Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৃত্যু রঙ্গিনী || Panchkari Dey » Page 3

মৃত্যু রঙ্গিনী || Panchkari Dey


দুইদিন পরে আবার সেই ডিটেটিভ বন্ধু রাজীবলোচনবাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে আমি তাঁহাকে একেবারে অনেক প্রশ্ন করিলাম।

তিনি বিরক্তভাবে উত্তর করিলেন, “অত ব্যস্ত হইবেন না—একেবারে অত কথার উত্তর দেওয়া যায় না। আমি এই দুইদিনে কি করিলাম, কোথায় ছিলাম, সে সমস্ত আমি একে একে বলিতেছি।” আমি। আচ্ছা, আপনি সত্বর সমস্ত কথা বলুন, আমি শুনিবার জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়াছি। রাজীব। আপনার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া আমি আমার বাসস্থানে উপস্থিত হই। তথায় এ সকল পোষাক-পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করিয়া দরিদ্রের ন্যায় জীর্ণ ছিন্ন-ভিন্ন বসন পরিধানপূর্বক ছদ্মবেশে মিসেস্ রায়ের সহিত সাক্ষাৎ করি।

আমি। কি বলিয়া পরিচয় দিলেন? তিনি কি বলিলেন?

রাজীব। তিনি কি আর বলিবেন? আমি চাকরীর প্রত্যাশায় তাঁহার কাছে গিয়াছিলাম। আমার প্রার্থনা বিফল হয় নাই—নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিতে হয় নাই। তিনি আমায় সামান্য মাহিনায় দাসরূপে নিযুক্ত করিলেন—আমিও এই দুইদিন প্রভুভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া মনের সাধে দাস্যবৃত্তি করিলাম। তার পর কি উপায়ে, কোন্ কোন্ ঘটনার মীমাংসা করিলাম, তাহা আপনার সমস্ত শুনিবার আবশ্যক নাই। যেগুলি আবশ্যক কথা, তাহা বলিলেই বোধ হয় যথেষ্ট হইবে।

আমি। আপনার যেরূপ ইচ্ছা, তাই করুন। যেরূপভাবে বলিতে ইচ্ছা করেন, সেইরূপভাবেই বলিতে পারেন, আমার তাতে কোন বাধা নাই।

রাজীব। মিসেস্ রায়ের নিকট চাকরী স্বীকার করিয়া আমি প্রথমেই বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি লোক জন রাখিতে বড় ইচ্ছুক নহেন। বাড়ীটি যত নিৰ্জ্জন হয়, ততই যেন তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। বিনা প্রয়োজনে বা বিনা আহ্বানে বাড়ীর ভিতরে চাকর লোকজন ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইলে তিনি বড় বিরক্ত হয়েন। রাত্রে তাঁহার বাড়ীর ভিতরে অন্য কোন লোক না থাকে, ইহাই যেন তাঁহার মনের অভিলাষ। গতকল্য রাত্রে আমি আর একজন রমণীকে তাঁহার সঙ্গে উদ্যানে পরিভ্রমণ করিতে দেখিয়াছিলাম। সে রমণীর শরীর অত্যন্ত অসুস্থ বলিয়া আমার বোধ হইল। বোধ হয়, তাঁহার যক্ষ্মাকাস হইয়াছে। মিঃ কুকের সহিত মিসেস্ রায়ের কি সম্বন্ধ বলিতে পারি না, কিন্তু তাঁহারা উভয়ে প্রায় নির্জ্জনে পরামর্শ করিয়া থাকেন। কখন কখন মিঃ কুক্ বাড়ীর বাহির হন বটে, কিন্তু অধিক বিলম্ব করেন না।

আমি। মিসেস্ রায়ের সহিত যে রমণী উদ্যানে ভ্রমণ করিতেছিলেন তিনি কে?

রাজীব। সে কথাটা আমি আপনাকে ঠিক বলিতে পারি না। মিস্ মনোমোহিনীকে আমি পূর্বে কখনও দেখি নাই।

আমি। বাড়ীতে কোন ডাক্তার আসেন কি?

রাজীব। ভবানীপুরের চরণদাসবাবুকে আসিতে-যাইতে দেখিতে পাই—তিনিই বোধ হয়, চিকিৎসা করিতেছেন।

চরণদাস শ্রীমানী, আমার সঙ্গে একসঙ্গে কলেজে পাঠ করিয়াছিলেন। দুই-চারিবার পরীক্ষায় ফেল হইয়া ডাক্তার হইয়াছেন। ভবানীপুরে তাঁহার বাড়ী—তিনি ধনী-সন্তান। সেই কারণে তাঁহার পসার অধিক জমিয়া গিয়াছে। মধ্যে মধ্যে তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইত। আমি স্থির করিলাম যে, একবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সংবাদ লইব।

বন্ধুবর গোয়েন্দা মহাশয়ের সহিত আরও অনেক কথা হইল। তাঁহার সমস্ত কথাই ভাসা-ভাসা —সমস্তই রহস্যপূর্ণ—পরিষ্কার করিয়া তিনি কিছুই বলিতে চাহেন না।

তিনি বিদায় গ্রহণ করিলে, ঘণ্টা দুই পরে অন্যান্য কাজ-কর্ম্ম শেষ করিয়া, আমি চরণদাসবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, তিনি গৃহে নাই— কাজে কাজেই তাঁহার জন্য আমায় অপেক্ষা করিতে হইল। প্রায় অর্ধঘণ্টা অতীত হইলে পর, বাড়ীর ভিতরে আমি তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। বুঝিলাম, তিনি ফিরিয়া আসিয়াছেন। বোধ হইল, যেন ঔষধ-সেবন-বিধি বিষয়ে কাহাকে কি বুঝাইয়া দিতেছেন। আমার কেমন কৌতূহল হওয়াতে, আমি এদিক্‌-ওদিক্ চারিদিকে খড়খড়ি দিয়া উঁকি-ঝুঁকি মারিয়া দেখিতে লাগিলাম, কাহার সহিত চরণদাসবাবু কথা কহিতেছেন। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিল, মিঃ কুক্ তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান।

আমি তখন বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, আলিপুরে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে নিশ্চয় কেহ অসুস্থ, তাই মিঃ কুক্ চরণদাসকে তথায় লইয়া গিয়াছিলেন। বোধ হয় রোগ শক্ত, নহিলে ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে মিঃ কুক্‌ বাড়ী পর্য্যন্ত আসিবেন কেন, আর চরণদাসবাবুই বা এত তাড়াতাড়ি নিজহস্তে ঔষধ করিয়া দিবেন কেন? বন্ধুবর গোয়েন্দার কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে মিস্ মনোমোহিনীরই শরীর ব্যাধিগ্রস্ত হইয়াছে বলিয়া অনুমান করিতে হইবে। পিতৃশোকে ভাবনা-চিন্তায় অভাগিনীর শরীর ভগ্ন হইয়া পড়িবে, তাহা কিছু বিচিত্র নয়; কিন্তু এত সত্বর তিনি এরূপ কঠিন পীড়াগ্রস্ত হইবেন, এ কথা আমি একদিনও ভাবি নাই।

যাহাই হউক, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে যদি কাহারও পীড়া হইয়া থাকে, তাহা হইলে চিকিৎসার জন্য আমায় ডাকা হইল না কেন? মিসেস্ রায় কি আমার চিকিৎসার উপর সন্তুষ্ট নহেন? বন্ধুবর ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে বাঁচাইবার জন্য আমি ত প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছিলাম—কোন বিষয়ে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করি নাই। তবে কেন মিসেস্ রায় আমাকে পরিত্যাগ করিয়া চরণদাসের দ্বারা চিকিৎসা করাইতেছেন?

এইরূপ মনে মনে নানাপ্রকার চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে বন্ধুবর চরণদাস সেই কক্ষে প্রবিষ্ট হইলেন। আমাকে দেখিবামাত্র তিনি দ্বারদেশ হইতেই উচ্চস্বরে কহিলেন, “আরে কে ও! ওগিলভি যে, কেমন আছ ভাই?”

আমি। আমি বেশ ভাল আছি, তুমি কেমন আছ, বল।

চরণ। আমিও বড় মন্দ নেই—বেজায় পরিশ্রম করতে হয়—খাবার শোবার সময় নাই বলিলেও চলে।

আমি। এখন তুমি আলিপুরে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়াছিলে বুঝি?

চরণ। হাঁ, তুমি কেমন করিয়া জানিলে?

আমি। আমি খড়খড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, তুমি মিঃ কুকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা কইতেছিলে।

চরণ। তুমি মিঃ কুক্‌কে জান?

আমি। জানি। সম্প্রতি ব্রজেশ্বর রায়ের ব্যারাম হওয়াতে মিঃ কুক্ আমাকে ডাকতে আসিয়াছিলেন। সেই রোগেই রায় মহাশয় মারা পড়েন। তুমি এখন কাহার চিকিৎসা করিতেছ, বল দেখি।

চরণ। কেন, তোমার এত আগ্রহের কারণটা কি আগে বল দেখি।

আমি। কারণ আছে বৈ কি, নইলে জিজ্ঞাসা করিব কেন?

চরণ। আমি এখন মিস্ মনোমহিনীকে চিকিৎসা করিতেছি।

আমি। কেমন দেখিলে?

চরণ। অবস্থা খুব খারাপ!

আমি। বল কি? অসম্ভব! এই যে সেদিন আমি তাঁহাকে সুস্থ শরীরে ইডেন-গার্ডেনে বেড়াইতে দেখিয়াছিলাম।

চরণ। কখনই না—তুমি ভুল দেখেছ। মিস্ মনোমোহিনীর দেহ আজ কয়েকমাস হইতে ভগ্ন হইয়া পড়িয়াছে। ওকি! তোমার মুখ অমন সাদা হ’য়ে গেল কেন? তোমার হয়েছে কি?

আমি। সে কি? তুমি কি তবে বলিতে চাও যে, তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়াছে?

চরণ। মস্তিষ্ক বিকৃত? কৈ না, তাহা ত কিছু নয়। তাঁহার মানসিক কোন রোগ ত দেখিলাম না। মিস্ মনোমোহিনীর যক্ষ্মাকাস হইয়াছে—আমার বিশ্বাস, তিনি খুব জোর আর এক সপ্তাহ কাল বাঁচিতে পারেন।

আমি চরণদাসের কথা শুনিয়া অবাক হইলাম। সে হয় ত ঠিক কথা বলিতেছে, আমি তবে কি স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম। স্বপ্নে মিস্ মনোমোহিনীর সহিত ইডেন-উদ্যানে কথা কহিয়াছিলাম? চরণদাসের কথা আমি বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। যদি চরণদাস আমায় বলিত যে, মিস্ মনোমহিনীর মস্তিষ্ক খারাপ হইয়া গিয়াছে, তিনি উন্মাদিনী হইয়াছেন, তাহা হইলে সে কথায় আমি আস্থা স্থাপন করিতে পারিতাম। যক্ষ্মাকাসের কোন চিহ্নই ত পূর্বে দেখি নাই। মিস্ মনোমোহিনীর ত কাসির নাম মাত্র ছিল না।

আমি বলিলাম, “বন্ধু! নিশ্চয় তোমার ভুল হইয়াছে। তুমি যাহার চিকিৎসা করিতেছ, সে কখনই মিস্ মনোমোহিনী নয়; হয় ত অন্য কোন রমণীর চিকিৎসা করিবার জন্য তোমায় লইয়া গিয়াছিল, তুমি তাহাকেই মিস্ মনোমোহিনী মনে করিয়াছ।”

চরণদাস হাসিয়া উত্তর করিল, “তুমি কি পাগল হইয়াছ না কি? এখন আধঘণ্টা হয় নাই, আমি মিস্ মনোমোহিনীকে দেখিয়া আসিলাম, আর তুমি বলিতেছ, আমার ভুল হইয়াছে?”

আমি। যদি তা’হয়, তাহা হইলে তুমি ঠিক রোগ ধরিতে পার নাই। ভুল চিকিৎসা করিতেছ। তুমি বল দেখি, মিস্ মনোমোহিনী দেখিতে কেমন? তাঁহার চেহারা কি রকম?

চরণদাস অবিকল বর্ণন করিল। সে বর্ণনায় মিস্ মনোমোহিনী ছাড়া অন্য কাহাকেও আমার মনে হইল না। আমি আর স্থির হইয়া বসিয়া থাকিতে পারিলাম না। চেয়ার হইতে উঠিয়া গৃহমধ্যে এদিক-ওদিক্ পাগলের মত বেড়াইতে লাগিলাম। ক্ষণকাল পরে বলিলাম, “বন্ধু, তুমি হয় ত মনে করিতেছ, আমি পাগলের মত প্রলাপ বকিতেছি—কিন্তু তা নয়! আমি যাহা বলিতেছি, তা ঠিক। আমি তোমায় বলিতে পারি, সে কখনই মিস্ মনোমোহিনী নয়। তবে তুমি তাঁহার চেহারার যে রকম বর্ণন করিলে, তাঁহাকে ছাড়া আর কাহাকে চিকিৎসা করিতেছ, এ আমার মনে হয় না। তাঁহার চেহারা, আকার, প্রকার, গঠন, তুমি অবিকল বর্ণন করিয়াছ। কে জানে, বলিতে পারি না, মিস মনোমোহিনীর কোন যমজ ভগ্নী আছেন কি না, নহিলে তাঁহার এত সত্বর এত বড় একটা শক্ত ব্যারাম হইবে, তা’ আমি কিছুতেই ধারণা করিতে পারি না।”

চরণ। তুমি আমাকে অবাক্ করিলে ভাই! তাহার মাতা মিসেস্ রায়ের মুখে আমি শুনিয়াছি যে, মিস্ মনোমোহিনী আজ কয়েক মাস হইতে কাস রোগে ভুগিতেছেন।

আমি। তার মাতা? বিমাতা বল।

চরণ। ওঃ—তা’ আমি জানি না। যাক্ সে যা’ই হ’ক, তাতে কিছু আসে-যায় না। আমি জানিতাম না যে, তুমি ও বাড়ীতে কিছুদিন পূর্বে চিকিৎসা করিয়াছিলে। এখন ব্যারামটি কিছু শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। কালই পরামর্শ করিবার জন্য আর একজন ডাক্তার আনিবার কথা উত্থাপন করিব।

সকালে যখন মিস্ মনোমোহিনীকে দেখিতে যাইব, তখন মিসেস্ রায়ের নিকট তোমার নাম করিব—কি বল? তোমায় যদি ডাকিয়া পাঠান হয়, তা হলে তুমি যাইবে ত? তুমি গেলেই বুঝিতে পারিবে, আমি যাহা বলিতেছি, তাহার একবিন্দুও মিথ্যা নহে। আর বোধ হয়, রোগ আমি ঠিক ধরিয়াছি—চিকিৎসাও ঠিক চলিতেছে। যাহা হউক, তুমি গেলেই সব ঠিক হইবে।

আমি। যদি আমি দেখি, তা’ হলে অবশ্য বিশ্বাস করিব—কিন্তু যতক্ষণ না দেখিতেছি, ততক্ষণ আমার মনের এ ধারণা ঘুচিবে না।

এই কথা বলিয়া চরণদাসের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম। সারারাত্রি আমার নিদ্রা হইল না। মিস্ মনোমোহিনীর কথা ভাবিতে ভাবিতে রজনী প্রভাত হইয়া গেল।


প্রাতে উঠিয়াই দেখিলাম, আমার বন্ধুবর রাজীবলোচন গোয়েন্দা আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য বসিয়া আছেন।

অন্যান্য কথাবার্তার পর আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন আলিপুরের খবর কি, বলুন।” রাজীবলোচন বলিলেন, “মিসেস্ রায়ের একজন দাসী আছে, তাহার সহিত কাল আলাপ করিয়াছিলাম। সে সহসা কোন কথা বলিতে চাহে না। বলে, ‘কাজ কি, মশায়,—আমাদের সে সব কথায়? ও সব বড় ঘরের কথা নিয়ে কি শেষকালে বিপদে পড়ব। বড় ঘরের বড় কথা—আমাদের সে সব কথার দরকার কি?’ তার পর আমি যখন তাহার হাতে একেবারে একখানি দশটাকার নোট গুঁজিয়া দিলাম, তখন সে সন্তুষ্ট হইয়া আর বড় ঘরের কথা বলিতে কোন আপত্তি উত্থাপন করিল না। সে বলিল, মিসেস্ রায় তাঁহাকে রজনীতে বাড়ী হইতে চলিয়া যাইতে বলেন—রজনীতে বাড়ীর মধ্যে অন্য কোন লোক থাকে, ইহা তাঁহার ইচ্ছা নয়; কিন্তু ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় জীবিত থাকিতে দুই-একদিন বাড়ী যাইতে অধিক রাত্রি হওয়াতে, দাসী বাড়ী ফিরিয়া যায় নাই। লুকাইয়া নীচের ঘরে শুইয়া থাকিত। সেই দুই-একদিনে তাহার বিশ্বাস হইয়াছে যে, ঐ বাড়ীতে প্রেতযোনি আছে। রাত্রে ভয়ানক গোঙানির শব্দ শোনা—”

আমি। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যুর পরেও কি সে-ঐরূপ গোঙানি শব্দ শুনিয়াছিল?

রাজীব। দাসী বলে, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যুর দুই-একদিন পূর্বে এবং পরেও সে ঐ প্রকার শব্দ শুনিয়াছিল। তাহাই ভূতের ভয়ে সেই অবধি সেই আর ও বাড়ীতে রাত্রি যাপন করে না।

আমি। বলেন কি! তা হলে মিস্ মনোমোহিনীর কথার সহিত অনেকটা মিলিতেছে।

রাজীব। ডাক্তার, শুধু নাড়ী টিপিলে হয় না। সকল বিষয়ই একটু তলিয়ে বুঝে দেখা চাই।

আমি। মিস্ মনোমোহিনীর শরীর অসুস্থ, এ কথা ঠিক ত?

রাজীব। হাঁ।

আমি। এই কয় দিনের মধ্যে এতবড় একটা শক্ত ব্যারাম কেমন করিয়া তাঁহার শরীর মধ্যে প্রবেশ করিল—আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।

রাজীব। কি করিব বলুন—রোগ কখন কি রকমে হয়, তা’ আপনারা বলিতে পারেন। আমি কেবল এই পৰ্য্যন্ত জানি—মিস্‌ মনোমোহিনী অত্যন্ত পীড়িতা।

আমি। দাসীর কাছে আর কিছু সংবাদ পাইলেন?

রাজীব। সে বলে মিঃ কুক্‌কে সে রাত্রের ঐরূপ গোঙানি শব্দের কথা একদিন বলিয়াছিল। তাহাতে তিনি অত্যন্ত রাগিয়া তিরস্কার করেন। তাহাই সেই পর্য্যন্ত সে আর সে সকল কথা উত্থাপন করিতে সাহস করে নাই। মিস্ মনোমোহিনীকে বড় ভালবাসে, তাঁহার শরীর অসুস্থ হওয়াতে সে বড় চিন্তিত হইয়াছে।

আর অন্যান্য দুই-চারিটি কথার পর গোয়েন্দা মহাশয় বিদায় গ্রহণ করিলেন। আমি অপার চিন্তাসাগরে নিমগ্ন হইলাম।


আমার মনে হইতে লাগিল, আমি সকলই স্বপ্ন দেখিতেছি। যেন স্বপ্নে কথা কহিতেছি, স্বপ্নে ঘুরিয়া-ফিরিয়া বেড়াইতেছি, স্বপ্নে সকল কার্য্য করিতেছি। কোন ঘটনাই মিলিতেছে না—ঘটনাবলীর পরস্পরের সহিত যেন কোন সম্বন্ধ নাই। এই সেদিন ইডেন-গার্ডেনে মিস্ মনোমোহিনীকে দেখিলাম, তাঁহার সহিত কথা কহিলাম, তাঁহার শরীর অসুস্থ কি না কিছুই ত বুঝিতে পারিলাম না।

চরণদাসবাবু যাঁহার চিকিৎসা করিতেছেন, তাঁহার যক্ষ্মাকাস হইয়াছে। সে রোগীও মিস্ মনোমোহিনী নামে অভিহিত। তাহার আকার-প্রকার চরণদাসবাবু যে প্রকার বর্ণনা করিলেন, তাহাও ঠিক মিস্ মনোমোহিনীর সহিত মিলিয়া গেল। অথচ অল্প দিন পূর্বে তাঁহার আকার-প্রকার, তাঁহার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু জানিতে পারা যায় নাই যে, তিনি অত বড় একটা শক্ত রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন।

তারপরে আমার বন্ধু গোয়েন্দা মহাশয়ের মুখে দাসীর কথা যাহা শুনিয়াছি, এবং সে রায় মহাশয়ের বাড়ীতে রজনীতে যে প্রকার শব্দের কথা বলিয়াছিল, সে কথার সহিত মিস্ মনোমোহিনীর কথা অবিকল মিলিয়া যাওয়াতে আমার সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হইতে লাগিল। কিন্তু একটা বিষয় যেন বেশ স্পষ্ট বোঝা যাইতেছে। মিস্ মনোমোহিনী, তাঁহার পিতার মৃত্যুর পর দিবস আমার নিকট আসিয়া যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার বিকৃত মস্তিষ্কের কাল্পনিক উদ্ভাবনা মনে করিয়া আমি সে সকল কথার উপরে কোন আস্থা না রাখিয়া অগ্রাহ্য করিয়াছিলাম বলিয়া মনে বড় আক্ষেপ জন্মিল।

আমি যাহা স্থির করিয়াছিলাম, তাহা সত্য হইলেও হইতে পারে; এ রকম ঘটনাও যে ঘটে না, তাহাও নয়; কিন্তু এমনও ত হইতে পারে যে, তাঁহার বর্ণিত ঘটনাগুলি সত্য বলিয়াই, তাঁহার মনে সেই প্রকার ভীতির সঞ্চার হওয়াতে তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃতভাব ধারণ করিয়াছিল। সে বিকৃত ভাবের পূর্ব্বে তিনি যাহা দেখিয়াছিলেন, সে সকল ঘটনার মূলে হয়ত নিগুঢ় তত্ত্ব নিহিত থাকিতে পারে। যাহাই হউক, তিনি সেদিন যখন আমায় সেই সকল কথা বলিতেছেন, তখন তাহা একেবারে অবিশ্বাস করাটা আমার ভাল হয় নাই।

মনোমোহিনীর বিষয় ভাবিতে ভাবিতে আমারও মস্তিস্ক বিকৃত হইবার উপক্রম হইল। আমি যেন আর ভাবিতে পারিলাম না। সমস্ত ঘটনাই যেন অসংলগ্ন বোধ হইতে লাগিল। কোন ঘটনার সহিত যেন কোন ঘটনার কোন সম্বন্ধ নাই—সবই যেন অন্ধকার! সবই যেন ভয়ানক রহস্য-জালে জড়িত! আমি উন্মত্তের ন্যায় গৃহমধ্যে পরিভ্রমণ করিতে লাগিলাম।

পরদিন চরণদাসের সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হে রায় মহাশয়ের বাড়ীর খবর কি?”

চরণ। খারাপ—বড় খারাপ! আমি যাহা বলিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিল দেখিতেছি—যাক্ সে কথা। দেখ, আমি পরামর্শ করিবার জন্য তোমায় ডাকিবার প্রস্তাব করিয়াছিলাম—

আমি। তারপর?

চরণ। প্রথমে, যখন পরামর্শ করিবার কথা উত্থাপন করিলাম, তখন তাহাতে কেহ অসম্মতি প্রকাশ করিলেন না; কিন্তু তোমার নাম করাতেই আপত্তি হইল। সব কথা আমার মনে নাই। আর সব কথা তোমার শুনিয়াও কাজ নাই। মিসেস্ রায় তোমার চিকিৎসার বড় পক্ষপাতী নহেন। তাঁহার ইচ্ছা, যদি পরামর্শ করিবার একান্তই আবশ্যক হয়, তাহা হইলে মেডিকেল কলেজের অন্য কোন বিজ্ঞ ইংরাজ ডাক্তারকে আনাইয়া পরামর্শ করা উচিত। আমি তাঁহার মনোভাব বুঝিয়া আর দ্বিতীয়বার তোমার কথা বলিতে ইচ্ছা করিলাম না।

আমি। মিস্ মনোমোহিনীর অবস্থা তাহা হইলে এখন বড় খারাপ?

চরণ। হাঁ, অতি সত্বরেই তাঁহার মৃত্যু হওয়া সম্ভব।

আমি। তুমি আজ আবার তাঁহাকে দেখিতে যাইবে?

চরণ। যাইব।

আমি। মেডিকেল কলেজের সে ডাক্তার কখন আসিবেন?

চরণ। বোধ হয়, কাল সকালে তাঁহাকে আনা হইবে।

আমি। তিনি কি বলেন, আমি কেমন করিয়া জানিতে পারিব?

চরণ। আমি তোমায় বলিয়া যাইব।

আমি। যদি না আসিতে পার বা তুমি যে সময় আসিবে, সে সময়ে যদি আমি বাড়ীতে না থাকি?

চরণ। তাহা হইলে আমি তোমায় পত্রদ্বারা জানাইব।

আমি। বেশ তাই ভাল।

এইরূপ কথাবার্তার পর আমি বিদায় গ্রহণ করিলাম। সে রাত্রি আমার নিদ্রা হইল না—নানা প্রকার ভাবনা-চিন্তায় কাটিয়া গেল।


সকাল বেলা আমি যে সময় চা পান করিতেছি, সেই সময় একজন অপরিচিত লোক আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। আমি প্রথমে মনে করিয়াছিলাম, তিনি কোন রোগের চিকিৎসার জন্য আমার নিকট আসিয়াছেন; কিন্তু তাঁহার আকার-প্রকার দেখিয়া তাঁহাকে নিরোগ বলিয়াই বোধ হইল।

তিনি কহিলেন, “আপনার সহিত আমার পরিচয় নাই। আমিও আপনাকে চিনি না-আপনিও আমাকে জানেন না। আমি আপনার কাছে চিকিৎসার জন্য আসি নাই।”

সে কথা তিনি বলিবার পূর্বেই আমি অনুমান করিয়াছিলাম। আমি তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলাম।

তিনি বলিলেন, “আমার নাম—মূলার। আমি শুনিয়াছি, আপনি ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে কাহার চিকিৎসা করিতেছিলেন। এখন আমি জানিতে চাই, সেই বাড়ীতে আপনি মিঃ কুক্‌ নামে কোন লোককে দেখিয়াছেন কিনা? যিনি মিঃ কুক্ নামে পরিচিত, তিনি আর কোন নামে অভিহিত হয়েন কি না, তাহাই জানিবার জন্য আমি আপনার কাছে আসিয়াছি। তাঁহাকে মিঃ ডিসিল্ভা নামে কেহ ডাকেন কি না?

আমি। আমি মিঃ কুকের ভগ্নীপতির চিকিৎসা করিবার জন্য গিয়াছিলাম। যাহা হউক, আপনি এ সকল কথা আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?

মূলার। সে অনেক কথা।

আমি। আমার এখন কোন কাজ নাই—অনেক কথা হইলেও আমি তাহা এখন শুনিতে পারি আমার সময় আছে। আর আপনার অনেক কথা শুনিবার জন্য আমার বড় কৌতূহল হইতেছে।

আমি বুঝিলাম, তিনিও আমায় সে সকল কথা বলিবার জন্য প্রস্তুত আছেন, কেবল আমার সময় আছে কিনা, তাহাই জানিবার অপেক্ষায় ছিলেন।


মিঃ মূলার বলিতে আরম্ভ করিলেন, “সে অনেক ঘটনার কথা। তাহার গোড়ার ঘটনার সহিত যদিও মিঃ কুকের কোন সম্পর্ক নাই; তথাপি সমস্ত কথা না বলিলে আপনি ভাল বুঝিতে পারিবেন না বলিয়া আমায় বলিতে হইবে।

“আলিপুরে আমার জন্ম হয়। আঠার বৎসর বয়সে আমি গৃহত্যাগ করি। ব্যবসা-বাণিজ্য করিবার অভিপ্রায় ছিল, কিন্তু অর্থের সুবিধা না হওয়ায় কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ কেিত পারি নাই। আমার তখনও যে অবস্থা, এখনও তাই। তখনও দিন আনিতাম, দিন খাইতাম—এখনও দিন আনি, দিন খাই। প্রথমতঃ আমি পুনায় যাই। সে সময়ে মানুষ চেষ্টা করিলে নিজের উন্নতি করিতে পারিত; চেষ্টা থাকিলে অর্থের তাদৃশ আবশ্যক হইত না। আমার যথেষ্ট চেষ্টা ছিল, ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিশেষ অনুরাগ ছিল, সুতরাং অল্প দিনের মধ্যেই আমি অর্থ সঞ্চয় করিতে সমর্থ হইলাম। তখন আমার প্রিয়জন সাক্ষাতের আগ্রহ বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। যখন আমি পুনায় ব্যবসা-বাণিজ্য করিতে ছিলাম, তখন মাঝে মাঝে মাতাকে পত্র লিখিতাম ও টাকা পাঠাইতাম। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবকে পত্র লিখিতে বিরত থাকিতাম না। পাঁচ বৎসর হইল, আমার মাতাঠাকুরাণীর কাল হইয়াছে। আমি জানিতাম, বাবাও সে সময়ে বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন, পরিশ্রম করিয়া অর্থোপার্জ্জন করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল; তাহার উপর তিনি লেখাপড়া কিছুই জানিতেন না- এমন কি পত্রাদিও লিখিতে পারিতেন না। অনেক দিন পর্য্যন্ত তাঁহার কোন সংবাদ পাইলাম না। আমি টাকা পাঠাইতাম, কিন্তু বাবা তাহা পাইতেন কি অপর কোন লোকে তাহা লইত, তাহা জানিতাম না।

“আমি বিবাহ করিয়াছিলাম। একটি পুত্র-সন্তানও জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। দুই বৎসর গত হইল, আমার পুত্রটি কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে। সেই শোকে আমার স্ত্রী অকালে আমায় পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। নবীন উৎসাহে অনেক আশা করিয়া আমি যে সংসার পাতিবার আয়োজন করিতেছিলাম, স্ত্রী পুত্রের মৃত্যুতে সে উৎসাহ ভাঙ্গিয়া গেল; জীবনের সুখ শান্তি বিলুপ্ত হইল, আর অর্থ সঞ্চয়ের জন্য তাদৃশ চেষ্টা রহিল না—গৃহে ফিরিয়া আসিবার জন্য মন বড় চঞ্চল হইল।

“প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পূর্বে আমি দেশে ফিরিয়া আসিয়াছি। দেশের এখন সে চেহারাই নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কত পরিবর্ত্তন হইয়া গিয়াছে, তাহা বলিতে পারি না। ছোট ছোট গ্রামগুলি এখন যেন এক-একটি ছোট-খাট শহর হইয়াছে বলিলেও চলে। দেশে ফিরিয়া আসিয়া চারিদিক্ দেখিয়া আমার মনে এই সকল কথাই প্রথমে উদিত হইল। আমারও একখানি ছোট-খাট কুঁড়ে ছিল, আঠার বৎসর বয়ঃক্রম কালে আমি তাহা পরিত্যাগ করিয়া যাই। তখন দেশের যে সকল বালক-বালিকাকে দেখিয়া গিয়াছিলাম, তাহারা এখন কত বড় হইয়াছে—যে সকল বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে জানিতাম ও চিনিতাম তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই ধরাধাম পরিত্যাগ করিয়াছেন। তার পর ত্রিশ বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে, দেশের আর সে চেহারাই নাই—আমার পক্ষে সকলই যেন নূতন, সকলই যেন অপরিচিত বলিয়া বোধ হইতেছে।

“নিজের বাড়ী চিনিয়া লইতেও অনেক বিলম্ব হইল। তথায় কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া পিতার অনেক অনুসন্ধান করিলাম। যদি জানিতাম তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, তাহা হইলেও আমার তাহা অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ ছিল না, কিন্তু শুনিলাম যে, পিতা এক সপ্তাহ পূর্বে কোথায় চলিয়া গিয়াছেন। আমার বড় কষ্ট হইল—প্রাণে দারুণ আঘাত লাগিল।

“প্রতিবেশীগণের মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে আন্দাজে একটা দিন ও তারিখ স্থির করিলাম যে, ২৮শে জুন তারিখে তিনি মিঃ ডিসিল্ভা নামক এক ব্যক্তির সহিত গৃহত্যাগ করিয়াছেন।

“শুনিলাম মিঃ ডিসিল্ভা নামক একজন লোক আলিপুরে আমাদের বাড়ীর নিকট আসিয়া একটি ছোট-খাট বাড়ী ভাড়া করেন। পিতার সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় হয়। পিতা দরিদ্র বলিয়া প্রতিবেশীগণের মধ্যে অনেকেই তাঁহার সহিত কোন প্রকার ঘনিষ্ঠতা করিতেন না। এমন কি পাছে তিনি কখনও কাহারও নিকট কিছু প্রত্যাশা করেন, এই ভয়ে কেহই তাঁহার ত্রিসীমায় আসিতেন না। আত্মীয়-স্বজনগণ ত বহু পূর্বেই তাঁহার সহিত সম্পর্ক রহিত করিয়াছিলেন। অতি কষ্টে পিতার দিন চলিত। আমি মধ্যে মধ্যে যাহা পাঠাইতাম ও তাঁহার নিজের পূর্ব সঞ্চিত যাহা কিছু ছিল, তাহা হইতেই তাঁহার জীবনধারণ হইত।

“মিঃ ডিসিল্ভা এই সকল কথা প্রতিবেশীগণের মুখে শুনিয়াছিলেন, ও বোধ হয়, স্বকার্য্য উদ্ধার বাসনায় তাহার সহিত ঘনিষ্ঠতা করিয়াছিলেন। হয় ত পিতা তাঁহাকে দুরবস্থার কথা জানাইয়াছিলেন, হয় ত তিনি বলিয়াছিলেন, আমি আঠার বৎসর বয়ঃক্রমকালে গৃহত্যাগ করিয়া আর ফিরিয়া আসি নাই এবং ফিরিয়া আসিবারও কোন সম্ভাবনা নাই। মিঃ ডিসিল্ভা পিতাকে মধ্যে মধ্যে অর্থ সাহায্য করিতেন। এমন কি, আমি প্রতিবেশীগণের মুখে শুনিয়াছি যে, তিনি আমার পিতার প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া, তাঁহার ভার গ্রহণ করিতেও সম্মত হইয়াছিলেন।

“পিতা যদিও অত্যন্ত বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, যদিও তাঁহার জীবনধারণের উপযুক্ত অর্থ-সম্পত্তি ছিল না, তথাপি তিনি মৃত্যুকামনা করিতেন না। জগতের মধ্যে দেহের উপর সকলের যেরূপ মমতা থাকা সম্ভব, তাঁহারও তাহা ছিল। কাজেকাজেই অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া অপেক্ষা মিঃ ডিসিল্ভার প্রস্তাবে সম্মত হওয়াই উচিত বিবেচনা করিয়াছিলেন।

“পিতার সম্মতিক্রমে মিঃ ডিসিল্ভা তাঁহাকে লইয়া যান্‌; কিন্তু কোথায় যাইবেন, কোথায় থাকিবেন, তাহা কাহাকেও কিছু বলিয়া গেলেন না। প্রতিবেশীগণের মধ্যেও কেহ জানিয়া রাখিবার ঔৎসুক্য প্রকাশ করিলেন না। আমি আলিপুরে তাঁহারও গতিবিধির কোন সূত্র না পাইয়া প্রতিজ্ঞা করিলাম যে, যেমন করিয়াই হউক, আমি তাঁহার সন্ধান লইব, যেমন করিয়া পারি—তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব।

“আমি কলিকাতায় আসিয়া একজন গোয়েন্দার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমার পিতার অনুসন্ধান করিবার ভার গ্রহণ করিলেন। তিনি আমায় যেসকল কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহার অনেক কথার উত্তর দিতে পারিলাম না। জানিবার মধ্যে কেবল এইমাত্র জানিতাম যে, আমার পিতা ২৮শে জুন তারিখে সন্ধ্যার সময় গৃহত্যাগ করেন।

“অনেক অনুসন্ধানের পর সেই গোয়েন্দা আমায় একদিন বলিলেন যে, তিনি মিঃ ডিসিল্ভার সন্ধান পাইয়াছেন। তিনি আলিপুরে রায় মহাশয়ের বাড়ীতে আছেন।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোথায়? ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে?”

মূলার বলিলেন, “হাঁ, সেইখানেই বটে। যাহা হউক, আমার নিযুক্ত গোয়েন্দা এই পৰ্য্যন্ত সন্ধান দিয়াই আর একটা শক্ত মামলা লইয়া লক্ষ্মৌ যাত্রা করিলেন। কাজেকাজেই আমার উদ্বিগ্নচিত্ত আর প্রবোধ মানিল না—আমি রায় মহাশয়ের বাড়ীতে মিঃ ডিসিল্ভার সহিত সাক্ষাৎ করিব, স্থির করিলাম। গত সোমবারে আমি ব্রজেশ্বর রায়ের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। তথায় গিয়া যাহা শুনিলাম, তাহাতে মিঃ ডিসিল্ভা নামে কোন ভদ্রলোক তথায় থাকেন বলিয়া আমার বোধ হইল না। তবে কি গোয়েন্দা মিথ্যা বলিয়া আমায় ভুলাইয়া গেলেন, না তাঁহার ভ্রম হইল? মিঃ কুকের সহিত সে বাড়ীতে আমার সাক্ষাৎ হইল। কথায় কথায় তাঁহার সহিত রাগারাগিও হইল, শেষে যখন আমার ভ্রম বুঝিতে পারিলাম, তখন তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া, রায় মহাশয়ের বাড়ী হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। আমার চেষ্টা এইখানেই ফুরাইল। গোয়েন্দা মহাশয় ফিরিয়া না আসিলে আর কোন কাৰ্য্যই হইবে না ভাবিয়া, আমি তখনকার মত নিরস্ত হইলাম।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে আপনি এখানে আসিয়া প্রথমেই আমাকে মিঃ কুকের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন কেন?”

মূলার কোন কারণ দর্শাইতে পারিলেন না। আমার মুখের দিকে বিস্মিত নয়নে চাহিয়া, কি উত্তর দিবেন, তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। ক্ষণকাল এইরূপ চিন্তার পর তিনি কহিলেন, “আমি রায় মহাশয়ের বাড়ী হইতে ফিরিয়া আসিয়াই আমার গোয়েন্দাকে সকল কথা খুলিয়া লিখিলাম। তাহাতে তিনি এই উত্তর দিয়াছেন—

গোয়েন্দার পত্ৰ

“আপনি রায় মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া বড় অন্যায় কাজ করিয়াছেন। আপনার পিতার ও মিঃ ডিসিল্ভার অনুসন্ধানের জন্য আপনি যখন আমার উপর ভার দিয়াছেন ও সেইজন্য অর্থব্যয় করিতেছেন, তখন আমার উপর আপনার সম্পূর্ণ নির্ভর করাই উচিত ছিল। আপনি যদি এত অধীর হয়েন, তাহা হইলে সমস্ত কাৰ্য্যই বিফল হইয়া যাইবে। আমি যতদিন না কলিকাতায় ফিরিয়া যাই, ততদিন আপনি এ প্রকার অন্যায় কার্য করিতে বিরত থাকিবেন। কারণ আপনি গোয়েন্দাগিরির কিছু বুঝেন না। স্বেচ্ছায় যাহা কিছু করিতে যাইবেন, তাহাতেই পদে পদে ভ্রম-প্রমাদ ঘটিবে ও তাহাতে আপনার অনিষ্ট বই ইষ্ট হইবে না। আপনি এই একবার রায় মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া কতদূর খারাপ কাজ করিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না। আপনি লিখিয়াছেন, আমি ভুল করিয়াছি, কিন্তু দেখিবেন, আমি যাহা বলিয়াছি, কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া তাহাই প্রমাণ করিব। তাহার এক বর্ণও মিথ্যা হইবে না। মিঃ কুক্‌ই যে সেই মিঃ ডিসিল্ভা, তাহাতে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। তবে প্রমাণ প্রয়োগের কিছু অভাব ছিল বলিয়াই, আমি তখন কিছু করিয়া উঠিতে পারি নাই। আপনি ব্যস্ত হইবেন না— আমি শীঘ্রই ফিরিয়া গিয়া আপনার পিতার সন্ধান করিয়া দিব।

ইতি— আপনার নিয়োজিত গোয়েন্দা”

পত্রখানি পাঠ শেষ করিয়া মিঃ মূলার কহিলেন, “গোয়েন্দা মহাশয়ের আগামী কল্য আসিবার কথা আছে; কিন্তু আমি কিছুতেই সুস্থির হইতে পারিতেছি না। আর যদিই আমি গোয়েন্দার সাহায্য ব্যতীত কোন সন্ধান করিতে পারি, তাহাই বা না করিব কেন? এই বিবেচনায়, গোয়েন্দা মহাশয় আমায় নিবারণ করিলেও আমি পিতার অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছিলাম। শুনিলাম, কিছুদিন পূর্বে আপনি ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে চিকিৎসা করিয়াছিলেন। তাই আমি আপনার কাছে আসিয়াছি। আশা করি, কোন কোন বিষয়ে আপনি আমায় অনুসন্ধান দিতে পারিবেন।”

আমি। আমার যথাসাধ্য, আমি আপনার জন্য করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু যতক্ষণ পর্য্যন্ত আপনার নিয়োজিত গোয়েন্দা, তাঁহার কথাগুলি সপ্রমাণ করিতে না পারেন, ততক্ষণ পর্য্যন্ত কোন কাজ করা যায় না—কোন কথাও বলা উচিত নয়।

তিনি কহিলেন, “গোয়েন্দারা যে কোথা হইতে কি সংগ্রহ করেন, কেমন করিয়া অনুসন্ধান করেন, তাহা বুঝিবার কোন উপায় নাই। তিনি যেরূপ অনুসন্ধানে যে ফল পাইয়াছেন, তাহা বলিলে আমার মন অনেকটা প্রবোধ মানিত। আমিও বুঝিতে পারিতাম, তাঁহার চেষ্টায় কোন ফল ফলিবে কি না। কিন্তু ইনি সহজে কোন কথা বলিতে চাহেন না।”

আমি। সে যাহা হউক, আপনার কথা শুনিয়া এ ঘটনায় আমারও বিশেষ আগ্রহ জন্মিয়াছে। আপনিও গোয়েন্দার মুখ হইতে অন্য কথা শুনিবার জন্য যেমন ব্যগ্র হইয়াছেন, আমিও আপনার মুখ হইতে সেই সকল কথা শুনিবার জন্য তেমনি ব্যগ্র হইয়া রহিলাম, জানিবেন। এখন যে পৰ্য্যন্ত শুনিলাম, তাহাতে আমার গোয়েন্দার কথায় পুরা বিশ্বাস হয় না। এমন কি, অসম্ভব বলিয়া মনে হয় আমি যদি আপনার নিয়োজিত গোয়েন্দার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করি, তাহাতে বোধ হয়, আপনার কোন আপত্তি—“

তিনি। (বাধা দিয়া) না—না—আমার আর তাতে আপত্তি কি? কিন্তু কাল তাঁহার কলিকাতায় আসিয়া পৌঁছিতে অনেক রাত হইতে পারে, সে সময়ে সাক্ষাৎ করা কি, আপনার সুবিধা হইবে? আমি। যত রাতই হউক না কেন, আপনি তাঁহাকে এখানে আনিবেন। আমার সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করিবার আপনার কোন আবশ্যক নাই।

তার পর অন্যান্য দুই-চারিটি কথার পর মিঃ মূলার বিদায় গ্রহণ করিলেন।

তিনি যে গোয়েন্দাকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, আমার বন্ধু গোয়েন্দার নিকটে তাঁহার নাম অনেকবার শুনিয়াছি। সুতরাং তাহার সহিত আলাপ করা আমি আবশ্যক বিবেচনা করিলাম। আমার বন্ধু গোয়েন্দার নাম রাজীবলোচন বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মিঃ মূলার কর্তৃক নিয়োজিত গোয়েন্দার নাম ধনদাস পাকড়াশী। শুনিয়াছিলাম, ধনদাস রাজীবলোচনের নিম্নতন কৰ্ম্মচারী। সুতরাং ধনদাস এই ঘটনায় যাহা কিছু সন্ধান পাইয়াছেন, তাহা হয় এতক্ষণ রাজীবলোচনের কর্ণগোচর হইয়াছে, নয় তিনি জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন। মনে অনেকটা আশা হইল যে, হয়ত এই দুইজন গোয়েন্দার সাহায্যে এই নিগূঢ় রহস্যের মর্ম্মোদ্ভেদ করিতে পারিব।


কতক্ষণে দিন রাত কাটিয়া পরদিন আসিবে, আমি তাহাই প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। মিঃ মূলারের মুখে আমি যে সকল কথা শুনিলাম, তাহাতে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীর ঘটনা সম্বন্ধে আমার কৌতূহল এত অধিক মাত্রায় বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল যে, কতক্ষণে ধনদাস পাড়াশীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে, তাহাই আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম। সেদিন যেন আর কাটে না — সেদিন যেন অতি প্রকাণ্ড বলিয়া আমার বোধ হইতে লাগিল।

যদিও ভয়ানক সন্দেহ-বহ্নিতে আমি জ্বলিতে লাগিলাম, তথাপি তাহা হইতে উদ্ধার লাভের কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না। সমস্ত দিনের মধ্যে আমি আর কোন কাজ করিতে পারিলাম না। কি যে ভাবিতেছি, তাহার ঠিক নাই—অথচ সর্ব্বদাই চিন্তিত— ঘোরতর চিন্তিত। কিসের এত চিন্তা, কিছু বুঝিতে পারি না—অথচ ক্রমাগতই চিন্তা করিতেছি।

মিস্ মনোমোহিনীর কেহ কোন হানি করিবে, এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না। তাঁহার অনিষ্টসাধন করিবার লোক ত আমি খুঁজিয়া পাই না। আমার চক্ষে সে ললনা কাহারও নিকটে কোন প্রকারে অপরাধিনী হইতে পারেন না। তাঁহার অনিষ্টসাধনে কাহারও কিছু লাভ হইবে না।

মিস্ মনোমোহিনী বা ঐ নামে আর কোন রমণী যে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে মৃত্যুশয্যায় শায়িত, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নাই।

ধীরে ধীরে সেদিন কাটিয়া গেল। পরদিন প্রাতঃকালে উঠিয়াই আমি চরণদাসের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সে আমাকে দেখিয়াই এমন চকিতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল যে, সহসা প্রেতযোনী সম্মুখীন হইলেও লোকে এত চমকিত হয় কিনা, বলিতে পারি না।

“আরে এস ওগিলভি! এই দুইদিনের মধ্যে তোমার চেহারার কি আশ্চর্য্য পরিবর্তন ঘটিয়াছে! তুমি কি মিস্ মনোমোহিনীর কথা ভেবে ভেবে পাগল হবে না কি? তোমার হয়েছে কি? নিজের ছেলে মেয়ের শক্ত ব্যারাম হ’লেও যে, লোকে এত চিন্তিত হয় না।” চরণদাসবাবু এই কথাগুলি বলিলেন।

আমি উত্তর করিলাম, “আমার কথা এখন ছাড়িয়া দাও। কেন এই দুইদিনের মধ্যে আমার এত পরিবর্ত্তন হইয়াছে, সে কথা আমি তোমায় পরে বলিব। মিস্ মনোমহিনী কেমন আছেন?”

চরণ। কাল রাত্রি আটটার সময়ে একটা বড় টাল গিয়াছে—অবস্থা বড় খারাপ দাঁড়াইয়াছিল। আজকের দিন যে কাটে, এমন ত আমার বোধ হয় না; কিন্তু সে যাহাই হউক, তুমি এমন ক’রে পরের ভাবনা ভাবিয়া ভাবিয়া আপনার শরীর মাটি করিতেছ কেন? আমি কিছুই বুঝিতে পারি না।

আমি চরণদাসের কথায় কান না দিয়া বলিলাম, “তোমায় আমি একটি কথা জিজ্ঞাসা করি। তুমি ত অনেকবার ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়াছ। বলিতে পার, সে বাড়ীতে সর্ব্বশুদ্ধ কয়জন লোক আছে?”

চরণ। লোকের মধ্যে আমি ত মিঃ কুক্, মিসেস্ রায় ও মিস্ মনোমোহিনীকে ছাড়া আর কাহাকেও দেখিতে পাই না—আর কেহ আছে বলিয়াও আমার বোধ হয় না।

আমি। চাকর লোকজনও কেহ নাই?

চরণ। প্রায়ই মিঃ কুক্ নিজে আমায় সঙ্গে ক’রে বাড়ীর ভিতর লইয়া যান, চাকর লোকজনকে ত আমি দেখি নাই। যখনই গিয়াছি, তখনই রোগীর জন্য তাঁহাদিগকে বিশেষ চিন্তিত ও কাতর দেখিয়াছি। আমার যাইবার সময় হইলেই হয় মিঃ কুক্, নয় মিসেস্ রায়কে দরজায় আমার জন্য অপেক্ষা করিতে দেখিয়াছি।

আমি। তুমি বাড়ীর ভিতরে গিয়া কোন দিন কখনও কোন প্রকার গোঁঙানি শব্দ বা কাতর চীৎকার বা অন্য কোন প্রকার কিছু শুনিয়াছ কি না? মিঃ কুক্ ও মিসেস্ রায়ের গতিবিধিতে কোন সন্দেহের কারণ আছে কি না, আমায় বলিতে পার?

চরণ। রহস্যজালপূর্ণ বা আশ্চর্য ঘটনা যদি কিছু থাকে, বা কোন প্রকারে কোন বিষয়ে যদি আমার কিছু সন্দেহ হইয়া থাকে, তাহা হইলে তোমার এই দুই-তিন দিনের ব্যবহার, তোমার চেহারার আশ্চর্য্য পরিবর্তন ও তোমার অপূর্ব্ব প্রশ্নাবলীই আমায় কতকটা বিচলিত করিয়াছে, বলিতে হইবে। তুমি আমার কথা শুন। কি একটা ভীষণ সন্দেহে তুমি আক্রান্ত হইয়াছ, তাহা আমি বলিতে পারি না—কিন্তু বোধ হয়, তুমি অনর্থক আপনার দেহ ও মস্তিষ্ককে ক্লেশ দিতেছ। দিন কয়েকের জন্য তোমার এখন বায়ু পরিবর্ত্তন একান্ত কর্ত্তব্য হইয়া পড়িয়াছে।

আমি উচ্চ হাসি হাসিয়া চরণদাসের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম। সে অবাক্ হইয়া আমার দিকে চাহিয়া রহিল। হয় ত আমাকে উন্মত্ত বলিয়া তাহার ধারণা হইল। সে হয় নিজে গিয়া বা পত্রের দ্বারা আমার সমস্ত কথা জানাইবে বলিয়াছিল, কিন্তু সময় পায় নাই। আমি অত ব্যগ্র ভাবে তাহার বাড়ীতে প্রাতঃকালে উপস্থিত না হইলে সে বোধ হয় আমার কাছে যাইত বা পত্রের দ্বারা আমায় সমস্ত কথা জানাইত। কথায় কথায় সে কথা উঠাতে সে আপনার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়া একটু লজ্জিতও হইল এবং ক্ষমা প্রার্থনা করিল।

বাটীতে ফিরিয়া আসিয়া সেদিন যে আমার কেমন করিয়া কাটিল, তাহা আমি কিছুই বলিতে পারি না। কত লোকের কথার প্রকৃত উত্তর দিতে পারিলাম না, কত রোগীকে দেখিতে যাওয়া ভুলিয়া গেলাম। এখনও সে সকল কথা মনে হইলে আমি লজ্জা বোধ করি।

সন্ধ্যার পর আমি হুকুমজারী করিলাম যে, মিঃ মূলার ও ধনদাস পাকড়াশী ছাড়া আর যে কেহই আসুন না কেন, তাঁহাদিগকে বলা হইবে যে, আমি বাড়ীতে নাই। প্রতি মুহূর্তে আমি মিঃ মূলার ও ধনদাস বাবুর আগমন প্রত্যাশা করিতে লাগিলাম—অন্য কোন কাজই করিতে আমার আর তখন প্রবৃত্তি হইল না।


রাত্রি নয়টার সময়ে একজন অপরিচিত লোক আমার গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিবার পূর্বেই তিনি আত্মপরিচয় প্রদান করিয়া কহিলেন, “আমার নাম ধনদাস পাকড়াশী। মিঃ মূলারের কাছে শুনিলাম, আপনি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার অভিলাষ প্রকাশ করিয়াছিলেন।”

আমি আসন পরিত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার সহিত আমার সাক্ষাৎ করা অত্যন্ত আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। আপনি যদি এখানে না আসিতেন, তাহা হইল মিঃ মূলার আর আমি আপনার বাসায় আজ রাত্রেই উপস্থিত হইতাম।”

ধনদাস। মিঃ মূলারের সহিত হাবড়া ষ্টেশনে আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল;তিনি আমার জন্যই তথায় অপেক্ষা করিতেছিলেন—কারণ তিনি বাসায় আমার সাক্ষাৎ পাইতেন কি না কেহ তাহা বলিতে পারে না, আমি নিজেও বলিতে পারি না; গোয়েন্দার জীবনে কোন একটি নির্দ্দিষ্ট স্থানে থাকা-না- থাকার কিছুই নিশ্চয়তা নাই। এই এখন আপনার সহিত দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছি, দুই ঘণ্টা পরে আমি কোথায় থাকিব এবং কতদূরে যাইব, তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। মিঃ মূলার আমাকে সঙ্গে করিয়া এখানে আসিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার উপস্থিতি অনাবশ্যক ও বিপজ্জনক বলিয়া আমার ধারণা হওয়াতে আমি তাঁহাকে বিদায় দিয়াছি। তিনি বড় অস্থিরচিত্ত লোক। আমাকে একটি কার্যভার প্রদান করিয়াও নিজে সে কার্য্যে বাধা প্রদান করিতেছেন—নিজে নিজের ক্ষতি করিতেছেন— তাহা তিনি বুঝিয়াও বুঝিতে পারিতেছেন না।

আমি। হাঁ, তিনি তাঁহার পিতার কোন সন্ধান পাইয়াছেন?

ধনদাস। সন্ধান পাওয়া ত আর বড়-একটা সহজ কথা নয়, কিন্তু তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করিলেন না। তিনি নিজের বিদ্যা চালাইতে গিয়া অনিষ্ট বই ইষ্ট কিছুই করিতে পারেন নাই; অথচ আমার কাজের কত ক্ষতি করিয়াছেন, তাহা বলা যায় না। সে কথা যাক্, মিঃ মূলার আপনার সহিত যে সকল কথা কহিয়াছিলেন, তাহাতে বোধ হয়, এখনও আপনার দৃঢ় বিশ্বাস হয় নাই যে, মিঃ কুক্‌ ও মিঃ ডিসিল্ভা একই লোক।

আমি। না, আমি এখনও তাহা বিশ্বাস করিতে পারি না। যতক্ষণ পর্য্যন্ত প্রকৃত প্রমাণ না পাওয়া যাইতেছে, ততক্ষণ কেমন করিয়া তাহা বিশ্বাস করি। প্রমাণের উপর নির্ভর করিতেছে।

ধনদাস বলিলেন, “আমি আপনাকে বলিতেছি, মিঃ কুক্ ও মিঃ ডিসিল্ভা একই লোক। আচ্ছা, সে কথা আপনি পরে বুঝিতে পারিবেন—এখন থাক্। আমি আপনার নিকট হইতে কোন কথা জানিতে ও আপনাকে কোন কথা শুনাইতে চাই।”

এই বলিয়া তিনি কেমন করিয়া মিঃ ডিসিল্ভা মিঃ কুক্রের সন্ধান করিয়াছিলেন, তাহা আমায় বলিলেন। আমি তাঁহার আশ্চর্য্য ক্ষমতার ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয় পাইয়া পরম পরিতুষ্ট হইলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন্ তারিখে আপনার সহিত মিঃ কুকের প্রথম সাক্ষাৎ হয়?”

আমি। আমায় তিনি ২রা জুলাই তারিখে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে চিকিৎসা করিবার জন্য ডাকিয়া লইয়া যান।

তিনি। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে আপনি পূর্ব হইতেই জানিতেন?

আমি। জানিতাম।

তিনি। আপনি যখন প্রথম তাঁহাকে দেখিয়াছিলেন, তখন কি তিনি আপনার সহিত কথা কহিতে পারিয়াছিলেন?

আমি। না, তিনি তখন অচেতন অবস্থায় ছিলেন।

তিনি। আপনি গিয়া তাঁহাকে অচেতন অবস্থায়ই দেখিয়াছিলেন?

আমি। হাঁ।

তিনি। আপনি জানেন, সেই সময়ে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে দাস-দাসীগণের মধ্যে একটা কাণা-ঘুষা হইয়াছিল, আর অনেকেই অনেক প্রকার সন্দেহ করিয়াছিল?

আমি। যে সময়ে গিয়াছিলাম, সে সময়ে দাসদাসী কেহই ছিল না। একজন দাসী কাজ করিত, আর তাহার কন্যা আসিয়া মাঝে মাঝে তাহাকে সাহায্য করিত। আমি শুনিয়াছিলাম বটে যে, দাস- দাসীগণের মধ্যে একটা কলহ উপস্থিত হওয়াতে ও তাহারা মিসেস্ রায়ের আজ্ঞানুবর্ত্তী হইয়া না চলাতে, তিনি তাহাদিগকে জবাব দেন।

তিনি। দাসদাসীগণের মধ্যে যে কলহের কথা আপনি বলিতেছেন, তাহা আপনি কেমন করিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন?

আমি। কিছুদিন পরে আমি সে কথা শুনিয়াছিলাম। ৪ঠা জুলাই সোমবার সকালে আমি গিয়া দেখি, ব্রজেশ্বর রায়ের মৃত্যু হইয়াছে। মৃতদেহ দেখিয়া আমি নীচে নামিয়া আসিয়া, মিসেস্ রায়ের সহিত কথা কহিতেছি ও প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিতেছি, এমন সময়ে একখানি গাড়ী করিয়া মিস্ মনোমোহিনী উপস্থিত হইলেন।

তিনি। তাঁহাকে কি টেলিগ্রাফ্ করা হইয়াছিল?

আমি। না। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের পীড়া প্রতি মুহূর্ত্তেই সাংঘাতিক হইয়া পড়িতেছিল বলিয়া, তাহারা টেলিগ্রাফ করিবার সময়ও পান নাই

তিনি। তা’ হলে মিস্ মনোমোহিনী হঠাৎ সেই সময় আসিয়া পড়িয়াছিলেন?

আমি। হাঁ, অবশ্য তিনি আসিয়াই এই দারুণ সংবাদ শুনিয়া বড় কষ্ট পাইয়াছিলেন। যখন তিনি পিতাকে শেষ দেখিয়াই বম্বে গিয়াছিলেন, তখন ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের শরীর বেশ সবল ও সুস্থ ছিল।

তিনি। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের সেবা-শুশ্রূষার জন্য কোন লোক রাখা হইয়াছিল কি?

আমি। না, মিসেস্ রায় সে ধরণের স্ত্রী নহেন। তিনি স্বামীকে বাঁচাইবার জন্য আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া সেবা-শুশ্রূষা করিয়াছিলেন।

তিনি। এইবার আমি আপনাকে একটি অনাবশ্যক প্রশ্ন করিব। আপনি বলিতে পারেন, মিস্ মনোমোহিনী কখন প্রথম তাঁহার পিতার মৃতদেহ দেখিয়াছিলেন?

আমি। যেদিন তিনি আসিয়াছিলেন, সেইদিন শেষ রাত্রিতে তাঁহার পিতার মৃতদেহ প্রথম দেখেন।

তিনি। সেই রাত্রেই?

আমি। হ্যাঁ পিতার মৃত্যু-সংবাদে তিনি এত ব্যথিত ও শোক-সন্তপ্ত হইয়াছিলেন যে, পাছে তাঁহার শরীরের কোন ক্ষতি হয়, এই ভয়ে মিসেস্ রায় তাঁহাকে সেদিন ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃতদেহ দেখিতে বাধা দিয়াছিলেন। পর দিন মৃতদেহ দেখিতে দিবেন বলিয়া মিস্ মনোমোহিনীকে প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিয়াছিলেন। সকাল হইবার কিছু পূর্বে মিস্ মনোমোহিনী কিসের শব্দ শুনিয়া জাগরিত হয়েন। তিনি আমায় বলিয়াছেন, যেন উদ্যানে মাটি খোঁড়া ও মাটি তোলার শব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইতেছিল। মিস্ মনোমোহিনী তার পর পিতার শয়ন কক্ষে প্রবেশ করেন। যদিও শোকে ও আতঙ্কে তাঁহার শরীরের অবস্থা ভাল ছিল না, তথাপি তাঁহার পিতা সত্যসত্যই মৃত বা জীবিত আছেন কি না দেখিবার জন্য তিনি দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হইয়াছিলেন। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের শয়ন- কক্ষের দ্বারে চাবি দেওয়া ছিল। মিস্ মনোমোহিনী অপর চাবির দ্বারা তাহা উন্মোচন করেন। তার পর কক্ষমধ্যে গিয়া তিনি শবদেহের আবরণী চাদরখানি তুলিয়া যাহা দেখিয়াছিলেন, তাহা অতিশয় বিস্ময়জনক। তিনি দেখিলেন যে, সে শবদেহ তাঁহার পিতার নহে; পরদিন যখন মিস্ মনোমোহিনী আসিয়া আমায় এই সকল কথা বলেন, আমি তাহা বিশ্বাস করি নাই। বরং তাঁহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছিলাম যে, তিনি যাহা দেখিয়াছেন বা শুনিয়াছেন, তাহা তাঁহার শোকসন্তপ্ত চিত্তের বিকারমাত্র।

তিনি। তার পরে তিনি আর একবারও কি পিতার মৃতদেহ দেখিয়াছিলেন?

আমি। আমার নিকট হইতে ফিরিয়া যাইবামাত্রই মিসেস্ রায় মিস্ মনোমোহিনীকে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের শয়নকক্ষে লইয়া যান। এই দ্বিতীয়বার দেখাতেই মিস্ মনোমোহিনী আপনার ভ্রম বুঝিতে পারেন এবং তাঁহার বিশ্বাস হয় যে, সেই শবদেহ তাঁহার পিতা ব্রজেশ্বর রায় ভিন্ন অপর কাহারই নয়।

তিনি। আচ্ছা, ডাক্তার ওগিলভি সাহেব? এত কথা শুনিয়াও কি আপনার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় নাই যে, মৃতদেহ বদল হইতেও পারে?


আমি বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে ধনদাস গোয়েন্দার দিকে চাহিয়া কহিলাম, “সর্বনাশ! এরূপ অদ্ভুত কল্পনা ত আমার মনোমধ্যে একবারও উদিত হয় নাই। কেমন করিয়া তাহা বদল হইবে? আমি ব্রজেশ্বর রায়কে যে চিনিতাম না, তাহা নয়। মৃত্যুর পরে এবং পূর্বে আমি সেই একই দেহ দেখিয়াছিলাম। তাহাতে বিন্দুমাত্র বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় নাই।”

ধনদাস বলিলেন, “ব্রজেস্বর রায়ের সঙ্গে আপনি বাল্যকালে এক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, তার পর কতদিন আপনার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই, সেই সময়ের মধ্যে তাঁহার চেহারার কতখানি পরিবর্ত্তন ঘটিতে পারে, এ সকল কিছু আপনি ভাবিয়া দেখিয়াছিলেন কি? যাঁহাকে চিকিৎসা করিবার জন্য মিঃ কুক্‌ আপনাকে লইয়া গিয়াছিলেন, কে বলিতে পারে যে, তিনিই আপনার সহপাঠী সেই ব্রজেশ্বর রায়? একরকম চেহারার দুইজন লোক কি দেখিতে পাওয়া যায় না? কে বলিতে পারে, বহুকাল পরে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের পরিবর্তে অপর একজন সম-আকৃতির লোককে দেখিয়া, তাহাকে ব্রজেশ্বর রায় বিবেচনায়, আপনার ভ্রম হইতে পারে কি না? কে বলিতে পারে, অজ্ঞান অবস্থায় আপনি যাঁহাকে চিকিৎসা করিয়াছিলেন, তিনিই সেই ব্রজেশ্বর রায় কি না? হয় ত সেই রজনীতে মিস্ মনোমোহিনী যাঁহার মৃতদেহ দেখিয়াছিলেন, তিনি ব্রজেশ্বর রায় নহেন। যাহা হউক, সে সব কথা যাক্, আমি আপনাকে আরও কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক বিবেচনা করি। আচ্ছা, আপনি আমায় বলতে পারেন যে, মিস্ মনোমোহিনীর যথার্থ মনের ধারণা কি? তিনি কি এখন মনে করেন যে, সেই রজনীতে তিনি যাহা দেখিয়াছিলেন, তাহা তাহার বিকৃত চিত্তের বিকার মাত্র; তিনি যে সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, তাহা ভ্রমাত্মক?”

আমি। প্রথমে যদিও তিনি তাহা বুঝিতে পারেন নাই, কিন্তু শেষে যখন অকাট্য প্রমাণ প্রয়োগের দ্বারা তাহার সন্দেহভঞ্জন হইল, তখন তিনি স্বীকার করিয়াছিলেন যে, তাঁহারই ভ্রম হইয়াছিল।

ধনদাস। প্রথমে তিনি কিছুতেই তাহা বুঝেন নাই?

আমি। না।

ধনদাস। আপনি অনেক বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াও, তাঁহার দৃঢ় ধারণা হইতে তাঁহাকে বিচলিত করিতে পারেন নাই?

আমি। না।

ধনদাস। আপনার কথাবার্তায় বোধ হইতেছে, মিঃ কুকের সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইবার পর মনোমোহিনীর সহিতও সাক্ষাৎ হইয়াছিল।

আমি। হ্যাঁ, মনোমোহিনীর সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, কিন্তু এ বড় আশ্চর্য্যের বিষয় যে, তিনি এত শীঘ্র দুরারোগ্য রোগাক্রান্ত হইবেন, আমি স্বপ্নেও ইহা কল্পনা করি নাই—এমন কি, আমার তাহা বিশ্বাসই হয় না।

ধনদাস। মিস্ মনোমোহিনী এখন অত্যন্ত পীড়িত— কে তাঁহার চিকিৎসা করিতেছেন? বোধ হয় আপনাকে তাঁহারা আর ডাকেন নাই।

আমি। ভবানীপুর নিবাসী ডাক্তার চরণদাস বাবু এখন মিস্ মনোমোহিনীর চিকিৎসা করিতেছেন।

ধনদাস। আপনি কেমন করিয়া তাহা জানিতে পারিলেন?

আমি। চরণদাস বাবু আমায় বলিয়াছিলেন। আমি তাঁহার মুখে মিস্ মনোমোহিনীর পীড়ার কথা শুনিয়া আবাক্ হইয়াছিলাম। গত শুক্রবারে আমি প্রথমে তাঁহার নিকট হইতে মিস্ মনোমোহিনীর অসুখের কথা শুনি। তিনি বলেন যে, তাঁহার যক্ষ্মাকাস হইয়াছে। অথচ এই ঘটনার কিছুদিন পূর্বেই যখন মিস্ মনোমোহিনীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়, তখন তাহার শরীরে কোন রোগের চিহ্নমাত্র ছিল না।

ধনদাস। আপনি কেমন করিয়া তাহা জানিতে পারিলেন?

আমি। চরণদাস বাবু আমায় বলিয়াছিলেন। আমি তাঁহার মুখে মিস্ মনোমোহিনীর পীড়ার কথা শুনিয়া অবাক্ হইয়াছিলাম। গত শুক্রবারে আমি প্রথমে তাঁহার নিকট হইতে মিস্ মনোমোহিনীর অসুখের কথা শুনি। তিনি বলেন যে, তাঁহার যক্ষ্মাকাস হইয়াছে। অথচ এই ঘটনার কিছুদিন পূর্বেই যখন মিস্ মনোমহিনীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়, তখন তাহার শরীরে কোন রোগের চিহ্নমাত্র ছিল না।

ধনদাস। আপনি চরণদাস বাবুকে কি বলিয়াছিলেন?

আমি। কি আর বলিব, আমি প্রথমতঃ তাহার কথায় বিশ্বাসই করি নাই।

ধনদাস। আপনি আর কোন কথা শুনিয়াছেন?

আমি। শুনিয়াছিলাম যে, মিসেস্ রায় ও মিঃ কুক্‌ এ দেশ ছাড়িয়া অন্যদেশে চলিয়া যাইবার জন্য কৃতসঙ্কল্প হইয়াছেন। মিস্‌ মনোমোহিনী কিন্তু তাঁহাদের সহিত যাইতে অস্বীকৃতা হইয়াছিলেন।

ধনদাস। কারণ?

আমি। আমি যতদূর শুনিয়াছি ও যাহা বুঝিয়াছি, তাহাতে আমার এই অনুমান হয় যে, মিস্ মনোমোহিনী কলিকাতা ছাড়িয়া যাইতে সম্মত নহনে।

ধনদাস। কেন, এখানকার আত্মীয়স্বজন ছাড়িয়া যাইতে তাঁহার কষ্ট হইয়াছিল বুঝি?

আমি। শুধু তাহাই নহে, অন্য কারণও ছিল।

ধনদাস। সে কারণটি কি তাহা শুনিতে পাই না?

আমি। মিঃ কুক্রের চরিত্র সম্বন্ধে মনোমোহিনী সন্দেহ করেন।

ধনদাস। সন্দেহ করিবার কোন কারণ জানেন?

আমি। ইচ্ছা করিলে হয়ত জানিতে পারিতাম, কিন্তু সে ইচ্ছা আমার ছিল না। আমি মিস্ মনোমোহিনীকে সে সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই।

ধনদাস। আপনি বলিয়াছেন যে, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যুর পর মিস্ মনোমোহিনী সেই বাড়ীতে কাহার কাতর স্বর শুনিয়াছিলেন; সে স্বর শুনিয়া তিনি মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার পিতা তাঁহাকে করুণস্বরে ডাকিতেছেন। তাহাতে তিনি অনুমান করিয়াছিলেন যে, তখনও তাঁহার পিতার মৃত্যু হয় নাই—তখনও তিনি জীবিত আছেন; কিন্তু সে স্বর কোথা হইতে আসিতেছে, তাহা তিনি কিছুই স্থির সিদ্ধান্ত করিতে পারেন নাই।

আমি। না।

ধনদাস। পরে মিস্ মনোমোহিনীর বিশ্বাস হইয়াছিল যে, মৃত্যুর পূর্বে পিতার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই বলিয়া, কন্যার মায়ায় ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় পরলোক হইতে মিস্ মনোমোহিনীকে করুণস্বরে ডাকিতেছিলেন এবং সেই করুণস্বর অতি ক্ষীণভাবে তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইতেছিল।

আমি। হাঁ, বোধ হয় মিস্ মনোমোহিনী শেষে ইহাই সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন।

ধনদাস। অথবা এমন হইতে পারে যে, মিস্ মনোমোহিনী সেই কাতর স্বর শুনিয়া অনুমান করিয়াছিলেন যে, তাঁহার পিতা প্রেতযোনী প্রাপ্ত হইয়াও মায়ামমতাবশতঃ কন্যাকে একবার দেখিতে আসিয়াছিলেন।

আমি। হইতেও পারে।

ধনদাস। দেখুন, আমি প্রেতযোনীর উপর বড় বিশ্বাস করি। সময়ে সময়ে এই বিশ্বাসে আমাদের অনেক কার্যোদ্ধার হয়।

আমি। আপনার এ হেঁয়ালীর ন্যায় কথার ভাব বুঝিতে পারিলাম না।

ধনদাস হাসিয়া বলিলেন, “ক্রমে বুঝিতে পারিবেন, একেবারেই কি সব কথা বুঝা যায়?”

এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং তখনকার মত বিদায় প্রার্থনা করিলেন।

আমিও তাঁহার সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি আমার বন্ধু রাজীবলোচন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে জানেন কি?”

ধনদাস। জানি, গোয়েন্দাগিরি কার্য্যে তিনি আমার গুরু। তাঁহার পরামর্শ ব্যতীত আমি প্ৰায় কোন কাজ করি না।

আমি। আপনি কি এ সম্বন্ধে তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করিতেছেন?

ধনদাস। সে কথা শুনিয়া আপনার কি লাভ?

আমি। লাভ না থাকিলে জিজ্ঞাসা করিব কেন?

ধনদাস। হাঁ, তাঁহার পরামর্শ লইতেছি।

আমি। তাহা হইলে আপনারা উভয়েই এই কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছেন।

ধনদাস। হাঁ, প্রথমতঃ তিনিও জানিতেন না, আমি এ কাৰ্য্যে হাত দিয়েছি;আর আমিও জানিতাম না যে, তিনি এই ঘটনায় নিযুক্ত হইয়াছেন। আমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইবামাত্র, আমি তাঁহার পরামর্শ গ্রহণের জন্য কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করাতেই সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িল। তাহার পর আমি আর একটা গুরুতর ঘটনা লইয়া পশ্চিমে চলিয়া গিয়াছিলাম, তিনি একাই এখানে এই ঘটনা সম্বন্ধে সকল কাজ করিতেছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি আমায় যে সকল পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে আমি অনেক বিষয় জানিতে পারিয়াছি। কলিকাতায় আসিয়া তাঁহার সঙ্গে আমার এখনও সাক্ষাৎ হয় নাই—তাহা হইলেই আমি বাকী সমস্ত কথা তাঁহার নিকট হইতে জানিতে পারিব। আর আপনার কাছে আমি যাহা সংগ্রহ করিলাম, তাহাও যথা সময়ে তাঁহাকে বলিতে পারিব।

আমি। আমার কাছে আপনি আর কি সংগ্রহ করিলেন?

ধনদাস। কি সংগ্রহ করিলাম, তাহা যদি আপনি বুঝিতে পারিতেন, তাহা হইলে অনেকেই গোয়েন্দা হইতে পারিত। আপনার আর কোন কথা বলিবার আছে?

আমি। বলিবার আমার কোন কথাই আর নাই, তবে আপনারা যত শীঘ্র এই ঘটনার গুপ্তরহস্য প্রকাশ করিতে পারেন, আমার পক্ষে ততই মঙ্গল। আমি আর ভাবিতে পারি না—আমার সকল দিকেই ক্ষতি হইতেছে। কুক্ষণে আমি আলিপুরে ব্রজেশ্বর রায়কে দেখিতে গিয়াছিলাম।

ধনদাস। আপনার কি অনুমান হয়?

আমি। অনুমান আর কি হইবে—আমার চক্ষে এখন সমস্তই অন্ধকার। আমি যেন সমস্তই বুঝিতে পারিতেছি, অথচ কিছুই স্থির সিদ্ধান্ত করিতে পারিতেছি না। সামান্য অন্ধকার কাটিয়া গেলেই যেন আমি দিনের আলোক দেখিতে পাই; কিন্তু অন্ধকার আরও নিবিড় হইতেছে। মিস্‌ মনোমোহিনী মৃত্যুমুখে পড়িয়াছেন, ইহা যেন আমি বিশ্বাস করিয়াওঁ করিতে পারিতেছি না; অথচ আমি চরণদাসের কথা অবিশ্বাসও করিতে পারি না।

ধনদাস। আপনার বিশ্বাস হউক আর নাই হউক, মিস্ মনোমোহিনীর জীবন অতি সঙ্কটাপন্ন হইয়া পড়িয়াছে, সন্দেহ নাই। সে যাহা হউক, এখন প্রায় রাত্রি দশটা বাজিয়াছে, এ সময়ে বাড়ীর বাহির হইলে বোধ হয়, আপনার কার্য্যের কোন ক্ষতি হইবে না?

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমায় আপনার সঙ্গে কোথায় যাইতে হইবে, বলুন।”

ধনদাস। কোথায় যাইতে হইবে, তাহা বলিতে পারি না। আমার সঙ্গে বাহির হইতে সম্মত আছেন কি না?

এরূপ অযাচিত আহ্বানে আমার মনে কেমন একটু সন্দেহ হওয়াতে আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম। ধনদাস বোধ হয়, আমার মনের ভাব স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন। মৃদু হাসি হাসিয়া তিনি কহিলেন, “আপনি কি আমার উপরে সন্দেহ করিতেছেন? আমি মিঃ কুকের চর নহি, আপনার কোন ভয় নাই।”

আমি তাঁহার কথায় কথঞ্চিৎ লজ্জিত হইলাম। কোন উত্তর দিতে না পারিয়া ভাল মানুষের মত টুপি লইয়া ধনদাসের পশ্চাদ্‌গামী হইলাম।

রাস্তায় বাহির হইবামাত্র একটি লোক আমাদের জিজ্ঞাসা করিল, “এইটিই কি ওগিলভি সাহেবের বাড়ি?”

আমি তাহার হস্তে একখানি পত্র দেখিয়া উত্তর করিলাম, “হ্যাঁ, এই তাঁহার বাড়ী—আমারই নাম ওগিলভি।”

পরিচয়টি দিবামাত্র সেই লোকটি আমার হাতে সেই পত্রখানি দিয়া কহিল, “আমি ডাক্তার চরণদাস বাবুর বাড়ী হইতে আসিতেছি।”

চরণদাসের নাম শুনিয়া আমি অত্যন্ত আগ্রহের সহিত পত্রখানি গ্রহণ করিলাম, এবং নিকটবর্তী একটা আলোক-স্তম্ভের নীচে দাঁড়াইয়া তাহা পাঠ করিতে লাগিলাম—

“প্রিয় ওগিলভি!

চরণদাসের পত্ৰ

আমি এইমাত্র আলিপুর নিবাসী ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাটী হইতে ফিরিয়া আসিতেছি। মিস্ মনোমোহিনী রাত্রি নয়টার সময় দেহত্যাগ করিয়াছেন।

আপনার চরণদাস
শ্রীমানী।”

কি সর্বনাশ! মিস্ মনোমোহিনী দেহত্যাগ করিলেন! মৃত্যুর পূর্বে একবার তাঁহাকে দেখিতেও পাইলাম না!

ধনদাস জিজ্ঞাসা করিলেন, “পত্রে কি লেখা আছে? কোন মন্দ খবর না কি?”

আমি। মন্দ খবর! অতি মন্দ—অতি মন্দ—ইহা অপেক্ষা সর্ব্বনেশে সংবাদ আমাদের আর কিছুই হইতে পারে না।

এই বলিয়া পত্রখানি তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি নিবিষ্ট চিত্তে তাহা পাঠ করিয়া আমায় বলিলেন, “চলুন, অতি শীঘ্র—বিলম্ব করিবার বিন্দুমাত্র সময় নাই।”

আমি। কোথায় যাইবেন?

ধনদাস। আলিপুরে।

আমি। কেন? আর সেখানে কিসের জন্য যাইব?

মিস্ মনোমোহিনীর মৃত্যু-সংবাদে আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছিলাম। আমার নিজ পুত্রকন্যার মৃত্যু হইলে যেরূপ শোক সন্তপ্ত হইতাম, বন্ধুবর ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের কন্যার মৃত্যু-সংবাদে আমি তদধিক ব্যথিত হইলাম। আমার আর কোথাও যাইতে ইচ্ছা হইতেছিল না—পদদ্বয় দেহভার বহন করিতে অসম্মত হইতেছিল; এমন সময় ধনদাস আমার হাত ধরিয়া কহিলেন, “সেখানে যাইবার বিশেষ আবশ্যক আছে, পরে সমস্ত কথা জানিতে পারিবেন। এখন আর কথা কহিবার সময় নাই- আমার সঙ্গে চলিয়া আসুন।”

ধনদাসের টানাটানিতে আমি চলিলাম বটে, কিন্তু বড় ক্লেশ হইতে লাগিল।


ধনদাস বাবুর কথায় আপত্তি করিবার উপায় ছিল না, কাজেকাজেই তাঁহার সঙ্গে আমায় যাইতে হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে, যে মনোমোহিনীর জীবন রক্ষার জন্য আমার ও অন্যের এত চেষ্টা, তাহাই যখন বিফল হইল, তখন আর তথায় যাওয়ার লাভ কি?

যখন আমরা আলিপুরের পোল পার হইতেছি, সেই সময়ে ধনদাস গোয়েন্দা আমায় বলিলেন, “শীঘ্র আসুন, আর এক মুহুর্ত্তও অপেক্ষা করিবার সময় নাই।”

একে ত আমার ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীর দিকে যাইতেই ইচ্ছা ছিল না; তাহার উপর ধনদাস বাবুর টানাটানিতে আমার বড় বিরক্তি বোধ হইতেছিল।

আমি বলিলাম, “আপনি বৃথা টানাটানি করিয়া আমায় এতদূর আনিলেন। মিস্ মনোমোহিনীকে যদি বাঁচাইতে পারিতাম, তাহা হইলেও এতটা দৌড়াদৌড়ির ফল ফলিবার আসা থাকিত; যখন তিনিই জীবিত নাই, তখন আর অনর্থক ছুটাছুটি কেন?”

আমার কথার কোন উত্তর না দিয়াই তিনি বলিলেন, “চুপ্ করুন—কথা কহিবেন না। পায়ের শব্দ না হয়। চোরের মত চুপি চুপি আমার সঙ্গে চলিয়া আসুন।”

আমি তাহাই করিলাম; কিন্তু তখনও ধনদাসের উদ্দেশ্য কিছই বুঝিতে পারিলাম না। অল্পক্ষণ পরেই আমরা ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম। যেদিকে অশ্বশালা ও কোচম্যান, সহিস ও চাকরদিগের বাসস্থান, সে স্থানে দণ্ডায়মান না হইয়া আমরা আরও অগ্রসর হইলাম।

রায় মহাশয়ের বাটীর চতুস্পার্শ্বে প্রাচীর-পরিবেষ্টিত বিস্তৃত উদ্যান ছিল, তাহা পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি। সেই চতুৰ্দ্দিকস্থ প্রাচীরের দুইদিকে বড় রাস্তা ও দুইদিকে ছোট ছোট গলি। সুতরাং চারিদিকেই যাতায়াতের সুবিধা ছিল।

ধনদাস বাবু আমায় সঙ্গে লইয়া তিনদিকে পরিভ্রমণ করিলেন, তথাপি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার কোন চেষ্টা করিলেন না। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক্ ঘুরিয়া যখন আমরা উত্তর দিকে আসিলাম, তখন দেখিলাম, রায় মহাশয়ের বাড়ীতে দ্বিতলের একটি কক্ষ হইতে ক্ষীণালোকরশ্মি বহির্গত হইতেছে।

ধনদাস। যে ঘরে আলোক দেখা যাইতেছে, ওই ঘরটি কার, আপনি বলিতে পারেন? আমি। কেমন করিয়া বলিব?

ধনদাস। এই বাড়ীতে ত আপনি দু-চারবার আসিয়াছেন, একটা অনুমান করিয়া বলুন দেখি, ঐ ঘরে আপনি কখন প্রবেশ করিয়াছেন কি না?

আমি আরও কি কথা বলিতে যাইতেছিলাম, এমন সময়ে সহসা ধনদাস আমার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, “চুপ্—চুপ্—আর কথা কহিবেন না।”

আমি নীরব হইলাম। তিনি এত সজোরে আমার হাত চাপিয়া ধরিয়া টানিয়া লইয়া যাইতেছিলেন যে, তাঁহার কাণ্ড-কারখানা দেখিয়া আমার অত্যন্ত আশঙ্কা হইতেছিল। যে স্থানে তখন আমরা উপস্থিত, তাহা রায় মহাশয়ের বাড়ীর পশ্চাদ্দিক্। সেদিকে জন-প্রাণীরও বাস নাই। রজনীতে- অন্ধকারে—আমরা দুইটি প্রাণী ব্যতীত তথায় অন্য লোকের সমাগম নাই।

সহসা একটি শব্দ আমাদের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল, ধপধপাস্, ধপ্—ধপাস, ধপ্—ধপাস্ – ও কি ও! সর্বনাশ!! এ জনশূন্য স্থানে এ কিসের শব্দ?

ধপ্‌—ধপ্—ধপাস্, ধপ-ধপ্—ধপাস্, ধপ্—ধপাস্! ওকি! ব্যাপার কি? ও কীসের আওয়াজ? মিস্ মনোমোহিনীর কথা আমার মনে উদয় হইল। ধনদাস আমার করদ্বয় আরও চাপিয়া ধরিলেন। পাছে আমি কোন কথা কহিয়া ফেলি, সেইজন্য যেন তিনি আমায় প্রকারান্তরে সাবধান করিয়া দিলেন।

ধপ–ধপ্—ধপাস্, ধপ-ধপ্—ধপাস্‌, ধপ্—ধপ্—ধপাস্—এ নিশ্চয় মাটি খোঁড়া ও মাটি ফেলার শব্দ।

আমি চুপি চুপি ধনদাস গোয়েন্দার কানে কানে কহিলাম, “শুনছেন?”

ধনদাস। চুপ্।

আমি আর কোন কথা না বলিয়া মিস্ মনোমোহিনীর কথা ভাবিতে লাগিলাম। তাঁহার পিতার যেদিন মৃত্যু হয়, সেই রজনীতে তিনিও এই প্রকার শব্দ শুনিয়াছিলেন।

ধনদাস বলিলেন, “বাগানের ভিতর হইতে নিশ্চয় এ শব্দ আসিতেছে, আপনি কি বলেন?” আমি বলিলাম, “নিশ্চয়! নিশ্চয় তাহার আর কোন ভুল নাই, কিন্তু ইহার মানে কি? আজও কি ইহারা কারাও জন্য গোর খুঁড়িতেছে না কি? এ ব্যাপার কি? তবে ইহারা ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে এইখানেই গোর দিয়াছে? আবার কি সেই গোর খুঁড়িতেছে না কি? কেন, তাহারই বা কারণ কি?

ধনদাস। ব্যস্ত হইবেন না। ব্রজেশ্বর রায়ের পুনরায় গোর খোঁড়া হইতেছে, তাহাই বা আপনাকে কে বলিতেছে? আপনি কেনই বা এমন অসম্ভব কথা মনে স্থান দিতেছেন?

আমি। আপনার কি অনুমান হয়?

ধনদাস। অন্য কাহারও জন্য গোর খোঁড়া হইতেছে, এরূপও ত ইহাতে পারে। অন্য কাহাকেও এইখানে গোর দেওয়া হইবে—এমনও ত হইতে পারে।

তড়িদ্বেগে একটি নতুন ভাব আমার প্রাণে উদিত হইল;শিরায় শিরায়, ধমনীতে ধমনীতে খরতরবেগে প্রবল রক্তস্রোত প্রবাহিত হইয়া মস্তিষ্ক বিকৃত করিয়া তুলিল। তবে কি মিস্ মনোমোহিনীর জন্য এই স্থান প্রস্তুত করা হইতেছে? আমি একেবারে উন্মত্তের ন্যায় ধনদাস গোয়েন্দাকে জড়াইয়া ধরিলাম।

তিনি আমায় ধরিয়া বলিলেন, “অত বিচলিত হইবেন না। ব্যাপার কি আগে বুঝিয়া দেখুন।”

আমি। বলুন—বলুন—আমি আর অপেক্ষা করিতে পারিতেছি না।

ধনদাস। যাঁহাকে এই গোরে গোর দেওয়া হইবে, তাঁহার এখনও গোর দিবার অবস্থা দাঁড়ায় নাই। আগে তাঁহার বিষয় একটা নিষ্পত্তি করিয়া তবে—

আমি। বলেন কি–বলেন কি–

ধনদাস। কোন কথা এখন বুঝাইয়া বলিবার সময় নাই। এই সামনে যে গাছটি, প্রাচীরের গায়ে সংলগ্ন রহিয়াছে দেখিতেছেন, ঐ গাছের ডাল ধরিয়া নিঃশব্দে আমি প্রাচীরের উপরে উঠিব, তাহার পর আপনি উঠিবেন।

আমার উত্তরের অপেক্ষায় আর তিনি দাঁড়াইলেন না। গাছের ডাল ধরিয়া প্রাচীরের উপরে উঠিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠিলাম। প্রাচীরের উপরে উঠিয়া তিনি একবার চতুর্দ্দিক্ নিরীক্ষণ করিলেন। তাহার পর আমায় বলিলেন, “এখান হইতে উদ্যানের ভিতর আমরা অনায়াসেই লাফাইয়া পড়িতে পারি। প্রাচীর তত উচ্চ নয়; কিন্তু লাফাইয়া পড়া হইবে না। লাফাইয়া পড়িলে একটা শব্দ হইতে পারে।”

আমি। তবে কি করিবেন?

ধনদাস। প্রাচীরের উপর দিয়া খুব সাবধানে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলিয়া আসুন।


ধনদাস গোয়েন্দা যাহা বলিলেন, আমিও তাহাই করিলাম। তাঁহার পিছনে পিছনে, ধীরে ধীরে অতি সাবধানে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়াই হাতের কাছে আমরা একটি আম্রবৃক্ষ পাইলাম, তাহার শাখা ধরিয়া উদ্যানমধ্যে নামিয়া পড়া সহজ বিবেচনায় ধনদাস আমায় ইঙ্গিত করিলেন।

তাঁহার ইঙ্গিত অনুসারে আমি নিঃশব্দে উদ্যানমধ্যে নামিয়া পড়িলাম। পরক্ষণেই তিনি আমার পশ্চাতে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন।

ধনদাস গোয়েন্দা আমার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “আসুন, এইবার নিঃশব্দে আমার পিছনে চলিয়া আসুন।

আমি তাহাই করিলাম। যেদিক্ হইতে শব্দ আসিতেছিল, সেই দিকে অগ্রসর হইলাম।

ধপ্‌—ধ—ধপাস্, ধপ্—ধপ্—ধপাস্‌, ধপ্—ধপ-ধপাস্—শব্দ সেইরূপই চলিতেছে—বিরাম নাই। যখন আমরা সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া খুব নিকটবর্ত্তী হইলাম, তখন ধনদাস আমার কানে কানে বলিলেন, “মিঃ কুক্‌ মাটি খুঁড়িতেছে, সেই গোরে মিস্ মনোমোহিনীকে গোর দেওয়া হইবে। যদি এখনও তাঁহার মৃত্যু না হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, মিঃ কুক্রের এই কাৰ্য্য শেষ হইলেই তাঁহার জীবনলীলা ফুরাইবে।”

আমি। আপনি পাগলের মত কি বলিতেছেন—রাত্রি নয়টার সময়ে তাঁহার ত মৃত্যু হইয়াছে। কেন, চরণদাসের পত্র কি আপনি ভাল করিয়া পাঠ করেন নাই?

ধনদাস। আমি ঠিক বলিতে পারি না। মৃত্যু হইয়াছে, তাহাও বলিতে পারি না—মিস্ মনোমোহিনী জীবিত আছেন কি না তাহাও জানি না; কিন্তু এই সময়! যদি এখনও জীবিত থাকেন, তাহা হইলে এ যাত্রা তিনি রক্ষা পাইলেন।

আমি। কিন্তু চরণদাস স্পষ্টই লিখিয়াছেন যে, রাত্রি নয়টার সময় মিস্ মনোমোহিনী দেহত্যাগ করিয়াছেন।

ধনদাস। চরণবাবুর চিঠি এবং তাঁহার কথা আপনি ভুলিয়া যান;আমি যাহা বলি, তাহাই শুনুন। আমি। বলুন।

ধনদাস। মিস্ মনোমোহিনী জীবিতই থাকুন, আর মৃতই হউন, রাস্তা হইতে ঐ দ্বিতলের যে কক্ষে আলোক-রশ্মি দেখিয়াছেন, ঐ ঘরে তিনি আছেন। এখন আমি পুনরায় আপনাকে সাবধান করিয়া দিতেছি, খুব সাবধানে আমার সঙ্গে কথা কহিবেন, খুব সাবধানে পা ফেলিবেন, খুব সাবধানে চারিদিকে লক্ষ্য রাখিবেন। ব্যাপার বড় গুরুতর! উদ্দেশ্য বড় ভয়ানক!! এ সকল কার্য্যে সফলতা লাভ করিতে হইলে জীবনের মায়া পরিত্যাগ করিতে হয়—

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন আপনি কি করিতে চাহেন?”

ধনদাস। আমাদের দুইজনের মধ্যে একজনকে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিতে হইবে। শত বাধা বিপত্তি থাকিলেও তাহা অতিক্রম করিতে হইবে। যেমন করিয়া হউক, ঐ ঘরে যাইতেই হইবে। আপনার বন্ধু রাজীবলোচন বাবু এই সময়ে যে এখানে উপস্থিত নাই, তাহা আমি কোনক্রমেই বিশ্বাস করিতে পারি না। তিনি নিশ্চয়ই আছেন, এবং অন্যদিক্ রক্ষা করিতেছেন, এ কথা আমি আপনাকে নিঃসন্দেহে বলিতে পারি।

আমি। তিনি কোথায় আছেন?

ধনদাস। আমার অনুমান হয়, তিনি বাড়ীর ভিতরে আছেন।

আমি। কিসে আপনি এরূপ অনুমান করেন?

ধনদাস। সে কারণ আছে—আপনাকে তাহা বুঝাইতে গেলে অনেকটা সময় লাগিবে—এখনকার সময় ভারি মূল্যবান।

আমি। আপনি কি বাড়ীর ভিতরে যাইতেছেন?

ধনদাস। হাঁ।

আমি। আমি কি করিব?

ধনদাস। আপনি এইখানে দাঁড়াইয়া থাকিবেন। মিঃ কুক্ কি করে, কোথায় যায়, সেইদিকে লক্ষ্য রাখিবেন। আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি, বাড়ীর ভিতর কোন একটা গোলমাল শুনিলেই বা অন্য লোকে তথায় প্রবেশ লাভ করিয়াছে জানিতে পারিলেই মিঃ কুক্ মরিয়ার ন্যায় তথায় উপস্থিত হইবে। সেই সময়ে আপনাকে অসমসাহসিকের ন্যায় কার্য্য করিতে হইবে। আমি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমি কি করিব?”

ধনদাস তখন বাড়ীর দিকে দুই-চারি পদ অগ্রসর হইয়াছেন, আমার নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “আর কথা কহিবেন না—চুপ, নীরবে সকল কার্য্য আপনাকে করিতে হইবে। সময় নাই— উপায় নাই—সহায় নাই। আপনাকে কি করিতে হইবে, তাহা কি আর আপনাকে বুঝাইয়া দিতে হইবে? যাহাতে কুক্ বাড়ীর ভিতর পৌঁছিতে না পারে, তাহার জন্য আপনি প্রাণান্ত পণ করিয়া চেষ্টা করিবেন। এই কথা যেন মনে থাকে যে, কুক্ যদি একবার বাড়ীর ভিতরে উপস্থিত হইতে পারে, তাহা হইলে আমার আর রাজীবলোচন বাবুর জীবন রক্ষা করা দায় হইবে।”

ধনদাস গোয়েন্দা আর আমার সহিত কোন কথা না কহিয়া, উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া চলিয়া গেলেন। আমি কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া তথায় দণ্ডায়মান রহিলাম।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress