দিদির বন্ধু স্নিগ্ধাদির বর সিদ্ধাৰ্থদা
দিদির বন্ধু স্নিগ্ধাদির বর সিদ্ধাৰ্থদা কলেজে পড়ানোর কাজ ছেড়ে ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন। এখন বাইরে-বাইরে থাকেন। সেই যে সেবার কাশ্মীরে কণিষ্কর মুণ্ডু উদ্ধার করার ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছিলেন, তারপর থেকে আর অনেকদিন সিদ্ধাৰ্থদার সঙ্গে সন্তুর দেখাই হয়নি। সিদ্ধাৰ্থদারা কয়েক বছর কাটালেন বেলজিয়ামে, তারপর সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন কানাডায়। আবার যেন কোথাও বদলি হয়েছেন, সেই ফাঁকে বেড়াতে এসেছেন। কলকাতাতে।
স্নিগ্ধাদি একদিন এসেছিলেন সন্তুদের বাড়িতে। দিদি তো এখানে নেই, দিদি এখন ভূপালে। মায়ের সঙ্গে অনেক গল্প করার পর স্নিগ্ধাদি সন্তুকে নেমন্তন্ন করলেন তাঁদের বাড়িতে।
সিদ্ধাৰ্থদা আবার শখের ম্যাজিশিয়ান। খাওয়া-দাওয়ার পর সিদ্ধাৰ্থদা ম্যাজিক দেখাতে লাগলেন কয়েকটা। সন্তু অনেক ম্যাজিকের বই পড়েছে, সিদ্ধাৰ্থদার সব কটা ম্যাজিকই সে ধরে ফেলতে পারত। কিন্তু ম্যাজিকের আসরে ওরকম করা উচিত নয় বলে সে চুপ করে রইল। শেষকালে একটা তাসের ম্যাজিকে সিদ্ধাৰ্থদা একটুখানি ভুল করে ফেলায় সন্তু আর হাসি চাপতে পারল না।
সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, এই, তুমি হাসলে কেন? দেখবে, তোমার জামার পকেট থেকে আমি একটা মুর্গির ডিম বার করে দেব?
স্নিগ্ধাদি বললেন, আহা, তোমার যা পচা-পচা মাজিক, সন্তু ঠিক ধরে ফেলেছে!
সিদ্ধাৰ্থদা ভুরু কুঁচকে সন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সন্তু মানে? দা গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারার? আমি তো ওকে চিনতেই পারিনি, অনেক বড় হয়ে গেছে!
ম্যাজিক দেখানো বন্ধ করে সিদ্ধাৰ্থদা সন্তুকে কাছে ডেকে নানান গল্প শুরু করে দিলেন। এক সময় তিনি বললেন, জানো সন্তু, কানাডায় আমাদের এমব্যাসির ছেলেমেয়েদের জন্য একদিন সবুজ দ্বীপের রাজা সিনেমাটা দেখানো হল। তুমি আর কাকাবাবু যে একেবারে আন্দামানে জারোয়াদের মধ্যে চলে গিয়েছিলে, আমি তো জানতুমই না! তুমি তো সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করেছিলে। আমি একেবারে থ্রিলাড! সন্তু লাজুক-লাজুক মুখ করে রইল। সিদ্ধাৰ্থদা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর আর কোথাও গিয়েছিলে? সন্তু তাদের অভিযানের কাহিনী শোনাতে লজ্জা পায়। সে বলল, এই, আরও দুএক জায়গায়…
সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, আমার এবার পোস্টিং কোথায় জানো তো? ইজিপ্টে। কাকাবাবুকে বলো না, সেখানে একবার চলে আসতে? সেখানেও তো কত রহস্যময় ব্যাপার আছে, পিরামিড, স্ফিংকস, মরুভূমি…
স্নিগ্ধাদি বললেন, হ্যাঁ, চলে এসো, বেশ মজা হবে, আমরাও থাকব।
সন্তু বলল, শুধু আমি যেতে চাইলেই তো হবে না। কাকাবাবু অন্য একটা কাজ নিয়ে এখন ব্যস্ত আছেন।
কয়েকদিন আগে কাকাবাবু চলে গেছেন দিল্লিতে। সন্তুকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্যই করেননি। যাওয়ার দিন সত্ত্বই নিজে থেকে জিজ্ঞেস করেছিল, ককাবাবু, আমাকে নিয়ে যাবেন না?
কাকাবাবু বলেছিলেন, না রে, তুই গিয়ে কী করবি? আমি যাচ্ছি সরকারি কাজে। প্লেনে যাব, প্লেনে আসব, কোনও অসুবিধে তো নেই!
কিন্তু সন্তুর সন্দেহ হয়েছিল, দিল্লি থেকে কাকাবাবু আরও কোথাও যাবেন। সেই ফস, লম্বা বৃদ্ধ লোকটি এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় তুলে নিতে এসেছিলেন কাকাবাবুকে। সন্তুর বেশ মন খারাপ হয়েছিল।
সন্তুর আবার মন খারাপ হয়ে গেল, যখন শুনল যে, স্নিগ্ধাদির বোন রিনিও এবারে ওঁদের সঙ্গে যাবে ইজিপ্টে। রিনি সন্তুর চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট, এ-বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। সে দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। রিনি। সন্তুর আগেই ফরেন কান্ট্রিতে যাচ্ছে? সন্তু এ-পর্যন্ত বিদেশ বলতে শুধু নেপাল ঘুরে এসেছে। অবশ্য নেপালও খুব সুন্দর জায়গা। সন্তুর আবার যেতে ইচ্ছে করে।
রিনি বলল, সিদ্ধাৰ্থদা, ইজিপ্ট থেকে গ্রিস তো খুব দূরে নয়! আমাকে একবার গ্রিস ঘুরিয়ে আনবেন তো?
সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, হ্যাঁ, গ্রিস তো ঘুরে আসাই যায়। ইচ্ছে করলে আমরা রোমেও যেতে পারি। আমার রোম দেখা হয়নি।
গ্রিস, রোম, এইসব নাম শুনলে সন্তুর রোমাঞ্চ হয়। আলেকজাণ্ডার, জুলিয়াস সিজার এইসব নাম মনে পড়ে।
সন্তু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এল।
সামনে অনেকদিন ছুটি, সন্তুর আর সময়ই কাটতে চায় না। কুনাল চলে গেছে। ওর মামাবাড়ি ভাগলপুরে। বাপিও দাৰ্জিলিং যাবে–যাবে করছে। খেলাধুলো জমছে না। বাড়িতে যত বই ছিল, সবই সন্তুর পড়া, নতুন বই আর জোগাড় করা যাচ্ছে না।
কিছু একটা করতে হবে তো। একদিন দুপুরবেলা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সন্তু ঠিক করল, সে এক-একাই এবার থেকে এক-একটা রহস্য সমাধানের চেষ্টা করবে। কাকাবাবুর যদিও অনেকের সঙ্গেই চেন্নাশুনো, তবু কাকাবাবুও তো বিশেষ কারুর সাহায্য নিতে চান না।
কদিন ধরেই কাগজে একটা খবর বেরুচ্ছে। তিলজলায় একটা পুকুরে এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি ছেলে ড়ুবে গেছে। কিন্তু তাদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ জলে ড়ুবে গেলে কিছুক্ষণ বাদে তার মৃতদেহটা ভেসে উঠবেই। পুকুরটা বেশি বড় নয়। অথচ পোর্ট কমিশনার্সের পেশাদার ড়ুবুরিরাও কয়েক ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করে ছেলে দুটির কোনও চিহ্ন দেখতে পায়নি।
ছেলেদুটিকে ড়ুবে যেতে অনেকেই দেখেছে। ঘটনা দুটিই ঘটেছে বিকেলবেলা। — গরমের দিনে এই সময় অনেকেই ওই পুকুরে স্নান করতে আসে। ওই ছেলেদুটি জলে নামল, আর উঠল না, তা হলে ওরা গোল কোথায়? অনেকে বলছে, ওই পুকুরের তলায় নিশ্চয়ই গুপ্ত সুড়ঙ্গ আছে। অনেক কালের পুরনো পুকুর, সেই নবাবি আমলের। পেশাদার ড়ুবুরিরা অবশ্য কোনও সুড়ঙ্গের কথা বলেনি। এতদিন ঐ পুকুরে অনেকেই স্নান করছে, কারুর কিছু হয়নি, হঠাৎ এক সপ্তাহের মধ্যেই দুটি ছেলে অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে?
সন্তু মনে-মনে এই কেন্সটা টেক আপ করে নিল।
তিলজলা জায়গাটা কোথায়? সন্তু কোনওদিন ঐ নামের জায়গায় যায়নি, তার চেনা কেউ ওখানে থাকেও না। তিলজলা কী করে খুঁজে পাওয়া যায়? কুনাল ওর সাইকেলটা সন্তুর কাছে রেখে গেছে। ইচ্ছে করলে সন্তু এখন সাইকেলে কলকাতার যে-কোনও অঞ্চলে চলে যেতে পারে।
রাস্তার মোড়ে একটা বই-পত্রপত্রিকার স্টল আছে। সেই স্টলের মালিক গুপিদা বেশ ভালমানুষ ধরনের। সন্তু ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই এই স্টল থেকে ম্যাগাজিন, কমিক্স, গল্পের বই কেনে। গুপিদা তাকে চেনেন।
সন্তু সেই স্টল থেকে কলকাতার একটা ম্যাপ কিনে পাশের দেয়ালে মেলে ধরল। কিন্তু তাতেও সে তিলজলা খুঁজে পায় না। কী ব্যাপার, তা হলে কি তিলজলা কলকাতার মধ্যে নয়, বাইরে কোথাও?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, গুপিদা, তিলজলা জায়গাটার নাম খুঁজে পাচ্ছি না কেন?
গুপিদা বললেন, পাচ্ছি না? পিকনিক গার্ডেনস দ্যাখো, তার পাশেই পাবে।
সন্তু অবাক। পিকনিকের জন্য বাগান, সেখানে সবাই পিকনিকের জন্য যায়? সন্তু তো এরকম কোনও জায়গার নামই শোনেনি।
গুপিদা ওর হাত থেকে ম্যাপটা নিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, এই দ্যাখো, ভবানীপুর, এই হাজরা মোড়, এই হল বালিগঞ্জ ফাঁড়ি, তারপর এই বণ্ডেল রোড ধরে সোজা গেলে রেল-লাইনের লেভেল ক্রসিং পাবে, তার ওপারে.।
বেলা এখন চারটে। সঙ্গে আর কারুকে নিলে হত। বাপিকে ডাকবে? কিন্তু বাপির এইসব ব্যাপারে কোনও উৎসাহ নেই। থাক, সন্তু একাই যাবে।
সাইকেলটা না নিয়ে যাওয়াই ভাল। লোকের চোখে পড়ে যাবে। সন্তু হাঁটতে শুরু করে দিল।
বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেল সহজেই। লোককে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল বণ্ডেল রোড কোনটা। কতদিনই সন্তু একলা-একলা রাস্তা দিয়ে হাঁটে। কিন্তু আজকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। আজ সন্তু এমন একটা কাজ নিয়ে যাচ্ছে, যার কথা পৃথিবীতে আর কেউ জানে না। সন্তুর কি মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে? রাস্তার প্রায় সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে কেন?
লেভেল ক্রসিং পার হয়ে অন্য দিকে চলে এল সন্তু। যেন কলকাতা নয়, যেন অন্য একটা নতুন জায়গায় বেড়াতে এসেছে সে। যদিও জায়গাটাতে নতুনত্ব কিছু নেই, ভাঙা, ঘিঞ্জি রাস্তা, বাস আর সাইকেল-রিকশা চলছে।
খানিকদূর এগোবার পর আর-একটা সমস্যা মাথায় এল সন্তুর। কোন পুকুরে ছেলেদুটো ড়ুবে গিয়েছিল, তা কী করে বোঝা যাবে? তিলজলাতে কি একটাই পুকুর আছে? পিকনিক গার্ডেনস তার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে? কত বড় বাগান? সেখানেও নিশ্চয়ই পুকুর থাকবে! ঘটনোটা কি সেখানেই ঘটেছিল?
সন্তু একটা সাইকেল-রিকশা ডেকে উঠে পড়ল।
চালক জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?
সন্তু বলল, পিকনিক গার্ডেনে।
সাইকেল-রিকশার চালক একটু বিরক্তভাবে বলল, অ্যাঁ? এটাই তো পিকনিক গার্ডেন।
সন্তু রাস্তার চারপাশে বাড়িগুলোর দিকে তাকাল। কোনও বাগান তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পুকুর কোথায়?
সন্তুর মনে হল, ইনভেস্টিগেটর হতে গেলে আগে সব রাস্তা-টাস্তাগুলো ভাল করে চেনা দরকার। এবার থেকে সে নিয়মিত কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেডাবে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখানে একটা পুকুর আছে?
চালক বলল, একটা কেন, অনেক গণ্ডা পুকুর আছে। কোথায় যাবেন সেটা বলুন না। ঠিকানা কী?
সন্তু বলল, ঠিকানাটা মনে নেই, আমার পিসিমার বাড়ি, কাছেই একটা পুকুর আছে… ঐ যে যে-পুকুরে দুটো ছেলে ড়ুবে গেছে…
চালক আর বাক্যব্যয় না করে প্যাড়ল ঘোরাল।
একটু বাদেই বড় রাস্তা ছেড়ে সাইকেল-রিকশাটা ঢুকল একটা মাঝারি রাস্তায়। কয়েকবার ডান-দিক বী-দিক ঘুরে সেটা এসে থামল একটা পুকুরের সামনে।
চালক জিজ্ঞেস করল, এবারে চেনা লাগছে?
সন্তু বলল, হ্যাঁ, ঐ তো ঐ কোণের বাড়িটা?
ভাড়া পেয়ে সাইকেল-রিকশার চালক চলে গেল উল্টো দিকে। কোনও কারণ নেই, তবু সন্তুর বুকটা এত টিপটপ করছে। এই সেই পুকুর, যার মধ্যে রহস্যময় কিছু আছে, যে দুটো ছেলেকে টেনে নিয়েছে, আর ফিরিয়ে দেয়নি।
পুকুরটা বেশ বড়ই। কালো রঙের জল। মাঝখানটায় কিছু কচুরিপানা রয়েছে, তাতে সুন্দর হালকা-নীল রঙের ফুলও ফুটেছে। পুকুরটার তিনদিকেই বাড়ি, একটা দিক ফাঁকা। সেখানে খানিকটা ঝোপঝাড়ের মতন হয়ে আছে, তারপর খানিকটা দূরে একটা কারখানা।
সন্তু ভেবেছিল যে, এখানে অনেক লোকজন দেখতে পাবে। পুলিশ, দমকল, খবরের কাগজের ফোটোগ্রাফার…। কিন্তু কেউই নেই। খবরের কাগজ পড়লে মনে হয়, এই জায়গাটা বুঝি ভিড়ে-ভিড়াক্কার হয়ে গমগম করছে! একটা লোকও স্নান করছে না পুকুরে। রাস্তা দিয়ে দুচারজন লোক যাচ্ছে, কিন্তু কারুর কোনও কৌতূহল আছে বলেও মনে হয় না।
পুকুরটার জলের দিকে তাকিয়ে মিনিট পাঁচেক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সন্তু। কাকাবাবু হলে কী করে এই রহস্যটার সমাধান করতেন? খবরের কাগজ পড়লে মনে হয়, ড়ুবুরিরা কিছু খুঁজে পায়নি বলে পুলিশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ছেলেদুটো তো জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না!
যে-জায়গায় কোনও ঘটনা ঘটে, সে-জায়গাটা কাকাবাবু নিজের চোখে দেখতে যান সব সময়। খবরের কাগজ পড়েই তো তিনি সুন্দরবনের নদীতে খালি জাহাজটা দেখতে গিয়েছিলেন। এখানে এসে কি কাকাবাবু জলে নেমে পড়তেন? পায়ের জখমের জন্য কাকাবাবুর সাঁতার দিতে অসুবিধে হয়। তাহলে? কাকাবাবু নিশ্চয়ই সন্তুকে বলতেন জলে নামতে।
সন্তু ভাল সাঁতার জানে। কিন্তু অচেনা জায়গায় এই রকম একটা পুকুর, কালো মিশমিশে জল, এখানে নামার কথা ভাবতেই সন্তুর ভয়-ভয় করছে। কাকাবাবু সঙ্গে থাকলে কক্ষনো ভয় করে না। খোঁড়া পা নিয়ে কাকাবাবু নিজে কত সাংঘাতিক বিপদের দিকে এগিয়ে যান, শুধুমনের জোরে।
একটা লোকও এই পুকুরের জলের ধারে কাছে নেই। সবাই ভয় পেয়েছে? একটা পুকুরের জলে ভয়ংকর কী থাকতে পারে? খবরের কাগজে লিখেছে, ড়ুবুরিরা জল তোলপাড় করে কিছুই দেখতে পায়নি। কোনও গোপন সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা কোনও অদ্ভুত জন্তু লুকিয়ে আছে? : کلم
শুধু শুধু জলের দিকে তাকিয়ে থেকে কোনও লাভ নেই। ফিরে যাবে? কিছুই করা গেল না? প্রথম কেস হাতে নিয়েই সন্তু হেরে যাবে? যদিও কেউ জানে না, তবু সন্তুর লজ্জা লাগছে।
পুকুরটার চারপাশটা অন্তত একবার ঘুরে দেখা দরকার। রাস্তার ঠিক উল্টো দিকটায় যেখানে ঝোপঝাড় রয়েছে, সেখানে কি কোনও ঘাট আছে? ছেলে দুটো ড়ুব-সাঁতারে ওপারে গিয়ে ঐ ঝোপের মধ্যে যদি লুকিয়ে থাকে, তাহলে অনেকেই ভাবতে পারে ওরা ড়ুবে গিয়ে আর ওঠেনি। মজা করার জন্য ছেলেদুটো এরকম করতেও পারে।
সন্তু পুকুরের পাড় ধরে হাঁটতে লাগল। তিনদিকে তিনটে ঘাট আছে, তার মধ্যে একটা ঘাট বেশ বড়, থাক-থাক ইটের সিঁড়ি, দুপাশে বসবার জায়গা।
যে-দিকটায় ঝোপঝাড়, সেই দিকটা বেশ নোংরা। বোধহয় কারখানার লোকেরা তাদের আবর্জনা এই দিকে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলে। ভাঙা কাচ, চায়ের খুরি, ময়লা ন্যাকড়া ছড়িয়ে আছে অনেক। অনেক বড়-বড় ঘাস গজিয়ে গেছে এখানে। একটা বা দুটো ছেলে ইচ্ছে করলে অনায়াসেই এই ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে।
এই জায়গাটার মাটি থসথসে, কাদা-কাদা। চার-পাঁচদিন আগেও যদি কেউ এ-দিকটায় এসে থাকে তাহলে তার পায়ের চিহ্ন এখনও পাওয়া যাবে। একটা বেশ বড় গর্তও রয়েছে, কেউ মাটি কেটে নিয়ে গেছে। সন্তু এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণ নজর রেখে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ সে দেখতে পেল, এক জায়গায় একটা হলদে রঙের জামা পড়ে আছে। জামাটা দেখে খুব পুরনো বলে মনে হয় না। সন্তুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এখানে একটা জামা এল কী করে?
জামাটার খানিকটা রয়েছে ঝোপের মধ্যে, খানিকটা জলে ড়ুবে আছে। সন্তু পা টিপে-টিপে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে জামোটা তুলতে যেতেই এক কাণ্ড হল!
পায়ের তলার নরম মাটি ধসে গিয়ে সন্তু হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল জলে। ভাল সাঁতারু হয়েও সে ভয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। তার মনে হল, কুমিরের চেয়েও সাংঘাতিক কোনও জন্তু এক্ষুনি তাকে কামড়ে দেবে!
সে-রকম কিছুই হল না। প্রথম পড়ার ঝোঁকে সন্তু চলে গেল অনেকখানি জলের মধ্যে। পুকুরটা খুব খাড়া আর পিছল, পা রাখা যায় না। ড়ুবজলে থেকে উঠে আসবার পর দাঁড়াবার চেষ্টা করেও তার পা হড়কে যেতে লাগল বারবার। তারপর সে সাঁতরে পারের কাছে এসে এক গোছা ঘাস মুঠো করে ধরল, অমনি সেখানকার মাটিও খসে পড়ল।
কয়েকবার এরকম চেষ্টা করার পর সন্তু উঠে এল ওপরে। জামা প্যান্ট একেবারে জবজবে ভিজে, জুতো কাদায় মাখামাখি। মাথায় শ্যাওলা জড়িয়ে গেছে। জামার পকেটে দুখানা দুটাকার নোট ছিল, সে দুটি বুঝি গেছে একেবারে।
একটা গোলমাল শুনে সন্তু মুখ তুলে তাকাল। পুকুরের ওপারে রাস্তার ধারে একদল লোক জমেছে, সবাই সন্তুকেই দেখছে আর কী যেন বলাবলি করছে। তারপর তারা দৌড়ে আসতে লাগল। এদিকে।
তারা কাছাকাছি আসতেই সন্তু শুনতে পেল, কয়েকজন চেঁচিয়ে বলছে, মরা ছেলে ফিরে এসেছে! মরা ছেলে ফিরে এসেছে! সুড়ঙ্গ দিয়ে পাতালপুরীতে চলে গিয়েছিল?
এ-কথা শুনে সন্ধুর চোখ বড়-বড় হয়ে গেল। এই রে, এরা কি ভেবেছে, জলে-ডোবা দুজন ছেলের মধ্যে সে একজন? তিন-চার দিন পর কেউ জলের তলা থেকেফিরে আসতে পারে? এ কি রূপকথা নাকি?
লোকগুলো সন্তুকে ঘিরে ধরে এমন চাঁচামেচি করতে লাগল যে, সন্তু কোনও কথাই বলতে পারল না। অনেকেরই ধারণা, সন্তু ড়ুবে যাওয়া ছেলেদের একজন। কয়েকজন অবশ্য সন্দেহ প্ৰকাশ করল যে, এর পায়ে জুতো রয়েছে কেন? জুতো পরে তো কেউ সাঁতার কাটতে নামে না। তাদের বিশেষ কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। একজন বেশ গলা চড়িয়ে বলল, আমিই তো প্রথম দেখেছি, মাঝপুকুরে ভুশ করে জল ঠেলে উঠল, তারপর সাঁতরে-সাঁতরে এই দিকে চলে এল।
ক্রমশই বেশি ভিড় জমছে। মজা দেখবার জন্য পাড়ার ছোট-ছেট ছেলেমেয়েরা বাড়ির বউরাও ছুটে আসছে। কেউ বলল, ওর মুখ শুকিয়ে গেছে, ওকে দুধ খাওয়াও? কেউ বলল, পুলিশে খবর দাও; কেউ বলল, খবরের কাগজের ফোটোগ্রাফারকে ডাকে।
একজন বয়স্কমতন ভারিক্কি চেহারার লোক সন্তুর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, এই যে খোকা, তুমি সন্ধেবেলা এখানে কী করছিলে? কোথা থেকে এলে?
সন্তু উত্তর দিতে পারল না।
লোকটি বলল, মিস্টিরিয়াস ব্যাপার। তিন দিন ধরে এই পুকুরের জল কেউ ছোঁয় না, অথচ একটা ছেলে জল থেকে উঠে এল?
সন্তু এবারে কোনওক্রমে বলে উঠল, আমি পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলুম।
বয়স্ক লোকটি বিকট গলায় হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল।
শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়াল অনেক দূরী। সন্তুকে ওরা কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। পাতালপুরীতে সন্তু কী দেখেছে, তা বলবার জন্য খোঁচাতে লাগল অনেকে। এর মধ্যে এসে পড়ল পুলিশ। সন্তুকে নিয়ে চলল থানায়।
সন্তু এসেছিল গোয়েন্দাগিরি করতে, তাকে থানায় যেতে হল চোরের মতন!
থানায় বড়বাবু ভিড় হটিয়ে এক সন্তুকে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে। বড়বাবুর গায়ের রঙ খুব ফস, মাথায় অল্প-অল্প টাক, দেখলে মনে হয় সিনেমার পুলিশ। তিনি ভুরু নাচিয়ে বললেন, নাও, লেট মি হিয়ার ইওর সং! তুমি জামা-প্যান্ট-জুতো পরে পুকুরে ড়ুব দিয়েছিলে কেন? সন্তু বলল, বলছি, আগে এক গেলাস জল খাব? সন্তুর গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ। কত দুৰ্গম জায়গায় কত রকম বিপদ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে সে। কিন্তু আজ কলকাতা শহরের মধ্যেই সে যে বিপদে পড়েছে, তার সঙ্গে আগের কোনও কিছুরই তুলনা হয় না। লোকগুলো যদি তাকে মারতে শুরু করত? থানায় এসে সে অনেক নিরাপদ বোধ করছে।
জল খাবার পর সন্তু মুখ তুলতেই বড়বাবু বললেন, নাও, মই বয়, আমি সত্যি কথা শুনতে চাই, নাথিং বাট দা টুথ..
বড়বাবুর কথার মাঝখানেই সন্তু বলল, আপনি স্পেশাল আই. জি. মিঃ আর. ভট্টাচাৰ্য কিংবা ডি. আই. জি. ক্রাইম মিঃ বি, সাহাকে একবার ফোন করবেন?
কথা বলতে-বলতে থানার বড়বাবুর মুখখানা হাঁ হয়ে গেল। তিনি ভুরু নাচাতে ভুলে গেলেন।
সেই রকম অবস্থায় প্রায় এক মিনিট থেমে থেকে তিনি বললেন, কাদের নাম বললে? স্পেশাল আই. জি. কিংবা ডি. আই. জি? এদের ফোন করব কেন?
সন্তু বলল, ওঁরা দুজনেই আমার কাকাবাবুকে চেনেন। আমাকেও চেনেন। পুলিশ কমিশনারও একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।
বড়বাবু হাঁক দিলেন, বিকাশ! বিকাশ! আর-একজন পুলিশ অফিসার উঁকি মারতেই বড়বাবু বললেন, ওহে বিকাশ, এ ছেলেটি যে বড়-বড় কথা বলে! লম্বা-লম্বা পুলিশ অফিসারদের নাম করছে।
সন্তু বলল, আপনারা হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। আমার পরিচয়টা জানলে আপনাদের সুবিধে হবে। সেইজন্য আমি ওঁদের ফোন করতে বলছি।
বিকাশ নামের কালো; লম্বা চেহারার পুলিশ অফিসারটি বলল, তোমার গল্পটা কী আগে শুনি?
সন্তু বলল, ঐ পুকুরটায় নাকি দুটো ছেলে ড়ুবে গেছে, তাদের আর পাওয়া যায়নি, সেইজন্য আমি পুকুরটা দেখতে এসেছিলুম।
তারপর জামা-জুতো পরে জলে নেমে গেলে?
ইচ্ছে করে নামিনি। পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলুম।
বড়বাবু বললেন, তা তো হতেই পারে। পা পিছলে কি কেউ জলে পড়ে যেতে পারে না?
বিকাশ বলল, স্যার, বাইরে অনেক লোক ভিড় জমিয়ে আছে। হৈ-হাল্লা করছে। তারা এত সহজ গল্প বিশ্বাস করবে না।
বড়বাবু রেগে উঠে বললেন, তাদের জন্যে কি রোমহর্ষক গল্প বানাতে হবে? মহা মুশকিল! এ-ছেলেটি বড় বড় পুলিশ অফিসারদের নাম করছে, যদি সত্যিই তাঁদের সঙ্গে চেনা থাকে? ফোন করো! ফোন করে। ওহে খোকা, কী নাম তোমার?
সন্তু বলল, আমার কাকার নাম রাজা রায়চৌধুরী। তাঁর নাম বলুন। আমাকে সন্তু নামে উনি চিনবেন।
ফোনে ঐ দুজনের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বড়বাবুর মুখের চেহারাটাই বদলে যেতে লাগল। চোখ দুটো হল গোল-গোল আর ভুরুদুটো উঠে গেল অনেকখানি।
তিনি বলতে লাগলেন, অ্যাঁ? কী বলছেন স্যার? বিখ্যাত? অ্যাডভেঞ্চার করে? ওদের নিয়ে বই লেখা হয়েছে? না স্যার, আমি বই-টই বিশেষ পড়ি না, বই পড়ার সময় পাব। কখন! হ্যাঁ। ছেলেটি আমার সামনেই বসে আছে…আপনাকে দেব, কথা বলবেন?
স্পেশাল আই. জি. সাহেব টেলিফোনে হাসতে-হাসতে বললেন, কী হে সন্তু, তিলজলার পুকুরে ড়ুব দিতে গিয়েছিলে কেন? ওখানে কি গুপ্তধন আছে নাকি?
সন্তু লাজুকভাবে বলল, না, মানে এমনিই। পুকুরের ধার দিয়ে হাঁটছিলুম, হঠাৎ পা পিছলে.
হঠাৎ ঐ পুকুরটার ধার দিয়েই বা হাঁটতে গেলে কেন? তুমি কি এক-একই গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ নাকি?
না, এমনিই বেড়াতে এসেছিলুম। এদিকে…
এরপর বড়বাবু থেকে শুরু করে থানার সমস্ত লোক দারুণ খাতির করতে লাগল সন্তুকে। বাইরের ভিড় হটিয়ে দেওয়া হল। সন্দেশ-রসগোল্লা-শিঙাড়া এসে গেল সন্তুর জন্য। সন্তু খেতে চায় না, তবু ওঁরা ছাড়বেন না।
তারপর পুলিশের গাড়ি সন্তুকে পৌঁছে দিয়ে এল তাদের বাড়ির কাছাকাছি।
সন্তুর মনটা তবু খুব খারাপ হয়ে রইল। লজ্জাও করছে খুব। প্রথমবারেই এরকম ব্যর্থতা। ছিছিছি।
বাড়িতে পৌঁছেই সন্তু দেখল। একজন অপরিচিত লোক বসে আছেন তাদের বসবার ঘরে। বাবা তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন।
ভিজে জাম-কাপড় যাতে কেউ দেখতে না পায় তাই সন্তু পাশের বারান্দা দিয়ে সুট করে উঠে যাচ্ছিল ওপরে, পায়ের আওয়াজ পেয়ে বাবা হাঁক দিয়ে বললেন, কে রে? সন্তু নাকি? এদিকে আয়…শুনে যা !
আসছি, বলেই সন্তু এক দৌড়ে চলে গেল ওপরে। তাড়াতাড়ি জামা-প্যান্ট বদলে আবার নীচে নেমে এল।
বাবা বললেন, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? এই ভদ্রলোক তোর জন্য কখন থেকে বসে আছেন! দ্যাখ, রাজা তোর নামে চিঠি পাঠিয়েছে।
সন্তু তাড়াতাড়ি কাকাবাবুর চিঠিটা নিয়ে খুলল। চিঠিটা এসেছে দিল্লি থেকে। কাকাবাবু লিখেছেন :
স্নেহের সন্তু, একটা কাজের জন্য দিল্লি এসেছিলাম / দুচারদিনের মধ্যেই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরশু থেকে খুব জ্বরে পড়ে গেছি। বেশ কাবু করে। দিয়েছে। এ কাজটা শেষ না করে ফিরে যেতে চাই না। ভেবেছিলাম। এবার তোর সাহায্যের কোনও দরকার হবে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, তোকে সঙ্গে আনাই উচিত ছিল। দিন দশোকের জন্য কলকাতা ছেড়ে এলে কি তোর পড়াশুনোর ক্ষতি হবে? দাদা আর বৌদিকে জিজ্ঞেস করবি / যদি কোনও অসুবিধে না থাকে, তাহলে আগামীকালই চলে আসতে হবে। যে ভদ্রলোকের হতে চিঠি পাঠাচ্ছি। তিনিই প্লেনের টিকিট পৌঁছে দেবেন। দিল্লি এয়ারপোর্টে তোকে রিসিভ করার জন্য লোক থাকবে। দাদাকেও আলাদা চিঠি দিলাম / ইতি
কাকাবাবু
পুনশ্চ : তোর একটা পাসপোর্ট করানো হয়েছিল, মনে আছে? সেটা সঙ্গে নিয়ে আসবি।
চিঠিটা পড়তে পড়তেই সন্তু আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। এতক্ষণের মনখারাপ আর লজ্জা এক নিমেষে কোথাও উধাও হয়ে গেল।
বাবার দিকে তাকাতেই বাবা বললেন, হ্যাঁ, চলে যা! অসুখে পড়েছে, এক-একা আছে! কী অসুখ সে-কথাও লেখেনি।
আগন্তুকটি বললেন, আমি তাহলে টিকিটের ব্যবস্থা করে রাখছি। কাল বিকেলের ফ্লাইটে…
ওপরে এসে সন্তু কাকাবাবুর চিঠিখানা যে কতবার পড়ল তার ঠিক নেই। অতি সাধারণ চিঠি, তবু দুটো জিনিস বোঝা গেল না। কাকাবাবু কোন কাজে দিল্লি গেছেন? আর পাসপোর্ট নেবার কথা লিখলেন কেন? দিল্লি যেতে তো পাসপোর্ট লাগে না।