রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – রাবণের তৃতীয়বার যুদ্ধে আগমন
রাম যা কর নিজগুণে, আমি ভজন সাধন জানিনে।
মিছে গেল দীনের দিন, না হৈল ভজন ঘেরিল শমনে।।
যা কর হে রামচন্দ্র জগৎ-গোঁসাই।
তোমা বিনে ত্রিভুবনে আর কেহ নাই।।
মায়ানদীর তীরে আছি রাম তোমার চরণ করে সার।
ও রাঙ্গা চরণ তরণী করে রাম আমায় কর হে পার।।
স্ত্রীলোকের ক্রন্দন উঠিল ঘরে ঘরে।
অভিমানে শোকে মত্ত রাজা লঙ্কেশ্বরে।।
যুঝিবারে তরে সাজে রাজা দশানন।
সর্ব্বাঙ্গে ভূষিত কৈল রাজ-আভরণ।।
ভয়ে অভিমানে রাজা আঁখি ছল ছল।
কোমপনে যুঝিতে চলিল রণস্থল।।
আপনি করিছে সাজ লঙ্কা-অধিকারী।
মেঘের বরণ অঙ্গে ধবল উত্তরী।।
দশমুণ্ডে রতন-মুকুট সারি সারি।
মৃগমদে পরিলেক সুগন্ধি কস্তূরী।।
নানা অলঙ্কারে করে ভুবন উজ্জ্বল।
দশ ভালে দশ মণি করে ঝলমল।।
কোপে কাঁপে অধরোষ্ঠ চলে রণমুখে।
দশ হাজার রাণী এসে ঘেরে চারিদিকে।।
কেহ ধরে আশে পাশে কেহ ধরে কর।
কারো পানে ফিরিয়া না চান লঙ্কেশ্বর।।
না থাকে রাবণ রাজা কারো উপরোধে।
রাণী মন্দোদরী গিয়া পশ্চাতে বিরোধে।।
মন্দোদরী বলে শুন লঙ্কা-অধিপতি।
বুদ্ধিমন্ত হয়ে কেন ছন্ন হৈল মতি।।
পরম পণ্ডিত তুমি বলে মহাবীর।
বিশ্রবা-মুনির পুত্র পরম সুধীর।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল জিনিলে বাহুবলে।
যম ইন্দ্র কম্পমান তোমায় দেখিলে।।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি লঙ্কা-অধিকারী।
আমি কি বুঝাব তোমায় হীনবুদ্ধি নারী।।
তপাথি কিঞ্চিৎ বলি করি পরিহার।
স্থির হয়ে দাণ্ডাইয়ে শুন একবার।।
মুনিগণে কহে সর্ব্ব শাস্ত্রের বিহিত।
রমণীর সুমন্ত্রণা শুনিতে উচিত।।
বিপদে সুবুদ্ধি যদি রমণীতে বলে।
সে বুদ্ধি পুরুষ থাকে পরম কুশলে।।
বহুকাল লঙ্কাপুরে করিলে রাজত্ব।
কোন্ যুগে দেখিয়াছ এমন অনিত্য।।
কোন্ কালে বানরেতে লঙ্ঘেছে সাগর।
কোন্কালে সলিলেতে ভেসেছে পাথর।।
অপরূপ এমন শুনেছ কোন্ দেশে।
পাষাণ মনুষ্য হয় চরণ-পরশে।।
শ্রীরাম মনুষ্য নন বিষ্ণু-অবতার।
সীতা ফিরে দেহ যুদ্ধে কার্য্য নাহি আর।।
দশানন বলে, সীতা দিতে পারি ফিরে।
হাসিবেক বিভীষণ না সবে শরীরে।।
কহিবেক ইন্দ্র আদি যত দেবগণ।
যুদ্ধে হেরে সীতা ফিরে দিলেক রাবণ।।
ছোট হয়ে খোটা দিবে বড় ভয় বাসি।
সান্ত্বনা হইয়ে গৃহে বৈসহ প্রেয়সী।।
বরঞ্চ রামের শরে ত্যজিব জীবন।
সীতা ফিরে দিতে না পারিব কদাচন।।
মন্দোদরী রাণী বলে ভাগ্য হলে হীন।
বল বুদ্ধি পরাক্রম পাসরে প্রবীণ।।
আসন্ন সময়ে বুদ্ধি ঘটে বিপরীত।
কোপ না করিহ রাজা শুনহ কিঞ্চিৎ।।
সংসারের কর্ত্তা রাম পতিত-পাবন।
ত্রিভুবনে সকলেরে করেন পালন।।
সত্ত্বগুণে সেই প্রভু পালেন সবারে।
শত্রুভাবে আইলেন মারিতে তোমারে।।
লক্ষ্মীরূপা সীতাদেবী পূজিতা ভুবনে।
লক্ষ্মীরে দিতেছ দুঃখ অশোকের বনে।।
যে জন পালন-কর্ত্তা সেই জন মারে।
অভাগ্য তোমার মত নাহিক সংসারে।।
ঈষৎ হাসিয়া কহে লঙ্কা-অধিকারী।
সামান্য হে বুদ্ধি তব রাণী মন্দোদরী।।
শক্তিরূপা মহালক্ষ্মী সীতা ঠাকুরাণী।
তুমি কি বুঝাবে মোরে আমি তাহা জানি।।
জপ যজ্ঞ পূজা করে রাখিতে না পারে।
বিনা অর্চ্চনাতে পড়ে আছেন দুয়ারে।।
নীরাহারে অনাহারে জপে কত জন।
মৃত্যুকালে নাহি পায় যেই শ্রীচরণ।।
ধ্যানযোগে ভাবিয়া না পান মুনি ঋষি।
সে রাম ভাবেন আমায় নিরাহারে বসি।।
জাগিছে আমার রূপ শ্রীরামের মনে।
ভাবিছেন আমারে বধিবে কতক্ষণে।।
মরিব রামের হাতে ভাগ্যে যাহা আছে।
যমের না হবে সাধ্য ঘনাইতে কাছে।।
বিষ্ণুদূতে লয়ে যাবে তুলিয়ে বিমানে।
সমান প্রতাপে যাব জীবনে মরণে।।
ইন্দ্র আদি দেবতা জীবনে আজ্ঞাকারী।
মরিয়া বৈকুণ্ঠে আমি যাব সর্ব্বোপরি।।
না বুঝিয়া ভাগ্যহীন কহিলে আমারে।
আমা সম ভাগ্যবান নাহিক সংসারে।।
দেখিব করিয়া যুদ্ধ মরি কিংবা মারি।
ক্রন্দন সম্বরি গৃহে যাহ মন্দোদরী।।
মরণ নিকটে তার কি করে ঔষধে।
না রহে রাবণ মন্দোদরীরর প্রবোধে।।
স্বামী প্রদক্ষিণ করি পড়িল মঙ্গল।
মন্দোদরী-চক্ষে জল করে ছল ছল।।
অন্তরে জানিয়া রাণী কান্দিল প্রচুর।
দশ হাজার সতিনীতে গেল অন্তঃপুর।।
অষ্টাদশ বৃহন্দের বাহিরে রাবণ।
সারথি সাজায়ে রথ যোগায় তখন।।
কনক রচিত রথ সুগঠন চাকা।
উপরেতে শোভা করে ধ্বজের পতাকা।।
বিচিত্র নির্ম্মাণ রথ সাজিল প্রচুর।
রথের উপরে রাজা সংগ্রামের শূর।।
দশানন বলে অস্ত্রধারী যত জনে।
ছোট বড় সাজিয়া আসুক মম সনে।।
মহীরাবণ পড়িল বংশের চূড়ামণি।
আর কারে পাঠাইব যাইব আপনি।।
যতেক আছিল সৈন্য লঙ্কার ভিতর।
সাজিয়া রাবণ সঙ্গে চলিল সত্বর।।
পশ্চিম দ্বারেতে আছে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
যুঝিবারে সেই দ্বারে গেলেন রাবণ।।