মুক্তগদ্য কবি হওয়ার কারণ
লেখক কোন গাছপালা নয় যে তা জন্মাবে। কিংবা কোন খেলনা পুতুল নয় যে তাকে তৈরী করা যাবে। কোনও কোনও মানুষ পরিবেশ ও পরিস্থিতির চাপে পরে লেখক হন। তবে তাদের সবাই লেখক হন না। যিনি লেখক হন, তার ভিতর লেখার সহজাত সক্ষমতা থাকতে হবে, আর তার আগ্রহ থাকতে হবে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার, তাহলে তার লেখা শানিত হয়ে উঠবে। আর তাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে সংবেদনশীল মন নিয়ে মানুষের জীবন। আর থাকতে হবে উদ্দাম কল্পনা-শক্তি এবং তা প্রকাশ করার সক্ষমতা। থাকতে হবে লেখার জন্য কঠোর শ্রম করার মানসিকতা। মাণিক বন্দোপাধ্যায় ভাষায়, শ্রমিকের মতো শ্রম দিতে হবে, লেখার পিছনে।
ডস্টয়ভক্সির মতোন লেখক, পরিস্থিতির চাপে না পড়লে তিনি কখনও এক লাইনও লিখতেন না, এ কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। ব্যাক্তি জীবনে তিনি ছিলেন সেচ্ছাচারী এবং জুয়ারী। জুয়া খেলে হেরে গিয়ে, বন্ধু বান্ধবদের কাছে অনেক ধারকর্য হয়ে গেলে পরে, তিনি সেই ধার শোধ করার অর্থের জন্য, দশ পনেরো দিন সেচ্ছায় ঘরবন্ধী হয়ে থেকে, প্রকাশকদের তাগিদে এক-একটা উপন্যাস লিখেছেন।
লেখা শেষ করেই, তা প্রকাশকের কাছে জমা দিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে নগদ প্রাপ্তি বুঝে নিয়ে আবার এসেই, তা দিয়ে জুয়া খেলায় মেতেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না হেরে গিয়ে কপর্দক শূন্য হয়েছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আর তিনি কোন লেখার কথাই ভাবতেন না। হাতের প্রাপ্ত অর্থ সব ফুরালেই, তবে আবার তিনি নতুন লেখার কথা ভাবতেন, এবং তা শুরু করতেন।
রবীন্দ্রনাথেরও লেখক হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল, তাঁর শিশুকালের নিঃসঙ্গতা (বাবা ও মা কারও সান্নিধ্য না পাওয়া ও গৃহপরিচারকের কাছে শিশুকালের দিনযাপনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা) ‘জীবনস্মৃতি’ পড়ে তা জানা যায়।
নজরুলের লেখক হওয়ার পিছনে কারণ ছিল তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, তাঁর জেল যাপন, ও তেজী বিদ্রোহী মনোভাব।
শরৎচন্দ্রের লেখক হওয়ার কারণ ছিল, অসহায় মানুষের হৃদয়ের আর্তি, যারা মুখের ভাষায় তা প্রকাশ করতে পারত না, তাদের মুখে তা প্রকাশ করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের মাথায় তুলে নিয়ে নিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র।
সুকান্তেরও কারণ ছিল তাঁর চারপাশের সেই সময়কার শ্রমিক কৃষকের উপর অত্যাচার-অনাচার-অবিচার দেখে তার মন কাঁদত। তাই তিনি তার প্রতিবাদ করতে লেখা শুরু করেছিলেন।
জীবনানন্দেরও লেখা-লেখি করার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর অসহায় নিঃসঙ্গতার মধ্য মানব ও প্রকৃতি প্রেম।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ও কোনদিন লেখক হওয়ার কথা ভাবেননি। রাজনীতি ছিল তার আমর্শ। একদিন ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচবার জন্য একজনের বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে মশার কামড়ে তাঁর ঘুম না আসায়, হাতের কাছে ‘কালিকলম’ পত্রিকাটি পেয়ে, সেটি পড়তে শুরু করেন। সেই পত্রিকার গল্প পড়তে পড়তে রাত ভোর হয়ে যায়। পরে তিনি ভাবেন আমিও তো এমন গল্প লিখতে পারি। তারপর একদিন ‘রসকলি’ গল্পটি লিখে তিনি ‘কল্লোল’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন। সেই গল্পটি ‘কল্লোল’-য়ে প্রকাশেরর পর, বিদগ্ধজনেরা তা পড়ে, আলোড়িত হন। তাঁর কাছে নতুন গল্পের দাবী আসতে থাকে। তা পুরণ করতে তাকে, আরও নতুন কাহিনী লিখতে হয়। তারপর আর তাঁর লেখনী থামেনি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রথম জীবনে ভাবেননি, তিনি লেখক হবেন। তিনি বিজ্ঞানী হবেন ভেবে, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেছিলেন কলেজে। তারপর একদিন বন্ধুদের সঙ্গে গল্পচ্ছলে বাজী ধরে ‘অতসীমামি’ গল্পটি লিখে জমা দিয়ে এসেছিলেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। চার মাস পরে, তা ছাপা হয় সেই পত্রিকায় এবং আরও গল্প লেখার অনুরোধ আসতে থাকে তাঁর কাছে। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন মানিক। সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশের ফলে তার একাডেমিক পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং শেষপর্যন্ত শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। সাহিত্য রচনাকেই তিনি তার মূল পেশা হিসেবে বেছে নেন। মানিক বন্দ্যোপাধায়ের আর বিজ্ঞানী হওয়া হয়নি বটে, তবে বৈজ্ঞানিক মনোভাব তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হতে থাকে। তাঁর কলম আর তারপর থামেনি।
সুনীল গাঙ্গোপাধ্যায় প্রথম জীবনে জাহাজের খালাশি হয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবেন ভেবেছিলেন। তা যখন সম্ভব হয়নি, পরবর্তী কালে তিনি ভেবেছিলেন, একটা স্কুল মাষ্টারি জুটিয়ে নিয়ে, কবি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, আর কয়েকটা কবিতা লিখে, দু’একটা পাতলা চটি কবিতার বই প্রকাশ করেই জীবনের কর্মকান্ড শেষ করবেন। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে হয়ে গেলেন লেখক। এ কথা তিনি নিজে স্বীকার করেছেন।
সুনীল গাঙ্গোপাধ্যায় প্রথম উপন্যাস লেখার কারণ ছিল, তাঁর ভাষায় ‘সাগরদার (সাগরময় ঘোষ) আদেশ ‘দেশ শারদীয়া’ সংখ্যায় প্রথম উপন্যাস লেখার জন্য। যা অমান্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না।’ তার কারণ সেখানেই (দেশ ও আনন্দবাজারে) নিয়মিত ফিচার লিখে তাঁকে সংসার চালানোর খরচ জোগার করতে হতো। দু-একটা টিউশনি যা করতেন তাতে চা সিগারেট ও কফিহাউজের খরচও উঠতো না তা’তে ঠিকমতো।
দেশ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় তাঁর প্রথম উপন্যাস বের হয় নাম – ‘আত্মপ্রকাশ’। তারপর আর উপন্যাস লিখবেন না বলে তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্ত সে প্রতিজ্ঞা তিনি রাখতে পারেন নি।
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ ‘ঘরোয়া’ নামে একটি পত্রিকায় লিখতে বাধ্য হন, তাঁর নিজের পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’-য়ের প্রেসের দু-তিন সংখ্যার ছাপার খরচ বাকী পড়েছিল সেই প্রেসে, যেখানে ‘ঘরোয়া’ পত্রিকা ছাপা হতো। সেই ঋণ শোধ করার শর্ত হিসাবে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপাখ্যানটি লিখে সেখানে জমা দিয়ে উক্ত ঋণ পরিশোধ করেন তিনি। পরবর্তীকালে সেই লেখা পড়ে সত্যজিৎ রায় আলোড়িত হয়ে তাকে চলচিত্রে রূপায়িত করেন।
এরপর পাঠকদের ক্রমাগত চাহিদার ফলে, সুনীল গাঙ্গোপাধ্যায় আর তাঁর কলম থামাতে পারেননি। ফলে দেখা যাচ্ছে, একপ্রকার বাধ্য হয়েই তিনি লেখক হয়েছেন, স্বেচ্ছায় নয়। এ’কথা তিনি নিজেও স্বীকারও করেছেন।
কবি হতে চাইনি
শংকর ব্রহ্ম
[প্লেটোর ´আদর্শ সমাজ`থেকে কবির নির্বাসন প্রসঙ্গে]
বিশ্বাস করুন হুজুর আমি কবি হতে চাইনি
কবিতা লেখার কোন বাসনাই ছিল না আমার
দায়িত্ব এবং অভাব
দু কাঁধে জোয়ালের মতো চেপে বসে
ছেলেবেলা থেকেই
এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত অনেক ঘুরিয়ে মেরেছে
ফলে দেখেছি অনেক কিছু
বুঝেছি এত যে কম তার
তাই নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারবার
সে সব নিগূঢ় কথা শুনবে কে আর
সে সব কথাই লিখেছি ডাইরীর পাতায়
সে সব কবিতা হলে আমার কি দায়?
বিশ্বাস করুন হুজুর
আমি কখনোই কবি হতে চাইনি।