Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মিশর রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 5

মিশর রহস্য || Sunil Gangopadhyay

কাকাবাবু আর সন্তুকে কড়া পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে একটা সরকারি গেস্ট হাউসে। এর মধ্যে দুবার হামলা হয়ে গেছে কাকাবাবুর ওপর। কাকাবাবুর বন্ধুরা সবাই বলছেন ওঁকে কলকাতায় ফিরে যেতে। এখানে থাকলে ওঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু কাকাবাবু সে-কথা কিছুতেই শুনবেন না।

সাধক মুফতি মহম্মদ সেদিন সেই চেয়ারে বসেই মৃত্যু বরণ করেছেন। শেষ সময়ে তাঁর মুখে কোনও যন্ত্রণার ছাপ ছিল না, বরং ফুটে উঠেছিল অপূর্ব সুন্দর হাসি। যেন তিনি খুব তৃপ্তির সঙ্গে এই জীবন শেষ করে চলে গেলেন।

সাধক মুফতি মহম্মদের অনেক শিষ্য এই দিল্লিতেই আছে। এই শিষ্যদের আবার দুটি দল। এক দলের নেতা আল মামুন, আর অন্য দলটির নেতা হানি আলকাদি নামে একজন। শিষ্যদের ধারণা, সাধক মুফতি মহম্মদের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে তিনি তাঁর শেষ উইল ছবি দিয়ে লিখে গেছেন। শুধু রাজা রায়চৌধুরীই সেই ছবির মানে জেনেছে। রাজা রায়চৌধুরী বাইরের লোক, সে কেন এই গোপন কথা জানবে? আল মামুন কেন রাজা রায়চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? দ্বিতীয় দলের নেতা হানি আলকাদি অভিযোগ করেছে যে, আল মামুন নিজে নেতা হবার মতলবে সেই উইলের কথা অন্য কারুকে জানতে দিচ্ছে না।

কিন্তু মজা হচ্ছে এই, আল মামুনও রেগে গেছে কাকাবাবুর ওপর। বৃদ্ধ মুফতি মহম্মদের আঁকা ঐ ছবিগুলোর যে কী মানে, তা কাকাবাবু আল মামুনকেও বলেননি।

এমন কী, নরেন্দ্ৰ ভার্মা বারবার জিজ্ঞেস করলেও কাকাবাবু মুচকি হেসে বলেছেন, ধরে নাও, ঐ ছবিগুলোর কোনও মানে নেই। আমি অবশ্য একরকম মানে করেছি, সেটা ভুলও হতে পারে।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, তুমি কী মানে বুঝেছি, সেটাই শুনি?

কাকাবাবু বললেন, উঁহু, সেটাও বলা যাবে না। মুফতি মহম্মদ নিষেধ করে গেছেন।

অ্যাঁ! উনি কখন নিষেধ করলেন তোমায়? আমরা তো কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলুম!

কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেই কি সব বোঝা যায়? দেখলে না, আমি মুফতি মহম্মদকে লিখে কিছু প্রশ্ন জানালুম। উনিও ছবি এঁকে তার উত্তর দিলেন।

তুমি কী প্রশ্ন করেছিলে?

আমি একটা মানে উল্লেখ করে জানতে চেয়েছিলুম, আপনি কি এটাই বোঝাতে চাইছেন? উনি তার উত্তরে হ্যাঁ, বা না কিছুই লিখলেন না। উনি লিখলেন, তুমি আগে নিজে যাচাই করে দেখো, তার আগে কারুকে কিছু বোলো না।

যাচাই করে দেখো, মানে? অন্য কোনও পণ্ডিতের পরামর্শ নেবে? না, তাও তো পারবে না। অন্য কারুকে বলাই তো নিষেধ।

এটা যাচাই করার জন্য আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। ইজিপ্টে!

সন্তু বলে উঠল, পিরামিডের দেশে?

কাকাবাবু চোখ দিয়ে হেসে বললেন, মনে হচ্ছে তোর এবারে বিদেশ ঘোরা হয়ে যাবে, সন্তু!

সন্তুর মনে পড়ে গেল রিনির কথা। সিদ্ধাৰ্থদাদের সঙ্গে রিনি কায়রো বেড়াতে গেছে। তখন সে-কথা শুনে সন্তুর হিংসে হয়েছিল। এবারে সে-ই কায়রোতে পৌঁছে রিনিদের চমকে দেবে। কাকাবাবু এইজন্যই পাসপোর্ট আনতে বলেছিলেন?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা চিন্তিতভাবে বললেন, রাজা, এখন ইজিপ্ট গেলে তুমি যে একেবারে বাঘের মুখে গিয়ে পড়বে! এখানেই তুমি দুতিনবার বিপদে পড়েছিলে। দিল্লিতে যে এত ইজিপশিয়ান থাকে জানা ছিল না। ওখান থেকে আমাদের দেশে অনেকে পড়া-লিখা করতে আসে। বিজনেসের জন্যও আসে। আমি খবর নিয়ে জেনেছি, ঐ যে হানি আলকাদি নামের লোকটা, ওর অনেক গোঁড়া সাপোেটর আছে। ওর পাটি একবার একটা প্লেন হাইজ্যাক করেছিল। মুফতি মহম্মদের সিক্রেট তুমি যদি আগে ওদের কাছে ফাঁস না। করো, তা হলে ওরা তোমাকে ছাড়বে না?

কাকাবাবু বললেন, বাঘের মুখে গিয়ে পড়তেই তো আমার ইচ্ছে করে। তুমি কি ভাবিছ, পুলিশ-পাহারায় আমি এখানে বসে থাকব?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট তোমাকে এখন ইজিপ্ট পাঠাতে রাজি হবে না। ও দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের বেশ ভাল সম্পর্ক আছে, তুমি গিয়ে যদি এখন একটা গণ্ডগোল পাকাও…

কাকাবাবু তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, কিছু গণ্ডগোল পাকব না। আমাকে গভর্নমেন্টেরও পাঠাবার দরকার নেই। আমি নিজেই যাব। তুমি বরং একটু সাহায্য করো, নরেন্দ্র। আজকের মধ্যেই আমাদের দুজনের ভিসা জোগাড় করে দাও।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, আমি এখনও বলছি, তোমাদের ওখানে যাওয়া উচিত নয়।

কাকাবাবু এবারে হেসে ফেলে বললেন, তোমার হিংসে হচ্ছে বুঝি, নরেন্দ্র? আমরা বেশ ইজিপ্ট মজা করতে যাচ্ছি, তোমার যাওয়া হবে না। কিন্তু তোমাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি না।

মজা? তুমি ইজিপ্টে মজা করতে যাচ্ছ? হানি আলকাদিকে আমি যতটা চিনেছি, সে একটা দুর্দান্ত টাইপের লোক?

আরে, দুর্দান্ত প্ৰকৃতির লোকদের খুব সহজে বাগ মানানো যায়। যাদের বাইরে থেকে নরম-সরম মনে হয়, তাদেরই মনের আসল চেহারাটা বোঝা শক্ত। দেখো না। ওখানে কত মজা হয়। ফিরে এসে তোমাকে সব গল্প শোনাব।

কাকাবাবু উঠে গিয়ে তাঁর হাতব্যাগ খুলে রিভলভারটা বার করলেন। সেটা নরেন্দ্ৰ ভার্মার কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, এটা তোমার কাছে জমা রইল। বিদেশে যাচ্ছি, সঙ্গে আর্মস নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, হানি আলকাদির দলবল তোমার ওপর সাঙ্ঘাতিক রেগে আছে জেনেও তুমি কোনও হাতিয়ার ছাড়া অত দূরের দেশে যাবে?

কাকাবাবু নিজের মাথায় আঙুল দিয়ে টোকা মারতে মারতে ইয়ার্কির সুরে বললেন, কাঁধের ওপর যে জিনিসটা রয়েছে, তার থেকে আর কোনও অস্ত্ৰ কি বড় হতে পারে?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা এমন একটা মুখের ভাব করলেন, যেন তিনি বলতে চান, আঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না!

সন্ধেবেলা নরেন্দ্ৰ ভার্মা চলে যাবার পর কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, শোন, —এখানে খুব সাবধানে থাকবি। একা বাইরে বেরুবি না। ওরা যদি তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোথাও আটকে রাখে, তা হলে আমার ওপর চাপ দেওয়া সহজ হবে।

সন্তু মুখে আচ্ছা বললেও তলার ঠোঁটটা এমনভাবে কাঁপাল যাতে বেশ একটু গৰ্ব-গর্বভাব ফুটে উঠল।

সেটা লক্ষ করে কাকাবাবু বললেন, বুঝেছি, তুই মনে মনে ভাবছিস তো, তোকে কে আটকে রাখবে! তুই ঠিক পালাতে পারবি, তাই না? তাতেই তো আমার বেশি চিন্তা! তোর মতন বয়েসি একটা ছেলেকে সহজে মারে না, কিন্তু তুই পালাবার চেষ্টা করলে নিঘতি গুলিটুলি ছুঁড়বে। এর আগে তুই যতবার পালাবার চেষ্টা করেছিস, ততবার বেশি বিপদে পড়েছিস, মনে নেই?

সন্তু বলল, প্রত্যেকবার নয়। সেবারে ত্রিপুরায় যে আমি পালিয়েছিলুম, আর আমায় কেউ ধরতে পারেনি!

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। মানলুম। কিন্তু এবারে দিল্লিতে আর কায়রোতে গিয়ে সব সময় আমার সঙ্গে থাকিবি। এক-একা গোয়েন্দাগিরি করার চেষ্টা করবি না।

সতুর মনে পড়ল, সে এক তিলজলায় রহস্যসন্ধান করতে গিয়ে কী কেলেঙ্কারিই না হয়েছিল। ভাগ্যিস কাকাবাবু সে-কথা জানেন না।

অবশ্য সন্তু তখনই ঠিক করল, তা বলে সে দমে যাবে না। ভবিষ্যতে আবার সে ঐ রকম চেষ্টা করবে। সে এক-একা একটা রহস্যের সমাধান করে কাকাবাবুকে তাক লাগিয়ে দেবে।

পরদিন কাকাবাবু টেলিফোনেই অনেক কাজ সেরে ফেললেন। তার পরের দিনই তাঁদের ইজিপ্ট যাত্ৰা। নরেন্দ্ৰ ভার্মা গোমড়া মুখে ওঁদের পৌঁছে দিতে এলেন এয়ারপোর্টে। ওরা ভেতরে ঢোকার আগের মুহূর্তে নরেন্দ্ৰ ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, কী রাজা, এখনও কি মনে হচ্ছে তোমরা ওখানে মজা করতে যাচ্ছ?

কাকাবাবু চোখ টিপে বললেন, হ্যাঁ, দারুণ মজা হবে। ইশ, তুমি যেতে পারলে না।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, আমি খোঁজ পেয়েছি। হানি আলকাদিও আজ সকালে অন্য একটা প্লেনে ইজিপ্ট চলে গেছে। নিশ্চয়ই এমব্যাসি থেকে খবর পেয়েছে। যে, তুমি ইজিপ্টের ভিসা নিয়েছ!

কাকাবাবু সে খবর শুনে একটুও বিচলিত না হয়ে বললেন, তা তো যাবেই। নইলে মজা জমবে কেন? আল মামুন যায়নি? সে তো রাগ করে আমার সঙ্গে আর দেখাই করে না?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, তার খবর জানি না।

কাকাবাবু বললেন, যাবে, সেও নিশ্চয়ই যাবে। আচ্ছা নরেন্দ্র, ফিরে এসে সব গল্প হবে।

এই তো কদিন আগেই সন্তু প্লেনে চেপে কলকাতা থেকে এসেছে দিল্লিতে। সেই প্লেনটা ছিল এয়ারবাস আর এটা বোয়িং। একটা শিহরন জাগছে সন্তুর বুকের মধ্যে। বিদেশ, বিদেশ! পিরামিডের দেশ। ক্লিওপেট্রার দেশ।

প্লেন আকাশে ওড়বার পরেই সন্তু সিটবেল্ট খুলে উঠে দাঁড়াল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছিস?

ন্তু মুখ খুলে কিছু বলার আগেই কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, বাথরুমে যাবার কথা বলবি তো? শুধু শুধু মিথ্যে কথা বলতে হবে না। পুরো প্লেনটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে হয়েছে দেখে আয়। চলন্ত প্লেনে তো আর তোকে কেউ কিডন্যাপ করবে না! এক যদি প্লেনটা কেউ হাইজ্যাক করে। তা যদি করেই, তা হলে আর কী করা যাবে!

সন্তুর আসল উদ্দেশ্য হল যাত্রীদের মুখগুলো ভাল করে দেখা। চেনা কেউ আছে কি না। তার দৃঢ় বিশ্বাস, আল মামুনও এই প্লেনে রয়েছে। প্রথম থেকেই ঐ লোকটিকে সন্তু ঠিক পছন্দ করতে পারেনি। লোকটির সব সময় কী রকম যেন গোপন-গোপন ভাব। মনের কথা খুলে বলে না। আল মামুন প্রথমেই কাকাবাবুকে এক লক্ষ টাকার লোভ দেখিয়েছিল।

মুফতি মহম্মদ মরে যাবার পর আল মামুন খুব একটা দুঃখ পেয়েছেন এমন মনে হয়নি। তিনি কাকাবাবুকে বলেছিলেন যে, কাকাবাবু যদি সব ছবিগুলোর ভাষা শুধু আল মামুনকেই জানিয়ে দেন, তা হলে তিনি পাঁচ লক্ষ টাকা দেবেন।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তা কী করে হবে? আপনার গুরুই যে বলতে বারণ করেছেন!

না, প্লেনের যাত্রীদের মধ্যে একজনও চেনা মানুষ দেখতে পেল না। সন্তু। কয়েকজন ভারতীয় যাত্রী রয়েছে, কিন্তু তারা কেউ বাংলায় কথা বলছে না।

তখনও সন্তু জানে না যে, তার জন্য একটা দারুণ বিস্ময় অপেক্ষা করছে।

খাবার দিচ্ছে দেখে সন্তু এল নিজের জায়গায়। টেবিলটা খুলে পেতে নিল।

খেতে খেতে কাকাবাবু বললেন, তুই হিয়েরোগ্লিফিক্‌সের মানে বলে আমায় চমকে দিয়েছিল। পিরামিডগুলো কেন তৈরি হয়েছিল তাও তুই জানিস নিশ্চয়ই?

সন্তু বলল, রাজা-রানিদের সমাধি দেবার জন্য। ভেতরে অনেক জিনিসপত্তর রাখা থাকত, রাজারানিরা ভাবতেন যে, তাঁরা আবার বেঁচে উঠবেন।

সবচেয়ে পুরনো পিরামিড কতদিন আগে তৈরি হয়েছে বল তো?

সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে!

এটা আন্দাজে বললি, তাই না?

ধরা পড়ে গিয়ে সন্তু লাজুকভাবে হাসল।

কাকাবাবু বললেন, খুব পুরনো পিরামিডগুলো খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮৬ থেকে ২১৬০ বছরের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। তা হলে বলা যেতে পারে মোটামুটি সাড়ে চার হাজার বছর আগে। যাই হোক, পিরামিড তো অনেকগুলোই আছে। এর মধ্যে গিজার পিরামিড খুব বিখ্যাত। আর একটা আছে। খুফু। এটা বিরাট লম্বা। এখন তো পৃথিবীতে মস্ত-মস্ত বাড়ি তৈরি হয়েছে। এক সময় নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিডিং ছিল সবচেয়ে বড় বাড়ি, তারপর…

এখন শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার সবচেয়ে বড়।

হুঁ, তাও জানিস দেখছি। কিন্তু ঐ খুফুর পিরামিড এখনও ঐ সব বড়-বড় বাড়ির সঙ্গে উচ্চতায় পাল্লা দিতে পারে। এবারে তোকে একটা ভূতের গল্প বলি শোন! পিরামিডগুলোর আশেপাশে আরও অনেক গোপন সমাধিস্থান আছে মাটির নীচে। বাইরের থেকে সেগুলো বোঝাই যায় না। সাহেবরা একটা-একটা করে সেগুলো আবিষ্কার করেছে। সম্রাট খুফুর মায়ের নাম ছিল হেটেফেরিস। তাঁর সমাধিস্থানের কথা অনেকে জানতই না। একজন সাহেব সেটি আবিষ্কার করেন। সেখানে কোনও পিরামিড নেই, মাটির নীচে একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে ছিল সেই সমাধি। মমিগুলো যে কফিনের মধ্যে রাখে, তাকে বলে সারকোফেগাস। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, প্রথম যিনি সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে নামলেন, তিনি সেখানে অনেক কিছু দেখতে পেলেও সারকোফেগাসের মধ্যে রানি হেটেফেরিসের মমি দেখতে পেলেন না।

কেউ মমিটা চুরি করে নিয়ে গেছে!

হ্যাঁ, পিরামিড থেকে অনেক মমি চুরি গেছে বটে, কিন্তু রানি হেটেফেরিসের সমাধিস্থানে তো কেউ আগে ঢোকেনি। তাছাড়া, রাজা-রানিদের সমাধিস্থানে অনেক দামি দামি জিনিস থাকত। যেমন সোনার খাট, সোনার জুতো, মণিমুক্তো-বসানো পানপত্র, আরও অনেক কিছু। প্রথম যিনি সেই সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করেন, সেই চার্লস ব্ৰকওয়ে অনেক মূল্যবান জিনিস দেখতে পেয়েছিলেন, শুধু মমিটাই ছিল না। চোরেরা আর-কিছু নিল না, শুধু মমিটাই নিল? চোরেরা তো মমি নেয় বিক্রি করবার জন্যই!

তারপর?

এর এক বছর তিন মাস বাদে একদল পুরাতত্ত্ববিদ আবার ঐ সুড়ঙ্গে নামেন। তাঁরা কিন্তু সারকোফেগাসের মধ্যে রানি হেটেফেরিসের মমি দেখতে পান। তাঁরা সেই মমির ছবিও তুলেছিলেন। মিশর সরকারের অনুমতি ছাড়া মমি সরানো যায় না। তাই তাঁরা সেদিন আর কিছু করেননি। ওপরে পাহারা বসিয়ে রেখেছিলেন। পরদিন আবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল সারকোফেগাসের মধ্যে মমি নেই! আবার অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাই নিয়ে সে-সময় অনেক হৈচৈ হয়েছিল, পৃথিবীর বহু কাগজে খবরটা ছাপা হয়েছিল, এই নিয়ে বইও লেখা হয়েছে। চার্লস ব্ৰকওয়ে অবশ্য দ্বিতীয় অভিযাত্রী দলটির বক্তব্য একটুও বিশ্বাস করেননি।

আরও কিছু শোনবার জন্য সন্তু কাকাবাবুর মুখের দিকে ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে আছে দেখে কাকাবাবু বললেন, তোকে এমনি একটা রহস্যকাহিনী শোনালুম। আমরা যে-কাজে যাচ্ছি। তার সঙ্গে রানি হেটেফেরিসের সমাধির খুব একটা সম্পর্ক নেই।

খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। এঁটো প্লেট সরিয়ে নিয়ে গেল এয়ার-হস্টেসরা। তার একটু পরে একজন এয়ার-হস্টেস সন্তুর কাছে এসে ইংরেজিতে বলল, তোমার নাম তো সন্তু, তাই না? প্লিজ কাম উইথ মি! তোমাকে আর-একবার সিকিউরিটি চেক করা হবে।

সন্তু দারুণ অবাক হয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকাল। এয়ার-হস্টেসটি কাকাবাবুকে বলল, আই অ্যাম সরি স্যার, এই ছেলেটি সন্দেহজনকভাবে সারা প্লেন ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সেইজন্য ক্যাপ্টেন বললেন, ওকে একবার সার্চ করে দেখতে হবে! আমি ওকে একটু নিয়ে যাচ্ছি!

কাকাবাবু বললেন, গো অ্যাহেড!

সন্তু একই সঙ্গে আশ্চর্য হল, রেগে গেল, আবার বেশ মজাও পেল। এরা তাকে হাইজ্যাকার ভাবছে নাকি? সঙ্গে একটা খেলনা পিস্তল থাকলেও এদের বেশ ভয় দেখানো যেত।

এয়ার-হস্টেসটি সন্তুকে নিয়ে এল ককপিটে। সেখানকার দরজা খুলে ভেতরে ঢোকা মাত্র একজন বলে উঠল, হ্যান্ডস আপ!

তারপরই হেসে উঠল হো হো করে!

সন্তুর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বিমানদা!

সন্তুদের পাড়ার যে বিমান পাইলট, সে-ই এই প্লেনের ক্যাপটেন। এরকম যোগাযোগ যে ঘটতে পারে, তা সন্তুর একবারও মনে হয়নি।

এয়ার-হস্টেস আর কো-পাইলটরা হাসছে সন্তুর ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা দেখে। এয়ার-হস্টেসটি বলল, আমি যখন গিয়ে বললুম যে, ওকে সার্চ করা হবে, তখন এই ইয়াং জেন্টলম্যানটির মুখ একেবারে ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল। পকেটে সত্যি বোমা-পিস্তল কিছু আছে নাকি?

বিমান অন্য সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল সন্তুর। তারপর জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবুও দেখলুম রয়েছেন। তোরা কোথায় যাচ্ছিস?

সন্তু বলল, ইজিপ্ট।

বিমান বলল, ইজিপ্টে? সেখানে তোরা কোন ব্যাপারে যাচ্ছিস? নিশ্চয়ই বেড়াতে নয়?

সন্তু এবার একটু ভারিকি ভাব করে বলল, সেটা এখন বলা যাবে না!

বিমান অন্যদের বলল, জানো, এই যাঁকে কাকাবাবু বলছি, তিনি একজন ফ্যানটাসটিক পার্সন। পৃথিবীতে যে-সব মিষ্ট্রি অন্য কেউ সলভ করতে পারে না, সেগুলো তিনি সলভ করার চেষ্টা করেন। যেমন ওঁর জ্ঞান, তেমনি সাহস।

কো-পাইলট মিঃ কোহলি বললেন, তাহলে আমরা সবাই তাঁকে একবার দেখতে চাই।

বিমান বলল, আর একটা মজা করা যাক। সন্তুকে আমরা এখানে আটকে রাখি, তা হলে কাকাবাবু নিশ্চয়ই এক সময়ে এখানে ছুটে আসবেন।

ককপিটে বসে অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। প্লেনটা মেঘের রাজ্য দিয়ে যাচ্ছে বটে। তবু মাঝে-মাঝে চোখে পড়ে নীচের পৃথিবী। বিমান সন্তুকে বোঝাতে লাগল আকাশের মানচিত্র।

এক ঘণ্টা কেটে গেল, তবু কাকাবাবু সন্তুর কোনও খোঁজ করলেন না। বিমান বলল, চল রে, সন্তু, আমিই কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি।

দূর থেকে দেখা গেল কাকাবাবু বুকের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। ওরা কাছে যাবার পর কাকাবাবুকে ডাকতে হল না, তিনি মুখ তুলে, একটুও অবাক না। হয়ে, স্বাভাবিক গলায় বললেন, কী খবর, বিমান?

বিমান জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জানতেন আমি এই প্লেনে থাকব?

কাকাবাবু বললেন, না, তা জানতুম না! তবে জানাটা শক্ত কিছু নয়। সন্তুকে নিয়ে যাবার পরই মনে পড়ল, প্লেন টেক অফ করার পর ঘোষণা করা হয়েছিল, ক্যাপটেন ব্যানার্জি এবং তাঁর ক্রু-রা সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে। তখন দুই আর দুইয়ে চার করে নিলুম।

বিমান একটু হতাশ হয়ে বলল, কাকাবাবু, আপনি কখনও চমকে যান না, বা অবাক হন না?

কাকাবাবু বললেন, কেন হব না? পৃথিবীতে অবাক হবার মতন ঘটনাই তো বেশি। তবে এত সামান্য ব্যাপারে ব্যস্ত হই না।

কাকাবাবু, মিশরে কী ব্যাপারে যাচ্ছেন, জানতে পারি?

অতি সামান্য ব্যাপার!

তার মানে এখন বলবেন না! ইশ, আমাকে রিলিজ করছে আথেন্সে। যদি কায়রোতে নামতে পারতুম! দেখি যদি ম্যানেজ করে চলে আসতে পারি। কায়রোতে আপনারা কোথায় উঠবেন?

উঠব তো ওয়েসিস হোটেলে। কিন্তু কায়রোতে আমরা দুএকদিনের বেশি থাকব না। মেমফিসে চলে যাব। সেখানে কোথায় উঠব তার ঠিক নেই।

সন্তু বলল, বিমানদা, তুমি সিদ্ধাৰ্থদাকে চেনো তো? স্নিগ্ধাদির বর? ওরা এখন কায়রোতে আছেন। তুমি ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে খোঁজ কোরো! সিদ্ধাৰ্থদা ফার্স্ট সেক্রেটারি…

কাকাবাবু একটু ভর্ৎসনার চোখে তাকালেন সন্তুর দিকে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress