লাল রঙের বেনারসি
একটা সুন্দর লাল রঙের বেনারসি পরানো হয়েছে দেবলীনাকে। সে ঘুমিয়ে আছে একটা ধপধপে সাদা চাদরের ওপর। একটা মস্ত বড় ধুনুচি থেকে কুণ্ডল পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। তার সামনেই সেই মুণ্ডুসমেত বাঘছালটার ওপর চোখ বুজে বসে আছেন গুরুদেব।
পাহাড়ের গায়ে এই আশ্রম-ঘর। ছোট্ট একটা গুহার সামনে খড়ের ছাউনি। তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ঝরনা। সেই ঝরনা থেকে। কমণ্ডলুতে জল ভরে নিয়ে মনোজ এসে ঢুকল আশ্রমের মধ্যে।
তার পায়ের শব্দ শুনে গুরুদেব চোখ মেলে তাকিয়ে বললেন, এবার সময় হয়েছে।
ঝরনার জল দেবলীনার চোখেমুখে ছিটিয়ে দিয়ে তিনি কোমল স্বরে বললেন, চম্পা জাগো, চম্পা জাগো!
চম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তিনি বারবার ওই কথা বলতে লাগলেন। আস্তে চোখ মেলে দেবলীনা বলল, আমার চোখ জ্বালা করছে।
গুরুদেব বললেন, মনোজ, ধুনুচিটা বাইরে নিয়ে যাও!
তারপর তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ, চম্পা?
দেবলীনা বলল, আমি ভাল আছি গুরুদেব। আমার আর কোনও কষ্ট নেই। আমি এখন বাড়ি যাব।
গুরুদেব বললেন, হ্যাঁ, তুমি তোমার বাবার কাছে যাবে। উঠে বোসো, মনোজ তোমায় সঙ্গে নিয়ে যাবে। তোমার বাবার নাম কী, মনে আছে তো?
দেবলীনা ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ, মনে আছে। আমার বাবার নাম রণদুর্মদ ভঞ্জদেও।
গুরুদেব মনোজের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর আবার দেবলীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, মাকে মনে পড়ে তোমার? কী ছিল মায়ের নাম?
রানী হর্ষময়ী। আমার একটা ছোট্ট ভাই ছিল, তার নাম রণদুর্জয়, সে বাচ্চা বয়েসে স্বর্গে চলে গেছে। আমার মা-ও সেখানে চলে গেছে।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, তোমার ছোট ভাই তোমার মায়ের কাছে আছে। কিন্তু তোমার বাবা তোমার প্রতীক্ষায় বসে আছেন। তোমাকে দেখলে তিনি কী খুশিই হবেন! চম্পা, বলো তো তোেমার কী হয়েছিল?
চোরেরা আমাকে চুরি করে নিয়ে মেরে ফেলেছিল। আপনি মন্ত্র দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আপনি আমাকে এতদিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন।
বেঁচে উঠে তোমার ভাল লাগছে?
হ্যাঁ, খুব ভাল লাগছে, গুরুদেব। আমি এখন স্বর্গে মায়ের কাছে যেতে চাই। আমি এখন বাবার কাছে যাব।
হ্যাঁ, তা-ই যাবে। তুমি তোমাদের কটকের বাড়িটা চিনতে পারবে? মনে আছে সে বাড়ির কথা?
হ্যাঁ, সব মনে আছে। আমাদের বাগানে একটা পাথরের মূর্তির মুখ দিয়ে জল পড়ে। একটা ছোট চৌবাচ্চায় লাল-নীল মাছ আছে। দোতলার সিঁড়ির সামনে মস্ত বড় ঘড়ি। আমার বাবার ঘরে একটা রাধাকৃষ্ণের ছবি। সেই ছবির পেছনে লোহার সিন্দুক।
বাঃ, বাঃ, সব মনে আছে দেখছি! তোমার বাবাকে তুমি যে-গানটা শোনাতে, সেই গানটা একটু গাও তো।
দেবলীনা চোখ বুজে একটু মনে করার চেষ্টা করে গান ধরল :
প্রভু মেরে অবগুণ চিক ন ধরো
সমদরশী হৈ নাম তিহারো,
চাহে তো পার করো।।…
গুরুদেবের চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল। তিনি গদগদ কণ্ঠে বললেন, ধন্য, ধন্য! আজ আমার সাধনা ধন্য! সেই পনেরো বছর আগে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, চম্পাকে আমার সিদ্ধি দিয়ে, আমার আয়ু দিয়ে বাঁচিয়ে তুলব, তা যে এমনভাবে সার্থক হবে ভাবিনি! করুণাময়ের কী বিচিত্র লীলা! রাজা রণদুর্মদ তার মেয়েকে আবার ফিরে পাবে। এই চম্পা আর হারিয়ে যাবে না। মনোজ, তুই ঠিকমতন একে এর বাবার কাছে পৌঁছে দিবি!
মনোজ হাত জোড় করে বলল, নিশ্চয়ই গুরুদেব, আমি অতি সাবধানে নিয়ে যাব।
তুই ব্যাটা অর্থলোভী, তা আমি জানি। চম্পার বাবা তোকে বখশিস দেবেন, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবি, আর বেশি কিছু লোভ করবি না! মনে রাখিস, আমাকে ঠকাবার চেষ্টা করলে তুই সারা পৃথিবীর কোথাও লুকোবার চেষ্টা করে নিষ্কৃতি পাবি না। আমি তোকে ঠিক টেনে নিয়ে আসব এখানে।
মনোজ জিভ কেটে বলল, সে কী কথা গুরুদেব! আমি কখনও আপনার কথার অবাধ্য হতে পারি? বুড়ো মেজোবাবু একলা থাকেন, আমি মনপ্রাণ দিয়ে ওঁদের সেবা করব।
রাজকুমারী চম্পা রাজেন্দ্রাণী হবে একদিন। এই আমি বলে গেলাম। সব সময় খেয়াল রাখবি, ওর যেন অযত্ন না হয়। পুলিশ দেখে ভয় পাবি না। হাজারটা পুলিশও প্রমাণ করতে পারবে না যে, ও চম্পা নয়। মা চম্পা, তোমাকে যদি কেউ কখনও তোমার বাবাকে ছেড়ে যেতে বলে, তুমি কি চলে যাবে?
দেবলীনা বলল, না, কোনওদিন যাব না।
তুমি দেবলীনা নামে কারুকে চেনো?
কে দেবলীনা?
সে একটা মেয়ে, হারিয়ে গেছে। তুমি কলকাতা শহর দেখেছ কোনওদিন?
সেই পাঁচ বছর বয়েসে একবার বাবা-মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। গড়ের মাঠ, মনুমেন্ট, তার কাছে একটা হোটেল…
আর-একবার যাওনি?
আর একবার হাওড়া স্টেশনে নেমে দার্জিলিংয়ের ট্রেনে উঠেছি।
ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ! মা চম্পা, তোমার বাবার পিঠে কী দাগ আছে?
পিঠে নয়, কাঁধে। চিতাবাঘে থাবা মেরেছিল।
শুনলি মনোজ, শুনলি? চম্পা কিছুই ভোলেনি। সোনার মেয়ে চম্পা, ওকে ছেড়ে দিতে আমারও কষ্ট হচ্ছে। আমি মাঝে-মাঝে গিয়ে ওকে দেখে আসব। এবারে চম্পাকে আমি সাজিয়ে দিই।
গুরুদেব উঠে গিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকে একটা কুলুঙ্গি থেকে একটা ছোট পুঁটুলি নিয়ে এলেন। সেটার গিট খুলতে খুলতে বললেন, চম্পার দেহটা যখন আমি সুড়ঙ্গের মধ্যে নিয়ে আসি, তখন চম্পার গায়ে এই গয়নাগুলো ছিল। ওকে যারা মেরেছিল, তারা গয়নার জন্য মারেনি। এইগুলো আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম। আমি সন্ন্যাসী মানুষ, আমার কাছ থেকে তো কেউ চুরি করতে আসবে না। আজ এইগুলো কাজে লেগে গেল।
গয়নাগুলো চম্পার হাতে দিয়ে তিনি বললেন, এগুলো পরে নাও তো মা! বাবার কাছে যাবে, একেবারে নিরাভরণ হয়ে যেতে নেই।
দু হাতের চার গাছা করে সোনার চুড়ি, দু কানের দুটি হীরের দুল, গলায় একটা মুক্তোর মালা, সব পরে নিল দেবলীনা। গুরুদেব মুগ্ধভাবে বললেন, কী রকম ঠিক-ঠিক লেগেছে এতদিন পরেও! এই তো আমাদের রাজকুমারী চম্পা?
মনোজ বলল, গুরুদেব, এবার ওকে নিয়ে যাই? রাত অনেক হল।
গুরুদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, যেতে তো হবেই। আমার বুকটা খালি-খালি লাগবে। তুই ওকে কী করে নিয়ে যাবি?
মনোজ বলল, পাহাড়ের নীচে জঙ্গলের মধ্যে একটা গাড়ি লুকিয়ে রেখে এসেছি। কেউ টের পাবে না।
গুরুদেব ধমক দিয়ে বললেন, কেউ টের পেলেই বা ক্ষতি কী! লুকোবার দরকার নেই। চম্পা আর কারুর কাছে যাবে না। আর কারুকে চিনবে না!
মনোজ বলল, ওঠো চম্পা, গুরুদেবকে প্রণাম করো।
গুরুদেব চম্পার মাথায় হাত রেখে বললেন, রাজরাজেশ্বরী হও, মা। সুখী হও। সবাইকে সুখী করো।
মনোজও গুরুদেবকে প্রণাম করল। তারপর বলল, চম্পা, এসো। চম্পা দু এক পা এগিয়ে, আবার গুরুদেবের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, যাই গুরুদেব…
মনোজ আর গুরুদেব দুজনেই ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে বললেন, কী হল? কী হল?
চম্পা অজ্ঞান হয়ে গেছে। গুরুদেব ফ্যাকাসেভাবে হেসে বললেন, বেটির এখান থেকে চলে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু, রাজার মেয়ে, সে কি এই আশ্রমে থাকতে পারবে? যেতে তো ওকে হবেই।
তিনি আবার চম্পার মুখেচোখে জল ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে লাগলেন, চম্পা, জাগো…চম্পা, জাগো..
আবার চম্পা বড় বড় চোখ মেলে তাকাল। খুব যেন অবাক হয়ে সে দেখল গুরুদেব আর মনোজকে।
গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, চম্পা? শরীর খারাপ লাগছে? আজ সারাদিন খাওয়াও তো হয়নি কিছু। এসময় যে কিছু খেতে নেই।
চম্পা উঠে বসে বলল, এখন ঠিক আছি। কিছু হয়নি।
শরীর দুর্বল লাগছে না?
না। আমি এখন যেতে পারব।
কোথায় যাবে মনে আছে?
হ্যাঁ, কটকে আমার বাবা রাজা রণদুর্মদ ভঞ্জদের কাছে।
মনোজ, শহরে নিয়ে গিয়েই আগে ওকে কিছু খেতে দিবি। এসো মা চম্পা।
চম্পা বলল, গুরুদেব, আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে তো?
গুরুদেব বললেন, হ্যাঁ, হবে। নিশ্চয়ই হবে। আমি যাব তোমার বাড়িতে।
চম্পা আর মনোজ আশ্রমের বাইরে বেরিয়ে আসার পর গুরুদেব দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার কাছে। তাঁর হাই উঠল। হঠাৎ যেন শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তাঁর, ঘুম পাচ্ছে।
চম্পা আর মনোজ নামতে লাগল ঝরনাটার গা দিয়ে দিয়ে। চম্পা যাতে হোঁচট খেয়ে পড়ে না যায়, সেইজন্য তার হাত ধরতে যেতেই চম্পা কড়া গলায় বলল, না, আমার হাত ধরবে না। তুমি কর্মচারী, আমার হাত ধরছ কোন্ সাহসে?
মনোজ থতমত খেয়ে বলল, না, না, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ভাবছিলুম, তুমি যদি পড়ে যাও…।
চম্পা বলল, না, আমি ঠিক যেতে পারব।
একটু পরে মনোজ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল। গুরুদেবের সামনে সে সিগারেট খেতে পারেনি। সেও খুব ক্লান্ত। কাল রাত থেকে অনেক ধকল গেছে।
মনোজ সিগারেট ধরাতেই চম্পা ধমক দিয়ে বলল, তুমি আমার সামনে সিগারেট খাচ্ছ, তোমার এত সাহস?
মনোজ এবার রীতিমত হকচকিয়ে বলল, সিগারেট খাব না?
চম্পা বলল, রাজকুমারীর সামনে সিগারেট খাবার আস্পর্ধা হয়েছে তোমার? বাবাকে বলে দেব! সিগারেট ফেলে দাও, মনোজ!
মনোজ তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ঝরনার জলে ছুঁড়ে দিল। তারপর সে অনুনয় করে বলল, রাজকুমারী চম্পা, আমি একটা কথা বলব? নীচে যে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি, তার ড্রাইভার নতুন লোক। ভাড়া-গাড়ি। তুমি এত গয়নাগাঁটি পরে থাকলে সে-লোকটার যদি মাথায় বদ মতলব আসে? দিনকাল ভাল নয়। গয়নাগুলো খুলে আমার কাছে দাও!
চম্পা বলল, না!
শোনো রাজকুমারী, আমি তোমার ভালর জন্যই বলছি, এখন গয়নাগুলো খুলে রাখো।
না।
লক্ষ্মী মেয়ে, অবুঝ হয়ো না। গয়নাগুলো এখন দাও, তুমি বাড়িতে পৌঁছলেই তোমাকে আবার দিয়ে দেব। বাড়িতে তোমার আরও কত গয়না আছে!
আমি ওই ভাড়াকরা গাড়িতে যাব না!
তা হলে এখান থেকে কটক যাব কী করে? অনেক দূর।
আমি আমার বাবার গাড়িতে যাব। বাবার গাড়ি নিয়ে এসো। তোমার বাবার এখন কোনও গাড়ি নেই। রাজবাড়ির আর কোনও গাড়ি নেই। এই ভাড়া করা গাড়িতেই যেতে হবে।
তা হলে আমি যাব না। আমি গুরুদেবের কাছে ফিরে যাব!
মনোজ খপ করে চম্পার হাত চেপে ধরে বলল, ছেলেমানুষি কোরো না, চম্পা। যা বলছি তা-ই শোনো। ড্রাইভারটা নতুন, না হলে তোমাকে গয়নাগুলো খুলতে বলতুম না!
চম্পা খুব জোরে ঠাস করে মনোজের গালে একটা চড় কষাল। নিজের হাতটা টেনে নিয়ে বলল, তোর এত সাহস! বলেছি না, আমার গায়ে হাত দিবি না?
মনোজ নিজের গালে হাত বুলোত বুলোতে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল কয়েক পলক। চম্পা কিংবা দেবলীনা দুজনেই নরম স্বভাবের মেয়ে। এই মেয়ে যে তাকে এত জোরে চড় মারতে পারবে, সে কল্পনাই করতে পারেনি। কিন্তু চড় খেয়ে তার মাথায় রাগ চড়ে গেছে।
সে এবার গম্ভীর গলায় বলল, দ্যাখো, মেয়ে, আমার সঙ্গে বেশি চালাকি করো না? মনে রেখো, আমার জন্য তুমি রাজকুমারী হতে যাচ্ছ। এরপর মহা সুখে থাকবে।
চম্পার দু চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল, দাঁতে দাঁত ঘষে সে বলল, দ্যাখ মনোজ, আমি কে তুই জানিস? আমি পনেরো বছর আগে মরে গিয়ে ভূত হয়েছিলাম। এখন অন্য-একটা মেয়ের শরীরে ঢুকে পড়েছি। ফের যদি আমার গায়ে হাত দিস তুই, আমি তোর চোখ খুবলে নেব। তোের রক্ত চুষে খাব!
মনোজ চম্পার এই মূর্তি দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে দুএক পা পিছিয়ে গেল। তারপর সে একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে উঁচু করে বলল, কী, তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? আমি গুরুদেবের চ্যালা, আমি অত সহজে ভয় পাই না!
চম্পা এক পা এগিয়ে এসে বলল, তুই আমাকে মারবি? মার তো দেখি তোর কত সাহস! আমার গায়ে মারলেই তা গুরুদেবের গায়ে লাগবে, তুই জানিস! আয়, ওই পাথর ছুঁড়ে মার আমাকে। দ্যাখ, আমি ওই পাথরটা খেয়ে ফেলব!
মনোজ আস্তে পাথরটা ফেলে দিয়ে বলল, না চম্পা, আমি কি তোমাকে মারতে পারি? তুমি আমাদের রাজকন্যা, তোমাকে আমরা সবাই ভালবাসি…
চম্পা বলল, তুই আমাকে মারতে পারলি না তো, তবে দ্যাখ!
চম্পা চোখের নিমেষে নিজে দুহাতে দুটো পাথর তুলে নিল। সঙ্গে-সঙ্গেই সে দুটি ছুঁড়ে মারল মনোজের দিকে। মনোজ দুহাতে মুখ ঢেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করল। চম্পার একটা পাথর লাগল তার পিঠে, বড় পাথরটাই লাগল তার মাথার খুলিতে।
খুব জোরে আঘাত পেয়ে মনোজ বসে পড়ল মাটিতে। চম্পা সঙ্গে-সঙ্গে ছুট দিল বনের মধ্যে।
মিনিট-খানেক ঝিম মেরে বসে রইল মনোজ। তারপরেই তার খেয়াল হল যে, চম্পা পালিয়ে যাচ্ছে, চম্পা হাতছাড়া হয়ে যাবে। যন্ত্রণা সহ্য করেও সে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে লাগল চম্পার পেছনে-পেছনে।
জঙ্গলের মধ্যে চম্পার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, সেই শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল মনোজ। এক-একবার সে দেখতেও পাচ্ছে। পাহাড় দিয়ে তরতর করে। নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে চম্পা। মনোজ তার নাগাল পাচ্ছে না। কিন্তু সে ভাবল পাহাড় থেকে নীচে নামলেই সে চম্পাকে ধরে ফেলবে।
চম্পা এক সময় ঝরনার মধ্যে নেমে পড়ল। এ ঝরনায় মাত্র হাঁটু-জল, তবু চম্পা ওপারে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঝরনার মাঝখানে। মনোজ সেই ঝরনার ধারে পৌঁছতেই চম্পা তার দিকে হাতছানি দিয়ে বলল, আয় মনোজ, আয়, তোকে খাব!
মনোজ হাত জোড় করে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, রাগ করো না, চম্পা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি আর তোমার গায়ে হাত দেব না। তোমার গয়না খুলতে বলব না। তুমি আমার সঙ্গে চলো, তোমার বাবার কাছে পৌঁছে দেব!
চম্পা বলল, না, আমি তোর সঙ্গে যাব না। আমি বাবার কাছে একলাই যেতে পারব!
এবারে সে ঝরনাটা পার হয়ে আবার ছুটল।
পাহাড় ফুরিয়ে গেলে সমতলেও বেশ খানিকটা জঙ্গল আছে। চম্পা আর। মনোজ দুজনেই নেমে এসেছে সেখানে। মনোজ এবার প্রাণপণে ছুটে কমিয়ে আনল দূরত্ব। এক সময় সে ধরে ফেলল চম্পার শাড়ির আঁচল। চম্পা সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে গিয়ে হাতের দুটো আঙুল বসিয়ে দিল মনোজের চোখে।
তারপর সে হাহা করে হেসে উঠে বলল, তোকে অন্ধ করে দেব।
সঙ্গে-সঙ্গে জঙ্গলের রাস্তার বাঁক ঘুরে বেরিয়ে এল এক জিপগাড়ি। তার হেডলাইটের আলো পড়ল ওদের ওপর। মনোজ একবার মুখ তুলে দেখল জিপগাড়িটা। এটা তার গাড়ি নয়। বুঝতে পেরেই সে চম্পাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড় লাগাল পাশের জঙ্গলের মধ্যে।
জিপগাড়িটার সামনের সিটে, ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন কাকাবাবু আর দারুকেশ্বর। পেছনে সন্তু আর জোজো।
দারুকেশ্বর বলল, ওই তো চম্পা! ওই তো চম্পা!
কাকাবাবু বললেন, ওই তো দেবলীনা!
সন্তু আর জোজো গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে গেল চম্পার দিকে। সন্তু কখনও দেবলীনাকে শাড়ি-পরা অবস্থায় দ্যাখেনি, তাই প্রথমটা সে চিনতে পারেনি। একেবারে কাছে এসে মুখখানা দেখে সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, কাকাবাবু, এই তো দেবলীনা!
চম্পা সন্তুর বুকে একটা জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল, এই, তুই কে রে? রাজকুমারীর সামনে জোরে কথা বলছিস! সরে যা!
জোজো দেবলীনাকে দ্যাখেইনি, সে বলল, এই, তোমার সঙ্গে যে লোকটা ছিল, সে গেল কোথায়? সে তোমার বন্ধু না শত্রু?
চম্পা বলল, চুপ! কোনও কথা বললে চোখ গেলে দেব! ওই গাড়িটার আলো নেভাতে বল?
জিপটা থেমে গেছে। কাকাবাবু আর দারুকেশ্বরও নেমে এগিয়ে এলেন। এখন দারুকেশ্বরের হাতে টর্চ, সে আড়ষ্ট গলায় বলল, যা ভয় করেছিলুম, তা-ই হয়ে গেছে। সন্ন্যাসী গুরুদেব আপনাদের দেবলীনা দিদিমণির শরীরের মধ্যে চম্পার আত্মাকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
কাকাবাবু সেকথা গ্রাহ্য করলেন না। এগিয়ে এসে খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, কী রে, দেবলীনা? তোর কোনও ক্ষতি হয়নি তো?
চম্পা বলল, তোমাদের এত সাহস, গাড়ি দিয়ে আমার রাস্তা আটকেছ! সরে যাও, সবাই সরে যাও, আমি এখন কটকে যাব।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, এই-ই তো দেবলীনা। ও এরকমভাবে কথা বলছে। কেন?
দেবলীনা সন্তুর দিকে ফিরে প্রচণ্ড জোরে ধমক দিয়ে বলল, চুপ! কথা বলতে বারণ করেছি না? এবার তোর গলা আটকে যাবে!
কাকাবাবু হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? চম্পা না দেবলীনা?
চম্পা বলল, আমি রাজকুমারী চম্পা। রাজা রণদুর্মদ ভঞ্জদেওর মেয়ে। তোমরা এলেবেলে লোক, আমার রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
সন্তু বলল, এই, তুই কাকাবাবুর সঙ্গে ওরকমভাবে কথা বলছিস যে?
দেবলীনা এবার দুটো হাতের আঙুলগুলো ছড়িয়ে বলল, চোখ গেলে দেব, চোখ গেলে দেব।
কাকাবাবু সন্তুকে থামতে ইঙ্গিত করে আবার চম্পাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যদি চম্পা হও, তা হলে দেবলীনা কোথায় গেল? আমরা দেবলীনাকে খুঁজতে এসেছি।
চম্পা এবার হা-হা-হা-হা করে হেসে উঠল। হাসির দমকে দুলতে লাগল তার শরীর।