Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu » Page 10

মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu

শিল্পী কাজলের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলে— ‘বাব্বা ; একটা ফেজ গেল। চন্নন গেছে?’

‘অনেকক্ষণ।’

‘তবু ভাল।’

শিল্পী সেইরকম মেয়ে যাদের দেখে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একটা আর্টিকল লিখেছিলেন— ‘দোহাই তোদের একটুকু মোটা হ।’ চেহারার খানিকটা মিলের জন্যে সে সচেতনভাবে ভূতপূর্ব বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেনের মতো সাজে। মাঝখানে সিঁথি কেটে চকচকে পাট করে চুল আঁচড়ানো।

আজ সে জিনস-শার্ট হাঁকিয়ে এসেছে। মাঝখানে সিঁথি কেটে চকচকে পাট করে চুল আঁচড়ানো। কাজল বললে, ‘কী রে আজ যে একেবারে কোমর বেঁধে ব্যাপার কী?’

‘আজ কোমর বেঁধে? বলছ কি কাজলদি? লাস্ট মান্থটাই তো কোমর বেঁধে ছিলুম। আজ রঞ্জুদি এসে গেল আমারও ডিউটি শেষ।’

‘কম্ম ফতে?’

‘ফতে বললে ফতে। ফতে নয় বললে নয়।’

‘বুঝিয়ে বল।’

‘আগে ঠাণ্ডা নিয়ে এসো। দিল কী আজাদি ভাল করে অনুভব করি’, শিল্পী সোফার ওপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। একটা পা সোফার হাতায় তুলে দিয়ে।

ঠাণ্ডা নিয়ে এসে কাজল বলল— ‘কী রে সোফার ওপর ঠ্যাং নাচাচ্ছিস কেন, এ পোজে তো সুস্মিতা সেনের কোনও অ্যাড দেখিনি।’

‘দ্যাখো কাজলদি, বেশি বাজে বকো না, আমি এখন ভীষণ টায়ার্ড। জানো কত বেঁধেছি? মাটন রেজালা, বিরিয়ানি, শাম্মি কাবাব, চিকেন উইথ ক্যাশূ নাটস, ফিশ বলস, ল্যাম উইথ ডাম্পলিংস, স্মোকড হিলসা, পাইন অ্যাপল হিলসা…’

উঃ থাম থাম’ কাজল কানে আঙুল দেয় ‘এ বার বোধ হয় বলবি মাটন ইন রাবড়ি।’

‘বলতেই পারি। তোমাদের জামাইষষ্ঠীতে কী হয় মেনু? আগে মাছের ফ্রাই, ইলিশের ভাপা, মটন কারি এবং শেষ পাতে ল্যাংড়া আম আর রাবড়ি। অনেক জামাই-ই এই খেয়ে পটল তুলেছে তা জানো! বাঙালিদের মতন আনসায়েন্টিফিক মেনু আর কোনও জাত করে না। বিদেশে ওয়াইন পর্যন্ত এক এক রকমের মেনুর সঙ্গে এক এক রকম। হোয়াইট ওয়াইন খাবে মাছের সঙ্গে চিকেনের সঙ্গে, রেড ওয়াইন খাবে মাংসের সঙ্গে। খাবার আগে খাবে ককটেইল, পরে খাবে লিকিঅর। আহ্, কফি ব্র্যান্ডি কি আইরিশ ক্রিম যা খেত্তে না!’

‘ওহ শিল্পী, তোর বর বিদেশ যায় তুই বিদেশ যাস। আমি জানি। বাজে কথা রাখ। ফতে অথচ ফতে নয় কেন বললি— বাতা।’

প্যান্টের পকেট থেকে তিন জোড়া সিনেমার টিকিট বার করল শিল্পী, ব্যাগ খুলে বার করল তিনটে রেস্তোঁরার বিল। সবগুলোতে সই করা। নিরুপম গড়াই। এন. গড়াই, এন. গড়াই।

‘সইগুলো কী করে বাগালি?’

‘বললুম— অটোগ্রাফ করে দিন তো মশাই। অদূর ভবিষ্যতে তো মন্ত্রী হচ্ছেনই। তখন এগুলো নিলামে তুলে কিছু পয়সা কামাব।’

‘অমনি দিয়ে দিল?’

‘দিল তো!’

‘বেহেড বোকা নিরুপমটা। তখনই বলেছিলুম রঞ্জুটাকে, পার্টি করে, ও ছেলেকে বিয়ে করিসনি। ও টুপি পরবার জন্যেই জন্মেছে। তো শুনল না।’

‘তারপর?’

‘তার আর পর কী? স্থির হয়েছিল তিনটে রেস্তোঁরা একটা সিনেমা। আমি দুটোই তিন তিন প্রমাণ সহ এনে ফেলে দিলুম তোমার কাছে। তুমি রেকর্ড রাখো, ফাইল করো। বহোৎ কস্ট কী! কত নাটক, কত ঘোরাঘুরি, খরচাপাতিও মন্দ হল না।’

‘খরচাপাতি তোর হবে কেন? ও তো ওই বোকাটার।’

‘আরে সব সিনেমা, সব রেস্তোঁরা কি প্ল্যান করে ঢোকা যায়। নন্দনে সিনেমা দেখে বললুম— চলুন না নিরুপমদা তাজবেঙ্গলে খাই আজ। তো তো করতে লাগল। নানান বায়নাক্কা। ছেলে নেই, বউ নেই। সবাই মিলে এক দিন আসা যাবে, আজ কোথাও একটু কফি আর স্ন্যাকস খেয়ে বাড়ি যাওয়া যাক। ছেলে নেই, বউ নেই ও সব ছুতো, আসল কথা রেস্ত নেই। আমি বললুম, “আপনাকে আজ আমি খাওয়াবই। শান্তর জন্য নিয়ে যাব! আপনি আমাকে দু দিন খাওয়ালেন। আমি এক দিন।” তখনও বলছে খাঁটি কমিউনিস্টদের তাজবেঙ্গলে যাওয়া মানায় না। আমি বললুম, ‘বা রে, যখন মন্ত্রী হবেন, তখন এড়াবেন কী করে? তখন তাজবেঙ্গল, শেরাটন গ্রুপ… শিল্পী বলে একটা আবদেরে শালী ছিল মনেই পড়বে না।’

‘এতেই হয়ে গেল?’

‘গেল তো!’

‘ইডিয়ট।’ কাজল বলল।

‘ইডিয়ট হতে পারে, কিন্তু ভীষণ শেয়ানা।’

‘কীরকম?’

‘লোকের চোখের সামনে দিয়ে বেরোবে! কত সাধাসাধি করলুম একটা ভেনু ঠিক করতে সেখানে মিট করব, পাত্তাই দিল না। সেই আমাকে রোজ রোজ শাড়ি কিংবা শালোয়ার কামিজ পরে যাদু ঘোষের স্ট্রিটে যেতে হবে। ওই রাস্তায় তো আবার মেয়েদের প্যান্ট পরে ঢোকা নিষিদ্ধ।’

‘লেখা আছে না কি?’

‘ও সব বোঝা যায় কাজলদি?’

‘মানে তোর এই দুর্ধর্ষ রূপটা বোকাটাকে দেখাতে পারলি না, এই তো!’

‘দেখিয়েও বোধ হয় কিছু হত না। তোমাদের উত্তর কলকাতা হোপলেসলি মিডিইভ্যাল। নিরুপমদার মত মেয়েদের শাড়িতেই সবচেয়ে ভাল দেখায়, রান্না জানা মাস্ট, সাজগোজের দিকে বেশি নজর দেওয়া এই গরিব দেশে নাকি মানায় না।’

‘সারাটা মাস তুই ওই বোকাটার মনোহরণ করবার জন্যে যোগিনী সেজে রইলি?’

‘ভারী বয়ে গেছে। মনোহরণ আবার কী?’ শিল্পী ঠোঁট উলটাল। পেটের কথা বুঝতে অতশত লাগে না। জিনসটাই শুধু পরিনি। ম্যাচিং লিপস্টিক, ম্যাচিং টিপ, কস্ট্যুম জুয়েলারি, ভাল ভাল শিফন, খুব সেজেছি।’

‘তাতে কী রি-অ্যাকশন?’

ফুঁসে উঠে শিল্পী বলে ‘রি-অ্যাকশন? আহেলিতে খেতে গেছি, বললে ‘আমি এত দিন তোমাকে আপনি বলছিলাম, সরি।’

‘তারপর? তারপর?’ কাজল উৎসাহে মুখে এক টিপ মৌরি ফেলে।

‘তার আর পর নেই’— শিল্পী বললে।

‘কী বলাবলি করলি বলবি তো’ ‘আমি বললুম, ‘আপনাকে তো কবেই তুমি বলবার অধিকার দিয়ে রেখেছি, “হ্যাঁ”, নিরুপমদা বললে—“আমি প্রথমটায় বুঝতে পারিনি তুমি এত ছোট মানে বাচ্চা।”

‘তো ভাল তো?’ কাজলের উৎসাহে একটুও ভাঁটা পড়েনি। ‘বাচ্চা মেয়েই ওরা ভালবাসে। নিজেরা যত ধেড়ে হবে তত বাচ্চা পছন্দ ওদের।’

শিল্পী খুব মুষড়ে গেছে, বলল— ‘কাজলদি, অত মনস্তত্ত্ব জানি না, নিরুপমদা আমার প্রেসটিজ একেবারে পাংচার করে দিয়েছে।’

‘তো ভাল তো’— অভ্যাশবশত বলে ফেলেই, কাজল নিজেকে সংশোধন করে ‘না, প্রেসটিজটা কীভাবে পাংচার করল না জেনে…’

শিল্পী বলল— ‘তোমাকে বলেই বলছি। ভেঙো না কারও কাছে। বলে— তোমাকে বেশ ইয়াং আর লাইভলি দেখে আশা হয়েছিল— মার্কসিজম যে এখনও প্রাসঙ্গিক, তার ঠিকঠাক প্রয়োগ যে এখনও কুত্রাপি হয়নি— এটা বোঝাতে পারব, কিন্তু তুমি এতই শিশু, বলছ পল সায়েন্সে হনস্‌ নিয়ে পাশ করেছ, টুকে পাশ করোনি তো?’

‘বলল? এই কথা বলল তোকে? তুই মেনে নিলি? ঝগড়া করলি না?’

‘করব না? একশো বার করেছি। শুনিয়ে দিলাম— ব্রেবোর্নের মেয়েরা টুকলির সুযোগ পায় এ কথা যদি মনে করে থাকেন, ভুল করবেন। দিদিদের পরীক্ষার সময়ে যমের মতন চেহারা হয়ে যায়। আর তা যদি বলেন, সারা বছর ইউনিয়ন করে ইউনিয়নের চাঁইরা কী করে ফার্স্ট ক্লাস পায়, কী করে অ্যাট অল পাশ করে আমি জানতে চাই।’

‘কী এক্সপ্লানেশন দিল তাতে?’

বলল— ‘সেই জন্যেই তো কোনওমতে পাশ করেছি। নইলে রঞ্জুকে দেখিয়ে দিতুম। আর রিয়্যাল কম্যুনিস্টরা কখনও পরীক্ষকদের সঙ্গে লাইন করবে না। ও সব বুর্জোয়ারা করে। তোমাদের মতন আর কী!’

‘তারপর?’

‘তার আবার পর থাকে?’ গটগট করে বেরিয়ে চলে এসেছি। আসবার সময়ে বলে এসেছি ‘এই অপমানের একটা বিহিত আমি করবই। রঞ্জুদিকে বলবো আপনি ডুবে ডুবে জল খান। আমার মেয়ে তুলতুলকে কক্ষনও আপনাদের বাড়িতে রাখব না। তাকে আপনি ব্রেন-ওয়াশ করে ডাই-হার্ড কমিউনিস্ট করে ছেড়ে দেবেন, আমার এত ড্রেসের কালেকশন, এত কস্ট্যুম জুয়েলারি, আসল জুয়েলারি সব মাঠে মারা যাবে। বরং শান্তকে আমি হোস্টেলে রাখবার ব্যবস্থা করছি।’

‘কী বলল?’

‘কী আবার বলবে?’ …“আরে আরে চটছ কেন? শান্তকে হোস্টেলে রাখলে যে রঞ্জুদির সাহিত্যের উৎস শুকিয়ে যাবে। তুলতুলের জন্যে চকলেট কিনেছি, নিয়ে যাও, চন্দনবাবুর জন্যেও একটা কিনেছি.. বাচ্চা মেয়ের বাচ্চা বর।’

শিল্পীর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে।

কাজল বলল, ‘তুই একটু কেঁদে নে। আমি আসছি।’

আসল কথা কাজলের খুব হাসি পেয়েছে। শোবার ঘরে হাসতে গিয়ে দেখল তীর্ণা আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। অনীকের ঘরে হাসতে গিয়ে দেখল একটা আরশুলা ঘুরছে, গঙ্গাপ্রসাদের পড়ার ঘরে ডাঁই করা বই, দেওয়ালের তাকে, খাটে চেয়ারে-টেবিলে, বসবার জায়গাই নেই, তার হাসবার জায়গা! কাজল অবশেষে বাথরুমে গিয়ে পেট খুলে হাসল।

মুখে চোখে জল থাবড়ে যখন বসার ঘরে গেল, দেখে শিল্পী সোজা হয়ে বসে কাগজ পড়ছে। টেলিগ্রাফ, স্টেটসম্যান, এশিয়ান এজ, গণশক্তি, আনন্দবাজার, আজকাল, বর্তমান— সব।

কাজল বলল, ‘কী রে? পলিটিক্সে জ্ঞান সংগ্রহ করবার চেষ্টা করছিস?’

‘পা—গল!’ শিল্পী বলল—‘কাগজ থেকে পলিটিকসের জ্ঞান সংগ্রহ হয়? কটা সুইসাইড, কটা ধর্ষণ, কটা মাডার, কটা গণপিটুনি তার একটা স্ট্যাটিসটিক্স নিচ্ছিলুম।’

‘আর হাওয়ালা! স্ক্যাম?’

‘ওর হিসেব নেওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তা তোমাদের বাড়ি এত্ত কাগজ কাজলদি!’

কাজল বলল— ‘কী করি বল— আমি “আনন্দবাজার” ছাড়া পড়ি না, আমার বর “স্টেটসম্যান” ছাড়া পড়ে না, আমার ছেলে পড়ে “টেলিগ্রাফ” আর “আজকাল” ব্যালান্স করে, মেয়েটার চাই “বর্তমান”। “এশিয়ান এজ”টা শস্তায় পাই, আর “গণশক্তি”টা ছেলেমেয়ের এক বন্ধু আছে গোপাল, সে গছায়। আমরা যে যার বিল দিই ভাই, স্বামী-বাবাকে ট্যাক্স করি না।’

‘স্বামী-বাবা কে?’

‘কে আবার? আমাদের হোটেল-মালিক। আমার স্বামী, আমার ছেলেমেয়েদের বাবা।’

‘উঃ, পারোও বাবা, কাজলদি। আমি ভাবলাম তোমাদের গুরু-টুরু কেউ হবেন। আজকাল সব ঘরে ঘরে গুরু হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, এককালে ঘরে ঘরে গোরু থাকত, এখন তাতে একটা করে হ্রস্ব উকার যোগ হয়েছে, যুগ বদলালে যোগ তো হবেই।’

‘কিন্তু কাজলদি, গুরু আগেও ছিল, আমার মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি, সব আগের জেনারেশন গুরুদীক্ষা নিয়েছিলেন।’

‘ঠিকই বলেছিস। তবে আগে গোরুটাও ছিল, এখন সেটা আর থাকছে না, এখন মাতৃদুগ্ধ খেতে হবে বড় হয়ে গেলেও, বুড়ো হয়ে গেলেও, কিংবা হরিণের দুধ। গোরুর দুধ আর এরা খেতে দেবে না।’

এবার শিল্পী আসল প্রসঙ্গে আসে।

‘চন্দনকে স্টাডি করবার জন্যে তুমি আর কদ্দিন সময় নেবে? গাড়ি ছাড়া আমার কিন্তু খুব অসুবিধে হচ্ছে কাজলদি।’

‘বেশ তো চন্দনকে বলে দিচ্ছি, গাড়িটা তোকে দিয়ে দিতে।’

‘বাপ রে, এত দূর!’

‘এতই দূর।’ বলে কাজল আর এক টিপ ভাজা মৌরি মুখে পোরে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress