কাকাবাবু ইজিপ্টে
কাকাবাবু ইজিপ্টে আগে এসেছিলেন, কায়রো শহর এবং কাছাকাছি অনেকগুলো জায়গা। তাঁর বেশ চেনা। এরা তাঁর চোখ বাঁধেনি। হোটেলের বাইরে এসে একটা জিপগাড়িতে তুলেছে। পাশে কেউ রিভলভার উঁচিয়ে নেই। এরা বুঝেছে যে, এই মানুষটিকে অযথা ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ হবে कों!
কায়রো শহর থেকে পাঁচ-ছমাইল দূরেই তিনটি পিরামিড পাশাপাশি। কাছেই জগৎ-বিখ্যাত স্ফিংকস। এখন টুরিস্ট সিজন না হলেও স্ফিংকসের সামনে মোটামুটি ভিড় আছে। এই দুপুর-রোদের মধ্যেও। সেখানে রয়েছে অনেক উটওয়ালা আর ক্যামেরাম্যান। এরা টুরিস্টদের একেবারে কান কালাপালা করে দেয়।
কাকাবাবু লক্ষ করলেন, গাড়িটা এই জায়গার পাশ দিয়ে এগিয়ে চলল মেমফিসের দিকে। আগেকার তুলনায় এই রাস্তায় অনেক বেশি বাড়িঘর তৈরি হয়ে গেছে। মধ্যে-মধ্যে দুএকটা উঁচু উঁচু সরকারি বাড়ি। আগে এ-রাস্তায় অনেক খেজুরগাছ ছিল, এখন আর চোখে পড়ে না।
মেমফিস বেশি দূর নয়। কায়রো থেকে দশ-বারো মাইল। সড়ক-পথে খানিকটা যাবার পরেই শুরু হয়ে যায় মরুভূমি। গাড়িটা কিন্তু মেমফিসের দিকে গেল না, ধুধু মরুভূমির মধ্যে ছুটতে শুরু করল।
কাকাবাবু ভাবলেন, আগেকার দিনে আরবসন্দাররা মরুভূমির মধ্যে তাঁবু। খাটিয়ে থাকত দলবল নিয়ে। এখন আরবরা অনেক বড়লোক হয়ে গেছে, তারা এয়ার-কণ্ডিশানড বাড়িতে থাকে। হানি আলকাদি কি এখনও পুরনো কায়দা বজায় রেখেছে? নইলে এই মরুভূমির মধ্যে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়! গাড়ির কোনও লোক একটিও কথা বলছে না। কাকাবাবুও তাদের কিছু জিজ্ঞেস করলেন না!
প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর দূরে দেখা গেল ভাঙা দেওয়াল-ঘেরা একটা প্রাচীন প্রাসাদ। তার অনেক ঘরই ভেঙে পড়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়। সেখানে মানুষজন থাকে না। কিন্তু কাছে এলে দেখা যায়, একটা উঁচু পাঁচিলের আড়ালে দুটো উট বাঁধা আছে আর তিনখানা স্টেশান ওয়াগন।
জিপটা থামবার পর অন্যরা কিছু বলবার আগেই কাকাবাবু নিজেই নেমে পড়লেন। ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন চারদিকটা।
একজন কাকাবাবুকে বলল, ফলো মি!
খানিকটা ধ্বংসন্তুপ পর হবার পর ওরা এসে পৌঁছল একটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাথরের ঘরে। সেখানে খাট-বিছানা পাতা আছে। রয়েছে একটা ছোট টেবিল, কয়েকটা চেয়ার। দেয়ালের গায়ে একটা কাঠের আলমারি, সেটা বন্ধ।
সঙ্গে যে লোকটি এসেছিল, সে কাকাবাবুকে বলল, তুমি এইখানে বিশ্রাম নাও! তোমার কি খিদে পেয়েছে? তা হলে খাবার পাঠিয়ে দিতে পারি।
কাকাবাবু বললেন, আমি বিশ্রাম নিতে চাই না, আমার জন্য খাবার পাঠাবার দরকার নেই। আমি এক্ষুনি হানি আলকাদির সঙ্গে দেখা করতে চাই।
লোকটি বলল, অল ইন গুড টাইম। ব্যস্ত হচ্ছে কেন? এখন বিশ্রাম নাও কিছুক্ষণ। আশা করি তুমি এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করবে না। এই মরুভূমির বালির ওপর দিয়ে তোমার ওই ক্রাচ নিয়ে তুমি এক মাইলও যেতে পারবে না।
লোকটা দরজা খোলা রেখেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কাকাবাবু চোখ বুজে, কপালটা কুঁচকে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। লোকটা একটা নিষ্ঠুর সত্যি কথা বলে গেছে। একটা পা অকেজো বলে এখন আর চলাফেরার স্বাধীনতা নেই তাঁর। যে কাজের জন্য তিনি এসেছেন, তার জন্য দুখানা জোরালো পা থাকা খুবই দরকারি। অনেকদিন বাদে তিনি ভাঙা পাখানার জন্য দুঃখ বোধ করলেন।
একটু বাদে কাকাবাবু শুয়ে পড়লেন খাটে। দুপুরে খাওয়া হয়নি, তাঁর বেশ খিদে পাচ্ছে, কিন্তু এদের এখানে তিনি খেতে চান না। ভেতরে ভেতরে তাঁর এখনও খুব রাগ জমে রয়েছে। একবার রাগ হলে সহজে কাটতে চায় না।
শুয়ে পড়বার পর তিনি দেখলেন বালিশের পাশে দুখানি বই। কৌতূহলের বশে তিনি প্রথমে একটি বই তুলে নিলেন। সেটি কমপ্লিট ওয়ার্কস অব শেক্সপিয়ার। কাকাবাবু দারুণ অবাক হলেন। এই মরুভূমির মধ্যে, একটা প্রায় ভগ্নস্তুপের মধ্যে শেক্সপিয়ারের কবিতা! অন্য বইটি দেখে আরও অবাক হলেন। সেটাও ইংরেজি কবিতা, সং অফারিংগস বাই স্যার আর. এন টেগোর!
কাকাবাবু বিহুলভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইটা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টালেন। বইখানি এমনি-এমনি এখানে পড়ে নেই। কেউ একজন মন দিয়ে পড়েছে। অনেক কবিতার লাইনের তলায় লাল কালির দাগ দেওয়া!
প্রায় আধা ঘণ্টা বই দুটো নিয়ে নাড়াচাড়া করবার পর একটা শব্দ শুনে কাকাবাবু মুখ তুলে তাকালেন।
দেওয়াল-আলমারিটার পাল্লা খুলে গেছে। সেটা আসলে একটা দরজা। তার পাশ দিয়ে নেমে গেছে মাটির নীচে সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে একজন লোক দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে।
লোকটিকে দেখে প্রথমেই কাকাবাবুর মনে হল সিনেমার নায়ক। অপূর্ব সুন্দর তার চেহারা। অন্তত ছফুট লম্বা, চমৎকার স্বাস্থ্য, গৌর বর্ণ, টিকোলো নাক, মাথার চুল আধ কোঁকড়ানো। মুখে সরু দাড়ি। সে পরে আছে একটা বু জিনস আর ফিকে হলদে টি শার্ট। সেই শার্টে একটা সিংহের মুখ আঁকা। তার কোমরে একটা বুলেটের বেল্ট, আর দুপাশে দুটো রিভলভার। সে-দুটোর বাঁট আবার সাদা। লোকটির বয়েস তিরিশ-বত্ৰিশের বেশি নয়।
লোকটিকে দেখে কাকাবাবুর হাসি পেয়ে গেল।
লোকটি অর্ধেক ঠোঁট ফাঁক করে হেসে নিখুঁত উচ্চারণে ইংরিজিতে বলল, হ্যালো, মিঃ রায়চৌধুরী, গুড আফটারনুন। আশা করি তোমার এখানে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি?
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে বললেন, তুমিই হানি আলকাদি?
লোকটি সামনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁ বলল। তারপর মেঝেতে নেমে এসে বলল, ঘরের মধ্যে এখনও গরম, বাইরে কিন্তু চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে। চালা. আমরা বাইরে গিয়ে বসি। তোমাকে আমরা ফাইনেস্ট ইন্ডিয়ান টি খাওয়াব। সেই সঙ্গে ফিশ কাবাব! তোমরা বেঙ্গলিরা তো ফিশ ভালবাসো।
কাকাবাবু বললেন, ওসব প্লেজানট্রিস বন্ধ করো। আগে আমি তোমার কাছ থেকে কয়েকটা এক্সপ্লানেশান চাই। তুমি আমাকে এখানে ধরে আনিয়েছ কেন? আমি ভারতীয় নাগরিক, আমাকে বন্দী করার কী অধিকার আছে তোমার?
হানি আলকাদি খুব অবাক হবার ভান করে বলল, ধরে এনেছি? মোটেই না! তোমার কি হাত বাঁধা আছে? তোমাকে আমি নেমন্তন্ন করে এনেছি। তুমিই তো শুনলুম আমার দুজন লোককে হাতে এমন মেরেছ যে, এক বেচারির কজি মুচকে গেছে!
কাকাবাবু স্থির দৃষ্টিতে হানি আলকাদির চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমাদের দেশে বুঝি রিভলভার উঁচিয়ে নেমন্তান্ন করাই প্রথা? আমি আগেও এখানে এসেছি, অনেক নেমন্তন্ন খেয়েছি, কোনওদিন তো এরকম দেখিনি?
হানি আলকাদি লজ্জিত ভাব করে বলল, আরো ছিা ছিা ছি, হোয়াট আ শেম! আমার লোকেরা এরকম বাড়াবাড়ি করে ফেলে! আমি মোটেও সেরকম নির্দেশ দিইনি। অবশ্য তোমার সব কথা শুনেটুনে ওরা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। মিঃ রায়চৌধুরী, আমি সত্যি বলছি, আমরা এখানে অনেকেই ভারতীয়দের খুব পছন্দ করি। আমি তোমাদের রবীন্দ্রনাথ টেগোরের খুব ভক্ত। সবাই আমাকে বিপ্লবী বলে জানে, কিন্তু আমি একজন কবিও বটে। ছদ্মনামে আমার দুটো কবিতার বই বেরিয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, রবীন্দ্রনাথের কোনও ভক্ত কোমরে দুটো পিস্তল ঝুলিয়ে রাখে, এটা দেখা আমার পক্ষে একটা নতুন অভিজ্ঞতা বটে। যাক গে যাক,
হানি আলকাদি এগিয়ে এসে কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো তুলে ধরে বলল, তুমি বড় রেগে আছ। এই নাও, বাইরে চলো, আকাশটা কী সুন্দর হয়ে আছে এখন, দেখলে তোমার মন ভাল হয়ে যাবে।
অগত্যা কাকাবাবু বাইরে বেরিয়ে এলেন। সেখানকার ফাঁকা চত্বরে একটা টেবিল ও দুটি চেয়ার পাতা হয়েছে। কিছু লোকজন সেখানে খাবারদাবার আর চায়ের পট সাজিয়ে দিচ্ছে। আকাশটার একপ্ৰান্তে টকটকে লাল। তার পরের দিকটার মেঘে। অনেক রঙের খেলা। বড় অপূর্ব দৃশ্য।
কাকাবাবু তবু বললেন, শোনো হানি আলকাদি, আমার কতকগুলো প্রিন্সিপাল আছে। তোমার সঙ্গে বসে আমি খাবার কেন, এক গেলাস জলও খাব না। কারণ তুমি খুনি। তুমি বিনা দোষে আমাকে হত্যা করবার জন্য একজনকে পাঠিয়েছিলে দিল্লিতে।
হানি আলকাদি বলল, তোমাকে হত্যা করতে? মোটেই না! তা হলে এটা দ্য খো। বলেই চেঁচিয়ে ডাকল, মোসলেম! মোসলেম!
অমনি একজন লোক বেরিয়ে এল পাশের গলি থেকে। কাকাবাবু তাকে দেখেই চিনতে পারলেন। এই লোকটাই দিল্লিতে তাঁর আততায়ী হয়ে এসেছিল এক রাত্তিরে।
হানি আলকাদি অনেক দূরের একটা খেজুরগাছ দেখিয়ে সেই লোকটিকে কী যেন বলল আরবি ভাষায়। তারপর নিজের একটা রিভলভার দিল লোকটির হাতে।
লোকটি চোখ বন্ধ করে এক পাশ ফিরে গুলি করল। নিখুঁত লক্ষ্যভেদে উড়ে গেল। খেজুর গাছের ডগাটা।
হানি আলকাদি যেন তাতেও খুশি হল না। লোকটির পাশে গিয়ে ধমক দিয়ে কী যেন বলতে লাগল। লোকটি আবার রিভলভার তুলে গুলি ছোড়ায় জন্য তৈরি হল। ট্রিগার টিপতে যাবে এমন সময় হানি আলকাদি চেঁচিয়ে বলল, ব্লাডি ফুল! লুক বিহাইণ্ড! বলেই লোকটির কাঁধের ওপর একটা থাপ্পড় কষাল।
লোকটি তবুও গুলি ছুড়ল এবং এবারেও খেজুরগাছটার ডগার খানিকটা অংশ উড়ে গেল।
হানি আলকাদি হাসতে-হাসতে কাকাবাবুর দিকে মুহক ফিরিয়ে বলল, দেখলে? দেখলে তো? এই মোসলেম আমার বডিগার্ড। পৃথিবীতে যেখানেই যাই, ওকে সঙ্গে নিয়ে যাই। ওর মাথা ঠাণ্ডা। টিপ অব্যৰ্থ। তোমার কাছে ওকে পাঠিয়েছিলাম। শুধু তোমাকে একটুখানি আঘাত দেবার জন্য। তোমাকে প্ৰাণে মেরে ফেলতে চাইলে ও ঠিকই মেরে আসত! তখনও তোমার সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানতুম না। তোমাকে একটু ভয় দেখিয়ে আমাদের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলুম।
হঠাৎ কাকাবাবুর একটা হাত জড়িয়ে ধরে হানি আলকাদি খুবই অনুতপ্ত গলায় বলল, তোমাকে আঘাত দিতে হয়েছিল বলে আমি ক্ষমা চাইছি। ঐ যে বললুম, তখন তোমার সম্পর্কে ভাল করে জানা ছিল না। আমরা ভেবেছিলুম, তুমি আল মামুনের একটা ভাড়াটে লোক!
হানি আলকাদির এতখানি বিনীত ব্যবহার দেখে কাকাবাবু অভিভূত হয়ে গেলেন। কোমরে দুদুটো পিস্তল থাকলেও লোকটি সত্যিই একজন কবি!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, এবারে বুঝেছি। আমার অবশ্য বেশি আঘাত লাগেনি।
চলো, তা হলে কিছু খেয়ে নিই। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে, ভাল জাতের ভারতীয় চা একটু ঠাণ্ডা হলেই বিস্বাদ হয়ে যায়।
দুজনে এসে বসলেন টেবিলে। হানি আলকাদি যত্ন করে কাকাবাবুর প্লেটে খাবার তুলে দিল। চা বানাল সে নিজেই। কাকাবাবু চা পান করতে করতে আকাশে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে লাগলেন।
চা শেষ করে হানি আলকাদি একটা চ্যাপ্টা ধরনের সিগারেট ধরাল। তারপর কাকাবাবুর দিকে ডান হাত বাড়িয়ে বলল, এবারে দাও!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী?
মুফতি মহম্মদের উইল! তারপর আমার লোকেরা তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবে।
যদি আমি না দিই?
তা হলে তুমি আমাদের এখানেই সম্মানিত অতিথি হয়ে থাকবে। আমরা রোজ তোমাকে অনুরোধ করব। যাতে তুমি দিয়ে দাও! কিংবা সেগুলো কোথায় আছে তুমি বলে দাও! মিঃ রায়চৌধুরী, আমাদের গুরু মুফতি মহম্মদের সম্পদ আটকে রেখে তোমার কী লাভ? তা তো তুমি নিজে ভোগ করতে পারবে না। তুমি কি তা ইজিপ্টের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে? সে সব দিন আর নেই!
শোনো হানি আলকাদি, তোমাদের গুরু, মুফতি মহম্মদের কোনও সম্পদ ছিল কি ছিল না তা আমি জানি না। থাকলেও তা ভোগ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। তিনি তো ফকির ছিলেন শুনেছি, তার সম্পদ সম্পর্কে তোমাদের এত আগ্রহ কেন?
ফকির হবার আগে তিনি এক বিরাট বিপ্লবী দলের নেতা ছিলেন। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর টাকা ছিল তার দলের। সে সব কোথায় গেল?
তিনি তো বিপ্লবী দল ভেঙে দিয়েছেন প্ৰায় চল্লিশ বছর আগে। এতদিনেও। তোমরা তার সন্ধান পাওনি?
না। কেউ তা পায়নি। ওঁকে কেউ ঘটাতে সাহস করত না। কিন্তু মৃত্যুকালে তিনি নিশ্চয়ই সব বলে দিয়ে গেছেন। সেই সন্ধানই আমরা জানতে চাই! উনি যে ছবিগুলো ঐকেছিলেন, সেগুলো আমাদের দিয়ে দাও!
সেগুলো তো আমার কাছে নেই। আল মামুন সেগুলো শুধু আমাকে দেখতে দিয়েছে, আমাকে তো দেয়নি।
ইয়া আল্লা! আমরা বরাবর ভেবেছি, সেগুলো তুমিই লুকিয়ে রেখেছি। আল মামুনের একটা লোককে আমরা ধরে এনে টর্চার করেছিলুম, সেও ঐ কথাই বলেছে!
না, তা নয়। ছবিগুলোতে কী লেখা আছে তা একমাত্র আমি জানি। ছবিগুলো আল মামুন নিজের কাছেই রেখেছে, কিন্তু ওতে কী লেখা আছে তা ও কিছুই জানে না। অবশ্য ও লণ্ডনে লর্ড পেমব্রোকের কাছে ছবিগুলো নিয়ে যেতে পারে, তিনি আমার চেয়ে অনেক ভালভাবে ওগুলো ডিসাইফার করে দিতে পারবেন।
মিঃ রায়চৌধুরী, তুমি কি জানো না, লর্ড পেমব্রোক মাত্র দুসপ্তাহ আগে মারা গেছেন? সুতরাং এখন পর্যন্ত শুধু তুমিই ওগুলোর অর্থ জানো! দেরি করার সময় নেই। আজই আমরা সব কিছু জানতে চাই। আল মামুনও ছবিগুলোর অর্থ জানতে চেয়েছিল। তাকে বলিনি। তা হলে তোমাদের বলব কেন?
এই প্ৰথম হানি আলকাদি রেগে উঠল। টেবিলের ওপর এমন জোরে একটা ঘুসি মোরল যে, কপি-প্লেটগুলো কেঁপে উঠল ঝনঝনি করে। তার ফস মুখখানা টকটকে লাল হয়ে গেছে।
সে বলল, কী বলছি তুমি, আমাদের সঙ্গে ঐ পিশাচটার তুলনা? আমরা বিপ্লবী, আমরা কেউ নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবি না! আর ঐ লোকটা, ঐ আল মামুন, ও তো একটা ঘূণ্য লোভী মানুষ। ওর অনেক টাকা, তবুওর টাকার আশ মেটে না। ও মুফতি মহম্মদকে দিল্লিতে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গিয়েছিল শুধু এই লোভে যে, যদি মুফতি মহম্মদ শেষ পর্যন্ত ওকেই সব কিছুর সন্ধান বলে দেন। ওকে আমি খুন করব! নিজের হাতে।
কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে তোমরা যা ইচ্ছে করো। এর মধ্যে আমাকে জড়াচ্ছ কেন?
হানি আলকাদি নিজের রাগ খানিকটা সামলে নিল। তারপর সেও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে জড়াচ্ছি, তার কারণ, তুমিই এখন পর্যন্ত মুফতি মহম্মদের উইলের অর্থ জানো। তুমি যদি আমাদের বলতে না চাও, তা হলে আর কেউ যাতে জেনে না ফেলে, সেজন্য আমরা তোমার মুণ্ডুটা কেটে ফেলতে বাধ্য হব।
কাকাবাবু বললেন, ইউ আর ওয়েলকাম। আমার কাটা মুণ্ডু কোনও কথা বলবে না!
হানি আলকাদি। এবারে হঠাৎ কাকাবাবুর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, তুমি টেগোরের দেশের লোক, গান্ধীর দেশের লোক, তোমরা ভায়োলেন্সকে ঘৃণা করো, তা আমরা জানি। কিন্তু তোমরা তো আমাদের এদিককার দেশগুলোর অবস্থা জানো না! সে যাই হোক, তোমার মুণ্ডু কাটার কথা আমি এমনিই রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। তুমি আমাদের বলো বা না-ই বলো, আমরা তোমার কোনওই ক্ষতি করব না। তবু আমি কাতরভাবে তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছি। আমাদের দল এখন এমন অবস্থায় রয়েছে, প্রচুর টাকা ও অস্ত্রশস্ত্র না পেলে আমরা আজ কাজ চালাতে পারব না! সেইজন্যেই মুফতি মহম্মদের উইলের ওপর আমরা এত আশা রেখেছি।
কাকাবাবু হানি আলকাদির কাঁধ ধরে বললেন, ওঠে, চেয়ারে বোসো! শোনো, তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তোমাকে আমি খোলাখুলি বলছি, মুফতি মহম্মদ শেষ উইল করেছিলেন কি না, তা আমি জানি না। সত্যিই জানি না?
মিঃ রায়চৌধুরী, তোমাকে আমি বিশ্বাস করছি। তা হলে বলো, ছবিতে একে একে উনি কী বুঝিয়েছিলেন?
সেটা বলতে পারো এক ধরনের ছেলেমানুষ। একজন সাতানব্বই বছরের বৃদ্ধের শেষ কৌতুক। সেটা জেনে তোমার বা আল মামুনের কোনওই লাভ হবে না। বরং আমার মতন যে-সব লোক ইতিহাসের ব্যাপারে কৌতূহলী, তাদেরই আগ্রহ হবে। মুফতি মহম্মদ আমাকে আদেশ করেছেন যে, সেটা আমি যাচাই করার আগে যেন কারুকে না বলি। সেটা যাচাই করার পর আমি তোমাকে বলব নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে আমাকে তোমায় কয়েকটা সাহায্য করতে হবে।
কী সাহায্য বলে?
আমাকে একটা পিরামিডের মধ্যে ঢুকতে হবে। হয়তো একটা সমাধি-কুয়োর মধ্যেও নামতে হতে পারে। এজন্য গাইড চাই, উট চাই, আর কিছু সরঞ্জাম চাই। তুমি যদি সে-সব ব্যবস্থা করে দাও, তা হলে আমি কথা দিচ্ছি, আমি যদি কোনও গুপ্ত সম্পদের সন্ধান জানতে পারি, তবে তা তোমাকেই আগে জানাব।
হানি আলকাদি ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ইটস আ ডিল! তুমি কবে রওনা হতে চাও বলো? কাল সকালে?
কাকাবাবু বললেন, তার আগে দুএকটা কাজ আছে। মেমফিসে ডাগো আবদাল্লা নামে পুরনো একজন গাইডকে আমি চিনতাম। সে যদি বেঁচে থাকে, তাকে আমার দরকার হবে। আর হোটেল ওয়েসিস থেকে আমার ভাইপো সন্তুকেও আনাতে হবে এখানে। তাকে আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, তুমি পৌঁছে দিতে পারবে?
হানি আলকাদি বলল, তুমি এক্ষুনি চিঠি লেখো। দুঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। ডাগো আবদাল্লাও বেশ বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছে। তাকে আমি আনিয়ে দিচ্ছি।
তারপরই সে তার লোকজনদের হুকুম করল কাগজ আর কলম আনবার জন্য। সে-সব এসে গেলে কাকাবাবু চিঠি লিখতে শুরু করলেন!
স্নেহের সন্তু,
আমি ভাল আছি। এরা আমাকে বেশ যত্নে রেখেছে। হানি অ্যালকাদি লোকটি মন্দ না, তার সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেছে। এরপর এখান থেকে আমরা একটা অভিযানে বেরুব, সেজন্য তোকে আসতে হবে এখানে। তোকে যা করতে হবে তা বলছি। এই চিঠি যে নিয়ে যাবে, সে কাল সকালে তোকে একটা উট ভাড়া করে দেবে। সেই উটে চেপে তুই মেমফিসে চলে আসবি। সেখানে স্টেপ পিরামিড আছে চিনতে তোর অসুবিধে হবে না। অন্য পিরামিডের চেয়ে এর চেহারাটা একেবারেই আলাদা। এর বাইরের গা দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ির মতন উঠে গেছে। তুই সেখানে এসে অপেক্ষা করবি। এখানকার লোক তোকে গিয়ে নিয়ে আসবে।
চিন্তার কিছু নেই। কাল সন্ধের মধ্যে দেখা হবে।
ইতি কাকাবাবু
পুনশ্চ : সিদ্ধার্থকে সঙ্গে আনবার কোনওই দরকার নেই। ওকে বুঝিয়ে বলবি। আমরা যে-কাজে যাচ্ছি, তাতে সরকারি লোকজনদের না জড়ানোই ভাল। মান্টেকে বলবি, আমি আর তিন-চারদিন পরে ওর সঙ্গে মিউজিয়ামে গিয়ে দেখা করব।