পরদিন দেবাশিস একটু দেরি করে এল
পরদিন দেবাশিস একটু দেরি করে এল। ইচ্ছে ছিল সাড়ে আটটা নটা পর্যন্ত থেকে গল্পগুজব করবে। বাড়িতে রোজ সন্ধ্যেবেলা একলা বিজ্ঞানের বই আর সাময়িক পত্র পড়ে কাটে, এখানে নতুন লোকের সঙ্গ পাওয়া যাবে। প্রবালের অসামাজিক ব্যবহার সত্ত্বেও নৃপতির আড্ডাটি তার ভাল লেগে গিয়েছিল।
সাড়ে ছাঁটার সময় নৃপতির বৈঠকখানায় গিয়ে দেবাশিস দেখল প্রবাল পিয়ানোর সামনে বসে চাবির ওপর আঙুল বুলোচ্ছে, কপিল এবং আর একটি ছেলে তক্তপোশের পাশে বসে পাঞ্জা লড়ছে; নৃপতি এবং অন্য একটি যুবক পাশাপাশি বসে গল্প করছে। নৃপতি তাকে হাত তুলে ডাকল।
দেবাশিস কাছে গেলে নৃপতি বলল-‘বসুন। এখানে। পরিচয় করিয়ে দিই। দেবাশিস ভট্ট-বিজয়ামাধব মুখুজে। বিজয় হচ্ছে অধ্যাপক বংশের ছেলে, সম্প্রতি সংস্কৃতে এম.এ. পাস করে অধ্যাপনার কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে।’ দেবাশিসের পূর্ণ পরিচয় নৃপতি আগেই বিজয়কে দিয়েছিল, আর পুনরাবৃত্তি করল না।
বিজয় উৎসুক চোখে দেবাশিসকে দেখতে লাগল। নৃপতি তাদের মাঝখান থেকে উঠে পড়ল, বলল–’তোমরা গল্প কর, আমি আসছি।’
বিজয় দেবাশিসের দিকে একটু ঘেঁষে বসল। বলল—’এক পাড়াতে থাকি, অ্যাদ্দিন আলাপ-পরিচয় হয়নি, কি আশ্চর্য বলুন দেখি।’ চেহারা দেখেই দেবাশিসকে তার পছন্দ হয়েছিল; দীপার উপযুক্ত বর।
যদিও কলকাতা শহরে পাশাপাশি বাস করেও আলাপ-পরিচয় না হওয়াতে আশ্চর্য কিছু নেই, তবু দেবাশিস হাসিমুখে বলল—’আশ্চর্য বইকি।’
ওদিকে কপিল আর অন্য ছেলেটির পাঞ্জা লড়া শেষ হয়েছিল, নৃপতি তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল–’কি হে খড়্গ বাহাদুর, তোমার দেশে যাবার কথা ছিল না?
খড়্গ বাহাদুর প্রফুল্ল স্বরে বলল—’কথা তো ছিল নৃপতিদা, কিন্তু যাওয়া হল না।’
খড়্গ বাহাদুর নেপালী যুবক। তার মা বাঙালী। তাই তার মাতৃভাষাও বাংলা। চমৎকার চেহারা, যেমন পীতাভ সোনালী রঙ তেমনি লম্বা ছিপছিপে গড়ন। তার মুখে চোখে মঙ্গোলীয় রক্তের ছাপ। এত অল্প যে ধরা যায় না। বর্তমানে সে বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবল খেলোয়াড়; পায়ের কাছে বল পেলে সে যাদুকর বনে যায়। কলকাতার সবচেয়ে নামজাদা ফুটবল ক্লাবের সে খেলোয়াড়। তার খেলা দেখবার জন্যে লক্ষ লক্ষ দর্শক মাঠে জমা হয়। তার চরিত্রে বিন্দুমাত্র চালিয়াত নেই। উচ্চবংশের ছিল, কিন্তু ভারি কিয়ী। বয়স তেইশ কি চব্বিশ।
নৃপতি বলল–’কেন, যাওয়া হল না কেন?’
খড়্গ বাহাদুর বলল—’কাঠমাণ্ডুতে বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়েছিল, হঠাৎ তার পেলাম কীসব গণ্ডগোল হয়েছে, বিয়ে পেছিয়ে গেছে।’
নৃপতি বলল–’তার মানে এক বছরের ধাক্কা। ফুটবল সীজন এসে পড়ল, এরপর তুমি তো আর নেপালে গিয়ে বসে থাকতে পারবে না।’
খড়্গ বাহাদুর চোখে কৌতুক এবং মুখে বিষণ্ণতা নিয়ে মাথা নাড়ল।
চাকর বড় একটি ট্রের ওপর কয়েক পেয়ালা কফি নিয়ে এল, সকলেই এক এক পেয়ালা তুলে নিল। এই সময় সদর দরজার কাছ থেকে আওয়াজ এল–’ওহে, আমিও আছি, আমার জন্যে এক পেয়ালা রেখো।‘
একটি যুবক প্রবেশ করল। রজতগৌর বর্ণ, মুখের ছাঁচ কেষ্টনগরের পুতুলকেও হার মানায়; চোখ দু’টি উজ্জ্বল, ক্ষৌরিত মুখে একটা হাসি লেগে আছে। বয়স সাতাশ-আটাশ।
নৃপতি বলল—‘এস সুজন।’
সুজন মিত্র একজন উদীয়মান চিত্রনক্ষত্র; দু’ তিনখানা ছবি করেই বেশ নাম করেছে। যেমন গভীর ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে, তেমনি হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষমতাও আছে। সবচেয়ে বড় কথা, হঠাৎ খ্যাতি ও অর্থ লাভ করেও তার মেজাজ বিগড়ে যায়নি। নিজের কথা সাত কাহিন করে বলতে সে ভালবাসে না। বস্তুত তার সম্বন্ধে কেউ বড় কিছু জানে না। স্ত্রীজাতির প্রতি তার আসক্তির কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এমন কি সে বিবাহিত কি অবিবাহিত তাই কেউ জানে না। দক্ষিণ কলকাতার একান্তে একটি ছোট বাড়িতে একলা থাকে, বেশির ভাগ সময়ই হোটেলে খায়। অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং অপ্রকট তার জীবন।
সুজন ট্রে থেকে টপ করে একটা পেয়ালা তুলে নিয়ে বলল–’ঠিক সময়ে এসেছি, আর একটু হলে ফাঁকি পড়তাম।’
কফিতে একটি চুমুক দিয়ে সে তার উজ্জ্বল অভিনেতার চোখ দু’টি ঘরের চারিদিকে ফেরাল, তারপর দেবাশিসকে দেখে হ্রস্ব কণ্ঠে বলল–’নৃপতিদা, নতুন অতিথির সমাগম হয়েছে দেখছি!’
নৃপতি বলল—’হ্যাঁ, এস তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। খড়গ, তুমিও এস।’
পরিচয় বিনিময়ের পর সুজন মিটমিটি হেসে বলল—’দেবাশিসবাবু্, এখন বলুন দেখি আপনি ফুটবল খেলা দেখতে ভালবাসেন, না সিনেমা দেখতে ভালবাসেন?’
দেবাশিস বলল–’দুই-ই ভালবাসি। খেলার মাঠে এবং রূপালী পদায় আপনাদের দু’জনকে অনেকবার দেখেছি।’
তারপর সকলে মিলে খানিকক্ষণ হাসিগল্প চালাল। প্রবাল কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগ দিল না, নিজের মনে টুং-টাং করে পিয়ানো বাজিয়ে চলল।
রাত আন্দাজ ন’টার সময় সভা ভঙ্গ হল। দেবাশিস বেশ প্রফুল্ল মনে বাড়ি ফিরে এল।
এইভাবে কয়েকদিন কাটাবার পর এক রবিবার সকালবেলা বিজয়, তার বাবা নীলমাধব এবং নৃপতি দেবাশিসের বাড়িতে দেখা করতে এল। দেবাশিস তাদের খাতির করে নীচের তলায় বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো এবং নকুলকে চায়ের হুকুম দিল।
নীলমাধব মুখুজে অতিশয় গভীর প্রকৃতির লোক। তিনি আগে বিজয়ের মুখে দেবাশিস সম্বন্ধে সব কথা শুনেছিলেন এবং তত্ত্ব-তল্লাশও নিয়েছিলেন। পাত্রটিকে সৎপাত্র মনে হওয়ায় তিনি এখন স্বচক্ষে দেখতে এসেছেন। তিনি দেবাশিসকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করলেন এবং নৃপতির দিকে ঘাড় নেড়ে সন্তোষ জ্ঞাপন করলেন।
ইতিমধ্যে চা এসে পড়েছে। নৃপতি চা খেতে খেতে নিপুণভাবে বিয়ের প্রস্তাব তুলল। নৃপতির ঘটকালির দিকে বিশেষ দক্ষতা আছে।
আধা ঘন্টার মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেল। দেবাশিসের ঠিকুজি কোষ্ঠী ছিল না। তাই জ্যোতিষের যোটক বাদ দিতে হল। নৃপতি বলল—’দেবাশিস, দীপকে তোমার অপছন্দ হবে না জানি, তবু একবার দেখা দরকার। আজ বিকেলে আমি এসে তোমাকে এঁদের বাড়িতে নিয়ে যাব। কেমন?
দেবাশিস সম্মত হল। বলা বাহুল্য, এই কদিনে নৃপতি ও দেবাশিসের ঘনিষ্ঠত ‘তুমি ও ‘নৃপতিদার পর্যয়ে নেমেছে।
সেদিন অপরাহ্নে নৃপতি এসে দেবাশিসকে দীপাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। বৈঠকখানা ঘরে আসর হয়েছিল; আড়ম্বর কিছু নয়, টেবিলের মাঝখানে ফুলদানিতে এক গুচ্ছ ফুল, তক্তপোশের ওপর মখমলের আস্তরণ এবং মোটা তাকিয়া। বিজয় তাদের নিয়ে গিয়ে ঘরে বসালো, তারপর নীলমাধব এসে দেবাশিসকে তেতলার ঘরে নিয়ে গেলেন। উদীয়মাধব তার সঙ্গে দুচারটে কথা বললেন; তাঁর মুখ দেখে বোঝা গেল ভাবী নাতজামাই দেখে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
তারপর নীলমাধব দেবাশিসকে নিয়ে আবার নীচে নেমে এলেন। পাঁচ মিনিট পরে বিজয় গিয়ে দীপকে নিয়ে এল, দীপা এসে টেবিলের কাছে দাঁড়াল। পরনে আটপৌরে শাড়ি ব্লাউজ, কানে ছোট ছোট দু’টি সোনার আংটি, গলায় সরু হার, হাতে তিনগাছি করে চুড়ি। কনে দেখানো উপলক্ষে তাকে সাজগোজ করানো হয়নি, কিংবা সে নিজেই সাজগোজ করেনি। তার সারা দেহে প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহ। একবার সে পলকের জন্য চোখ তুলে দেবাশিসের দিকে চেয়ে আবার চোখ নীচু করল। ক্রূর ঋজু রেখার নীচে চোখের দৃষ্টি খর।
দেবাশিসের কিন্তু দীপাকে খুব ভালো লেগে গেল। স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা শূন্য সুকুম গুরু দীপকে দেখে তার মান মার্থের সঙ্গর হল মন হল একে ঐরূপে পেলে সে সুখী হবে।
দুমিনিট পরে বিজয় বলল–’দীপা, তুমি এবারে যাও। দেখা হয়েছে।’
দীপা চলে গেল। তারপর মিষ্টিমুখ করে দেবাশিস সলজ্জ সম্মতি জানাল।
দুহাপ্তার মধ্যে সব ঠিকঠাক, বিয়ে হয়ে গেল। এই দুহস্তার মধ্যে দীপা যে তার প্রেমিকের সঙ্গে চুপিচুপি টেলিফোন মারফত বাক্যালাপ করেছে সতর্ক পাহারা সত্ত্বেও কেউ তা জানতে পারল না।’
বিয়ের রাত্রে কনের বাড়িতে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে নৃপতির বাড়ির আড়াধারীরাও এল, কারণ তারা বিজয়ের বন্ধু। আবার বউভাতের রাত্রে যারা দেবাশিসের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে এল তাদের মধ্যে প্রজাপতি ফ্যাক্টরির সাহাকারীদের সঙ্গে নৃপতির দলও এল, কারণ তারা দেবাশিসের বন্ধু। যাকে বলে, বরের ঘরের মাসি কনের ঘরের পিসি।
দেবাশিসের বাড়িতে স্ত্রীলোক নেই, দীপার কয়েকটি প্রতিবেশিনী সখী এসে ফুলশয্যা সাজিয়ে দিয়ে গেল। অনেক রাত্রি পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া আমোদ-আহ্লাদ চলল। নৃপতির দলই আসর জমিয়ে রাখল। সুজন শুধুই চিত্রাভিনেতা নয়, সে নানারকম ম্যাজিক দেখাল। প্রবাল আজ আর কোনো অশিষ্টতা করল না, নিজে থেকেই গান গেয়ে শোনাল। সকলেই নববধূকে নানা রকম উপহার দিল। নৃপতি দিল সোনার রিস্টওয়াচ, কপিল দিল দামী একটা ঝরনা কলম, খড়্গ বাহাদুর দিল নেপালে তৈরি ঝকঝকে ধারালো কুকরি ছোরা, প্রবাল দিল তার নিজের গাওয়া কয়েকটা গানের রেকর্ড, সুজন দিল একটি রূপোর সরস্বতী মূর্তি। দেবাশিসের ফ্যাক্টরির বন্ধুরাও যথাযোগ্য উপহার দিলেন।
বউভাতের উৎসব শেষে অতিথির দল যখন বিদায় নিল তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। বুলি নীচের তলায় রইল। ভূত নকুল, আর দোতলায় দেবাশিস এবং দীপা। প্রথম মিলন শেষ রাত্রি।
অতিথিকে বিদায় দিয়ে দেবাশিস ওপরতলায় গিয়ে দেখল, সব ঘরে বড় বড় আলো জ্বলছে; বসবার ঘরের একটা চেয়ারে দীপা শক্ত হয়ে বসে আছে। দেবাশিস তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেবাশিসের স্বভাব, যা সম্ভাব্য তাই তার মন স্বীকার করে নেয়, বিলক্ষণতার দিকে সহজে তার দৃষ্টি পড়ে না। সে দীপার দিকে দু’ হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধ হেসে বলল–’এস।’
দীপা চকিতে একবার চোখ তুলল; তার চোখে ভয়ের ছায়া। দেবাশিস ভাবল, কুমারী মনের স্বাভাবিক লজ্জা। সে দীপর পাশের চেয়ারে বসে তার হাতের ওপর হাত রাখল, বলল–’বারোটা বেজে গেছে, আর কতক্ষণ বসে থাকবে। চল, শোবার সময় হল।’
দীপা হাত সরিয়ে নিল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, তবু যা বলবার তা বলতে হবে, আর দেরি করা চলবে না। সে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল–’আমি-আমি আলাদা শোব।’
দেবাশিসের মনে কৌতুকের সঙ্গে একটু বিস্ময় মিশল। কথাগুলো যেন একটু বেসুরো, ঠিক লজ্জার মত নয়। তবু সে হাসিমুখেই বলল—’তুমি আলাদা শুলে ফুলশয্যা হবে কি করে?
দীপার শরীর কেঁপে উঠল; সে শরীরের সমস্ত স্নায়ু পেশী শক্ত করে বলল–না–নাআমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। আমি-?
এবার দেবাশিসের মন থেকে কৌতুকের ভাব একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ স্থির চোখে দীপার। পানে চেয়ে থেকে বলল–’কি কথা বলতে চাও?’
দীপার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল, সে কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–’আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমি অন্য একজনকে ভালবাসি।’
কথাটার ভাবাৰ্থ দেবাশিসের মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগল, তারপর তার মনে যে দীপ জ্বলেছিল, তা আস্তে আস্তে নিবে গেল; তার মনে হল, ঘরের উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোটাও যেন কমে কমে পিদিমির চেয়েও নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। সে দীপার। পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শুষ্ক প্রশ্ন করল—’তবে আমাকে বিয়ে করলে কেন?’
দীপা ঘাড় গুজে বসে রইল, কেবল তার অন্তরের ব্যাকুলত কণ্ঠস্বরে ব্যক্ত হ’ল–’আমি দোষ করেছি, কিন্তু আমার উপায় ছিল না। বাড়ির লোক জোর করে আমার বিয়ে দিয়েছে।’
‘যাকে ভালবাস তাকে বিয়ে করলেই পারতে।’
‘জাত আলাদা, তাই–’
‘জাত।’ একটা কঠিন হাসি দেবাশিসের মনের মধ্যে হিল্লোলিত হয়ে স্থির হল–’তা এখন কি করা যেতে পারে?’
দীপা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ব্যগ্র মিনতির কণ্ঠে বলল–’আমাকে আপনার বাড়িতে থাকতে দিন, আমি আপনাকে বিরক্ত করব না, আপনার সামনে আসব না—‘তার গলা কান্নায় বুজে এল।
ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে দেবাশিস নিজের চুলের মধ্যে আঙুল চালাল, বলল–’এর জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। সব কথা ভেবে দেখতে হবে। তুমি যাও, শোও গিয়ে।’ সে ফুল দিয়ে সাজানো শয়নঘরের দিকে আঙুল দেখোল–’আমি অন্য কোথাও শোব।’
দীপা আর দাঁড়াল না, দ্রুত ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তার চুলে তখনো ফুলের মালা জড়ানো, গলায় হাতে ফুলের গয়না। সেই অবস্থাতেই সে ফুল-ঢাকা বিছানার ওপর আছড়ে পড়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। এত সহজে পরিত্ৰাণ পাবে তা সে আশা করেনি।
দোতলায় আর একটি শয়নকক্ষ ছিল, দেবাশিসের বাবা যে ঘরে শুতেন; নকুল সে ঘরও পরিষ্কার করেছিল, খাটের ওপর বিছানা পেতে সুজনি ঢাকা দিয়ে রেখেছিল। বিয়ের শুভদিনে বাড়িতে কোথাও সে অপরিচ্ছন্নতা রাখেনি। দেবাশিস দীর্ঘকাল অব্যবহৃত এই ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ খাটের পাশে বসে রইল। মাথাটা গরম হয়ে উঠেছে, সে কক্ষসংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে কল খুলে মাথাটা কলের তলায় রাখল। তারপর ভিজে মাথায় ফিরে এসে আলো নিভিয়ে বিছানার সুজনির ওপরেই শুয়ে পড়ল।
রেল গাড়ি প্রচণ্ড বেগে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ যখন লাইনের বাইরে লাফিয়ে পড়ে তখন কাউকে নোটিস দেয় না; দেবাশিসের জীবনে তেমনি আজ এই মহাদুর্যোগ এসেছে অপ্রত্যাশিতভাবে; দু’ মিনিট আগেও এই দুযোগের কোনো আভাস সে পায়নি। কিন্তু আত্মহারা হয়ে বিপথে কুপথে ছুটোছুটি করলে চলবে না, মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভেবে-চিন্তে সুবুদ্ধির পথ বেছে নিতে হবে।
দেবাশিস জটিল চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল। সে শান্ত ধীর প্রকৃতির মানুষ, অন্য কেউ হলে আজ রাত্রেই একটা কাণ্ড করে বসত।
দীপা অন্য একজনকে ভালবাসে, এইটেই হচ্ছে মূল কথা। দীপা কাকে ভালবাসে, সে লোকটা কে, তা জানিবার আগ্রহ দেবাশিসের নেই; সে যেই হোক না কেন, দীপা তাকে ভালবাসে। তবু দীপা পারিবারিক চাপে পড়ে দেবাশিসকে বিয়ে করেছে। কিন্তু এই বিয়েকে সে স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কে পরিণত করতে চায় না। . প্ৰেমাস্পদের সঙ্গে দীপার ঘনিষ্ঠতা কত দূর অগ্রসর হয়েছিল? জল্পনা নিষ্ফল।
দীপার বাড়ির সকলেই অবশ্য দীপার অসবৰ্ণ প্রণয়ের কথা জানে, বিজয়মাধব জানে। জেনে-শুিনে তারা এই কাজ করেছে। হয়তো ভেবেছে, বিয়ের পর দীপা ক্রমে তার প্রণয়ীকে ভুলে যাবে। কিন্তু দীপা ভুলবে বলে মনে হয় না, প্রণয়ীর প্রতি তার একনিষ্ঠা আছে। …নৃপতি কি জানে? বোধ হয় জানে না, জানলে দেবাশিসের এমন অনিষ্ট করত না; নৃপতিকে সজ্জন বলেই মনে হয়। …কিন্তু যা হবার তা তো হয়েছে, এখন এই জট ছাড়াবার উপায় কি? ডিভোর্স? একটা বেজে গেল, দুটো বেজে গেল। এতক্ষণ পরে দেবাশিস লক্ষ্য করল, বসবার ঘরে তীব্র শক্তির আলোটা জ্বলেই চলেছে। সে উঠে আলোটা নেবাতে গেল। দীপার ঘরের দরজা বন্ধ; দরজার পাশ দিয়ে যাবার সময় সে একটু থেমে কান পেতে শুনল, কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে কোনো শব্দ এল না; দীপা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সে বসবার ঘরের আলো নিবিয়ে ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ল।
ঝাঁ ঝাঁ রাত্রি। কলকাতা শহর নিঝুম হয়ে আছে। দূরে একটা রেলের ইঞ্জিন একটানা বাঁশী বাজাতে বাজাতে আরো দূরে গিয়ে মিলিয়ে গেল। দেবাশিস অন্ধকারে চোখ মেলে শুধু ভাবছে–
তিনটে বেজে গেল। দেবাশিসের মনে হল, নীরন্ধ অন্ধকারের মধ্যে এক বিন্দু জোনাকি আলো জ্বলছে আর নিবছে.একটা অর্ধ-পরিণত সংকল্প.তার বেশি আজ রাত্রে আর কিছু সম্ভব নয়…
দেবাশিস আবার বাথরুমে গিয়ে মাথায় জল ঢালল, তারপর ফিরে এসে বিছানায় শোবার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারল না, শরীরের ক্লান্তি কেটে যাবার পর ভোরের আলো ফুটতে-নো-ফুটতেই তার ঘুম ভেঙে গেল। সে মুখ ধুয়ে নীচে নেমে গেল। নকুল তখনো ওঠেনি, কাল রাত্রের খাটাখাটুনির পর আজ বোধ হয় একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছে। দেবাশিস নিঃশব্দে সদর দরজা খুলে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল। শুকনো বাগানে ফুল নেই, কিন্তু ভোরের বাতাসটি বেশ মিঠে। সে সদর দরজা থেকে ফটক পর্যন্ত পায়চারি করতে লাগল।
একটু একটু করে দিনের আলো ফুটছে, কিন্তু এ রাস্তায় এখনো লোক চলাচল আরম্ভ হয়নি। দেবাশিস পায়চারি করতে করতে এক সময় ফটকের কাছে এসে দাঁড়াল। বন্ধ ফটকের উপর কনুই রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল, বাঁ দিক থেকে একজন লোক হন।হন করে আসছে। কাছে এলে সে চিনতে পারল-বিজয়মাধব।
বিজয়মাধবের সঙ্গে এই কয় দিনে দেবাশিসের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, উপরন্তু সে এখন তার শ্যালক। কিন্তু বিজয়কে আসতে দেখে তার মনটা গরম হয়ে উঠল। তাই বিজয় যখন মুখে হাসি ফুটিয়ে ফটকের ওপারে এসে দাঁড়াল তখন দেবাশিসের মুখে সে হাসির প্রতিবিম্ব পড়ল না, সে গম্ভীর চোখে বিজয়ের পানে চেয়ে বলল–’আবার কি জন্যে এসেছেন? কৰ্তব্যকর্ম কি এখনো শেষ হয়নি?’
বিজয়ের হাসি মিলিয়ে গেল, সে থতমত খেয়ে বলে উঠল—’দীপা কিছু বলেছে নাকি?’
দেবাশিস নীরস কণ্ঠে বল–’সবই বলেছে। সে অন্তত আমায় ঠকায়নি।’
বিজয় কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মত চেয়ে থেকে হঠাৎ ফাটক খুলে ভিতরে এল, তারপর দেবাশিসের হাত চেপে ধরে ব্যগ্র মিনতির স্বরে বলল–’ভাই দেবাশিস, তুমি দীপার স্বামী, তুমি আমার পরমাত্মীয়, আমার ছোট ভাইয়ের সমান। আমি একটা কথা বলব, শুনবে?’
‘কি বলবেন বলুন।’
‘দীপা একেবারে ছেলেমানুষ, সবে সতেরো পেরিয়ে আঠারোয় পা দিয়েছে, ওর মনে কল্পনা-বিলাস ছাড়া আর কিছু নেই। ওইটুকু মেয়ের বুদ্ধিই বা কতখানি? তুমি ভাই ওর কথায় কান দিও না। দুচার দিন ঘর করলেই আগের কথা সব ভুলে যাবে। কম বয়সের একটা খেয়াল বই তো নয়?’
‘ওর কথা শুনে তা তো মনে হয় না।’
‘মেয়েমানুষের কথার কি কোনো দাম আছে? ওরা আধুনিক কায়দায় বড় বড় কথা বলে, ভিতরে কিন্তু ফঙ্কিকার। দীপা স্কুলে পড়েছে, স্কুলের মেয়েদের সঙ্গে মিশে পাকামি শিখেছে। ওর মনটা ভাবপ্রবণ; সিনেমা-থিয়েটার নাচগানের দিকে টান আছে, যদিও আমরা তাকে কোনোদিন আশকার দিইনি। আমি জোর গলায় বলছি, আমাদের বংশের মেয়ে কখনো বিপথে কুপথে যাবে না।’
দেবাশিস শান্ত গলায় বলল–’আপনার ভয় নেই, এ নিয়ে আমি ঝোঁকের মাথায় কোনো কেলেঙ্কারি কাণ্ড করব না, যা করবার ভেবে-চিন্তে করব। এ কথা বাড়ির বাইরে আর কেউ জানে?’
‘না।’ বিজয় আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় বাড়ির দোরের কাছে নকুলকে দেখা গেল। নকুল এগিয়ে এসে বলল-‘দাদাবাবু্, চা তৈরি হয়েছে।’
বিজয় খাটো গলায় তাড়াতাড়ি বলল—’আচ্ছা ভাই, আজ আমি যাই। শীগগির আবার আসব।’ বলে সে দ্রুতপদে চলে গেল।
দেবাশিস বাড়ির দিকে ফিরে যেতে যেতে বলল–’নকুল, তুই আমাদের চা ওপরের ঘরে দিয়ে আয়।’
নকুল মুচকি হেসে বলল—’তাই দিয়েছি দাদাবাবু!’ দেবাশিস দোতলায় উঠে গেল। দেখল, বসবার ঘরে নীচু টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম সাজানো রয়েছে আর দীপা তক্তপোশের পাশে চুপটি করে বসে আছে—কাল রাত্রে যেমন বসে ছিল। অবশ্য কাল রাত্রের বাসি জামাকাপড়, ফুলের গয়না আর নেই, তার বদলে পাট-ভাঙ্গা শাড়ি ব্লাউজ। দেবাশিস আসতেই দীপা একটু আড়ষ্টভাবে উঠে দাঁড়াল।
দেবাশিস দোর বন্ধ করে দিয়ে দোরের সামনে ফিরে দাঁড়িয়ে দীপার। পানে তাকাল। খোলা জানালা দিয়ে সকালের নরম আলো দীপার ওপর পড়েছে। বিজয় যা বলেছিল তা মিথ্যে নয়, দীপার ছিপছিপে শরীরে কীেমার্যের কোমলতা এখনো লেগে আছে, ভারি ছেলেমানুষ মনে হয়। কিন্তু তার মুখে পরিণত মনের দৃঢ়তা, মুখের লাবণ্য যেন দৃঢ়তার উপাদানে তৈরি।
দেবাশিস কাছে এসে চায়ের সরঞ্জামের দিকে দৃষ্টি নামালো; টি-পটে চা, দু’টি পেয়ালা, গরম দুধ, চিনির কিউব, প্লেটে স্তুপীকৃত টোস্ট, মাখনের পাত্রে মাখন, অন্য একটি পাত্রে মারমালেড় এবং চারটি সিদ্ধ ডিম। নকুল দু’জনের জন্য প্রচুর প্রাতরাশ করেছে, একলা দেবাশিসের জন্য এত করে না।
দেবাশিস দীপার দিকে চোখ তুলে সহজ গলায় বলল–’তুমি চা ঢালবে?’
দীপাদের বাড়িতে সাবেক রেওয়াজ, পেয়ালায় চা ঢালা হয়ে সকলের কাছে যায়; প্রাতরাশ খাওয়ার কোনো বিধিবদ্ধ রীতি নেই। সে একটু ইতস্তত করল। তাই দেখে দেবাশিস বলল–’আচ্ছা, আমিই চা ঢালছি।’
দু’টি পেয়ালায় চা ঢেলে সে একটি পেয়ালা দীপার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—’বসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে, চা খেতে খেতে কথা হবে।’
দীপা সঙ্কুচিতভাবে চেয়ারে বসল। তার সঙ্কোচ মনের জড়ত্র নয়, অপরিচিত এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্কোচ। তার জীবনে অভাবনীয় ওলট-পালট আরম্ভ হয়েছে।
দেবাশিস নিজের চায়ে একটি ছোট চুমুক দিয়ে পেয়ালা নামিয়ে রাখল, বলল–’তোমার দাদা বিজয়মাধব আজ ভোর হতে না হতে এসেছিল।’
দীপা চকিত চোখ তুলে আবার চোখ নত করল। দেবাশিস এক টুকরো টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল–’তার কথা শুনে মনে হল তোমার গুপ্তকথা বাড়ির সবাই জানে। বাইরের কেউ জানে নাকি?’
দীপা মাথায় একটা ঝাঁকনি দিয়ে বলল-‘না-না–।’ আর কোনো কথা তার শুকনো গলা দিয়ে বেরুল না।
দেবাশিস বলল–’তা সে যাই হোক, সব কথা বিবেচনা করা দরকার। একটা ব্যাপার ঘটেছে, আমার জীবনে হঠাৎ একটা বেয়াড়া সমস্যা এসে হাজির হয়েছে। যথাসাধ্য কেলেঙ্কারি বাঁচিয়ে তার নিম্পত্তি করতে হবে। আমার কথা বুঝতে পারছ?’
দীপা ঘাড় নাড়ল, অস্ফুট স্বরে বলল–’পারছি।’ সে কিন্তু দেবাশিসের ধরনধারন কিছুই বুঝতে পারছে না। এরকম অবস্থায় মানুষ কি এমনিভাবে কথা বলে?
দেবাশিস টেস্টে কামড় দিয়ে বলল–’তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
দীপা তাড়াতাড়ি চায়ের পেয়ালা হাতে তুলে নিল, কিন্তু হাতের পেয়ালা হাতেই রইল, ঠোঁট পর্যন্ত উঠল না।
দেবাশিস শান্তভাবে বলল—’সমস্যার সোজাসুজি নিষ্পত্তি আছে-ডিভোর্স।’
দীপার হাতের পেয়ালা কেঁপে উঠল। আর একটু হলেই পড়ে যেত। সে সামলে নিয়ে রুদ্ধস্বরে বলল—’না।’
দেবাশিস ভুরু তুলে বলল–’না কেন? তোমার বাড়ির লোক ভালবাসার পাত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে না দিয়ে অন্যায় করেছেন, সে অন্যায় সংশোধন করা উচিত।’
দীপা নত চোখে বলল—’আমার দাদু-তিনি তাহলে বাঁচবেন না।’
দেবাশিস কিছুক্ষণ কথা কইল না, কতকটা যেন অন্যমনস্কভাবে দীপার পানে চেয়ে রইল। তারপর নিজের ঈষদুষ্ণ পেয়ালাটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে নিঃশেষ করে আবার রেখে দিল।
উদয়মাধবকে দেবাশিস দেখেছে, বৃদ্ধের চারিত্রিক প্রবলতা অনুভব করেছে, নাতনী ডিভোর্স-কোর্টে গিয়েছে শুনলে তিনি হয়তো আত্মহত্যা করবেন না, কিন্তু নাতনীকে খুন করতে পারেন।
‘ডিভোর্স যদি সম্ভব না হয় তাহলে দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে—তুমি বাপের বাড়ি ফিরে যাও, সেখানে যেমন ছিলে তেমনি থাকে।’
‘না, ওরা আবার আমায় ফেরত পাঠিয়ে দেবে। মাঝ থেকে জানাজানি হবে।’
‘তাহলে তৃতীয় পন্থা হচ্ছে এখানেই থাকা। আলাদাই থাকবে, আমি তোমার কাছে যাব না। কিন্তু আমারও তো লোকলজ্জা আছে। বাইরের লোকের কাছে ভণ্ডামি করতে হবে। তুমি পারবে?’
দীপা ঘাড় নেড়ে জানাল, সে পারবে।
দেবাশিস বলল–’বাড়ির চাকরীও বাইরের লোক। তার সামনেও ধোঁকার টাটি খাড়া রাখতে হবে।’
দীপা আবার ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
দেবাশিস নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল–’বেশ। কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে?’
দীপা চুপ করে রইল, এ প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই জানে না। দেবাশিস আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল। স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা খুবই অল্প; কিন্তু তার মনে হল, এরা বড় স্বার্থপর, নিজের স্বার্থই বোঝে, আর কারুর কথা ভাবে না।
কাল দেবাশিস ভেবেছিল, এখন দু’তিন দিন সে ফ্যাক্টরিতে যাবে না, সারা দিন বাড়িতে থেকে বউয়ের সঙ্গে ভাব করবে। কিন্তু সব ভণ্ডুল হয়ে গেল। সে খানিকক্ষণ বিমনাভাবে ঘুরে বেড়ালো, কাল রাত্রে যে বিছানায় শুয়েছিল সেটা ঝেড়েকুড়ে ঠিক করে রাখল, নকুল না। সন্দেহ করে যে, তারা আলাদা শুয়েছে। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে বলল–’নকুল, আমার খাবার তৈরি কর, আমি ন’টার সময় ফ্যাক্টরি যাব।’
স্নান করতে গিয়ে দেবাশিসের একটা কথা মনে এল। সে দেখল, দীপা তখনো বসবার ঘরে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে, সে তার কাছে গিয়ে বলল–’নকুলের চোখে যদি ধুলো দিতে হয় তাহলে তোমার ঘরের লাগোয়া বাথরুমে আমাকে স্নান করতে হবে। অন্য বাথরুমে আমার ভিজে কাপড় দেখলে নকুলের মনে সন্দেহ হবে। আমি তোমার বাথরুমে স্নান করতে পারি?
দীপার মনে হল দেবাশিস তাকে ব্যঙ্গ করছে। সে চোখ তুলে চাইল, কিন্তু দেবাশিসের মুখে ব্যঙ্গবিদ্রূপের চিহ্নমাত্র দেখতে পেল না। সে তখন একটু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
দেবাশিস মানাহার করে ন’টার সময় কাজে চলে গেল।
অতঃপর সংসারের সব ভার পড়ল নকুলের ওপর। নতুন বউকে বাড়ির কাজকর্ম শেখাতে হবে, বউয়ের খাওয়া-দাওয়ার ওপর নজর রাখতে হবে। বাড়িতে দ্বিতীয় স্ত্রীলোক নেই; সাময়িকভাবে নকুল হয়ে উঠল বাড়ির গিন্নী।
দুপুরবেলা দীপকে ভাত খাইয়ে নকুল ওপরে পাঠিয়ে দিল, বলল–’যাও, একটু ঘুমিয়ে নাও গিয়ে।’
কিন্তু দীপার দিনের বেলা ঘুমোনো অভ্যোস নেই। সে ঘুরে ঘুরে ওপরতলাটা দেখতে লাগল।…এই ঘরে কাল রাত্রে দেবাশিস। শুয়েছিল…নকুল যেন জানতে না পারে, সে ওপরে আসবার আগেই রোজ বিছানা ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রাখতে হবে.বাড়ির পাশের ব্যালকনি থেকে বাগানটা দেখা যায়। বাগানের ছিরি নেই, যেন কত কাল কেউ বাগানের দিকে তাকায়নি। দেবাশিসের বাগানের শখ নেই। দীপার খুব বাগানের শখ আছে। সে বাপের বাড়ির খোলা ছাদে টবের বাগান করেছিল।
ঘণ্টাখানেক ঘুরে ফিরে সে বসবার ঘরে এল। রেডিওগ্রামের ওপর নজর পড়ল। দীপা রেডিও শুনতে ভালবাসে. বাপের বাড়িতে তার একটি ট্রানজিস্টার ছিল, সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গান শুনত, ফুটবলের কমেন্টারি শুনাত, নাট্যাভিনয় শুনত। ট্রানজিস্টারটা আনা হয়নি। তার অনেক নিজস্ব জিনিস বাপের বাড়িতে পড়ে আছে।
দীপা রেডিওগ্রামের কপাট সরিয়ে কলকব্জা নাড়াচাড়া করতে করতে গানের সুর বেজে উঠল। দুপুরবেলার শান্ত ত্ররাহীন প্রোগ্রাম। সে রেডিওর পাশে একটা গদি-মোড়া আরাম-চেয়ারে বসে শুনতে লাগল।
কাল রাত্রে দীপা অল্পই ঘুমিয়েছে, যেটুকু ঘুমিয়েছে তাও যেন আড়ষ্ট হয়ে। এখন রেডিওর মৃদু গুঞ্জন শুনতে শুনতে তার চোখ বুজে এল।
হঠাৎ তার চমক ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। সে চোখ মেলে দেখল, ঘরের কোণে ছোট টেবিলের ওপর টেলিফোন বাজছে। দীপা রেডিও বন্ধ করে দিল। নিশ্চয় দেবাশিসের টেলিফোন। একটু ইতস্তত করে সে উঠে গিয়ে ফোন তুলে নিল।
‘হ্যালো।‘
অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ এল—’দীপা, আমার গলা চিনতে পারছ?’
দীপার বুক ধড়ফড় করে উঠল, সে অবরুদ্ধ স্বরে বলল–’পারছি।’
‘ঘরে কেউ আছে?’
না, আমি একা।’
‘বেশ। তোমার স্বামীকে বলেছ?’
‘বলেছি।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কিছু না।’
‘রাত্রে তোমাকে বিরক্ত করেনি?
‘না।‘
‘তুমি একলা শুয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ। এইভাবে চালিয়ে যাও।’
‘কত দিন?
‘একটু সময় লাগবে। তুমি ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। শপথ মনে আছে তো?’
‘হ্যাঁ।‘
‘শপথ করেছ, আমার নাম কাউকে বলবে না। মা কালীর নামে শপথ করেছ, মনে আছে?’
‘আছে।’
‘তোমার স্বামী হয়তো নাম জানবার জন্যে পীড়ন করতে পারে।’
‘নাম জানতে চাননি। চাইলেও আমি বলব না।’
‘বেশ। আমি মাঝে মাঝে তোমাকে ফোন করব। দুপুরবেলা তোমার স্বামী যখন বাড়িতে থাকবে না। তখন ফোন করব।’
‘আচ্ছা।’
সে ফোন রেখে দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসল। মনে হল তার শরীরের সমস্ত জোর ফুরিয়ে গেছে।