নিরুপমা হোটেলের রান্না ভাল
নিরুপমা হোটেলের রান্না ভাল।
মধ্যাহ্ন ভোজন দেশী ও বিলাতি মতে সমাধা করে পুলিসের দল ডাইনিং রুম থেকে বেরুলেন, সঙ্গে ব্যোমকেশ। রাখালবাবু দ্বিতীয় সাব-ইন্সপেক্টরকে বললেন, ‘দত্ত, তুমি এখানে থাকে। এই নাও, দু’ নম্বর ঘরের চাবি। ফিঙ্গারপ্রিন্টের দল এখনি আসবে, তাদের ঘর খুলে দিও। আমি ঘোষকে নিয়ে বেরুচ্ছি। আসুন ব্যোমকেশদা।’
তিনজনে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালেন। রাখালবাবু পকেট থেকে খাতা বার করে বললেন, ‘এ সময় কাউকে বাড়িতে পাব। কিনা বলা যায় না। যাহোক, চলুন আগে জগবন্ধু পাত্রকে দেখা যাক! লোকটিকে ওড্র-কুলোদ্ভব মনে হচ্ছে।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘হুঁ।’
একটা ট্যাক্সি ধরে তিনজনে উঠে বসলেন, ট্যাক্সি জগবন্ধু পাত্রের ঠিকানা লক্ষ্য করে ছুটিল। রাখালবাবু বললেন, ‘ব্যোমকেশদা, আজ আপনি এমন চুপচাপ কেন? কিছু বলছেন না।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘এখন কেবল শুনে যাচ্ছি, বলা-কওয়ার সময় এখনো আসেনি।–সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে।’
জগবন্ধু থাকেন একটি তেতলা বাড়ির নীচের ফ্ল্যাটে। রাখালবাবু কড়া নাড়লেন, একটি লোক দোর খুলে দাঁড়াল। ছাঁটা দাড়ি, কোল-কুঁজো ধরনের চেহারা, বয়স আন্দাজ চল্লিশ। রাখালবাবু বললেন, ‘আপনার নাম জগবন্ধু পাত্র?
‘হাঁ।’ জগবন্ধু পুলিসের ইউনিফর্ম দেখে একটু সচকিত হয়ে বললেন, ‘কি দরকার?’
‘নিরুপমা হোটেলে রাজকুমার বসু নামে এক ব্যক্তি খুন হয়েছেন—‘
‘জগবন্ধু পাত্রের মুখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে উঠল, তিনি বলে উঠলেন, ‘রাজকুমার খুন হয়েছে!’ ‘হ্যাঁ। আপনাকে দু’ একটা প্রশ্ন করতে চাই।’
‘আসুন।’ জগবন্ধু পাত্র একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের বসলেন, ‘বসুন, আমি এখনি আসছি।’
তিনি পাশের ঘরে চলে গেলেন।
বসবার ঘরটি ছোট এবং নিরাভরণ; একটি টেবিল ও তিনটি চেয়ার আছে; টেবিলের ওপর টেলিফোন। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরিয়ে ঘরের এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল, কিন্তু কোথাও গৃহস্বামীর চরিত্রের কোনো পরিচয় পেল না।
পাঁচ মিনিট কাটল, দশ মিনিট কাটল, জগবন্ধু পাত্রের দেখা নেই। রাখালবাবু তখন গলা চড়িয়ে ডাকলেন, ‘জগবন্ধুবাবু!’ কিন্তু উত্তর এল না।
ব্যোমকেশ মুখ টিপে হাসল, বলল, ‘মনে হচ্ছে জগবন্ধু পাত্র গৃহত্যাগ করেছেন।’
রাখালবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘পালিয়েছে! এসো ঘোষ, বাড়ির ভেতরটা দেখা যাক। আসুন ব্যোমকেশদা।’
ব্যোমকেশ কিন্তু গেল না; ঘোষকে নিয়ে রাখালবাবু ভিতরে গেলেন। দেখলেন, কেউ নেই, খিড়কির দোর খোলা।
রাখালবাবু ফিরে এসে বললেন, ‘পাখি উড়েছে।’
ব্যোমকেশ ইতিমধ্যে টেবিলের দেরাজ খুলে একটা বাঁধানো খাতা বার করেছিল, তার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল, ‘লোকটা বোধহয় ঘোড়দৌড়ের টাউট ছিল।’
‘তাই নাকি! কিন্তু পালাল কেন?’
‘নিশ্চয় গুরুতর গলদ আছে। শুধু ঘোড়দৌড় হলে পালাত না।’
রাখালবাবু থানায় ফোন করলেন। পলাতকের বর্ণনা দিলেন, আরো লোক ডেকে পাঠালেন। তারপর ফোন নামিয়ে বললেন, ‘ঘোষ, তুমি এখানে থাকে, আমরা অন্য কাজে যাচ্ছি। এখনি থানা থেকে আরো লোক এসে পড়বে। বাড়ি তন্ন তন্ন করে তল্লাশ করো। আঙুলের ছাপ নিশ্চয় পাবে; ততক্ষণাৎ হেডু অফিসে পাঠিয়ে দেবে। লোকটা বোধহয় দাগী আসামী।’
জগবন্ধু পাত্রের বাসা থেকে বেরিয়ে রাখালবাবু ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি মনে হয়? জগবন্ধু পাত্রই আমাদের আসামী?
ব্যোমকেশ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বলা যায় না। লোকটা রাজকুমারের মৃত্যু-সংবাদ শুনে চমকে উঠেছিল। তবে অভিনয় হতে পারে।’
অতঃপর মোহনলাল কুণ্ডুর বাসায় গিয়ে জানা গেল, কুণ্ডু মশাই কলকাতায় নেই। সস্ত্রীক কাশী গিয়েছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই।
সেখান থেকে তাঁরা শ্যামাকান্ত লাহিড়ীর বাড়ি গেলেন। কিন্তু এখানেও নিরাশ হতে হলো। শ্যামাকান্ত বাড়ি নেই, অফিসে গেছেন। শ্যামাকান্ত পোর্ট কমিশনারের অফিসে বড় চাকরি করেন। এইটুকুই শুধু জানা গেল। সন্ধ্যের আগে তাঁকে পাওয়া যাবে না।
রাখালবাবু নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাকি রইলেন শুধু লতিকা চৌধুরী। ইনি যখন মহিলা তখন আশা করা যায় দুপুরবেলা এঁকে বাসায় পাওয়া যাবে।’
শ্ৰীমতী চৌধুরী স্বতন্ত্র বাড়িতে থাকেন, ফ্ল্যাট নয়। ছোটখাটো বাড়িটি, বেশ পরিচ্ছন্ন, সামনে একফালি ফুলের বাগান। ঘণ্টি বাজাতেই একটি চশমা-পরা মহিলা দোর খুলে বললেন, ‘কাকে চাই? কর্তা বাড়ি নেই।’ তারপরই তাঁর চকিত দৃষ্টি পড়ল রাখালবাবুর ইউনিফর্মের ওপর।
জেনারেল রামপিরিত যে বৰ্ণনা দিয়েছিল, মহিলাটির সঙ্গে তার মিল আছে। তবে বয়স বিশ-পঁচিশ নয়, আরো বেশি। ত্রিশ-বত্ৰিশ বছর বয়সেও কিন্তু ছিমছাম গড়ন এবং সুশ্ৰী মুখ থেকে যৌবনের রেশ সম্পূর্ণ মুছে যায়নি।
রাখালবাবু বললেন, ‘আপনার নাম শ্ৰীমতী লতিকা চৌধুরী?’
শ্ৰীমতী চৌধুরীর ঠোঁট হঠাৎ আলগা হয়ে গেল, তিনি স্খলিতস্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ। কি দরকার?’
রাখালবাবু বললেন, ‘আপনাকে দু-চারটে প্রশ্ন করতে চাই। আমি পুলিসের লোক।’
শঙ্কা-শীর্ণ মুখে মিসেস চৌধুরী বললেন, ‘আসুন।’
বসবার ঘরটি পরিপাটিভাবে সাজানো; নীচু চেয়ার, সোফা, সেন্টার পিস। দেয়ালে একটি মধ্যবয়স্ক পুরুষের আবক্ষ ফটোগ্রাফ টাঙানো রয়েছে; মুখখানা কঠোর, চোখের নির্মম দৃষ্টি দর্শককে সর্বত্র অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে; এ ঘরে থাকলে ওই সন্ধানী দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।
ব্যোমকেশ ও রাখালবাবু পাশাপাশি সোফায় বসলেন; শ্ৰীমতী চৌধুরী একটি চেয়ারের কিনারায় বসে ভয়ার্তা চোখে তাঁদের পানে চাইলেন।
‘আপনার স্বামীর নাম কি?’
‘তারাকুমার চৌধুরী।’
‘কি কাজ করেন?’
‘ইঞ্জিনীয়র। রেলের ইঞ্জিনীয়র।’
‘ছেলেপুলে?’
‘নেই। আমরা নিঃসন্তান।’
‘কাল রাত্রি সওয়া ন’টার সময় আপনি নিরুপমা হোটেলে গিয়েছিলেন?’
শ্ৰীমতী চৌধুরীর চোখ দু’টি চশমার ভেতরে বিস্ফারিত হলো, ‘আমি! না না, আমি তো সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম।’
‘হোটেলের দরোয়ান আপনাকে কাল দেখেছে, সে আপনাকে সনাক্ত করতে পারবে।’
শ্ৰীমতী চৌধুরীর মুখ শুকিয়ে গেল, তিনি ঠোঁট চেটে বললেন, ‘কিন্তু আমি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম–আলেয়া সিনেমাতে। টিকিটের প্রতিপত্র দেখাতে পারি।’
‘আপনি সিনেমার টিকিট কিনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ছবি শেষ হবার আগেই নিরুপমা হোটেলে গিয়েছিলেন, রাজকুমার বোসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।’
রাজকুমারের নাম শুনে শ্ৰীমতী চৌধুরীর মুখ মড়ার মত হয়ে গেল। তাঁর ঠোঁট দুটো অস্ফুটভাবে নড়তে লাগল, ‘রাজকুমার বসু–তাকে তো আমি চিনি না—’
ব্যোমকেশ বন্দুকের গুলির মত প্রশ্ন করল, ‘সুকান্ত সোমকে চেনেন?’
শ্ৰীমতী চৌধুরী জলবদ্ধ হরিণীর মত ব্যোমকেশের পানে চাইলেন, তারপর দু’ হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন।
ব্যোমকেশ নরম সুরে বলল, ‘আমরা জানি, রাজকুমার বোস আর সুকান্ত সোম একই ব্যক্তি। সে আপনাকে ব্ল্যাকমেলা করছিল। কাল রাত্রি সওয়া ন’টার সময় সিনেমা-ফেরত আপনি তাকে টাকা দিতে গিয়েছিলেন। এখন বাকি কথা সব বলুন, আপনার কোনো ভয় নেই।’
শ্ৰীমতী চৌধুরী কিছুক্ষণ ফোঁপালেন, তারপর চোখ মুছে মুখ তুললেন, ভাঙা-ভাঙা গলায় বললেন, ‘বলছি। কেন জানতে চান আপনারাই জানেন, কিন্তু দোহাই আপনাদের, আমার স্বামী যেন কিছু জানতে না পারেন।’
ব্যোমকেশ দেয়ালের ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ইনি আপনার স্বামী?’
‘হ্যাঁ।’ ‘কড়া প্রকৃতির লোক মনে হয়। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে আমরা কাউকে কিছু বলব না।’
তারপর মিসেস চৌধুরী লজ্জানত চোখে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে যে কাহিনী বললেন তার সারাংশ এই :
বারো-তেরো বছর আগে শ্ৰীমতী চৌধুরী যখন কুমারী ছিলেন তখন তাঁর প্রকৃতি ছিল অন্য রকম, তিনি নিজেকে সংস্কারমুক্ত অতি-আধুনিক মনে করতেন। বাপের বাড়িতে টাকা ছিল বেশি, শাসন ছিল কম। লতিকা চক্রবর্তী বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে হৈ হৈ করে, সিনেমা-থিয়েটার দেখে সময় কাটাতেন।
সে-সময় চিত্র-জগতে সুকান্ত সোম নামে একজন হীরো ছিল, যেমন তার চেহারা তেমনি অভিনয়। লতিকা চক্রবর্তী তার প্রেমে পড়ে গেলেন, সাধারণ প্রেম নয়, একেবারে বাঁধন-ছেড়া প্রেম। তিনি সুকান্তকুমারকে প্রবল অনুরাগপূর্ণ চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেন। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা হতে লাগল।
লতিকা সুকাস্তকে বিয়ে করবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছিলেন, কিন্তু একদিন জানতে পারলেন, সুকান্তর ঘরে একটি স্ত্রী আছে। তাঁর প্রেমে ভাটা পড়ল। তাঁর বাবা বোধহয় কিছু সন্দেহ করেছিলেন, তিনি তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন।
তারপর দু’বছর কাটল। লতিকা দেবীর স্বামী লোকটি অতিশয় সজ্জন। কিন্তু যৌন শিথিলতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত কড়া। বিয়ের পর লতিকা চৌধুরীর রোমাঞ্চের নেশা ছুটে গিয়েছিল, স্বামীকে তিনি প্রীতি ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন। সন্তানাদি না হলেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়ে উঠেছিল।
একদিন কাগজে ভয়ঙ্কর খবর বেরুল, সুকান্ত নিজের স্ত্রীকে খুন করেছে। কেস আদালতে উঠল। আসামী অবশ্য খালাস পেয়ে গেল, কারণ সে আত্মরক্ষার্থে খুন করেছে; স্ত্রী ছুরি নিয়ে তাকে আক্রমণ করেছিল, তার মুখ এবং সবঙ্গে কেটে ফালা-ফালা করে দিয়েছিল, সে নিজের প্ৰাণ বাঁচাবার জন্যে স্ত্রীকে গলা টিপে মেরেছে। যতদিন মোকদ্দমা চলেছিল। ততদিন লতিকা দেবী ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলেন, পাছে কোনো সূত্রে তাঁর নামটা প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু সাক্ষী বা আসামী কেউ তাঁর নাম করল না; তখন তিনি নিশ্চিন্ত হলেন।
অতঃপর দু-তিন বছর নিরুপদ্রবে কেটে গেল।
সুকান্তর সিনেমার কাজ শেষ হয়েছিল; ও রকম একটা মুখ নিয়ে সিনেমার হীরো সাজা যায় না। সে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছিল। হঠাৎ একদিন সুকান্ত তার বীভৎস মুখ নিয়ে লতিকা দেবীর সঙ্গে দেখা করল, বলল, ‘আমার টাকার দরকার, তোমাকে দিতে হবে। বেশি নয়, ছাঁ মাস অন্তর তিন শো টাকা; তোমার পক্ষে অতি সামান্য। যদি না দাও, তুমি আমাকে যে-সব চিঠি লিখেছিলে সেগুলি তোমার স্বামীকে দেখাব।’
সেই থেকে শ্ৰীমতী চৌধুরী ছ’ মাস অন্তর তিন শো টাকা গুনছেন। ছ’ মাসে তিন শো টাকা তাঁর গায়ে লাগে না, কিন্তু সদাই ভয়, পাছে স্বামী জানতে পারেন।
কাল রাত্রে তিনি টাকা দিতে নিরুপমা হোটেলে গিয়েছিলেন, দু’নম্বর ঘরের দোরের বাইরে থেকে সুকান্ত সোমকে টাকা দিয়ে চলে এসেছিলেন। আর কিছু জানেন না।
শ্ৰীমতীর কাহিনী শেষ হলে শ্রোতা দু’জন কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলেন। তারপর ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আচ্ছা, আজ আমরা যাই। একটা সুখবর দিয়ে যাই, কাল রাত্রি সওয়া নটা থেকে এগারোটার মধ্যে সুকান্ত সোম ওরফে রাজকুমার বোস খুন হয়েছে।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’জনে ফুটপাথে এসে দাঁড়ালেন। রাখালবাবু বললেন, ‘শ্ৰীমতীর আত্মকথা তো শুনলাম। কিন্তু খুনের হদিস পাওয়া গেল না।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘একেবারে কিছুই পাওয়া যায়নি এমন কথা বলা যায় না। আজ যতগুলি লোকের এজেহার শুনেছি তাদের মধ্যে একজন একটা বেফাঁস কথা বলেছে। কিন্তু কে বলেছে। মনে করতে পারছি না।’
‘কী বেফাঁস কথা?’
‘সেইটেই মনে আসছে না। অনেক কথার মধ্যে ওই কথাটা মগ্নচৈতন্যে ডুব মেরেছে।’
রাখালবাবু ঘড়ি দেখলেন, প্রায় তিনটে বাজে। বললেন, ‘আমি এখন থানায় ফিরব। আপনি?’
‘আমি একবার নতুন বাড়ির কাজকর্ম তদারক করে বাসায় ফিরব। কাল সকালে আবার দেখা হবে। ইতিমধ্যে যদি নতুন খবর কিছু পান, দয়া করে টেলিফোন করবেন।’
পাঁচটার পর বাসায় ফিরে ব্যোমকেশ এক পেয়ালা চা খেল, তারপর সিগারেট ধরিয়ে তক্তপোশের ওপর লম্বা হলো। অজিত বাড়ি নেই, সাড়ে চারটের সময় দোকানে গেছে। ব্যোমকেশ একলা একলা চোখ বুজে শুয়ে সিগারেট টানতে লাগল।
সাড়ে ছাঁটার সময় সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। সত্যবতী কী একটা কাজে ঘরে এসেছিল, চমকে উঠে বলল, ‘কি হলো?’
ব্যোমকেশ উদ্ভাসিত মুখে বলল, ‘মনে পড়েছে!’
‘কী মনে পড়ল?’
‘কাছে এসো, কানে কানে বলছি।’
কানে কানে কথা শুনে সত্যবতী হাসিমুখে ব্যোমকেশের বাহুতে একটি ছোট্ট চড় মারল। ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাকে একবার বেরুতে হবে।’
‘আবার বেরুবে। কোথায় যাবে?’
‘কালকেতু খবরের কাগজের অফিসে। দশ বছরের পুরনো কাগজের ফাইল দেখতে হবে।’
‘ফিরতে নিশ্চয় রাত করবে। জলখাবার খেয়ে যাও।’
‘দরকার নেই। পেটে নিরুপমা হোটেলের গদ আছে।’
পরদিন সকালবেলা ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে টেলিফোন করল, ‘তাজা খবর কিছু আছে নাকি?’
রাখালবাবু বললেন, ‘সাড়া-জাগানো কোনো খবর নেই। লাশ পরীক্ষা করে অপ্রত্যাশিত কোনো খবর পাওয়া যায়নি; মৃত্যুর সময় ডিনারের আন্দাজ দেড় ঘণ্টা পরে। দুনম্বর ঘরে রাজকুমার আর গুণধরের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। — শ্যামাকান্ত লাহিড়ীর বাসায় আবার গিয়েছিলাম; সে পরিষ্কার অস্বীকার করল, বলল, নিরুপমা হোটেলে যায়নি। জেনারেল রামপিরিত কিন্তু তাকে সনাক্ত করেছে। শ্যামাকাস্তকে অ্যারেস্ট করিনি, কিন্তু তার পেছনে লেজুড় লাগিয়েছি।’
‘তারপর?
‘জগবন্ধু পাত্রের আসল নাম জানা গিয়েছে–ভগবান মহান্তি। দাগী আসামী; মেদিনীপুরে একটা স্ত্রীলোককে খুন করে চৌদ্দ বছর জেলে গিয়েছিল, তারপর জেল ভেঙে পালায়। কলকাতায় এসে ছদ্মনামে ঘোড়দৌড়ের দালালি করছিল।’
‘আর কিছু?’
‘লিতিকা দেবীর স্বামী তারাকুমার চৌধুরী সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম। তিনি সে-রাত্রে এগারোটার পর বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু এতক্ষণ কোথায় ছিলেন জানা যাচ্ছে না।’
‘জানার দরকার নেই। হোটেলের খবর কি?’
‘হোটেলের অতিথিরা বড় অস্থির হয়ে উঠছেন। ভাবছি আজ বিকেলবেলা তাদের ছেড়ে দেব।–আপনি কিছু পেলেন?’
‘পেয়েছি। আমি এখনি নিরুপমা হোটেলে যাচ্ছি। আপনিও আসুন।’
এক নম্বর ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাখালবাবু ও ব্যোমকেশের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। রাখালবাবু দোরে টোকা দিলেন।
দোর খুলে গেল। মিসেস শোভনা রায় রাখালবাবুকে দেখে জ্বলে উঠলেন, ‘এই যে। আপনি আর কতদিন আমাকে আটকে রাখবেন। আমার মত একজন ডাক্তারকে এমনভাবে আটকে রাখা আইনবিরুদ্ধ তা জানেন কি?’
রাখালবাবু বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আপনার যদি কোনো নালিশ থাকে আদালত আছে। আপাতত আপনাকে আমরা দু-চারটে কথা বলতে চাই।’
দু’জনে ঘরে প্রবেশ করলেন, ব্যোমকেশ চেয়ারে বসে বলল, ‘আপনাকে একটা গল্প শোনাতে চাই, মিসেস রায়।’
মিসেস বায় আবার জ্বলে উঠলেন, রূঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি আবার কে! ঠাট্টা করছেন নাকি?’
রাখালবাবু বললেন, ‘ইনি ব্যোমকেশ বক্সী। নাম শুনে থাকবেন।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘ঠাট্টা করছি না, মোটেই ঠাট্টা করছি না। আপনি বসুন।’
ব্যোমকেশের নাম শুনে মিসেস রায় থতিয়ে গিয়েছিলেন, খাটের ধারে বসলেন। রুক্ষ স্বর যথাসম্ভব নরম করে বললেন, ‘কি বলবেন বলুন। আমি কিন্তু আজই বহরমপুর ফিরে যাব।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘সেটা ভবিষ্যতের কথা।—গল্পটি খবরের কাগজে পড়লাম, সংক্ষেপে শোনাচ্ছি। —সুকান্ত সোম একজন সিনেমা আর্টিস্ট ছিল—’
মিসেস রায়ের শরীর শক্ত হয়ে উঠল, তিনি অপলক চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চেয়ে রইলেন। ব্যোমকেশ শুষ্ক স্বরে বলল, ‘চেনেন দেখছি। চেনবারই কথা, সে আপনার জামাই ছিল। —সুকান্ত সোম সিনেমা করে খুব নাম করেছিল। আপনি তখন বর্ধমানে প্র্যাকটিস করতেন। বিধবা মানুষ, সংসারে কেবল একটি মেয়ে। বর্ধমানে সুকাস্তের যাওয়া-আসা ছিল। সে একদিন আপনার মেয়েটিকে ভুলিয়ে নিয়ে ইলোপ করল। সুকান্ত আপনার মেয়েকে লোভ দেখিয়েছিল তাকে সিনেমার হিরোইন করবে। আপনি সুকান্তকে পছন্দ করতেন না, তাই ইলোপমেন্ট।
‘একসঙ্গে কিছু দিন বাস করবার পর দু’জনের প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ল; দু’জনেরই মিলিটারি মেজাজ। ঝগড়া আরম্ভ হলো। ঝগড়ার প্রধান কারণ, সুকান্ত আপনার মেয়েকে হিরোইন বানাতে পারেনি। একদিন ঝগড়া চরমে উঠল, আপনার মেয়ে ছুরি দিয়ে সুকান্তর মুখ কেটে ফালা-ফালা করে দিল। সুকান্ত নিজের প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে আপনার মেয়েকে গলা টিপে খুন করল।
‘খুনের আসামী সুকান্ত তিন মাস পুলিসের হাসপাতালে রইল। সেখান থেকে তাকে যখন বিচারের জন্যে আদালতে হাজির করা হলো তখন তার বীভৎস মুখ দেখে জজ সাহেব পর্যন্ত চমকে গেলেন। জেলের হাসপাতালে প্লাস্টিক সাজারির ব্যবস্থা নেই; সুকান্তর মুখের ঘা শুকিয়েছে বটে, কিন্তু সিনেমার হিরোর পার্ট করার মত মুখ আর নেই।
‘বিচার হলো। আপনি সুকান্তর বিরুদ্ধে সাক্ষী ছিলেন, মিসেস রায়। কিন্তু তাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারলেন না। তার হাতে অস্ত্র ছিল না, আপনার মেয়ের হাতে অস্ত্র ছিল; আত্মরক্ষার অজুহাতে সুকান্ত ছাড়া পেয়ে গেল।’—
মিসেস শোভনা রায় আগুন-ভরা চোখে বললেন, ‘মিছে কথা। ও আগে আমার মেয়েকে গলা টিপে মেরেছিল, তারপর নিজে নিজের মুখ ছুরি দিয়ে কেটেছিল।’,
ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে বলল, ‘কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুকান্ত সিনেমা আর্টিস্ট, সে কখনো নিজের মুখে ছুরি মেরে নিজের আখের নষ্ট করত না; নিজের গায়ে ছুরি মারত। যাহোক, সুকান্ত খুনের দায় থেকে রেহাই পেল বটে, কিন্তু তার সিনেমা-জীবন শেষ হয়ে গেল। সৎপথে থেকে অন্য কোনো উপায়ে জীবিকা অর্জনের রাস্তা সে জানত না, সে কলকাতা থেকে পালিয়ে গিয়ে পাটনায় বাসা বাঁধিল এবং ব্ল্যাকমেলের ব্যবসা শুরু করল। গত দশ বছরে কলকাতায় কটকে কাশীতে দিল্লীতে তার অনেক খদ্দের জুটেছে। কারুর ওপর সে অযথা উৎপীড়ন করে না, ছ’ মাস অন্তর এসে বাঁধা-বরাদ্দ আদায় তসিল করে। এই তার জীবিকা।
‘সুকান্ত যখন আদায় তসিলের জন্যে কলকাতায় আসত তখন এই নিরুপমা হোটেলেই থাকত। আপনি ইতিমধ্যে বর্ধমানের বাস তুলে দিয়ে বহরমপুরে গিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন, আপনিও মাঝে-মধ্যে এসে এই হোটেলে থাকেন। কিন্তু ঠিক একই সময়ে দু’জনের আসা আগে ঘটেনি, আপনি সুকান্তকে এখানে দেখেননি।
‘দৈবক্রমে এবার আপনি তাকে দেখতে পেলেন, সে আপনার পাশের ঘরেই উঠেছে। সে বোধ হয় আপনাকে দেখতে পায়নি। পেলে সাবধান হতো। আপনি তাকে পেলে খুন করবেন। এই ধরনের একটা ইচ্ছে আপনার মনে ছিল, কিন্তু দশ বছর সে-আগুন ছাই-চাপা পড়েছিল। এখন সুকান্তকে হাতের কাছে পেয়ে ছাই-চাপা আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল। আপনার মেয়েকে যে খুন করেছে তাকে আপনি বেঁচে থাকতে দেবেন না। আপনার মেয়ে বোধ হয় আপনার কাছ থেকেই তার উগ্র হিংস্র প্রকৃতি পেয়েছিল।
‘সে-রাত্রে ডিনার খেয়ে এসে আপনি নিজের ঘরে অপেক্ষা করে রইলেন। কিভাবে তাকে খুন করবেন তার প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছেন; এখন শুধু শুভমুহূর্তের অপেক্ষা।
‘সওয়া নটা থেকে সুকান্তর ঘরে লোক আসতে শুরু করল। আপনি নিজের ঘরে ওত পেতে আছেন। দশটার সময় লোক আসা বন্ধ হলো। আপনি অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরুলেন। দোতলার অন্য অতিথিরা দোর বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে, যে-চাকরটা সিঁড়ির সামনে শোয় সে এখনো আসেনি। এই সুযোগ।
‘আপনি দু’ নম্বর দোরে টোকা দিলেন। সুকান্ত তখন শুয়ে পড়েছিল, সে উঠে দোর খুলল; আপনি সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে অস্ত্রটা ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর দোর টেনে বন্ধ করে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। আপনার সঙ্গে যে রাজকুমার বোসের সম্বন্ধ আছে তা কেউ জানে না, আপনাকে কে সন্দেহ করতে পারে! বরং রাত্রে যারা রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, সন্দেহ পড়বে তাদের ওপর।
‘আপনি একটি ছোট্ট ভুল করেছিলেন। ইন্সপেক্টর যখন আপনাকে জেরা করেন তখন আপনি বলেছিলেন, রাজকুমারকে আপনি আগে কখনো দেখেননি; তার পরেই বললেন, ও মুখ দেখলে মনে থাকত। রাজকুমারের মুখ যে মনে রাখার মত তা আপনি জানলেন কি করে? ঘরের দিকে
রাজকুমারের মুখ আপনি দেখতে পাননি। এই বেফাঁস কথাটা যদি আপনি না বলতেন তাহলে দশ বছরের পুরনো খবরের কাগজের ফাইল দেখার কথা আমার মনে আসত না।’
এই পর্যন্ত বলে ব্যোমকেশ চুপ করল। মিসেস রায় কামারের হাপরের গানগনে আগুনের মত জুলতে লাগলেন। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘সব মিছে কথা। সুকান্ত আমার মেয়েকে খুন করেছিল, কিন্তু আমি তাকে খুন করিনি। কি দিয়ে খুন করব? আমার কাছে কি ছোরা-জুরি আছে?’
ব্যোমকেশ তাঁর ডাক্তারি ব্যাগের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘আছে। ওই ব্যাগের মধ্যে আছে।’
মিসেস রায়ের চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেল।
‘না, নেই। এই দেখুন—’
ব্যাগ খুলে ক্ষিপ্র হস্তে তার ভিতর থেকে তিনি একটি কাঁচি বার করলেন। লম্বা লিকলিকে সার্জিকাল কাঁচি, তার দুটো ফলা আলাদা করা যায়। মিসেস রায় কাঁচির একটা ফলা খুলে নিয়ে নিজের বুকে বসিয়ে দিতে গেলেন। কিন্তু রাখালবাবু প্রস্তুত ছিলেন, তিনি বিদ্যুৎবেগে মিসেস রায়ের মণিবন্ধ চেপে ধরলেন। মিসেস রায় উন্মত্ত কণ্ঠে চীৎকার করে উঠলেন, ‘ছেড়ে দাও–ছেড়ে দাও
ব্যোমকেশ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাক, অস্ত্রটাও পাওয়া গেছে। ওটা না পেলে মুশকিল। হতো।’