লিলি সিম্পসন-এর বাঘ
০১.
উরি বাবাঃ। একেবারে কাঁড়িয়া পিরেত মারা শীত।
রুদ বাংলোর বসার ঘরের দরজাটা ফাঁক করে ট্রেতে করে এক থালা গরম পেঁয়াজি বাবুর্চিখানা থেকে এনেই দড়াম করে শালকাঠের পেল্লায় পাল্লাটাকে ভেতর থেকে বন্ধ করে ঘরের মধ্যে ঢুকল ভটকাই। ঢুকে, ট্রেটাকে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল। বলল, যে যে গরম পেঁয়াজি খেতে চাও, খেয়ে নাও। দ্যাখো আনতে আনতেই বোধহয় কুলফি হয়ে গেল। বিলেতেও এত শীত নেই।
তুই কি বিলেতে গেছিস?
যাইনি, যাব কখনও নিশ্চয়ই।
ঋজুদা পাইপটা মুখ থেকে বাঁ হাত দিয়ে নামিয়ে ডান হাত দিয়ে একটা পেঁয়াজি তুলে নিতে নিতে আমাদের বলল, সত্যিই রে। খেলে খা। এখুনি ঠান্ডা হয়ে যাবে।
তারপর ভটকাইয়ের দিকে ফিরে বলল, কাঁড়িয়া পিরেত তো ভূশণ্ডির মাঠের পেতনিই, সে আবার নতুন করে মরবে কী করে!
বাংলার পেনেটির কাছের ভূশণ্ডির মাঠ আর পালামৌয়ের এই রুদ বাংলো৷ কীসের সঙ্গে ইসে। ভূত পেতনিও এই শীতে নির্ঘাত মারা যাবে।
ভটকাই বলল।
আমি বললাম, এখানে তাই বাংলার ডিসপেপটিক, যখন-তখন চা খাওয়া টিংটিঙে এ ভূত বা নেকি পেতনি পাবি না। এখানের ভূতদের ব্যাপারই আলাদা।
তিতির বলল, তুমি কি পালামৌর ভূতদের ওপরে অথরিটি?
আমি নই। রমেনদা। ঋজুদাকে জিজ্ঞেস কর না। রমেনদাকে আমি মাত্র একবারই মিট করেছিলাম বেতলাতে। তাও অনেকদিন আগে। তখন রমেনদা লাঠি নিয়ে চলেন। জিপ অ্যাক্সিডেন্টে একটি পা কেটে বাদ দিয়ে ছোট করে দিতে হয়েছিল। ছিলেনও গড়িয়াহাটের প্রেসিডেন্সি নার্সিংহোমে বহুদিন। তখন ঋজুদার সঙ্গে দেখতেও গেছিলাম ওঁকে একদিন। তাই না ঋজুদা?
হুঁ।
ঋজুদা বলল।
তা তোর রমেনদার সঙ্গে পালামৌর ভূতেদের কী সম্পর্ক?
সে তার নিজের মুখে শুনলে বুঝতি। তবে দুরকমের ভূতের কথা আমার মনে আছে। প্রথম রকম দারহা ভূত। তার সঙ্গে জঙ্গলের পথে একলা তোর যদি কখনও দেখা হয়ে যায় তো সে একবার শালগাছের মতো লম্বা আর একবার পুটুস ঝাড়ের মতো বেঁটে হয়ে যাবে। দেখতে অতি সাধারণ দেহাতি। খাটো ধুতি আর ফতুয়া বা শার্ট পরনে, শীতকাল হলে কাঁধে একটা কম্বল। সে ওমনি ক্রমাগত লম্বা আর বেঁটে হতে থাকবে।
তারপর?
ভটকাই ইন্টারেস্ট পেয়ে, পেঁয়াজিতে কামড় দিয়ে বলল।
তারপর, হয় তোমার জান বাঁচাবার জন্যে তার সঙ্গে কুস্তি লড়ো, নয়তো ফওত হয়ে যাও।
ফওত হয়ে যাও মানে?
ভটকাই প্রশ্ন করল।
মানে, তোর ভাষাতে ফুটে যাওয়া আর কী। তবে সে ওমনি ফোঁটা নয়। পার্মানেন্ট ফোঁটা। মরে তুমি হয় পুটুস ফুল নয় কেলাউন্দা হয়ে জঙ্গলের অঙ্গ হয়ে যাবে। মনুষ্যত্ব গায়েব হয়ে যাবে।
আর অন্যরকম ভূত?
সে ভূতকে দেখা যায় না। তারা কোয়েল নদীর খাত ধরে খাপু খাপু খাপ খাপু করে ডাকতে ডাকতে পাখি হয়ে ওড়ে। চাঁদনি রাতে বেশি ওড়ে অন্ধকার রাতের চেয়েও। সেই সময়ে কেউ যদি নদীর দিকে যায় তবে ঘাড় মটকে দেয় নিপুণ হাতে। ঘাড় মটকাবার শব্দটা পর্যন্ত শোনা যায় না।
যত্ত সব গ্যাঁজা গুল।
ভটকাই বলল।
আমি বললাম, নিজের সাধের ঘাড়টি যখন মটকাবে তখনই জানবে গাঁজা না গুল। গাডু বাংলোতে আমি একবার ঋজুদার সঙ্গে ছিলাম গরমের দিনে। চাঁদনি রাতে নদীর দৃশ্য একটু ভাল করে দেখতে নদীর দিকে নেমেছি কয়েক পা বাংলো ছেড়ে, শুনি খাপু খাপু খাপু ডাক।
তারপর?
তারপর আর কী? এক লাফ মেরে প্রায় দৌড়ে বাংলোর বসার ঘরে যেখানে ঋজুদা, মোহনদা, রমেনদা, বাবলুদা, নিমাইঁদারা সব বসে গল্প করছিল। এক পাটি স্লিপার পড়ে রইল বালিতেই।
ওরা সকলে সমস্বরে বললেন, কী হল? রুদ্র?
আমি বললাম, কিছু না তো।
পরদিন সকালে চটির পাটিটি উদ্ধার করি।
ঋজুদা হাসি হাসি মুখ করে আমার নির্জলা গুল শুনছিল। এমন রাতে, এমন পরিবেশে, এমন ঠান্ডায় ভূত-প্রেত সব কিছুই মানিয়ে নেওয়া যায়।
ঋজুদা বলল, গাড়ুর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে এত বড় কংক্রিটের ব্রিজ হয়ে। যখন ব্রিজ ছিল না তখন শীতকালে বাঁশের চাটাই পাতা থাকত, নদীতে যেখানে কম জল সেখানে। মোহনরাই পাতাত। যাদের অনেক ট্রাক বা জিপ ওপারে যেত-আসত, তারা ছাড়া আর কার গরজ? অনেক নির্জন ছিল জায়গাটা। গাড়ু বস্তিটাও এত বড় হয়ে ওঠেনি তখন। বড় বাঘের ডিপো ছিল তখন গাডু। ওপাশে কুটুকু আর ওদিকে মারুমার। মারুমারে অবশ্য নদী ছিল না। নালা ছিল একটা। গাড়ু আর কুটুকু ছিল নদীর ওপরেই।
আর কেচকি? ঔরঙ্গা আর কোয়েলের সঙ্গমে?
তিতির বলল।
হ্যাঁ কেচকি পিকনিক স্পট ছিল, শিকারের জায়গা ছিল না।
তারপর চুপ করে থেকে বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় এই সমস্ত জায়গার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার কথা লিখে রেখে যাই। আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তো এসব স্মৃতি মুছে যাবে। কতদিনের কতরকম স্মৃতি। কত মানুষ, শহরের, গ্রামের, জঙ্গলের। পালামৌতে এখনই আসি না, নইলে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর প্রতি বছর একাধিকবার এসেছি। তা অবশ্য সম্ভব হয়েছিল মোহন বিশ্বাসের বাবা মুকুন্দলাল বিশ্বাস আর প্রিন্স অফ পালামৌ মোহন বিশ্বাসেরই জন্যে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার।
তুমি না লিখলে কী হবে, তোমার চেলা রুদ্র রায় তো কম লেখেনি তোমার সম্বন্ধে।
তা ঠিক। ওই তো বিখ্যাত করে দিল ঋজু বোসকে। নইলে, কে আর তাকে চিনত। এমনই বেশি বিখ্যাত করল যে মাঝে মাঝে এমব্যারাসিং লাগে।
তুমি কী বলছ ঋজুদা! আজকে বাংলার প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে একজন করে ঋজু। হয়ে গেছে তা কি তুমি জান? সকলের ছেলের নামই দেখি ঋজু।
এমনকী বাস ও ট্যাক্সির নামও হয়ে গেছে ঋজু।
তাই? এ সবই রুদ্রর অপকীর্তি।
ঋজুদা বলল।
এই রুদ বাংলো ঘিরে তোমার কী স্মৃতি আছে?
স্মৃতি তো আছে অনেকই। তার মধ্যে রুদের মানুষখেকো বাঘ শিকারের স্মৃতিটাই সবচেয়ে উজ্জ্বল।
মানুষখেকো বাঘ? রুদে? কত বছর আগে?
তা পঁয়ত্রিশ বছর তো হবেই কম করে। তখন আমি একেবারে ছেলেমানুষ। জেঠুমনির মক্কেল ছিলেন মুকুন্দলাল বাবু। সেই সুবাদেই জেঠুমনি পালামৌতে প্রথমবার আসেন পঞ্চাশের দশকে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। তারপর আঠারো বছর বয়স হতেই একা একাই আসতাম জেঠুমনি ও মুকুন্দবাবুর প্রশ্রয়ে। মোহন আমার ছোট ভাইয়ের মতো ছিল। অল্প বয়সে মুকুন্দবাবু মারা যাওয়ার পর মোহনই এত বড় ব্যবসাকে আরও অনেক বড় করে। মোহনের সাকরেদরা ছিল রমেনদা, বাবলু, নিমাই, শান্টু এবং আরও অনেকে। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। কত আনন্দ যে করেছি ওদের সকলের সঙ্গে বহু বহু বছর, তা বলার নয়। ওদের প্রতি কৃতজ্ঞতার যে ঋণ, তা এ জীবনে শোধবার নয়।
তারপর বলল, এ জন্যেই আজকাল সাঁওতাল পরগনাতেই আর আসতেই ইচ্ছে করে না। হাজারিবাগে গোপাল সেন নেই, সুব্রত চ্যাটার্জি নেই, মহম্মদ নাজিম নেই, ডালটনগঞ্জে মোহন নেই, বাবলু নেই, রমেনদাও কলকাতাতে। যাঁদের কথা বলতে গিয়ে ‘নেই’ বললাম তারা একেবারেই নেই। মোহন আমার চেয়ে অনেক ছোট ছিল, বাবলুও। গোপাল ও সুব্রত সমবয়সি–আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু বনজঙ্গলের। নাজিম সাহেব যদিও বয়সে বড় ছিলেন কিন্তু স্পিরিটে নয়। মনমৌজি, জিন্দা-দিল, জবরদস্ত পুরুষমানুষ। তোরা তো জানিস, শহরে আমার কোনও বন্ধু নেই, শত্রু আছে অনেক। বন্ধুরা সব জঙ্গলের বন্ধু ছিল। আজ তারা প্রায় কেউই নেই। অসময়ে চলে গেছে অনেকেই।
তারপরে বলল, হ্যাঁ থাকবার মধ্যে ওড়িশার কটকে আছেন চাদুবাবু, সমরেন্দ্রনাথ দে আর অঙ্গুলে বিমলবাবু, বিমল ঘোষ। কটকের ফুটুদা, পি কে সুরও চলে গেছেন। চাদুবাবু ও বিমলবাবু বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড় হলেও, তারা ভালই আছেন। ওড়িশার জঙ্গলের সেসব দিনের কথাও ভোলার নয়।
তারপর বলল, বয়স তো কারওই বসে থাকে না। মেঘে মেঘে বেলা বাড়েই। চলে যাওয়ার আগে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা, নমস্কার জানাতে ইচ্ছা করে যদিও জানি না, যাঁদের উদ্দেশে তা জানানো, তা তাদের কাছে পৌঁছবে কি না!
রুদের বাঘের গল্পটা আমাদের শোনাবে না ঋজুকাকা?
তিতির বলল।
শোনাব না কেন? তবে আজকে নয়। আছি তো আরও দুদিন। আজ রাতে, কথা যে হয়েছে, শুধুই গান হবে। আগে তিতির তারপরে ভটকাই তারপরে রুদ্র।
আর তুমি? তিতির বলল।
আমি আবার গায়ক নাকি?
আমরা যদি গায়ক হই তো তুমি বড় গায়ক।
সে হবে। আর্টিস্ট বেশি হয়ে গেছে। দেখা যাবে।
.
০২.
পরদিন আমরা মিরচাইয়া ফলস-এ পিকনিকে গেলাম। কিছুটা এগিয়ে গ্লিয়ে ঋজুদা আমাদের সুগা বাঁধ আর মারুমারের বনবাংলো দেখিয়ে আনল। মিরচাইয়াতে লছমন আর ইকবালকে নামিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়েছিল রসদপত্র দিয়ে। মিরচাইয়াতে এখন জল কম। বিরাট কালো চ্যাটালো পাথরগুলো, যাদের ওপর দিয়ে প্রপাতের জল নামে ওপর থেকে, এখন ন্যাড়া। ওই একটা পাথরের ওপরে রান্নাবান্নার বন্দোবস্ত করছে লছমনেরা। মুগের ডালের খিচুড়ি, বেগুনি, কষা মাংস আর টোম্যাটোর চাটনি। লছমন আবার টোম্যাটোকে বলে টোমাটম।
মারুমারের পুরনো বাংলোর পাশেই, ঠিক পাশে নয়, সামনের দিকে হুলুক পাহাড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো একটি বড় কুসুমগাছের ওপরে একটি কটেজ বানিয়েছেন পালামৌর বনবিভাগ। সেই কটেজের নাম দিয়েছেন বুদ্ধদেব গুহ। মি। এটা মারুমার বাংলোর চৌকিদারের কাছ থেকেই জানতে পেলাম আমরা।
ঋজুদা বলল, কুসুম গাছে যে লাক্ষা হয় তাকে বলে কুমি। লেখক হয়তো লাক্ষার কোনও কারখানাতে গিয়ে থাকবেন নইলে নামের এই মিলটা কাকতালীয় বলতে হবে। গাছে যে লাক্ষা হয় তাকে বলে সিড ল্যাক আর সিড ল্যাক থেকে তৈরি হয় স্টিক ল্যাক।
তিতির বলল, ওই লেখকের ‘সাসানডিরি’ নামের একটি বইয়েতে আছে মুরহুর একটি লাক্ষা কারখানার কথা। ‘মাধুকরী’র হাটচান্দ্রাতেও আছে লাক্ষা কারখানার কথা।
সাসানডিরি মানে কী?
আমি বললাম।
‘সাসানডিরি’ হচ্ছে মুন্ডাদের কবরখানা। তিতির বলল। ঋজুদা বলল, দেখলি। আমি কী আর এমনি এমনি বলি যে তিতির তোদের মধ্যে সবচেয়ে ওয়েল-ইনফর্মড।
ভটকাই বলল, তিতিরের যে খুব জ্ঞান তা আমরা জানি বলেই তো আমি ওকে মিস উইসডম বলে ডাকছি।
কবে থেকে ডাকছিস?
দু মাস হল।
বাজে কথা।
তিতির বলল।
তারপর বলল, তোমার যে কখন কী মতি হয়, তা তুমিই জান। তোমারও নাম আমি দিয়েছি একটা। এবার থেকে সকলেই সেই নামেই ডাকব তোমাকে।
কী?
মিস্টার গুলেরু।
গুল সকলে ইচ্ছে করলেই মারতে পারে না। গুল মারা একটা উঁচুদরের আর্ট।
তিতির বলল, কাল রুদ্র ভূতের গল্প বলছিলে তুমি। ঋজুকাকা, তুমি যে সারা পৃথিবীর বনে-জঙ্গলে এত ঘুরেছ, তোমার কোনও ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়নি।
ঠিক ভৌতিক বলব না, আধিভৌতিক বলতে পারিস।
আধিভৌতিক মানে কি আর্ধেক ভৌতিক?
ভটকাই বলল।
আমরা সকলে ভটকাইয়ের কথাতে হেসে উঠলাম।
জিপ তিতিরই চালাচ্ছিল। সামনে ঋজুদা বসেছিল। পেছনে আমি আর ভটকাই।
ঋজুদা বলল, হাসছিস কেন? ভটকাই বাংলাটা ভালই জানে। তা ছাড়া ওই স্ট্রং কমনসেন্স দিয়ে মানের প্রায় কাছাকাছি তো এসেছে।
বাংলা ও জানবে না কেন? আমাদের মধ্যে ওই তো একমাত্র যে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়েছে এবং পড়ছে।
বাংলা জানব না কেন? তবে ওইসব ভূত-টুত সুপারস্টিশাস ব্যাপারে আমার ইন্টারেস্ট নেই। তোরা ইংরেজি-মিডিয়াম স্কুলে পড়ে কী করে যে এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হলি, তা তোরাই জানিস।
আমরা আবার হাসলাম আর এক রাউন্ড।
তিতির বলল, আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু পুরো দিলে না তুমি ঋজুদা।
ঋজুদা মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ, সেই দুটোর মধ্যে একটা হয়েছিল এই অঞ্চলেই। বেতলার চেক নাকাতে। আর অন্যটা হয়েছিল ওড়িশার বামরাতে। ঠিক বামরাতে নয়। বামরা আগে করদ রাজ্য ছিল ইংরেজদের সময়ে। বামরা থেকে আমরা জিপে কনসর নদী পেরিয়ে কিলবগা বলে একটা জায়গাতে ঝুপড়ি বানিয়ে ছিলাম–সেইখানে। সঙ্গে জেঠুমনিও ছিলেন। তবে প্রথমটি : আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, দ্বিতীয়টি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিন্তু আমি সিদ্ধির গুলি খেয়েছিলাম। তাই ঘটনাটা গুলিজাত গুল না সত্যি তা আমি নিজেও জানি না।
ভটকাই বলল, আমরা আজকে রুদের বাঘের গল্প শুনব এমনই কথা ছিল। রয়েওছি যখন রুদ বাংলোতে তখন রুদের গল্পই আগে বলা উচিত তোমার।
এখন তো রুদে নেই, বিকেলে ফিরে যাব সেখানে। সেখানে গিয়েই শুনো।
দুসস। দিনের আলোতে ভূতের গল্প জমে না। ভূতের গল্পটা রাতের জন্যে তোলা থাক। এখন রুদের বাঘের গল্প বলো।
ডিরেক্টর ভটকাই বলল।
ততক্ষণে আমরা মিরচাইয়াতে প্রায় পৌঁছে গেছি। ঋজুদা বলল, তা হলে কী ডিসিশন হল?
