দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – দুরভিসন্ধি
রায়মল্ল সাহেব কোথায় কি ভাবে আছেন, তাহা কেহ জানে না; কিন্তু তিনি যেখানে যান, যেন কেহ তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করে। এতদিন গোয়েন্দাগিরি কাজ করিয়াছেন, কিন্তু কেহ কখন তাঁহার অনুসরণে সাহসী হয় নাই। রায়মল্ল গোয়েন্দার দোর্দণ্ড প্রতাপ—অখণ্ডনীয় প্রভাব। তাঁহার নাম শুনিয়া দস্যু, তস্করগণ ভয়ে দূরে পলাইত। আজ কয়দিন ধরিয়া কে যেন তাঁহার পদানুসরণ করিতেছে। তিনি যেখানে যাইতেছেন, সেইখানেই যেন কেহ তাঁহার উপরে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেছে, পথে ঘাটে চলিতে গেলেও প্রায় কালমুস্কো জোয়ান দু-একটা সহসা তাঁহার পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতেছে। দুইজন দূরে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া যেন কি পরামর্শ করিতেছে। অলক্ষ্যে কে যেন সতত তাঁহার কার্য্যকলাপের দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি রাখিয়াছে। রায়মল্ল সাহেব এ দায়ে কখনও ঠেকেন নাই, তাই তাঁহার মনে হইল, এইবার জগৎসিংহ আর কিছু উপায় না দেখিতে পাইয়া, তাঁহাকে হত্যা করিয়া সকল দায় হইতে উত্তীর্ণ হইবার কল্পনা করিয়াছে। ভয় কাহাকে বলে, তাহা তিনি জানিতেন না। এ সকল দেখিয়া-শুনিয়াও তাঁহার বড় বিশেষ ভয় হইল না। কিন্তু তারার জন্য তিনি সতর্ক রহিলেন।
পত্র লিখিয়া তিনি বুঁদিগ্রাম হইতে অজয়সিংহকে আনাইয়া রাখিয়াছিলেন; সে-ই মঙ্গলও আসিয়াছিল। আর যে রাজপুত, তারাকে বৰ্দ্ধমানে বিসর্জ্জন দিয়া আসিয়াছিল, তাহাকেও তিনি অনেক অনুসন্ধানের পর বাহির করিয়াছিলেন।
এইরূপে কতিপয় দিবস অতিবাহিত হইলে পর একদিন রায়মল্ল সাহেব রজনীযোগে বহির্গত হইয়াছেন, এমন সময়ে তিনি সহসা দেখিলেন, তাঁহার দুই পার্শ্ব দিয়া দুইজন লোক তড়িদ্বেগে চলিয়া গেল। তিনি বুঝিলেন, ইহারা এখনও তাহার সঙ্গ ছাড়ে নাই। কি কারণে জানি না, সেদিন তাঁহার নিকটে অস্ত্র-শস্ত্রাদি কিছুই ছিল না। তিনি দেখিলেন, সেই দুইজন লোক কিয়দ্দূরে অগ্রসর হইয়া যেন পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিতেছে এবং তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া কি পরামর্শ আঁটিতেছে। যে গলি দিয়া তিনি যাইতেছিলেন, তাহা এক প্রকার নির্জ্জন স্থান বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অথচ যদি তিনি সেই স্থান হইতে পশ্চাৎপদ হন্, তাহা হইলে যে দুইজন লোক তাঁহার পিছু লইয়াছিল, তাহারা শিকার হাতছাড়া হইবার আশঙ্কায় দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে পারে। এই সকল কথা ভাবিতে ভাবিতে তিনি ফিরিয়া না আসিয়া ক্রমাগত অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সেই জনশূন্য গলিতে তিনি সেই অগ্রবর্ত্তী লোক এই দুইটি ব্যতীত আর কেহই নাই। তিনি বুঝিতে পারিলেন, আর কিছুদূর অগ্রগামী হইলেই তাহারা আক্রমণ করিবে। বহু চিন্তার পর তিনি একটি সরাপখানায় প্রবেশ করিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহার একজন অনুচর তথায় উপস্থিত ছিল। সে লোকটির ছদ্মবেশ দেখিয়া প্রথমে রায়মল্ল সাহেবের ভ্রান্তি হইয়াছিল। তিনি তাঁহাকে চিনিতে পারেন নাই; কিন্তু তিনি তথায় প্রবেশ করিবা মাত্রই সে উঠিয়া তাঁহার কাছে আসিল।
রায়মল্ল সাহেব নিম্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে কি দরকার, অজিৎ?”
অজিৎ। সেই আপনি যার পিছু নিতে বলেছিলেন, তার সঙ্গে সঙ্গেই আছি।
রায়মল্ল। এখানে আমাদের আর কেউ আছে?
অজিৎ। চার-পাঁচজন আছে।
রায়মল্ল। তোমার কাছে পিস্তল আছে?
অজিৎ। হাঁ।
রায়মল্ল। আমাকে দাও। তোমরা প্রস্তুত থেকো, এখনই একটা ভয়ানক কাজ করতে হ’বে; যে লোকটার উপর লক্ষ্য রাখতে বলেছি, সে-ও যাতে হাত-ছাড়া না হয়, তার উপায় করো—আমি আছি।
এই বলিয়া রায়মল্ল সাহেব পিস্তলটি লইয়া প্রস্থান করিলেন।
সরাপখানায় প্রয় দশ-বারোটি লোক মালামী করিতেছিল; কিন্তু তাহাদের মধ্যে যাহারা মদ না খাইয়া মাতালের ভান করিয়া মাতালগণের সঙ্গে সমান মালামী করিতেছিল, তাহারাই রায়মল্ল গোয়েন্দার অনুচর
রাস্তায় জনমানব নাই। সরাপখানায় যে কয়জন লোক ছিল, তাহাদিগকে দেখিলে ভাল লোক বলিয়া বোধ হয় না—পল্লীটাও ভাল নয়। ভদ্রলোকের বাস খুব কম। যে স্থলে অন্যলোক ভয়ে কম্পিত হইত, প্রাণনাশের বিভীষিকায় আকুল হইত, রায়মল্ল সাহেব সেই স্থলে অপূৰ্ব্ব সাহসিকতা ও অতুল মানসিক তেজের পরিচয় দিলেন। তিনি, শুঁড়িখানা হইতে বাহির হইয়া পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে রাস্তায় চলিতেছিলেন, সেইরূপভাবেই পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিলেন।
জগৎসিংহ যে লোককে পাঁচ হাজার টাকা দিতে স্বীকৃত হইয়াছিল, তাহাকে নিজালয়ে লইয়া গিয়া কি বলিয়াছিল এবং তাহার পর কি করিয়াছিল, তাহা পাঠক-বর্গ অবগত নহেন।
জগৎসিংহ মহাপাপী। যে প্রভুপত্নীর পতিব্ৰত্যে জলাঞ্জলি প্রদান করে, তার মত বিশ্বাসঘাতক, তার মত পাপী, আর কে আছে? পরের সম্পত্তি অপহরণ করিয়া পার্থিব ঐশ্বর্য্য ভোগ করিতেছে। এতদিন যে অতুল বিষয় সম্পত্তি সে নির্বিবাদে ভোগ করিয়াছে এবং ভবিষ্যতে যাহাতে সে সুখে বঞ্চিত হইতে না হয়, তজ্জন্য যখন এত আয়াস স্বীকার করিয়াছে, তখন কি তাহা সহজে ছাড়িয়া দিতে পারে? সে রায়মল্লের প্রাণবিনাশ করিয়া কন্টকের মূলোচ্ছেদ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইল। বিলক্ষণ অনুসন্ধানে সে জানিল, রায়মল্ল সাহেব রাজেশ্বরী উপত্যকা হইতে তারাকে উদ্ধার করিয়া আর বুদিগ্রামে প্রত্যাগত হন্ নাই। তখন সে সেই প্রসিদ্ধ গোয়েন্দার কার্য্যের উপরে গোয়েন্দাগিরি করিবার জন্য বহু লোক নিযুক্ত করিল। কিন্তু তাহার নিয়োজিত লোকজনের মধ্যে কেহই রায়মল্ল সাহেবের প্রাণ বিনষ্ট করিতে সাহসী হইল না। তখন তাহার মনে হইল, রাজারাম, রঘু ডাকাত অথবা দুইজনে একত্র সম্মিলিত না হইলে অপর কাহারও দ্বারা এ দুরূহ কার্য সম্পন্ন হইবার নয়। রাজারাম তাহার অভিসন্ধি শুনিয়া সেই কথারই প্রতিধ্বনি করিল। সে চিরকাল রঘু ডাকাতকে সর্দ্দার বলিয়া স্বীকার করিয়া আসিয়াছে এবং তাহার সূতীক্ষ্ণবুদ্ধি প্রভাবে অনেক সময়ে বিশেষ লাভবান্ হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত তাহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস, রঘু ডাকাতের মত অদ্বিতীয় সাহসী পুরুষ ভারতবর্ষের মধ্যে আর কেহ নাই। এই সকল কারণে রাজারাম জগৎসিংহকে পরামর্শ দিল, রঘু ডাকাত যদি একবার জেল হইতে বাহির হইতে পারে, তাহা হইলে রায়মল্লের ন্যায় দশটা লোককে হত্যা করিতে পারিবে।
জগৎসিংহও ভাবিয়া-চিন্তিয়া তাহাই ধাৰ্য্য করিল। তার পর সে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিতে স্বীকৃত হইয়া একটি লোক নিযুক্ত করিল। তাহাকে বুঝাইল, দেখ, তুমি দেখতে অনেককটা রঘু ডাকাতের মত। রঘু ডাকাতের আত্মীয় ব’লে পরিচয় দিয়ে তোমাকে জেলের ভিতরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। সেখানে সে যে পোষাক পরে আছে, সেই পোষাক তুমি পারবে, আর তাকে তোমার পোষাক ছেড়ে দেবে। রঘু তোমার পোষাক পরে জেল থেকে বেরিয়ে আসবে, আর তুমিই জেলে থাকবে। তাকে আমার এখন বড় আবশ্যক। রঘু ডাকাত মনে করে আদালতে তোমাকে নিয়ে বিচার হবে, তাতে নিশ্চয়ই তোমার সপরিশ্রম কারাদণ্ড হবে? যদি পারি, পরে তোমায় উপায়ন্তরে উদ্ধার করব। এখন মনে কর, তোমায় জেল খাটতে হবে। আর সেইজন্যই তোমায় পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছি। তোমায় জেল খাটতে হবে বটে, কিন্তু তোমার স্ত্রী- পুত্র পরিজনের ভরণ-পোষণের ভার আমি লইলাম। ঐ পাঁচ হাজার টাকা তোমার সঞ্চিত থাকবে। তুমি জেলখানা থেকে ফিরে এলে যা-হোক একটা লাভজনক ব্যবসা-বাণিজ্য ক’রে চালাতে পারবে।
জগৎসিংহ যে ব্যক্তিকে এই সকল পরামর্শ দিল সে একে গরীব, তায় দারুণ অন্নকষ্টে ক্লিষ্ট। স্ত্রী- পুত্র-পরিবার প্রভৃতির ভবিষ্যৎ সুখাশায় ও বৰ্ত্তমান অন্নদায় হইতে নিষ্কৃতিলাভার্থে জগৎসিংহের এই জঘন্য ঘৃণ্য পরামর্শে সম্মত হইয়া জেলে গেল। রঘু ডাকাত কারাগার হইতে বহির্গত হইয়া রাজারাম ও জগৎসিংহের সহিত মিলিত হইল। রায়মল্লের উপর রঘুনাথের জাতক্রোধ হইয়াছিল। তাঁহার প্রণনাশ করিতে সে উৎসাহের সহিত সে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইল। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, গোয়েন্দা সদার রায়মল্ল জানিতে পারিয়াছিলেন, কোন মন্দ অভিসন্ধিতে কেহ তাঁহার পিছু লাগিয়াছে।