রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – রাবণ ও মহীরাবণের মন্ত্রণা শ্রবণ করিয়া বিভীষনের রাম লক্ষ্মণের রক্ষা বিধান
দুই জনে কহে কথা বসি সিংহাসনে।
বিভীষণ নিবেদিল রামের চরণে।।
যোড়হাতে রঘুনাথে বলে বিভীষণ।
নিশ্চিন্ত হইয়ে কেন রয়েছে রাবণ।।
ইন্দ্রজিৎ পড়িয়াছে বীর নাহি আর।
কি মন্ত্রণা করে রাবণ দেখি একবার।।
প্রণমিয়ে শ্রীরাম লক্ষ্মণ জাম্ববান।
পক্ষীরূপ হইয়া চলিল বিভীষণে।।
রাবণের অন্তঃপুরে গেল অনিমিখে।
রাবণ সহিত মহীরাবণেরে দেখে।।
পিতা পুত্র দুই জনে বসি একাসনে।
যুক্তি করে দুজনেতে হরষিত মনে।।
মহীরাবণে দেখিয়ে চিন্তিত বিভীষণ।
রামের নিকটে এল ত্বরিত গমন।।
বিভীষণ কহে আসি করি যোড়হাত।
আজি বড় সঙ্কট যে দেখি রঘুনাথ।।
রাবণের পুত্র এক সে মহীরাবণ।
মায়ার সাগর বেটা বুন্ধে বিচক্ষণ।।
মন্দোদরী-গর্ভে সেই জন্মিল তনয়।
তাহার সংগ্রামে সুরাসুর করে ভয়।।
পাতাল-পুরেতে থাকে বাপের আদেশে।
মহাবল পরাক্রম সবে ভয় বাসে।।
তাহার সংগ্রামে প্রভু কারো নাই রক্ষা।
ত্রিভুবন বিজয়ী ধনুক বাণ-শিক্ষা।।
মায়া পাতি ডাকিনী ছাওয়ালে যেন হরে।
সেইমত মহী মায়া করে চুরি করে।।
কত মায়া ধরে কেহ নাহি জানে সন্ধি।
মহামায়া তার ঘরে সত্যে আছে বন্দী।।
যাহা মনে করে তাহা করিবারে পারে।
ত্রিভুবন কাঁপে মহীরাবণের ডরে।।
হেন দুষ্ট আসিয়াছে লঙ্কার ভিতরে।
আজি নিশি জাগ সবে হইয়া সত্বরে।।
বুঝিয়া সুযুক্তি কর মন্ত্রী জাম্ববান।
মহীর মায়াতে কিসে হবে পরিত্রাণ।।
জাম্ববান কহে শুন বীর হনুমান।
বিপত্তে নাহিক বন্ধু তোমার সমান।।
বিভীষণের বচন করহ অবগতি।
কিরূপে নিস্তার পাব আজিকার রাতি।।
হনুমান বলে, শুন যত বীরভাগে।
চোরা বেটা বিনাশিব সারা রাত্রি জেগে।।
মরিল সকল বীর মহী বেটা আছে।
মহীরাবণ বধিয়া রাবণে বধি পিছে।।
এখনো রাবণ বেটা জীতে সাধ করে।
লঙ্কাপুরী উপাড়িয়া ডুবাব সাগরে।।
চতুর্দ্দশ ভুবনেতে সুগ্রীবের গতি।
যেখানে লুকায়ে থাকে নাহি অব্যাহতি।।
লেজের কুণ্ডলী গড় করিব নির্ম্মাণ।
সকলে জাগিয়া থাক সবে সাবধান।।
রহিব সকল কপি গড় আগুলিয়ে।
কার সাধ্য যাইবেক আমারে ভাণ্ডিয়ে।।
বিভীষণ বলে শুন পবন-নন্দন।
প্রতীত তোমার বাক্যে হবে কোন্ জন।।
যাবৎ এ কালনিশি প্রভাত না হয়।
তাবৎ আমার মনে না হয় প্রত্যয়।।
শ্রীরাম বলেন শুন পবন-কুমার।
আজি রাত্রি উদ্ধারিতে ভরসা তোমার।।
হাসিয়া হাসিয়া কন মন্ত্রী জাম্ববান।
হনুমান বীর বড় কহিলা প্রমাণ।।
দেখাদেখি এসে যদি রণে দেয় হানা।
তবেত তাহার সঙ্গে খাটে বীরপণা।।
অলক্ষিতে চোর আসি যাবে চুরি করে।
দেখিতে না পাবে হনু কি করিবে তারে।।
অলক্ষিতে আসিবে সে চুরি বিদ্যা জানে।
একত্তরে সবাই থাকহ জাগরণে।।
জাম্ববান বলে তব অতুল বিক্রম।
আজিকার রাত্রি তুমি কর পরিশ্রম।।
এইবেলা বৈস সবে দৃঢ় যুক্তি করি।
বেলা অবসান হৈল আইল শর্ব্বরী।।
এত বলি বিভীষণ তথা হৈতে যায়।
অন্তরে থাকিয়া মহী দেখিবারে পায়।।
ভরত হইয়া এল হনুমানের কাছে।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ দুই ভাই কোথা আছে।।
চৌদ্দবর্ষ বনবাসী মস্তকেতে জটা।
দশরথ রাজার আমরা চারি বেটা।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ কোথা করি দরশন।
এত শুনি কহিছেন পবন-নন্দন।।
ক্ষণেক বিলম্ব কর আসুক বিভীষণ।
ইহা শুনি পাছু হটে সে মহীরাবণ।।
হেনকালে ধাইয়া আইল বিভীষণ।
হনু বলে ভরত আইল এইক্ষণ।।
হনুমানে চাহি বিভীষণ কহে কথা।
দ্বার না ছাড়িও যদি আসে তব পিতা।।
এত বলি বিভীষণ গেল অতি দূরে।
কৌশল্যা হইয়া মহী আইল সত্বরে।।
কৌশল্যা বলেন শুন পবন-কুমার।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে মোরে দেখাও একবার।।
হনুমান বলে মাতা করি নিবেদন।
ক্ষণেক থাকহ হেথা আসুন বিভীষণ।।
এতেক শুনিয়া মহী তিলেক না থাকে।
বিভীষণ ধাইয়া আইল দূর থেকে।।
বিভীষণে দেখি বুড়ী যায় গুড়িগুড়ি।
তাহা দেখি হনু করে দন্ত কড়মড়ি।।
উপনীত হইল রাক্ষস বিভীষণ।
কহিল সকল কথা পবন-নন্দন।।
বিভীষণ বলে শুন আবার বচন।
দ্বার না ছাড়িবে যদি আইসে পবন।।
এত বলি বিভীষণ করিল গমন।
হইয়া জনক-ঋষি দিল দরশন।।
জনক বলেন শুন পবন-নন্দন।
রাম সঙ্গে আমার করাহ দরশন।।
আমার জামাতা হন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
চতুর্দ্দশবর্ষ গত নাহি দরশন।।
তোমারে না চিনি আমি বলে হনুমান।
ক্ষণকাল থাকহ আসুন বিভীষণ।।
এতেক শুনিয়া ঋষি হনুমান-বোল।
হনুমান-সঙ্গেতে যুড়িল গণ্ডগোল।।
হেনকালে বিভীষণ দিলেন হাঁকার।
পলায় জনক-ঋষি দেখা নাহি আর।।
উপনীত হইল রাক্ষস বিভীষণ।
বিভীষণে কহে সব পবন-নন্দন।।
বিভীষণ বলে যদি আসে তব পিতা।
গড়ের ভিতরে যেতে না দিও সর্ব্বথা।।
এতেক বলিয়া বিভীষণের গমন।
বিভীষণ হয়ে মহী দিল দরশন।।
হনুমান বলে তুমি গেলে এইক্ষণে।
এত শীঘ্র ফিরে এলে কিসের কারণে।।
বিভীষণ বলে শুন পবন-নন্দন।
চোরা মায়া কত জানে সে মহীরাবণ।।
সাবধানে থাক তুমি আজিকার নিশি।
রাম লক্ষ্মণের হাতে রক্ষা বেঁধে আসি।।
এতেক বলিয়া মহী গড়েতে প্রবেশে।
অলক্ষিতে গেল রাম লক্ষ্মণের পাশে।।
সুগ্রীব-অঙ্গদ-কোলে আছে দুই ভাই।
মায়ারূপে নিশাচর গেল সেই ঠাঁই।।
মহামায়া স্মরি ধূলি দিল উড়াইয়ে।
রাম লক্ষ্মণ নিদ্রা যায় অচেতন হয়ে।।
অচৈতন্য হয়ে পড়ে যতেক বানর।
হাত হৈতে খসে পড়ে গাছ ও পাথর।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ দোঁহে নিদ্রায় অচেতন।
সুড়ঙ্গে লইয়া যায় আপন ভবন।।
নিদ্রা নাহি ভাঙ্গে দোঁহে আছেন শয়নে।
ঘরের ভিতরে লয়ে রাখিল গোপনে।।
জাম্ববানের কথা যদি হৈল অবসান।
হেনকালে করযোড়ে বলে হনুমান।।
মায়াবী রাক্ষস সেই কত মায়া জানে।
সাবধানে থাক যেন না পায় সন্ধানে।।
শ্রীরামেরে কহিলেন পবন-নন্দন।
বিষ্ণুচক্র আকাশে করহ আচ্ছাদন।।
চক্র আচ্ছাদন যদি রহিল গগনে।
শূন্যেতে আসিতে পারে কাহার পরাণে।।
বিশ্বকর্ম্মার পুত্র নল মায়ার নিধান।
পাতালে রহুক গিয়া হয়ে সাবধান।।
সাবধান হয়ে সবে রহ সারি সারি।
লেজে গড় বান্ধি আমি তাহে থাকি দ্বারী।।
লেজ হয় দীর্ঘাকার শতেক যোজন।
গঠিল বিচিত্র গড় পবন-নন্দন।।
প্রাচীর চৌতার হৈল অতি মনোহর।
সকল কটক ঢোকে তাহার ভিতর।।
সুগ্রীবের কোলে রাম কমল-লোচন।
অঙ্গদের কোলে রন ঠাকুর লক্ষ্মণ।।
লাঙ্গুলের গড়ে বীর যুড়িলেক দেশ।
তাহাতে সসৈন্যে রাম করেন প্রবেশ।।
অপূর্ব্ব লেজের গড় নির্ম্মাণ যে করি।
বিভীষণ ভ্রমিতেছে হইয়া প্রহরী।।
সকল কটক মাঝে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
গাছ পাথর হাতে কপি করে জাগরণ।।
লেজেতে বান্ধিল গড় ঠেকিল গগন।
উপরেতে বিষ্ণুচক্র ফিরে ঘনে ঘন।।
গড়ের দ্বারেতে দ্বারী আপনি যে রহে।
কার সাধ্য প্রবেশ করিতে পারে তাহে।।
এইরূপে সকলেতে তথায় রহিল।
কৃত্তিবাস রামায়ণ যত্নে বিরচিল।।