তিতির বলল, ভটকাই বহুদিন পরে একটা মানবার মতো কথা বলেছে। মেনে নাও। কথাটা ঠিকই যে দিনের বেলা ভূতের গল্প জমে না।
তবে রুদের বাঘের গল্পটাই এখন শুনবি? গল্প শোনার আগে মিরচাইয়া পৌঁছে একটু কফির বন্দোবস্ত কর তো ভটকাই। এই রোদের মধ্যেও হাত যেন জমে যাচ্ছে। প্রতি বছর পূর্ব ভারতের অধিকাংশ বনে-জঙ্গলেই জানুয়ারির শেষে বৃষ্টি হয় আর ঠান্ডাটা জব্বর পড়ে! এবারেও ব্যতিক্রম নেই। তবে এখনও রোদ আছে। দেখবি, হয়তো রাত থেকে বৃষ্টি নামবে।
ঈরে বাবা। রোদের মধ্যেই হি হি করছি আর রাতে বৃষ্টি নামলে তো মরেই যাব।
তিতির বলল।
কিন্তু খিচুড়ি তো ওই দুপুরেই হয়ে গেল। রাতের মেনু কী হবে? কোয়ার্টার মাস্টার?
ঋজুদা ভটকাইকে জিজ্ঞেস করল।
ভটকাই বলল, ডিসিশন নেওয়া আছে। রাতে বার-বি কিউ হবে ক্যাম্পফায়ারে। ছোট শুয়োর, মানে, suckling pig জোগাড় করতে বলেছিলাম, তা পেল না চৌকিদারেরা। তার জায়গায় কেজি পাঁচেকের একটা পাঁঠা জোগাড় হয়েছে। জোগাড় করেছে ইকবাল।
ও এ জন্যেই শুয়োর পায়নি। শুয়োর ওদের হারাম না?
তাই তো। মনেই ছিল না। তাহলে অন্য কাউকে পাঠাতাম।
পাঁচ কেজি মাংস খাব চারজনে? আমরা কি রাক্ষস?
ডোন্ট বি সেলফিশ। চৌকিদার এবং আমাদের খিদমতগারেরা নেই? তারাই তো বেশি খাবে?
ম্যাগনানিমাস হয়ে ভটকাই বলল।
আর?
আর ঘিয়ে ভাজা গরম গরম পরোটার সঙ্গে খুব ঝাল করে আলুর তরকারি। আঁওলার আচার। তার ওপরে ভূতের গল্প তো আছেই।
তিতির বলল, জমে যাবে রাতে, কী বলো রুদ্র?
আমি বললাম, জমেই তো আছি কিন্তু এবারে শুরু করো ঋজুদা।
চল, জিপ থেকে নামি, ভটকাই কফিটা খাওয়াক তারপরে না হবে গল্প।
তা ঠিক।
ভটকাই বলল।
.
০৩.
জনি ম্যাকগাওয়েন আর লিলিয়ান সিম্পসন আমার সহপাঠী ছিল কানাডার মনট্রিয়ালের ম্যাকগিল উনির্ভাসিটিতে। লিলিয়ান আমাদের দুজনেরই বন্ধু ছিল। কিন্তু কী কারণে জানি না ওর আমার ওপরে বেশি দুর্বলতা ছিল। যে কারণে জনি আমাকে ঈর্ষা করত। যদিও আমাদের বিষয় ছিল আলাদা আলাদা। আমরা ছুটির দিনে, সামারে, স্লিপিং ব্যাগ পিঠে বেঁধে লম্বা লম্বা ট্রেকিংয়ে যেতাম। রাতের বেলা ক্যাম্পফায়ারের সামনে বসে রান্না করতে করতে, রান্না আর কী টিনের খাবার গরম করা আর কী, আমি ওদের ভারতবর্ষের জঙ্গলের গল্প বলতাম, জেঠুমনির গল্প। ওরা শুনতে শুনতে হেসে গড়াত। জনির এক মামা থাকতেন দক্ষিণ আফ্রিকাতে। সেখানে জনি একবার ছুটিতে গেছিল। সেখান থেকে ফেরার পরে সে খুব উৎসাহের সঙ্গে আফ্রিকার গল্প শোনাত। ছেলেবেলাতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড়’, মরণের ডঙ্কা বাজে’ ইত্যাদি বই পড়ে আফ্রিকার প্রতি আমার এক দারুণ আকর্ষণ জন্মেছিল। তবে দক্ষিণ নয়, পূর্ব আফ্রিকা যেখানে কিলিমানজারো পাহাড়, গোয়রাংগোরা আগ্নেয়গিরি, সেরেঙ্গেটির ঘাসবন।
তারপর বলল, তোদের এসব কী বলছি, তোরা সকলেই তো আফ্রিকা-রিটার্নড।
সে তো তোমারই জন্যে। ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’, ‘রুআহা’ এসব জায়গাতে অ্যাডভেঞ্চার করা তুমি নইলে কি আর হত।
আমি কে? সবই ওপরওয়ালার করা। আমার মধ্যপ্রদেশীয় বন্ধু বদ্রিপ্রসাদ যাকে বলে সনযোগ।
তিতির বলল, তুমি তো কানাডার মনট্রিয়াল দিয়ে শুরু করলে, বিশ্ববিখ্যাত– ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি, জনি ম্যাকগাওয়েন আর লিলিয়ান সিম্পসনকে দিয়ে সেখান থেকে পালামৌর রুদ বাংলো তো বহুদূর। একটু জলদি জলদি আগে বাড়ো ঋজুকাকা নইলে তো বাঘের গল্প শেষ হতে রাত হয়ে যাবে।
দেখি ভটকাই তোকে ইনফ্লুয়েন্স করেছে। নইলে আগে বাড়ো-টাড়ো তো তুই আগে বলতিস না।
বলে না, সঙ্গ দোষে স্বভাব নষ্ট। রুদ্র খুঁজে পেতে আমাদের জন্যে কী যে এক বাগবাজারি মাল এনে উপস্থিত করেছে। আমাদের সভ্যতা ভব্যতা স্বভাব নষ্ট হতে বসেছে।
তিতির বলল।
স্বভাব নষ্ট হচ্ছে কি না জানি না তবে ‘মাল’ ‘টাল’-এর মতো শব্দ ব্যবহার না করাই ভাল। এসব তো প্রলেতারিয়েতদের শব্দ তোরা বুর্জোয়া আছিস বুর্জোয়াই থাক না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে এই দুর্লভ স্পেসি, চশমাচোখো কি ‘স্লো-লরিস’ বাঁদরের মতোই আর দেখা যাবে না।
ঠিক বলেছ। ভদ্রলোকে যখন বলে না, বলা উচিত নয় অন্তত।
তিতির বলল।
ভটকাই বলল, যত দোষ নন্দের ঘোষ।
আমি বললাম, এবার গল্পে ফেরো ঋজুদা।
হ্যাঁ।
তা আমি ওদের বলতাম এই কানাডার জঙ্গলে ট্রেকিং করে কোনও উত্তেজনাই নেই। যে জঙ্গলে বাঘ নেই, চিতা নেই, হাতি নেই, ভালুক নেই, সাপ নেই আরও কত কিছুই নেই, সে জঙ্গলে ট্রেক করে বা প্রকৃতির মধ্যে রাত কাটিয়ে কোনওরকম উন্মাদনাই আসে না। মনে হয় ফুলের বাগানে শুয়ে আছি। এসো কখনও ভারতবর্ষে, জঙ্গল কাকে বলে দেখাব। আলো-ছায়ার রহস্য, বাঘের মতো দুর্দান্ত ব্যক্তিত্বর প্রাণী, যে সারা জীবনই বলতে গেলে মুনি-ঋষিদের মতো একাই কাটায়।
জনি বলেছিল কোনওদিন ইন্ডিয়াতে গেলে বাঘ শিকার করাবে? আমি উত্তর আমেরিকার জঙ্গলে Moose শিকার করেছি আমার কাকার সঙ্গে।
আমি বলেছিলাম Moose তো তৃণভোজী। প্রকাণ্ড, মস্ত শিংওয়ালা অ্যান্টেলোপ আমাদের শম্বরের মতো, তা মারতে আর বাহাদুরি কী লাগে। তবে বাঘ মারতে বাহাদুরি লাগে। মাচায় বসে বাঘ দেখলেও তোমার অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে–এক্সট্রা ট্রাউজার নিয়ে এসো সত্যিই যদি আসো কখনও।
শুনে লিলিয়ান খুব হেসেছিল।
আমি দেশে ফিরে আসার অনেক অনেকদিন পর প্রিন্সটন থেকে ওরা চিঠি লিখল যে ওরা বেড়াতে যাচ্ছে অনেকদিনের জন্যে অস্ট্রেলিয়াতে, যাবার পথে ইন্ডিয়া ঘুরে যেতে চায়–যদি বাঘ শিকার করিয়ে দিতে পারি তবেই আসবে নইলে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জের মোলোকাই দ্বীপে ববি। নেলসন-এর সঙ্গে এক সপ্তাহ কাটিয়ে চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া। ববিও আমারই মতো ব্যাচেলর এবং মোলোকাইয়ে ডোল মান্ডির মডেলের আনারসের ফার্ম করে দিন কাটাচ্ছিল। লিখেছিল, আসতে পারে মাত্র এক সপ্তাহের জন্যে। পুরনো দিনের মতো উই উইল বিট ইট আপ’ কিন্তু বাঘ মারিয়ে দিতে হবে। ও ওর ফোর সিক্সটি ফাইভ ডাবল-ব্যারেল রাইফেল নিয়ে আসবে যা দিয়ে ও মুজ মেরেছিল।
উত্তরে আমি ফোন করে বললাম, বাঘ বাঁধা থাকে না। আফ্রিকান সিংহদের মতো অত সহজে তাদের দেখাও যায় না। মারবার কথা দেওয়া তো দূরস্থান দেখাবার কথা দেওয়াও মুশকিল। তবে দেখাবার আপ্রাণ চেষ্টা করব খবর যখন এত আগে পেলাম। তবে বাঘ দেখতে পেলেই যে মারতে পারবেই এমন ধারণা নিয়ে এসো না দেয়ার আর মেনি আ স্লিপস বিটউইন দ্য কাপ অ্যান্ড দ্য লিপ। বাঘ যে বাঘই। তাকে নিজে চোখে দেখলেই বুঝবে।
ওরা সঙ্গে সঙ্গে বলল, যে ওরা আসবে। পরে, চিঠিতে বিস্তারিত সব জানাল। আসবে ডিসেম্বরের শেষে। অক্টোবরেই জঙ্গল খোলে। ওই সময়ে আন্ডারগ্রাথ খুব বেশি থাকে জঙ্গলে, জানোয়ার দেখতে অসুবিধে হয়, বিপজ্জনক জানোয়ার যদি এক গুলিতে না মরে তাহলে সে আরও অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে ওই আন্ডারগ্রোথেরই জন্যে। কিন্তু এক গুলিতে মারা যাবে নাই বা কেন? ‘আগেই নাই-চিন্তা করনের দরকারটা কী কও দেহি’? জ্যেঠুমনি যেমন বলতেন, আমিও তেমন করেই নিজেকে বললাম।
এবারে চলো মন রুদ-নিকেতনে।
ভটকাই বলল।
আর ধানাইপানাই করনের কাম নাই।
.
০৪.
ওদের প্রোগ্রাম ফাইনালাইজ করে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি মুকুন্দবাবু, মানে মোহনের বাবাকে লিখলাম। মোহন তখনও ব্যবসার ভার নেয়নি। লিখলাম, বেতলার কেরকেটা এবং চিপদোহরের তাদের মেট মুসলিমকে খবর দিতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আমি এক সাহেব মেমসাহেবকে নিয়ে যাব–যে ফরেস্ট ব্লকে বাঘের পাকা খবর থাকবে সেই ব্লকের রিজার্ভেশন করে বাঘ মারার পারমিট আমার নামে বের করে সেই ব্লকেরই পুরো বাংলোর রিজার্ভেশন করে রাখতে। আর ফরেস্ট গার্ড এবং তাঁদের জঙ্গলের মেট মুন্সিদেরও বলে রাখতে বাঘের খোঁজখবর নিয়মিত রাখতে। সে কোথায় থাকে, তার ‘রাহান-সাহান’ কী? গোরুমোষ শিকার করে, নাকি জংলি জানোয়ার মেরেই খায়। প্রয়োজনে ডিসেম্বরের গোড়াতে আমি দিনদুয়েকের জন্যে চলে আসব বন্দোবস্ত পাকা করতে।
মুকুন্দবাবু আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি ফোন করে বললেন যে আমার আগে যাওয়ার দরকার নেই, আমার সাহেব বন্ধুর জন্যে তিনি বাঘকে জরুর তার সামনে হাজির করাবেন। এখন মারতে পারা না পারা তারই ভাগ্য অথবা বাঘের ভাগ্য।
দেশ স্বাধীন হবার পরে এবং বিশেষ করে জমিনদারি অ্যাবোলিশন অ্যাক্ট চালু হবার পরে অনেক রাজা-মহারাজারাই শিকারের কোম্পানি খুলে ফেলেছিলেন। বিদেশি শিকারিদের বাঘ মারবার জন্যে নিয়ে আসতেন–আফ্রিকাতে যা বহুদিন থেকেই চালু ছিল। শর্ত ছিল ‘To produce a tiger within shootable distance’ব্যাস তাহলেই পাঁচ-দশ হাজার ডলার দিতে হবে। অনেকের হাত ভাল ছিল না, অনেকেই বাঘ দেখে নিজেরাই কুপোকাত হতেন। তারপর সেই বাঘকে নিজেদের মাইনে করা শিকারিদের দিয়ে মারিয়ে আরও পাঁচ-দশ হাজার ডলার নিতেন। বিদেশিরা দেশে ফিরে বলতেন তাদের মারা ট্রফি।
যাই হোক, জনি আর লিলিয়ান এলে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা জেঠুমনির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওঠালাম। জেঠুমনির বাড়ি আর গ্র্যান্ড হোটেলে খুব একটা তফাত ছিল না। তা ছাড়া তখন কলকাতাতে গ্র্যান্ড ছাড়া তেমন হোটেল ছিলই বা কোথায়? একদিন একরাত ওদের কলকাতা ঘুরিয়ে দেখিয়ে পরদিন রাঁচি এক্সপ্রেসে রাঁচি পৌঁছলাম। বি. এন. আর. থুড়ি এস. ই. আর. হোটেলে উঠে বাথরুম করে চান করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে রওয়ানা হলাম পালামৌর দিকে। কিষুন ড্রাইভার এসেছিল গাড়ি নিয়ে। তখন সে ছেলেমানুষ। পরে সে মোহনের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হয়েছিল এবং বহু বছর ধরে কার ও জিপে আমার ডিউটি করেছে। খুব ভাল হাত ছিল। ঠান্ডা মাথা, পাহাড়-জঙ্গলের পথে দিনে-রাতে আঠারো ঘণ্টা গাড়ি চালাতে দেখেছি আমি ওকে আর মুখে হুজৌর’ ছাড়া কথা নেই। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বিভাগের অধিকাংশ গাড়ির ড্রাইভারকে দেখে মনে হয় এখুনি কালাজ্বরে ভুগে উঠে আজই ডিউটিতে জয়েন করেছেন। ব্যবহারও তাদের বেশ রুক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের ট্রেড ইউনিয়নগুলো তো কারওকে কাজটা ভাল করে করতে বলেনি শুধু মিটিং-মিছিল করে দাবি-দাওয়ার চিৎকার করতে শিখিয়েছে। অথচ বেসরকারি কাজ যারা করে তাদের মাইনে সরকারি কর্মচারিদের চেয়ে অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও তাদের ব্যবহার একেবারেই অন্যরকম। এ কথা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি।
তারপর?
হ্যাঁ। কিষুনই বলল যে রুদ বাংলোতে বুকিং করা হয়েছে। সেখানে পৌঁছেই লাঞ্চ হবে। তবে পৌঁছতে পৌঁছতে চারটে বেজে যাবে। আপনারা যদি সাড়ে আটটার মধ্যে রাঁচি থেকে বেরোতে পারেন তো ভাল হয় তবে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে।
ওদের তাই বলে দিলাম। ঠিক সাড়ে আটটাতেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। রাতুর রাজবাড়ি ডানদিকে রেখে বিজুপাড়া হয়ে কুরু হয়ে কুরু চাদোয়ার ঘাট হয়ে চাঁদোয়া টোড়ি লাতেহার হয়ে ডালটনগঞ্জের আগে সাত কিমিতে বাঁদিকে ঢুকে গেলাম বেতলার পথে। বেতলা পৌঁছে কেঁড় হয়ে মুণ্ডু হয়ে গাড়ু হয়ে আমরা রুদে যখন পৌঁছলাম তখন সাড়ে তিনটে বাজে। পথে লাতেহারে দাঁড়িয়ে ওদের কালাজামুন আর নিমকি খাইয়েছিলাম ওদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও। ওরা বলল, স্টম্যাক আপসেট হবে। আমি বললাম, লাহোরের এই পণ্ডিতের দোকানের কালাজামুন আর নিমকি না খেয়ে পালামৌতে কেউ বাঘ মারতে পারেনি।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কি খেয়েছিলেন?
ভটকাই বলল।
পালামৌ-এর লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তো আর নিজে বাঘ মারেননি তাই হয়তো খাননি তা ছাড়া তার সময়ে পণ্ডিতের এই দোকান আদৌ ছিল কিনা কে জানে!
যাই হোক, আমার কথাতে ভজে ওরা বাধ্য হয়ে গেল।
বিদেশিদের ধারণা ভারতবর্ষে জল আর খাবার খেলেই মৃত্যু অনিবার্য। কত রকমের ভুল ধারণাই যে চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। ভারতীয়দেরও কোনও চেষ্টা নেই এই ভুল ভাঙাবার।
বিদেশি কেন? এন আর আই ভারতীয়রাও তো তেমনই। ওঁদের হাব-ভাব দেখলে হাসি পায়।
বিকেলে একটা ঘুম দিয়ে উঠে মুসলিম, সুখরাম, আর তাহের আলির সঙ্গে বসলাম স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে। বেতলা থেকে কেরকেটাও এসেছিল ছুটি নিয়ে। স্ট্র্যাটেজি যা নেবার সে তো আমাকেই নিতে হবে। বাঘের ব্যাপারে এরা দুজনেই পুরো নভিস।
বাঘটা মদ্দা বাঘ। বেশ বড় বাঘ। গৃহপালিত গোরু মোষ একেবারে মারে না যে তা নয়। তবে বর্ষাকালেই বেশি মারে। তখন তো জঙ্গলের সব কাজ বন্ধ থাকে বলে আসাও বন্ধ থাকে বহিরাগতদের। নিরিবিলিতে শিকারি-রহিত হয়ে বাঘেদের ভোজ লাগাতেও সুবিধে হয়।
বাঘটার একটি ডেরা জঙ্গলের মধ্যের একটি গুহায়। নদীর ওপরে। সম্ভবত নদীতে জল-খেতে আসা বন্যজন্তুদের দেখতে পায় সে গুহা থেকে। বা গুহার বাইরের পাথরে বসে, তাই ওইখানে আস্তানা গেড়েছে।
মানুষও মারছে নাকি মাঝে মধ্যেই?
জন্তু বলতে?
তিতির বলল।
কী নেই তাই বল! হাতি, রুদের দিকে একটু কম আছে যদিও কিন্তু বাইসন বা ভারতীয় গাউর, বুনো মোষ, শম্বর, চিতল হরিণ, শুয়োর, বার্কিং ডিয়ার, শজারু, ভাল্লুক আরও কত জানোয়ার।
ভাল্লুক কি বাঘের খাদ্য?
না, খাদ্য তো নয়ই বরং মাঝে মাঝে ভাল্লুকের সঙ্গে লড়াইয়ে বাঘের প্রাণসংশয়ও হয়। আর শজারু যদিও খাদ্য কিন্তু খুব খিদে না পেলে শজারুকে ঘাঁটায় না বাঘ। শজারুর কাটা বাঘের গায়ে গলাতে বিধে গেলে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায় এবং অনেক সময়ে তাতে বাঘ মারাও যায়। মারা যাক আর না যাক এই কাটার জন্যে, স্বাভাবিক খাদ্য যেসব জন্তু জানোয়ার তা ধরার ক্ষমতা থাকে না বলে অনেক সময়ে মানুষখেকোও হয়ে যায়। এই বাঘটাও তাই হয়েছিল কি না কে জানে!
আমি বললাম, বাইসনকেও ঘটায় না বাঘ।
তা ঠিক। তবে বাচ্চার ওপরে লোভ আছে খুব। হাতির বাচ্চার ওপরেও।
তারপর?
তিতির বলল।
আমরা ঠিক করলাম পরদিন সকালে জঙ্গলে গিয়ে বাঘের যাতায়াতের পথ দেখতে হবে। পায়ের দাগও নিজের একবার দেখা দরকার। সেই গুহাটাতেও সরেজমিনে তদন্তে যাওয়া দরকার।
তারপর।
তারপর সাহেব-মেমসাহেব শীতে কাবু। পশ্চিমি দেশে সব জায়গাতে হিটিং থাকাতে শীত সহ্য করার ক্ষমতা তাদের অনেক কমে গেছে অথচ একদিন এদের পূর্বপুরুষেরাই ওই প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে কানাডা ও উত্তর আমেরিকাতে আস্তানা গেড়েছিল। এখন তারা অনেকেই আরাম আয়েসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
যাই হোক পরদিন ভোরে চা খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। তবে লিলি আর জনি বাংলোর হাতাতে রোদে চেয়ার পেতে বসে থাকল। বাঘের খোঁজ করতে গিয়ে অত ভিড় বাড়াবার দরকার নেই তাই ওদের রেখে গেলাম।
বাংলো থেকে পাঁচশো গজ গিয়েই বাঘের পায়ের দাগ দেখা গেল। কাল রাতের দাগ। তার মানে আমরা তাকে দেখার আগেই আমরা যখন ক্যাম্প ফায়ারের সামনে বসে বার-কি-কিউ করছিলাম কচি শুয়োরের তখন বাঘ এসে আমাদের দেখে গেছে। পায়ের দাগ দেখেই বুঝলাম যে মদ্দা বাঘ এবং বেশ বড় বাঘ। এত বড় বাঘ দেখে আনাড়ি শিকারিদের অবস্থা কী হয় তাই চিন্তার।
ঘণ্টাখানেক চতুর্দিক ঘুরে আমরা এই সিদ্ধান্তে এলাম যে বাঘ বাংলোর ডানদিকের জঙ্গলেই আছে। তখন কেরকেটা বলল, দুপুরেই যদি হকোয়া করা যায় তবে বাঘকে মারার একটা সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। কোনদিক দিয়ে হকোয়া করা হবে এবং শিকারিদের ও স্টপারদের মাচা কোন কোন গাছে বাঁধা যেতে পারে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ফিরে এলাম ব্রেকফাস্টের আগেই রুদের বাংলোতে। সুখরাম, তাহের আলি এবং কেরকেটা গেল রুদ বস্তিতে হাঁকোয়াওয়ালা ঠিক করতে। সকাল সকাল গিয়ে তাদের ধরতে না পারলে সবাই জঙ্গলে বেরিয়ে যাবে কুপ কাটতে তাই ওদের তড়িঘড়ি পাঠিয়ে দিলাম। বেলা দশটা নাগাদ ওরা ফিরে এলে চৌকিদারকে বললাম ওদের নাস্তা দিতে। নাস্তা করে ফিরে এসে ওরা বলল আমরা এবারে যাই মাচা বাঁধতে। ঠিক হল দুপুরের খাওয়ার পরে বানারীর পথে যে মস্ত শিমূল গাছটা আছে পথের বাঁপাশে সেখানে আমরা জিপ নিয়ে যাব। সেখান থেকে মাচাতে নিয়ে যাবে ওরা। কেরকেটা থাকবে বিটার বা হাঁকাওয়ালাদের সঙ্গে আর তাহের আলি আর সুখরাম থাকবে স্টপারদের মাচাতে। অভিজ্ঞ স্টপার না হলে বাঘ এদিক ওদিক দিয়ে বেরিয়ে চলেও যেতে পারে শিকারিদের মাচার দিকে না এসে। হাঁকা করাও যেমন একটি বিশেষ কাজ তেমনি বাঘকে ঠিক পথে চালিত করাও বিশেষ কাজ। জোরে আওয়াজ করলে বাঘ ভয় পেয়ে যেতে পারে এবং তা করলে বিটারদের মধ্যে কারও কারও বাঘের হাতে জখম অথবা নিহত হবারও আশঙ্কা থাকে। ঠিক করলাম ওদের এক মাচাতে চড়িয়ে দিয়ে আমি কাছাকাছি কোনও গাছে থাকব অবস্থা সামাল দেবার জন্যে।
তারপর?
দুপুর একটাতে লাঞ্চ সেরে আমরা জিপ নিয়ে সেই শিমূল গাছের নীচে গিয়ে পৌঁছলাম। কেরকেটা হাঁকাওয়ালাদের নিয়ে গুহাটার দিকে চলে গেছিল আগেই। গুহার পেছন থেকে হাঁকা করে গুহা থেকে বাঘকে বার করে শিকারিদের মাচার দিকে তাড়িয়ে আনবে ওরা। তাহের আলি তার লালরঙা সোয়েটারটা নাড়াবে একটা টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে আর তাই দেখেই কোয়া শুরু করাবে কেরকেটা।
জনি ম্যাকগাওয়েনের হেভি রাইফেল তো ছিলই। আমার চার্চিল শটগানটি– ডাবল ব্যারেল, ত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলের, লিলিকে দিলাম। কী করে গুলি ভরতে হয় তা শিখিয়ে দুটি অ্যালফাম্যাক্সের এল. জি. ওকে দিয়ে ফিসফিস করে বললাম যে মাচাতে উঠে গুলি ভরবে। সেফটি ক্যাচও দেখিয়ে দিলাম। বুড়ো আঙুল দিয়ে সামনে ঠেললেই বন্দুক আনসেফ হয়ে যাবে তখন ট্রিগার টানলেই গুলি বেরোবে। জনি দেখলাম আমার মাতব্বরি বিশেষ পছন্দ করছে না। সে তিনটি গুলি ম্যাগাজিনে দিয়ে চেম্বারে একটি দিয়ে রাইফেল সেফ করে নিল।
কেরকেটা খুবই অভিজ্ঞ। সাহেব-মেমসাহেব যে আমাদের মতো পা মুড়ে বসতে পারবে না তা জেনেই ওদের মাচার ওপরে দুটো বাঁশের মোড়াও ওরা পেতে দিয়েছিল। গাছের ডাল কেটে যে সিঁড়ি বানানো হয়েছিল তা দিয়ে ওরা ওপরে উঠে যেতেই সিঁড়িটাকে বয়ে নিয়ে আমরা দূরে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম। আমি পাশের একটি কেঁদ গাছে উঠে যাওয়ার পরই তাহের আলি সোয়েটার নাড়িয়ে হাঁকোয়া শুরু করার নির্দেশ দেবার জন্যে চলে গেল। সেই নির্দেশ দিয়েই সে তার গাছে চড়ে পড়বে। স্টপারদের বা আমার কোনও মাচা ছিল না।
ওদের দেখে মনে হল জনি আর লিলি বেশ আরামেই বসেছে। তখন সূর্য মাথার ওপরে তাই তাদের টুপি দুটো খুলে তারা পেছনে রাখল। বলেছিলাম মাচাতে বসে নড়াচড়া বা কোনও শব্দ করবে না। বাঘ এলে তাকে কাছে আসতে দেবে এবং পঁচিশ-ত্রিশ গজের মধ্যে এসে গেলে তবেই গুলি করবে। এবং গুলি করবে বুক, ঘাড় বা মাথাতে নিশানা নিয়ে। ভুলক্রমে যেন পেট বা পেটের নীচে গুলি না লাগে। ওরা মাথা নেড়ে বুঝেছে বলল।
নিজে শিকার করা আদৌ কঠিন নয় কিন্তু কোনও শুট-এ যদি কোনও অতিথিকে দিয়ে বাঘ মারাতে হয় তখন তা বিশেষ কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত অতিথির নিশানা বা স্নায়ুর ওপরে নিজের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। দ্বিতীয়ত বাঘকে যদি জায়গামতো গুলি করে ধরাশায়ী না করতে পারে তবে সেই বাঘের বিস্তর বেগ দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। আহত বাঘকে ছেড়ে চলে যাওয়া কাপুরুষের লক্ষণ তো বটেই বাঘের যন্ত্রণা শেষ করাটাও বড় কর্তব্য। গুলি যে জায়গাতেই লাগুক যন্ত্রণা তো হবেই। তা ছাড়া রাইফেলের গুলি শরীর এফোঁড় ওফোড় করে দেয় যেহেতু, সেহেতু রক্তক্ষরণও প্রচুর হয়। এল. জি. বা বল, মানে। বন্দুক দিয়ে মারলে এফেঁড় ওফোড় করার ক্ষমতা থাকে না সে গুলির, তাই বন্দুক দিয়ে মারা আহত বাঘকে খুঁজে বের করে শেষ না করতে পারলে সে বাঘের মানুষখেকো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এ বাঘ তো মানুষখেকোই।
এই সময়ে অভিজ্ঞ শিকারিরও প্রচণ্ড উত্তেজনা হয় আর নতুন শিকারিদের তো কথাই নাই।
হাঁকোয়া শুরু হয়ে গেল। মাদল, ধামসা ও শিঙের আওয়াজ এবং উঁচুগ্রামে বেচারি বাঘ এবং তার অদৃশ্য মা বাবার প্রতি প্রচুর অশ্লীল গালগাল করতে করতে কোয়াওয়ালারা শিকারিদের রক্ত জল করে এগিয়ে আসতে লাগল। নানা পাখি, মুরগি, ময়ূর, তিতির, বটের আসকল এসব ভয় পেয়ে উড়ে আসতে লাগল। একটি কোটরা হরিণ বা বার্কিং ডিয়ার দৌড়ে গেল মাচার প্রায় সামনে দিয়েই। জনি রাইফেল ওঠাচ্ছিল, লিলি দেখলাম তার হাত চেপে ধরে বারণ করল। আমার পূর্ণ নিষেধ ছিল। বলেছিলাম বাঘ শিকারে এসে অন্য কোনও জানোয়ারকেই গুলি করা চলবে না। গুলি করলে বাঘ সেই গুলির শব্দেই সাবধান হয়ে বিটারস লাইন ভেঙে দু-চারজনকে জখম করে বেরিয়ে যাবে তা হলে অথবা স্টপারদের নিষেধ না শুনে হাঁকোয়ার পথের ডানদিকে বাঁদিকে বেরিয়ে যাবে।
হাঁকোয়াওয়ালারা যত এগিয়ে আসতে লাগল ততই উত্তেজনাও বাড়তে লাগল। একটা মস্ত ভাল্লুক হন্তদন্ত হয়ে চার পা তুলে লাফাতে লাফাতে চলে গেল। জনি দক্ষিণ আফ্রিকাতে শিকার করেছিল। সিংহও নাকি মেরেছিল একটা কিন্তু আফ্রিকাতে শিকার করা এবং সিংহ মারা আর ভারতে বাঘ মারা এক ব্যাপার নয়। এ কথা তোরাও জানিস আফ্রিকাতে গিয়ে নিজ চোখে সেখানকার বনজঙ্গল ও জানোয়ারদের দেখেছিস বলেই জানবি। ভারতের জঙ্গলের সৌন্দর্য ও ভয়াবহতাই আলাদা। অবশ্য পশ্চিম আফ্রিকার জঙ্গলও তাই কিন্তু পুব বা দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গল সেরকম নয়।
নিশ্চয়ই! বললাম আমরা সমস্বরে।
ভটকাই বলল, টেনশন এখন প্রচণ্ড, এখন অন্য প্রসঙ্গ এনো না। তারপরে কী হল বলো?
একদল মেয়ে শম্বর, যে দলে একটিও শিঙাল ছিল না, দুদ্দাড় করে তাদের খুরে খুরে মেদিনী কাঁপিয়ে চলে গেল। বিটাররা প্রায় এসে গেছে। সচরাচর বাঘ বা চিতা কিন্তু বিটারদের পায়ে পায়ে আসে। অনেক সময়ে আবার ছুলোয়া শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে আসে–সেসব ক্ষেত্রে ধূর্ত বাঘ হকোয়া বা ছুলোয়া যে হবে তার অনুমান আগেভাগেই করে নিতে পারে। প্রথম শব্দ শোনার পরই দ্রুতগতিতে বিপজ্জনক এলাকা ছেড়ে তারা পালাতে চায়। এই পূর্ণবয়স্ক বাঘ এর আগে অনেকবার হাঁকোয়ার সম্মুখীন হয়েছে এবং হয়েও যে এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে তার মানে হকোয়ার হাল-হকিকৎ সে ভালমতোই জানে।
এখন উত্তেজনা তুঙ্গে। এমন সময়ে ওই হো। বাঘোয়া যা রহা হ্যায় হোবহত বড়া বাঘ।
এসব কথার মানে তো জনি আর লিলি বুঝতে পারছিল না। তাতে ওদের উত্তেজনা আরও বেশি হচ্ছিল। হঠাৎ দেখা গেল প্রকাণ্ড বাঘটি আসছে। গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে শীতের শেষ দুপুরের সূর্যের আলোর মধ্যে দিয়ে ফ্রিস্টাইলে সাঁতার কাটার মতো করে বাঘ এগিয়ে আসছে সোজা ওদের মাচার দিকেই। মাঝে তিন-চারবার স্টপারদের ঠক ঠক করে গাছের সঙ্গে কুড়ুলের বাড়ির শব্দ পেয়েছিলাম।
বাঘটা যেন বিজ্ঞাপনের মডেল। ক্যাটওয়াক করে এসে, যেন পোজ দিয়ে দাঁড়াল মাচার সামনে। যেন না বলে বলল, আমি এসেছি।
I have finally arrived.
তারপর?
তারপর আর কী?
জনি ওয়েসমুলারের মতো চেহারার জনি ম্যাকগাওয়েন বলল, ওহ মাই গড।
তারপর?
তারপর বাঘ মাচার দিকে মুখ তুলে চাইল কে তাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করে বিজাতীয় ভাষায় কথা বলছে দেখার জন্যে।
জনির রাইফেল কিন্তু তার কোলের ওপরেই রয়ে গেল, যেমন ছিল, তাতে হাত পর্যন্ত লাগাল না সে।
তারপর?
তারপর লিলি বন্দুকটা তুলে দড়াম করে দেগে দিল। গুলিটা কোথায় লাগল। বুঝলাম না। একটু পরে বুঝেছিলাম লেজে। লেজে গুলি লাগতেই বাঘ প্রচণ্ড গর্জন করে এক লাফ মারল ওদের দিকে কিন্তু ধরতে না পেরে মাটিতে পড়েই আরেক লাফে অন্তর্হিত হয়ে গেল।
তারপর?
তারপর আর কী? মঞ্চে শ্মশানের নীরবতা কিন্তু আমাদের সামনে তো তখন ইংরেজিতে যাকে বলে Hell broke loose সেই অবস্থা।
কেরকেটা এসে দাঁড়াল আলোকিত রঙ্গমঞ্চে।
বলল কেয়া হুয়া?
আমার কিশোর কুমারের গানটা মনে পড়ে গেল। কেয়া হুয়া? ক্যায়সে হুয়া?
লিলির দিকে তাকালাম।
সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আই অ্যাম সরি। ভেরি ভেরি সরি ঋজু। বাট লুক অ্যাট জনি।
জনির অবস্থা শোচনীয়। বাকরুদ্ধ। সেই বেতালের গল্পে ভালুকের থাপ্পড় খাওয়া মানুষের মতো অবস্থা তার। সে নামতেও পারছে না।
লিলি বল, ঋজু, গো টু দ্য বাংলো অ্যান্ড ব্রিং অ্যানাদার ট্রাউজার ফর হিম প্লিজ।
আমি সকলকে বলে ভিড় কাটাবার কথা বললাম। রইল শুধু তাহের আলি আমার সঙ্গে। ওকে সেখানে রেখে জিপ চালিয়ে রুদ বাংলোতে এসে জনির একটি ট্রাউজার এবং জলের বোতল এবং টয়লেট পেপারের একটা বাক্স নিয়ে ফিরে গেলাম।
আমরা হো-হো করে হাসতে লাগলাম।
ঋজুদা বলল, তোরা হাসছিস! বেচারা জনির অবস্থাটা ভাব একবার।
আমি বললাম, তুমি গুলি করলে না কেন?
কেন যে করলাম না তা আজও ভাবি।
কেন করলে না?
তিতির বলল।
এ নয় যে আমি মস্ত বীরপুরুষ এবং একটুও ভয় পাইনি। ভয় অবশ্যই পেয়েছিলাম। বড় বাঘের সঙ্গে মোকাবিলা তো জীবনে কম করিনি কিন্তু অমন হুংকার কখনও শুনিনি। আমি যদি মানুষ না হয়ে বাঁদর হতাম তাহলে সেই হুংকারেই গাছের ডাল থেকে হাত ফসকে নীচে পড়ে যেতাম।
কেন? তোমার বন্ধু জনিও তো সহজেই পড়তে পারত। বড় কম্মোটি করে ফেলতেই বোধ হয় চলচ্ছক্তিরহিত হয়ে গিয়ে থাকবে।
প্রথমত, গুলি করিনি বাঘটা ওদের দিয়ে মারাব বলেই এ যাত্রাতে আসা। ওরা কত দূর দেশ থেকে এসেছে এবং দূর দেশে চলেও যাবে। জীবনে বাঘ মারার সুযোগ ওদের হয়তো আর কখনওই আসবে না। আমি মারলে তো সে বাঘ ওদের হত না। কোনও ভাল স্পোর্টসম্যানই অন্যের মারা ট্রফিকে নিজের বলে চালান না। তাই গুলি করিনি।
দ্বিতীয়ত আমি বুঝতেই পারিনি যে লিলি মার তো মার বাঘের লেজে গুলি করেছে। আমি ভেবেছিলাম গুলি লাগেইনি।
তারপর বলল, আমি মারলেও বাঘ যখন ব্রড সাইড টার্গেট হয়ে দুপুরের রোদে রাজার মতো দাঁড়াল ওকে তখনই মারতে পারতাম। যখন লাফাল তখন তাকে শূন্যেই মারতে পারতাম। তারপর যখন মাটিতে পড়েই অন্তর্হিত হল তখনও তার আগেও মারতে পারতাম। কিন্তু বললাম না, বাঘ আমার মারলে চলত না তাই মারিনি।
তারপর?
ইতিমধ্যে গিরিধারী বড় এক প্লেট গরম গরম পেঁয়াজি নিয়ে এসে বলল, জুম্মান বাবুর্চি পাঠাল ঝাল নুন সব ঠিক আছে কিনা চেখে দেখতে।
হাতে হাতে উঃ উঃ করতে করতেও পেঁয়াজিগুলো আমরা তুলে নিলাম। গরম পেঁয়াজি মুখেই ভটকাই বলল, তোমার কী রাইফেল ছিল?
আমার হাতে আমার প্রিয় থ্রি সিক্সটি-সিক্স রাইফেলটা ছিল। ম্যানলিকার শুনার। ও রাইফেল দিয়ে আমি জীবনে একটি গুলিও মিস করিনি। জেঠুমনি অস্ট্রিয়া থেকে ইমপোর্ট করিয়ে ছিলেন। যেমন ব্যালান্স, তেমন মার। অ্যাকুরেট টু দ্য পাওয়ার এন। গুলি করলে বাঘ ওইখানেই থাকত।
কিন্তু তাহলে তো রুদ-এর বাঘের গল্প হত না। বাঘ এল, মারলে, আর পড়ে গেল এমন শিকারের গল্প আমরা কেউই শুনতে চাই না।
তিতির বলল।
তোরা না শুনতে চাইলেও জনি ম্যাকগাওয়েন শুনতে অবশ্যই চাইত। ওর অপকম্মোর ব্যাপারটা আমি কেরকেটা, তাহের আলি আর সুখরাম ছাড়া আর কেউই জানল না যদিও কিন্তু বেচারি জনি। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি না ওই কম্মোজনিত লজ্জার চেয়ে অনেক বেশি ভয় পেয়েছিল ও বাঘের দর্শনে ও গর্জনে। ভূতে পাওয়ার মতো কেবলই মাথা নাড়ে দুদিকে আর বলে, নো কমপ্যারিজন উইথ আ লায়ন। আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যানিম্যাল। লেটস গেট ব্যাক টু ক্যাল।
কলকাতা ফিরব কী করে! লেজে হোক আর যেখানে তোক বাঘের গায়ে গুলি তো লেগেছে। আহত বাঘ, তাকে ছেড়ে চলে গেলে পুরো পালামৌতে টি-টি পড়ে যাবে। আমার ভবিষ্যতে আসার কোনও মুখই থাকবে না। তা ছাড়া মুকুন্দবাবুই বা কী বলবেন। বনবিভাগের সব হোমরাচোমরার সঙ্গে ওঁর অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক। তার মুখেও চুনকালি পড়ে যাবে।
তারপর?
সন্ধের আগেই কেরকেটা, সুখরাম আর তাহের আলি ফিরে এল। আগুনের সামনে বসে আমরা আবার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে পড়লাম। জনি আর লিলি ঘরেই থাকল ফায়ারপ্লেস-এর সামনে। হুইস্কির বোতল খুলে জনি প্রায় আগুনের মধ্যে পা দুটো সেঁধিয়ে দিয়ে এই বাঘের স্মৃতি ভোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সে স্মৃতি তো ভোলার নয়। বড় বাঘের সঙ্গে যাদেরই মোকাবিলা হয়েছে সেই মোকাবিলার স্মৃতি আজীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। কখনও স্বপ্নে কখনও খোলা চোখেই একা থাকলে বা ওই জঙ্গলে আবার গেলে সেই স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হবে।
আমরা চারজনে আলোচনা করছিলাম গুলিটা, মানে এল. জি.-র দানা বাঘের লেজের আগায় লেগেছে না গোড়ায়। গোড়াতে লাগলে ব্যথা বেশি হবে এবং বাঘের মলত্যাগ করতেও অসুবিধা হতে পারে। তখন কথা হল বাঘের সঙ্গে মোলাকাত আবার কীভাবে করা যায়। হাঁকাতে সে আর বাইরে আসবে না। বিটারস বা হাঁকোয়ালাদের মেরে বেরিয়ে যাবে লাইন ক্রস করে।
কেরকেটা বলল, একটা নধর কিন্তু ছোট মোষ বেঁধে দেওয়া যাক আজই। বাঘকে তো খেতে হবে। লেজের যন্ত্রণা নিয়ে তার পক্ষে বন্যপ্রাণী ধরে খাওয়া মুশকিল হবে কয়েকদিন। হয়তো মানুষ মারাও।
সুখরাম বলল, বেকারকা বাত। উ বাঘোয়া আভি নজদিকমে থোড়াই রহবে করে গা। বহুত দূর চল দিয়া হোগা ও। ফিন পাত্তা লাগানা পড়েগা উ হায় কাহা। পাতা লাগনেসে প্যায়দল যাকে উসকো পালসা শিকারমে মারনা হোগা।
তাহের আলি বলল, দো রোজ দিখা যায়।
চারদিকের বস্তির লোকদের বলে দিতে হবে বাঘের টাটকা পায়ের দাগ দেখলেই যেন আমাকে নইলে ওদের খবর দেয়। কেরকেটা বলল, অন্য ফরেস্ট গার্ডদেরও বলে দেবে ঘটনার কথা। কানকাটা বাঘের খোঁজ রাখবে তারা।
তিতির বলল, কানকাটা কেন?
ঋজুদা বলল, আমিও সেই প্রশ্নই করলাম তাহের আলিকে।
সে বলল, বাঘটার বা কানটা ছেঁড়া আছে। হয় শিশুকালে নয় বড় হবার পর অন্য বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ে তার কান কাটা গেছে। কাটা মানে পুরো কাটা না। কানটা ছিঁড়ে গেছে। অথবা কোনও শিকারির বাঘের মাথা লক্ষ্য করে করা গুলি মাথা মিস করে তার কানের মধ্যে দিয়ে চলে গেছিল হয়তো। এ জঙ্গলে বাঘটা এসেছে বছর তিনেক হল। যারা তাকে দেখেছে সেই সব প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ীই বলল তাহের ও কথা। তা ছাড়া হরিণের সেনসাস যখন হয় তখন বছর দুয়েক আগে বাঘটাকে কেউ কাছ থেকে দেখেছিল। কেউ দেখেছে যে বাঘের বাঁ কানটা ঝুলে আছে।
তারপর?
তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে দুদিন দেখাই যাক। আমাদের হাতে আরও পাঁচদিন সময় আছে। ষষ্ঠ দিনে লাঞ্চের পরই রওনা দিতে হবে রাঁচির দিকে, রাঁচি থেকে রাঁচি-হাওড়া এক্সপ্রেস ধরার জন্যে। তখন রাস্তাঘাট এত ভাল ছিল না। অনেক সময় লাগত রাঁচি পৌঁছতে। রাঁচি এক্সপ্রেস তখন রাঁচি থেকেই ছাড়ত। হাটিয়া থেকে আসত না ট্রেন। হেভি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কারখানার পত্তন যদিও হয়ে গেছে ট্রেন হাটিয়া থেকে ছাড়ত না।
তারপর?
আমাদের পারমিটে একটি ভাল্লুক, একটি শম্বর, একটি স্পটেড ডিয়ার এবং যত খুশি শুয়োর মারার ছাড়পত্র ছিল। কিন্তু বাঘের একটা হিল্লে না করা পর্যন্ত অন্য কিছু শিকারের ইচ্ছে এবং উপায়ও ছিল না। লিলির গুলিতে শব্দ তো হয়েইছে আবারও রাইফেল বন্দুকের আওয়াজ শুনলে বাঘ যদি এ তল্লাটে থাকেও তাহলে সে বহুদূরে চলে যাবে।
ঋজুদা বলল, যা ঘটল তার পরে জনি ও লিলিও আর শিকারের কথা মুখেও আনবে না মনে হয়।
রাতেরবেলা যখন জুম্মান ডিনার সার্ভ করল তখন জনি প্রায় ড্রাঙ্ক হয়ে গেছে। কেবলই বলছে হোয়াট আ শেম। হোয়াট আ শেম।
আমি বললাম, এরকম অনেকেরই হয় তোমার বিশেষ লজ্জিত হবার কারণ নেই।
তারপরই বলল, তোদের কি কন্টিপেটাংয়ের গল্পটা বলেছি?
কন্টিপেটাং? সেটা আবার কী জিনিস?
আমি বললাম।
সে হাজারিবাগের সীতাগড়ার মানুষখেকোর গল্প। কখনও বলা যাবে।
কখনও নয়, আজ রাতেই বলতে হবে।
ভটকাইও বলল, হ্যাঁ আমরা আজ রাতেই শুনব।
ঋজুদা বলল, দেখা যাবে, রাত তো হোক।
আর ভূতের গল্প দুটো?
আমি বললাম।
তিতির বলল হ্যাঁ সে দুটো তো শুনতে হবেই তবে সে দুটো কালকের রাতের জন্যে ভোলা থাক।
তাহলে কানকাটার গল্প কখন শোনা যাবে?
আমি বললাম।
হবে রে হবে। সব হবে। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না আর আমরা তো শিকারে আসিনি–গল্প করেই সময় কাটবে। সময়ের অভাব কোথায়।
ভটকাই বলল, হ্যাঁ। গল্প আর ভালমন্দ খাওয়া-দাওয়া।
বলেই বলল, আজ রাতের মেনু কী হবে?
ঋজুদা বলল, জুম্মান বলেছে আজ রাতে সে ছাতুর লিট্টি বানাবে সঙ্গে আচার আর মুরগির কাবাব।
ফাইন। জমে যাবে।
ভটকাই বলল।
লছমন বলে পাঠাল আধঘণ্টার মধ্যে খিচুড়ি হয়ে যাবে। গরম গরম খেয়ে নিলে আর গরম করার ঝামেলা থাকবে না।
ঋজুদা বলল, আমাদের ডাকলেই আমরা চলে যাব। কালো কালো পাথরের ওপরে বসে গরম গরম সার্ভ করা খাবার রোদে পিঠ দিয়ে বসে খাব। গল্প না-হয় মুলতুবি থাকবে রাতের জন্যে। ডিসেম্বরের দিন। আকাশও মেঘলা করে এসেছে। ঋজুদার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি করে সেই ডিসেম্বর শেষের বৃষ্টিটা এবারে আসছে মনে হয়। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়াও বইবে কনকনে।
.
০৫.
রুদ-এর বাংলোতে ফিরে আমরা ঋজুদাকে ধরে বসলাম যে আগে কন্টিপেটাংয়ের গল্পটা আমরা শুনতে চাই।
বিকেলে সকলে মিলে হেঁটে এলাম কিছুটা। তারপর সন্ধে নামলে ঋজুদাকে ঘিরে ক্যাম্পফায়ারের সামনে গোল হয়ে বসে আমরা বললাম, এবারে কন্টিপেটাং। বৃষ্টি এখনও নামেনি তবে মনে হচ্ছে রাতেই নামবে। চৌকিদার এসে আগুনে নতুন কাঠ দিয়ে আগুনটাকে জোর করে দিয়ে গেল।
মোহনদা একবার ঘুরে গেল বাবলু আর রমেনদাকে নিয়ে। প্রতি সন্ধেতে, সে ডালটনগঞ্জে থাকলে চিপদোহরে আসে ব্যবসার কাজে। যেখানে তার ট্রাকের গারাজ এবং কারখানা আছে। মুসলিম এই ডিপোর ইনচার্জ। চিপদোহর থেকে ডালটনগঞ্জ আঠারো মাইল। আর মারুমার বেশ দূরে।
মোহনদা এসে বলল, কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছে না তো ঋজুদা?
ঋজুদা বলল, তুমি আবার এতদূর এলে কেন? বৃষ্টি নামবে যে কোনও সময়ে।
দেখে গেলাম। না এলে আমার চাকরিটাই তো যাবে। তবে এক কাপ করে চা খেয়েই রওনা দেব কারণ আজ শান্টুর ছেলে রনির জন্মদিন। শান্টু মোহনদার মাসতুতো ভাই। এখন হুলুক পাহাড়ের কাজের জিম্মাতে আছে।
মোহনদারা যেতে যেতে অন্ধকারও হয়ে গেল। আমরা বললাম, এবারে শুরু করো।
ঋজুদা পাইপটা ভাল করে ধরিয়ে নিয়ে বলল, এ পঞ্চাশের দশকের গল্প। আমি তখন একেবারেই ছেলেমানুষ। কলেজে পড়ি। হাজারিবাগের সুব্রত এবং গোপালও তাই। আমি আর গোপাল হাজারিবাগে গেছি। বর্ষাকাল। খবর পেলাম সীতাগড় পাহাড়ে একটি মস্ত বড় বাঘ ম্যানইটার হয়েছে। মানুষ তো মারছেই তার ওপরে পাহাড়ে যে পিজরাপোল আছে তার গোরু-মোষও মারছে যথেষ্ট।
গোপাল মানে, তোমার বন্ধু গোপাল সেন?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হ্যাঁ। আর অন্য কোনও গোপালকে চিনি না আমি। গোপালদের গয়া রোডের পূর্বাচল বাড়িতে আছি। চমন রান্নাবান্না করে। রান্না মানে আমরা যা তিতির মুরগি খরগোশ মারি তাই রান্না করে। দুজনেই ছাত্র। আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। শিকার হলে মাংস নয়তো এবেলা খিচুড়ি ওবেলা খিচুড়ি। তাই অমৃত। তখন সদ্য যৌবন–ভাললাগার ক্ষমতা–একটুতে হেসে গড়ানো–এখন যেমন তোদের। সেসব দিনের কথা মনে হলে মন বড় বিধুর হয়ে যায়। সুব্রত চ্যাটার্জির সঙ্গে আমরাই যেচে আলাপ করি। সেবারেই। ওর বাবা তখন হাজারিবাগের পুলিশ সাহেব। ওর সঙ্গে আলাপ করলে যদি জিপ-টিপ-এর সুবিধা হয় এই ছিল উদ্দেশ্য। তা হয়নি কিন্তু সমবয়সি সুব্রত ও তার ছোট ভাই মুকুলের সঙ্গ পেয়েছিলাম। কত যে শিকার আমরা করেছি একসঙ্গে সেই সব বেহিসেব বিপজ্জনক দিনে তা আজ মনে হলে রোমাঞ্চ হয়।
সুব্রত এবং গোপাল আজ কেউই নেই তাই ওদের স্মৃতিমাখা গল্প করতে বসলে মনে হয় ওদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করছি।
বলেই ঋজুদা চুপ করে গেল।
বুঝলাম, মন ভারাক্রান্ত। আমরাও চুপ করে রইলাম ঋজুদা নিজে না যতক্ষণ কথা শুরু করে।
পাইপটা পরিষ্কার করে ঋজুদা বলল, সুব্রত চলে গেল তার বাবার সঙ্গে কোডারমাতে। তখন হাজারিবাগ মস্ত বড় জেলা ছিল। গিরিডি, কোডারমা, চাতরা এসব আলাদা জেলা হয়নি। তাই আমি আর গোপাল নাজিম সাহেব–মহম্মদ নাজিম–আমাদের হাজারিবাগের শিকারের গুরুর সঙ্গে সাইকেল রিকশা করে পাঁচ-ছ মাইল গিয়ে বন্দুক কাঁধে পায়ে হেঁটে সীতাগড় পাহাড়ের নীচে গিয়ে পৌঁছলাম বাঘের খোঁজে। কপাল ভাল। পথের পাশেই একটি নালাতে বাঘের পায়ের দাগ পাওয়া গেল। অতবড় বাঘের পায়ের দাগ তার আগে বা পরেও কখনও দেখিনি। সেই বাঘের চামড়া এখনও সুব্রতর বাড়িতে আছেদশ ফিট ছ ইঞ্চি লম্বা–বিটউইন দ্য পেগস।
ভটকাই বলল, আরেকটা মাপ কী যেন হয় বাঘের?
আমি বললাম, ওভার দ্য কার্ভস।
ঋজুদা বলল, বিটউইন দ্য পেগস মানে বাঘের লেজ আর নাকের সামনে খোটা পুঁতে সেই দুই খোঁটার মধ্যের দুরত্ব। আর ওভার দ্য কার্ভস হচ্ছে বাঘের গায়ের ওপর দিয়ে মেজারিং টেপ শুইয়ে নিয়ে লেজ অবধি পৌঁছে তার দুরত্ব মাপা। বলা বাহুল্য, ওভার দ্য কার্ভস মাপলে বিটউইন দ্য পেগস-এর চেয়ে বেশি হয়।
তিতির বলল, গল্পে ফেরো ঋজুকাকা।
হ্যাঁ। বাঘের পায়ের দাগ যে নালাতে দেখেছিলাম সে নালাটি থেকে উঠে পথ, পেরিয়ে বাঘ চলে গেছিল সীতাগড়া পাহাড়ের গায়ে। এই যাতায়াতের পথেই একটি ঝকড়া আমগাছ দেখে আমরা ঠিক করলাম বিকেলে এসে ওই গাছে মাচা বেঁধে বসব।
একটু থেমে বলল, তখন আমাদের কারওরই রাইফেল ছিল না। বন্দুকই ভরসা।
নাজিম সাহেব বললেন, চলুন একবার সীতাগড়া গ্রামে যাওয়া যাক। মাচা বাঁধার বন্দোবস্ত করে একটি মোষও বাঁধার বন্দোবস্ত করে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে হাজারিবাগ যাতে বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে এখানে আবার ফিরে আসতে পারি। বর্ষাকাল। সূর্য ডুববে সাড়ে ছটা নাগাদ। দু ঘণ্টা সময় থাকবে হাতে গোছগাছ করে নিয়ে মাচায় বসার জন্যে।
তার আগের দিন গোপালের তিন-চারজন বন্ধু কলকাতা থেকে একটি সিএয় গাড়িতে করে এসে হাজির। তাদের মধ্যে একজন নতুন বন্দুক কিনেছে। সে হাজারিবাগে বাঘ মারতে এসেছে যদিও বকও মারেনি তার আগে। তাদের মিথ্যে কথা বলে, আমাদের বন্দুক ভেঙে বাজারের থলেতে ঢুকিয়ে সাইকেল রিকশা করে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কাছারির মোড়ে নাজিম সাহেবের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সীতাগড়া যাই।
আমরা যখন সেই নালা থেকে উঠে লালমাটির বড় রাস্তাতে উঠেছি সীতাগড়া গ্রামে যাব বলে, সেই সময়ে সেই সিএয় গাড়ি সেখানে এসে হাজির। গোপালের ভাষায় চারগাছা’ শিকারি সমেত।
যার গাড়ি ও বন্দুক সে গাড়ি থেকে নেমেই বলল, আমাদের বাদ দিয়েই বাঘ মারবে। চালাকি পেয়েছ? চমনলালকে জেরা করে আমরা সব জেনে নিয়েছি। আমাদেরও সঙ্গে রাখতে হবে।
নাজিম সাহেব বললেন, আপলোগ সামনা যাকে সীতাগড়া গাঁওমে ইন্তেজার কিজিয়ে হামলোঁগ সব আভূভি আতা হ্যায়। তব বাতচিত হোগা।
কী ভেবে, ওরা গাড়িতে চড়ে চলে গেল।
তারপর ঋজুদা বলল, ওই পয়েন্ট থেকে আমরা কাট-অফ হয়ে যাচ্ছি। এরপরে কন্টিপেটাংয়ের গল্পটা শোন।
তারা গিয়ে গ্রামের সামনের মস্ত পিপ্পলগাছের নীচে গাড়ি দাঁড় করাল। বুড়ো মাহাতো এসে তাদের ঝকঝকে করে মাজা কাসার ঘটি থেকে জল আর গুড় খাওয়াল।
বুড়ো জিজ্ঞেস করল, হুজৌররা কেন এসেছেন?
মুখ্য শিকারি বলল, বাঘ মারনেকে লিয়ে। হিয়াপর হ্যায় বাঘ?
বাঘ?
বলল, বুড়ো মাহাতো। তারপর বলল, বাঘোয়া যো হ্যায় উ দিখকর আপলোগোঁকো দিমাগ খরাব হো যায়গা। ইতনা বড়া উঁচা। বলে ডান হাত দিয়ে নিজের বুক দেখাল।
তারপর বলল, মগর সাব আপনোগ পইলে বাঘঘায়া মারা কেয়া?
মুখ্য শিকারি বলল, বহুত মারা। সুন্দরবন তো কলকাত্তা কি নজদিকমেই হ্যায় না। বহত বাঘ মারা।
বুড়ো বলল, তব তো আচ্ছাই হ্যায়। মগর আপ কি কন্টিপেটাং হ্যায় ক্যা?
কন্টিপেটাং? উও কোন চিজ?
বাতাউ আপকো?
জরুর জরুর। বাতাইয়ে।
দেখিয়ে হুজৌর, কলকাত্তাসে এক ভারী শিকারি আয়া হুয়া থা। নাম থা চুনিবাবু। বহত ভারী শিকারি। সুন্দরবনমে বহত বাঘঘায়া মারকর আয়া।
তারপর?
উসবাদ বহত সারা তাম্বু লগ গ্যয়া। বহত মেহমান ভি থে। নাচনা-গানা ফালানা ঢামকানা। তো বাঘোয়া মারনেকি লিয়ে বহত বড়া নরপাঠঠা কাঁড়া ভি বন্ধা গিয়া ঔর উসকি ওপর মাচান।
কাঁড়াটা কী জিনিস?
ভটকাই বলল।
আমি বললাম, কাঁড়া আর ভইষা মানে, পুরুষ মোষ আর মেয়ে মোষ আমাদের যেমন বলদ আর গোরু, বুঝেছিস?
ভটকাই ইয়ার্কি মেরে বলল, হ্যাঁ জি। অব সমঝা।
তারপর?
তিতির বলল, এই ভটকাইটা মিছিমিছি ডিসট্রাক্ট করে দেয় গল্পটাকে। বলো ঋজুকাকা।
হ্যাঁ। বলি।
তো বুড়ো মাহাতো বলল, মাচান মে হাম ঔর চুনিবাবু বৈঠ গ্যয়া চার বাজি। চুনিবাবু কি ডাহিনে বন্দুকোয়া আর বাঁয়া রাইফেলোয়া।
মুখ্য শিকারি বলল, তারপর? উস বাদ।
ক্যা বলেগা হুজৌর, সুরজ বুড়হা নেহি, ঘোড়া যেইসি বাঘোয়া আকর পৌঁছ গ্যয়া। পৌঁছকর ইকদফে কাড়াকা তরফ দেখিন ওঁর ইক দফে মাচান কি তরফ দেখিন।
ম্যায় বোলা উনকি কানপট্টিয়ামে মু লাগাকর, মারিয়ে চুনিবাবু, মারিয়ে চুনিবাবু।
উসবাদ?
না বাত, না চিত, না বন্দুক উঠাইস, না রাইফেলোয়া। ঔর নীচে খাড়া হো কর বাঘোয়া ইম্মে উম্মে গাম্মাতা হ্যায়।
গাম্মাতা মানে?
মানে, দেখছিল।
উস বাদ?
উস বাদ আচানক ইতনা আওয়াজ ওর উতনাহি বদবু।
উস বাদ?
কেয়া করে ম্যায় হুঁওড়া পুতানিয়া, উপরমে চুনিবাবু নিচুমে বাঘোয়া।
উস বাদ?
আওয়াজ না শুনকর বাঘোয়া তো ভাগ গিয়া ওঁর ম্যায় তুরন্ত উতর আয়া মাচানসে। অংগলি সে নাক বন্ধ কর ম্যায় বলিন, আপ ঈ ক্যা কর দিয়া চুনিবাবু। বাঘোয়া ইতনা আহসান সে মারনে শকতে থে।
উস বাদ?
উস বাদ চুনিবাবু হামারা উপর বহতই বিগড়ে। বিগড়কে কহিন চুপ রহো। চুপ রহো। জলদি যাও, পায়জামা লাও।
পায়জামা?
হ্যাঁ হ্যাঁ পায়জামা। হামারা দো মাহিনেসে কিলিয়ার নেহি থে। হামারা কন্টিপেটাং থা। বাঘোয়া দিখকর দো মাহিনাকা…এক মরতবে হো গ্যায়া।
বলেই, বুড়ো মাহাতো চুপ করে গেল।
সমবেত জনমণ্ডলি এবং মুখ্য শিকারিও নির্বাক।
বুড়ো বলল, পহিলে বাতাইয়ে আপকি কন্টিপেটাং হ্যায় ক্যা? কন্টিপেটাং রহনেসে বাঘোয়া ম্যায় নেহি দিখলাউঙ্গা।
বলতেই, আমরা সকলে হো হো হো করে হাসতে লাগলাম।
হাসি শেষ হলে তিতির বলল, তোমাদের বাঘ মারার কী হল?
আমরা পরে মেরেছিলাম, তবে ওই সন্ধেতে নয়। না মারলে আর সুব্রতর দেওয়ালে বাঘের চামড়া ঝোলে কী করে।
তিতির বলল, তা হলে আর বেচারি জনি ম্যাকগাওয়েনের দোষ কী? সে তো আর একলা নয়।
অবশ্যই একলা নয়। এবং সে কথাই তো আমি বলেছিলাম জনিকে।
কী বলেছিলে?
ইতে লজ্জা পাওনের কিছু হয় নাই।
ভটকাই বলল।
.
০৬.
একপ্রস্থ করে চা খাওয়ার পরে এবং ঋজুদার পাইপ-ক্লিনিং-এর রিচুয়াল-এর পরে তিতির জিজ্ঞেস করল, গোপালকাকার সেই বন্ধুরা তারপরে কী বলল তোমাকে?
তারা আর কী বলবে। আমরা যখন হেঁটে হেঁটে সীতাগড়া গ্রামের প্রায় কাছে চলে এসেছি, দেখলাম ছাই-রঙা সিএয় গাড়ি তিরবেগে এদিকে আসছে গ্রামের দিক থেকে, পেছনে লাল ধুলোর মেঘ উড়িয়ে।
আমাদের দেখে গাড়ি দাঁড়াল। গাড়ির মালিক, বন্দুকের মালিক এবং ল্যান্সডাউন টেরাসের বন্ধু (নাম বলা যাবে না) মুখ বের করে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে বলল, উই আর আউট অফ দ্য শুট।
গোপালের মুখ দেখে মনে হল যে সে বাঁচল। আমরা তো বাঁচলামই। কিন্তু মনে তীব্র হতাশা মাখিয়ে গোপাল বলল, কিন্তু কেন? তারপর বলল, আমরা স্কাউটিং করতে এসেছিলাম তাই ইচ্ছে করেই তোমাদের জানাইনি কিন্তু যত বড় বাঘ দেখলাম…
বাঘ দেখলে?
ওরা সমস্বরে বলল।
বাঘ দেখলাম মানে বাঘের পায়ের দাগ দেখলাম। তাতেই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। এই বাঘ শিকার করতে more the merrier-মানে শিকারিদের কথা বলছি।
ভটকাই বলল, এ কী। চিরদিন তো শুনেছি বাঘ মারতে একা যাওয়াই ভাল বিশেষ করে মানুষখেকো বাঘ, বড়জোর একজন সঙ্গী থাকতে পারেন–এ কী ফুটবল খেলা যে এগারোজন লাগবে?
ঋজুদা বলল, সে তো সবাই জানে। গোপাল ওদের স্তোক দিল।
তারপর সেই বন্ধু আবার বলল, চোপ। উই হ্যাভ মেড দ্য ডিসিশান। আমরা লাঞ্চের পরই চলে যাব তিলাইয়া। রাতটা সেখানে কাটিয়ে কাল বার্নপুরে। তার পরদিন কলকাতা। বাই-ই-ই। তোমরা দেরি করে ফিরলে আর হয়তো দেখা হবে না হাজারিবাগে।
আমাদের তো দেরি হবেই।
তারপর গাড়ি স্টার্ট করে একটু এগিয়ে গিয়ে আবার ব্যাক করে ফিরে এল। এসে বলল, দ্যাট ওল্ড ম্যান…
নাজিম সাহেব বললেন, কিসকা বাত কর রহে হ্যায় আপ?
আরে ওই মাহাতো।
উনোনে তো বহতই আচ্ছা আমি হ্যায়। আপনোগোঁকি গুড় কি সাথ ঠান্ডা পানি পিয়া কি নেহি? সবহি কো তো পিলাতা।
উও তো পিলায়া। উসকো গুড়-পানিকি লিয়ে হামলোগ থোড়ি আয়াথা হিয়া।
বলেই, গোপালের দিকে চেয়ে বলল, হি ইজ আ ফাস্ট রেট খসসর।
কী বললে?
খচ্চর।
বলেই, অ্যাকসিলেটর দাবিয়ে টিকিয়া উড়ান চালিয়ে চলে গেল।
‘টিকিয়া উড়ান’ কী ব্যাপার ঋজুকাকা?
তিতির জিজ্ঞেস করল।
জানিস না তুই? আমি জানি, তোরা সকলেই জানিস। রুদ্র তো জানেই। এটা সুব্রতর ছোট ভাই মুকুলের কয়েনেজ। মানে, হুড নামানো, কাঁচ নামানো, পর্দা তোলা, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ডওয়ার-এর ডিসপোজাল-এর জিপ এমনই জোরে চালানো। হবে যে মাথার টিকি মাথার পেছনে পত পত করে উড়তে থাকবে এবং তখনই হবে ‘টিকিয়া উড়ান’ চালানো।
তিতির বলল, সত্যি! পারও তুমি আর তোমার বন্ধুরা।
এখন আর পারি না। তবে সে ছিল একদিন। নবযৌবনের দল ছিলাম আমরা।
‘ভালমানুষ নইরে মোরা ভালমানুষ নই।
পুঁথির কথা কইনে মোরা উল্টোকথা কই।‘
ভটকাই বলল।
কটা বাজে রে?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
আজকাল বেশ কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছে ঋজুদা, হয়তো একটু বুড়োও। নিজের হাতে বাঁধা রোলেক্স-এর ক্রনোমিটার থাকা সত্ত্বেও কষ্ট করে হাত তুলে নিজে সময়টা দেখবে না, অন্য কারওকে জিজ্ঞেস করবে। বেশ কিছুদিন হয় এমন করছে।
তিতির বলল, মোটে পৌনে সাতটা। সূর্য তো ডুবে গেছে পাঁচটাতে।
এমন সময় জোর হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি এল। দৌড়াদৌড়ি করে সবাই রুদ বাংলোর ভিতরে গিয়ে সেঁধোলাম। চৌকিদার, গিরিধারী, ওরা সব দৌড়ে এল চেয়ারগুলো ভিতরে করতে। ভিতরেও ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছিল। সব ঘরে। তখনই তাই নিয়ম ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ইলেকট্রিসিটি এসে যাবে এখানেও, তখন ডবল হিটার জ্বলবে। এই সুপ্রাচীন ও রইসি প্রথা উঠে যাবে। পৃথিবী অতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আগেরকার দিনের আর কিছুই থাকছে না।
তা ঠিক। ভটকাই বলল।
ঋজুদা বলল, সবচেয়ে বেশি যা বদলাচ্ছে তা মূল্যবোধ। আগেরকার দিনের সমস্ত মূল্যবোধই বদলে যাচ্ছে। অথবা কী জানি! বয়স হচ্ছে বলেই হয়তো আমার এমন মনে হয়। তোরাই বলতে পারবি।
তিতির অস্ফুটে বলল, আমরা আগেরকার দিনের মানুষ না হয়েও একথা বুঝতে পারি ঋজুকাকা। আমরা একটা সাংঘাতিক সময়ে বড় হচ্ছি। এক আঁধির মধ্যে। এই অন্ধ আঁধির মধ্যে অনেকেই পথ হারাবে যদি তাদের হাত ধরে এই অন্ধকার পার করে নিয়ে যাবার কেউ না থাকে। আমাদের তুমি আছ। আমাদের হারিয়ে যাবার ভয় নেই কোনও।
আমি কে? আমি নিজেই দিশেহারা হয়ে যাই আজকাল মাঝে মাঝে। গত দী। বছরের মধ্যে বদলটা সাংঘাতিক হয়েছে।
ভালই তো ঋজুদা। ইনফরমেশন টেকনোলজিতে যে এত উন্নতি হয়েছে এ কি খারাপ?
সত্যি কথা বলতে কী আমি নিজে এখনও নিশ্চিত নই। ব্যবসা বাণিজ্যর পক্ষে অবশ্যই ভাল তবে মানুষের জীবনে তো ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াও অন্য অনেক দিক আছে। সেই সব দিকের পক্ষে ভাল কী না তা এখনও নিশ্চিত করে বলার সময় বোধহয় আসেনি।
এখন আর সিরিয়াস কথার মধ্যে যেতে ইচ্ছে করছে না। জনি সাহেবের বাঘের কী হল তাই এখন শুনতে চাই। গল্পটা পুরো না শুনলে রাতে ঘুম হবে না।
ভটকাই বলল।
আমরা সবাই ভিতরে এসে গুছিয়ে বসলে ঋজুদা বলল, রাতে খাবার সময়ে লিলিয়ানকে বললাম, তোমার বাঘটার চামড়া অস্ট্রেলিয়াতে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। আমাদের কলকাতাতে কাথবার্টসন অ্যান্ড হার্পার, ওয়াটার্ল স্ট্রিটের মোড়ে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের পাশে, তারা খুব ভাল taxidermist। নইলে, মাড্রাসেও পাঠাতে পার ভ্যান ইনজেন অ্যান্ড ভ্যান ইনজেন-এ। তোমাদের States-এর ঠিকানা দিয়ে দিলে তোমরা যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে ছুটির পরে ফিরবে তখন সেখানে পাঠিয়ে দেবেন ওঁদের মধ্যে যে কেউই।
ঋজুদা তারপরে বলল, লিলি সিম্পসনও হুইস্কি খাচ্ছিল। এমনিতে সে এসব খায় না। খেলে, সামান্য ওয়াইন খায়। কিন্তু ওয়াইন ছিল না আমাদের সঙ্গে। সে বলল, তোমার ঠাট্টা কি এখনও শেষ হয়নি? আমাদের এমন দুরবস্থা ঘটানোর পরও? জনি বলছে, আমি কী করে ওই কেরকেটাটেরকেটাদের সামনে মুখ দেখাব কাল? লজ্জাতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
আমি একটু রাগ করেই বললাম, লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়ে যায় লিলি।
ভটকাই চেপে ধরল ঋজুদাকে। বলল, ‘লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়ে যাওয়ার ইংরেজি কী? তুমি ঠিক কী বলেছিলে?
ঋজুদা হেসে ফেলে বলল, ভটকাইটা দিনে দিনে সত্যিই মহা বাঁদর হয়ে উঠছে। তোরা ঠিকই বলিস।
তারপর বলল, ইংরেজিতে বলেছিলাম, এনাফ ইজ এনাফ, উ্য আর গোয়িং টু হিট দ্য সিলিং। এরই ভাবার্থ করলে ‘লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়ে যায়’ হয়ে যায়।
তাতে লিলি অবাক হয়ে বলল, কান্ট উ্য সি? উই মিন এভরিওয়ার্ড অফ ইট।
আমি বললাম, শিকারের নিয়ম হল যে বাঘের শরীর থেকে প্রথম রক্তপাত ঘটাবে বাঘ তার। তুমি লেজেই মার আর যেখানেই মার, তুমি প্রথমে মেরেছ যখন তখন আমি বা তাহের আলি বা সুখরাম বা কেরকেটা যেই বাঘকে মারি না কেন, বাঘ তোমারই থাকবে।
সত্যি!
উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল লিলি।
তারপর বলল, তুমি কী করে শিওর হলে যে আমার গুলি লেজ-এ লেগেছিল। আমি তো কিছু বুঝতেই পারিনি।
–তুমি যখন অভিজ্ঞ হবে তখন বুঝতে পারবে। আমরা সকলেই লক্ষ করেছিলাম যে একগুচ্ছ বাঘের চুল আর কিমার মতো একটু মাংস মাটিতে পড়ে আছে। খুব সম্ভব তোমার গুলিটা লেজ ভেদ করে যায়নি, লেজ ছুঁয়ে গেছে। এল. জি.র দানা লেজ ভেদ করতেই পারত কারণ দূরত্বও বেশি ছিল না। কিন্তু গুলিটা গেছে লেজ ঘেঁষে।
বাঘ যে লাফিয়েছিল, আমাদের যদি ধরে ফেলত?
ধরে ফেললে তো ফুরিয়েই যেত। আজকে এ প্রশ্ন তুমি আমাকে করতে পারতে না। তবে বাঘটা সম্ভবত তোমাদের ধরবার জন্যে লাফায়নি। লেজে গুলি লাগায় হঠাৎ হতভম্ব হয়ে গিয়ে রিফ্লেক্স অ্যাকশানে লাফিয়েছিল। আমি দেখেছি পেটে, পিঠে বা লেজে গুলি লাগলে এবং শিকারি যদি অদৃশ্য থাকে তখন বাঘ প্রচণ্ড আক্রোশে ঘাড় ঘুরিয়ে তার ব্যথার জায়গাটাকেই কামড়ে ধরে। কেন ধরে, তা বলতে পারব না কিন্তু দেখেছি যে ধরে।
তুমি কি কাল ওই বাঘের খোঁজে যাবে ঋজু?
যেতে তো হবেই। লেজের চোট কেমন তা তো জানা নেই। তা ছাড়া তোমাদের বাঘ মারবার জন্যে নিয়ে এলাম পালামৌ। বাঘ না মারিয়ে ফেরত পাঠাই কী করে।
তা হলে আমি যাব তোমার সঙ্গে।
জনি বলল।
না, তুমি যাবে না। লিলি বলল।
জনি বলল, না, তুমি বুঝছ না, আমার নিজের কাছে, এত মানুষের কাছে আমার নিজেকে প্রমাণ করতে হবে নইলে সারাজীবন এই লজ্জা বয়ে বেড়াতে হবে আমাকে।
কে জানবে? এই কেরকেটারা জানল তো কী হল? সভ্য সমাজের কেউই তো জানছে না। আমি তো আর কাউকে বলছি না।
ঋজুদা বলল।
জনি বলল, না না, আমি তো জানব। তা হয় না। উ্য মাস্ট টেক বোথ অফ আস অ্যালং।
এ তো সিটুর প্রসেশন নয় বাছা যে লাল ঝান্ডা নিয়ে কাতারে কাতারে মানুষকে যেতে হবে। কিন্তু ওদের বলে কী লাভ?
আমি বললাম, আচ্ছা, আগে খোঁজ করি গিয়ে। এ সময়ে প্রসেশন করে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। কী করে নিঃশব্দে চোখ-কান খোলা রেখে সব ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে বাঘের জঙ্গলে চলতে হয় তা শিখতে দীর্ঘদিনের অধ্যবসায় লাগে। একদিনেই সব হয় না। শিকার মানে, অনেক মূর্খরই ধারণা যে, ট্রিগার টানা। ট্রিগার টানাটা শিকারের সবচেয়ে কম জরুরি ব্যাপার। ট্রিগার টানার আগে যত জায়গায় যেতে হয়, যত মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, যত পশুপাখি গাছপালা পাহাড় নদীর সঙ্গে পরিচিত হতে হয়, সেইটেই হচ্ছে আসল। মূর্খরা তা জানে না বলেই বলে, বাঘ মারা আর কী কঠিন কাজ, মাচাতে বসে ট্রিগার টেনে দিলেই তো হয়ে গেল। তোমরা দেখলে তো কঠিন কাজ কি না। ট্রিগার টানাটাও কঠিন কাজ নইলে জনি পারল না কেন ট্রিগার টানতে আর তুমিই বা মিস করলে কেন?
অবশ্যই দেখলাম। আমাদের কাছে এমন স্টুপিডের মতো কথা কেউ বলতে এলে আমরা তাদের বলব যে যা তারা ভাবে তা নয়।
ওক্কে। লিলি বলল। যদি হঠাৎ করে বাঘের সঙ্গে তোমাদের দেখা না হয়, মানে, যদি সুযোগসুবিধা হয় তবে আমাদের সঙ্গে নিয়ে। আমরা এতটাই এমব্যারাসড হয়ে আছি যে বলতেও লজ্জা করছে।
আমি বললাম, কাম অন। আই অ্যাম অ্যান ওল্ড ফ্রেন্ড অফ বোথ অফ ঊ্য। উ্য শুডনট ফিল এমব্যারাসড অ্যাট অল।
তারপর বললাম, কানাডাতে ট্রেকিং করার সময় যে বলতাম, আমাদের দেশের জঙ্গল অন্যরকম, আমাদের বাঘ অন্যরকম, ঠিক কিনা।
ঠিক। হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক।
এই অবধি বলে ঋজুদা বলল, এবার গান-টান হোক। তারপর লিট্টি সেরিমনি তো আছে। কালকে বাকি অংশটি হবে।
আর ভূতের গল্প?
হবে। হবে। সময়ে সব হবে। সময়কে সময় দিতে হয়।
আবার শুরু করো ঋজুদা।
হ্যাঁ।
.
০৭.
ওরা, মানে জনি আর লিলিয়ান শুয়েই ছিল। যা ঠান্ডা এখন পালামৌতে ঘুমোবার মতন আরাম আর কিছুই নেই। জেঠুমনি বলতেন, ঘুম হচ্ছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ এবং নিখরচাতে পাওয়া যায়। নেপোলিয়ান থেকে শিবাজি, যাঁরাই মানুষের মতো মানুষ ছিলেন, তারাই ঘোড়ার পিঠে চলতে চলতে ঘুমোতে পারতেন, আর আমাদের চেনা মানুষের মতো মানুষ পটকাদা, পোর্ট কমিশনারস-এর হেড ক্লার্ক, ট্রাম বাসে অকাতরে ঘুমোতে পারতেন। এরকম মেড টু অর্ডার ঘুম কারওই দেখিনি আমি। রাসবিহারী-রসা রোডের মোড় থেকে ট্রামে চড়েই ঘুমিয়ে পড়তেন আর নিজের স্টপেজ এলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে নেমে যেতেন। কন্ডাক্টরকে পয়সাও দিতেন ঘুমেরই মধ্যে এবং টিকিটটা হাতঘড়ির নীচে গুঁজে রাখতেন।
জুম্মানকে বলাই ছিল। আমি দরজা খোলামাত্র কাঁচের একটা বড় গ্লাসে করে ধোঁয়া-ওঠা চা নিয়ে এল। আমি তৈরি হয়ে বেরিয়েছিলাম। তখনও প্রচণ্ড ঠান্ডা। সারারাত শিশির পড়েছে। এখন গাছগাছালির পাতা থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়ার মতো জল ঝরছে। শীতের বনের গায়ের একটা থম-মারা গা-শিরশির করা গন্ধ, ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধে ম-ম করছে চারধার।
শীতের দিনে গ্লাসে করে চা খেলে চা অনেকক্ষণ গরম থাকে এবং দু হাতে ধরে থেকে হাত দুটোও গরম হয়ে ওঠে। আমার অবশ্য হাত গরম করার অন্য সহায় আছে। পাইপ।
চা খাওয়া শেষ করে জুম্মানকে বললাম, আমি কখন ফিরব ঠিক নেই। সকালের নাস্তা এমনকী দুপুরের খাবারও সাহেব মেমসাহেবকে দিয়ে দিয়ে। আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না। ওঁদের বোলো যে, আমি এ কথা বলে গেছি।
মাথার টুপিটা কান অবধি টেনে দিয়ে ফোর ফিফটি ফোর হান্ড্রেড জেফরি নাম্বার টু রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম গাডুর দিকে। এই কানকাটা ঠান্ডাতে টুপি কান অবধি না নামালেই নয়। তবে, কিছুক্ষণ চলার পরেই গা গরম হয়ে যাবে, মাথাও। তবে টুপি তো পরে থাকতেই হবে, তবে হালকা করে। পাইপটা পুরো ফিল করে লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে বাঁ হাতের মুঠিতে ধরে ডান হাতে রাইফেলের ব্যারেল ধরে রাইফেলটাকে কাঁধে শুইয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
দামি রাইফেলবন্দুকের এই এক অসুবিধা। কারেলে ও বাট-এ স্লিং থাকে না, যে কাঁধে ঝুলিয়ে নেওয়া যাবে। এসব রাইফেল বন্দুক তৈরি হত রাজা মহারাজাদের জন্যে। তারা হেঁটেই শিকার করুন, কি হাতির পিঠে বসে, ভারতে বা আফ্রিকাতে, তাঁদের বন্দুক রাইফেলও বইত গান-বেয়ারাররা। দু-তিনটি বিভিন্ন বোর-এর রাইফেল বন্দুক কাঁধে করে সঙ্গে হাওদাতে অথবা মাটিতে থাকত দু-তিনজন ভাল স্থানীয় শিকারি। বন্যপ্রাণী দেখলে যার দিকে হাত বাড়াতেন, রাজা বা মহারাজা বা গভর্নর, বা ভাইসরয়, জেনারেল সে সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র এগিয়ে দিত শিকারির দিকে। বিপজ্জনক হয়ে উঠলে প্রয়োজনে সঙ্গী শিকারিরাও গুলি করত। তবে তা করত নিতান্ত প্রয়োজন হলেই। আমি তো রাজা মহারাজা নই, তাই আমার রাইফেল আমাকেই বইতে হচ্ছে।
তখন পুবে সবে আলো ফুটেছে। পথের পাশের একটা বড় কালো পাথরের ওপরে বসলাম আমি একটু এগিয়েই। জায়গাটার পাশ দিয়ে একটি নালা বয়ে গেছে। তার বালিতে এবং পথের ভেজা মাটিতে বাঘের পায়ের দাগ যদি দেখা যায় সেই আশাতেই বসলাম যদিও কিছু অন্য কারণও ছিল। নির্মলকুমারী মহলানবিশ-এর বাইশে শ্রাবণ’ বইয়েতে অনেকদিন আগে পড়েছিলাম যে রবীন্দ্রনাথ তাকে লেখা একটি চিঠিতে লিখছেন: ‘রোজ শেষ রাতে সূর্যোদয়ের আগে পর্যন্ত নিজের মনকে আমি চান করাই। শান্ত’ আমার মন্ত্র। রাতেও শুতে যাওয়ার আগে সেই জন্যে কিছুক্ষণ আমি একা বসে থাকি। সেই সময়টা আমার নিজের মনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করার সময়। সারাদিন কত তুচ্ছ কারণে নিজের কাছে নিজের পরাজয় ঘটে, তাতে মন ক্লিষ্ট হয়ে থাকে, রাতে শুতে যাওয়ার আগে মনকে শান্ত করে পরিষ্কার করে নিতে না পারলে শান্তি পাই না। আর শেষ রাত্রে আমার নিজের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কাজ চলতে থাকে। সেই সময়টা খুব ভাল সময়। বাইরের কোনও কোলাহল থাকে থাকে না, নিজেকে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।
তিতির বলল, তোমার ওপরে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এমনভাবে পড়েছে যে মনে হয়, জেঠুমনির প্রভাবও তেমনভাবে পড়েনি।
জেঠুমনি যতই বৈচিত্র্যময় মানুষ হন না কেন, তিনি মানুষই ছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ তো আমার দেবতা।
ভটকাই বলল, চারদিকে যখন লোকে রবীন্দ্রনাথকে হ্যাঁটা দিচ্ছে, উচ্ছ্বাস বর্জিত’ নতুন জীবনী লিখছে মানুষ’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, আর তুমি যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে গেলে।
হ্যাঁ, অনেক মানুষই এখন রবীন্দ্রনাথ যে আর দশটা সাধারণ মানুষেরই মতো ছিলেন, তার বিস্তর দোষ ছিল, তার চরিত্রে কলঙ্ক ছিল–এই সব প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন যে, সেটা ঠিক। কিন্তু তারা তা করুন। ঈশ্বরবোধেরই মতো রবীন্দ্ৰবোধও একটা বিশেষ ব্যাপার। শিক্ষা, মানসিকতা এবং রুচিতে যারা আলাদা নন, তাঁদের মতো mundane ক্রিয়াকর্মকরা মানুষদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন করা তো সহজ নয়। যার যেমন অভিরুচি, যার যেমন দৃষ্টিভঙ্গি, যার যেমন শিক্ষা, তিনি সেই মতোই কাজ করবেন। এসব নিয়ে আলোচনা না করাই ভাল।
ঋজুদা হেসে বলল, আমি কিছুই বলছি না। তবে এই সব ছোটখাটো অশিক্ষিত, নির্গুণ, কুরুচিসম্পন্ন মানুষ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যা খুশি বলতে পারেন।
ভটকাইই আমাদের থামিয়ে দিয়ে বলল, ঋজুদা যাচ্ছিল ল্যাজে গুলি খাওয়া বাঘের খোঁজে আর কোথা থেকে এই রুদ-এর বাংলোতে তোরা সব ভারী ভারী ব্যাপার এনে ফেললি। ঋজুদারও দোষ আছে।
ঋজুদা বলল, মানছি, আছে। রবীন্দ্রনাথকে আমি আমার বাবার চেয়েও বেশি সম্মান করি। তাকে কেউ কিছু বললে, বা ছোট করলে আমার মাথার ঠিক থাকে। কিছু মানুষ নিজের নিজের বই বিক্রি ও পয়সাওয়ালা মালিককে খুশি করার জন্য নিজেদের যে কত নীচে নামাতে পারেন, তা ভাবলেও বড় ঘেন্না হয়।
তিতির বলল, তারা যা করছেন করুন। বাঙালি তাদের মুখে ঝাল খাবে না। রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসংগীত এখন এক প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। এ কোনও গুরুবাদের কথা নয়। বাঙালির মনের কথা অনেক প্রজন্মের বাঙালির মনের কথা। কিছুক্ষণের দুর্গন্ধবাহী হাওয়া এই পরিবেশকে দূষিত করতে পারবে না।
এবারে তুমি লিলিয়ান সিম্পসনের বাঘ-এর গল্পটাতে ফিরে যাবে ঋজুদা, প্লিজ।
হ্যাঁ। যাচ্ছি।
সেই পাথরটার ওপরে বসে থাকতে থাকতেই রোদ উঠল। আমি উঠে গিয়ে নালার বালি এবং পায়ের ধুলো ভাল করে পরীক্ষা করলাম। না, বাঘের পায়ের দাগ নেই কোনও।
তারপরে পাইপটা কিছুক্ষণ খেয়ে এগোলাম। আস্তে আস্তে রোদটার জোর বাড়তে লাগল। ওপরে নীল, পলিউশনহীন আকাশ, নীচে শিশির ভেজা প্রকৃতির মধ্যে লাল মাটির শিশির ভেজা পথ চলে গেছে। জোরে নিশ্বাস নিলে নাক হিম হয়ে যায়–এখনও এত ঠান্ডা।
মাইলখানেক মাটিতে চোখ রেখে হাঁটার পরে একটা জানোয়ার চলা পথ, ইংরেজিতে যাকে গেম-ট্র্যাক বলে, তার সন্ধান পেলাম। পথটা বাঁদিক থেকে ডানদিকে গেছে বড় রাস্তাকে কেটে। অথবা অন্যভাবে বললে বলতে হয়, ডানদিক থেকে বাঁদিকে গেছে। নদী ডানদিকে। আর সেই নদীই কোয়েল। একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে আমি ডানদিকেই যাওয়া মনস্থ করলাম।
এই পায়েচলা পথে অনেক জানোয়ারের পায়ের দাগ পেলাম। বাইসনের একটি দল, শম্বরের একটি দল, কোটরা হরিণ, চিতল হরিণ, হায়না, ভাল্লুক, বড়কা বুনো শুয়োর এবং একটি বড় বাঘ। বাঘের পায়ের দাগটি সম্ভবত গতকালের। তার ওপরে এত জানোয়ারের শোভাযাত্রার চিহ্ন যে, সেই দাগকে প্রায় চেনাই যাচ্ছে। না। তবে মনে হল, এ লিলির বাঘই।
তারপরই বলল, তোরা কুটকু যাসনি, না?
কুটকু? না তো।
আমরা বললাম।
দেখি, এবারে হয় কিনা। সম্ভব হলে নিয়ে যাব। তবে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। হুটার, মোডোয়াই হয়ে। কুটকুর কাছে কোয়েলের রূপই আলাদা। বাংলার সামনে নদীর ওপরে পিলার তুলে নদীর বেশ কিছুটা ভিতরে বসবার জায়গা করা আছে একটি। সাহেবরা বানিয়ে গেছিল। ব্যাটাদের সৌন্দর্যজ্ঞান ছিল খুব।
তারপরই বলল, তোরা কেউ কোয়েলের কাছে পড়েছিস?
তিতির হাত তুলে বলল, পড়েছি।
তবে তো পড়েছিসই। যেখানে সুগত হাঁকোয়া শিকারে গিয়ে মারা গেল, সেই কুটকু।
তিতির আমাদের বলল, পালামৌতে আসার আগে তোদেরও পড়ে আসা উচিত ছিল। প্রায় চল্লিশ বছর আগে লেখা বই কিন্তু কোনওদিনও পুরনো হবে না। ক্ল্যাসিক হয়ে গেছে।
তা হোক গে, এখন ঋজুদা আগে বাড়ো। আবার তুমি অফফ-ট্র্যাক হয়ে যাচ্ছ।
ঠিকই বলেছিস। নাঃ আর নো ভেজাল। তোরাও অন্য প্রসঙ্গ আনবি না আর। লিলিয়ান সিম্পসন-এর বাঘের গল্প শেষ হলে খাওয়া-দাওয়াও হবে না কিন্তু।
মাঝে একটু কফি ব্রেক?
ভটকাই বলল।
তা হতে পারে। কিন্তু নিঃশব্দে। এতদিন আগের ঘটনা আমার কি ছাই সব মনেও আছে?
যাই হোক, আবার শুরু করো।
হ্যাঁ, গেম-ট্রাকটা এঁকে বেঁকে প্রায় আধ মাইল চলে গেছেনদীর দিকে। এদিকে কিন্তু মিশ্র জঙ্গল। শাল, শিশু, ক্কচিৎ মহুয়া, আরও ক্কচিৎ সেগুন, মাঝে মাঝে বাঁশের ঝাড় হাতি আর বাইসনদের প্রিয়। কুঁচফলের গাছ, কোলাউন্দা, করৌঞ্জ, জংলি নিম, আমলকী, শিমূল আরও কত কী গাছ।
এমন সময়ে পথের ডানদিকে ওপরে একটা ঝটপট আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালাম। চার-পাঁচটি ঘোর লালরঙা পাখি বসে আছে সেখানে। এরকম পাখি আগে দেখিনি। আয়তনে পায়রার মতো। তবে লাল মানে আর্টিস্টরা যাকে বলে পোস্ট অফিস রেড, সেরকম লাল–অরেঞ্জ মিনিভিট-এর শরীর বা সিপাহি বুলবুল-এর মাথার মতো লাল নয়। এ পাখি কখনও দেখিনি, কোথাও শুনিওনি। শুনিওনি বললে ভুল হবে, ওড়িশার সুন্দরগড়ের মহুলসুখা ম্যাঙ্গানিজ খাদানের কাছের কুড়ারি নদীর পাশের একটি আদিবাসী গ্রামের আদিবাসীদের মুখে এইরকম পাখিদের কথা শুনেছিলাম। তবে সে পাখি পরিযায়ী। এবং জোড়া। কোনও কোনও বছরে সেই জোড়া পাখি তাদের গ্রামে এলে ফসল খুব ভাল হয়। তাই সে পাখি এলে যে শিমূলগাছের মগডালে তারা এসে আস্তানা গাড়ে তার তলায় দেবতার থানের মতো পুজো চড়ায় আদিবাসীরা। এই পাখির কথা মহুলসুখার চিঠি’ নামের একটা বইতেও পড়েছিলাম। সঙ্গে দূরবিন নেই, থাকলে আরও ভাল করে দেখা যেত পাখিগুলোকে, মনোযোগ সহকারে পারিপার্শ্বিক ভুলে ওপরে তাকিয়ে আছি এমন সময়ে হালকা পায়ের আওয়াজ শুনলাম পেছনে। চকিতে রাইফেল বাগিয়ে ফিরেই দেখি সুখরাম। সে ভয়ার্ত মুখে আমাকে বলল, মুখ নামান, মুখ নামান, ঋজুবাবু, ওই পাখিদের দেখবেন না।
কেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম।
বাঘের জঙ্গলে কেউ জোরে কথা বলে না, বিশেষ করে বাঘ খুঁজতে এসে, তাই সুখরাম ফিসফিস করে কথা বলছিল।
বললাম, কী ব্যাপার?
ওগুলো মায়া পাখি। ও পাখি যে দেখে তার মৃত্যু হয়।
মৃত্যু তো সকলেরই হবে একদিন না একদিন।
তা নয়, তার মৃত্যু হয় তাড়াতাড়ি। ওগুলো পাখি নয়, মায়া পাখি।
মায়া পাখি?
হ্যাঁ।
যত্ত বোগাস।
আমি বললাম। তারপর আবার ওপরে তাকালাম। দেখি একটিও পাখি নেই। তারা ভোজবাড়ির মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাদের উড়ন্ত ডানার ফটাফট শব্দও শুনতে পেলাম না অথচ তারা উড়ে চলে গেল। কী করে হয়। ধন্দে পড়লাম আমি। ওই সব অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন জংলি মানুষদের খপ্পরে পড়ে আমিও কি অমনই হয়ে যাব? ভেবে দুশ্চিন্তা হল আমার।
সুখরাম বলল, ওদের নাম লালি। ওরা বুঢ়া দেও-এর আশ্রিত।
পনেরো কুড়ি বছর পরে কখনও কখনও হঠাৎ দেখা যায় এদের। এদের দেখা গেলে বাঁশগাছে ফুল আসে এবং সব বাঁশগাছ মরে যায়। এরা অমঙ্গলের দূতী। বনের পশুপাখির ক্ষতি করতে এলে কখনও কখনও বুড়হা দেও এদের পাঠান সাবধান করতে। ওই বাঘ বুঢ়া দেও-র আশ্রিত। ওকে মারার চেষ্টা করাটা ঠিক হবে না বাবু।
আমি টোব্যাকোর পাউচ থেকে একটু তামাক দিলাম সুখরামকে। সে বাঁ হাতের তেলোতে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে খইনির মতো মেরে নিয়ে তার নীচের ঠোঁটের নীচে চালান করে দিল। তারপর সেই সুগন্ধি বিলিতি গোল্ডব্লক টোব্যাকোর রস তার পাকস্থলীতে যাওয়াতে সে একটু চাঙ্গা হল। বলল, কেরকেটা আর তাহের আলি অন্য দিক দিয়ে ওই গুহাগুলোর দিকেই রওনা হয়েছে। এতক্ষণ বোধহয় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তাহের আলির কাছে বন্দুক আছে, যদিও বে-পাশি, তবে আপনার ভরসাতেই সে এনেছে বন্দুক। জানে আপনার পারমিট আছে আর বিশ্বাসবাবুদের মেহমান আপনি। আপনাকে ছোঁয় এমন হিম্মত বনবিভাগের কোনও আমলার নেই।
আমি বললাম, চলো এবারে এগোই। আর কথা নয়।
লালি পাখি দেখার পরও ওই বাঘের পেছনে যাওয়াটা কি ঠিক হবে আপনার?
আমি বললাম, বিপদ হলে আমার হবে। তোমার তো হবে না। তবে আর কী? চলো এগোই। এই রাইফেল হাতে থাকতে স্বয়ং যমরাজকেও পরোয়া করি না আমি।
নিমরাজি হয়ে সুখরাম বলল, চলুন।
প্রায় নদীর কাছাকাছি এসে যখন পড়েছি তখন দেখি কেরকেটা আর তাহের আলি গুহার নীচে একটা গোল পাথরের ওপরে বসে আছে। তার মানে, ওরা নদীতে বালিতে বাঘের পায়ের দাগ পেয়েছে এবং সে গুহাতেই আছে সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছে। গুহাটার সামনে একটা মস্ত বড় চ্যাটালো কালো পাথর বুক চিতিয়ে আছে আদিবাসী ছেলের বুকের মতন। বাঘ যদি গুহাতে গিয়ে শেষ রাতে সেঁধিয়ে থাকে তা হলে এই শীতের সকালে পাথরের শিশির শুকিয়ে গেলেই সে ওই চ্যাটালো পাথরের ওপর শুয়ে রোদ পোয়াতে পোয়াতে ঘুমুবে। গুহামুখে একটা অল্পবয়সি পিপ্পাল গাছ আছে। গ্রীষ্মে তার ছায়াতে সে শুয়ে থাকে। শীতের সূর্যর অয়নপথের ফারাক হওয়াতে সেই পিপ্পাল গাছের ছায়া পড়ে না সকাল বেলায়।
ততক্ষণে চনমনে রোদ উঠে গেছে। গুহার নীচে একজোড়া র্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গো ওড়াউড়ি করে ঝগড়া করছে। পাখিগুলোর গলার স্বর ধাতব। ভারী ঝগড়াটে পাখি। এরা বনমোরগ জাগবারও আগে জেগে উঠে ডাকাডাকি শুরু করে। তাদের বাসার কাছে অন্য পাখি এলে তারা তেড়ে যায় তাদের, তা বাসাতে বাচ্চা ডিম থাকুক আর নাই থাকুক। তাদের চেয়ে আকারে অনেকগুণ বড় পাখিদের সঙ্গেও টক্কর দিতে তারা পিছপা হয় না। তাদের লম্বা চেরা লেজ উড়িয়ে ঘাড়ের কেশর ফুলিয়ে ভীমবিক্রমে তারা আক্রমণ করে প্রতিপক্ষকে।
গুহার কাছেই আছে ওরা তাই কথা বলতে পারবে না। আমি আর সুখারাম আকারে-ইঙ্গিতে ওদের কাছে শুধোলাম, ব্যাপার কী?
ওরাও কিছু বলল আকারে-ইঙ্গিতে কিন্তু কী বলল তা আমরা বুঝতে পারলাম না। আমিও গুহার কাছে যাব কি না তা জানা দরকার। ওরা কি গুহামুখে আওয়াজ করে বাঘকে গুহা থেকে বের করে আনতে চায়? তা যদি করে, তবে তাহের আলিরই মারতে হবে বাঘকে। নদীর ওপারে গুহা। বেশ দূর। আমার ফোরফিফটি ফোর হান্ড্রেড হেভি রাইফেল দিয়ে অত দূরে গুলি করলে মিসও হতে পারে। থ্রি-সিক্সটি সিক্স রাইফেলটা কেন নিয়ে এলাম তা ভেবে আপসোস হচ্ছিল। ওই রাইফেল দিয়ে আরও দূর থেকে আমি নির্ভুল নিশানায় নানা জানোয়ারকে গুলি করেছি দিনেরাতে। আমার গর্ব ছিল যে ওই রাইফেলে আমি একটা গুলিও মিস করিনি কখনও।
আমি বললাম, রাইফেলটা দেখি না আজকাল। গেল কোথায় ঋজুদা?
ঋজুদা হেসে বলল, ওটা ভাল লোকের কাছেই আছে।
কার কাছে?
ভিক্টর ব্যানার্জি।
অভিনেতা?
হ্যাঁ, ভিক্টরের ভিলা আছে মুসৌরি পাহাড়ে। তার আশেপাশে সে হয়তো ঘুরাল-টুরাল মারে। সেই নিয়েছে রাইফেলটা। তবে দাম দিয়ে নিয়েছে।
দেওয়াটা উচিত হয়নি তোমার। কত স্মৃতি ও রাইফেল ঘিরে তোমার।
তিতির বলল।
ঋজুদা বলল, সব স্মৃতিই একদিন মুছে যায়, মুছে যেতে বাধ্য। আমি মরে গেলে আমার স্মৃতিও মুছে যাবে তোদের মন থেকে। কালের এই নিয়ম। স্মৃতি আঁকড়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, কোনও স্মৃতিই। পুরনোকে পেছনে না ফেলতে পারলে সামনে এগোবি কী করে।
ভটকাই বলে, আবার চলো গুহার কাছে।
হ্যাঁ।
ঋজুদা বলল।
তারপর বলল, একটু কফি হতে পারে তো? কী কোয়ার্টার মাস্টার?
ভটকাই তড়াক করে উঠে বাবুর্চিখানাতে বলেই ফিরে এসে আবার সেই অভিব্যক্তি করল। ইরে। কী শীত। কাড়িয়া পিরেত মারা শীত।
বলেই বলল, ভূতের গল্পটা হবে তো।
তিতির বলল, আগে বাঘের গল্প শেষ হোক।
ঠিক।
ভটকাই বলল।
সুখরামই বলল, আমি বরং যাই ওদের কাছে। কী মতলব জেনে আসি আর আপনাকে কী করতে হবে তাও।
ভেবে বললাম, তাই ভাল। ওরা যদি আমাকে ওখানে যেতে বলে তবে হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকলেই এগিয়ে যাব। নইলে, নদীর মধ্যে যে সাদা পাথরের স্তূপটা আছে আমি সেই অবধি এগিয়ে গিয়ে পাথরের ওপরে আড়াল নিয়ে বসতে পারি। সেখান থেকে বাঘ গুহামুখের চাতালে এসে দাঁড়ালে অথবা কোনও কারণে যদি তাড়া খেয়ে বা আহত হয়ে পালাতে চায় তবে হয়তো এই গেম-ট্রাক ধরেই দৌড়ে এসে পথের গভীর জঙ্গলের আশ্রয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে তখন নদী পেরুবার সময়ে সে আমার এই রাইফেলের রেঞ্জের মধ্যে থাকবে। তাকে মারতে অসুবিধে হবে না।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা দুজনেই এগোলাম নিঃশব্দে। ঠিক নিঃশব্দে নয়, যথাসম্ভব কম শব্দ করে। তার পর আমি গিয়ে ওই পাথরের স্তূপে আড়াল নিয়ে উঠে বসলে, সুখরাম এগিয়ে গেল।
ঋজুদা বলল, আমরা তো শখের শিকারি আর সুখরাম কেরকেটা তাহের আলিরা বনেরই মানুষ। ওরা যেমন নিঃশব্দে বনের মধ্যে চলাফেরা করতে পারে আমরা হাজার চেষ্টা করলেও পারব না।
আমাকে বসিয়ে সুখরাম এগিয়ে গেল।
এমন সময়ে দেখলাম যে তাহের আলি পকেট থেকে বিড়ি বের করে বিড়ি ধরাল একটা। বাঘের গুহার এত কাছে দেশলাইয়ের শব্দ বা বিড়ির গন্ধ দুই-ই বাঘের কানে ও নাকে যেতে পারে। কাজটা ভাল করল না। ভাবলাম আমি।
ওরা যেখানে বসে আছে, বাঘ গুহা থেকে বেরিয়ে ওই চাতালে এসে দাঁড়ালে ওদের দেখতে পাবে না। চাতালের শেষ প্রান্তে এসে উঁকি মেরে দেখলেই চোখে পড়বে ওদের, নইলে নয়।
সুখরাম নদীর চারভাগের তিনভাগ অতিক্রম করে গেছে এমন সময়ে দেখলাম বাঘ গুহা থেকে বেরিয়ে চাতালে এসে দাঁড়াল। তাকে থিতু অবস্থাতে দেখে বোঝা গেল সে কত বড় বাঘ। সকালের রোদ এসে পড়েছে তার ঝলমলে পাটকিলে কালো শরীরে। সে এক রাজকীয় দৃশ্য। সে বাইরে আসতেই বনের মধ্যে থেকে ময়ূর, হনুমান এবং নানা পাখি একসঙ্গে ডেকে উঠল। লেজেই লাগুক গুলি আর যেখানেই লাগুক আহত বাঘ তো আহত বটেই, তা ছাড়া কাল রাতে হয়তো শিকারও ধরতে পারেনি কিছু শরীরে যন্ত্রণাতে। বাঘের মেজাজ বিলক্ষণ খারাপ ছিল। সে গুহামুখে দাঁড়িয়েই এক হুংকার দিল এবং হুংকার দিয়েই নদীর বুকে সুখরামকে দেখতে পেয়ে পাথরের পর পাথর এক এক লাফে টপকে সুখরামের দিকে ধেয়ে এল। ব্যাপারটার অভাবনীয়তাতে সুখরাম তো চমকালই তাহের সিং আর কেরকেটাও কম চমকাল না।
বাঘ নদীতে নামতেই তাহের আলি বাঘকে লক্ষ করে গুলি করল। আশ্চর্য! বাঘ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তাহের আলি আর কেরকেটা দুজনকেই দেখল কিন্তু তার আততায়ীকে আক্রমণ না করে সে ততক্ষণে দৌড়-লাগানো সুখরামের দিকেই ধেয়ে গেল।
কেন?
তিতির বলল।
কেন, তা বলতে পারব না তবে বাঘ বা চিতা ওরকমই করে, কুকুরও যেমন করে। কেউ দৌড়ে গেলে তারা তার পেছনেই দৌড়ে গিয়ে লাফ মেরে ধরে বা ঘাড় মটকায়।
সুখরামটা ইডিয়েটের মতো আমার দিকে দৌড়ে আসছিল ফলে বাঘ আর সুখরাম একই লাইনে পড়ে যাওয়াতে আমি গুলি করতে পারছিলাম না। সেই একই কারণে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে উঠে বাঘের পেছন পেছন দৌড়ে আসা তাহের আলিও গুলি করতে পারছিল না, পাছে সুখরামের গায়ে গুলি লাগে।
তখন আমি ওরে ব্যাটা বাঘ! বলে ডাকাতদের মতো চিৎকার করে পাথরের স্তূপ থেকে লাফিয়ে নেমে সুখরামের দিকে দৌড়ে গেলাম এবং সুখরামকে রাইফেলের নলের এক ধাক্কাতে বালিতে ফেলে দিয়ে বাঘের মুখোমুখি দাঁড়ালাম।
এত কিছু ঘটে গেল কিন্তু এক-দেড় মিনিটের মধ্যে। বাঘ আমাকে দেখে যেই আমার ওপরে লাফাতে যাবে আমি ডানদিকের ব্যারেল ফায়ার করলাম তার বুক। লক্ষ করে। তাতে সে পড়ে গেল কিন্তু পড়ে গিয়ে আবারও উঠে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসার মতো এগিয়ে আসতে লাগল প্রচণ্ড বেগে। তখন আমি বাঁদিকের ব্যারেল ফায়ার করলাম তার কপাল লক্ষ করে। বাঁদিকের ব্যারেল ফায়ার করতেই বাঘ সামনের দু থাবা জড়ো করে বালির মধ্যে থাবার ওপরে তার মুখোনি রেখে স্থির হয়ে গেল। ধীরে ধীরে তার চোখের পাতাদুটি বন্ধ হয়ে গেল।
এক আকাশ আলোর মধ্যে, এত গাছ, ফুল, পাখিকে সাক্ষী রেখে আমি একটি খুন করলাম। আর কাকে করলাম? না, যে বনের রাজা, যে সাহসী শ্রেষ্ঠ, যে পৌরুষের সংজ্ঞা। বিলেতে তৈরি দামি রাইফেলের হেভি বুলেট তার বুকের মাঝখানটা আর কপালের মাঝখানটা চিরে দিল?
ভারী মন খারাপ হয়ে গেল আমার। পেছনে কিছুটা হেঁটে গিয়ে একটা পাথরে বসে পকেট থেকে পাইপটা বের করে আগুন ধরালাম। মাথা থেকে টুপিটা খুললাম যেন, বাঘকে সম্মান জানাতেই।
সুখরামের জ্ঞান নেই। কেরকেটা এবং তাহের আলি দৌড়ে এসে তাকে চিত করে শোওয়াল। মুখে চোখে নদীর জলের ঝাঁপটা দিল। অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার ছিল আমাদের। সুখরামের কাছ থেকে তো বটেই, নিজেদের কাছ থেকেও।
তিতির বলল, নিজেদের কাছ থেকে কেন?
শোন। কফিটা খেয়ে নিয়ে বলছি।
কফি খাওয়া হয়ে গেলে ঋজুদা বলল, কিছুক্ষণ পর সুখরামের জ্ঞান এল। আমার রাইফেলের নলের ধাক্কাটা তার পেটে বেশ জোরেই লেগেছিল কিন্তু কোনও উপায় ছিল না। তাকে লাইন অফ ফায়ার থেকে সরাতে না পারলে আমি গুলি করতে পারতাম না, তা ছাড়া বাঘও ধরে ফেলত তাকে।
তাহের আলি ওই অসময়ে বিড়ি ধরাতে গেল কেন?
জিজ্ঞেস করেছিলে তাকে?
আমি বললাম।
ঋজুদা বলল, করেছিলাম। সে কী বলল, বলছি।
সুখরামের মুখের ওপরে ওরা দুজন ঝুঁকে পড়ে ওর নাম ধরে ডাকছিল। কিছুক্ষণ পরে সুখরাম চোখ খুলে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, লালি। লালি।
তাহের আলি আর কেরকেটা তাকে সায় দিয়ে বলে উঠল, হামলোগোনে ভি দিখা থা। আয়া থা উও চিড়িয়া।
কেরকেটা বলল, সায়েদ উ বাঘোয়া ভি দিখা থা নেহি তো অ্যাইসা অজিবসা বেওহার কাহে করেগা বাঘোয়া?
তবে এটা ঠিক বাঘের এরকম ব্যবহার সত্যিই অবাক করা ব্যাপার। ওই বাঘ লিলিয়ানের গুলির পর এবং সুখরামকে দেখে যেমন হুংকার দিয়ে উঠেছিল তা একেবারেই আশ্চর্যের ব্যাপার। বাঘ, শিকারি শ্রেষ্ঠ। তার যতই যন্ত্রণা হোক সে মুখ দিয়ে সচরাচর টু শব্দটি করে না। গুলি লাগলেও নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে যায়, না লাগলেও। আওয়াজ করে তার অবস্থান সে কিছুতেই জানান দিতে চায় না। তা ছাড়া দিনমানে সে কখনও ফাঁকা জায়গাতে যেখানে তাকে সহজে দেখা যায় তেমন ভাবে চলাফেরাই করে না। সবসময়েই আড়ালে আড়ালে আলোছায়ার হেঁয়ালির মধ্যে নিঃশব্দে চলাফেরা করে। কেরকেটা ও তাহের আলিকে সে দেখতে পায়নি। হয়তো দেশলাই জ্বালাবার শব্দ ও বিড়ির উগ্র গন্ধ পেয়ে থাকবে কিন্তু গুহার নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেরিয়ে সে নদীর বুকে সুখরামকে দেখতে পেয়ে একেবারে ফাঁকা সম্পূর্ণ আড়ালহীন জায়গাতে অতখানি তেড়ে আসবে যে কেন সেটা বোধগম্য হল না। তাহের আলি বক্তব্য হল, আজ সকালে অমঙ্গলের লালি পাখিরা যেমন আমাদের সকলের নজরেই এসেছে বিভিন্ন সময়ে তা বাঘের নজরেও এসেছে।
ঋজুদা বলল, আমি বললাম, বাঘ তো সচরাচর ওপরে তাকিয়ে চলে না।
কেরকেটা বলল, লালি পাখিরা তো নীচেও নামে। হয়তো নদীর বুকে নেমে জল খাচ্ছিল তখন বাঘ তাদের দেখে থাকবে।
তোমাদের কুসংস্কার নিয়ে তোমরা থাকো। ওসব লালি পাখির অমঙ্গলের কথা
আমি মানি না।
কিন্তু অমন পাখি কি দেখেছেন আগে কখনও ঋজুবাবু! আপনি তো এই সব পাহাড়-জঙ্গলে আঠারো বছর বয়স থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আমি ওদের বললাম না যে শুধু পালামৌর জঙ্গলই নয় বিহারের অন্য নানা জায়গার জঙ্গল, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, আসাম এবং দক্ষিণ ভারতের নানা জঙ্গল এবং সুন্দরবনেও আমি অনেক বনে-জঙ্গলে ঘুরেছি কিন্তু সুন্দরগড়ের মহুলসুখা খাদানের কাছের একটি আদিবাসী গ্রামে এরকম পাখি, তাও মাত্র একজোড়ার গল্প শোনা ছাড়া এদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমি একেবারেই অজ্ঞ ছিলাম। তখনও আমার মন বলছিল যে সকালে যা দেখেছিলাম তা আসলে সত্য নয়। হয় মনের ভুল, নয় optical illusion. কিন্তু আমি তো একাই নই। ওরা তিনজনও দেখেছিল। তা ছাড়া ওদের কথা মানতে হলে একথা মানতে হয় যে বাঘও এই অমসুলে পাখি দেখার কারণেই তার অন্ধকার গুহার আশ্রয় ছেড়ে আমার ফোর-ফিফটি ফোর হানড্রেড রাইফেলের গুলি খেয়ে মরার জন্যে এই সকালে এতখানি পথ ফাঁকাতে এসে আমার সামনে পৌঁছত না। অমঙ্গল বাঘেরও হয়েছিল।
তাহের আলি গেল রুদ গাঁয়ে তোক জোগাড় করতে বাঘকে বয়ে বাংলোয় নিয়ে যাবার জন্যে। শালকাঠের গুঁড়ি কেটে বাঘকে চৌদোলার মতো বয়ে আনতে জনাবারো নোক লাগবে। লতা দিয়ে সেই ডালগুলো বেঁধে চৌদোলা করবে। বাঘের ওজন তো কম নয়। তার ওপরে অত বড় বাঘ।
আমার কিছু ভাল লাগছিল না। পাইপের টোব্যাকো সব ফুরিয়ে গেলে ছাই ফেলে আবার টোব্যাকো ভরে কিছুটা টোব্যাকো সুখরাম আর কেরকেটাকে দিয়ে আমি বাংলোর দিকে এগোলাম। ওরা বাঘকে নিয়ে এলে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সম্পূর্ণ সুস্থ বাঘ। পাকা মানুষখেকোও নয়। তাকে মারা মানুষের মিথ্যে শ্লাঘা ও বাহাদুরি প্রবণতাকেই উজ্জীবিত করা মাত্র। এই হত্যার কোনও মানে নেই। অথচ বন্ধুকৃত্যের জন্যে করতে হল।
তারপর একটু থেমে বলল, তোরা জানিস যে আমি একা বা তাদের সঙ্গে নিয়েও বা জেঠুমনির সঙ্গে যত বাঘ মেরেছি তার মধ্যে মানুষখেকো বা আকছার গাঁয়ের গোরু-মোষ মারা বাঘই বেশি। আমার বড় অপরাধী লাগে। বাঘ এমনই এক জানোয়ার যাকে আমি admire করিই শুধু নয়, adore করি। এই বাঘ মানুষ খেয়ে থাকতে পারে তবে তাকে মানুষখেকো আখ্যা দেওয়া যায়নি। দেয়নি কেউ। তা হলে তো আমরা যাবার আগে অন্য শিকারিরাই তাকে মেরে দিত।
তারপর?
কফির কাপগুলো ট্রেতে সাজাতে সাজাতে বলল তিতির।
তারপর কী? আমি যখন রুদ বাংলোর হাতাতে ঢুকলাম গেট দিয়ে তখন দেখি লিলি আর জনি রোদে বসে ব্রেকফাস্ট করছে। জুম্মান দাঁড়িয়ে ওদের খিদমতগারি করছে। গুলির শব্দ ওরা শুনেছিল এবং শুনে, বলাই বাহুল্য খুবই উদ্বিগ্ন হয়েছিল। আমাকে দেখতে পেয়েই দুজনে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল। বলল, কী হল?
কী আবার হবে। লিলিয়ান সিম্পসন-এর বাঘ ওরা নিয়ে আসবে একঘণ্টার মধ্যে। হাতাতে শুইয়ে দেবে। তোমরা ছবি-টবি তুললে তাহের আলিরা চামড়া ছাড়িয়ে দেবে ওই নালার কাছে নিয়ে গিয়ে। চামড়া ছাড়ানো হলেই দিনে শকুন এবং রাতে শেয়াল ও হায়েনারা তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। এই নিয়ম প্রকৃতির।
জুম্মান বলল, নাস্তা ক্যা লাউ হুজুর?
বললাম স্ক্যামবলড এগস উইথ বেকন অ্যান্ড ফিঙ্গার চিপস। আর দুটো টোস্ট দিও মামালেড দিয়ে আর একপট কফি।
আমি বললাম, তাহের আলি যে গুলি করেছিল সেটা কোথায় লেগেছিল বাঘের?
ঋজুদা হেসে বলল, সেও এক রহস্য। তাহের আলি আমার-তোর চেয়ে অনেক ভাল শিকারি। সবরকম ওয়েপনই ও চালিয়ে অভ্যস্ত নানা সাহেব-সুবোর কল্যাণে।
কী মেরেছিল ও? এল. জি. না বল?
আমি বললাম।
রোটাক্স বল।
কোথায় লেগেছিল গুলি?
লেজে। তবে লেজের ডগাতে নয় গোড়াতে।
আমরা সকলেই হেসে উঠলাম।
ভটকাই বলল, এমন লেজে-খেলানো বাঘের কথা শুনিনি কোথাও।
তারপর বলল, এবার ভূতের গল্প দুটো?
ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে বলল, এ যাত্রা নয়। সব একসঙ্গে হয় না। গলা ব্যথা হয়ে গেছে। পালামৌর বেতলার আর বামরার কিলবগার ভূতের গল্প পরের বার যখন কোথাও যাব তখন হবে।
তিতির বলল, ইটস ভেরি মিন অফ উ্য ঋজুদা। তুমি কথা দিয়ে কথা রাখলে না।
রাখলাম না তা তো নয়। একটু পিছিয়ে দিলাম এই যা।
তারপর বলল, বলে ফেললেই তো ফুরিয়ে যাবে। থাক না বাকি।
আমি বললাম, খাবার লাগাতে বলি?
ঋজুদা বলল, বল। কাজের মধ্যে দুই খাই আর শুই। কাল জঙ্গলে তোদের দশ মাইল ট্রেকিং করিয়ে আনব। তোরা সইদূপ ঘাটে গেছিস? বারেষান-এ? মহুয়ার্ডার? যেসব জায়গাতে, ব্রেকফাস্ট খাবার পরে জিপে যাওয়া যাবে, মানে কোনও এক জায়গাতে। একেবারে সাতসকালে উঠে তার আগে ট্রেকিং।
ভটকাই দুটো হাতের পাতা ঘষে বলল ঈরে বাবাঃ। কী শীতরে বাবা। একেবারে কাঁড়িয়া পিরেত মারা শীত।