অভিজিৎ
বুড়ো মানুষদের সঙ্গে থাকার একটা দোষ হল, কখন তাদের কী হয় তা নিয়ে ভাবনা থাকে।
সকালবেলায় দেখি, দাদুর মশারি গোটানো। কেমন কেতরে শুয়ে আছে। মাথাটা পড়ে গেছে। বালিশ থেকে। মুখটা হাঁ-করা। একটা মাছিও ভনভন করছে মুখের সামনে।
পরিষ্কার ডেথ-সিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেছেন। স্ট্রোক। মৃত্যু।
পরের দৃশ্যগুলো পরপর ভেসে যাচ্ছিল চোখের সামনে। লোক ডাকো। কাঁদো, যদি সম্ভব হয়। কাধ দাও, পোড়াও।
ডাকলাম, দাদু! দাদু!
পট করে চোখ মেললেন, কী ব্যাপার?
শুয়ে আছেন যে বেলা অবধি?
ও–বলে উঠে বসলেন। কোমরের আলগা কষিটা ঠিক করতে করতে বললেন, আজকাল এটা হয়েছে। মাঝে মাঝে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ি। রাতে ভাল ঘুম হয় না তো! কাজের মেয়েটা আসেনি?
না।
তা হলে আজ হরিমটর। রাঁধবে কে?
আমার বুকটা এখনও ধুক ধুক করছে। বললাম, দরকার হলে আমি রাঁধব। চিন্তার কিছু নেই।
তুমি রাঁধবে? তুমি রাঁধবে কেন? ইস্কুলের দেরি হয়ে যাবে না?
না। স্কুল এগারোটায় বসে।
দাদু প্রগাঢ় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কাল অনেক রাত অবধি আমার ঘুম হয়নি। তোমার নতুন কেনা হ্যারিকেনটায় খুব আলো হয়। চোখে লাগছিল। অভ্যেস নেই কিনা, অত আলো সহ্য হয় না।
বললেন না কেন, নিবিয়ে দিতাম।
তা কেন, পড়াশুনো করছিলে বোধহয়। নতুন চাকরি, তার ওপর মাস্টারি, একটু ঝালিয়ে নেওয়া দরকারও। তাই কিছু বলিনি।
আমি বললাম, দু ঘরের মাঝখানের দরজাটায় কপাট নেই। থাকলে লাগিয়ে দিতাম।
কপাট দুটো ঘুণে ধরে পচে গেল। আমি আর লাগাইনি। কী দরকার? ও ঘরটায় তো কেউ থাকে না।
এখন আমি থাকব। কপাট আমিই লাগিয়ে নেবখন।
দাদু মাথা নেড়ে বলেন, তারও দরকার নেই। তুমি থাকবে, আমিই হয়তো থাকব না। কপাট দিয়ে তখন কী করবে?
কথাটা ভেবে দেখার মতো। আমি আর কী বলব?
দাদু বললেন, সাইকেলও তত বোধহয় একটা নো দরকার। গণেশেরটা বোধহয় আর বেশিদিন দেবে না, না?
চাইলে দেবে, কিন্তু তার দরকার কী? কিনেই ফেলব একটা।
নতুন চাকরি। টাকা পয়সা হাতে আসতে না আসতেই মোটা খরচ। সামলাতে পারবে?
হয়ে যাবে কোনওরকম।
মা-বাবাকেও কিছু পাঠাতে হবে তো।
ও নিয়ে ভাববেন না।বলে আমি রান্নাবান্নার জন্য রওনা হচ্ছিলাম।
দাদু বললেন, এক কাজ করো। আমার তেমন খিদে নেই। আজ বোধহয় একাদশীও। ছোট পঞ্জিকাটা দেখো তো।
আমি দেখলাম। একাদশীই।
দাদু বললেন, তা হলে এ বেলা গণেশের বাড়িতেই খেয়ে স্কুলে রওনা হয়ে যাও। প্রথম প্রথম পাচুয়াল হওয়া ভাল। দেরি হলে কে কী বলবে।
রোজ ওদের বাসায় যাচ্ছি।
আদর করেই তো খাওয়ায়।
তা অবশ্য করে। তবু রোজ খাওয়া ভাল নয়।
রোজ না হয় নাই খেলে, আজকের দিনটা চালিয়ে দাও। কাল কাজের মেয়েটাও এসে যাবে।
আমি বিরক্ত হয়ে বলি, মেয়েটা কি এমনি কামাই মাঝে মাঝে করে?
করে। তা আমার অসুবিধে হয় না। চালিয়ে নিই। অসুবিধে তোমাদের।
তাই দেখছি।
যতটা বীরত্বের সঙ্গে রান্না করতে রাজি হয়েছিলাম, কাঠের উনুন ধরাতে গিয়ে তা ফানটুস হয়ে গেল। স্টোভ এ বাড়িতে নেই, দাদু তা কিনবেনও না। বাড়িতে শুকনো ডালপালা, পাতানাতার অভাব নেই। এসব ইন্ধন থাকতে পয়সা দিয়ে জ্বালানি কেনে কোন আহাম্মক!
মোটামুটি একটা ডাল ভাত নামাতেই আমার দম বেরিয়ে গেল, স্কুলেরও বেলা প্রায় যায় যায়।
দাদু দূর থেকে সবই লক্ষ করছেন। আমি খেতে বসার পর বললেন, আজ পারলে বটে, কিন্তু রোজ পারবে না। কাজের মেয়েটা আজকাল ঘরের কাজ করতে চায় না। ঠিকাদারের মজুর খাটলে অনেক বেশি পায়। কাজের লোকের খুব অভাব।
আমি গোগ্রাসে গিলতে গিলতে বললাম, কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশে ঝি চাকর বলে কেউ থাকে না। উন্নত দেশগুলিতেও নেই।
তাই নাকি?–দাদু চিন্তিতভাবে বললেন।
আমি বললাম, ভাববেন না। দুদিনে এসব অভ্যাস হয়ে যাবে। কাল আমি একটা স্টোভ কিনে আনব।
স্টোভ!-দাদু চোখ কপালে তুললেন, আবার স্টোভ কেন?
ভয় পাবেন না। রোজ জ্বালাব না, যেদিন কাজের মেয়ে আসবে না, শুধু সেদিন।
খুব খরচের হাত তোমার। এটা ভাল নয়।
যা দরকার তা তো কিনতেই হবে।
তা বলে একসঙ্গে এত! এই তো হ্যারিকেন কিনলে, সাইকেলও কিনবে বলছ, আবার স্টোভ!
খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বললাম, আপনার আজ খেতে কষ্ট হবে। শুধু ডাল ভাত আর সেদ্ধ।
যথেষ্ট। আমি তো শুধু সেদ্ধ দিয়ে খাই। আজ তবু ডাল হয়েছে।
আমি গণেশকাকার কাছ থেকে ধার করে আনা সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেশি সময় নেই।
নতুন চাকরির একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে। নিতান্তই মাস্টারি যদিও। তবু এই প্রথম নিজেকে খানিকটা মূল্য দেওয়া যাচ্ছে। একেবারে ফালতু, পরনির্ভরশীল, শিকড়হীন তো আর নই। কিছু একটা করছি, কাজে লাগছি।
আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী তা আমি জানি। শিষ্ট আমি নই, শান্তও নই। কোনওকিছুই আমি সহজে মেনে নিইনা। শিবপ্রসাদ স্কুলে ঢুকেই আমি টের পেয়েছি, এই স্কুলে গভীর গণ্ডগোল আছে। ধীরে ধীরে সেগুলি আমাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। তারপর জোট বাঁধা। পারিজাত জানে না, কী একখানা টাইমোমা যে শিবপ্রসাদ স্কুলে স্থাপন করেছে। এর জন্য তাকে নাস্তানাবুদ হতে হবে।
আমি যেদিন প্রথম স্কুলে জয়েন করি সেদিন কিছু লোক এসে বাইরে থেকে খুব শ্লোগান দিল। কমলা সেনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ব্যর্থ করো। অসীমা দিদিমণি গদি ছাড়ো। পারিজাতের মুণ্ডু চাই।
সবাই বারণ করা সত্ত্বেও আমি ফটকের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাদের লক্ষ করলাম। এরা কারা তা বুঝলাম না। তবে মনে হল এরা নিশ্চয়ই জনসাধারণের প্রতিনিধি নয়। ভাড়াটে লোক হওয়াই সম্ভব।
তিনদিন বাদে স্ট্রাইক হয়ে গেল। কমলা সেনের পদত্যাগের প্রতিবাদে।
গণ্ডগোলের আঁচটা প্রথম থেকেই টের পাচ্ছি। বলতে কী, গণ্ডগোলের জায়গাই আমার প্রিয়। এই আমার স্বক্ষেত্র, এই আমার ইনসেনটিভ।
একদিন অসীমাদি ডেকে পাঠিয়েছিলেন তার ঘরে।
মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগছে কাজ করতে?
ভালই।–নিস্পৃহ গলায় বললাম। আমার চাকরি হওয়ার পিছনে ওঁর একটু হাত আছে। কিন্তু তা বলে কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হওয়ারও মানে হয় না। স্কুলের হেডমাস্টার বা হেডমিসট্রেসের পদটিই একটি কায়েমি স্বার্থের সুযোগ। ভবিষ্যতে হয়তো ওঁর বিরুদ্ধে আমাকে লড়তে হবে। মনটাকে বেশি কৃতজ্ঞতার মাখন মাখিয়ে রাখলে অনেক ফ্যাচাং।
উনি অবশ্য আমার মুখভাব তেমন করে লক্ষ করলেন না। কেমন যেন অন্যমনস্ক, বিপন্ন মুখভাব। হতেই পারে। কমলা সেন নাকি খুব ভাল অ্যাডমিনস্ট্রেটর ছিলেন। তাকে হটিয়ে ইনি এসেছেন। আর এই রদবদলের মূলে আছে পারিজাত। টিচার্সরুমে বসে প্রায় সারাদিনই এসব কথা হয়। কাজেই সাবধান হওয়া ভাল। লোকে যাতে ধরে না নেয় যে, আমি অসীমা বা পারিজাতের লোক। আমি তা নইও।
অসীমা দিদিমণি আমার দিকে আনমনে চেয়ে বললেন, স্কুলে খুব গণ্ডগোল হচ্ছে, তাই না? এর মধ্যে এসে নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে!
না। গণ্ডগোল হতেই পারে।
অসীমাদি একটু চুপ করে চেয়ে থেকে বললেন, আমার ভাল লাগে না। স্কুলটা চিরকাল শান্ত ছিল। কোনও গণ্ডগোল ছিল না। এখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব লোক এসে বিশ্রী শ্লোগান দেয়, ঢিল ছেড়ে। ছেলেমেয়েরা ভয় পায়।
আমি দোনোমোনো করে বলি, ওই লোকগুলো কারা তা আপনি জানেন?
কারা আর হবে? পাবলিক।
আমার সন্দেহ থেকে গেল। কমলা সেনের পদত্যাগ যদি অবৈধ বা অন্যায় কিছু হয়ে থাকে তবে আইন-আদালত আছে। আর পাবলিকের আন্দোলন ঠিক এরকম প্রকৃতির হয় না। বেশিরভাগ স্কুলেই এরকম কিছু অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থাকে। তাতে বাইরে থেকে রোজ ঢিল পড়ার কারণ নেই। আন্দোলন আমি কিছু কম করিনি।
পরদিন লোকগুলো আবার এল। আমি এবার ফটক খুলে বেরিয়ে সোজা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। জনা ত্রিশেক লোক। আমাকে মুখোমুখি দেখে কেমন একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
আমি তাদের চ্যালেঞ্জ করতে যাইনি। তবে হাতজোড় করে বললাম, আমাকে কিছু বলতে দিন।
লোকগুলো সম্মতি বা অসম্মতি কিছুই প্রকাশ করল না। আমি স্কুলের সামনে একটা কালভার্টের ওপর দাঁড়িয়ে স্ট্রিট কর্ণার করা অভ্যস্ত গলায় আধঘণ্টা ধরে একটা চোস্ত ভাষণ দিলাম। তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। পুলিশ লেলিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিতও ছিল।
কাজ হল। দুদিন যাবত তারা আসছে না।
টিচার্স রুমে যারা একদম পাত্তা দিত না তারা এখন কথাটথা বলছে।
স্কুলটা আমার ভালই লাগছে। বেশ বড় স্কুল। হাজার খানেকেরও বেশি ছাত্রছাত্রী, ডিসিপ্লিন চমৎকার। ক্লাস বাগে আনতে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয় না।
আজ স্কুল শুরু হওয়ার মুখেই অসীমাদি ডেকে পাঠালেন।
পারিজাত আপনাকে একটু ডেকে পাঠিয়েছে। জরুরি দরকার।
আমাকে!–আমি একটু ভ্রু কোচকাই। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগল না।
সেক্রেটারির বাড়িতে গেলে এখন ঘটনাটা অন্যরকম দেখাবে। কিন্তু ডাকলে যেতেই হয়। বললাম, কখন?
আজই। খুব দরকার বলছিল।
অগত্যা।
পারিজাত আজও জরুরি মিটিং করছিল। সুতরাং আমাকে উমেদারের মতোই অপেক্ষা করতে হল বাইরে। আমি আগের দিনের মতোই একটা কুঞ্জবনে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। আজ অবশ্য রুমা নেই। একা আমি।
একটু বাদেই দারোয়ান এসে ডেকে নিয়ে গেল।
পারিজাত একটু ভোম হয়ে আছে। খুব মানসিক ব্যস্ততার মধ্যে থাকলে মানুষের মুখেচোখে যেন একটা আস্তরণ পড়ে যায়। তবে আমাকে দেখে ছুরির ফলার মতো ঝিকিয়ে উঠল তার হাসি, এই যে হিরো, এসো, এসো। বোসো।
আমি বসতে বসতে বললাম, হিরো কীসের?
শুনলাম, অধরের ভাড়াটে লোকজনকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছ! সত্যি নাকি?
কার ভাড়াটে লোক?
একজন নমস্য ব্যক্তির। অধর বিশ্বাস।
আমার ভিতরে একটু টিকটিক আওয়াজ হল। অধর বিশ্বাস। সেই সাইক্লিস্ট! মস্তান!
বললাম, ঠিক জানেন?
পারিজাত হাসল। বলল, জানি। কিন্তু এর বেশি হিরো হতে যেয়ো না। বিপদে পড়বে।
আমার ইচ্ছে হয়েছিল, জামার কলারটা একটু তুলে দিই। তার বদলে খুব আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে একটু হাসলাম। প্রথাসিদ্ধ মস্তানদের দিন কবেই শেষ হয়ে গেছে। এক সময়ে খুদে খুদে নকশাল ছেলেদের ভয়ে তাদের আমি প্রাণভয়ে পালাতে দেখেছি।
পারিজাত আমার মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্টই আমার ভিতরটা দেখে নিয়ে বলল, তুমি অবশ্য নকশাল ছিলে। ভয়ডর কিছু কম। তাই না?
আমি গোমড়া মুখ করে রইলাম।
পারিজাত খুব আস্তে করে বলল, নিমকহারাম।
আমি ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো চমকে উঠে বলি, কী বললেন?
নিমকহারাম।
তার মানে?
লজ্জা করে না?
কী বলছেন স্পষ্ট করে বলুন।
হৃদয়হীন। অকৃতজ্ঞ।
আমি চটে উঠে বলি, খামোখা গালমন্দ করছেন কেন?
করা উচিত বলে।
আমি কী করেছি?
এই ঘোরতর বেকার সমস্যার যুগে তুমি একটা ভদ্র চাকরি পেয়েছ।
তাতে কী হল?
চাকরিটা পেয়েছ আর একজনের বদান্যতায়।
সে আবার কে?
যাক, অকৃতজ্ঞতা তাহলে ডিপ রুটেড! এর মধ্যে তাকে ভুলতেও শুরু করেছ! অ্যাঁ।
আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই নোকটার অদ্ভুত আচরণে। কিন্তু তেজের গলায় বলি, আমি কারও বদান্যতার ধার ধারি না।
ধারো না, তার কারণ তুমি জেনুইন অকৃতজ্ঞ।
আমি অকৃতজ্ঞ নই।
পারিজাত চট করে তার টেম্পোটাকে একটু নামিয়ে এনে বলে, নও?
না।
তুমি তোমার দেশকে ভালবাসো? জনগণকে?
এ প্রশ্ন অবান্তর।
পারিজাতের দুটো চোখ চিকচিক করতে থাকে। বলে, যারা শ্রেণিশত্রু নয় তাদের কথা বলছি। তাদের ভালবাসতে তো অসুবিধে নেই?
আমি আপনার কথা ধরতে পারছি না।
ধরার দরকার নেই। যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দিয়ে যাও না।
আপনি আমাকে প্যাঁচে ফেলতে চান বলে মনে হচ্ছে।
বুদ্ধি তো বেশ টনটনে দেখছি।
আমি নির্বোধ নই, আপনিও জানেন।
জানি, হাড়ে হাড়ে জানি। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টায় তুমি তিন-তিনজন কঠোর মহিলার স্ট্রং রেকমেনডেশন জোগাড় করে ফেলেছিলে।
ও কথা থাক। কাজের কথায় আসুন।
আমি কাজের কথাই বলছি। তুমি জনগণ এবং সর্বহারাদের ভালবাসো কি না।
হয়তো বাসি।
তুমি একটা চাকরি পেয়েছ কি না।
পেয়েছি।
তা হলে?
তা হলে কী?
জনগণের প্রতি তোমার কোনও কর্তব্য আছে কি না।
সব সময়েই আছে।
পারিজাত একটু ঝুঁকে বসে আমার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে থেকে বলে, জনগণের মধ্যে বিশেষ একজন তোমার জন্য অনেকটাই ত্যাগ স্বীকার করেছিল। প্রায় আত্মোৎসর্গ। মনে পড়ে?
সে কে?
তাকে ভুলে যাওয়াটা অপরাধ অভিজিৎ।
আমি বিরক্ত মুখে বলি, আপনি কি প্রতিমার কথা বলছেন?
পারিজাত একটা শ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দেয়। মৃদু স্বরে বলে, যাক। নামটা অন্তত মনে আছে।
প্রতিমার কী হয়েছে?–আমি জিজ্ঞেস করি।
কী হবে? একজন নিম্ন-মধ্যবিত্তের যুবতী মেয়েদের জীবনে কী আর হয়? কিছুই হয় না। তারা বসে থাকে। অপেক্ষা করে। চাকরি বা বিয়ে কিছু একটা আশা করতে থাকে। শেষ অবধি হয়তো কোনওদিনই হয় না। তুমি কি জানো, বেকার সমস্যার মতো এইসব অনূঢ়া কন্যাদেরও একটা বিশাল সমস্যা রয়েছে এ দেশে?
জানব না কেন? আমারও দুটো বোনের বিয়ে বাকি।
তুমি জানো যে, বেকার সমস্যা এবং অনুঢ়া সমস্যা দুটোই কো-রিলেটেড?
তাই নাকি?
ন্যাকামো কোরো না অভিজিৎ। বুদ্ধিমান ছেলেদের এটা জানার কথা যে, দেশে এত বেকার না থাকলে মেয়েদের বরের অভাব হত না।
তা বটে।
তুমি কি জানো, উপযুক্ত পাত্রদের সংখ্যা কম বলেই দেশে একটা দুষ্ট পণপ্রথা ক্রমেই প্রসারলাভ করছে? এবং বেকার সমস্যা, বিয়ে ও পণপ্রথা এই তিনটেই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত? জানো?
বোধহয়।
তা হলে?
তা হলে কী?
এখন চাকরি পাওয়ার পর তোমার কর্তব্য কী হওয়া উচিত?
আমি বোকার মতো চেয়ে থাকি। লোকটা বাস্তবিকই পাজির পা-ঝাড়া। তবু একে আমি ঘেন্না করতে পারছি না, এর ওপর রেগে উঠতে পারছি না। হঠাৎ হেসে ফেলে বললাম, কিছু কর্তব্য করতে হবে নাকি কারও প্রতি?
দায়িত্বশীলদের তো সেটাই মোটো হওয়া উচিত। তুমি নিজে উঠে গেছ, এবার আর একজনকেও টেনে তোলো।
কী করতে হবে?
ভেবে দেখো। আমি ফোর্স করতে চাই না।
ফোর্স করলেও লাভ নেই। কেউ ফোর্স করে কখনও আমাকে দিয়ে কিছু করাতে পারেনি।
পারিজাত একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, মডার্ন ওয়ারফেয়ার সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা নেই বলে ওকথা বলছ। এ যুগে বুদ্ধিমান লোকেরা ফোর্স কীভাবে অ্যাপ্লাই করে জানো?
খানিকটা জানি!
কিছুই জানো না। তোমাকে কখনও সেই যুদ্ধে নামতে হয়নি।
আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
দেখাচ্ছি। কিন্তু লক্ষ করছি, তুমি ভয় পাচ্ছ না।
আমি হেসে ফেলি, বলি, না, পাচ্ছি না।
তা হলে আমাকে স্ট্র্যাটেজি বদলাতে হয়।
কীরকম?
একবার প্রতিমার সঙ্গে দেখা করে অন্তত একটা হ্যালো বলে এসো। এটুকু ওর পাওনা। বেচারা মহৎ হওয়ার জন্য চাকরি থেকে সরে দাঁড়াল অথচ সেই মহত্ত্বটুকু কেউ স্বীকার করল না। এটা নিষ্ঠুরতা অভিজিৎ।
আমি রাগ করে উঠে পড়লাম। বললাম, আর কোনও কথা নেই তো?
সে সব পরে হবে।
আমি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে সাইকেলে উঠে ঝড়ের বেগে সেটাকে চালাতে লাগলাম। এসব কী হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি। ষড়যন্ত্র! প্ল্যান! ফাঁদে ফেলার চেষ্টা!
আমি মউডুবির দিকে অর্ধেক পথ গিয়েও আচমকা সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিই।
দরজা খুলল প্রতিমা। ম্লানমুখী। কয়েকদিনেই যেন কৃশকায়া। বিষণ্ণ। কিছু বলল না প্রথমে। ভাসা ভাসা বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। ওর চোখ বলল, এতদিন কোথায় ছিলেন?
ফেরার পথে ধীরে ধীরে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। খুব ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে আপনমনে একটু করে হেসে উঠছি আমি। কী হল আমার হঠাৎ? কী হল? যাঃ! পাগল, পাগল, দুনিয়াটাই পাগল!