মেঘে ঢাকা তারা : 07
নীতা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একবার প্রকাশকের দোকানে যাবে বাবার কপিটা দিয়ে আসতে। কাদম্বিনীও সনতের সঙ্গে গীতাকে দেখতে গেল। কদিন থেকে তারও শরীরটা ভালো নেই। বারে বারে মাকে খবর পাঠাচ্ছে এর ওর মুখে।
মন্টু বলে ওঠে—আর একটু বসবে না মা? এখনও ছটা বাজতে দেরি আছে।
গীতার ওখানেও যে যেতে হবে বাবা। এতদূর এসে দেখা করে যাব না?
মন্টু চুপ করল। বেশ তাহলে এসো আর একদিন।
—হ্যাঁ।
কাদম্বিনী ওখান থেকে বের হয়ে সনতের বাড়ির দিকে চলেছে।
নীতা কাজ সেরে স্টেশনে ফিরবে। মাও গীতার বাসা থেকে এসে স্টেশনে পৌঁছোলে, তারা দুজনে বাড়ি যাবে, নীতা ট্রাম লাইনের দিকে এগিয়ে চলে।
কাঁধের ব্যাগে বাবার বই-এর প্রুফ-কপিগুলো। সনতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে নীতা- মাকে আটটা সাতাশের গাড়িতে স্টেশনে তুলে দেবে।
নীতা-গীতার ওখানে যেতে একটু বিব্রত বোধ করে। সেই দুপুরের ঘটনার পর থেকে গীতার ওখানে আর যায়নি। যেতে মন চায় না নীতার। সেই ঘটনা মনে পড়লে নিজের কাছে দুঃসহ অপমান বোধ করে, সম্মানে বাধে তার। এমনিতে অসহায় সে, কিন্তু কোথায় যেন দুর্জয় তার আত্মশক্তিতে একটা নিজের বিশ্বাস আর দৃঢ়তা চাপা আছে—বিন্দুমাত্র ঘা খেয়ে জেগে ওঠে সেই আত্মসম্মানী মেয়েটি। সেখানে আপস করতেও যায় না।
সনৎও তা জানে। তাই আর যেতে অনুরোধও করেনি তাকে।
নীতার কথায় মুখ তুলে তাকাল। নীতা বলে ওঠে—কলেজ স্ট্রিটে একটু প্রকাশকের দোকানে যেতে হবে। দু-চারখানা বইও কিনব। স্টেশনে মাকে তুমি পৌঁছে দিও, সামনেই অপেক্ষা করব আমি। বুক স্টলের পাশেই।
—বেশ।
সনৎ জানে ওকে টলানো যাবে না। তাই চুপ করে সম্মতি দিল মাত্র। নীতা এগিয়ে যায় কলেজ স্ট্রিটের দিকে। কোথায় নীতার মনে একটা কাঠিন্য আছে যেখানে সনৎ ঘা- খেয়ে ফিরে আসে বারবার।
প্রকাশক ভদ্রলোক নীতাকে আসতে দেখে খাতির যেন একটু বেশি মাত্রাতেই করে! সমস্ত কপিটা ইতিমধ্যে পড়ে দেখেছে। সস্তায় মন্দ জিনিস সে পাচ্ছে না। তাছাড়া কয়েকটা পরিচিত স্কুলে বই ধরাবার প্রতিশ্রুতি এসেছে। মাধববাবুকে অনেকেই চেনেন শিক্ষকরা।
নীতা আশাভরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, দোকানের আলমারিতে থরে থরে সাজানো বই পত্র। খদ্দেরদের আনাগোনা চলেছে। কত দূর-দূরান্তরে লোক নিয়ে যাচ্ছে বই। চিন্তার ক্রমবিকাশ চলেছে এইভাবেই।
বুক কাঁপছে, দুরদুর, মাধববাবুর জীর্ণ মুখখানা ভেসে ওঠে। থরে থরে সাজানো রয়েছে যেন বাবার বইগুলো! একটা হাসি-ভরা বৃদ্ধের চোখে জীবনের আশাপূরণের তৃপ্তি—আনন্দ!
প্রকাশকই বলেন—বই করেছেন মন্দ নয়। আর কি লিখছেন? লিখতে বলবেন তাঁকে।
—মাধববাবুর একটা সই যে দরকার!
দোকান সরকার একটা কনট্রাক্ট ফর্ম ভাউচার এগিয়ে দেন তার দিকে।
প্রকাশক ভদ্রলোক বলে ওঠেন—জানেন তো, একটা ফর্মালিটি আর কি। নতুন গ্রামার-এর কথাটা বলবেন। পুরো কপি রেডি করতে হবে। নিন ভাউচারটা।
—আমার সই করলে হবে? না হয় কালই সই করিয়ে এনে দেব।—
তাই হবে। নতুন পরিচয় কি না, তবে ওঁর লেখা আমাদের ভালো লেগেছে। বেশ খেটে লিখেছেন। সামান্য কিছু অ্যাডভান্স আমরা নতুন গ্রামার বাবদ এখন দিই। পরে রয়্যালিটি থেকে ওটা বাদ যাবে।
নীতা একটু অবাক হয়ে গেছে। এই মুহূর্তেই যেন বাবাকে খবরটা দিতে পারলে বাঁচত সে। যেন কি এক রাজ্যে জয় করার সংবাদ নিয়ে চলেছে সে!
—কবে নাগাদ ও বই বেরোবে?
আগ্রহ ফুটে ওঠে ওর কণ্ঠে। প্রকাশক ভদ্রলোক ওর আন্তরিকতায় প্রথম দিন থেকেই মুগ্ধ হয়েছিলেন; অনুমানও করেছিলেন বাবার জন্য ওর ভালোবাসার পরিমাণ। একটু হেসে জবাব দেন।
—কাল প্রেসে দেব, মাস তিন-চারের মধ্যেই বের হবে আশা করছি। জানেন তো কাগজের অবস্থা; সব যেন কালো বাজারে ঢুকছে। তবু ব্যবসা হবে। কাল ওটা সই করিয়ে আনবেন— দরকার হয় টাকাটা নিয়ে যান। সমর, ক্যাশ থেকে একশো টাকা দিয়ে একটা চালানে সই করিয়ে নাও।
নীতা যেন এই ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারে না। মনে হয়, সে যেন কি একটা স্বপ্ন দেখছে। মনে হালকা একটা সুর জাগে—বিকালের পড়ন্ত বেলায় আজ মনে হয় শরীরে মনে কোনো গ্লানি নেই তার। সম্পূর্ণ সুস্থ আজ সে। দেহে-মনে সবদিক থেকে আজ সুন্দর মনে হয়।
দাদার কথা মনে পড়ে। শঙ্করের উপর কেমন যেন বৃথা রাগ করে ওই কড়া কথাগুলো বলেছিল সে। আজ সবাইকে ভালো লাগে। ওদের সকলকে।
বাবার খুশির আনন্দে মন তার হালকা হয়ে গেছে। সবই তাই সহজ ঠেকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় স্টেশনের দিকে। কি খেয়ালবশে চার পয়সার চিনাবাদাম কিনে নেয়—একটা একটা করে তাই ছাড়িয়ে চলেছে। বেশ লাগছিল তার।
পায়ে পায়ে মনের খুশি উপচে পড়ে নীতার
গীতা কিছুদিন থেকেই দেখছে সনতের মনে কোথায় একটা পরিবর্তন জেগেছে। আপিস থেকে ছুটি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে, অন্য কোনো পথের সন্ধান করছে সে। ভয় হয় চাকরিই ছেড়ে দেবে নাকি। বাইরের ঘরেই কাটায় বেশি সময় বইপত্র নিয়ে। ডেকেও সাড়া পায় না এমনি তন্ময় হয়ে ডুবে যায় কাজে।
—ডাকছ?
গীতা একটু রাগত স্বরেই বলে ওঠে—কানে শুনতে পাও না?
গীতা বারবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে বিরক্ত হয়ে উঠেছে।
কি লিখছিল সনৎ, একগাদা বইয়ের থেকে কি যেন মহাসমস্যা খুঁজে উদ্ধার করতেই ব্যস্ত। বহু কষ্টে চিন্তাধারার খেই মেলাবার চেষ্টায় তন্ময় হয়ে আছে। এই সময় বাধা পড়তে ওর দিকে তাকাল। গীতার ডাকে বিরক্ত হয়ে ওঠে।
—অসময়ে ডাকাডাকি না করলেই পারো! দেখছ কাজ করছি।
হাতের কলম ফেলে দিয়ে বেশ চড়া সুরেই বলে—বলো, কী বলছিলে?
গীতার মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়—থাক, তোমার শুনে কাজ নেই।
চলে গেল। গীতা আরও কি বলতে যাচ্ছিল, বলল না।
কোথায় যেন একটা অদৃশ্য কালো ছায়া সংসারে এসে পড়েছে। ক্রমশ গাঢ়তর হচ্ছে, পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে ঝড়ের মেঘ। সেই শান্ত-মিষ্টি দিনগুলো গীতার মনে আজ কেমন হাহাকার আনে। সেদিনের সনৎ আজ নিঃশেষে বদলে গেছে, গীতা বেশ বুঝতে পারে সনতের কাছে সে একটা বোঝা হয়ে উঠেছে।
ভাবনাটা গীতার মনে ক্রমশ একটা বেদনার সাড়া আনে। নীরব সেই বেদনা। শূন্য ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে চারিদিক।
এমনি দিনে মাকে আসতে দেখে যেন সাহস পায় সে। কাদম্বিনী ওর বাসায় আসেনি। এখন এসে এদিক-ওদিক-সেদিক—এ ঘর সে ঘর দেখে; ঘরকন্না গেরস্থালির কথাও ওঠে। সনৎ বের হয়ে গেছে দোকানের দিকে, অতিথি সৎকারের আয়োজনেই বোধহয়।
গীতা মায়ের কথায় মুখ তুলে তাকাল—হ্যাঁরে, সনৎ চাকরিতে জয়েন দিয়েছে?
—না! ছুটি নাকি এখনো শেষ হয়নি। কে জানে বাপু, কি ওর মনে আছে। আমার তো ভয় করে মা।
কাদম্বিনী মেয়ের কথার সুরে কি যেন একটা অমঙ্গলের আশঙ্কা করে গীতার দিকে তাকিয়ে থাকে। মা দু’চোখ মেলে মেয়ের মুখে কিসের সন্ধান করে।
—হ্যাঁ-রে, ঠিকমতো বনি-বনা-
মেয়ের পক্ষে এটা একটা যেন দুঃসহ লজ্জার কথা। মায়ের কাছেও কোনো মেয়ে এত বড় অক্ষমতার কথা স্বীকার করে না। জবাব দেয় গীতা—না, না। তবে কি জানো, বড় একরোখা লোক।
সনৎ ঘরে ফিরেছে। তাকে শুনিয়েই কাদম্বিনী বেশ একটু অবাক হয়ে গলা তুলেই জবাব দেয়—অবুঝ হলে চলবে কেন বাছা। বিয়ে-থা করেছে, আজ বাদ কাল পুষ্যিপোত্রও এক-একটি বাড়বে। এখন হুট করে কিছু আর করা ঠিক নয়। চাকরি-বাকরি তো করতেই হবে! তুই ভালো করে বুঝিয়ে বলিস বাপু
গীতা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ বিরক্তিভরা কণ্ঠেই বলে ওঠে গীতা—জানি না। যে যা ভালো বোঝে করুক।
গীতা নিজেই মায়ের এঁটো বাসনগুলোয় জল বোলাতে থাকে। রান্নাঘরে তখনো রাজ্যের কাজ বাকি। দু-বালতি জল দিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে থাকে। এসব ঠিক কাদম্বিনীর ভালো ঠেকে না। কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব দুজনের মধ্যে।
মায়ের চোখের সামনে কেউ কিছু এড়াতে পারেনি। কাদম্বিনীও ভাবেনি সনতের মনে এমনি ঝড় উঠবে পরে, এতদিন পরও তার জের চলবে।
রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এসে মা বলে ওঠে—হ্যাঁ রে, একটি ঝি রাখিস না কেন? বলছিস শরীর ভালো নেই।
গীতা বেশ চড়া সুরেই জবাব দেয়—আমার গতরে ঘুণ ধরে না মা। গতরই তো দেখেছে আমার। আর কোনো গুণ তো নেই, তাই গতর খাটিয়েই খাই পরি। অন্য গুণ—লেখাপড়া জানা চাকরে যদি হতাম তাহলে অন্য ব্যবস্থা হতো।
মা যেন বুঝতে পারে এগুলো গীতার কথা নয়। সনতের উপর রাগের কথা। তারই নিক্ষিপ্ত বাণগুলো কুড়িয়ে নিয়ে গীতা এক-একটি করে তাক বুঝে ছুড়ে মারছে—শব্দভেদি বাণ।
এ ঘরে সনৎ বুঝতে পারে ওর উদ্দেশ্যে এইসব কথা শোনানো। মনে মনে রাগই হয় তার, বিশেষ করে মায়ের সামনে এগুলো না তুললেই পারত গীতা। ঝিকে তো গীতা নিজেই জবাব দিয়েছে।
কিন্তু এ নিয়ে কথা তুললেই কথা বাড়বে। তাই চেপে গেল সে।
সনৎ স্টেশনে কাদম্বিনীকে তুলে দিয়ে আসে। বিশেষ কোনো কথা হয় না। কাদম্বিনী এখানে এসে সনতের ব্যবহারে খুব যে খুশি হয়নি এটা বেশ বুঝতে পারে সনৎ।
নীতার চোখে-মুখে খুশির হাওয়া। বাবার কনট্রাক্ট ফরমটা দেখায় সনৎকে। সনত্ত খুশি হয়। কাদম্বিনীও শোনে কথাটা। নীতা বলে চলেছে—দেখো, কাজ করে এলাম একটা। বাবার নতুন বই-এর কনট্রাক্ট।
সনতের মনটা ভালো নেই। বাড়িতে কেমন যেন আবহাওয়াটা বিষিয়ে উঠেছে। তবু ওই কথাগুলো ভালো লাগে, মাস্টারমশায় খুব খুশি হবেন।
গীতার মনের জ্বালায় জ্বলছে ওই বাড়ির আলো বাতাস। ফিরতে যেন মন চায় না ওখানে সনতের। নীতার কথাগুলো শুনছে আনমনে।
মাধববাবুর বই ছাপা হচ্ছে। নীতার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারই চেষ্টায় সম্ভব হয়েছে এসব। কোন অমৃতদাত্রী নারী ও
নিজের জীবনকে শুধু ব্যর্থ করে রেখে দিল। আশপাশের চারিদিকে তারই দেওয়া সুরভি সৌরভ। যেন অভিশাপগ্রস্ত কোনো নারী ও জীবনের সঞ্জীবনীমন্ত্র সে জানে, শেখাতে পারে, তাই দিয়ে বাঁচবে অন্যজন। কিন্তু তার নিজের জীবনে যে মন্ত্রসাধন ব্যর্থ হয়ে গেছে।
কাদম্বিনী খুশি হয়—কত টাকা দেবে?
টাকাটাই তার কাছে প্রশ্ন, সে চাকরি করেই হোক, আর লিখেই হোক। আর গান গেয়েই হোক। সবকিছু মূল্য তার কাছে টাকা-আনা-পাই-এ।
হাসে নীতা—বই বিক্রি হলে আরও দেবে। এখন একশো আগাম দিয়েছে! ট্রেনের দিকে এগিয়ে যায় তারা প্ল্যাটফর্মের ওদিকে। সনৎ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
গীতা কিছুদিন আগেও দেখেছিল টাকাটা। একটা কানের গহনা গড়াবার শখ, মাকেও ডিজাইনটা দেখিয়েছে। দোকানে দেবার জন্য টাকাটা খুঁজতে গিয়ে অবাক হয়—এ বাক্স ও সুটকেস এখান-ওখান হাতড়েও পায় না। টাকাটা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। ঝি-চাকরও কেউ নেই যে সরিয়ে নেবে। তালাচাবিও ঠিক রয়েছে! তবে গেল কোথায় টাকাটা! কি যেন ভাবছে সে।
সনৎ ওদের স্টেশনে তুলে দিয়ে ফিরে আসছে। মনে মনে কোথায় একটা বেদনা অনুভব করে। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট অসহায় বোধ করে আজ সনৎ প্রচণ্ডভাবে। কোনো কিছুই করণীয় যেন নেই। একা সে। মাধববাবুর একটার পর একটা টেক্সট বুক আজ ভালো দোকান থেকে ছাপা হচ্ছে। খ্যাতি-সম্মানও পাবেন তিনি।
মাধববাবুর মতো স্থবির লোকও আজ নিজেকে প্রকাশ করবার পথ পেয়েছেন! আর সে? হেলায় হারিয়েছে মহত্তম জীবনের সব আমন্ত্রণ। কিসের মোহে সে জানে না! নিজেকে ব্যর্থ করেছে সে—নষ্ট করেছে সব সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। এইসব আজ চোখের সামনে বড় হয়ে উঠেছে।
বাড়িতে পা-দিয়ে দেখে, ঘরের মেঝেতে গীতা বসে আছে গুম হয়ে, সুটকেস-বাক্স হাঁটকানো, মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে জিনিসপত্র জামা-শাড়ি। সনৎ ঘরে পা-দিয়ে একটু অবাক হয়।
গীতা কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে ওকে—দেড়শো টাকা ছিল এখানে, কী হল?
সনৎ চমকে ওঠে। নীতাকে টাকা দেবার খবরটা কি তবে কোনরকম জানতে পেরেছে! একটু সামলে নিয়েই বলে—মন্টুর অসুখ, ওষুধপত্র কিনতে হচ্ছে, তাই নীতাকে দিয়েছি!
দপ করে জ্বলে উঠে গীতা—মিথ্যা বলতে একটু লজ্জা হল না? নীতাকে উপহার দিয়েছ বলো! পুরনো প্রেম কি সহজে ভোলা যায়!
পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে ওঠে সনতের, এই জঘন্য মন্তব্যে। চুপ করে তাকিয়ে থাকে; বারবার তাকে এই উপলক্ষ তুলে ছুতোয়-নাতায় অপমান করতেও দ্বিধা নেই ওর।
স্ত্রী। একমাত্র এই অধিকারেই ওর মনের সব কমনীয়তা ও সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্র অনুভূতিকে ও নিঃশেষে গলা টিপে হত্যা করবার দাবি রাখে। ওর যুক্তিসঙ্গত অন্য কোনো কারণই পায়- নি সে। জবাব দেয় সনৎ, বেশ কঠিন হয়ে ওঠে ওর কণ্ঠস্বর। আজ সেও প্রতিবাদ জানাতে চায়। প্রয়োজন ছিল তাই দিয়েছি। আমার টাকা, খরচ করবার স্বাধীনতা আমার নিশ্চয়ই আছে!
গীতা চটে ওঠে, আরও গলা চড়িয়ে বলে—কথাটা বলতে একটু লজ্জাও বোধ হল না?
-–কেন লজ্জার কোনো কাজই করিনি।
—কাল একটা বেউশ্যেকে টাকা দিয়ে এসেও ওই কথা বুক ফুলিয়ে জাহির করবে? তাও যদি পাঁচ-সাতশো রোজগার করতে।
গীতার জিভ দিয়ে জ্বালাধরা কথা বেরোচ্ছে গলগল করে। চুলগুলো খুলে লুটিয়ে পড়েছে। ফরসা টকটকে রঙ লালচে হয়ে উঠেছে। যেন ফণা মেলে দাঁড়িয়েছে এক কালনাগিনী, চোখে তার হিংসার অগ্নিজ্বালা, জিভে গরলের তীব্রতা। এই দর্পিণী রূপ দেখেনি সনৎ—ওর অন্তরের সমস্ত পুঞ্জীভূত বিষ মুখে চোখে এসে জমেছে। অসহ্য হয়ে উঠেছে এই পরিবেশ।
—থামবে তুমি! বাধা দেয় সনৎ।
আজ সব কিছুর জন্য সে তৈরি হয়ে উঠেছে। এমনি করে তিলে তিলে সহ্য করবে না সে গীতার সমস্ত অভিযোগ। দরকার হয় আজ অন্য পন্থাই নেবে। তরা জন্য যে কোনো মূল্য দিতে হোক না কেন, প্রস্তুত সে। অসহ্য হয়ে উঠেছে তার এই প্রহসন।
গীতা ওর কথার সুরে ঘাবড়ে যায়।
সনৎ বলে চলেছে—এমনি অসংযত কথা বললে তার ফলও ভালো হবে না। ঢের সয়েছি। সহ্যের একটি সীমা আছে। সাবধান করে দিচ্ছি। টাকা গেছে, টাকা আবার ফিরে পাবে। কাকে হিংসা কর? কেন? ছিঃ!
সনৎ বের হয়ে গেল। বাইরের ঘরে গিয়ে বসেছে।
কাগজপত্র বই এদিক-ওদিক ছড়ানো। মেঝেতে জমা-করা একগাদা ছেঁড়া কাগজের জঞ্জাল, সিগারেটের কুচি। এসব যেন ইচ্ছে করে ঝাঁট দেয় না গীতা। পড়াশোনায় মন দিতে পারে না; হু-হু জ্বলছে আগুন। সনতের মনে হয় জীবনে এই নীচতার প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। একজনকে মনে পড়ে সংসারের জন্য সে যথাসর্বস্ব ত্যাগ করেছে। কিন্তু জানে না যাদের জন্য এত ত্যাগ সে করেছে, কি তাদের পরিচয়। নীতার সম্বন্ধে তারা কি ভাবে। মনের কোণে তাদের নীতার জন্য এতটুকু সম্ভ্রমবোধও নেই।
ওরা জানে ওরা নিজের অন্তরের দিক থেকে নিঃস্ব কাঙাল। তাই পরিপূর্ণ মানুষের সেই দুর্লভ গুণ যার অন্তরে আছে, নিঃশেষে অপরকে ভালোবাসার মন্ত্র যে জানে, সেই সম্পদকে—নীতার মনের সেই ঐশ্বর্যকে, হিংসা করে ওরা। তাই গীতার এই হীন ধারণা নীতার সম্বন্ধে।
নিজের চারিপাশে একটা নাগপাশের বন্ধন অনুভব করে সনৎ। আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। পদে পদে অপমানিত করেছে তাকে। যেখানেই মুক্তির পথ খুঁজেছে, পেয়েছে শুধু বাধা আর বাধা। সনৎ আজ বাধার দুস্তর পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মাধববাবুর মনে আনন্দের জোয়ার। নীতার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। চুক্তিপত্রে সই করে বৃদ্ধ যেন আজ আনন্দে উপচে পড়ছেন। ঋণী তিনি। নীতার কথা মনে হয় বারবার।
কাদম্বিনী স্বামীর কথায় ফিরে চায়—ওর গুণ তুমি জানো না বড়বউ! ভগবান সব গুণ ওকে দিয়েছে।
কাদম্বিনী গীতার দুঃখ ভোলেনি। তখনও মনে মনে গজরাচ্ছে। গীতার সংসারে দুঃখের কালো ছায়াটা মুছে যায়নি, তার জন্য সে নীতাকেই দায়ী করেছে। মাধববাবুর কথায় জবাব দেয় কাদম্বিনী—হ্যাঁ, খুব গুণবতী মেয়ে তোমার!
কথাটায় বিদ্রূপের জ্বালা ফুটে ওঠে। মাধববাবুর মনের অবস্থা অন্যরকম। ওদিকে কান দেবার সময় নেই। বলে ওঠেন—প্রেসে দেবার পর যেন প্রুফ পাঠায় নীতা, আর একটু কারেকশন করতে হবে। বলে দিবি ওদের।
—আচ্ছা!
নীতা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, মায়ের মুখ-চোখ থমথমে ভাব। স্টেশন উঠে অবধি ভালো করে কোনো কথাই বলে নি মা; কোথায় যেন কি একটা ঘটেছে মায়ের মনে।
ঠিক অনুমান করতে পারে না। মা কেমন এড়িয়ে চলছে তাকে।
সকাল বেলায় নীতা স্নান খাওয়া সেরে আপিসে বের হচ্ছে। স্টেশনে যাত্রীদের ভিড়। আপিসের বাবুরা জমেছে স্টেশনে, হাঁ করে তাকিয়ে আছে কখন ট্রেন আসবে। আছে স্কুল-কলেজের ছাত্র ফেরিওয়ালার দল। গুপি মিত্তিরও অনেক পথ ঘুরে শেষকালে চাকরির সোজা পথে এসেছে এইবার।
আপিস করছে। হাতে টিফিনের কৌটা—ছোট তোয়ালে, বাজার করে ফিরছে সন্ধ্যাবেলায়। উদ্ধত শৌখিন যুবকটির মনে মনে এসেছে পরিবর্তন। সেই উড়ু উড়ু ভাব আর নেই।
নীতাই প্রশ্ন করে—আপিস চলেছ?
— হ্যাঁ!
বদলেছে ওদের জীবন। মাপকাটা ছকের মধ্যে যেমন করেই হোক না এনে ঢুকিয়ে দেবে এই নিয়ম। গুপি মিত্তিরের মতো বেপরোয়া মনকেও সংসারের চাপ দুরস্ত করে ফেলেছে। ওরা মাথা নুইতে বাধ্য হয়েছে।
চারিদিকে সমাজ জীবনে অর্থনৈতিক জীবনে সেই ছক-বাঁধা; তার বাইরে মাথা ঠুকেও লাভ নেই। একদিন সনাতন জীবনে ওরা অল্পায়ুর দল এসে মাথা নোয়াবে সামান্য নিশ্চিন্ততার ব্যর্থ আশায়।
এগিয়ে চলেছে নীতা। হঠাৎ সনৎকে এ সময় দেখে একটু অবাক হয়। নির্জন ছায়াঘন হাঁটা পথ দিয়ে আসছে সে। চোখে-মুখে কি একটা দুশ্চিন্তার জমাট ছায়া, স্নানও করেনি। চুলগুলো উশকো-খুশকো; কেমন যেন থমথমে ছায়া ওর মুখে-চোখে। নীতা একটু অবাক হয়ে গেছে ওকে এই সময় এখানে দেখে। প্রশ্ন করে—তুমি! এ সময়? কী ব্যাপার?
সনৎ দাঁড়াল, ওর দিকে তাকিয়ে আছে ব্যাকুল চাহনিতে। নীতা ঠিক বুঝতে পারে না।
নীতা বলে ওঠে—চলো বাড়ির দিকে।
—না! সনৎ জবাব দেয়। মনে ওর একটা ঝড় বইছে। হঠাৎ যেন সেই ঝড় ছাপিয়ে বলে ওঠে সে—আজ আপিস নাইবা গেলে নীতা। একটু দরকার ছিল।
অনুনয়ের সুর ফুটে ওঠে সনতের কথায়। কেমন বিচিত্র ঠেকে এই আহ্বান। গিনিগলা রোদের নিবিড় স্পর্শ লেগেছে মিশকালো আঁশফল গাছের পাতায় পাতায়। ক্লান্ত উদাস সুরে পাখি ডাকছে, কর্মব্যস্ত জীবন থেকে শান্ত-মধুর এক স্বপ্নজগতের ক্ষণিক আহ্বান। থমকে দাঁড়ায়! এ যেন অন্য কোনো নীতা। ব্যাকুল কামনামদির মন হঠাৎ যেন এরই জন্য কান পেতে ছিল, এত দুঃখ-হতাশার মাঝেও।
এমনি উতলা হতে দেখেছে সনতকে বহুবার—সে আজ স্মৃতিতে পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু ফেলে আসা দূরপথ যেন ছায়াসন্ধান নিয়ে হাতছানিতে তাকে ডাকে বারবার। আজও।
জলার ধারে ঘন-কালো পাতা ভরা রেইনট্রি গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নাড়ছে বাতাসে সবুজ হোগলা বন। কোথায় ডাহুক ডাকছে থেকে থেকে। এখানে ওরা আগে আসত—বেশ সুন্দর ঠাঁইটা।
কালো আয়ত চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে নীতা। হারানো দিনের পরে আবার যেন অতর্কিতে ফিরে এসেছে দুজন, সব বাধা-ব্যবধান উত্তীর্ণ হয়ে সেই ছায়ামগ্ন তীরভূমিতে। আজও সেখানে পাখি ডাকে, ফিরে আসে ঝরা বকুলের গন্ধমাখা মৌসুমি বাতাস।
নীতা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। সনৎ বলে চলেছে—জীবনকে যেদিন চিনি নি, সেইদিনই পাশার ছকে বাজি ফেলে বিকিয়ে দিয়েছি তাকে। হঠাৎ যেদিন বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেলাম সেদিন দেখি দেউলিয়া। কোনো পুঁজিই আমার নেই।
নীতা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে জানে গীতার কাছে সনৎ পেয়েছে অফুরান আঘাত, ওর জীবনের মূল সুর কোনোদিনই তার সুরে মেলেনি, বেসুরো ঠেকেছে বারবার। তাই এই অশান্তি আর ব্যর্থতায় মন ছেয়ে বসেছে। কালো করে দিয়েছে ওদের মনের সব আলো।
সনৎ ব্যাকুল কণ্ঠে আজ ডাক দেয়—নীতা! আজও ফিরে পেতে ইচ্ছে করে সেই জীবন। তার জন্য সমস্ত ত্যাগ সইতে পারব।
—সনৎ। নীতা চমকে ওঠে। সনৎ থেমে গেছে। নীতা বলে চলেছে—কিন্তু ফেরবার পথ কই সনৎ। তোমার আমার এ পরিচয় কোনোদিনই সমাজ স্বীকৃতি দেবে না! লজ্জা রাখবার ঠাঁই থাকবে না কোথাও! তা আর হবার নয়।
—তাই বলে মুখ বুজে এই অভিনয় আত্মবঞ্চনা সহ্য করে যেতে হবে দিনের পর দিন?
সনতের কণ্ঠে বিদ্রোহের সুর। পুরুষ অধৈর্য হয়ে ওঠে, সে চায় ভাঙন। নারীর স্বভাবে বন্ধনটাই সত্য। তাকে মেনে নিয়ে সে হয় তৃপ্ত।
নীতা জবাব দেয়—অভিনয় নয় প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এরই মাঝে খুঁজতে হবে সমাধানের পথ—শান্তির স্পর্শ।
একটা কথা মনে পড়ে বারবার। একটা গানের সুর। শঙ্কর একদিন কথায় কথায় বলেছিল—দুঃখকে এড়িয়ে শান্তি নয়। দুঃখকে বরণ করে নিয়েই—জয় করার, সহজ ভাবে গ্রহণ করার, নামই শান্তির সন্ধান! কঠিন সে তপস্যা তবু তা সত্য।
নীতা যেন নিজের সেই চরম শান্তিরই সন্ধান করে চলেছে। নীরবে মেনে নিয়েছে তার ভাগ্যের সব নিষ্ঠুর পরিহাস। সনৎ ওই মতে বিশ্বাস করে না। চোখের উপর দেখেছে নীতার এই দুঃখ-দহন। তাই প্রতিবাদ করে।
—তুমিও কি প্রায়শ্চিত্ত করবে? কি তোমার পাপ?
আজ নীতা স্বীকার করে তার দোষ। সেদিন নিজের দাবি জানাতে এগিয়ে যায়নি কেন। গীতা সেই ঔদাসীন্যের সুযোগ নিয়েছে মাত্র। দোষী সে নিজেই। ম্লান হাসিতে ভরে ওঠে ওর মুখ জবাব দেয় নীতা ম্লান কণ্ঠে।
—দোষ আমার সাধারণ হওয়া। অতি সাধারণ মেয়ে আমি। নিজেকে অভিমানে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। বাকি অক্ষমতাটুকু আমার নয়। ভগবান যদি কেউ থাকে—তারই। আমি কালো কুৎসিত পুরুষের মন ভোলাবার মতো কোনো পাথেয়ই আমার নেই।
—নীতা! আজ বাধা দেয় সনৎ। সে দিনের মোহমুক্ত সনৎ। রূপের সংজ্ঞা বদলে গেছে তার কাছে, শুধু চোখের নয়, মনের রূপটাই আসল বলে দেখেছে সনৎ। মনের মাধুরী দিয়ে নীতাকে আজ তাই রূপবতী বলে দেখেছে সে। অন্তরের সেই অসীম স্নিগ্ধশ্যাম রূপ তাকে ব্যাকুল করে তুলেছে। কি যেন সম্পদ আর হারাবার দুঃখ সে সইতে পারে না।
কথায় কথায় বাগানে মধ্যে এসে পড়েছে তারা। সরু পথের দু’পাশে সবুজ গাছগাছালি, বাতাসে প্রথম আম্রমুকুলের মধুসৌরভ, গুনগুন সুরে ওড়ে মৌমাছি! ঘেঁটুফুলের উদগ্র সুবাসে মনে কি এক ব্যাকুল মদিরতা আনে। ওর একটা হাত সনতের হাতে, সব বাধা যেন ভাঙতে চায় সনৎ! হু-হু ঝড় বইছে গাছের মাথায়। নীল নির্জনে নীতা যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে—বুক ঠেলে উঠেছে সেই ব্যর্থ ব্যাকুল নারী— সব হারানোর দুঃখে যে কাঁদে, পাওয়ার স্বপ্নে যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে—একে চেনে না নীতা। এ যেন তার অন্য সত্তা। ঊষর জীবনমরু ক্ষণিকের বর্ষণেও সুধাস্নাত হোক। সব ভুলে যায় সে। ভুলে গিয়ে তৃপ্ত হতে চায়।
হঠাৎ চমকে উঠে নীতা! পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সরে দাঁড়াল।
সনৎ তাকিয়ে আছে ওর দিকে—পাতার ফাঁক দিয়ে এক ফালি আলো ওর থমথমে মুখে আলোছায়ার মায়াজালে রচনা করেছে। বিচিত্র এক রহস্য আর আহ্বানের ভাষায়। নীতা চমকে উঠেছে।
ব্যাকুলকণ্ঠে সে বলে ওঠে—সনৎ অনেক বেলা হয়েছে, তুমি বাড়ি ফিরে যাও।
—আমার কথার জবাব দাওনি নীতা।
স্থির কণ্ঠে বলে উঠে নীতা—জবাব অনেক আগেই দিয়েছি সনৎ!
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল সে। নীতার মুখে ম্লান হাসির আভা!
সহজভাবেই কথাটা বলবার চেষ্টা করে নীতা—সে জীবন অনেকদিন আগেই ফেলে এসেছি সনৎ। কোনো দাবিও রাখিনি। নিঃশেষে মুক্তি দিয়েছি তোমাকে সেইদিনই। দুজনের পথ আজ বেঁকে গেছে দুদিকে
—নীতা!… আবার যদি ফিরে যাই সেই পথে! সনৎ তখনও ডাক দেয় তাকে।
দূরাগত সেই সুর তবু নীতার কানে বাজে না।
বলে ওঠে, নীতা— কোনোদিন আর ও কথা মুখে না তুললেই খুশি হবো সনৎ। ও স্বপ্ন আমি কোনোদিনই দেখতে আর চাই না।
শেষের দিকে ওর কণ্ঠস্বর ভিজে আসে। নীতা নিজের দুর্বলতা চেপে বেশ কঠিন স্বরেই বলে ওঠে—তুমি যাও, ফেরবার ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। নীতা উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে চলে রোদের মাঝে ছাতাটা মেলে।
একা বসে রইল সনৎ স্তব্ধ হয়ে।
পিছন ফিরে তাকাল না নীতা, বের হয়ে গেল বাগান থেকে।
প্রায় জনশূন্য পথে দুপুরের রোদ উপচে পড়ছে, কেমন যেন বন্ধ্যা ধরিত্রী কাঁপছে রোদের তাপে; বিশুষ্ক ধরিত্রী—নিদারুণ নিষ্ঠুরতা ওর বুক থেকে হাজারো রৌদ্রশিখায় বিস্তারিত হচ্ছে। অসহ্য কেমন জ্বালা ওঠে সারা বাতাসে। জ্বলছে সর্বংসহা মৃত্তিকা। শুকিয়ে ফেটে উঠছে মাটি নিষ্করুণ-শুষ্কতায়।
বাগানের বাইরে এসে থমকে দাঁড়াল নীতা; এক ঝলক তীব্র রোদ যেন ছাড়া পাওয়া একঝাঁক জানোয়ারের মতো লাফ দিয়ে এসে পড়েছে অতর্কিতে তার উপর, ধারালো নখদন্ত বিস্তার করে টুকরো টুকরো করে ফেলবে তাকে। সারা শরীরে অসহ্য-যন্ত্রণা, একটা প্রচণ্ড কাশির ঝোঁকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপছে; কানের কাছে সেই হু-হু শব্দ মাঠ-গাছগাছালি কাঁপিয়ে এগিয়ে আসছে প্রবল বেগে—তাকে হারিয়ে ফেলে কোন শুন্যে বাজপাখির শিকার ধরা করে তুলে নিয়ে যেতে চায়—উধাও করে দিতে চায়। ঝাঁ-ঝাঁ করছে কান মাথা। সব বসন্তকে ব্যর্থ প্রত্যাখ্যানে ফিরিয়ে দিল সে। সারা হৃদয়ের এই সেই নীরব কান্না।
কাশছে! জিভের উপর নোনতা আস্বাদ! হঠাৎ চমকে ওঠে নীতা! পরক্ষণেই সোজা হয়ে এগিয়ে যায়। দূরে দেখা যায় স্টেশনের দিকে ফিরে যাচ্ছে সনৎ। ডাকতে গিয়ে থামলো, ওকে ফেরাতে পারে না নীতা। কোনোমতেই পারে না। ও চলে যাক, দূরে যাক। বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে সে।
সারা শরীরে একটা দুঃসহ-ক্লান্তি ঘনিয়ে আসে।
মাকে কিছু না বলেই নিজের ঘরে শুয়ে পড়ল নীতা। গীতা চলে যাবার পর গোটা ঘরটাই তার দখলে। পরিষ্কার করবারও সময় নেই। কোনোমতে একটা চাদর টেনে আপাদমস্তক ঢাকা দিয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। জ্বর-জ্বর বোধ হয়। মাথা তোলবার ক্ষমতাও নেই, যন্ত্রণায় যেন ছিঁড়ে পড়ছে। কাশিটা থেমেছে তবে ক্লান্তিতে তখনও হাঁপাচ্ছে নীতা।
মাধববাবু আবার করবার মতো কাজ পেয়েছেন। প্রুফ দেখা, লেখা। অবকাশ সময়টুকু কাজে ভরে ওঠে। আবার কারেকশন করা নিয়েই দিন কাটে; তারই গল্প হয় নীতার সঙ্গে। বলেন— দেখেছিস, থার্ড চ্যাপ্টারটা কি করেছি। নতুন করে লিখলাম।
নীতা বাবার কথায় সায় দেয়—হ্যাঁ দেখেছি। চমৎকার হয়েছে।
—দেখেছিস তাহলে? হবে না? রীতিমতো খেটেছি। বুঝলি, পারফেক্ট করতে হবে তো। পড়ার বই বলে কথা।
কাদম্বিনী যেন ধীরে ধীরে সংসারের হাল ধরতে এগিয়ে আসছে। নীতা রোজগার করতেই সব উৎসাহটুকু নিঃশেষ করে দিয়েছে, মাকে তুলে দেয় টাকা। সংসারের জমা খরচের ব্যাপারে আর থাকতে ইচ্ছা করে না।
আপিস থেকে মন্টুর সাহেব এসেছেন। মাধববাবুর ঘরে বসেন। তিনি আলাপ-পরিচয় করেন—ছোট সাহেব মিঃ রবার্টস।
মাধববাবুর সঙ্গে তিনি ইংরাজিতে আলাপ করে অবাক হন। ইংরাজ হয়ে ইংরাজি কাব্যসাহিত্য তিনি কিছু পড়েছেন, এঁর জ্ঞান তার চেয়ে অনেক বেশি। নীতা চা নিয়ে আসে। সামান্য আয়োজন কিন্তু অভ্যর্থনার ত্রুটি নেই।
মিঃ রবার্টস আশা করেছিলেন সাধারণ একজন মজুরের মতোই এদের পরিবেশ হবে, ইতিপূর্বে তাদের অনেককেই দেখেছেন তিনি। কিন্তু বাড়ি এসে দেখে-শুনে অবাক হয়ে যান তিনি।
দেশবিভাগের উদ্দেশ্য আর ইংরাজের এই শুভকাজে কতটুকু হাত ছিল, মাধববাবু তাই নিয়েই বেশ আলোচনা করেন উদ্বেগ জড়িত কণ্ঠে। অ্যালেন ক্যামবেলের লেখা নতুন বইটার কথা আলোচনা করেন। ইংরাজের কূটনীতি আর দূরদর্শিতার কথাও ভোলেননি তাঁরা, আজ একটা জাতির এই চরম দুর্ভাগ্যের জন্য ইংরাজও কম দায়ী নয়।
মিঃ রবার্টস দীর্ঘদিন এদেশে আছেন। তিনিও জানেন এর কতখানি সত্য। তাই প্রতিবাদ করতে পারেন না।
মাধববাবু বলে চলেছেন— তোমরা ইচ্ছা করেই এটা করেছিলে।
রবার্টস হাসছে। নীতা বাবাকে বাধা দেবার চেষ্টা করে— তোমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে বাবা।
—যাই মা!
আবার তর্কের খেই ধরে বলতে থাকেন—একটা জাতের মেরুদণ্ড তোমরা ভেঙে দিয়েছ— ‘ইউ হ্যাভ টার্নড দেম টু এ ক্লাস অব বেগারস্’। তোমার আমার এতে কোনো হাত ছিল না মিঃ রবার্টস, জাতিগত ভাবে কথাটা বলছি।
কাজের কথায় আসেন সাহেব।
—মন্টুর দুর্ঘটনার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত। কোম্পানির তরফ থেকে তাকে চাকরিতে রাখবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
—’সো কাইন্ড অব ইউ’! কথাটা নীতা বলে ওঠে।
রবার্টস সঙ্কোচ বোধ করেন—না, না, এটা আমাদের কর্তব্য।
কাদম্বিনী দরজার পাশ থেকে কৌতূহলী ভঙ্গিতে উঁকি মেরে দেখছে শ্বেতাঙ্গ পুঙ্গবকে। তার বিজাতীয় ভাষা বোঝবার ক্ষমতা নেই, তবু কি যেন আশার কথা বলছে, এটা নীতাকে দেখেই অনুমান করতে পারে।
সাহেব চলে যেতেই বের হয়ে আসে কাদম্বিনী—কী বললেন? হ্যাঁরে?
মাধববাবুই জবাব দেন এক রাশ প্রুফ থেকে মুখ তুলে—মন্টুর চাকরি থাকবে কোম্পানি থেকেই একটা কাঠের পা দয়া করে তৈরি করে দেবে। সেই সঙ্গে হাজার কয়েক টাকা ক্ষতিপূরণও দেবে।
ঠিক খুশি হননি মাধববাবু। প্রথম দিন থেকেই মন্টুর ওখানে চাকরি করা—তার হাবভাব চালচলন কোনোটাই ভালো চোখে দেখেননি। ছেলেবেলা থেকে—যৌবনকালে পীরগঞ্জে থাকতে ইংরাজ জাতটাকে কোনোদিনই ক্ষমার চোখে দেখেননি তিনি। এর জন্য দুর্ভোগ ভুগতে হয়েছে, পুলিশের জুলুমও সয়েছেন। ওদের খাতায় নাম উঠেছে, কারণে-অকারণে জেরাও করেছে পুলিশ তাঁকে।
আজ সেই তাদেরই ডাকে ছেলেকে চাকরি করতে দেখে খুশি হননি, তৃপ্ত হননি, ওদের অযাচিত এই করুণার দানে। নীতাকেই কথাটা বলেন—এ ভিক্ষাটুকু না নিলেই ভালো হতো নীতা!
নীতা বাবার বুকের জ্বালায় খবর জানে। চুপ করে থাকে।
ফোঁস করে ওঠে কাদম্বিনী—তা নেবে কেন? উপোস দিতে হবে যে?
মাধববাবু চটে ওঠেন—তাই বলে ভিক্ষে নিতে হবে? কাদম্বিনীও কড়া জবাব দিতে যায়, নীতার কথায় থামল।
—তুমি কাজে যাও মা!
কাদম্বিনী তখনকার মত রাগ চেপে রইল।
বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করে নীতা—এ ক্ষতিপূরণ তারা লেবার কোর্টের চাপে দিতে বাধ্য হয়েছে বাবা। ওদের ইউনিয়ন চাপ দিয়েছে—তবেই না এসেছেন উনি। নইলে এত দয়া ওঁদের?
—ও! তাই নাকি?
কথাটা খানিকটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। মাধববাবু চুপ করে তাকালেন নীতার দিকে। নীতা বলে চলেছে—হ্যাঁ; সবই বলেছে আমাকে মন্টু।
কাদম্বিনী মনে মনে খুব অখুশি হয়নি। সুস্থ থাকতে মন্টুর রোজগার চোখে দেখেনি, দয়া করে মাঝে মাঝে কিছু দিয়েছে কদাচিৎ। এখন একসঙ্গে বেশ কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে এবং বাড়িতে বসে মাস চারেক কয়েকশো টাকা আসবে। তার উপর নীতার ছিটেবেড়ার রোজগার আছে—জমেছে শঙ্করের দেওয়া কিছু টাকা। বাড়ির দু’খানা ঘর ফেলে পাকা দোতলা বানাবার স্বপ্ন দেখে। কোনোরকমে কাজ শুরু করতে পারলে শঙ্করের কাছ থেকে আরও কিছু নেবে—আজকাল নাকি বেশ রোজগার করে সে। নবীন মুদির দোকানে রেডিওতে শোনা যায় তার গান। খুব ভালো গাইয়ে হয়েছে সে এখন।
সেদিন দত্তগিন্নিই কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয় কাদম্বিনীকে।
—তা এইবার দু’পয়সা আসছে দিদি, কোনোরকমে ঘরটা তুলে নাও। ছেলের বিয়ে-থা দিতে হবে। এদিকে তো শুনলাম সুখবরটা।
সুখবরই। কাদম্বিনীর মুখে-চোখে খুশির আভা। মনের কোণে আলো জাগে।
আবার দিন বদলের আশা করে সে। দুঃখ চিরকাল থাকে না। মুখ-বুজে বুজে সইতে পারলে যুঝতে পারলে দুঃখও একদিন হার মানে।
কাদম্বিনী নতুন জগতের স্বপ্ন দেখছে, নতুন ঘরের। ওদিকে এগিয়ে যায়। আজ বাড়িতে নানা কাজ। সত্যনারায়ণ পুজো দিচ্ছে।
পুজোর আয়োজন পত্র আছে। নীতাকে তাগাদা দেয়—হলো রে নীতা।
—হয়েছে মা, যাচ্ছি।
নীতা ঘরটা সাফ করছে, মন্টু আসবে আজ হাসপাতাল থেকে। তারই মানসিকে আজ বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজোর আয়োজন করেছে। গীতাকেও আনতে পাঠিয়েছে মা, কলোনির কোন ছেলের মারফত।
চারিদিকে নানা ঝামেলা, একা কাদম্বিনী হিমশিম খেয়ে যায়। মাধববাবুও নিজেই বাজারে গেছেন।
বেশ কিছুদিন পর মাধববাবু আবার যেন ভরসা পেয়েছেন, মানুষের মাঝে বাঁচবার একটা আশার আলোর সন্ধান পেয়েছেন। কাদম্বিনীর কথাটা মনে ধরে মাধববাবুর।
—ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস করো না? তাদের দয়াতেই সব দিকই রক্ষা হয়।
চিরকালই ওদিকে খেয়াল করেননি মাধববাবু। মানবধর্মে বিশ্বাসী একটি সংস্কারমুক্ত মন। স্ত্রীর মনে আঘাত দিতে চান না। হাসেন তিনি চুপ করে। বলে ওঠেন—তাহলে পুজোর বাজার করতে যেতে হবে বলো?
—যাও না!
—দাও, একটু ঘুরেই আসি।
অনেকদিন পর আবার পথে বের হন মাধববাবু।
রোদের আলো পড়েছে গাছগাছালির মাথায়, পথের দু-ধারে বাড়ির চালে লতিয়ে উঠেছে কুমড়োলতার হলদে ফুলের অমলিন হাসি। বাতাসে কেমন চাপা সৌরভ জাগে। পৃথিবী সুন্দর—মানুষের মনে তারই স্পর্শলাগা চাঞ্চল্য!
সনৎ ফিরে গেছে বাড়িতে।
বাড়িতে পা-দিয়ে কেমন স্তম্ভিত হয়ে যায়। মনে তখনও জেগে রয়েছে নীতার কথাগুলো। কেমন যেন সঙ্কুচিত বোধ করে নিজেকে। নীতার সেই চাহনি—দৃঢ়স্বরের সতেজ প্রত্যাখ্যান তাকে আজ নতুন পথের সন্ধান এনে দিয়েছে। কি যেন মস্ত একটা ভুল করতে বসেছিল সে। দুস্তর লজ্জা তার মনে তখনও জড়িয়ে রয়েছে। নিজের এক মুহূর্তের ভুলের জন্য আসে অপরিসীম ঘৃণা।
সনৎও বুঝেছে গীতার এ ব্যাপারে এই অভিযোগের মূলে সত্য কিছু না থাকা নেই। তার দুর্বল মন কোনোটাই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়নি। শুধু আলেয়ার পিছনেই ছুটছে। আজ সেই কথাটা—ভুলটা, বুঝতে সে পেরেছে।
তার পথ আজ বাঁধা হয়ে গেছে। এ পথ ছেড়ে যাবার উপায় নেই। আজ আপস করেই বাঁচতে হবে তাকে।
বাড়িতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাইরের ঘরে আলো নেই। সারা বাড়িটা নীরব নিস্তব্ধ। গীতার সঙ্গে ঝগড়া করেই বের হয়েছিল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। একটা আলো একক জ্বলছে। বারান্দা, রান্নাঘর, আর কোথাও আলো নেই। সব অন্ধকারে—আলো শুধু ওই ঘরটুকুতেই।
ঘরে ঢুকে একটু অবাক হয়। বিছানায় পড়ে আছে গীতা।
কেমন যেন অসহায় মলিন-বিবর্ণ-পাংশু চেহারা। ওকে দেখে হঠাৎ সনতের মনে একটা বেদনা জাগে। ওকে অবহেলা আর অবজ্ঞা করেই ফেলে রেখেছে দূরে। কোনোদিনই কাছে টেনে নেয়নি আপন করে।
অবিচার করেছে গীতার উপর। ওর কাছে এসে দাঁড়াল সনৎ।
একফালি আলো পড়েছে ওর সুগৌর মুখে। চোখ-বুজে পড়ে আছে গীতা। আয়ত সুন্দর চোখে নেমেছে ঘন নিবিড় ক্লান্তির-ছায়া। মন কেমন করে। একটি মানুষকে যেন বন্দি করে তার উপর নিদারুণ অবহেলা আর ঘৃণার বোঝা চাপিয়ে রেখেছে সনৎ অন্যায় ভাবে।
হঠাৎ পায়ের শব্দ পেয়ে উঠে বসল গীতা।
এ যেন অন্য গীতা। এতকাল নিজের স্বার্থ নিয়ে যে বারবার এগিয়ে এসেছে সনতের পথে বাধা দিতে, এ সেই নারী নয়। ক্লান্ত-দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
—শরীর খারাপ? এগিয়ে যায় সনৎ।
তার কণ্ঠেও অনুশোচনার সুর, কথা কইল না গীতা। কম্পিত সলজ্জ-দৃষ্টি মেলে একবার তাকাবার চেষ্টা করে মাথা নিচু করে। মধুর-অনুরাগ আর সফল কামনার ছায়া পড়েছে ওর চোখে—আরক্তিম গণ্ডদেশ।
কি এক মধুর স্বপ্ন দেখে গীতা। তার মনের পরতে বাজে আনন্দসুর— প্রতিষ্ঠার দাবি! আর স্বার্থপরের মতো নিজের দাবি জানাতে হবে না। তার আসন স্বীকৃত—দাবি প্রতিষ্ঠিত। তার সংসারে আজ সুর জেগেছে সার্থকতার। মা হতে চলেছে সে!
সব দুঃখ-বেদনার মধ্যে গীতা এই মধুর সত্যটিকে অনুভব করে আনন্দে অধীর হয়ে উঠেছে। চোখ মেলে তাকাল সনতের দিকে।
সলজ্জ মধুর-চাহনি, ওতে আর ফুটে ওঠে না জ্বালা। শান্ত-মধুর সে চাহনি।
সনৎ ওর কথায় চমকে ওঠে। কাছে এগিয়ে এসে ওর হাতখানা তুলে নেয়। ব্যাকুলকণ্ঠে ডাক দেয়—গীতা!
কথা বলল না গীতা। সমস্ত কামনা একটি সুন্দর রূপে প্রকাশিত হয়েছে। সনতের নিবিড় স্পর্শ ওর সারা দেহে মনে। আকাশ-পাতাল পার্থক্যের ফাঁক বুজে কি একটি মিলনসেতু রচিত হয়েছে দুজনের মনে। সব ভুল নিঃশেষে জীর্ণ পাতার মতো মন থেকে ঝরে গেছে।
আজ গীতার কোনো অভিযোগ নেই। সনত্ত থমকে দাঁড়িয়েছে। আজ বিকেলের সুরটা কোথায় হারিয়ে গেছে। সব কামনা, চাওয়ার ব্যাকুলতা থেমে গেছে তার মনে।
—আগে কেন বলোনি? সনৎ প্রশ্ন করে।
গীতা আজ এগিয়ে দেয় নিজেকে। কণ্ঠে ওর পরিহাসতরল সুর। সনতের দিকে তাকাল—ধ্যাৎ! আস্ত বোকা তুমি!
হাসতে গীতা, পরম নিশ্চিন্ত গৌরবময়ী একটি নারী! সনৎ আজ ওর নবজাতক ব্যক্তিত্বের কাছে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
কাদম্বিনীর কোনো দিকে নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই। নীতাও সকাল সকাল আপিস থেকে ফিরে মাকে না জানিয়েই বাইরের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সেইখানেই আস্তানা পেতেছে।
শঙ্কর চলে যাবার পর থেকে ও ঘরটা খালি হয়ে গেছে। মন্টুর পায়ের জন্য নীতাই নিজের ঘরখানা ছেড়ে দেয়।
—ওর কষ্ট হবে, আমি বরং বাইরের ঘরে থাকি।
নিজেই যেন সরে যেতে চায় এই বাড়ির মধ্য থেকে একটু দূরে, বাইরে। কাদম্বিনী একবার প্রশ্ন করে মাত্ৰ – কেন?
—মন্টু থাকুক এই ঘরে।
এরপর আর এ নিয়ে বিশেষ কথা তোলেনি কাদম্বিনী। কেমন যে দূরে দূরে সরে থাকতে চায় নীতা এটা মায়েরও দৃষ্টি এড়ায় না।
—কি হয়েছে তোর বল দিকি? কাজকর্মও বিশেষ করিস না।
নীতা চমকে ওঠে, মায়ের তীক্ষ্ণ-দৃষ্টির সামনে নীতা বিব্রত বোধ করে। পরক্ষণেই সামলে নেয়। আপিসের পরীক্ষা কিনা, পাশ করলে প্রমোশন হবে। তাই একটি নিরিবিলিতে পড়াশুনা করছি। বাড়ির কাজকর্ম তো তুমিই দেখাশোনা করছো মা।
—কি জানি বাছা। কাদম্বিনী বিশেষ কিছু বোঝবার চেষ্টা করে না, করা স্বভাবও নয়, যে-যা বলে তাই মেনে নিয়েই খুশি হয়ে থাকতে চায়। জড় চেতনার মানুষ; মনের গভীরে তলিয়ে কোনোদিনই কোনো কার্যকারণ অনুসন্ধান করা তার স্বভাববিরুদ্ধ।
নীতা বাড়ির ওই ঝামেলায় বড় একটা যায় না। চারিদিকে কলরব উঠেছে। প্রতিবেশীরাও এসেছে, দত্তজা গিন্নি, মধুর মা–আরও অনেকে আসে পুজোর সময়।
নীতার বুকের মধ্যে সেই ব্যথাটা কেমন কনকন করে ওঠে, দম বন্ধ হয়ে আসছে। বিছানায় পড়ে কোনরকমে সামলাবার চেষ্টা করে সে। বাইরে থেকে একটা গাড়ি থামার শব্দে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে আপিসের ছোট সাহেব নিজে গাড়িতে করে মন্টুকে পৌঁছে দিয়ে গেল। ক্রাচের উপর ভর দিয়ে এগিয়ে আসছে মন্টু। চেহারাটা ভালো হয়েছে। হাসিমাখা মুখ; ব্লেজারের সেই কোটখানা পরনে; পায়ের দিকটা খালি, মেঝের উপর কাঠের শব্দ ওঠে— ঠক্ ঠক্ ঠক্। নিষ্ঠুর ভাগ্যের কঠিন অভিশাপের মতো কাঠের ক্রাচটা শব্দ তুলেছে— একটানা নিষ্ঠুর শব্দ!
— দিদি!
এগিয়ে এসে এ ঘরে ঢুকলো মন্টু। নীতা আবছা আলোয় ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো শুরু হয়েছে। আলো জ্বলছে, সবুজ কলাপাতায় উছলেপড়া আলো, আকাশ-বাতাস ভরে ওঠে উলুধ্বনির শব্দে। ওদের আনন্দ কোলাহল থেকে দূরে পরিত্যক্তের মত দাঁড়িয়ে আছে ভাগ্যহত দুটি ভাইবোন।
একজন যন্ত্রের নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় দলিত, পিষ্ট, অন্যজন জীবনের নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে অন্তঃসারহীন। একটা বিকৃত মাংসপিণ্ড ব্যাঙের মতে লাফ দিয়ে চলেছে, সে মন্টু—সুন্দর একটি ব্যর্থ যৌবন।
একালের, এ যুগের অভিশাপ ওর সারা দেহ-মনে।
নীতা নিজের মনের দুঃখ-হতাশা, জীর্ণ শরীরের বেদনা সব কিছু ভুলে মন্টুর দিকে তাকিয়ে- থাকে। তার তুলনায় জীবন মন্টুকে পরিহাস করেছে আরও নিষ্ঠুর মর্মান্তিক ভাবে।
ওদের উলুধ্বনি, পূজা-মন্ত্রের শব্দ, আনন্দ-উল্লাস, রোশনাই ভেসে আসে। সবকিছুই আজ অর্থহীন বলে বোধহয় নীতার কাছে।
মন্টুর কল্যাণে আজ পুজো হচ্ছে। এর নাম দেবতার কল্যাণ ভিক্ষা! কথাটা আজ বিশ্বাস করে না নীতা। কি দিয়েছে তাকে জীবন? কি তারা পেয়েছে জীবন দেবতার কাছে? কোনো কৃতজ্ঞতা সেখানে তাদের নেই।
বাঁচবার জন্য দৈনন্দিন এই সংগ্রাম মনে হয় নিষ্ঠুর বঞ্চনা আর পরিহাস ভরা, সেই প্রাণপণ সংগ্রাম করে দুমুঠো ভিক্ষান্নের প্রত্যাশায় বসে থাকা—এই যদি জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, তবে সেই জীবনকে টিকিয়ে রাখবার জন্য দেবতার কাছে ঘটা করে এই কামনা জানাবার কোনো সার্থকতা নেই। এর শেষ হওয়াই ভালো।
মন্টু অবাক হয়—কাঁদছিস বড়দি!
আবছা অন্ধকারে নীতা চমকে ওঠে—কই, না তো! বস। দাঁড়িয়ে রইলি কেন?
—তুই শুয়ে যে! মন্টু বলে ওঠে।
এ কথার কোনো জবাব কাউকে দেয়নি নীতা। দিয়ে লাভ কি! তাই এড়িয়ে যায়। হাসে নীতা—এমনিই।
হঠাৎ মূর্তিমান একটা কলরবের মতো ঘরে ঢোকে, আলো হাতে গীতা। ওদের দেখে এগিয়ে আসে। বলে-তোরা এখানে?
ঘরটা আলোয় ভরে ওঠে, গীতার দিকে তাকিয়ে থাকে নীতা। রূপ যেন তার ধরে না, উপচে-পড়া রূপ। ভাদরের নদীর মতো কুলে কুলে সুর তুলে চলেছে। কলাপাতা রঙের শাড়ি খানায় ফুটে ওঠে নিটোল প্রস্ফুট যৌবন। নীতা এই জাগর রূপ দেখে চমকে ওঠে। মায়ের মুখে ও কথাটা শুনেছিল নীতা। গীতা মা হতে চলেছে, নবমাতৃত্বের শ্যাম সজীবতা তার দেহমনে
চিৎকার করছে গীতা—বা রে, আমি বাড়ি খুঁজে সারা, তোরা দুজনে এই ঘরে। চল! ওঠ বলছি। অ্যাই দিদি।
হইচই শুরু করে গীতা। নীতা হাসছে—কি পাগলামি করিস রে?
—পাগলামি! না উঠলে তোর হাত ধরে হিঁচড়ে তুলব। অ্যাই!
নীতাকে টেনে তুলতে যায়, গায়ে হাত পড়তেই চমকে ওঠে গীতা! সেই আনন্দ-আভা মুছে যায় ওর চোখ থেকে। অবাক হয়ে গেছে গীতা।
—এ কি রে? তোর যে জ্বর। দারুণ জ্বর!
নীতার মুখে সেই হাসির ম্লান আভাটুকু মেলায়নি। বলে ওঠে চাদরটা চাপা দিতে দিতে— কদিন শরীরটা ভালো নেই রে।
গীতার সুরে সমবেদনা ফুটে ওঠে। এ অন্য কোনো নারী! আর নীতাও জানে সার্থকতা এসেছে খুশি হয়েছে, পূর্ণ হতে চলেছে গীতা। তাই অনুকম্পা দেখায় রিক্ত নীতাকে।
গীতা অনুযোগ করে—এ কি হাল করেছিস দিদি? শরীরের দিকে নজর দিস নি?
নীতা জবাব দেয়—সময় ছিল কইরে?
—না, তুই বড্ড খাটিস।
নীতা জবাব দেয় না। ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। করুণা করছে আজ গীতাও তাকে! ওদের কাছে তার স্বীকৃতি নেই, শ্রদ্ধা ভালোবাসা নেই, করুণা আর দয়া কুড়োবার পর্যায়ে যেন এসে পড়েছে সে। নীতা চাদরখানা চাপা দেয় ভালো করে।
গীতা উঠে পড়ে। ঠাণ্ডা লাগাস না বাপু, দিনকাল ভালো নয়। যাই, ওদিকের সব কাজ বাকি পড়ে আছে। প্রসাদ দিতে হবে রাজ্যের লোককে।
কাদম্বিনী ডাক দেয় বাইরে থেকে–বাছা, ও গীতু! মন্টু আয়। সধবাদের ডাক গীতা—
মেয়েকে ডাকতে এসেছে, গীতা বের হয়ে গেল। পিছু পিছু মন্টুও।
আবার আবছা আঁধার নেমে আসে ঘরে। জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের এক ঝলক আলো শুধু জেগে রয়েছে। হু-হু বইছে বাতাস। নীতা চুপ করে শুয়ে থাকে এঘরে।
শুভকাজে ওকে, গীতা কাদম্বিনী কেউ আহ্বান জানাল না। সধবাদের উলুধ্বনি-মাঙ্গলিকে দেবতা বরণ করা হবে। সেই যোগ্যতা নীতার নেই। সে যেন আজ ধীরে ধীরে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে সংসারের নানা কাজে। কর্মব্যস্ত জীবনের দায়িত্বও কমে আসুক। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত সে। একা এই পৃথিবীতে। কাজের চাপে নানা দায়িত্ব আর দারিদ্র্যের বোঝায়, জীবনে অন্য কোনোদিকে দৃষ্টি দিতে পারেনি নীতা, বন্ধুও কেউ নেই। সমস্ত পৃথিবী যেন তাকে নিষ্ঠুর অঙুলিহেলনে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ওদের মাঝে যেতেও মন চায় না নীতার।
একটা দমকা কাশির বেগে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। জীর্ণ দেহটা কাশির আবেগে কেঁপে ওঠে। কপালে ফুঠে ওঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অসহ্য-যন্ত্রণা— বুক-পিঠে কে যেন সুচ দিয়ে বিঁধছে! গলাটা শুকিয়ে আসে।
একলা ঘরে পড়ে অন্ধকারে হাঁপাচ্ছে নীতা। কানে আসে শঙ্খধ্বনি কলরবের শব্দ! জল! একটু জল! বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
কোনোরকমে বিছানায় শুয়ে শুয়েই হাতড়াতে থাকে নীতা। আবছা অন্ধকারে শীর্ণ চোখ দুটো জ্বলছে—অস্বাভাবিক দীপ্তিতে। কঠিন তৃষ্ণায় একবিন্দু পানীয়ের ব্যর্থ সন্ধান করে সে।