মাতালের গল্প
প্রায় অনুরূপ নামে আমার যে অতিচপল, অতিতরল গল্পগুচ্ছ রয়েছে, সেই গ্রন্থের পাঠকেরা অবশ্যই আশঙ্কা করতে পারেন, আমি হয়তো আবার সেই একই গল্প করতে বসেছি।
তাঁদের অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। আমার স্বভাবচরিত্র তাঁরা ভালভাবেই জানেন। চুরি করতে করতে আমার এমন স্বভাব হয়ে গেছে যে, আজকাল আমি নিজের লেখা থেকে পর্যন্ত চুরি করছি।
যাই হোক, আশ্বাস দিচ্ছি, নামে এক হলেও এবারে আর নিজের লেখা বা অন্য কারও রচনা থেকে চুরি নয়, সরাসরি সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা থেকে। তদুপরি মোটেই হাসির গল্প নয়, করুণ কাহিনী, ওই যাকে বলে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’।
অবশ্য প্রথম আখ্যানটি করুণ কিনা বলা কঠিন। ঘটনাটি দৈনিক কাগজের পৃষ্ঠা হয়ে কলকাতার লোকদের মুখে মুখে ফিরেছে গত পক্ষে।
কলকাতার ময়দানে কৈশোরে বা প্রথম যৌবনে ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচ লাইন দিয়ে টিকিট কেটে দেখেনি, এ-শহরে এমন লোক বিরল। এবং এই সৌভাগ্যবানেদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যিনি জীবনে টিকিটের লাইনে বা প্রবেশপথের মুখে দাঁড়িয়ে কারণে কিংবা অকারণে কলকাতার প্রবাদপ্রসিদ্ধ মাউন্ট পুলিশদের হাতে এবং তাদের ঘোড়াদের পায়ে লাঞ্ছিত হননি।
ময়দানের শেষ প্রান্ত মানে উত্তর সীমানা থেকে সোজা রাস্তা এসে পড়েছে চৌরঙ্গিতে। চৌরঙ্গির আগে ময়দান এলাকায় সেই রাস্তার নাম রানি রাসমণি রোড। সেই রাসমণিকে জানবাজারে তাঁর নিজের বাড়িতে যেতে হলে যেতে হবে সুরেন ব্যানার্জি রোড দিয়ে। এই সুরেন ব্যানার্জি রোডে প্রথমে একটু এগিয়ে কলকাতা পুরসভার বিপরীতে এলিট সিনেমার পাশে মাউন্ট পুলিশের অর্থাৎ ঘোড়সওয়ার পুলিশের সদর দপ্তর।
এই সদর দপ্তরের চারপাশেই মানে জানবাজার, মেট্রো গলি, নিউ মার্কেট, ধর্মতলা ইত্যাদি স্থানে প্রচুর নেশার রসদ, পানীয়ের ঠেক। সুতরাং কোনও মধ্যরাতে, কোনও ঘোড়সওয়ার সেপাই সারাদিন ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করার পর এই পরিবেশে যদি কিঞ্চিৎ নেশাগ্রস্ত হয়ে চুরচুর মেজাজে একটির পর একটি আস্তাবলবদ্ধ ঘোড়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়ে যান, তাতে আশ্চর্য না হলেও চলবে।
সেদিন মধ্য রজনীতে নগরীর রাজপথে এক অপূর্ব দৃশ্য। একের পর এক আস্তাবল-মুক্ত, লাগামহীন ঘোড়া দুলকি চালে ময়দানের দিকে চলেছে। জন্মাবধি ওই একটি রাস্তাই তারা চেনে। ময়দানেই তাদের গতিবিধি। সেই দিকেই তারা যাত্রা করেছে।
গ্রীষ্মরজনীর শুক্লা ত্রয়োদশীর চাঁদের আলোয় সেইদিন সে এক অনৈসর্গিক, অভূতপূর্ব দৃশ্য কলকাতার প্রাচীন রাস্তায়। এই সময়ে রসভঙ্গ ঘটেছিল এক দায়িত্ববান কর্মীর অনুপ্রবেশে। ইনি লক্ষ করেন যে, শূন্যপৃষ্ঠ মুক্ত অশ্বগুলি ময়দানগামী হয়েছে। ইনি এদের প্রত্যেকের নাম জানেন এবং শিক্ষিত অশ্ববৃন্দ নিজেরাও নিজেদের আলাদা নাম সম্বন্ধে সচেতন। সুতরাং পিছন থেকে উচ্চস্বরে তাদের নাম ধরে ডাকামাত্র তারা কান উঁচু করে সেই ডাক শুনে, একটি করুণ হ্রেষাধ্বনি করে মুখ ঘুরিয়ে আবার গুটিগুটি নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল।
এই কাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি করুণ দুর্গাপুরের মাতালদের কাহিনী। খুব সংক্ষেপে সেটি বলব। কারণ, করুণা আমার বিষয় নয়।
দুর্গাপুর-আসানসোল অঞ্চলের একটি স্থানীয় বিবাহে একটি ভাড়াটে বাসে বরযাত্রীরা বিবাহসভায় যাচ্ছিল। এর মধ্যে একদল মদের হাঁড়ি নিয়ে উঠেছিল বাসের ছাদে। মদ্যপান, সেই সঙ্গে গান, তারপরে চলন্ত বাসের ছাদে যূথবদ্ধ নাচ। বাসের চালক নাকি দু’বার গাড়ি থামিয়ে এদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। কিন্তু ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। মাতাল না শোনে বিপদের বাণী।’
নৃত্যগীত চমৎকার চলছিল এবং চলত, যদি না রাস্তার ওপরে একটা রেলওয়ে ব্রিজ বাধা হয়ে দাঁড়াত। আর, বাধা মানে বিশাল বাধা। চলন্ত বাসের ওপর থেকে ব্রিজে ধাক্কা খেয়ে নর্তকেরা ছিটকে পড়লেন চারদিকে। বেশ কয়েকজন মৃত, বাকিরা জীবন্মৃত।
এই করুণ কাহিনীর পরে এবার একটু হালকা গল্প বলি। রসিকতা দিয়েই শেষ করি।
আলোচ্য বিষয়টি একটি কথোপকথন, পানশালায় জনান্তিকে শোনা।
একটি টেবিলে দু’জন মুখোমুখি বসে মদ্যপান করছেন, দু’জনেই অনেকক্ষণ ধরে পান করছেন, এখন প্রায় রাত এগারোটা বাজে। এই দু’জনের মধ্যে একজন শ্রীযুক্ত কখ অবিবাহিত, দ্বিতীয়জন শ্রীযুক্ত গঘ বিবাহিত, মাত্র বছরখানেক আগে বিয়ে করেছেন।
শ্রীযুক্ত কখ: দাদা, বাড়ি চলুন। অনেক রাত হল।
শ্ৰীযুক্ত গঘ: আরেকটু বসো।
শ্রীযুক্ত কখ: দাদা, এই যে আপনি এত দেরি করে বাড়ি ফেরেন, বউদি আপনাকে মিস করেন না ।
শ্ৰীযুক্ত গঘ: কদাচিৎ।
শ্ৰীযুক্ত কখ: কদাচিৎ?
শ্ৰীযুক্ত গঘ: হ্যাঁ, ভাই। তোমাদের বউদিদির হাতের টিপ অসামান্য। স্কুলে ভাল বাস্কেটবল খেলতেন। লক্ষ্য অব্যর্থ। হাতা, খুন্তি, ফুলদানি, জুতো, বই— যা কিছু ছুড়ে মারেন, একেবারে অব্যর্থ। কখনও কদাচিৎ আমাকে মিস করেন।