মেয়েদের কথা
গল্পটা বলার আগে আপনাদের কিছু কথা বলতে চাই। আমাদের দেশের রাজা রামমোহন রায় আর ঈশ্বর চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এই দুজন মহান মানুষ ইংরেজদের সহায়তায় নারীদের জন্য বিশেষ দুটো আইন পাশ করে দিয়ে গেছেন। এনারা ছাড়া বিভিন্ন পুরুষ স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিভিন্ন লেখক কবি তাদের বর্জ্রগম্ভীর আওয়াজে ও কালজয়ী কলমে আহ্বান জানিয়েছেন নারী শক্তির।
স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর নারীরা যেখানে বিদেশী আদব কায়দায় কথা বলে বা পোশাক পড়ে তখন তাদের নিয়ে বাড়ির মেয়ে মহলে , পাড়ার চায়ের দোকানে এমনকি উচ্চশিক্ষিত মানুষের দ্বারা সমৃদ্ধ কোনো দপ্তরেও বিকৃত কিছু কথা বার্তা ওঠে।
রাত করে বাড়ি ফেরা, ছেলে বন্ধুর সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা – এই তো পরিবারের মুখে চুনকালি দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। এবার বলি এসব কথা আমার আগে আরও অনেকের মুখেই শুনেছেন। কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গেছে সেটাও বুঝি।
এমনকি এটাও জানি যে যখনই মেয়েদের নিয়ে কোনো মেয়ে আওয়াজ তোলে তখন সে আমাদের চোখে “so called feminist” হয়ে যায়। একদম সিলমোহর মারা। এরপর সে যতই বোঝানোর চেষ্টা করুক যে আমার এই বিদ্রোহ শুধুমাত্র পুরুষ জাতির বিরূদ্ধে নয়, এই বিদ্রোহ সেই সব নারীদেরও বিরূদ্ধে যারা নিজে মেয়ে হয়ে ও অন্য একটা মেয়ের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে তাদের ভাষা আর ব্যবহারের দ্বারা। এর শুধুমাত্র আমিই নই – মেয়েদের সামাজিক , পারিবারিক , আর্থিক এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে যে যে প্রশ্ন তুলবে তারা তাদের সঠিক দাবি কিছুতেই বোঝাতে পারবে না। আসলে কেউ তা বুঝতে চায় না।
এই গল্প সেই একবিংশ শতকের মুম্বাইবাসী উমার। অনন্তর সাথে বিয়ের পর সে মুম্বাই চলে যায়। সরকারী দপ্তরে খুব বড়ো একটা পদে অনন্ত চাকরী করে। তাই বিয়ের আগের স্কুলের চাকরি ছেড়ে সাতাশ বছরের উমা চলে স্বামীর নতুন সংসারে। অনন্তর একমাত্র অর্থাৎ উমার ননদ তার বিয়ে হয়ে গেছে বছর পাঁচেক আগে। উমার শ্বশুর মশাই বহুদিন আগেই মারা গেছেন, আর শ্বাশুড়িমা নিজের স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে উমাকে তাই বিয়ের পর নতুন সংসারে দিনের প্রায় দশ ঘন্টা একাই কাটাতে হয়। নতুন জায়গা কারোর সাথে তেমন পরিচিতি নেই যে দুটো কথা বলবে।
বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে অনন্তকে বলে একটা প্রাইভেট স্কুলে জয়েন করলো উমা। এদিকে অনন্তর মার কানে খবরটা যেতেই বিনোদিনী দেবী জ্বলে পুড়ে উঠলেন। উমার বাপের বাড়ি ফোন করে তার মা কে বললেন তাঁর মেয়ের সংসারে কোনো মন নেই, শুধু বাইরের চিন্তা। বিয়ের পর কোথায় স্বামী সেবা করবে তা না করে অন্যের বাচ্চাকে শিক্ষা দেওয়ার খুব তাড়া লেগেছে। এই নিয়ে অনন্তর সাথে দুএকটা কথায় উমার ঝামেলা হলেও আবার সব ঠিক হয়ে যায়। সেও আর চাকরিটা চাড়ে নি । প্রায় দেড় বছর চাকরি করার পর উমা চাকরি ছাড়ল কারণ তার গর্ভে এক ছোট্ট উমা তখন বড়ো হচ্ছিল। এবারে কিন্তু কাউকে বলতে হয়নি, উমা জানে তার সংসারে ঠিক কখন কি প্রয়োজন, কখন কি করলে তার নিজের এবং অনন্তর দুজনের পক্ষেই ভালো।
বিনোদিনী দেবী নিজের স্বামীর ঘর চিরতরের জন্য ছাড়তে নারাজ কিন্তু ছয় মাস পর পর নিজের ছেলে মেয়ের সাথে দেখা করতে যান। মেয়ে হয়েছিল বাবার মত তাই মায়ের কোনো কথা সে বেশি গুরুত্ব দিত না কিন্তু ছেলে অর্থাৎ অনন্ত যেনো বিনোদিনী দেবীর কার্বন কপি। মায়ের কথাই শেষ কথা তার কাছে। তাই মা মুম্বাইতে যাওয়ার পর থেকেই উমার সাথে মনোমালিন্য টা একটু বেশিই বেড়ে যেত।
মা আর ছেলে অর্থাৎ বিনোদিনী দেবী আর অনন্ত চেয়েছিল প্রথম সন্তান ছেলে হোক । কারণ ছেলে বংশের প্রদীপ, সেই তো বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই একবিংশ শতকে নিজের সুস্থ সন্তানের কামনা বা সেই সন্তানের সম্পূর্ণ জীবনের সার্বিক মঙ্গল কামনার পরিবর্তে অনন্ত আর তার মা বংশ প্রদীপ চাইছে। কিন্তু তাদের সে আশা পূর্ণ হল না। ঘরে এলো রীতি, ফুটফুটে একটি মেয়ে।
উমাকে এর জন্য খুব বেশি কথা শুনতে হয় নি কারণ তখনও অপশন ছিল। মায়ের কথায় একবছরের মাথায় দ্বিতীয় সন্তানের জন্য উমাকে বলতে লাগল অনন্ত। ওদিকে উমার ননদ, তারও প্রথম সন্তান মেয়ে । কিন্তু তা সত্বেও বিনোদিনী দেবী কিন্তু মেয়েকে দ্বিতীয় সন্তানের জন্য কোনো রকম বাধ্য করেন নি। কারণ সেতো নিজের মেয়ে, বৌমা তো নয়।
এর মধ্যে উমার বড়ো একটা অসুখ ধরা পড়ল। কয়েক মাসের মধ্যে দুবার অপারেশন করতে হল। অনন্ত সকালে বেড়িয়ে যায় , সারাটা দিন নিজের অসুস্থ শরীর রাত্রেও মেয়ের কান্না। উমা হাঁপিয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করে। কিন্তু এই যন্ত্রণা তো শুধুমাত্র শরীরের । গোটা হৃদয় জুড়ে যে যন্ত্রণা তার হদিস কেউ রাখে না। অনন্তকেও বলতে পারে না। কারণ সেই ব্যথা অনন্তর থেকেই পাওয়া।
সন্ধ্যা হোক বা রাত অফিস থেকে ফেরার পর অনন্ত নিজের মতো সময় কাটায়, টিভি দেখা, বই পড়া বা ফোনে কারোর সাথে চ্যাট। উমা হয়তো তখন রান্না ঘরে রাতের খাবার তৈরি করছে। এই সময় পাশে নিজের মনে খেলতে থাকা রীতি যদি কোনো কারণে কেঁদে ওঠে অনন্ত একবারও ফিরে তাকায় না। নিজের সন্তান , নিজের শরীরের অংশ তবুও কি ভীষণ অবহেলা । দুএকবার গভীর অভিমানে অনন্তকে উমা বলেই ফেলেছিল কিন্তু অনন্ত সেটা কায়দা করে এড়িয়ে গেছে বারবার।
পরপর দুটো অপারেশন হওয়ার পর উমা খুব রোগা হয়ে যায়। দেখে যেন মনে হয় সবসময়ই অসুস্থ। এর ছয় মাসের মাথায় অনন্তর মা যায় তাদের কাছে। তিনি ফিরে আসতেই আবার শুরু হয় ঝামেলা, অনন্ত জোর করতে থাকে কারণ দেখায় বয়স হচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে নিতে হবে। উমা বলেছিল শরীরটা আর একটু সেরে উঠুক তারপর ভাবা যাবে কিন্তু ছেলে সন্তানের জন্য পাগল অনন্ত কিছুই শোনে নি।
ভগবানের কি অশেষ লীলা ন’মাস পর উমার দ্বিতীয় সন্তান হল। রীতির ছোটো বোন বীথি। ঘরে লক্ষ্মী এলো কিন্তু একমাত্র উমা ছাড়া আর কারোর মুখেই কোনো হাসি নেই।
গল্পটা এই টুকুই আমার জানা ছিল। এর পর উমার কি হল, সেকি তার দুই কন্যা সন্তান নিয়ে সুখে স্বামীর ঘর করতে পারলো নাকি বিবাহ বিচ্ছেদই হল তার শেষ পরিণতি? কিছুই জানা নেই আমার।শুধু এটুকু জানি যদি অনন্ত তার মায়ের কথা না শুনত বা বিনোদিনী দেবী যদি নিজের খারাপ মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারতেন তাহলে হয়ত উমাকে এতো কষ্ট ভোগ করতে হত না, কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য হীনমন্যতায় ভুগতে হত না, নিজের সন্তানের বাবার কাছে এই প্রশ্নটা করতে হত না যে – “কন্যা সন্তান বলেই কি আমার রীতির ভাগে এই অবহেলা?”
এখানে উল্লেখ্য – বিনোদিনী দেবী নিজের মেয়েকে কিন্তু পুত্রসন্তানের জন্য কোনরকম চাপ সৃষ্টি করেন নি। সরকারী চাকুরে অনন্ত শিক্ষিত সমাজের প্রতীক কিন্তু তার ঘরেই অবহেলিত নারী। বিনোদিনী দেবী নিজে মেয়ে হয়েও আর এক মেয়ের প্রতি তার নিষ্ঠুর অবিচার এবং পিতা অনন্তর নিজ কন্যার প্রতি অবহেলা। এই হল আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান। এই কাহিনী শুধু আমার গল্পের নয় – প্রতিটি বাড়ির ইঁট , বালি, সিমেন্টে লেগে থাকা জীবন্ত চরিত্র এগুলো।