Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দশম পরিচ্ছেদ

মুচিরামের মাথায় বজ্রাঘাত হইল। তিনি পেস্কারিতে ঘুষ লইয়া অসংখ্য টাকা রোজগার করেন-আড়াই শত টাকার ডিপুটিগিরিতে তাঁহার কি হইবে? মুচিরাম সিদ্ধান্ত করিলেন-ডিপুটিগিরি অস্বীকার করিবেন। কিন্তু ভজগোবিন্দ বুঝাইলেন যে, অস্বীকার করিলে রীড সাহেব নিশ্চয় বুঝিবে যে, মুচিরাম ঘুষের লোভে পেস্কারি ছাড়িতেছে না-তাহা হইলে শীঘ্রই তাড়াইয়া দিবে। তখন দুই দিক যাইবে। অগত্যা মুচিরাম ডিপুটিগিরি স্বীকার করিলেন।

মুচিরাম ডিপুটি হইয়া প্রথম রূবকারী দস্তখতকালীন পড়িয়া দেখিলেন, লেখা আছে, শ্রীযুক্ত বাবু মুচিরাম গুড় রায়বাহাদুর ডিপুটি কালেক্টর। প্রথমটা বড়ই আহ্লাদ হইল,-কিন্তু শেষ কিছু লজ্জাবোধ হইতে লাগিল। যে মুহুরি রূবকারী লিখিয়াছিল, তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওহে-গুড়টা নাই লিখিলে। শুধু মুচিরাম রায়বাহাদুর লেখায় ক্ষতি কি? কি জান, আমরা গুড় বটে, কিন্তু আমাদের খেতাব রায়। তবে যখন অবস্থা তেমন ছিল না, তখন রায় খেতাব আমরা লিখিতাম না। তা’ এখন গুড়েও কাজ নাই, শুধু মুচিরাম রায়বাহাদুর লিখিলেই হইবে |” মুহুরি ইঙ্গিত বুঝিল, হাকিমের মন সবাই রাখিতে চায়। সে মুহুরি দ্বিতীয় রূবকারীতে লিখিল, “বাবু মুচিরাম রায়, রায়বাহাদুর |” মুচিরাম দেখিয়া কিছু বলিলেন না, দস্তখত করিয়া দিলেন। সেই অবধি মুচিরাম “রায়” চলিতে লাগিল; কেহ লিখিত, “মুচিরাম রায়, রায়বাহাদুর,” কেহ লিখিত, “রায় মুচিরাম রায় বাহাদুর |” মুচিরামের একটা যন্ত্রণা ঘুচিল-গুড় পদবীতে তিনি বড় নারাজ ছিলেন, এখন সে জ্বালা গেল। তবে লোকে অসাক্ষাতে বলিত “গুড়ের পো”-অথবা “গুড়ে ডিপুটি |” আর স্কুলের ছেলেরা কবিতা করিয়া শুনাইয়া শুনাইয়া বলিত,

“গুড়ের কল্‌সীতে ডুবিয়ে হাত
বুঝতে নারি সার কি মাত?”

কেহ বলিত,
“সরা মাল্‌সায় খুসি নই।
ও গুড় তোর নাগরী কই?”

মুচিরাম তাহাদের তাড়াইয়া মারিতে গেলেন, তাহারা তাঁহাকে মুখ ভেঙ্গাইয়া, উভয় হস্তের অঙ্গুষ্ঠ সন্দর্শন করাইয়া, উচ্চৈঃস্বরে কবিতা আওড়াইতে আওড়াইতে পলাইল। লাভের মধ্যে মুচিরাম লম্বা কোঁচা বাঁধিয়া আছাড় খাইলেন-ছেলেদের আনন্দের সীমা থাকিল না। শেষে মুচিরাম স্কুলের ছেলেদের মাসে মাসে কিছু সন্দেশ বরাদ্দ করিয়া দিয়া কবিতা হইতে উদ্ধার পাইলেন। কিন্তু আর একটা নূতন গোল হইল। শীতকালে খেজুর গুড়ের সন্দেশ উঠিল-ময়রারা তাহার নাম দিল ডিপুটি মণ্ডা।

বাজারে যাহা হউক, সাহেবমহলে মুচিরামের বড় সুখ্যাতি হইল। বৎসর বৎসর রিপোর্ট হইতে লাগিল, এরূপ সুযোগ্য ডিপুটি আর নাই। এরূপ সুখ্যাতির কারণ-

প্রথম। সেই মিষ্ট কথা। একবার তিনি কমিশনার সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। সাহেব তখন মেমসাহেবের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া গরমমেজাজ ছিলেন, এতেলা হইবামাত্র বলিলেন, “নেকাল দেও শালাকো |” বাহির হইতে মুচিরাম শুনিতে পাইয়া সেইখান হইতে দুই হাতে সেলাম করিয়া বলিল, “বহুৎ খুব হুজুর। হামারা বহিনকো খোদা জিতা রাখে |”

দ্বিতীয়। মুচিরাম ডিপুটির হাতে প্রায় হপ্তম পঞ্জমের কাজ ছিল-অন্য কাজ বড় ছিল না। হপ্তম পঞ্জমের মোকদ্দমায় একে সহজেই বড় বিচার আচারের প্রয়োজন হইত না-তাতে আবার মুচিরাম বিচার আচারের বড় ধার ধারিতেন না-চোখ বুজিয়া ডিক্রী দিতেন-নথির কাগজও বড় পড়িতেন না। সুতরাং মাস্কাবার দেখিয়া সাহেবরা ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। জনরব যে, মুচিরামের একেবারে হঠাৎ সর্ব্বোচ্চ শ্রেণীতে পদবৃদ্ধি হইবে। কতকগুলো চেঙ্গড়া ছোঁড়া শুনিয়া বলিল, “আরও পদবৃদ্ধি? ছটা পা হবে না কি?”

দুর্ভাগ্যক্রমে, এই সময়ে চট্টগ্রামের কালেক্টরীতে কিছু গোলযোগ উপস্থিত হইল। গোল মিটাইবার জন্য সেখানকার কমিশ্যনার একজন ভারি বিচক্ষণ ডিপুটি কালেক্টর পাইবার প্রার্থনা করিলেন। বোর্ড বলিলেন-বিচক্ষণ ডিপুটি? সে ত মুচিরাম ভিন্ন আর কাহাকে দেখি না-তাহাকেই চট্টগ্রাম পাঠান হৌক। গবর্ণমেণ্ট সেই কথা মঞ্জুর করিয়া মুচিরামকে চাটিগাঁ বদলি করিলেন।

সম্বাদ পাইয়া মুচিরাম বলিলেন, এইবার চাকরি ছাড়িতে হইল। তাঁহার শোনা ছিল, চাটিগাঁ গেলেই লোকে জ্বর প্লীহা হইয়া মরিয়া যায়। আরও শোনা ছিল যে, চাটিগাঁ যাইতে সমুদ্র পার হইতে হয়-এক দিন এক রাত্রের পাড়ি। সুতরাং চাটিগাঁ যাওয়া কি প্রকারে হইতে পারে? বিশেষ ভদ্রকালী-ভদ্রকালী এখন পূর্ণযৌবনা-সে বলিল, “আমি কোন মতেই চাটিগাঁ যাইব না-কি তোমায় যাইতে দিব না। তুমি যদি যাও, তবে আমি বিষ খাইব |” এই বলিয়া ভদ্রকালী একটা বড় খোরা লইয়া তেঁতুল গুলিতে বসিলেন। ভদ্রকালী তেঁতুল ভালবাসিতেন-মুচিরাম বলিতেন, “ওতে ভারি অম্বল হয়-ও বিষ |” তাই ভদ্রকালী তেঁতুল গুলিতে বসিলেন-মুচিরাম হাঁ হাঁ করিয়া নিষেধ করিতে লাগিলেন-ভদ্রকালী তাহা না শুনিয়া “বিষ খাইব” বলিয়া সেই তেঁতুলগোলায় লবণ ও শর্করা সংযোগপূর্ব্বক আধ সের চাউলের অন্ন মাখিয়া লইলেন। মুচিরাম অশ্রুপূর্ণলোচনে শপথ করিলেন যে, তিনি কখনই চাটিগাঁ যাইবেন না। ভদ্রকালী কিছুতেই শুনিল না-সমুদায় তেঁতুলমাখা ভাতগুলি খাইয়া বিষপান-কার্য্য সমাধা করিল। মুচিরাম তৎক্ষণাৎ চাকরিতে ইস্তেফা পাঠাইয়া দিলেন।

স্থূল কথা, মুচিরামের জমীদারীর আয় এত বৃদ্ধি হইয়াছিল যে, ডিপুটিগিরির সামান্য বেতন, তাঁহার ধর্ত্তব্যের মধ্যে ছিল না। সুতরাং সহজে চাকরি ছাড়িয়া দিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress