বিয়ের পর দু’মাস কেটে গেল
দেবাশিস আর দীপার বিয়ের পর দু’মাস কেটে গেল। যেদিনের ঘটনা নিয়ে কাহিনী আরম্ভ হয়েছিল, সেই যেদিন দেবাশিস ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে এসে দীপকে সিনেমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দীপা যায়নি, দীর্ঘ পশ্চাদ্দৃষ্টির পর আমরা সেইখানে ফিরে এলাম।
দেবাশিস পায়ে হেঁটে নৃপতির বাড়ির দিকে যেতে যেতে মাঝ-রাস্তায় থমকে দাঁড়াল। তার মনটা তিক্ত হয়েই ছিল, এখন নৃপতির বাড়িতে গিয়ে হালকা ঠাট্টা-তামাশা উদ্দেশ্যহীন গল্পগুজব করতে হবে, প্রবালের পিয়ানো বাজনা শুনতে হবে ভাবতেই তার মন বিমুখ হয়ে উঠল। অনেক দিন পড়াশুনো করা হয়নি, অথচ তার যে কাজ তাতে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা সম্বন্ধে পৃথিবীর কোথায় কি কাজ হচ্ছে সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। তার কাছে কয়েকটা বিলিতি বিজ্ঞান-পত্রিকা নিয়মিত আসে, কিন্তু গত দু’মাস তাদের মোড়ক পর্যন্ত খোলা হয়নি। দেবাশিস আবার বাড়ি ফিরে চলল। আজ আর আড্ডা নয়, আগের মত সন্ধ্যেটা পড়াশুনো করেই কাটাকে।
দীপা রেডিও চালিয়ে দিয়ে চোখ বুজে। আরাম-চেয়ারে বসে ছিল, দেবাশিসকে ফিরে আসতে দেখে রেডিও বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল, উদ্বিগ্ন প্রশ্নভরা চোখে তার পানে চাইল। দেবাশিস যথাসম্ভব সহজ গলায় বলল—’ফিরে এলাম। অনেক দিন পড়াশুনো হয়নি, আজ একটু পড়ব।’
টেলিফোন টেবিলের নীচের থাকে বিলিতি পত্রিকাগুলো জমা হয়েছিল দেবাশিস সেগুলো নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল; সেখানে পত্রিকার মোড়ক খুলে তারিখ অনুযায়ী সাজাল, তারপর বিছানায় শুয়ে পিঠের নীচে বালিশ দিয়ে পড়তে আরম্ভ করল।
ওঘরে দীপা আস্তে আস্তে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গ্ৰীষ্মের সন্ধ্যা দ্রুত নিবিড় হয়ে আসছে। পদ্মলোচন বাগানে জল দিচ্ছে। আজ দীপা বাগানে যায়নি। বিকেলবেলা সে সিনেমায় যাবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর দেবাশিস আহত লাঞ্ছিত মুখে চলে গেল, দীপার মনটাও কেমন একরকম হয়ে গেল। যত দিন যাচ্ছে তার জীবনটা এমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে যে, মনে হয় কোনো দিনই এ জট ছাড়ানো যাবে না। মনের মধ্যে একটা নতুন সমস্যা জন্ম নিয়েছে, তার কোনো সমাধান নেই।
বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে, পদ্মলোচন বাগানের কাজ শেষ করে চলে গেল। দীপা তখন জানলা থেকে ফিরে নিঃশব্দে দেবাশিসের ঘরের দিকে গেল। দেবাশিস তখন আলো জ্বেলেছে, বিছানায় বালিশ ঠেসান দিয়ে পড়ায় নিমগ্ন। দীপা কিছুক্ষণ দোরের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকাল; কিন্তু দেবাশিস তাকে দেখতে পেল না। দীপা তখন একেবারে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দেবাশিস চমকে চোখ তুলল।
দীপা বলল–’চা খাবে?’
দেবাশিস একটু হাসল। দীপা বিকেলবেলার রূঢ়তার জন্যে অনুতপ্ত হয়েছে। সে বলল—’তুমি যদি খাও আমিও খাব।’
‘এক্ষুনি আনছি।’ দীপা হরিণীর মত ছুটে চলে গেল। দেবাশিস কিছুক্ষণ দোরের দিকে চেয়ে থেকে আবার পড়ায় মন দিল।
দীপ রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, নকুল রান্না চড়িয়েছে। সে বলল—’নকুল, তুমি সরো, আমি চা তৈরি করব।
নকুল বলল—’চা তৈরি করবে? দাদাবাবু খাবেন বুঝি? তা তুমি কেন করবে বউদি, আমি করে দিচ্ছি।’
‘না, আমি করব। তুমি সরো।’
নকুল মনে মনে খুশি হল—’আচ্ছা বউদি, তুমিই কর।’
নকুলের ছায়াচ্ছন্ন মন অনেকটা পরিষ্কার হল। এই দু’মাস দেখেশুনে তার ধারণা জন্মেছিল, গোড়াতে কোনো কারণে এদের মনের মিল হয়নি, এখন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসছে। ঘি আর আগুন। একসঙ্গে কত দিন ঠাণ্ডা থাকবে!
দীপা চা তৈরি করে ট্রে-র ওপর টি-পাট, দু’টি পেয়ালা প্রভৃতি বসিয়ে ওপরে উঠে গেল, বসবার ঘরে ট্রে রেখে দেবাশিসের দোরের কাছে এসে বলল–’চা এনেছি।’
দেবাশিস তৎক্ষণাৎ উঠে এসে চায়ের টেবিলে বসিল। দীপা চা পেয়ালায় ঢেলে একটি পেয়ালা দেবাশিসের দিকে এগিয়ে দিল, নিজের পেয়ালাটি হাতে তুলতে গিয়ে খানিকটা চা চলকে পিরিচে পড়ল।
আজ দেবাশিস হঠাৎ ফিরে আসার পর দীপার শরীরটাও যেন শাসনের বাইরে চলে গেছে। থেকে থেকে বুকের মধ্যে আনচান করে উঠছে, মাথার মধ্যে যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, কান্নায় গলা বুজে আসছে। সে কাঁদুনে মেয়ে নয়, এত দিনের দীর্ঘ পরীক্ষায় সে পরম দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তীৰ্ণ হয়েছে। তবে আজ তার এ কী হ’ল?
এক চুমুক চা খেয়ে দেবাশিস বলল—’আঃ! খাসা চা হয়েছে। কে করল-নকুল?’
‘না—আমি।’ দীপার গলাটা কেঁপে গেল, মনে হল শরীরের অস্থিমাংস নরম হয়ে গেছে। সে আস্তে আস্তে বসে পড়ল।
দেবাশিস আর কিছু বলল না, কেবল একটু প্রশংসাসূচক হাসল। দীপা দু’ চুমুক চা খেয়ে নিজেকে একটু চাঙ্গা করে নিল, তারপর যেন গুনে গুনে কথা বলছে এমনিভাবে বলল—’কাল তুমি আমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে?’
দেবাশিস চকিত চোখে তার পানে চাইল, ক্ষণেক নীরব থেকে বলল–’তোমার যদি ইচ্ছে না। থাকে, আমার মন রাখার জন্যে সিনেমা দেখার দরকার নেই।’
‘না, আমি দেখতে চাই।’ চায়ের পেয়ালা শেষ করে দেবাশিস উঠে দাঁড়াল–’বেশ, তাহলে নিয়ে যাব।’ দেবাশিস নিজের ঘরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছে এমন সময় ঘরের কোণে টেলিফোন বাজল।
দীপার বুক আশঙ্কায় ধকধক করে উঠল। কার টেলিফোন!
দেবাশিস গিয়ে টেলিফোন ধরল–’হ্যালো।’
অন্য দিক থেকে কে কথা বলছে, কী কথা বলছে, দীপা শুনতে পেল না, কেবল দেবাশিসের কথা একাগ্র হয়ে শুনতে লাগল, ‘ও…কী খবর?…না, আজ বাড়িতেই আছি…না, শরীর ভাল আছে…এখন?…ও বুঝেছি, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি…না না, কষ্ট কিসের…আচ্ছা—‘
টেলিফোন নামিয়ে রেখে দেবাশিস কব্জির ঘড়ির দিকে তাকালো, আটটা বেজে গেছে। ‘আমাকে একবার বেরুতে হবে। হেঁটেই যাব। আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।’
সে বেরিয়ে গেল। দীপা কোনো প্রশ্ন করল না; সে জানতে পারল না, দেবাশিস কোথায় যাচ্ছে। একলা বসে বসে ভাবতে লাগল, কে দেবাশিসকে টেলিফোন করেছিল?
দেবাশিস আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরল না। তারপর আরো কিছুক্ষণ কেটে গেল। নকুল নীচে থেকে এসে বলল–’হ্যাঁ বউদি, দাদাবাবু কোথায় গেল? কখন ফিরবে?’
দীপা বলল—’তা তো জানি না নকুল। কোথায় গেছেন বলে যাননি, শুধু বললেন আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরবেন।’
নকুল বলল–’আধা ঘণ্টা তো কখন কেটে গেছে। খাবার সময় হল। কখনো তো এমন দেরি করে না।’ নকুল চিন্তিতভাবে বিজবিজ করতে করতে নীচে নেমে গেল।
একজনের উদ্বেগ অন্যের মনে সঞ্চারিত হয়। দীপার মনও উৎকণ্ঠায় ভরে উঠল; নানারকম বাস্তব-অবাস্তব সম্ভাবনা তার মাথার মধ্যে উকিঝুঁকি মারতে লাগল।
নটা বেজে পাঁচ মিনিটে টেলিফোন বেজে উঠতেই দীপা চমকে উঠে দাঁড়াল, ভয়ে ভয়ে গিয়ে টেলিফোন তুলে কানো ধরল, ক্ষীণস্বরে বলল—’হ্যালো।’
অপর প্রাস্ত থেকে স্বর এল–’আমি। গলা শুনে চিনতে পারছ?’
দীপার গলার আওয়াজ আরো ক্ষীণ হয়ে গেল–’হ্যাঁ।’
‘তোমার স্বামী বাড়িতে আছে?’
‘না।‘
‘খবর সব ভাল?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার স্বামী কোনো গোলমাল করেনি?’
‘না।‘
‘তুমি যেমন ছিলে তেমনি আছ?’
‘হাঁ।’
‘আমার নাম কাউকে বলনি?’
‘না।‘
‘মা কালীর নামে দিব্যি করেছ, মনে আছে?’
‘আছে।’
‘আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত। সাবধানে থেকে। আবার টেলিফোন করব।’
দীপার মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না, সে টেলিফোন রেখে আবার এসে বসল; মনে হল, তার দেহের সমস্ত প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেছে। দুহাতে মুখ ঢেকে সে চেয়ারে পড়ে রইল।
সাড়ে ন’টার সময় নকুল আকার এসে বলল—বউদি, দাদাবাবু এখনো এল না, আমার ভাল ঠেকছে না—‘
এই সময় তৃতীয় বার টেলিফোন বাজল। দীপার মুখ সাদা হয়ে গেল; সে সমস্ত শরীর শক্ত করে উঠে গিয়ে ফোন ধরল। মেয়েলী গলার আওয়াজ শুনল–’হ্যালো, এটা কি দেবাশিস ভট্টের বাড়ি?’
দীপার বুক ধড়ফড় করে উঠল, সে কোনো মতে উচ্চারণ করল—’হ্যাঁ।’
‘আপনি কি তাঁর স্ত্রী?’
‘হ্যাঁ।’
‘দেখুন, আমি হাসপাতাল থেকে বলছি। আপনি একবার আসতে পারবেন?’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘ইয়ে-আপনার স্বামীর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। আপনি চট্ করে আসুন।’
দীপার মুখ থেকে বুক-ফাটা প্রশ্ন বেরিয়ে এল—’বেঁচে আছেন?’
‘হ্যাঁ। এই কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান হয়েছে।’
‘আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। কোন হাসপাতাল?’
‘রাসবিহারী হাসপাতাল, এমারজেন্সি ওয়ার্ড।’
ফোন রেখে দিয়ে দীপা ফিরল; দেখল, নকুল তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নকুল ব্যাকুল চোখে চেয়ে বলল–’বউদি?
নকুলের শঙ্কা-বিবশ মুখ দেখে দীপা হঠাৎ নিজের হৃদয়টাও দেখতে পেল। আজকের দীপা আর দু’ মাস আগের দীপা নেই, সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। তার মাথাটা একবার ঘুরে উঠল। তারপর সে দৃঢ়ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল—’তোমার দাদাবাবুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’
নকুল আস্তে আস্তে মেঝের ওপর বসে পড়ল। দীপা বলল—’না নকুল, এ সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। চল, এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে।’
দীপা নকুলকে হাতে ধরে টেনে দাঁড় করালো।