রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – নরান্তক, দেবান্তক, মহোদর, ত্রিশিরা, অতিকায় ও মহাপাশের যুদ্ধ ও মৃত্যু
এইরূপে ক্রন্দন করয়ে দশানন।
অশ্রুজলে অভিষিক্ত হইল বদন।।
পিতার কাতর দেখি পুত্র জন্মে দুঃখ।
ত্রিশিরা বিক্রম করে রাবণ সম্মুখ।।
করিলে তপস্যা পিতা হইতে অমর।
অমর হইতে ব্রহ্মা নাহি দিলা বর।।
অমর হইল বিভীষণ নিজগুণে।
ব্রহ্মার কৃপায় সেই সর্ব্বশাস্ত্র জানে।।
শাস্ত্র-অনুরূপ খুড়া কহিলেক হিত।
ধার্ম্মিক চরিত্র তিনি বিচারে পণ্ডিত।।
ত্রিভুবন জিনে পিতা তোমার বাখান।
দেবতা গন্ধর্ব্ব আদি নাহি ধরে টান।।
জ্যেষ্ঠ ভাই কুবের ধনের অধিকারী।
তারে জিনি পুষ্পরথ নিলে লঙ্কাপুরী।।
ময়-দানব মহারাজ সর্ব্বলোক মাঝে।
কন্যাদান দিয়া সে তোমারে দেখ পূজে।।
বাসুকির বিষদাহে ত্রিভুবন পুড়ে।
তব শব্দ পাইলে পলায় উভরড়ে।।
ইন্দ্র যম বরুণের করিলে বিতথা।
মনুষ্য বেটারে জিনা কত বড় কথা।।
নানা অস্ত্র সংগ্রামে করিব অবতার।
আজিকার যত যুদ্ধ সে আমার ভার।।
গরুড়ের মুখে যেন দগ্ধ হয় সাপ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে মারি ঘুচাব সন্তাপ।।
ত্রিশিরা বিক্রম করে, রাজা হরষিত।
আর তিন ভাই তার রোষে আচম্বিত।।
দেবান্তক নরান্তর অতিকায় বীর।
সংগ্রামে যাইতে চাহে নাহি হয় স্থির।।
চারিজন মহাবল চিরকাল জানি।
চারিজনে ঐক্য হলে ত্রিভুবন জিনি।।
রাজ প্রসাদ যাহা পাইল চারিজন পরি।
কুসুম চন্দন মাল্য সুগন্ধী কস্তূরী।।
বীরধটি পরে কেহ নামে গঙ্গাজল।
রত্নেতে নির্ম্মিত পরে কর্ণেতে কুণ্ডল।।
পরিল সোণার সানা রত্নের টোপর।
মাণিক্যের হার সাজে গলার উপর।।
নানা রত্ন অলঙ্কার পরিল শরীরে।
কনক কঙ্কণ বালা পরে দুই করে।।
চারি বেটা পরিলেক চারি রাজার ধন।
রাবণের চারি বেটা কামিনী-মোহন।।
মহাপাশ বীর আর ভাই মহোদর।
ছয় জন যাত্রা করে সংগ্রাম ভিতর।।
ছয় বীর যাত্রা করে সংগ্রাম প্রবীণ।
বিদায় হইয়া করে পিতৃ প্রদক্ষিণ।।
নীল বর্ণ হস্তী এল নীল মেঘ-জ্যোতি।
ঐরাবতের বংশে তার হয়েছে উৎপত্তি।।
বড়ই প্রবল সেই মদমত্ত হাতী।
তাহাতে চড়িল মহোদর যোদ্ধাপতি।।
উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব যেন পবনের গতি।
সেই অশ্বে চড়ে দেবান্তক মহামতি।।
আর অশ্ব ভূমে পাদ পড়ে কি না পড়ে।
হাতে শেল নরান্তক সেই অশ্বে চড়ে।।
সাজালেক রথ যেন রবির প্রকাশ।
হাতে শেল তাতে চড়ে বীর মহাপাশ।।
আর রথ সাজায় মাণিক্য মণি হীরা।
হাতে খাণ্ডা চড়ে তাতে কুমার ত্রিশিরা।।
সুবর্ণের রথ শত ঘোড়ার সাজনি।
সেই রথে অতিকায় চড়িল আপনি।।
পুত্র সব যাত্রা করে শুনি এ বচন।
সবার জননী আসি করিছে রোদন।।
কুম্ভকর্ণ হেন বীর পড়ে গেল রণে।
যাইও নাকো ব্যথা দিয়া জননীর প্রাণে।।
ধনুর্ব্বাণ হেন বীর পড়ে গেল রণে।
যাইও নাকো ব্যথা দিয়া জননীর প্রাণে।।
ধনুর্ব্বাণ ছাড় বাছা প্রাণ বড় ধন।
কল্যাণে থাকিবে রাখ মায়ের বচন।।
বিভা কৈলৈ কত দেব-দানব-নন্দিনী।
কোথা যাহ তা সবারে করে অনাথিনী।।
সম্প্রতি করিলে বিভা, নহে সহবাস।
অগ্নি দিয়া পোড়াল লঙ্কার গৃহবাস।।
চারি ভাই চতুর্দ্দোল লহ স্কন্ধে করি।
শ্রীরামেরে দেহ লয়ে জানকী সুন্দরী।।
হেন কর্ম্ম করিলে যদ্যপি রাজা রোষে।
পলাইয়া থাক গিয়া পর্ব্বত কৈলাসে।।
কুবের তোমার পিতৃজ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবর।
সেবি তাঁকে পুত্র সম থাক তাঁর ঘর।।
মাতৃগণ-বচনেতে পুত্র সব কোপে।
পুত্রের দেখিয়া ক্রোধ ভয়ে তারা কাঁপে।।
পুত্রগণ কোপে বলে দিতাম প্রতিফল।
জননী বলিয়া এত সহি সে সকল।।
জগতের কর্ত্তা মোরা, বীরবংশে জন্ম।
মানুষের ডরে রব করে সেবাকর্ম্ম।।
আনিল পুষ্পকরথ পিতা যারে জিনে।
কোন্ লাজে শরণ লব তাহার চরণে।।
বাহুবলে পিতা মোর ত্রিভুবন শাসে।
লুকায়ে থাকিব কেন ডরায়ে মানুষে।।
বিপক্ষ-সম্মুখে যদি সংগ্রামেতে মরি।
দিব্যরথে চড়িয়া যাইব স্বর্গপুরী।।
আপন মন্দিরে যাহ না কর বিষাদ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে মেরে ঘুচাব বিবাদ।।
গরুড়ের মুখে যেন ভস্ম হয় সাপ।
গ্রাসিয়া বানর-সেনা দেখাব প্রতাপ।।
মায়েরে প্রবোধ করি ছয় জন সাজে।
রুষিয়া প্রবেশ করে সংগ্রামের মাঝে।।
ছয় সেনাপতি ঠাট ছয় অক্ষৌহিণী।
কটকের পদভরে কাঁপিছে মেদিনী।।
ধূলায় দিবসে বাট হৈল অন্ধকার।
ছয়া বীর উত্তরিল করি মার মার।।
দুই সৈন্যে মিশামিশি বাজে মহারণ।
গাছ উপাড়িয়া আনে যত কপিগণ।।
বানরেতে গাছ পাথর করে বরিষণ।
বাণে কাটি রাক্ষসেতে করে নিবারণ।।
রাক্ষসেতে বাণ এড়ে অনলের শিখা।
বানর কটক পড়ে নাহি লেখজোখা।।
ব্যাঘ্রের ঝাঁপনি যেন বানরের রঙ্গ।
মরণের ভয় নাই, রণে নাহি ভঙ্গ।।
চড় চাপড় মুষ্ট্যাঘাত বানরের তাড়া।
কত শত রাক্ষসের মাথা করে গুঁড়া।।
অনেক রাক্ষস পড়ে অত্যল্প-বানর।
কুপিল যে নরান্তক রাবণ-কুমার।।
চতুর্দ্দিকে চাপিয়া উঠিল তার ঘোড়া।
চতুর্দ্দিকে অস্ত্রবৃষ্টি করে ঘোড়া যোড়া।।
বানরেরে মারে বীর মহা শেলপাট।
বানরের রক্তে কাদা হয়ে গেল বাট।।
নরান্তকের বাণ কেহ সহিতে না পারে।
ভঙ্গ দিয়া বানর পলায়ে গেল ডরে।।
ডাকিয়া সুগ্রীব কহে অঙ্গদের আগে।
দেখ দেখি অঙ্গদ কটক কেন ভাগে।।
আপনি করিয়া যুদ্ধ রাখ কপিগণ।
নরান্তকে মেরে তোষ শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
সুগ্রীবের বচনে অঙ্গদ পড়ে লাজে।
কটক সাজায়ে গেল সংগ্রামের মাঝে।।
রণেতে প্রবেশ করে অতি ক্রোধমুখে।
দূর হৈতে নরান্তকে বালিসুত ডাকে।।
দুই হাত শূন্য মোর দেখ নিশাচর।
যত শক্তি আছে হান বুকের উপর।।
দেবতা জিনিস্ বেটা শেলের কারণ।
আজিকার যুদ্ধে তোর বধিব জীবন।।
শ্রীরামের ভৃত্য আমি সংসারে পূজিত।
তুই অস্ত্র এড়িলে না হব আমি ভীত।।
পাইক মারিয়া বেটা ফির কি কারণ।
তোমাতে আমাতে যুঝি জিনে কোনজন।।
দুই হাত পসারিয়া পেতে দিল বুক।
অঙ্গদের বিক্রমে সুগ্রীবের কৌতুক।।
কোপে নরান্তক বীর অধরোষ্ঠ কাঁপে।
এড়িলেক শেলপাট অতিশয় কোপে।।
এড়িলেক শেলপাট দিয়া হুহুঙ্কার।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে লাগিল চমৎকার।।
অঙ্গদের বুক যেন বজ্রের সমান।
বুকেতে ঠেকিয়া শেল হৈল দুইখান।।
অঙ্গদ বলে, তোর, অস্ত্র গেল রসাতল।
মোর ঘা সম্বর বেটা, তবে জানি বল।।
আপনা পাসরে কোপে বালির নন্দন।
নরান্তকে মারিতে ভাবয়ে মনে মন।।
বজ্রমুষ্টি মারি ঘোড়া করিলেক চূর।
পড়িল দুর্জ্জয় ঘোড়া ঊর্দ্ধে চারি খুর।।
দুই চক্ষু ঠিকরিল জিহ্বা বাহিরায়।
নরান্তক কুপিয়া অঙ্গদ পানে চায়।।
বজ্রমুষ্টি মারিলেক অঙ্গদের বুকে।
মুখে রক্ত উঠে তার ঝলকে ঝলকে।।
শরীর ব্যথিত তবু নহেত কাতর।
প্রবেশ করিল গিয়া রণের ভিতর।।
মহাবল অঙ্গদ অত্যন্ত ক্রোধভরে।
বুকে হাঁটু দিয়া তবে নরান্তকে মারে।।
নরান্তক পড়িল, দেখিল দেবান্তকে।
সসৈন্যেতে অঙ্গদে বেড়িল চারিদিকে।।
হস্তীর উপরে চড়ি আইল মহোদর।
চালাইয়া দিল করী অঙ্গদ উপর।।
অনুবল ত্রিশিরা হইল ততক্ষণ।
অঙ্গদেরে বেড়ে আসি বীর দুই জন।।
মহোদর জাঠা মারে অঙ্গদের বুকে।
মুখে রক্ত উঠে বীরের ঝলকে ঝলকে।।
মুখে রক্ত উঠে তবু না হয় কাতর।
অন্ধকার করি ফেলে গাছ ও পাথর।।
মধ্যেতে অঙ্গদ চারিদিকে নিশাচর।
দেখি হনুমান বীর ধাইল সত্বর।।
মহারণে মিশামিশি হৈল ছয়জন।
বাজিল তুমুল যুদ্ধ নহে নিবারণ।।
দেবান্তকের হাতে ছিল লোহার পাবড়ি।
হনুমানের বুকে মারে দুহাতিয়া বাড়ি।।
কুপিল সে হনুমান সংগ্রামের শূর।
পদাঘাতে দেবান্তকে করিলেক চূর।।
হস্তীর উপরে তবে আইল মহোদর।
নীল সেনাপতি বিন্ধি করিল জর্জ্জর।।
বাণ খেয়ে নীলবীর করিল উঠানি।
এক টানে উপাড়ে পর্ব্বত একখানি।।
পড়িল পর্ব্বত গোটা শব্দ গেল দূর।
হস্তসহ মহোদরে করিলেক চূর।।
তিন ভাই পড়ে রণে দেখে অতিকায়।
হাতে খাণ্ডা ত্রিশিরা সংগ্রাম মাঝে যায়।।
হনুমান মহাবীরে দেখিল সম্মুখে।
দুহাতিয়া বাড়ি মারে হনুমানের বুকে।।
প্রহারেতে হনুমান আপনা পাসরে।
এক লাফে পড়ে তার রথের উপরে।।
ত্রিশিরার হাতে খাণ্ডা অতি খরশান।
সে খাণ্ডায় ত্রিশিরারে করে খান খান।।
ভাই ভাইপো রণে পড়ে দেখে মহাপাশ।
হাতে গদা কপিগণে করিছে বিনাশ।।
নীলবর্ণ গদাখান দেখে চারিভিতে।
অধিক হইল রাঙ্গা কপির শোণিতে।।
জয়ঘণ্টা বাজে সে গদার চারিপাশে।
দেবতা গন্ধর্ব্ব আদি সবে কাঁপে ত্রাসে।।
মহাপাশের বাণ কেহ সহিতে না পারে।
ভঙ্গ দিয়া পলাইলে সকল বানরে।।
হেমকূট কপি আইল বরুণ-নন্দন।
পর্ব্বত উপাড়ে এক ঘোর দরশন।।
এড়িল পর্ব্বতখান অতি ক্রোধমনে।
মহাপাশ বীর পড়ে পর্ব্বত চাপনে।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ।
লঙ্কাকাণ্ডে গাহিলেন গীত রামায়ণ।।