রক্তের মধ্যে দাসত্বের দাগ
যদিও আমি কোনও দিন অফিস-কাছারি করি নাই, তবু কেন জানি না। রবিবার সকালে ঘুম ভাঙিতে বিলম্ব হয়। পূর্বপুরুষেরা চাকুরে ছিলেন, রক্তের মধ্যে বোধ হয় দাসত্বের দাগ রহিয়া গিয়াছে।
পরদিনটা রবিবার ছিল, বেলা সাড়ে সাতটার সময় চোখ মুছিতে মুছিতে বাহিরের ঘরে আসিয়া দেখি ব্যোমকেশ দুহাতে খবরের কাগজটা খুলিয়া ধরিয়া একদৃষ্টি তাকাইয়া আছে। আমার আগমনে সে চক্ষু ফিরাইল না, সংবাদপত্রটাকেই যেন সম্বোধন করিয়া বলিল, ‘নিশার স্বপন সম তোর এ বারতা রে দূত!’
তাহার ভাবগতিক ভাল ঠেকিল না, জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কী হয়েছে?’
সে কাগজ নামাইয়া রাখিয়া বলিল, ‘সত্যকাম কাল রাত্রে মারা গেছে।’
‘অ্যাঁ! কিসে মারা গেল?’
‘তা জানি না।–তৈরি হয়ে নাও, আধা ঘণ্টার মধ্যে বেরুতে হবে।’
আমি কাগজখানা তুলিয়া লইলাম। মধ্য পৃষ্ঠার তলার দিকে পাঁচ লাইনের খবর—
–অদ্য শেষ রাত্রে ধর্মতলার প্রসিদ্ধ সুচিত্রা এম্পেরিয়মের মালিক সত্যকাম দাসের সন্দেহজনক অবস্থায় মৃত্যু ঘটিয়াছে। পুলিস তদন্তের ভার লইয়াছে।
সত্যকাম তবে ঠিকই বুঝিয়াছিল, মৃত্যুর পূবাভাস পাইয়াছিল। কিন্তু এত শীঘ্র! প্রথমেই স্মরণ হইল, কাল সন্ধ্যার সময় নন্দ ঘোষ চাদরের মধ্যে খেটে লুকাইয়া বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করিতেছিল–
বেলা সাড়ে আটটার সময় ব্যোমকেশ ও আমি আমহার্স্ট স্ট্রীটে উপস্থিত হইলাম। ফটকের বাহিরে ফুটপাথের উপর একজন কনস্টেবল দাঁড়াইয়া আছে; একটু খুঁতখুঁত করিয়া আমাদের ভিতরে যাইবার অনুমতি দিল।
ইট-বাঁধানো রাস্তা দিয়া সদরে উপস্থিত হইলাম। সদর দরজা খোলা রহিয়াছে, কিন্তু সেখানে কেহ নাই। বাড়ির ভিতর হইতে কান্নাকাটির আওয়াজও পাওয়া যাইতেছে না। ব্যোমকেশ দরজার সম্মুখে পৌঁছিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, নীরবে মাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। দেখিলাম দরজার ঠিক সামনে ইট-বাঁধানো রাস্তা যেখানে শেষ হইয়াছে সেখানে খানিকটা রক্তের দাগ। কাঁচা রক্ত নয়, বিঘাতপ্রমাণ স্থানের রক্ত শুকাইয়া চাপড়া বাঁধিয়া গিয়াছে।
আমরা একবার দৃষ্টি বিনিময় করিলাম; ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল। তারপর আমরা রক্ত-লিপ্ত স্থানটাকে পাশ কাটাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
একটি চওড়া বারান্দা, তাহার দুই পাশে দুইটি দরজা। একটি দরজায় তালা লাগানো, অন্যটি খোলা; খোলা দরজা দিয়া মাঝারি। আয়তনের অফিস-ঘর দেখা যাইতেছে। ঘরের মাঝখানে একটি বড় টেবিল, টেবিলের সম্মুখে ঊষাপতিবাবু একাকী বসিয়া আছেন।
ঊষাপতিবাবু টেবিলের উপর দুই কনুই রাখিয়া দুই করতলের মধ্যে চিবুক আবদ্ধ করিয়া বসিয়া মুম্ন আমরা প্রবেশ করলে দুখািভরা চোখ তুলিয়া চাহিলন, শুষ্ক নিষ্প্রাণ স্বরে বললেন, ‘কী চাই?’
ব্যোমকেশ টেবিলের পাশে গিয়া দাঁড়াইল, সহানুভূতিপূর্ণ স্বরে বলিল, ‘এ-সময় আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম, মাফ করবেন। আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী—’
ঊষাপতিবাবু ঈষৎ সজাগ হইয়া পর্যায়ক্রমে আমাদের দিকে চোখ ফিরাইলেন, তারপর বলিলেন, ‘আপনাদের আগে কোথায় দেখেছি। বোধহয় সুচিত্রায়।–কী নাম বললেন?’
‘ব্যোমকেশ বক্সী। ইনি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়।–কাল আমরা আপনার দোকানে গিয়েছিলাম—’
ঊষাপতিবাবু আমাদের নাম পূর্বে শুনিয়াছেন বলিয়া মনে হইল না, কিন্তু খদ্দেরের প্রতি দোকানদারের স্বাভাবিক শিষ্টতা বোধ হয় তাঁহার অস্থিমজ্জাগত, তাই কোনও প্রকার অধীরতা প্রকাশ না করিয়া বলিলেন, ‘কিছু দরকার আছে কি? আমি আজ একটু–বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেছে—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘জানি। সেই জন্যেই এসেছি। সত্যকামবাবু–’
‘আপনি সত্যকামকে চিনতেন?’
‘মাত্র পরশু দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি আমার কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন–’
‘কী প্রস্তাব?’
‘তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে, হঠাৎ যদি তাঁর মৃত্যু হয় তাহলে আমি তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে অনুসন্ধান করব।’
ঊষাপতিবাবু এবার খাড়া হইয়া বসিলেন, কিছুক্ষণ নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া থাকিয়া যেন প্রবল হৃদয়াবেগ দমন করিয়া লইলেন, তারপর সংযত স্বরে বলিলেন, ‘আপনারা বসুন। —সত্যকাম তাহলে বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু মাফ করবেন, আপনার কাছে সত্যকাম কেন গিয়েছিল বুঝতে পারছি না। আপনি—আপনার পরিচয়-মানে আপনি কি পুলিসের লোক? কিন্তু পুলিস তো কাল রাত্রেই এসেছিল, তারা—’
‘না, আমি পুলিসের লোক নই। আমি সত্যান্বেষী। বেসরকারী ডিটেকটিভ বলতে পারেন।’
‘ও—’ ঊষাপতিবাবু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, ‘সত্যকাম কাকে সন্দেহ করে, আপনাকে বলেছিল কি?’
‘না, কারুর নাম করেননি।–এখন আপনি যদি অনুমতি করেন। আমি অনুসন্ধান করতে পারি।‘
‘কিন্তু–পুলিস তো অনুসন্ধানের ভার নিয়েছে, তার চেয়ে বেশি আপনি কী করতে পারবেন?’
‘কিছু করতে পারব। কিনা তা এখনও জানি না। তবে চেষ্টা করতে পারি।’
এত বড় শোকের মধ্যেও ঊষাপতিবাবু যে বিষয়বুদ্ধি হারান নাই। তাই তাহার পরিচয় এবার পাইলাম।
তিনি বলিলেন, ‘আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ, আপনাকে কত পারিশ্রমিক দিতে হবে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিছুই দিতে হবে না। আমার পারিশ্রমিক সত্যকামবাবু দিয়ে গেছেন।’
ঊষাপতিবাবু প্রখর চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, তারপর চোখ নামাইয়া বলিলেন, ‘ও। তা আপনি অনুসন্ধান করতে চান করুন। কিন্তু কোনও লাভ নেই, ব্যোমকেশবাবু।’
‘লাভ নেই কেন?’
‘সত্যকাম তো আর ফিরে আসবে না, শুধু জল ঘোলা করে লাভ কী?’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ স্থির নেত্ৰে ঊষাপতিবাবুর পানে চাহিয়া থাকিয়া ধীরস্বরে বলিল, ‘আপনার মনের ভাব আমি বুঝেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, জল ঘোলা হতে আমি দেব না। আমার উদ্দেশ্য শুধু সত্য আবিষ্কার করা।’
ঊষাপতিবাবু একটি ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলিলেন, ‘বেশ। আমাকে কী করতে হবে বলুন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কাল কখন কীভাবে সত্যকামবাবুর মৃত্যু হয়েছিল আমি কিছুই জানি না। আপনি বলতে পারবেন কি?’
ঊষাপতিবাবুর মুখখানা যেন আরও ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল, তিনি বুকের উপর একবার হাত বুলাইয়া বলিলেন, ‘আমিই বলি—আর কে বলবে? কাল রাত্রি একটার সময় আমি নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। দুম করে একটা আওয়াজ। মনে হল যেন সদরের দিক থেকে এল–’
‘মাফ করবেন, আপনার শোবার ঘর কোথায়?’
ঊষাপতিবাবু ছাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘এর ওপরের ঘর। আমি একই শুই, পাশের ঘরে স্ত্রী শোন।’
‘আর সত্যকামবাবু কোন ঘরে শুতেন?’
‘সত্যকাম নীচে শুত। ঐ যে বারান্দার ওপারে ঘরের দোরে তালা লাগানো রয়েছে ওটা তার শোবার ঘর ছিল। আমার স্ত্রীর শোবার ঘর ওর ওপরে।’
‘সত্যকামবাবু নীচে শুতেন কেন?’
ঊষাপতিবাবু উত্তর দিলেন না, উদাসচক্ষে বাহিরের জানালার দিকে তাকাইয়া রহিলেন। তাঁহার ভাবভঙ্গী হইতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে, রাত্রিকালে নির্বিঘ্নে বহিৰ্গমন ও প্রত্যাবর্তনের সুবিধার জন্যই সত্যকাম নীচের ঘরে শয়ন করিত। তাহার রাত্রে বাড়ি ফিরিবার সময়েরও ঠিক ছিল না।
এই সময় ভিতর দিকের দরজার পদ সরাইয়া একটি মেয়ে হাতে সরবতের গেলাস লইয়া প্রবেশ করিল এবং আমাদের দেখিয়া থমকিয়া গেল, অনিশ্চিত স্বরে একবার ‘মামা-? বলিয়া ন যযৌ ন তস্থৌ হইয়া রহিল। মেয়েটির বয়স সতেরো-আঠারো, সুন্দরী নয় কিন্তু পুরন্ত গড়ন, চটক আছে। বর্তমানে তাহার মুখে-চোখে শঙ্কার কালো ছায়া পড়িয়াছে।
ঊষাপতিবাবু তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, ‘দরকার নেই।’ মেয়েটি চলিয়া গেল।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার বাড়িতে কে কে থাকে?’
ঊষাপতিবাবু বলিলেন, ‘আমরা ছাড়া আমার দুই ভাগনে ভাগনী থাকে।
‘এটি আপনার ভাগনী?
‘হ্যাঁ।’
‘কতদিন এরা আপনার কাছে আছে?’
‘বছরখানেক আগে ওদের বাপ মারা যায়। মা আগেই গিয়েছিল। সেই থেকে আমি ওদের প্রতিপালন করছি। বাড়িতে আমরা ক’জন ছাড়া আর কেউ নেই।’
‘চাকর-বাকর?’
‘পুরনো চাকর সহদেব বাড়িতেই থাকে। সে ছাড়া ঝি আর বামনী আছে, তারা রাত্রে থাকে না।’
‘বুঝেছি। তারপর কাল রাত্রির ঘটনা বলুন।’
ঊষাপতিবাবু চোখের উপর দিয়া একবার করতল চালাইয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ। আওয়াজ শুনে আমি ব্যালকনির দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। নীচে অন্ধকার, কিছু দেখতে পেলাম না। তারপরই সদর দরজার কাছ থেকে সহদেব চীৎকার করে উঠল…ছুটতে ছুটতে নীচে নেমে এলাম, দেখি সহদেব দরজা খুলেছে, আর–সত্যকাম দরজার সামনে পড়ে আছে। প্ৰাণ নেই, পিঠের দিক থেকে গুলি ঢুকেছে।’
‘গুলি! বন্দুকের গুলি?’
‘হ্যাঁ। সত্যকাম রোজই দেরি করে বাড়ি ফিরত। সহদেব বরান্দায় শুয়ে থাকত, দরজায় টোকা পড়লে উঠে দোর খুলে দিত। কাল সে টোকা শুনে দোর খোলবার আগেই কেউ পিছন দিক থেকে সত্যকামকে গুলি করেছে।’
‘গুলি। আমি ভেবেছিলাম—’ ব্যোমকেশ থামিয়া বলিল, ‘তারপর বলুন।’
ঊষাপতিবাবু একটা চাপা নিশ্বাস ফেলিলেন, ‘তারপর আর কী? পুলিসে টেলিফোন করলাম।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নতমুখে চিন্তা করিল, তারপর মুখ তুলিয়া বলিল, ‘সত্যকামবাবুর ঘরে তালা কে লাগিয়েছে?’
ঊষাপতি বলিলেন, ‘সত্যকাম যখনই বাড়ি বেরুত, নিজের ঘরে তালা দিয়ে যেত। কালও বোধহয় তালা দিয়েই বেরিয়েছিল, তারপর–’
‘বুঝেছি। ঘরের চাবি তাহলে পুলিসের কাছে?
‘খুব সম্ভব।’
‘পুলিস ঘর খুলে দেখেনি?
‘না।’
‘যাক, আপনার কাছে আর বিশেষ কিছু জানবার নেই। এবার বাড়ির অন্য সকলকে দু’ একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।’
‘কাকে ডাকব বলুন।’
‘সহদেব বাড়িতে আছে?’
‘আছে নিশ্চয়। ডাকছি।’
আসিয়া বসিলেন।
সহদেব প্রবেশ করিল। জরাজীর্ণ বৃদ্ধ, শরীরে কেবল হাড় ক’খানা আছে। মাথায় ঝাঁকড়া পাকা চুল, ভ্রূ পাকা, এমন কি চোখের মণি পর্যন্ত ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছে। লোলচর্ম শিথিলপেশী মুখে হাবলার মত ভাব।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার নাম সহদেব? তুমি কত বছর এ-বাড়িতে কাজ করছ?’
সহদেব উত্তর দিল না, ফ্যালফ্যাল করিয়া একবার আমাদের দিকে একবার ঊষাপতিবাবুর দিকে তাকাইতে লাগিল। ঊষাপতিবাবু বলিলেন, ‘ও আমার শ্বশুরের সময় থেকে এ-বাড়িতে আছে–প্ৰায় পঁয়ত্ৰিশ বছর।’
ব্যোমকেশ সহদেবকে বলিল, ‘তুমি কাল রাত্ৰে–‘
ব্যোমকেশ কথা শেষ করিবার আগেই সহদেব হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘আমি কিছু জানিনে বাবু।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার কথাটা শুনে উত্তর দাও। কাল রাত্রে সত্যকামবাবু যখন দোরে টোকা দিয়েছিলেন তখন তুমি জেগে ছিলে?’
সহদেব পূর্ববৎ জোড়হস্তে বলিল, ‘আমি কিছু জানিনে বাবু।’
ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহাকে বিদ্ধ করিয়া বলিল, ‘মনে করবার চেষ্টা কর। সে-সময় দুম্ করে একটা আওয়াজ শুনেছিলে?’
‘আমি কিচ্ছু জানিনে বাবু।’
অতঃপর ব্যোমকেশ যত প্রশ্ন করিল সহদেব তাহার একটিমাত্র উত্তর দিল-আমি কিছু জানিনে বাবু। এই সবাঙ্গীন অজ্ঞতা কতখানি সত্য অনুমান করা কঠিন; মোট কথা সহদেব কিছু জানিলেও বলিবে না। ব্যোমকেশ বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘তুমি যেতে পোর। ঊষাপতিবাবু্, এবার আপনার ভাগনীকে ডেকে পাঠান।’
ঊষাপতিবাবু সহদেবকে বলিলেন, ‘চুমকিকে ডেকে দে।’
সহদেব চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে চুমকি প্রবেশ করিল, চেষ্টাকৃত দৃঢ়তার সহিত টেবিলের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিলাম তাহার মুখে আশঙ্কার ছায়া আরও গাঢ় হইয়াছে, আমাদের দিকে চোখ তুলিয়াই আবার নত করিল।
ব্যোমকেশ সহজ সুরে বলিল, ‘তোমার মামার কাছে শুনলাম তুমি বছরখানেক হল এ-বাড়িতে এসেছ। আগে কোথায় থাকতে?
চুমকি ধরা-ধরা গলায় বলিল, ‘মানিকতলায়।’
‘লেখাপড়া করে?’
‘কলেজে পড়ি।’
‘আর তোমার ভাই?’
‘দাদাও কলেজে পড়ে।’
‘আচ্ছা, কাল রাত্তিরে তুমি কখন জানতে পারলে?’
চুমকি একটু দাম লইয়া আস্তে আস্তে বলিল, ‘আমি ঘুমোচ্ছিলুম। দাদা এসে দোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল, তখন ঘুম ভাঙল।’
‘ও—তুমি রাত্তিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে শোও?’
চুমকি যেন থতমত খাইয়া গেল, বলিল, ‘হ্যাঁ।’
‘তোমার শোবার ঘর নীচে না ওপরে?’
নীচে পিছন দিকে। আমার ঘরের পাশে দাদার ঘর।’
‘তাহলে বন্দুকের আওয়াজ তুমি শুনতে পাওনি?’
‘না।’
‘ঘুম ভাঙার পর তুমি কী করলে?’
‘দাদা আর আমি এই ঘরে এলুম। মামা পুলিসকে ফোন করেছিলেন।’
‘আর তোমার মামীমা?’
‘তাঁকে তখন দেখিনি। এখান থেকে ওপরে গিয়ে দেখলুম। তিনি নিজের ঘরের মেঝোয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।’ চুমকির চোখ জলে ভরিয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ সদয় কষ্ঠে বলিল, ‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও। তোমার দাদাকে পাঠিয়ে দিও।’
চুমকি ঘরের বাহিরে যাইতে না যাইতে তাহার দাদা ঘরে প্রবেশ করিল; মনে হইল সে দ্বারের বাহিরে অপেক্ষা করিয়া ছিল। ভাই বোনের চেহারায় খানিকটা সাদৃশ্য আছে। কিন্তু ছেলেটির চোখের দৃষ্টি একটু অদ্ভুত ধরনের। প্যাঁচার চোখের মত তাহার চোখেও একটা নির্নিমেষ আচঞ্চল একাগ্রতা। সে অত্যন্ত সংযতভাবে টেবিলের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল এবং নিম্পলেক চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল।
সওয়াল জবাব আরম্ভ হইল।
‘তোমার নাম কী?’
‘শীতাংশু দত্ত।’
‘বয়স কত?’
‘কুড়ি।’
‘কাল রাত্ৰে তুমি জেগে ছিলে?’
‘হাঁ।’
‘কী করছিলে?’
‘পড়ছিলাম।’
‘কী পড়ছিলে? পরীক্ষার পড়া?’
‘না। গোর্কির ‘লোয়ার ডেপথস পড়ছিলাম। রাত্রে পড়া আমার অভ্যাস।’
‘ও…বিন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলে?’
‘পেয়েছিলাম। কিন্তু বন্দুকের আওয়াজ বলে বুঝতে পারিনি।’
‘তারপর?’
সহদেবের চীৎকার শুনে গিয়ে দেখলাম।’
‘তারপর ফিরে এসে তোমার বোনকে জাগালে?’
‘হ্যাঁ।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চিবুকের তলায় করতল রাখিয়া বসিয়া রহিল। দেখিলাম ঊষাপতিবাবুও নির্লিপ্তভাবে বসিয়া আছেন, প্রশ্নোত্তরের সব কথা তাঁহার কানে যাইতেছে কিনা সন্দেহ। মনের অন্ধকার অতলে তিনি ডুবিয়া গিয়াছেন।
ব্যোমকেশ আবার সওয়াল আরম্ভ করিল।
‘তুমি রাত্রে শোবার সময় দরজা বন্ধ করে শোও?’
না, খোলা থাকে।’
‘চুমকির দোর বন্ধ থাকে?’
‘হ্যাঁ।। ও মেয়ে, তাই।’
‘যাক।–কাল রাত্ৰে সকলে শুয়ে পড়বার পর তুমি বাড়ির বাইরে গিয়েছিলে?’
‘না।’
‘সদর দরজা ছাড়া বাড়ি থেকে বেরুবার অন্য কোনও রাস্তা আছে?’
‘আছে। খিড়কির দরজা।’
‘না। বেরুলে আমি জানতে পারতাম। খিড়কির দরজা আমার ঘরের পাশেই। দোর খুললে ক্যাঁচ-কাঁচ শব্দ হয়। তাছাড়া রাত্রে খিড়কির দরজায় তালা লাগানো থাকে।’
‘তাই নাকি! তার চাবি কার কাছে থাকে?’
‘সহদেবের কাছে।’
‘হুঁ। সত্যকামবাবু রাত্ৰে দেরি করে বাড়ি ফিরতেন তুমি জান?’
‘জানি।’
‘রোজ জানতে পারতে কখন তিনি বাড়ি ফেরেন?’
‘রোজ নয়, মাঝে মাঝে পারতাম।’
‘আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পার।’
শীতাংশু আরও কিছুক্ষণ বোমকেশের পানে নিষ্পলক চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।
ব্যোমকেশ ঊষাপতিবাবুর দিকে ফিরিয়া ঈষৎ সঙ্কুচিত স্বরে বলিল, ‘ঊষাপতিবাবু্, এবার আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে কি?’
ঊষাপতিবাবু চমকিয়া উঠিলেন, ‘আমার স্ত্রী! কিন্তু তিনি—তাঁর অবস্থা—’
‘তাঁর অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তাঁকে এখানে আসতে হবে না, আমিই তাঁর ঘরে গিয়ে
‘দু’-একটা কথা—’
ব্যোমকেশের কথা শেষ হইল না, একটি মহিলা অধীর হস্তে পদ সরাইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। তিনি যে ঊষাপতিবাবুর স্ত্রী, তাহাতে সন্দেহ রহিল না। ব্যোমকেশকে লক্ষ্য করিয়া তিনি তীব্র স্বরে বলিলেন, ‘কেন আপনি আমার স্বামীকে এমনভাবে বিরক্ত করছেন? কী চান আপনি? কেন এখানে এসেছেন?’
আমরা তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। মহিলাটির বয়স বোধকরি চল্লিশের কাছাকাছি কিন্তু চেহারা দেখিয়া আরও কম বয়স মনে হয়। রঙ ফরসা, মুখে সৌন্দর্যের চিহ্ন একেবারে লুপ্ত হয় নাই। বর্তমানে-তাঁহার মুখে পুত্রশোক অপেক্ষা ক্রোধই অধিক ফুটিয়াছে। ব্যোমকেশ অত্যন্ত মোলায়েম সুরে বলিল, ‘আমাকে মাফ করবেন, নেহাত কর্তব্যের দায়ে আপনাদের বিরক্ত করতে এসেছি–’
মহিলাটি বলিলেন, ‘কে ডেকেছে। আপনাকে? এখানে আপনার কোনও কর্তব্য নেই। যান আপনি, আমাদের বিরক্ত করবেন না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি কি চান না যে সত্যকামবাবুর মৃত্যুর একটা কিনারা হয়?’
‘না, চাই না। যা হবার হয়েছে। আপনি যান, আমাদের রেহাই দিন।’
‘আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।’
আমরা ঊষাপতিবাবুর পানে চাহিলাম। তিনি বিস্ময়াহতভাবে স্ত্রীর পানে চাহিয়া আছেন, যেন নিজের চক্ষুকৰ্ণকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না। মহিলাটিও একবার স্বামীর প্রতি দৃষ্টি ফিরাইলেন, তারপর দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।