-ডিসেন্ট লিভিং। যস্মিন্ দেশে যদাচার। কিন্তু না, গাছ কাটা আর হল না। পাড়ার সর্বজন শ্রদ্ধেয় উদীয়মান নেতা সকলেরই দাদা গোরাদা সিনে অ্যাপিয়ার হলেন। ভুঁড়ির তলায় ফুলসাজের লুঙি। গায়ে লাল বুক খোলা গেঞ্জি। গলায় মহাবীরের লকেট। হাতে পঞ্চাননের স্টিলের বালা। খবরদার গাছ কাটা চলবে না। গাছ সকলের। গাছ কী আপনার পেটারন্যাল প্রপাটি। জানেন না, সুন্দরী কন্যা, সুন্দর বাগান, রাস্তার দিকের রক আর কর্পোরেশনের পেচ্ছাবখানা সব হল পাবলিকের সম্পত্তি। আপনার রকও নেই, সুন্দরী কন্যাও নেই, আছে একটা বাগান, সেই বাগানে জনসাধারণ ঢুকলে অত উত্তেজিত হবার কী আছে। আপনি দেখছি সেলফিস জায়েন্টের বাবা।

গোরাবাবু, যখন লেখাপড়া করতেন তখন বোধহয় সেলফিস জায়েন্ট পড়ার সুযোগ হয়েছিল। তাকমাফিক, সময় বুঝে তার সঙ্গে একটা বাবা জুড়ে রত্নেশ্বরকে ঝেড়ে দিলেন। সেই দিনই রাতে পারিবারিক সভায় ঠিক হল, একটা অ্যালসেসিয়ান পুষতে হবে। কিন্তু অ্যালসেসিয়ান পোষার খরচও তো অনেক, রোজ পাঁচ-ছ টাকা তো খাবেই। তাহলে। কারুর মুখেই কোনও কথা নেই। তাহলে, রত্নেশ্বরের ছেলে বলল, এক কাজ করি, ‘কুকুর হইতে সাবধান’ এই নোটিসটা রাতারাতি ঝুলিয়ে দিয়ে দেখি, কী হয়। তাই হোক।

গেটের বাইরে নোটিস ঝুলে গেল। প্রথম কয়েকটা দিন বেশ কাজ হল। তারপরই হল বিপদ। কানাকানি হতে লাগল—কী কুকুর রে! একবারও ডাকে না। কত্তার শোবার ঘরে মোদক মেরে কাত হয়ে পড়ে থাকে নাকি রে। নোটিসটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কুকুরটাকে অন্তত মাঝে মাঝে ডাকানো উচিত। রত্নেশ্বরের ছেলে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাজার থেকে একটা ছোট মাটির হাঁড়ি কিনে আনল। সেই রাতেই পাড়া নিশুতি নিস্তব্ধ হওয়া মাত্র হাঁড়িতে মুখ ঢুকিয়ে নিজেই বারকয়েক কুকুর ডাকল। সারা বাড়ির বিভিন্ন কোণে দাঁড়িয়ে রাত দুটো অবধি নাগাড়ে কুকুর ডাক ছাড়ল। রাস্তার কুকুরের সঙ্গে ডাকাডাকির উতোর-চাপান চলল। স্ত্রী বললেন—সাধনায় কী না হয়? প্রথমটা তেমন হচ্ছিল না, এখন বেড়ে হচ্ছে। তবে ডাকের জাতটা একটু নেড়ি নেড়ি। সে আর কী করবে বলো, দিশি গলায় বিদেশি আওয়াজ বেরুবে কী করে। নাও এবার কুকুরকে ঘুম পাড়াও। দুটো নাগাদ ঘড়িতে পাঁচটার অ্যালার্ম দিয়ে কুকুর শুয়ে পড়ল।

ভোর পাঁচটায় উঠে রত্নেশ্বরের ছেলে অফিসে যাবার আগে পর্যন্ত কুকুর ডাকল। নাতিও মাঝে মাঝে কেঁউ কেঁউ করে সঙ্গত করল। এত ডাকাডাকি সহ্য হবে কেন। যতই হোক মানুষের গলা তো। গলা ভেঙে গেল। অফিস থেকে যখন ফিরল, তখন গলা দিয়ে আট রকমের সুর বেরুচ্ছে। রত্নেশ্বর বলল, আজ আর তোর ডেকে দরকার নেই। কুকুরের কখনও গলা ভাঙে না। হাঁড়িটা দে। আজ রাতে আমিই মাঝে মাঝে ডাকি, প্রহরে প্রহরে। এমনিতে তো ঘুম হয় না। তবু একটা কাজ পাওয়া গেল।

পাড়ার সকলে এদিকে বলাবলি করতে লাগলেন, কী কুকুর পুষেছে রে! ছোটবড় মাদী, মদ্দা সারা রাতই নানা সুরে চেল্লাচ্ছে। এক এক সময়, এক এক রকম ডাক।

ব্যাপারটা বেশ জমছিল। ডাকটাও বেশ সড়গড় হয়ে এসেছিল। নিয়ম করে সময় পেলই রত্নেশ্বর, রত্নেশ্বরের ছেলে, নাতি সকলেই বেশ কালোয়াতি করে কুকুরের ডাক ডাকছিলেন। সকলের স্বভাবেও বেশ পরিবর্তন আসছিল। রত্নেশ্বর রাগের সময় অবাক হয়ে লক্ষ করছিলেন, কিছু বলার আগেই গলা দিয়ে একটা চাপা গড়্ড় গড়্ড় শব্দ আপনিই বেরিয়ে আসছে। রত্নেশ্বরের ছেলে সেদিন বাসে অবাক হয়ে গেলেন—কে একজন পা মাড়িয়ে দিয়েছিল, গলা দিয়ে আপনি কেঁউ কেঁউ শব্দ বেরিয়ে এল। সহযাত্রীরা ইয়ারকি ভেবেছিলেন। একজন বললেন, ‘জেনুইন কুকুর মাইরি’। কোনও কারণে কেউ খুশি হলে কোমরের পেছনটা সুড় সুড় করে উঠত। তার মানে লেজ থাকলে পটাপট করে নাড়ানো সম্ভব হত। কোনও কিছু খাবার আগে ফোঁস ফোঁস করে শোঁকার ইচ্ছে হত। অনেকটা কুকুর কুকুর ভাব।

একদিন সব ভণ্ডুল হয়ে গেল কাল্লুটার জন্য। কাল্লু ভোর বেলা সামনের বাগানে প্রাতঃকৃত্য করছিল। আঁকসি হাতে মোক্ষদাবুড়ি গেটের বাইরে থেকে দেখে বললেন—একী হল? বাড়িতে কুকুর থাকলে আর একটা কুকুর ঢোকে কী করে? কুকুরে কুকুরে দেখা হলেই ঝটাপটি। চলে আয় তোরা। সব ভাঁওতা। তাই বলি, কুকুর দেখতে পাওয়া যায় না, রকম রকম খালি ডাক। মোক্ষদা ও তার বিরোধী দলবলেরা সব এক জোট, ইউনাইটেড ফ্রন্ট হয়ে গেট খুলে, নোটিস ছিড়ে হুড়মুড় করে রত্নেশ্বরের বাগানে আবার নিজেদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দিল।

রত্নেশ্বর গভীর আক্ষেপে ছেলেকে ডেকে বললেন, ডাকটাই আয়ত্ত করেছি রে, কুকুরের স্বভাবটা এখনও আয়ত্ত করতে পারিনি। ছি ছি, জনসাধারণের কাছে তাই আজ আমাদের হার হল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *