মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 12
কিন্তু সুমিতার কী হল? মালবিকাদিরই বা কী খবর? কাজলও জানে না, আমিও জানি না, শিল্পীও জানে না।
মালবিকাদির বাড়িতে শরিকে শরিকে আবার বিবাদ শুরু হয়েছে। মালবিকাদিকে কেউ ফোন করলেই কেটে দিচ্ছে। শ্যামপুকুরের সমিতিতে কোনও ফোনই নেই। সুমিতাদের বাড়ি ঝিনঝিন করে ফোন বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। অর্থাৎ হয় বাড়িসুদ্ধ সবাই হাওয়া খেতে গেছে, নয় ফোন খারাপ। ফলস রিং হচ্ছে। সুমিতার কলেজের নম্বর টিপতে খালি একটা হেঁড়ে মতো মেয়ে-গলা বলে ‘ইয়ে নাম্বার মওজুদ নহী হ্যায়।’
ঘন ঘোর বর্ষা। রাস্তায় যখন তখন হাঁটু জল জমে যাচ্ছে। আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সারা দিন খালি শেফালির মুখ। খুন্তি হাতে কেষ্ট ঠাকুরের মতো বেঁকে দাঁড়াবে দরজার পাশকাঠে ঠেস দিয়ে। ‘ইস বউদি, আজকে আমার হয়েছিল আর কী। অ্যাকসিডেন থেকে ঠাকুর বাঁচিয়েছেন। একটা মুখপোড়া তিন ঠেঙে অটো একেবারে ধড়ধড় করে মুখের সামনে।’
রোজই ওকে অ্যাকসিডেন থেকে ঠাকুর বাঁচান। হাঁটুর পেছনে আঁচড়, গোড়ালিতে ফোঁড়া, কনুইয়ে নুনছাল উঠে যাওয়া এর কোনওটা না কোনওটা ওর নিত্যদিন হবে। আমাকে তার বিশদ বিবরণ শুনতে হবে। দেখবার হলে দেখতে হবে, ওষুধ দিতে হবে। মানে ওষুধ বাতলাতে হবে, কিন্তু সে ওষুধ শেফালি ছোঁবে না। যদি আমি কোনও সাধারণ অ্যান্টি-সেপটিক মলমের নাম করি, টিউব দিই, শেফালি ঈষৎ মুখ বেঁকিয়ে বলবে ‘এ তো তুমি শীতকালে মুখে মাখো গো। এতে কী আর হবে?’ যদি বলি ‘মোড়ের ওষুধের দোকান থেকে ইনজেকশন নিয়ে আয় লিখে দিচ্ছি।’ ও বলবে ‘ডাক্তার দেখল না, বদ্যি এল না, তোমার কথায় অমনি ফুঁড়িয়ে আসব অত বোকা তুমি আমায় পাওনি।’
বেশ কিছুক্ষণ ভ্যাজর ভ্যাজর করার পর ‘অ্যাল’ বলে এত্তখানি জিভ কেটে বলবে—‘ও মা, তোমার ডিসটাব হচ্ছে। তুমি তো লিখছ’ আমার ধারণা আমি লিখছি কি না দেখতেই ও আসে। পাহারাঅলা। বিধুভূষণবাবুই ওকে টিকটিকি লাগিয়েছেন কি না কে জানে!
কাজলের কাছে প্রস্তাব দিই—‘এক দিন জয় মা বলে বেরিয়ে পড়া যাক’—মালবিকাদির সমিতিতে এক দিন, সেটা হাতের কাছে, কোনও ব্যাপার নয়, আরেক দিন সুমিতার কলেজে সেটা দক্ষিণ শহরতলিতে, গুরুতর ব্যাপার।
মালবিকাদির মহিলা সমিতিতে গেলে আমার একইসঙ্গে মন খারাপ এবং মন ভাল হয়ে যায়। ভাল হয় কেন না, এতগুলি মেয়ে প্রতিকূল পরিবেশ কাটিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে, আর্থিক স্বাধীনতার সুযোগ পাচ্ছে। এ তো খুবই আনন্দের কথা। মন খারাপ হয় এই জন্যে যে মানুষের জীবন তো শুধু দুটি অন্ন খুঁটি খাবার জন্যে নয়। খাবার যোগাড়ের লড়াইয়েই এদের জীবন শেষ হয়ে গেল। এমনই অবস্থা এত দিন পরেও আমাদের দেশের যে জীবনে বাঁচার প্রথম ধাপটা টপকাবার প্রাণান্ত চেষ্টাতেই এখনও আমাদের সব চেষ্টা শেষ। কী রকম বিমর্ষ লাগে এখানে এলে। সেই জন্যে চট করে আসি না।
মালবিকাদি বলে ‘তোরা কী জানিস তো? এসকেপিস্ট। কোনও সত্যিকার প্রবলেমের সামনে কক্ষণো দাঁড়াবি না। ওই মধ্যবিত্ত সমাজে কে মা বাবাকে দেখল না, কোন শাশুড়ি বউকে দেখতে পারল না, কী ভাবে নোংরা ঝগড়া ঝাঁটি করে অথবা না করে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেল, তারপর ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে টানাটানি, হেনস্থা—এই তোদের গল্পের বিষয়। কিম্বা তোরা বসে থাকবি গজদন্ত মিনারে সেখানে একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ, পরকীয়া, বড় জোর সাম্যবাদীদের অসম আচরণ, ফান্ডামেন্টালিস্টদের ধাপ্পাবাজির স্যাটায়ার লিখবি। হোপলেস তোরা হোপলেস।’
মালবিকাদির ধারণা সত্যিকারের লেখার যোগ্য ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, গল্প নাটক তৈরি হচ্ছে একমাত্র তার মহিলাসমিতিতে। যদিও আমাকে প্লট দিতে সে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়।
বিন্দুদি আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। বিন্দু নাম আমি শরৎচন্দ্রে আর হিন্দি সিনেমা ছাড়া এই মালবিকা মহিলা-সমিতিতেই একমাত্র দেখছি শুনছি। তা সে যাই হোক বিন্দুদির সুগোল মুখ, বড়ি খোঁপা এবং গোটা শরীরের একটা সুবর্তুল ডৌল থাকার জন্য নামটা খুব জুতসই লাগে।
ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় করে অন্তত গোটা পনেরো সেলাইমেশিন চলছে। লং ক্লথ, পপলিনের শাদা ঝলকাচ্ছে। মেয়েদের এক হাত সেলাইয়ের কাপড় চাপাকলের ও ধারে টেনে ধরে আছে। আর এক হাত এ ধারে টেনে ধরে আছে। মুখ তুলে ওরা হাসছে আবার সেলাইয়ে মুখ ফেরাচ্ছে। প্রথম ঘর ছেড়ে আমরা দ্বিতীয় ঘরে যাই। এটাই বিন্দুদির অর্থাৎ কার্যনির্বাহী সম্পাদকের ঘর। এখানে ছুঁচের কাজ হচ্ছে।
‘অ্যাই একদম মুখ তুলবি না, প্রতিটি ফোঁড় সমান হওয়া চাই।’ বিন্দুদি প্রথমেই ধমক মারে।
তা সে যদি বুনো ওল হয় তো তার বাঘা তেঁতুলও আছে। একটি বেশ পোড়-খাওয়া চেহারার মেয়ে বলল—‘তা যদি বলো বিন্দুদিদি তো তুম্মো তোমার হিসেবের খেরো থেকে মুখ তুলো না। মালুদিদি বলে দিয়েছে এখানে আমরা সবাই সমান? বলেনি কো? স্বামীজিও তো বলে গিয়েছেন—দরিদ্দ ভারতবাসী চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই। তা আমরা তো চাঁড়ালও নই বাপু।’
কথা কোথা থেকে কোথায় চলে এল। কাজল ফিসফিস করে বলল—‘রোজ ক্লাস বসিয়ে স্বামীজী রবীন্দ্রনাথ এই সব পাঠ হয় এখানে, বুঝলি তো? এখন উগরোচ্ছে। একটা কবিতার সাবসট্যান্স করে এসেছে, যে কবিতাই আসুক সেই একটাই চালাচ্ছে।’
আমিও ফিসফিস করে বলি—‘আসল কথা অ্যাপ্লিকেশন, প্রয়োগ। এই প্রয়োগটা মালবিকাদি শেখাতে পারছে না, বুঝলি?’
আমাদের সব ফিসফিসুনিই অবশ্য মাঠে মারা গেল, কারণ আমাদের সমালোচনার লক্ষ্য মালবিকাদি-ই অনুপস্থিত।
‘সমিতির কাজ দেখতে এয়েছেন, না দিদির কাছে? কিছু কিনবেন?’ বিন্দুদি ‘চাঁড়ালও নই বাপু’—মহিলাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমাদের জিজ্ঞেস করল।
এখন সমিতির কাজ দেখতে আসিনি, সমিতির কর্মরত মেয়েদের সামনে বলাটা কেমন রূঢ় লাগে। কিছু কিনব কি না এটার উত্তর শোনবার জন্যেও নিশ্চয়ই মেয়েরা মুখিয়ে আছে। মালবিকাদিরও একটা মান-সম্মান আছে, তার বন্ধুদেরও স্বভাবতই মান-সম্মান আছে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে কাজলা ঠোঁট-কাটার মতো বলল— ‘আমাদের কিছু কেনবার নেই, বিন্দুদি, আগেরগুলোই এখনও তোলা আছে তবে এসেছি যখন…’
বিন্দুদি চোখ গোল-গোল করে বলল— ‘ও মা, আপনারা এয়েছেন এই আমাদের কত ভাগ্যি। জিনিস কিনতে হবে— এমন কোনও কড়ার আছে না কি? — তা ছাড়া আমাদের বেশির ভাগ জিনিসই তো অর্ডার সাপ্লাইয়ের জিনিস— ছোঁয়া যাবে নাকো। ধরুন, পাজামা, পাঞ্জাবি, সায়া, নাইট-ফ্রক, টেপ-জামা, হাউস-কোট, অ্যাপ্রন, বাত-রোব, ঝোলা ব্যাগ। … তবে শৌখিন যদি দেখতে চান…’
এইটেই বিন্দুদির কায়দা। জেনেশুনেও আমরা ফাঁদে পড়ি। কাজল দু হাজার দিয়ে একটা কাচের কাজ করা সিল্ক কিনে ফেলে। আসল দাম আড়াই। কিন্তু আমাদের জন্যে দুই। পেয়েবল হোয়েনেবল। ইনস্টলমেন্ট তার ওপর। আমি একটা অ্যাপলিকে আর ফ্যাব্রিক পেন্টিংয়ে চমৎকার খাদির ঝোলা ব্যাগ পেয়ে যাই, ভেতরে দুটো খাপ, সব লাইনিং দেওয়া। যেন আমার পাণ্ডুলিপি বইবার জন্যেই মাপ দিয়ে তৈরি হয়েছে। এ-ও দুশো আসল দাম, আমাদের জন্য দেড়শো, পেয়েবল হোয়েনেবল। ইনস্টলমেন্ট।
‘এটা টু মাচ হয়ে যাচ্ছে রে রঞ্জু।’ কাজলা বিবেক-পীড়িত কণ্ঠে বলে— ‘দেড়শোটা টাকা— আবার বাকি রাখবি?’
‘তাতে কী হয়েছে?’ বিন্দুদি যথাসম্ভব মিষ্টি হেসে বলে— ‘ও দু হাজারও যা দুশোও তা। কাস্টমার হল গিয়ে কাস্টমার। তার সুবিধে-অসুবিধেগুলোই আমরা আগে দেখি।’
লজ্জায় অবনত ও বিবেকপীড়িত হয়ে আমি একশো টাকা বার করে দিই। পঞ্চাশ রইল। কাজলা একটি পয়সা ঠেকাল না। দুজনের বিবেকের জ্বালা আমি একাই মেটালাম।
বেরিয়ে এসে সে কথা বলতে, কাজলা ব্যাগ নাচিয়ে বলল— ‘গজবে যাবি না? আধো আঁধারে আধা-আধুরি বসে বসে একটু আইসক্রিম, একটু কোল্ড কফি, সামান্য কিছু স্ন্যাকস, সঙ্গে আড্ডা, রেস্ত আমার কাছে।’
‘গজব’-এ ঢুকতে যাচ্ছি, মনে পড়ল— এই যাঃ, মালবিকাদির কথা তো জিজ্ঞেস করা হল না?
‘অবভিয়াসলি নেই, ওখানে। কী আর জিজ্ঞাসা করব?’
দু’জনে দু’জনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিভোর হয়ে ‘গজবে’র সিঁড়ি বেয়ে চাতালে উঠেছি। দুপুরবেলা ফাঁকা টেবিল সব, দেখি শেষের টেবিলে আমাদের দিকে মুখ করে বসে স্বয়ং মালবিকা সান্যাল। সামনে আমাদের দিকে পেছন একটি ভদ্রলোক। পেছন থেকেও আমি চিনতে পেরেছি শুভম। কত ছবি দেখিয়েছে সুমিতা। দুজনে মুখ নিচু করে কেমন ঘনিষ্ঠভাবে ফিসফিস করে কথা বলছে। হায় সুমিতা। হায় তোর প্রেম, তোর বিশ্বাস-অবিশ্বাস, হায় সুযোগ। সুযোগের অসৎ ব্যবহার। সুমিতা, তুই জিতে গিয়ে হেরে গেলি ভাই।
যথাসম্ভব আওয়াজ না করে, ওদের দিকে পেছন করে আলতোভাবে বসি।
‘কিছু অর্ডার দিবি অ্যাট অল?’ — কাজলা ভারী-ভারী গলায় বলল।
‘এসেছি যখন। উঠে যেতে তো আর পারি না’— আমার গলাও ভারী।
‘ওরা লাঞ্চ খাচ্ছে। ঘড়িতে দুটো বেজে সাড়ে সাত মি., এখন লাঞ্চ খাওয়া হচ্ছে!’— কাজলা।
‘অনেক ডিশ নিয়েছে। মোগলাই মনে হচ্ছে। কেশর জাফরানের গন্ধ পাচ্ছি।’—আমি।
‘পারেও মালবিকাদিটা। এই সাঙ্ঘাতিক গরমে! ঘাড় ভাঙবি বলে এই ভ্যাপসায় মোগলাই?’ — কাজল।
‘তুই তো জানিস না, মালবিকাদিদের বাড়িশুদ্ধ খুব খাইয়ে। ওর বাবা ঝুড়ি করে ফিশফ্রাই খেতেন। মাত্র সাতের জন্য লেডিকেনির সেঞ্চুরি করতে পারেননি, পুরো খাওয়ার পর তো? সেঞ্চুরি মিস হল বলে জীবনে আর কোনওদিন লেডিকেনি ছোঁননি।’— আমি।
‘শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তা হলে মালবিকাদির খুব অসুবিধে হয়েছিল বল? আমার পিসশাশুড়িই যখন আমার খাওয়া দেখে বলেছিলেন—‘নতুন বউয়ের খাউন্তি দাউন্তি ভাল, তখন ..” কাজল।
‘না রে সেদিক থেকে মালবিকাদির ভাগ্য ভাল। খাওয়ার বন্ধুর ছেলের সঙ্গেই তো মেয়ের বিয়ে দিলেন মালবিকাদির বাবা।’— আমি। ‘খাওয়ার বন্ধু আবার কী? এক গেলাসের ইয়ার বল’— কাজল শোধরাল।
‘এক পাতে তো স্বামী-স্ত্রী আর ছোট্টছোট্ট ভাইবোনরা ছাড়া অপর আর কেউ খায় না— নইলে টাইফয়েডের পরে ডাক্তার জাওলা মাছের ঝোল ভাত পথ্য দিয়েছিলেন। ঝোল খেলেন কই মাছের, এক জামবাটি— দু কুড়ি কই। ডাক্তারবাবু সেই গল্প মালবিকাদির বাবাকে বলেন। তাইতেই মেসোমশাই লাফিয়ে উঠলেন— এই বাড়িতেই মেয়ের বিয়ে দেব, তা হলে খাওয়ার কষ্ট হবে না।’— আমি বিশদভাবে মালবিকাদির বিয়ের গল্প বলি।
‘এত খেয়েও মালবিকাদিটা স্লিম থাকে কী করে বল তো!’ কাজল ক্ষুব্ধ।
‘অনেকের অমন হয়। গাছেরও খায় তলারও কুড়োয়,— ভাগ্য!’ আমিও ভাগ্যের একচোখোমিতে বিষণ্ণ।
পিঠে আঙুলের টোকা পড়ল। অবভিয়াসলি মালবিকাদি। এতক্ষণ ধরে তো আর ইনকগনিটো থাকতে পারি না। এতক্ষণেও যদি না চেনে তা হলে বলতে হবে ইচ্ছে করে চিনছে না।
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি— মালবিকাদি নয়। শুভম। সুমিতার সেই বিশ্বাসঘাতক জাহাজি বর।
‘আপনি বোধহয় রঞ্জুদি, উনি কাজলদি!— মালবিকাদি ডাকতে বললেন। পিঠে টোকা মারার জন্যে দুঃখিত। মালবিকাদি বললেন— ওইভাবে ডাকতে।’
‘মালবিকাদি বললেন আর অমনি আপনি অজানা-অচেনা ভদ্রমহিলার পিঠে টোকা দিলেন?’— কাজলা মার-মার করে উঠেছে।
‘আমি আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু মালবিকাদি বললেন— এ আঙুল আপনারা মালবিকাদিরই আঙুল বলে ধরে নেবেন। ন্যাচার্যালি টোকাও তাঁর আঙুল যাঁর।’
‘অদ্ভুত লজিক তো!’— আমি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলি।
‘কী বলছ, বলো!’— মালবিকাদির টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলি।
‘দূরে বসে ফিসফিস করার মানে কী?’— মালবিকাদি দাবি করে ‘না চেনার ভান করার মানেই বা কী?’
কী জানি ফিসফিস কে করছে? না চেনার ভানই বা করছে কে?’— আমিও কম যাই না।
‘শেষ পর্যন্ত তোদের ডাকতে পাঠালুম শুধু এই জন্যে যে দেখে যা মালবিকা সান্যাল যখন খায় বুক ফুলিয়ে খায়। কাউকে ভয় পায় না। খাবার চ্যালেঞ্জ তো তোরাই দিয়েছিলি। মালবিকা সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছে।’
আমি ভালই বুঝতে পারি মালবিকাদি কিছু কিঞ্চিৎ রহস্য ভাষায় কথা বলছে যাতে আমরা এক রকম বুঝি, শুভম আরেক রকম বোঝে।
শুভম বললে— ‘এইটে তোমার মহত্তম গুণ মালবিকাদি। খাওয়া নিয়ে টিপিক্যাল মেয়েদের মতো ন্যাকামি করো না। আসুন না, আপনারা এখানেই বসুন না।’
‘আপনাদের টেবিলে আর জায়গা কই? খাদ্যখাদ্যে ভরে ফেলেছেন তো!’
মালবিকাদি আবার দ্ব্যর্থক ভাষায় বলে— ‘এই শুভ, খবরদার ওদের ডাকিস না, এটা তোর আমার আফেয়ার, ওরা ওদেরটা খাক।’
শুভম বলে— ‘এ ছি ছি ছি, মালবিকাদি এটা ঠিক হচ্ছে না, এই প্রথম আলাপ হল?’
‘তুই প্রথম দেখে থাকতে পারিস, আমি খুব কাছ থেকে বহু বার দেখেছি, আর দেখবার সাধ নেই। এরা মনে এক, মুখে এক। আর তোর যদি ভদ্রতা করবার ইচ্ছে জাগে তো তুই যা, গিয়ে ওদের সঙ্গে পকোড়া মাকোড়া খেতে যা। আমি একাই দু প্লেট বিরিয়ানি সাবড়াব আজ, মদন চাটুজ্জের মেয়ে আমি, সাধন সান্ন্যালের বউমা।’
মালবিকা সান্যালের সেই ‘রণং দেহি’ ‘কুছ পরোয়া নেই’ মূর্তির সামনে থেকে পত্রপাঠ পলায়ন করা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি। খুব রেগেছে। শুভম হাতজোড় করে বলল— ‘আমার ছুটি ফুরিয়ে এল। যাবার আগে আর এক দিন আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে আশা করি।’
ফেরবার সময়ে কাজল আবার আটকে দিল। উত্তেজিত গলায় বলতে লাগল— ‘আমাদের এত অপমান করার কারণটা মালবিকাদির কী বলে তোর মনে হয়?’
‘সত্যি! অপমান বলে অপমান, কোথাকার কে শুভম তাকে কি না বলল— ওই ভদ্রমহিলার পিঠে আঙুলের টোকা দিয়ে এসো,— আঙুল, টোকা সবই নাকি প্রতিনিধিমূলক। শুভমের আঙুল ইকোয়ালস মালবিকাদির আঙুল। সুতরাং শুভমের আঙুলের টোকা ইকুয়ালস মালবিকাদির আঙুলের টোকা। জানিস এই টোকা কী সাংঘাতিক জিনিস! আকাশবাণীতে সংস্কৃতি-সম্পর্কিত কোনও অনুষ্ঠানে প্রযোজক মশাই আমার দিদিকে, অঞ্জনাদিদি রে? স্পিচ স্টার্ট করার জন্য হাতে আঙুলের টোকা দিয়ে জানান দিয়েছিলেন। আমার দিদি প্রযোজককে চড় মেরে রেডিয়ো স্টেশন থেকে চলে আসেন। যারা দিদির স্পিচ শোনবার জন্যে বসে ছিল তারা সবাই চড়ের আওয়াজ শুনতে পায়। সেই দিদির বোন আমার পিঠে কিনা আঙুলের টোকা?’
‘টোকা না খোঁচা না হাত বুলোনো তুই-ই ভাল বলতে পারবি।’
কাজল ব্যাপারটাকে জটিল করে দেবার চেষ্টা করে।
‘ইট ওয়াজ পিওর টোকা’— আমি আমার জায়গায় অনড় থাকি।
‘তা সে যাক। কেন এই অপমান?’
‘হ্যাঁ কেন এই অকমান?’
সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তো আমার দিকে তাকিয়ে কাজল বললে— ‘অকমানটা আবার কী?’
‘তোর মানে তোদের গোপালের থেকে শিখেছি।’
ভীষণ বিরক্ত হয়ে কাজল বললে— ‘আমাদের মধ্যে আবার সেই চ্যাংকাটাকে আনার তোর দরকার কী? ওর নাম করিসনি আমার কাছে। মুড অফ হয়ে যায় আমার।’
কাজলদের বৈঠকখানায় এখন কেউ নেই। অনীক দরজা খুলে দিল। আমরা বৈঠকখানায় বসলাম। কিছুক্ষণ পর অনীকই আমাদের চা দিয়ে গেল। বিস্কুট।
‘আর কিছু লাগবে মাসি? পান? বিড়ি-সিগারেট?’
‘যা যা ফক্কড়, এখান থেকে যা এখন’— কাজল তেড়ে উঠল।
‘যাচ্ছি, যাচ্ছি,’ অনীক তাড়াতাড়ি ওপরে পালায়।
‘তোর কী মনে হয়?’— চায়ে চুমুক দিয়ে কাজল বলল।
‘এটা ধরা পড়ে যাওয়ার রাগ, আবার কী?’
‘কিন্তু আমরাই তো সর্বসমক্ষে বাজি ধরেছি। সবাই তো সবাইকে ফ্রি হ্যান্ড দিয়েছি। রেস্তোরাঁর বিল চেয়েছি। সিনেমার টিকিট চেয়েছি। ধরা পড়ে যাওয়ার কোনও কোয়েশ্চন নেই।’
‘ঠিকই তো।’ আমি বলি, ‘কিন্তু ভেবে দ্যাখ কাজলা এই যে অবজেকটিভ কোরিলেটিভটা গোলমেলে মনে হচ্ছে তারই জন্যে অন্তত মালবিকাদির এই হামবড়াইকে ডিকনস্ট্রাক্ট করা দরকার।’
‘মানে? পাশ করেছিস তো ফিলসফি নিয়ে। অতশত লিটর্যারি জার্গন হাঁকড়াচ্ছিস কেন? আমি তোর বিদ্যে জানি না মনে করেছিস?’— কাজল একেবারে মারমুখী। বাংলার মাস্টারমশাইয়ের বউ বলে ও আমাদের মধ্যে একটা বিশেষ গুরুস্থান দাবি করে থাকে— এ অধিকার ও সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না।
আমি বলি— ‘ব্যাপার যত গভীর, ততই তোকে ফিলসফিতে যেতে হবে বুঝলি!’
‘ফিলসফি তা হলে হল গিয়ে ডুবুরির পোশাক?’
‘তা সে যাই হোক, আমার ওপর গুরুগিরি না করে আগে সব ভেঙে ফেল, ভেঙে ফ্যাল।’
‘যা বাবা! কী ভাঙব? এই চারটি বেতের চেয়ার আর ওই একটি ফুলদানি তো আমার সম্বল।’
‘উফফ।’ আমি আরও অধৈর্য, আরও গভীর গলায় বলি— ‘মালবিকাদির কথাবার্তা, ব্যবহার সব ভেঙে ফ্যাল। ভেঙে ভেঙে ভেতর থেকে বিপরীত মানে টেনে টেনে বার কর।’
‘যেমন।’
‘যেমন—“তুই।” ’
‘যাব্বাবা যেমন “আমি”?’
‘দ্যাখ আমি বলি— ‘মন্টুর মাস্টারে’র মন্টুর মতো করিসনি। যথেষ্ট বয়স হয়েছে।’
‘আর কত হেঁয়ালি করবি? মন্টুর মাস্টারটা কে? মন্টুই বা কে?’
‘শিব্রামের মন্টুকে মনে নেই? মাস্টারমশাইদের ঘায়েল করে ছেড়ে দিত? সেই মন্টুকে টিউটর শেখালেন “আই” মানে “আমি”, শিখেছ? মন্টু বলল শিখেছি মাস্টারমশাই “আই” মানে মাস্টারমশাই।’
‘ওঃ হো, মনে পড়েছে, তার পরে সেই ছারপোকা?’
‘মনে পড়েছে তা হলে? আমি থেকে মালবিকাদির “তুই” ব্যবহার বিশ্লেষণ করতে বলছি।’
‘ও হো হো, শুভমকে “তুই” বলছিল, না?
‘ধরতে পেরেছিস? এখন এটা একটা আই-ওয়শ কি না বল। প্রথমে বল— তুই দিয়ে প্রেম হয়?’
‘কেন হবে না?’ কাজলা বলল— ‘আমাদের সময়ে বাংলা অনার্সকে তো আমরা বৃন্দাবন গার্ডনস বলতুম। মনে নেই। কলেজে দোলখেলা প্রথমে ওরাই শুরু করে, তা জানিস? তুই-ই তো বলতো সবাই সবাইকে। তার থেকেই তো দোলা আর সমীরের প্রেম বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে গেল। ওটা কোনও ব্যাপার নয়। আর আজকাল তো আকছার হচ্ছে। যেন এক ঢং।’
‘কেমন একটা ছোটভাই, পিঠ-চাপড়ানো পিঠ-চাপড়ানো ভাব দেখাচ্ছিল না?’
‘ছোটভাই না আরও কিছু! ভেড়ু। মালবিকাদি আঙুল দিয়ে ভদ্রমহিলার পিঠে খোঁচা মারতে বলল। সেও অমনি! বোগাস! মালবিকাদি শ্ৰীমতী কামাখ্যা এবং শুভম— শ্রীমান ভেড়ু।’
‘আচ্ছা আমরা এত রেগে যাচ্ছি কেন বল তো কাজলা। সত্যিই তো এই রকমই তো কনট্রাক্ট ছিল আমাদের?’
‘হোক না কন্ট্র্যাক্ট? সেই সঙ্গে এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংও ছিল আমরা সবাই ভদ্রলোক। স্টাডি করতে হলে ফিসফিস করতে হবে? এই তো চন্দন আমাকে কত গাড়ি চড়াল, কত খাওয়ালো, একটা বালুচরি পর্যন্ত কিনে দিল, কেউ বলতে পারবে দিনের পর দিন উধাও হয়ে দুজনে মুখোমুখি হয়ে ফিসফিস করেছি! এই ধর না কেন তুই। ন দশ দিন তো থেকে এলি এক বাড়িতে, একদিনও কি একা একা শালবনে গিয়েছিলি? একদিনও কি একা একা বসে তার মুখে জীবনানন্দ শুনেছিস?— মালবিকাদিরটা সাবোতাজ।’
আমি ক্ষীণ স্বরে বললুম— ‘তাই?’
খুব মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।