শেষ প্রশ্ন : ২১
বেলার মুখের প্রতি চাহিয়া আশুবাবু একটু হাসিলেন, কহিলেন, কেমন, বর্ণনা আমার মিললো তো? বুড়োবয়সে extravagance বলে উপহাস করা যে উচিত হয়নি, মানলে ত?
মহিলাটি নির্বাক হইয়া রহিলেন। আশুবাবু কমলের হাতখানি বার-কয়েক নাড়াচাড়া করিয়া বলিতে লাগিলেন, এই মেয়েটির বাইরেটা দেখেও মানুষের যেমন আশ্চর্য লাগে, ভেতরটা দেখতে পেলেও তেমনি অবাক হতে হয়। কেমন হরেন্দ্র, ঠিক নয়?
হরেন্দ্রও চুপ করিয়া রহিল; কমল হাসিয়া জবাব দিল, এ ঠিক কি না তাতে সন্দেহ আছে, কিন্তু কেউ যদি আপনাকে extravagant বলে তামাশা করে থাকেন, তিনি যে বেঠিক নন তাতে সন্দেহ নেই। মাত্রাজ্ঞানটা আপনার এ সংসারে অচল।
ইস, তাই বৈ কি! বলিয়াই আশুবাবু গভীর স্নেহের সুরে কহিলেন, এ বাড়িতে খাওয়াতে তোমাকে কিছুতেই পারবো না জানি, কিন্তু নিজের বাসাতে আজ কি খেলে বল ত?
রোজ যা খাই, তাই।
তবু কি শুনিই না? বেলা ভাবছিলেন, এও আমি বাড়িয়ে বলেচি।
কমল কহিল, অর্থাৎ আমার সম্বন্ধে আমার অসাক্ষাতে অনেক আলোচনাই হয়ে গেছে?
তা হয়েছে—অস্বীকার করবো না।
রৌপ্য-পাত্রে একখানা ছোট কার্ড লইয়া বেহারা ঘরে ঢুকিল। লেখাটা সকলেরই চোখে পড়িল, এবং সকলেই আশ্চর্য হইলেন। এ গৃহে অজিত একদিন বাড়ির ছেলের মতই ছিল, কিন্তু আগ্রায় থাকিয়াও আর সে আসে না। হয়ত ইহাই স্বাভাবিক। তথাপি এই না আসার লজ্জা ও সঙ্কোচ উভয় পক্ষেই এমনিই একটা ব্যবধান সৃষ্টি করিয়াছে যে তাহার এই অপ্রত্যাশিত আগমনে শুধু আশুবাবুই নয়, উপস্থিত সকলেই একটু চমকিত হইলেন। তাঁহার মুখের পরে ভারী একটা উদ্বেগের ছায়া পড়িল, কহিলেন, তাঁকে এই ঘরেই নিয়ে আয়।
খানিক পরে অজিত ঘরে ঢুকিল। পরিচিত ও অপরিচিত এতগুলি লোকের উপস্থিতির সম্ভাবনা সে আশঙ্কা করে নাই।
আশুবাবু কহিলেন, ব’সো অজিত। ভাল আছ?
অজিত মাথা নাড়িয়া কহিল, আজ্ঞে, হাঁ। আপনার শরীরটা এখন কেমন আছে? ভাল মনে হচ্ছে ত?
আশুবাবু বলিলেন, অসুখটা সেরেচে বলেই ভরসা পাচ্চি।
পরস্পর কুশল প্রশ্নোত্তর এইখানে থামিল। কমল না থাকিলে হয়ত আরও দুই-একটা কথা চলিতে পারিত, কিন্তু চোখাচোখি হইবার ভয়ে অজিত সেদিকে মুখ তুলিতে সাহস করিল না। মিনিট দুই-তিন সকলেই চুপ করিয়া থাকার পরে হরেন্দ্র প্রথমে কথা কহিল। জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি সোজা বাসা থেকেই এখন আসচেন?
কিছু একটা বলিতে পাইয়া অজিত বাঁচিয়া গেল। বলিল, না, ঠিক সোজা আসতে পারিনি, আপনার সন্ধানে একটু ঘুর-পথেই আসতে হয়েছে।
আমার সন্ধানে? প্রয়োজন?
প্রয়োজন আমার নয়, আর একজনের। তিনি রাজেনের খোঁজে দুপুর থেকে বোধ করি বার-চারেক উঁকি মেরে গেলেন। বসতে বলেছিলাম, কিন্তু রাজী হলেন না। স্থির হয়ে অপেক্ষা করাটা হয়ত ধাতে সয় না।
হরেন্দ্র শঙ্কিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, লোকটিকে দেখতে কেমন? বললেন না কেন সে এখানে নেই?
অজিত কহিল, সে সংবাদ তাঁকে দিয়েছি।
আশুবাবু বলিলেন, কমল, এই রাজেন ছেলেটিকে আমি দু’-তিনবারের বেশী দেখিনি—বিপদে না পড়লে তার সাক্ষাৎ মেলে না, কিন্তু মনে হয় তাকে অত্যন্ত ভালবাসি।কি যেন একটা মহামূল্য জিনিস সে সঙ্গে নিয়ে বেড়ায়। অথচ, হরেন্দ্রর মুখে শুনি সে ভারী wild,—পুলিসে তাকে সন্দেহের চোখে দেখে, ভয় হয় কোথায় কি একটা বিভ্রাট ঘটিয়ে বসবে, হয়ত খবরও একটা পাবো না, —এই দেখ না হঠাৎ কোথায় যে অদৃশ্য হয়েছে কেউ খুঁজে পাচ্চে না।
কমল প্রশ্ন করিল, হঠাৎ যদি খবর পান সে বিপদে পড়েচে, কি করেন?
আশুবাবু বলিলেন, কি করি সে জবাব শুধু তখনই দেওয়া যায়, এখন নয়। অসুখের সময় নীলিমা আর আমি বহু কাহিনীই তার হরেনের কাছ থেকে শুনেচি। পরার্থে আপনাকে সত্যি করে বিলিয়ে দেওয়ার স্বরূপটা যে কি, শুনতে শুনতে যেন তার ছবি দেখতে পেতাম। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যেন না তার কোন বিপদ ঘটে।
প্রকাশ্যে কেহ কিছু বলিল না, কিন্তু মনে মনে সকলেই বোধ হয় এ প্রার্থনায় যোগ দিল।
কমল জিজ্ঞাসা করিল, নীলিমাকে আজ ত দেখতে পেলাম না? বোধ করি কাজে ব্যস্ত আছেন?
আশুবাবু কহিলেন, কাজের লোক, দিনরাত কাজেই ব্যস্ত থাকেন সত্যি, কিন্তু আজ শুনতে পেলাম মাথা ধরে বিছানা নিয়েছেন।শরীরটা বোধ হয় একটু বেশী রকমই খারাপ হয়েছে, নইলে এ তাঁর স্বভাব নয়। কোন মানুষই যে অবিশ্রান্ত এত সেবা, এত পরিশ্রম করতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, অবিনাশের সঙ্গে আলাপ আগ্রায়। মাঝে মাঝে আসি যাই—কতটুকুই বা পরিচয়, অথচ, আজ ভাবি সংসারে আপন-পর বলে যে একটা কথা আছে সে কত অর্থহীন।দুনিয়ায় আপনার-পর কেউ নেই কমল, স্রোতের টানে কে যে কখন কাছে আসে, আর কে যে ভেসে দূরে যায় তার কোন হিসাব কেউ জানে না।
কথাটা যে কাহাকে উদ্দেশ করিয়া কিসের দুঃখে বলা হইল তাহা শুধু সেই অপরিচিত রমণী বেলা ব্যতীত অপর সকলেই বুঝিল। আশুবাবু কতকটা যেন নিজের মনেই বলিতে লাগিলেন, এই রোগ থেকে উঠে পর্যন্ত সংসারে অনেক জিনিসই যেন আর একরকম চেহারায় চোখে ঠেকে। মনে হয়, কিসের জন্যই বা এত টানাটানি, এত বাঁধাবাঁধি, এত ভালমন্দর বাদানুবাদ,—মানুষে অনেক ভুল, অনেক ফাঁকি নিজের চারপাশে জমা করে স্বেচ্ছায় কানা হয়ে গেছে। আজও তাকে বহু যুগ ধরে অনেক অজানা সত্য আবিষ্কার করতে হবে, তবে যদি একদিন সে সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠতে পারে।আনন্দ ত নয়, নিরান্দই যেন তার সভ্যতা ও ভদ্রতার চরম লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
কমল বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল। তাঁহার বাক্যের তাৎপর্য যে নিঃসংশয়ে বুঝিতেছে তাহা নয়,—যেন কুয়াশার মধ্যে আগন্তুকের মুখ দেখা। কিন্তু পায়ের চলন অত্যন্ত চেনা।
আশুবাবু আপনিই থামিলেন। বোধ হয় কমলের বিস্মিত দৃষ্টি তাঁহাকে নিজের দিকে সচেতন করিল, বলিলেন, তোমার সঙ্গে আমার আরও অনেক কথা আছে কমল, আর একদিন এসো।
আসবো। আজ যাই।
এসো। গাড়িটা নীচেই আছে, তোমাকে পৌঁছে দেবে বলেই বাসদেওকে এখনো ছুটি দিইনি। অজিত, তুমিও কেন সঙ্গে যাও না, ফেরবার পথে তোমাদের আশ্রমে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে!
উভয়ে তাঁহাকে নমস্কার করিয়া বাহির হইয়া আসিল। বেলা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির কাছে আসিয়া কহিল, আপনার সঙ্গে আলাপ করবার আজ সময় হলো না, কিন্তু এবার যেদিন দেখা হবে আমি ছাড়বো না।
কমল হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সে আমার সৌভাগ্য। কিন্তু ভয় হয় পরিচয় পেয়ে না আপনার মত বদলায়।
গাড়ির মধ্যে দুজনে পাশাপাশি বসিয়া। রাস্তায় মোড় ফিরিলে কমল কহিল, সেদিনের রাতটাও এমনি অন্ধকার ছিল, মনে পড়ে?
পড়ে।
সেদিনের পাগলামি?
তাও মনে পড়ে।
আমি রাজী হয়েছিলাম সে মনে আছে?
অজিত হাসিয়া কহিল, না। কিন্তু আপনি যে বিদ্রূপ করেছিলেন সে মনে আছে।
কমল বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, বিদ্রূপ করেছিলাম? কৈ না!
নিশ্চয় করেছিলেন।
কমল বলিল, তা হলে আপনি ভুল বুঝেছিলেন। সে যাক, আজ ত আর তা করচি নে—চলুন না, আজই দুজনে চলে যাই?
দ্যুৎ! আপনি ভারী দুষ্টু।
কমল হাসিয়া ফেলিল, কহিল, দুষ্টু কিসের? আমার মত এমন শান্ত সুবোধ কে আছে বলুন ত? হঠাৎ হুকুম করলেন, কমল, চল যাই,—তক্ষুনি রাজী হয়ে বললাম, চলুন।
কিন্তু সে ত শুধু পরিহাস।
কমল বলিল, বেশ, না হয় পরিহাসই হলো, কিন্তু হঠাৎ অপরাধটা কি করেছি বলুন ত? ডাকতেন তুমি বলে, আরম্ভ করেছেন আপনি বলতে। কত দুঃখে-কষ্টে দিন চলে—আপনাদেরই জামা-কাপড় সেলাই করে কোন মতে হয়ত দুটি খেতে পাই, অথচ আপনার টাকার অবধি নেই,—একটা দিনও কি খবর নিয়েছেন? মনোরমা এ দুঃখে পড়লে কি আপনি সইতেন? দিনরাত খেটে খেটে কত রোগা হয়ে গেছি দেখুন ত? এই বলিয়া সে নিজের বাঁ হাতখানি অজিতের হাতের উপর রাখিতেই আচম্বিতে তাহার সর্বশরীর শিহরিয়া উঠিল। অস্ফুটে কি একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু সহসা হাত টানিয়া লইয়া চেঁচাইয়া উঠিল, ড্রাইভার, রোকো রোকো,— এ যে পাগলা-গারদের সামনে এসে পড়েচি। গাড়ি ঘুরিয়ে নাও। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারা যায়নি।
অজিত কহিল, হাঁ, দোষ অন্ধকারের। শুধু সান্ত্বনা এই যে, হাজার অবিচারেও ও-বেচারার প্রতিবাদ করবার জো নেই। সে অধিকারে ও বঞ্চিত। এই বলিয়া সে একটু হাসিল। শুনিয়া কমলও হাসিল, কহিল, তা বটে। কিন্তু বিচার জিনিসটাই ত সংসারে সব নয়; এখানে অবিচারেরও স্থান আছে বলে আজও দুনিয়া চলচে, নইলে কোন্কালে সে থেমে যেতো। ড্রাইভার, থামাও।
অজিত কবাট খুলিয়া দিতে কমল রাস্তায় নামিয়া আসিয়া কহিল, অন্ধকারের ওর চেয়েও বড় অপরাধ আছে অজিতবাবু, একলা যেতে ভয় করে।
এই ইঙ্গিতে অজিত নিঃশব্দে পাশে নামিয়া দাঁড়াইতেই কমল ড্রাইভারকে বলিল, এবার তুমি বাড়ি যাও, এঁর ফিরে যেতে দেরি হবে।
সে কি কথা! এত রাত্রে এ-অঞ্চলে আমি গাড়ি পাব কোথায়?
তার উপায় আমি করে দেব।
গাড়ি চলিয়া গেল। অজিত কহিল, কোন ব্যবস্থাই হবে না জানি, অন্ধকারে তিন-চার মাইল হাঁটতে হবে। অথচ, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আমি অনায়াসে ফিরে যেতে পারতাম।
পারতেন না। কারণ, আপনাকে না খাইয়ে ওই আশ্রমের অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি যেতে দিতে পারতাম না। আসুন।
বাসায় দাসী আলো জ্বালিয়া আজ অপেক্ষা করিয়া ছিল, ডাকিতেই দ্বার খুলিয়া দিল। উপরে গিয়া কমল সেই সুন্দর আসনখানি পাতিয়া রান্নাঘরে বসিতে দিল। আয়োজন প্রস্তুত ছিল, স্টোভ জ্বালিয়া রান্না চড়াইয়া দিয়া অদূরে উপবেশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এমনি আর একদিনের কথা মনে পড়ে?
নিশ্চয় পড়ে।
আচ্ছা, তার সঙ্গে আজ কোথায় তফাত বলতে পারেন? বলুন ত দেখি?
অজিত ঘরের মধ্যে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া কোন্খানে কি ছিল এবং নাই, মনে করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
কমল হাসিমুখে কহিল, ওদিকে সারারাত খুঁজলেও পাবেন না। আর একদিকে সন্ধান করতে হবে।
কোন্ দিকে বলুন তো?
আমার দিকে।
অজিত হঠাৎ কি একপ্রকার লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া গেল। আস্তে আস্তে বলিল, কোনদিনই আপনার মুখের পানে আমি খুব বেশী করে চেয়ে দেখিনি। অন্য সবাই পেরেছে, শুধু আমিই কি জানি কেন পেরে উঠিনি।
কমল কহিল, অপরের সঙ্গে আপনার প্রভেদ ওইখানে। তারা যে পারতো তার কারণ, তাদের দৃষ্টির মধ্যে আমার প্রতি সম্ভ্রম-বোধ ছিল না।
অজিত চুপ করিয়া রহিল। কমল বলিতে লাগিল, আমি স্থির করেছিলাম, যেমন করে হোক আপনাকে খুঁজে বার করবোই। আশুবাবুর বাড়িতে আজই যে দেখা হবে এ আশা ছিল না, কিন্তু দৈবাৎ দেখা হয়ে যখন গেল, তখনই জানি ধরে আনবোই। খাওয়ানো একটা ছোট্ট উপলক্ষ,—তাই ওটা শেষ হলেই ছুটি পাবেন না। আজ রাত্রে আপনাকে আমি কোথাও যেতে দেবো না,—এই বাড়িতেই বন্ধ করে রাখবো।
কিন্তু তাতে আপনার লাভ কি?
কমল কহিল, লাভের কথা পরে বলবো, কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ বললে আমি সত্যিই ব্যথা পাই। একদিন ‘তুমি’ বলে ডাকতেন, সেদিনও বলতে আমি সাধিনি, নিজে ইচ্ছে করেই ডেকেছিলেন। আজ সেটা বদলে দেবার মত কোন অপরাধও করিনি। অভিমান করে সাড়া যদি না দিই, আপনি নিজেও কষ্ট পাবেন।
অজিত ঘাড় নাড়িয়া বলিল, তা বোধ হয় পাবো।
কমল কহিল, বোধ হয় নয়, নিশ্চয় পাবেন। আপনি আগ্রায় এসেছিলেন মনোরমার জন্যে। কিন্তু সে যখন অমন করে চলে গেল, তখন সবাই ভাবলে আর একদণ্ডও আপনি এখানে থাকবেন না। কেবল আমি জানতাম আপনি যেতে পারবেন না। আচ্ছা, আমিও যে ভালবাসি এ কথা আপনি বিশ্বাস করেন?
না, করিনে।
নিশ্চয় করেন। তাইতে আপনার বিরুদ্ধে আমার অনেক নালিশ আছে।
অজিত কৌতূহলী হইয়া বলিল, অনেক নালিশ? একটা শুনি।
কমল বলিল, শোনাবো বলেই ত যেতে দিইনি। প্রথমে নিজের কথাটা বলি। উপায় নেই বলে দুঃখী-গরীবদের কাপড় সেলাই করে নিজের খাওয়া-পরা চালাই—এ আমার সয়। কিন্তু দায়ে পড়েচি বলে আপনারও জামা সেলাই করার দাম নেবো—এও কি সয়?
কিন্তু তুমি ত কারও দান নাও না!
না, দান আমি কারও নিইনে, এমন কি আপনারও না। কিন্তু দান করা ছাড়া দেবার কি সংসারে আর কোন পথ খোলা নেই? কেন এসে জোর করে বললেন না, কমল, এ কাজ তোমাকে আমি করতে দেবো না। আমি তার কি জবাব দিতাম? আজ যদি কোন দুর্বিপাকে আমার খেটে খাবার শক্তি যায়, আপনি বেঁচে থাকতে কি আমি পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াবো?
কথাটা ব্যথায় তাহাকে ব্যাকুল করিয়া দিল, বলিল, এমন হতেই পারে না কমল, আমি বেঁচে থাকতে এ অসম্ভব। তোমার সম্বন্ধে আমি একটা দিনও এমন করে ভেবে দেখিনি। এখনো যেন বিশ্বাস হতে চায় না যে, যে কমলকে আমরা সবাই জানি সে-ই তুমি।
কমল কহিল, সবাই যা ইচ্ছে জানুক, কিন্তু আপনি কি কেবল তাদেরই একজন? তার বেশি নয়?
এই প্রশ্নের উত্তর আসিল না, বোধ করি অত্যন্ত কঠিন বলিয়াই; এবং ইহার পরে উভয়েই নীরব হইয়া রহিল। হয়ত অপরকে প্রশ্ন করার চেয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন দুজনেই বেশি করিয়া অনুভব করিল।
কি-ই বা রান্না, শেষ হইতে বিলম্ব হইল না। আহারে বসিয়া অজিত গম্ভীর হইয়া বলিল, অথচ মজা এই যে, যার যত টাকাকড়িই থাকুক তোমার উপার্জনের অন্ন হাত পেতে না খেয়ে কারও পরিত্রাণ নেই। অথচ, নিজে তুমি কারও নেবে না, কারও খাবে না। মাথা খুঁড়ে মরে গেলেও না।
কমল হাসিয়া কহিল, আপনারা খান কেন? তা ছাড়া কবেই বা আপনি মাথা খুঁড়লেন?
অজিত বলিল, মাথা খোঁড়বার ইচ্ছে বহুবারই হয়েছে। আর, তোমার খাই শুধু তোমার জবরদস্তির সঙ্গে পেরে উঠিনে বলে। আজ আমি যদি বলি, কমল, এখন থেকে তোমার সমস্ত ভার নিলাম, এ উঞ্ছবৃত্তি আর ক’রো না, তুমি তখনি হয়ত এমনি কটু কথা বলে উঠবে যে আমার মুখ দিয়ে আর দ্বিতীয় বাক্য বার হবে না।
কমল জিজ্ঞাসা করিল, এ কথা কি বলেছিলেন কোনদিন?
মনে হয় যেন বলেছিলাম।
আর আমি শুনিনি সে কথা?
না।
তা হলে শোনবার মত করে বলেন নি। হয়ত, মনের মধ্যে শুধু ইচ্ছে হয়েই ছিল—মুখ দিয়ে তা প্রকাশ পায়নি।
আচ্ছা, ধর আজই যদি বলি?
তা হলে আমিও যদি বলি,—না।
অজিত হাতের গ্রাস নামাইয়া রাখিয়া কহিল, এই ত! তোমাকে একটা দিনও আমরা বুঝতে পারলাম না। যেদিন তাজের সুমুখে প্রথম দেখি সেদিনও যেমন তোমার কথা বুঝিনি, আজও তেমনি আমাদের সকলের কাছে তুমি রহস্যই রয়ে গেলে। এইমাত্র নিজেই বললে আমার ভার নিন—আবার তখনি বললে, না।
কমল হাসিয়া কহিল, এমনি ধারা একটা ‘না’ আপনি বলুন ত দেখি? বলুন ত যা খেয়েছেন আর কোনদিন খাবেন না,—কেমন আপনার কথা থাকে।
অজিত কহিল, থাকবে কি করে? না খাইয়ে তুমি ত ছেড়ে দেবে না।
কিন্তু এবার কমল আর হাসিল না। শান্তভাবে বলিল, আমার ভার নেবার সময় আজও আপনার আসেনি। যেদিন আসবে, সেদিন আমার মুখ দিয়ে ‘না’ বেরুবে না। রাত হয়ে যাচ্ছে, আপনি খেয়ে নিন।
নিই। সেদিন কখনো আসবে কিনা বলে দিতে পার?
কমল মাথা নাড়িয়া কহিল, সে আমি পারিনে। জবাব আপনাকে নিজেই একদিন খুঁজে নিতে হবে।
সে শক্তি আমার নেই। একদিন অনেক খুঁজেচি কিন্তু পাইনি। জবাব তোমার কাছে পাব, এই আশা করে আজ থেকে আমি হাত পেতে থাকব।
এই বলিয়া অজিত নিঃশব্দে খাইতে লাগিল। খানিক পরে কমল জিজ্ঞাসা করিল, এত জায়গা থাকতে আপনি হঠাৎ হরেন্দ্রর আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলেন কেন?
অজিত কহিল, কোথাও ত থাকা চাই। তুমি নিজেই ত জানো আগ্রা ছেড়ে আমার যাবার জো ছিল না।
জানি তা হলে?
হাঁ, জানো বৈ কি।
আর তাই যদি সত্যি, সোজা আমার কাছে চলে এলেন না কেন?
যদি আসতাম, সত্যিই কি স্থান দিতে?
সত্যি ত আর আসেন নি? সে যাক, কিন্তু হরেন্দ্রর আশ্রমে ত কষ্টের সীমা নেই,—সেই ওদের সাধনা—কিন্তু অত কষ্ট আপনার সইল কি করে?
জানিনে কি করে সইল, কিন্তু আজ আমার ও-কথা মনেও হয় না। এখন ওদেরই আমি একজন। হয়ত, এই আমার সমস্ত ভবিষ্যতের জীবন। এতদিন চুপ করেও ছিলাম না। লোক পাঠিয়ে স্থানে স্থানে আশ্রম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেচি—তিন-চারটি আশ্রমের আশাও পেয়েচি—ইচ্ছে আছে নিজে একবার বার হব।
এ পরামর্শ আপনাকে দিলে কে? হরেন্দ্র বোধ হয়?
অজিত কহিল, যদি দিয়েও থাকেন নিষ্পাপ হয়েই দিয়েছেন। দেশের সর্বনাশ যারা চোখে দেখেচে—এর দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর দুঃখ, এর ধর্মহীনতার গভীর গ্লানি, এর দৌর্বল্যের একান্ত ভীরুতা—
কমল বাধা দিয়া বলিল, হরেন্দ্র এ-সব দেখেছেন অস্বীকার করিনে, কিন্তু আপনার ত শুধু শোনা কথা। নিজের চোখে কোন কিছু দেখবার ত আজও সুযোগ পাননি?
কিন্তু এ সবই ত সত্যি?
সত্যি নয় তা বলিনে, কিন্তু তার প্রতিকারের উপায় কি এই আশ্রম-প্রতিষ্ঠা?
নয় কেন? ভারতবর্ষ বলতে ত শুধু উত্তরে হিমালয় এবং অপর তিনদিকে সমুদ্র-ঘেরা কতকটা ভূখণ্ড মাত্র নয়? এর প্রাচীন সভ্যতা, এর ধর্মের বিশিষ্টতা, এর নীতির পবিত্রতা, এর ন্যায়-নিষ্ঠার মহিমা,—এই ত ভারত, তাই ত এর নাম দেবভূমি,—একে নিরতিশয় হীনতা থেকে বাঁচাবার তপস্যা ছাড়া আর কি কোন পথ আছে? ব্রহ্মচর্যব্রতধারী নিষ্কলুষ ছেলেদের—জীবনে সার্থক হবার—ধন্য হবার—
কমল বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, আপনার খাওয়া হয়েছে, হাত-মুখ ধুয়ে ও-ঘরে চলুন,—আর না।
তুমি খাবে না?
আমি কি দু’বেলা খাই যে আজ খাব? উঠুন।
কিন্তু আশ্রমে আমাকে ত ফিরে যেতে হবে।
না হবে না, ও-ঘরে চলুন। অনেক কথা আমার শোনবার আছে।
আচ্ছা চলো। কিন্তু বাইরে থাকবার আমাদের বিধি নেই, যত রাত্রিই হোক আশ্রমে আমাকে ফিরতেই হবে।
কমল বলিল, সে বিধি দীক্ষিত আশ্রমবাসীদের, আপনার জন্যে নয়।
কিন্তু লোকে বলবে কি?
লোকের উল্লেখে কোনদিনই কমলের ধৈর্য থাকে না, কহিল, লোকেরা আপনাকে শুধু নিন্দেই করবে, রক্ষে করতে পারবে না। যে পারবে তার কাছে আপনার ভয় নেই,—তাদের চেয়ে আমি ঢের বেশি আপনার। সেদিন সঙ্গে যেতে আমাকে ডেকেছিলেন—কিন্তু পারিনি, আজ আর না পারলে আমার চলবে না। চলুন ও-ঘরে, আমাকে ভয় নেই। পুরুষের ভোগের বস্তু যারা আমি তাদের জাত নই। উঠুন।
এ ঘরে আনিয়া কমল সম্পূর্ণ নূতন শয্যা-বস্তু দিয়া খাটের উপর পরিপাটি করিয়া বিছানা করিয়া দিল এবং নিজের জন্য মেঝের উপর যেমন-তেমন গোছের আর একটা পাতিয়া রাখিয়া কহিল, আসচি। মিনিট-দশেকের বেশী দেরি হবে না, কিন্তু ঘুমিয়ে পড়বেন না যেন।
না।
তা হলে ঠেলে তুলে দেব।
তার দরকার হবে না কমল, ঘুম আমার চোখ থেকে উবে গেছে।
আচ্ছা, সে পরীক্ষা পরে হবে,—এই বলিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। রান্নার পাত্রগুলি যথাস্থানে তুলিয়া রাখা, উচ্ছিষ্ট বাসন বারান্দায় বাহির করিয়া দেওয়া, দাসী বহুক্ষণ চলিয়া গেছে,—নীচে সিঁড়ির কবাট বন্ধ করা—গৃহস্থালীর এমনি সব ছোটখাটো কাজ তখনো বাকী, সে-সব সারিয়া তবে তাহার ছুটি।
কমলের সযত্ন-রচিত শুভ্র সুন্দর শয্যাটির ‘পরে বসিয়া একাকী ঘরের মধ্যে হঠাৎ তাহার দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল। বিশেষ কোন গভীর হেতু যে ছিল তাহা নয়, শুধু মনের মধ্যে একটা ভালো-লাগার তৃপ্তি। হয়ত একটু কৌতূহল মিশানো, কিন্তু আগ্রহের উত্তাপ নাই—শুধু একটি শান্ত আনন্দের মধুর স্পর্শ যেন নিঃশব্দে সর্বাঙ্গ পরিব্যাপ্ত করিয়াছে।
অজিত ধনীর সন্তান, আজন্ম বিলাসের মধ্যেই প্রতিপালিত; কিন্তু হরেন্দ্রর ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ভর্তি হওয়া অবধি দৈন্য ও আত্ম-নিগ্রহের সুদুর্গম পথে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের মর্মোপলব্ধির একাগ্র সাধনা এদিক হইতে দৃষ্টি তাহার অপসারিত করিয়াছিল। হঠাৎ চোখে পড়িল হলুদ রঙের সূতা দিয়া তৈরি বালিশের অড়ের চারিধারে ছোট্ট গুটি-কয়েক চন্দ্রমল্লিকা ফুল। বিছানার চাদরের যে কোণটি ঝুলিয়া আছে তাহাতে সাদা রেশম দিয়া বোনা কোন একটি অজানা লতার একটুখানি ছবি। এইটুকু শিল্পকর্ম,—সামান্যই ব্যাপার। কত লোকের ঘরেই ত আছে। অবসরকালে কমল নিজের হাতে সেলাই করিয়াছে। দেখিয়া অজিত মুগ্ধ হইয়া গেল। হাতে করিয়া সেইটি নাড়াচাড়া করিতেছিল, কমল বাহিরের কাজ সারিয়া ঘরে আসিয়া দাঁড়াইতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, বাঃ—বেশ ত!
কমল একটু আশ্চর্য হইল—কি বেশ? ঐ লতাটুকু?
হাঁ আর এই হলদে রঙের ফুলগুলি। তুমি নিজে করেচ, না?
কমল হাসিমুখে বলিল, চমৎকার প্রশ্ন। নিজে নয় ত কি কারিগর ডেকে তৈরি করিয়েছি? আপনার চাই ঐ-রকম?
না না না—আমার চাইনে। আমি কি করব?
তাহার এই ব্যাকুল ও সলজ্জ প্রত্যাখ্যানে কমল হাসিয়া কহিল, আশ্রমে নিয়ে গিয়ে শোবেন। কেউ জিজ্ঞেসা করলে বলবেন, কমল রাত জেগে তৈরি করে দিয়েচে।
দ্যুৎ!
দ্যুৎ কেন? নিজের জন্য এ-সব জিনিস কেউ তৈরি করে না, করে আর-একজনের জন্য। কষ্ট করে ঐ ফুলগুলি যে সেলাই করেছিলাম সে কি আপনি শোবো বলে? একদিন একজন আসবেই,—শুধু তারই জন্যে এ-সব তোলা ছিল। সকালে যখন চলে যাবেন, সমস্ত আপনার সঙ্গে দেব।
এবার অজিত নিজেও হাসিল, কহিল, আচ্ছা কমল, আমি কি এতই বোকা?
কেন?
তুমি আমাকেই মনে করে এ-সব তৈরি করেছিলে এও বিশ্বাস করব?
কেন করবেন না?
করব না সত্যি নয় বলে।
কিন্তু সত্যি বললে বিশ্বাস করবেন বলুন?
নিশ্চয় করব। তোমার পরিহাসের কোন সীমা নেই—কোথাও বাধে না। সেই মোটরে বেড়াবার কথা মনে হলে আমার লজ্জার অবধি থাকে না। সে আলাদা। কিন্তু যা পরিহাস নয়, সে যে তুমি কোন কিছুর জন্যেই মিথ্যে বলতে পারো না, এ আমি জানি।
তা হলে যদি বলি বাস্তবিক পরিহাস করিনি, সত্যি কথাই বলচি, বিশ্বাস করবেন?
নিশ্চয় করব।
কমল কহিল, তা যদি করেন আজ আপনাকে সত্যি কথাই বলব। তখনো রাজেন আসেনি। অর্থাৎ আশ্রমে স্থান না পেয়ে তখনো সে আমার গৃহে আশ্রয় নেয়নি। আমারো ত সেই দশা। আপনারা সবাই যখন আমাকে ঘৃণায় দূর করে দিলেন, এই বিদেশে কারো কাছে গিয়ে দাঁড়াবার যখন আর পথ রইল না,—সেই গভীর দুঃখের দিনের ঐ শিল্পকাজটুকু। সেদিন ঠিক কাকে স্মরণ করে যে করেছিলাম আমি কোনদিন হয়ত জানতে পারতাম না। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ বিছানা পাততে এসে হঠাৎ মনে হ’লো, না না, ওতে নয়। যাতে কেউ কোনদিন শুয়েছে তাতে আপনাকে আমি কোনমতে শুতে দিতে পারিনে।
কেন পারো না?
কি জানি, কে যেন ধাক্কা দিয়ে ঐ কথা বলে দিয়ে গেল। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, হঠাৎ স্মরণ হলো, ঐগুলি বাক্সে তোলা আছে। আপনি তখন বাইরে মুখ ধুচ্ছিলেন, এখনি এসে পড়বেন, তাড়াতাড়ি খুলে এনে পাততে গিয়ে আজ প্রথম টের পেলাম, সেদিন যাকে ভেবে রাত্রি জেগে ফুল-লতা-পাতা এঁকেছিলাম সে আপনি।
অজিত কথা কহিল না। শুধু একটা আরক্ত আভা তাহার মুখের ‘পরে দেখা দিয়া চক্ষের নিমেষে নিবিয়া গেল।
কমল নিজেও কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, চুপ করে কি ভাবচেন বলুন ত?
অজিত কহিল, শুধু চুপ করেই আছি, ভাবতে পারছি নে।
তার কারণ?
কারণ? তোমার কথা শুনে আমার বুকের ভিতর যেন ঝড় বয়ে গেল। শুধুই ঝড়,—না এলো আনন্দ, না এলো আশা।
কমল নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। অজিত ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, কমল, একটা গল্প বলি শোনো। আমার মাকে একবার আমাদের গৃহদেবতা রাধাবল্লভজীউ পূজোর ঘরে মূর্তি ধরে দেখা দিয়েছিলেন, তাঁর হাত থেকে খাবার নিয়ে সুমুখে বসে খেয়েছিলেন,—এ তাঁর নিজের চোখে দেখা। তবুও বাড়ির কেউ আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি। সবাই বুঝলে এ তাঁর স্বপ্ন, কিন্তু এই অবিশ্বাসের দুঃখ তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত যায়নি। আজ তোমার কথা শুনে আমার সেই কথা মনে পড়চে। তুমি তামাশা করোনি জানি, কিন্তু আমার মায়ের মতো তোমারো কোথাও মস্ত ভুল হয়েছে। মানুষের জীবনে এমন বহুকাল যায় নিজের সম্বন্ধে সে অন্ধকারেই থাকে। হয়ত হঠাৎ একদিন চোখ খোলে। আমারও তেমনি। এতদিন পৃথিবীর কত জায়গাতেই ত ঘুরেচি, শুধু এই আগ্রায় এসে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম। আমার থাকার মধ্যে আছে শুধু টাকা, বাবার দেওয়া। এ ছাড়া এমন কিছুই নিজের নেই যে আমারও অজ্ঞাতসারে তুমি আমাকেই ভালবাসতে পার।
কমল কহিল, টাকার জন্যে ভাবনা নেই, আশ্রমবাসীরা একবার যখন সন্ধান পেয়েছে তখন সে ব্যবস্থা তারাই করবে, এই বলিয়া সে হাসিয়া কহিল, কিন্তু অন্য সকল দিকেই যে আপনি এমন নিঃস্ব এ খবর কি ছাই আগে পেয়েছি? তা ছাড়া, ভাল-মন্দ বুঝে দেখবার সময় পেলাম কৈ? মনের মধ্যে শুধু একটা সন্দেহের মতই ছিল,—ঠিকানা পেতাম না,—কেবল এই ত মিনিট-দশেক হ’লো একলা ঘরে বিছানার সুমুখে দাঁড়িয়ে অকস্মাৎ ঠিক খবরটি কে এসে আমার কানে কানে দিয়ে গেল।
অজিত গভীর বিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, সত্যি বলচো মাত্র মিনিট-দশেক? কিন্তু সত্যি হলে এ ত পাগলামি।
কমল বলিল, পাগলামিই ত! তাই ত আপনাকে বলেছিলাম, আমাকে আর কোথাও নিয়ে চলুন। বিবাহ করে ঘর-সংসার করুন, এ ভিক্ষে ত চাইনি?
অজিত অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইল, কহিল, ভিক্ষে বলচ কেন কমল, এ ভিক্ষে চাওয়া নয়, এ তোমার ভালবাসার অধিকার। কিন্তু অধিকারের দাবী তুমি করলে না, চাইলে শুধু তাই যা বুদবুদের মত স্বল্পায়ু এবং তারই মত মিথ্যে।
কমল কহিল, হতেও পারে এর পরমায়ু কম, কিন্তু তাই বলে মিথ্যে হবে কেন? আয়ুর দীর্ঘতাকেই যারা সত্য বলে আঁকড়ে ধরতে চায়, আমি তাদের কেউ নয়।
কিন্তু এ আনন্দের যে কোন স্থায়িত্ব নেই কমল!
না-ই থাক। কিন্তু গাছের ফুল শুকোবে বলে সুদীর্ঘস্থায়ী শোলার ফুলের তোড়া বেঁধে যারা ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখে, তাদের সঙ্গে আমার মতে মেলে না। আপনাকে আরও একবার ঠিক এই কথাই বলেছিলাম যে, কোন আনন্দেরই স্থায়িত্ব নেই। আছে শুধু তার ক্ষণস্থায়ী দিনগুলি। সেই ত মানব-জীবনের চরম সঞ্চয়। তাকে বাঁধতে গেলেই সে মরে। তাই ত বিবাহের স্থায়িত্ব আছে, নেই তার আনন্দ। দুঃসহ স্থায়িত্বের মোটা দড়ি গলায় বেঁধে সে আত্মহত্যা করে মরে।
অজিতের মনে পড়িল ঠিক এই কথাই সে ইহারই কাছে পূর্বে শুনিয়াছে। শুধু মুখের কথা নয়, ইহাই তাহার অন্তরের বিশ্বাস। শিবনাথ তাহাকে বিবাহ করে নাই, ফাঁকি দিয়াছে, কিন্তু এ লইয়া কমল একটা দিনের জন্যও অভিযোগ করে নাই। কেন করে নাই? আজ এই প্রথম দিনের জন্য অজিত নিঃসংশয়ে বুঝিল, এই ফাঁকির মধ্যে তাহার নিজেরও সায় ছিল। পৃথিবী জুড়িয়া সমস্ত মানব-জাতির এই প্রাচীন ও পবিত্র অনুষ্ঠানের প্রতি এতবড় অবজ্ঞায় অজিতের মন ধিক্কারে পূর্ণ হইয়া গেল।
মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া কহিল, তোমার কাছে গর্ব করা আমার সাজে না। কিন্তু তোমার কাছে আর আমি কিছুই গোপন করব না। এঁরা বলেন, সংসারে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করাই পুরুষের সবচেয়ে বড় পুরুষার্থ। বুদ্ধির দিক দিয়ে এ আমি বিশ্বাস করি এবং এ সাধনায় সিদ্ধিলাভের চেয়ে মহত্তর কিছু নেই এ বিষয়েও আমি নিঃসংশয়। কাঞ্চন আমার যথেষ্ট আছে, তাতে লোভ নেই, কিন্তু সমস্ত জীবনে ভালবাসার কেউ নেই, কেউ কখনো থাকবে না, মনে হলে বুক যেন শুকিয়ে ওঠে। ভয় হয়, অন্তরের এ দুর্বলতা হয়ত আমি মরণকাল পর্যন্ত জয় করতে পারবো না। অদৃষ্টে তাই যদি কখনো ঘটে, আশ্রম ত্যাগ করে আমি চলে যাবো। কিন্তু, তোমার আহ্বান তার চেয়েও মিথ্যে। ও ডাকে সাড়া দিতে আমি পারবো না।
একে মিথ্যে বলচেন কেন?
মিথ্যেই ত। মনোরমা সত্যই কখনো আমাকে ভালবাসে নি, তার আচরণ বোঝা যায়, কিন্তু শিবনাথের প্রতি শিবানীর ভালবাসা ত আমি নিজের চোখেই দেখেচি। সেদিন তার যেন আর সীমা ছিল না, কিন্তু আজ তার চিহ্ন পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
কমল কহিল, আজ যদি তা গিয়েই থাকে, সেদিন কি শুধু আমার ছলনাই আপনার চোখে পড়েছিল?
অজিত বলিল, সে তুমিই জানো, কিন্তু আজ মনে হয় নারী-জীবনে এর চেয়ে মিথ্যে বুঝি আর নেই।
কমলের চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল, কহিল, নারী-জীবনের সত্যাসত্য নির্দেশের ভার নারীর ‘পরেই থাক। সে বিচারের দায়িত্ব পুরুষের নিয়ে কাজ নেই—মনোরমারও না, কমলেরও না। এমনি করেই সংসারে চিরদিন ন্যায় বিড়ম্বিত, নারী অসম্মানিত এবং পুরুষের চিত্ত সঙ্কীর্ণ, কলুষিত হয়ে গেছে। তাই এই মিথ্যে-মামলার আর নিষ্পত্তি হতে পেলে না। অবিচারে কেবল একপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না অজিতবাবু, দু’পক্ষেরই সর্বনাশ করে। সেদিন শিবনাথ যা পেয়েছিলেন, দুনিয়ার কম পুরুষের ভাগ্যেই তা জোটে, কিন্তু আজ তা নেই। কেন নেই এই তর্ক তুলে পুরুষের মোটা হাতে মোটা দণ্ড ঘুরিয়ে শাসন করা চলে, কিন্তু ফিরে পাওয়া যায় না। সেদিনের থাকাটা যেমন সত্যি, আজকের না-থাকাটাও ঠিক তত বড়ই সত্যি। শঠতার ছেঁড়া-কাঁথা মুড়ে একে ঢাকা দিতে লজ্জাবোধ করেছি বলে পুরুষের বিচারে এই হলো নারী-জীবনের সবচেয়ে বড় মিথ্যে? এই সুবিচারের আশাতেই আমরা আপনাদের মুখ চেয়ে থাকি?
অজিত উত্তর দিল, কিন্তু উপায় কি? যা এমন ক্ষণস্থায়ী, এমন ভঙ্গুর, তাকে এর বেশী সম্মান মানুষে দেবে কেন?
কমল বলিল, দেবে না জানি। আমার উঠানের ধারে যে ফুল ফোটে তার জীবন একবেলার বেশী নয়। তার চেয়ে ওই মসলা-পেশা নোড়াটা ঢের টিকসই, ঢের দীর্ঘস্থায়ী। সত্য যাচাই করার এর চেয়ে মজবুত মানদণ্ড আপনারা পাবেন কোথায়?
কমল, এ যুক্তি নয়, এ শুধু তোমার রাগের কথা।
রাগ কিসের অজিতবাবু? কেবল স্থায়িত্ব নিয়েই যাদের কারবার, তারা এমনি করেই মূল্য ধার্য করে। আমার আহ্বানে যে আপনি সাড়া দিতে পারেন নি তার মূলেও এই সংশয়। চিরদিনের দাসখত লিখে যে বন্ধন নেবে না, তাকে বিশ্বাস করবেন আপনি কি দিয়ে?ফুল যে বোঝে না তার কাছে ঐ পাথরের নোড়াটাই ঢের বেশি সত্য। শুকিয়ে ঝরে যাবার শঙ্কা নেই, ওর আয়ু একটা বেলার নয়, ও নিত্যকালের। রান্নাঘরের প্রয়োজনে ও চিরদিন রগড়ে রগড়ে মসলা পিষে দেবে—ভাত গেলবার তরকারির উপকরণ—ওর প্রতি নির্ভর করা চলে। ও না থাকলে সংসার বিস্বাদ হয়ে ওঠে।
অজিত তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, এ বিদ্রূপ কিসের কমল?
কমলের কানে বোধ করি এ প্রশ্ন গেল না, সে যেন নিজের মনেই বলিতে লাগিল, মানুষে বোঝে না হৃদয়-বস্তুটা লোহার তৈরী নয়। অমন নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে তাতে ভর দেওয়া চলে না। দুঃখ যে নেই তা নয়, কিন্তু এই তার ধর্ম, এই তার সত্য। অথচ এ কথা বলাও চলে না, স্বীকার করাও যায় না। এর চেয়ে বড় দুর্নীতি সংসারে আর আছে কি? তাই ত কেউ ভেবেই পেলে না শিবনাথকে কি করে আমি নিঃশেষে ক্ষমা করতে পারি। কেঁদে কেঁদে যৌবনে যোগিনী হওয়াটা তাঁরা বুঝতেন, কিন্তু এ তাঁদের সইল না। অরুচি ও অবহেলায় সমস্ত মন তাঁদের তিতো হয়ে গেল। গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে যায়, তার ক্ষত নূতন পাতায় পূর্ণ করে তোলে। এই হলো মিথ্যে, আর বাইরের শুকনো লতা মরে গিয়েও গাছের সর্বাঙ্গ জড়িয়ে কামড়ে এঁটে থাকে, সেই হলো সত্য?
অজিত একমনে শুনিতেছিল, শেষ হইলে সহসা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, একটা কথা আমরা প্রায় ভুলে যাই যে, আসলে তুমি আমাদের আপনার নয়। তোমার রক্ত, তোমার সংস্কার, তোমার সমস্ত শিক্ষা বিদেশের। তার প্রচণ্ড সংঘাত তুমি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারো না। এবং এইখানেই আমাদের সঙ্গে তোমার অহরহ ধাক্কা লাগে। রাত অনেক হলো কমল, এ নিষ্ফল কলহ বন্ধ করো,—এ আদর্শ তোমার জন্যে নয়।
কোন্ আদর্শ? আপনার ব্রহ্মচর্য-আশ্রমের?
অজিত খোঁচা খাইয়া মনে মনে রাগ করিল, কহিল, বেশ তাই। কিন্তু এ গূঢ়তত্ত্ব বিদেশীদের জন্যে নয়। এ তুমি বুঝবে না।
আপনার শাগরেদি করলেও পারবো না?
না।
এবার কমল হাসিয়া উঠিল। যেন সে-মানুষ আর নয়। কহিল,আচ্ছা বলুন ত, কি হলে ঐ সাধুদের আড্ডা থেকে আপনার নাম কাটিয়ে দিতে পারি ?বাস্তবিক, ঐ আশ্রমটা হয়েছে যেন আমার চক্ষুশূল।
অজিত বিছানায় শুইয়া পড়িয়া বলিল, রাজেন্দ্রকে ডেকে এনে তুমি অনায়াসে আশ্রয় দিলে,—তোমার কিছুই বোধ হয় মনে হলো না,—না?
কি আবার মনে হবে?
এ-সব বোধ করি তুমি গ্রাহ্যই করো না?
কি গ্রাহ্য করিনে, আপনাদের মতামত? না।
নিজের সম্বন্ধেও বোধ করি কখনো ভয় করো না?
কমল বলিল, কখনো করিনে তা বলতে পারিনে, কিন্তু ব্রহ্মচারীদের ভয় কিসের?
হুঁ, বলিয়া অজিত চুপ করিয়া রহিল।
হঠাৎ একসময়ে বলিয়া উঠিল, কেঁচো মাটির নীচে অন্ধকারে থাকে, সে জানে বাইরের আলোতে বার হলে তার রক্ষে নেই—তাকে গিলে খাবার অনেক মুখ হাঁ করে আছে। লুকানো ছাড়া আত্মরক্ষার কোন উপায় সে জানে না। কিন্তু তুমি জানো মানুষ কেঁচো নয়। এমন কি মেয়েমানুষ হলেও না। শাস্ত্রে আছে, নিজের স্বরূপটিকে জানতে পারাই পরম শক্তি,— এই জানাটাই তোমার আসল শক্তি, না কমল?
কমল কিছুই না বলিয়া শুধু চাহিয়া রহিল।
অজিত কহিল, মেয়েরা যে বস্তুটিকে তাদের ইহজীবনের যথাসর্বস্ব বলে জানে, সেইখানে তোমার এমন একটি সহজ ঔদাসীন্য যে, যত নিন্দেই করি, সে-ই যেন আগুনের বেড়ার মতো তোমাকে অনুক্ষণ আগলে রাখে। গায়ে লাগবার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এইমাত্র আমাকে বলছিলে পুরুষের ভোগের বস্তু যারা তাদের জাত তুমি নও। আজ রাত্রে তোমার সঙ্গে মুখোমুখি বসে এই কথাটার মানে স্পষ্ট হয়ে আসচে। আমাদের নিন্দে-সুখ্যাতিতে অবজ্ঞা করার সাহস যে তুমি কোথায় পাও, তাও বুঝতে পারচি।
কমল কৃত্রিম বিস্ময়ে মুখ তুলিয়া কহিল, ব্যাপার কি অজিতবাবু, কথাগুলো যে অনেকটা জ্ঞানবানের মত শোনাচ্চে?
অজিত কহিল, আচ্ছা কমল,সত্যি বলো, আমার মতামতও কি অন্য সকলের মতো তোমার কাছে এমনি তুচ্ছ?
কিন্তু এ কথা জেনে আপনার হবে কি?
কমল, নিজেকে শক্তিমান বলে আমি তোমার কাছে কোনদিন অহঙ্কার করিনি। বাস্তবিক, ভিতরে ভিতরে আমি যেমন দুর্বল, তেমনি অসহায়। কোন কিছুই জোর করে করার সামর্থ্য নেই আমার।
কমল হাসিয়া কহিল, সে আমি আপনার চেয়েও ঢের বেশি জানি।
অজিত কহিল, আমার কি মনে হয় জানো? মনে হয় তোমাকে পাওয়াও আমার যেমন সহজ, হারানোও আবার তেমনি সহজ।
কমল বলিল, আমি তাও জানি।
অজিত নিজের মনে মাথা নাড়িয়া বলিল, সেই ত। তোমাকে আজ পাওয়াই ত শুধু নয়, একদিন যদি এমনি করে হারাতেই হয় তখন কি হবে?
কমল শান্তকণ্ঠে কহিল, কিছুই হবে না। সেদিন হারানোও ঠিক এমনি সহজ হয়ে যাবে। যতদিন কাছে থাকবো আপনাকে সেই বিদ্যেই দিয়ে যাবো।
অজিত অন্তরে চমকিয়া উঠিল। বলিল, বিলেতে থাকতে দেখেচি, ওরা কত সহজে, কত সামান্য কারণেই না চিরদিনের মত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মনে ভাবি, কিছুই কি বাজে না? আর এই যদি তাদের ভালবাসার পরিচয়, তারা সভ্যতার গর্ব করে কিসের?
কমল কহিল,অজিতবাবু, বাইরে থেকে খবরের কাগজে যত সহজ দেখেচেন, হয়ত তত সহজ নয়, কিন্তু তবুও কামনা করি নরনারীর এই পরিচয়ই যেন একদিন জগতে আলো-বাতাসের মত সহজ হয়ে যায়।
অজিত নিঃশব্দে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল, কথা কহিল না। তারপর ধীরে ধীরে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া শুইতেই তাহার কি কারণে কোথা দিয়া চোখে জল আসিয়া পড়িল।
হয়ত কমল বুঝিতে পারিল। উঠিয়া আসিয়া শয্যার একপ্রান্তে বসিয়া তাহার মাথার মধ্যে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল, কিন্তু সান্ত্বনার একটা কথাও উচ্চারণ করিল না।
সম্মুখের খোলা জানালা দিয়া দেখা গেল পূবের আকাশ স্বচ্ছ হইয়া আসিয়াছে।
অজিতবাবু, ঘুমোবার বোধ করি আর সময় নেই।
না, এইবার উঠি। এই বলিয়া সে চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিল।