Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 7

রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay

রাত সাড়ে এগারোটার সময় কাকাবাবু বললেন, তা হলে দেবলীনা, এবারে সেই এক্সপেরিমেন্টটা করা যাক?

দেবলীনা ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ!

খাওয়া-দাওয়ার পর অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে ছিল ওরা দুজন। আজ ঝড়বৃষ্টি নেই, আকাশ পরিষ্কার। সন্ধে থেকে কিছুই ঘটেনি। আজ আর কোনও ঘর থেকে কোনও রহস্যময় ব্যক্তি বেরিয়ে এল না, কোনও বিকট শব্দ কিংবা অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া গেল না, কোনও ঘটনাই ঘটল না। সব চুপচাপ।

ওরা দুজনে বই পড়লেন অনেকক্ষণ ধরে, কাকাবাবু মাঝে-মাঝেই চোখ তুলে দেখছিলেন দক্ষিণের কোণের ঘরটার দিকে। এর মধ্যে শশাবাবু এসে খাবারদাবার দিয়ে গেছে, তারপর এঁটো বাসনপত্র নিয়ে যাবার সময় বলেছে, এবার আমি ঘুমোতে চললাম, আর কিছু দরকার নেই তো? কাকাবাবু তাকে কফির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, সে কফিও দিয়ে গেল। এখন নীচে আর কোনও জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই।

অন্য একটা ঘর থেকে আজ একটা মস্ত বড় ইজিচেয়ার বার করা হয়েছে। সেটা এতই পেল্লায় যে, দেখলে ঠাকুর্দা-চেয়ার বলতে ইচ্ছে করে। বসবার জায়গাটা খানিকটা ছিঁড়ে গেছে বটে, কিন্তু তার ওপরে একটা তোয়ালে চাপা দিয়ে কাজ চালানো যায়।

কাকাবাবু নিজে সেই চেয়ারটায় বসে ছিলেন এতক্ষণ, এবারে দেবলীনাকে সেখানে বসালেন। পেট্রোম্যাক্সটা খুব কমিয়ে রেখে দিলেন সেই চেয়ারের পেছন দিকে। সামনের বারান্দাটা আবছা অন্ধকার হয়ে গেল।

কাকাবাবু ঘরে গিয়ে একটা কালো রঙের ড্রেসিংগাউন পরে এলেন। হাতে একটা বড় টর্চ। দেবলীনার সামনে দাঁড়িয়ে সেই টর্চটা জ্বেলে আলো ফেললেন দেবলীনার চোখে। দেবলীনা চোখ পিটপিট করতে লাগল। কাকাবাবু বললেন,একটুক্ষণ জোর করে চেয়ে থাক। চোখ বন্ধ করিস না।

কাকাবাবু আস্তে-আস্তে টর্চটা এগিয়ে আনতে লাগলেন দেবলীনার মুখের কাছে। তাঁর ডান হাতের তর্জনীটা রইল টর্চের গায়ে লাগানো। একেবারে কপালের কাছে টর্চটা এসে পড়লে দেবলীনা বলল, আমি আর তাকাতে পারছি না, কাকাবাবু!

কাকাবাবু তাঁর তর্জনী দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন দেবলীনার দুই ভুরুর ঠিক মাঝখানের জায়গাটা!

দেবলীনা বলল, কাকাবাবু, আমার কপালের ভেতরটা ঝনঝন করে উঠল। এটা কি ম্যাজিক?

কাকাবাবু কোনও কথা না বলে টর্চটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার ঠিক একইভাবে তর্জনী এগিয়ে আনলেন, আবার ছুঁয়ে দিলেন কপালের সেই একই যায়গা।

পাঁচবার এরকম করার পর দেবলীনা আর চোখ মেলতে পারল না।

কাকাবাবু এবারে খুব টেনে-টেনে সুর করে বলতে লাগলেন, ঘুম-ঘুম-ঘুম-ঘুম-ঘুম-ঘুম…।

দেবলীনার চোখের পাতা দুটি বন্ধ, কিন্তু কাঁপছে, যেন সে চেষ্টা করেও খুলতে পারছে না চোখ। তার মুখে একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব।

কাকাবাবু তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?

আমি দেবলীনা দত্ত। আমার বাবার নাম শৈবালকুমার দত্ত, আমরা প্রিন্স আনোয়ার শা রোডে থাকি…

তোমার কি কিছু কষ্ট হচ্ছে, দেবলীনা?

না। একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আমার ভাল লাগছে।

তুমি এখন কোথায়?

আমি কেওনঝড়ে বেড়াতে এসেছি।

তুমি তোমার বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছ, তাই না? সঙ্গে তোমার বান্ধবী শর্মিলা রয়েছে?

হ্যাঁ। বাবার সঙ্গে, শর্মিলা…

তোমরা জঙ্গলে বেড়াতে গেলে, কার সঙ্গে গেলে?

মনোজবাবুর সঙ্গে। জঙ্গলে কত পাখি, টিয়া, বুলবুলি, ঘুঘু…

রাত্তিরবেলা তুমি হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলে, একা-একা ঘর থেকে বেরিয়ে এলে।

না তো, একা-একা বেরিয়ে আসিনি, একজন আমায় ডাকল।

কে তোমায় ডাকল, দেবলীনা?

একজন বুড়ো লোক, তার সাদা চুল, সাদা দাড়ি, সন্ন্যাসীর মতন দেখতে। সে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। সে বলল, চম্পা, এসো, এসো। এসো…

কিন্তু তুমি তো দেবলীনা, তুমি তো চম্পা নও!

হ্যাঁ, আমি দেবলীনা, দেবলীনা। আমি চম্পা নই!

তবে সে তোমায় চম্পা বলল কেন?

সে বলল, চম্পা, এসো, এসো, এসো..

তুমি তার সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে? সে তোমাকে কোথায় নিয়ে গেল?

সে চলে গেল। তারপর আমি…তারপর আমি…তারপর আমি..

হঠাৎ চোখ খুলে ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসল দেবলীনা। কপালের ওপর থেকে কাকাবাবুর হাতখানা এক ঝটকায় সরিয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হল, দেবলীনা, ঘুম ভেঙে গেল?

দেবলীনা কটমট করে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কে? কেন এখানে এসেছ? আমি রাজকন্যা চম্পা, আমাকে বিরক্ত কোরো না..

কাকাবাবু আর কিছু বলবার আগেই দেবলীনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসছি.আমি আসছি.

তারপর কাকাবাবুকে সে এক ঠেলা দিল। তার গায়ে এখন এত জোর যে, কাকাবাবু তার হাতটা ধরবার চেষ্টা করেও পারলেন না। তিনি বারান্দার রেলিং ধরে ব্যালান্স সামলালেন।

দেবলীনা দৌড়ে বারান্দার খানিকটা পেরিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

কাকাবাবু বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর এক্সপেরিমেন্টের যে এরকম ফল হবে, তা তিনি কল্পনাই করতে পারেননি। আগে তিনি যে কয়েকজনের ওপর হিপনোটিজম্ পরীক্ষা করেছেন, কখনও তো এমন কিছু ঘটেনি।

এই সময় তিনি সন্তুর অভাবটা খুব অনুভব করলেন। দেবলীনা দৌড়ে চলে গেল। তাঁর দৌড়বার ক্ষমতা নেই। ক্রাচ বগলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই দেবলীনা অনেক দূর চলে যাবে। সন্তু থাকলে ছুটে গিয়ে দেবলীনাকে আটকাতে পারত। সন্তুকে সঙ্গে না নিয়ে আসাটা খুব ভুল হয়েছে।

দেবলীনার যদি এখন কোনও বিপদ হয়, তা হলে তিনিই দায়ী হবেন।

তক্ষুনি দেবলীনাকে অনুসরণ করার চেষ্টা না করে তিনি বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে দেখতে লাগলেন।

দেবলীনা সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচের বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে নেমে পড়েছে। কাকাবাবু ব্যাকুলভাবে ডাকলেন, দেবলীনা! দেবলীনা!

দেবলীনা শুনতে পেল না, কিংবা শুনেও গ্রাহ্য করল না। উঠোন দিয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে সে বড় গেটটার তলায় ছোট গেটটা খুলে ফেলল। তারপর বাইরে বেরিয়ে গেল।

দুর্যোধন বা শশাবাবুকে ডেকে কোনও লাভ নেই। ওরা জাগবে না। জোর করে জাগালেও ওদের কাছ থেকে বিশেষ সাহায্য পাওয়া যাবে না। রিভলভারটা পকেটে নিয়ে, টর্চ জ্বেলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন সাবধানে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তিনি যদি সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যান, তা হলে কোনওই কাজ হবে না। একটা পা খোঁড়া বলেই তিনি অন্য পা-টা সম্পর্কে এখন বেশি সাবধান। তিনি ভাবতে লাগলেন, দেবলীনাকে নিয়ে এরকম পরীক্ষা করার ঝুঁকি নেওয়াটা তাঁর ঠিক হয়নি। দেবলীনা কেন বলল, আমি চম্পা! আগেই কেউ এই কথাটা ওর মনে গেঁথে দিয়েছে!

গেট পেরিয়ে বাইরে এসে কাকাবাবু এদিক-ওদিক তাকালেন। চতুর্দিকে একেবারে শুনশান। আজ শেয়ালরাও ডাকেনি। তবে চতুর্দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়, খানিকটা জ্যোৎস্না ফুটেছে আকাশে।

সামনের জঙ্গলের মধ্যে বালিমাটির টিলাটা তিনি দুপুরে এক সময় দেখে এসেছেন। দেবলীনা যদি সেখানে যায়, তা হলে খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না।

কাকাবাবু টর্চ জ্বেলে চারদিক দেখে নিলেন ভাল করে। মানুষজনের কোনও চিহ্ন নেই, তবু তাঁর মনে হল, দুএকজন বোধহয় লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে দেখছে আনাচ-কানাচ থেকে। কেন তাঁর এরকম মনে হচ্ছে? কেউ হঠাৎ পেছন থেকে তাঁকে আক্রমণ করবে?

এই চিন্তাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে এগোতে লাগলেন দৃঢ় পায়ে। দেবলীনার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন তিনি, দেবলীনার কোনও রকম বিপদ-আপদ হলে শৈবাল দত্তের কাছে তিনি মুখ দেখাবেন কী করে?

জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেই তিনি শুনতে পেলেন একটা গানের সুর। দেবলীনার গলা। দেবলীনা গান গাইছে। শৈবাল বলেছিলেন যে, দেবলীনাকে তিনি আগে কোনওদিন গান গাইতে শোনোননি। কাকাবাবুও শোনেননি।

সেই গানের আওয়াজ লক্ষ্য করে এগোতে লাগলেন কাকাবাবু। জঙ্গলের শুকনো পাতায় তাঁর ক্রাচ ফেলার শব্দ হচ্ছে। আরও একটা ওই রকম শব্দ যেন কানে আসছে। কেউ কি তাঁকে অনুসরণ করছে? এক-একবার থেমে তিনি অন্য শব্দটা বোঝার চেষ্টা করলেন। কিন্তু থামলে আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। তবে কি তাঁর মনের ভূল? টর্চের আলোতেও দেখা যাচ্ছে না কিছুই।

জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় বালিয়াড়িটা এক সময় তিনি দেখতে পেলেন। মস্ত বড় একটা উই-টিপির মতন। সেটা দেখেই তাঁর মনে হল, এক সময় কেউ বালি-পাথর ফেলে-ফেলে এটাকে বানিয়েছিল। হয়তো শিকার করার সময় ওর ওপর শিকারিরা বসত। এখন সেটার গায়ে অনেক আগাছা জন্মে গেছে।

টিলাটার চূড়ার প্রায় কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আছে দেবলীনা। মাথাটা ঝুঁকে গেছে সামনের দিকে। ঠিক যেন পুজো করার ভঙ্গি। সে যে গানটা গাইছে, তার কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। একটানা সুর, তার মধ্যে যেন মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে, ওমা, ওমা, মা গো মা…

শৈবাল দত্ত বলেছিলেন যে, ঠিক এই সময় ঝড় উঠেছিল, কিন্তু আজ ঝড় নেই। শৈবাল দত্ত আরও বলেছিলেন যে, তিনি দেবলীনার গায়ে হাত দিতে যেতেই সে ছুটে পালিয়েছিল। কাকাবাবু ভাবতে লাগলেন, কী করা যায়। আজও যদি দেবলীনা দৌড়ে পালায়, আর বাড়ি না-ফিরে চলে যায় আরও দূরে?

দেবলীনার নাম ধরে ডাকলে কি কোনও লাভ হবে? বরং তিনি ভাবলেন, দেখাই যাক না এর পর কী হয়। এখন দেবলীনার বিপদে পড়ার সম্ভাবনা নেই, তিনি পাহারা দিচ্ছেন। তাঁর বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল।

দেবলীনার গান শুনতে শুনতে একদৃষ্টিতে সে-দিকে তাকিয়ে ছিলেন কাকাবাবু, হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে তিনি চমকে উঠলেন।

টিলাটার গা ছুঁড়ে যেন উঠে এল একজন মানুষ। জ্যোৎস্নায় দেখা গেল। তার মাথার চুল আর মুখের লম্বা দাড়ি ধপধপে সাদা। পরনে রক্তাম্বর। এক-পা এক-পা করে সে এগিয়ে আসতে লাগল কাকাবাবুর দিকে।

এই সেই কাল রাতে দেখা বৃদ্ধ সন্ন্যাসী! কাকাবাবু আজ আর স্তম্ভিত হয়ে গেলেন না। ভূত নয়, মানুষ! আজ এর সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে।

কাকাবাবু হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার। বৃদ্ধটি কাকাবাবুর একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাত বাড়ালেই তাঁকে ছোঁয়া যাবে। এমনকী তাঁর লাল রঙের চাদর উড়ে এসে লাগল কাকাবাবুর গায়ে।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে?

বৃদ্ধটি ডান হাত তুলে গম্ভীর গলায় বললেন, তুই যা! তোর এখানে থাকার দরকার নেই! তুই যা, তুই যা!

কাকাবাবু বিস্মিতভাবে বললেন, আমি চলে যাব? কেন? আপনি কে, আগে বলুন!

বৃদ্ধটি কাকাবাবুর মুখের সামনে হাতখানা দোলাতে-দোলাতে বলতে লাগলেন, তুই যা! তুই যা! তুই যা! চলে যা!

কাকাবাবুর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। এ কী! এই বৃদ্ধ তাকে হিপনোটাইজ করছে নাকি? এ যে খোদার ওপর খোদকারি! তিনি নিজে পয়সা খরচ করে অস্ট্রিয়া গিয়ে এই বিদ্যে শিখেছেন, আর তাঁর ওপরেই কোদানি দেখাতে এসেছে একটা গ্রাম্য বুড়ো?

কাকাবাবু হেসে বলতে গেলেন, আমার ওপর ওসব চালাকি চলবে না। আপনি কে, কী চান, আগে বলুন…

কিন্তু এই কথা বলতে বলতে কাকাবাবুর জিভ জড়িয়ে গেল, চোখ টেনে এল। মাথা ঘুরছে। তিনি নিজেকে ঠিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। তবু চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি পকেট থেকে রিভলভারটা বার করার কথা ভাবলেন, কিন্তু তাঁর হাত অবশ হয়ে গেছে। তিনি শুধু শুনতে পাচ্ছেন বৃদ্ধের গমগমে গলা, তুই যা–তুই যা…চলে যা..চলে যা!

সেই আওয়াজে যেন তাঁর কানে তালা লেগে গেল, তিনি সম্পূর্ণ চেতনা হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু মাটিতে পড়ে গেলেন না। বৃদ্ধ তাঁর কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে ৩৪০

দিতেই তিনি কাঠের পুতুলের মতন ঘুরে গেলেন উলটো দিকে। হাঁটতে আরম্ভ

রলেন অন্ধের মতন। তাঁর বগল থেকে ক্রাচ দুটো খসে পড়ে গেল। তবু তিনি হাঁটতে লাগলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

কয়েকটা গাছে ধাক্কা খেতে-খেতে এক সময় তিনি পড়ে গেলেন ঝপাস করে। তাঁর শরীর নিস্পন্দ হয়ে গেল।

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন হাত তুলে। এবারে তিনি পেছন ফিরে ডাকলেন,চম্পা, চম্পা!

দেবলীনা সঙ্গে-সঙ্গে গান থামিয়ে বলল, কী গুরুদেব? বৃদ্ধ আদেশ করলেন, এসো, আমার কাছে চলে এসো! চম্পা টিলার ওপর থেকে নেমে এসে বৃদ্ধের কাছে বসে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে এণাম করল।

জঙ্গল থেকে আর-একটি লোক এবার বেরিয়ে এসে দাঁড়াল বৃদ্ধের পাশে। বৃদ্ধ তাকে দেখে বললেন, মনোজ, চম্পাকে কোলে তুলে নাও। তারপর চলো…

সে লোকটি বলল, গুরুদেব, ওই খোঁড়া লোকটি কি জঙ্গলে পড়ে থাকবে?

ও এখন থাক। ওর কোনও ক্ষতি হবে না। পরে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসো। এখন চম্পাকে ভেতরে নিয়ে চলো…।

মনোজ নিচু হয়ে দেবলীনার হাত ধরতে যেতেই দেবলীনা ছটফট করে উঠে বলল, না, আমি চম্পা নই। আমি দেবলীনা! আমার কাকাবাবু কোথায়?

বৃদ্ধ বললেন, তোমার কাকাবাবু কেউ নেই। তুমি চম্পা, তুমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি এখন আমাদের সঙ্গে এক জায়গায় যাবে।

দেবলীনা চেঁচিয়ে উঠল, না, আমি দেবলীনা! আমি দেবলীনা!

চেঁচাতে চেঁচাতে সে এক ছুট লাগাল। নেমে গেল জঙ্গলের দিকে।

মনোজ বলল, গুরুদেব, ওর ঘোর কেটে গেছে। ও জেগে উঠেছে। এখন কী হবে?

বৃদ্ধ ধমক দিয়ে বললেন, মূখ, ওকে ধরো। আমার চোখের সামনে নিয়ে এসো। আমি ওকে আবার মন্ত্র দিয়ে দিচ্ছি। শিগগির যাও!

মনোজ ছুটল দেবলীনার পেছনে-পেছনে। তারপর চলল একটা লুকোচুরি খেলা। মনোজের বেশ বলিষ্ঠ চেহারা, তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ নয়। এক-একটা বড় বড় গাছ ঘুরে-ঘুরে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল দেবলীনা। কাকাবাবু কাছেই অচেতন হয়ে পড়ে আছেন, তিনি কিছু টেরও পেলেন না!

হঠাৎ দেবলীনা তরতর করে চড়তে লাগল একটা গাছে। মনোজ ছুটে এসে তার একটা পা চেপে ধরলেও দেবলীনা অন্য পা দিয়ে একটা জোর লাথি মারল। তার মাথায়। তারপর উঠে গেল গাছের ওপরে। একেবারে মগডালে গিয়ে বসল।

দেবলীনার পায়ের একটা আঙুল লেগে গেছে মনোজের বাঁ চোখে। সে চোখ চেপে ধরে যন্ত্রণায় কাতর গলায় বলল, গুরুদেব, মেয়েটা গাছে উঠে গেছে। এখন কী করব?

দূর থেকে গুরুদেব বললেন, ওকে গাছ থেকে নামিয়ে আনো!

মনোজ বলল, কী করে নামাব? আমি গাছে চড়তে গেলে ও আমায় লাথি মারবে! অতি দস্যি মেয়ে! কুড়ল এনে গাছটা কেটে ফেলব?

ওপর থেকে দেবলীনা বলল, ছিঃ মনোজবাবু! আগেরবার আপনি আমার সঙ্গে কত ভাল ব্যবহার করেছিলেন।

এবার গুরুদেব চলে এলেন গাছটার কাছে। মনোজকে ভৎসনা করে তিনি বললেন, ছিঃ, চম্পার সঙ্গে ওরকমভাবে কথা বলতে নেই। সোনার মেয়ে চম্পা, গাছ কেটে ফেললে ওর চোট লাগবে না! ও এমনিই নেমে আসবে।

ওপরের দিকে তাকিয়ে তিনি দুহাত তুলে মিষ্টি করে বললেন, এসো, চম্পা, নেমে এসো, এসো.

দেবলীনা বলল, আমি চম্পা নই। কে চম্পা? সে তো মরে গেছে। অনেকদিন আগে। আমি দেবলীনা!

গুরুদেব এক সুরে আবার বললেন, এসো, চম্পা, নেমে এসো, এসো, এসো, এসো, এসো..

দেবলীনা আবার বলল, আমি, আমি, আমি, আমি, হ্যাঁ, আমি চম্পা। গুরুদেব আমি আসছি..

তার চোখ বুজে এল, হাতের মুঠি আলগা হয়ে গেল। ওপরের ডাল ছেড়ে সে পড়ে গেল নীচের ডালে, তারপর মাটিতে পড়ে যাবার আগেই তাকে লুফে নিলেন গুরুদেব। অত বৃদ্ধ হলেও তাঁর শরীরে প্রচুর শক্তি।

তিনি স্নেহের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, চম্পা, তোমার লাগেনি তো?

দেবলীনা আচ্ছন্ন গলায় বলল, না, আমার একটুও লাগেনি!

গুরুদেব বললেন, ঘুমিয়ে পড়ো, চম্পা। ঘুমোও, চম্পা, ঘুমোও, ঘুমোও,

ঘুমোও…

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল দেবলীনা। গুরুদেব এবার তাকে দিয়ে দিলেন মনোজের হাতে। মনোজ তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে চলল।

হাঁটতে হাঁটতে মনোজ জিজ্ঞেস করল, গুরুদেব, মেয়েটা হঠাৎ জেগে উঠল কী করে? এই একটু আগে ও ঠিক চম্পার মতন সুরে গান গাইছিল। আমি ভাবলুম, ও সত্যি চম্পা হয়ে গেছে।

গুরুদেব বললেন, মানুষের মন যে কী বিচিত্র, তা বোঝা দায়! সব কিছু তো আমিও বুঝতে পারি না। এক-এক দিন ঘুম ভেঙে এই দুনিয়াটা সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয় না? নিজেরই ঘরে শুয়ে আছ, অথচ চোখ মেলে তুমি মনে করতে পারবে না তোমার ঘরের দরজাটা কোন্ দিকে। হয় না এরকম?

সে-সব দিনে মনটা অন্য কোনও জগতে ভ্রমণ করে আসে! বুঝলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, বুঝেছি!

ছাই বুঝেছ! এসব কথা বুঝলে আর সবসময় ছটফট করতে না। এই মেয়েটির মন বড় পবিত্র, কোনও দাগ পড়েনি। এরকম মেয়ের মনের জোর অনেক তাগড়া জোয়ানের চেয়েও বেশি। আরও একটা কথা শুনে রাখো, একই মানুষের মনের জোর সব দিন সমান থাকে না। কম-বেশি হয়। আমারই তো এরকম হয়। যেমন ধরো, গতকালই আমি তেমন জোর পাইনি।

হলে কালই আমার চম্পা-মাকে নিয়ে যাওয়ার বাসনা ছিল। কিন্তু কাল আমি ওর কাকাটিকে দেখে একটু যেন ভয় পেয়ে গেলাম!

আপনি ভয় পেলেন? বলেন কী?

সত্য কথা স্বীকার করতে লজ্জা কিসের? কাল ওর কাকাটির দিকে এক নজর চেয়েই আমার মনে হল, এই মানুষটিরও যথেষ্ট পরাক্রম আছে। আমাকে দেখে সে ভয় পায়নি। তাকে কি কাবু করতে পারব? ব্যস, একবার যে-ই ওরকম সন্দেহ হল, অমনি আমার শক্তি কমে গেল।

কিন্তু আজ তো ওর কাকা আপনার সামনে দাঁড়াতেই পারল না?

ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম, ও আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। সামান্য এক বৃদ্ধ ভেবেছে। ওর নিজের সম্পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে না।

আমি অবশ্য পেছন দিকে তৈরি ছিলাম। ও যদি তেড়িবেড়ি করত, আমি আঘাত করতুম ওর মাথায়।

ওহে মনোজ, আমি যখন সঠিক তেজে থাকি, তখন আমার চোখের সামনে পঞ্চাশ মুহূর্তের বেশি সজ্ঞানে থাকতে পারে, এমন মানুষ ভূ-ভারতে নেই। বৃথা কি এত বছর সাধনা করেছি?

কথা বলতে বলতে ওরা ঝোপের সামনে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধটি দুহাতে ঝোপটা ফাঁক করতেই দেখা গেল একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ। মনোজ আগে দেবলীনাকে নিয়ে ঢুকে গেল তার মধ্যে, পরে ঢুকলেন গুরুদেব।

গুহার মধ্যে কিন্তু একেবারে বিচ্ছিন্ন অন্ধকার নয়। দূরে একটা মশালের আলো দেখা যাচ্ছে। গুহাটি বেশি চওড়া নয়। দেবলীনার যাতে মাথায় গুঁতো

লাগে, সেজন্য অতি সাবধানে হাঁটতে লাগল মনোজ। পেছন থেকে গুরুদেব বলতে লাগলেন, আস্তে আস্তে…

যেখানে মশাল জ্বলছে, সেখানটা একটা ঘরের মতন। মশালটা একটা। দেওয়ালে গোঁজা। মেঝেতে পাতা একটা বাঘছালের আসন, সামনে পোঁতা একটা ত্রিশূল। অনেক শুকনো ফুল-পাতা সেখানে ছড়ানো। এক পাশে একটা বিছানা পাতা, সেখানে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে কে যেন শুয়ে আছে।

মনোজ দেবলীনাকে শুইয়ে দিল বিছানার পাশে।

বাঘছালটির সঙ্গে বাঘের মুণ্ডটি পর্যন্ত এখনও রয়েছে। বৃদ্ধটি এসে বসলেন সেই আসনে। একটা কমণ্ডলু থেকে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, আঃ!

তারপর কমণ্ডলুটা নামিয়ে রেখে দুটো হাত ওপরের দিকে তুলে আবেগের সঙ্গে বললেন, মা চম্পা, মা চম্পা, এবার তুই মুক্তি পাবি! এতদিনে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। মনোজ, সব উপকরণ জোগাড় করো!

মনোজ বলল, সবই নিয়ে আসব প্রভু। আপনি কাজ শুরু করুন।

মনোজ পাশের বিছানা থেকে চাদরটা তুলে নিতেই দেখা গেল, সেখানে শোওয়ানো রয়েছে একটি কঙ্কাল! তার গায়ে একটা নতুন লালপাড় শাড়ি জড়ানো!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress