Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মাকড়সার রস – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 2

মাকড়সার রস – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay


ব্যোমকেশকে অনেক জটিল রহস্যের মর্মোদ্ঘাটন করিতে দেখিয়াছি ও তাহাতে সাহায্য করিয়াছি। তাহার অনুসন্ধান পদ্ধতিও এতদিন একসঙ্গে থাকিয়া অনেকটা আয়ত্ত হইয়াছে। তাই মনে মনে ভাবিলাম, এই সামান্য ব্যাপারের কিনারা করিতে পারিব না? বিশেষ, আমার প্রতি মোহনের বিশ্বাসের অভাব দেখিয়া ভিতরে ভিতরে একটা জিদও চাপিয়াছিল, যেমন করিয়া পারি এ ব্যাপারের নিষ্পত্তি করিব।
মনে মনে এইরূপ সঙ্কল্প আঁটিয়া মোহনের সহিত লেক হইতে বাহির হইলাম। বাস আরোহণে যখন নির্দিষ্ট স্থানের নিকট উপস্থিত হইলাম তখন সন্ধ্যা উর্ত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে–রাস্তার গ্যাস জ্বলিয়া উঠিতেছে। মোহন পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল। সার্কুলার রোড হইতে একটা গলি ধরিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইবার পর সম্মুখে একটা লোহার রেলিংযুক্ত বড় বাড়ি দেখাইয়া মোহন বলিল–“এই বাড়ি।”
দেখিলাম সেকেলে ধরনের পুরাতন বাড়ি, সম্মুখে লোহার ফটকে টুল পাতিয়া দারোয়ান বসিয়া আছে। মোহনকে দেখিয়া সেলাম করিয়া পথ ছাড়িয়া দিল, কিন্তু আমার প্রতি সন্দিগ্ধ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল–“বাবুজি, আপকো ভিতর যানা–”
মোহন হাসিয়া বলিল–“ভয় নেই দারোয়ান, উনি আমার বন্ধু।”
“বহুত খুব”–দারোয়ান সরিয়া দাঁড়াইল; আমরা বাড়ির সম্মুখস্থ অঙ্গনে প্রবেশ করিলাম। অঙ্গন পার হইয়া বারান্দায় উঠিতেই ভিতর হইতে একটা বিশ-বাইশ বছরের যুবক বাহির হইয়া আসিল–“কে, ডাক্তারবাবু? আসুন।” আমার দিকে সপ্রশ্ন নেত্রে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“ইনি–?”
মোহন তাহাকে একটু তফাতে লইয়া গিয়া নিম্নকণ্ঠে কি বলিল, যুবকও উত্তর দিল–“বেশ তো, বেশ তো, উনি আসুন না–”
মোহন তখন পরিচয় করাইয়া দিল–গৃহস্বামীর জ্যোষ্ঠপুত্র, নাম অরুণ। তাহার অনুবর্তী হইয়া আমরা বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম। দুইটা ঘর অতিক্রম করিয়া তৃতীয় ঘরের বন্ধ দরজায় করাঘাত করিতেই ভিতর হইতে একটা কহল-তীক্ষ্ণ ভাঙা কণ্ঠস্বর শুনা গেল–“কে? কে তুমি? এখন আমায় বিরক্ত করো না, আমি লিখছি।”
অরুণ বলিল–“বাবা, ডাক্তারবাবু এসেছেন। অভয়, দোর খোল।” একটি আঠারো-উনিশ বছর বয়সের যুবক–বোধহয় গৃহস্বামীর দ্বিতীয় পুত্র–দ্বার খুলিয়া দিল। আমরা সকলে ঘরে প্রবেশ করিলাম।
অরুণ চুপিচুপি অভয়কে জিজ্ঞাসা করিল–“খেয়েছেন?”
অভয় ম্লানভাবে ঘাড় নাড়িল।
ঘরে ঢুকিয়াই প্রথমে দৃষ্টি পড়িল, ঘরের মধ্যস্থলে ঘাটের উপর বিছানা পাতা রহিয়াছে এবং সেই বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়া বসিয়া, ডান হাতে উত্থিত কলম ধরিয়া, অতি শীর্ণকায় নন্দদুলালবাবু ক্রুদ্ধ কষায়িত নেত্রে আমাদের দিকে চাহিয়া আছেন। মাথার উপর উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো জ্বলিতেছিল, আর একটা টেবিল-ল্যাম্প ঘাটের ধারে উঁচু টিপাইয়ের উপর রাখা ছিল; তাই লোকটির সমস্ত অবয়ব ভাল করিয়া দেখিতে পাইলাম। তাঁহার বয়স বোধ করি পঞ্চাশের নীচেই কিন্তু মাথার চুল সমস্ত পাকিয়া একটা শ্রীহীন পাঁশুটে বর্ণ ধারণ করিয়াছে। হাড় চওড়া, ধারালো মুখে মাংসের লেশমাত্র নাই, হনুর অস্থি দু’টা যেন চর্ম ভেদ করিয়া বাহির হইয়াবার উপক্রম করিতেছে–পাৎলা দ্বিধা-ভগ্ন নাকটা মুখের উপর গৃধ্রের মত ঝুলিয়া পড়িয়াছে। চোখ দু’টা কোনো অস্বাভাবিক উত্তেজনার ফলে অত্যন্তু উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু উত্তেজনার অবসানে আবার যে তাহারা মৎস্যচক্ষুর মত ভাবলেশহীন হইয়া পড়িবে তাহার আভাসও সে-চক্ষে লুক্কায়িত আছে। নিম্নের ঠোঁট শিথিল হইয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সব মিলিয়া মুখের উপর একটা কদাকার ক্ষুধিত অসন্তোষ যেন রেখায় রেখায় চিহ্নিত হইয়া আছে।
কিছুক্ষণ এই প্রেতাকৃতি লোকটির দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া থাকিয়া দেখিলাম, তাঁহার বাঁ হাতটা থাকিয়া থাকিয়া অকারণে আনর্তিত হইয়া উঠিতেছে, যেন সেটা স্বাধীনভাবে, দেহ হইতে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হইয়া নৃত্য শুরু করিয়া দিয়াছে। মৃত ব্যাঙের দেহ তড়িৎ সংস্পর্শে চমকাইয়া উঠিতে যাঁহারা দেখিয়াছে, তাঁহারা এই স্নায়ু-নৃত্য কতকটা আন্দাজ করিতে পারিবেন।
নন্দদুলালবাবুও বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাইয়া ছিলেন, সেই ভাঙা অথচ তীব্র স্বরে বলিয়া উঠিলেন–‘ডাক্তার! এ আবার কাকে নিয়ে এসেছ এখানে? কি চায় লোকটা? যেতে বল–যেতে বল–”
মোহন চোখের একটা ইশারা করিয়া আমাকে জানাইলা যে আমি যেন গৃহস্বামীর এরূপ সম্ভাষণে কিছু মনে না করি; তারপর শয্যার উপর হইতে বিক্ষিপ্ত কাগজগুলো সরাইয়া শয্যাপার্শ্বে রাখিয়া রোগীর নাড়ি হাতে লইয়া স্থির হইয়া দেখিতে লাগিল। নন্দদুলালবাবু মুখে একটা বিকৃত হাস্য লইয়া একবার আমার পানে একবার ডাক্তারের পানে তাকাইতে লাগিলেন। বাঁ হাতটা তেমনি নৃত্য করিতে লাগিল।
শেষে হাত ছাড়িয়া দিয়া মোহন বলিল–“আবার খেয়েছেন?”
“বেশ করেছি খেয়েছে–কার বাবার কি?”
মোহন অধর দংশন করিল, তারপর বলিল–“এতে নিজেরই কেবল ক্ষতি করছেন। আর কারু নয়। কিন্তু সে তো আপনি বুঝবেন না, বোঝবার ক্ষমতাই নেই। ঐ বিষ খেয়ে খেয়ে মস্তিষ্কের দফা রফা করে ফেলেছেন।”
নন্দদুলালবাবু মুখের একটা পৈশাচিক বিকৃতি করিয়া বলিলেন–“তাই নাকি এয়ার? মস্তিষ্কের দফা রফা করে ফেলেছি? কিন্তু তোমার ঘটে তো অনেক বুদ্ধি আছে? তবে ধরতে পারছ না কেন? বলি, চারিদিকে তো সেপাই বসিয়ে দিয়েছ–কই, ধরতে পারলে না?” বলিয়া হি হি করিয়া এক অশ্রাব্য হাসি হাসিতে লাগিলেন।
মোহন বিরক্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–“আপনার সঙ্গে কথা কওয়াই ঝকমারি। যা করছিলেন করুন।”
নন্দদুলালবাবু পূর্ববৎ হি-হি করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন–“দুয়ো ডাক্তার, দুয়ো। আমায় ধরতে পারলে না, ধিনতা ধিনা পাকা নোনা–” সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠ তুলিয়া নাড়িতে লাগিলেন।
নিজের পুত্রদের সম্মুখে এই কদর্য অসভ্যতা আমার অসহ্য বোধ হইতে লাগিল; মোহনেরও বোধ করি ধৈর্যের বন্ধন ছিঁড়িবার উপক্রম করিতেছিল, সে আমাকে বলিল–“নাও অজিত, কি দেখবে দেখেশুনে নাও–আর পারা যায় না।”
হঠাৎ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আস্ফালন থামাইয়া নন্দদুলালবাবু দুই সর্প-চক্ষু আমার দিকে ফিরাইয়া কটুকণ্ঠে কহিলেন–“কে হে তুমি–আমার বাড়িতে কোন্‌ মতলবে ঢুকেছ?” আমি কোন জবাব দিলাম না, তখন–“চালাকি করবার আর জায়গা পাওনি? ওসব ফন্দি ফিকির এখানে চলবে না যাদু–বুঝেছ? এইবেলা চটপট সড়ে পড়, নইল পুলিস ডাকব। যত নচ্ছার ছিঁচকে চোরের দল।” বলিয়া মোহনকেও নিজের দৃষ্টির মধ্যে সাপটাইয়া লইলেন। সে আমাকে কি উদ্দেশ্যে আনিয়াছে ঠিক না বুঝিলেও আমার উপর তাঁহার ঘোর সন্দেহ জন্মিয়াছিল।
অরুণ লজ্জিতভাবে আমার কানে কানে বলিল–“ওঁর কথায় কান দেবেন না। ওটা খেলে ওঁর আর জ্ঞান বুদ্ধি থাকে না।”
মনে মনে ভাবিলাম, কি ভয়ঙ্কর এই বিষ যাহা মানুষের সমস্ত গোপন দুষ্প্রবৃত্তিকে এমন উগ্র প্রকট করিয়া তোলে! যে ব্যক্তি জানিয়া শুনিয়া ইহা খায় তাহার নৈতিক অধোগতির মাত্রাই বা কে নিরূপণ করিবে?
ব্যোমকেশ বলিয়াছিল সব দিক ভাল করিয়া লক্ষ্য করিতে, তাই যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘরের চতুর্দিক ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিয়া লইলাম। ঘরটা বেশ বড়, আসবাবপত্রও অধিক নাই–একটা খাট, গোটা দুই দিন চেয়ার, একটা আলমারি ও একটা তেপায়া টেবিল। এই টেবিলের উপর ল্যাম্পটা রাখা আছে এবং তাহারি পাশে কয়েক দিস্তা অলিখিত কাগজ ও অন্যান্য লেখার সরঞ্জাম রহিয়াছে। লিখিত কাগজপত্রগুলো অবিন্যস্তভাবে চারিদিকে ছড়ানো। আমি একটা কাগজ তুলিয়া লইয়া কয়েক ছত্র পড়িয়াই শিহরিয়া রাখিয়া দিলাম;–মোহন যাহা বলিয়াছিল তাহা সত্য। এ লেখা পড়িলে ফরাসী বস্তুতান্ত্রিক এমিল জোলারও বোধ করি গা ঘিন্‌ ঘিন্‌ করিত। শুধু তাই নয়, লেখার বিশেষ রসালো স্থলগুলিতে লাল কালির দাগ দিয়ে লেখক মহাশয় সেইদিকে দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন। বস্তুত, এতখানি নোংরা জঘন্য মনের পরিচয় আর কোথাও পাইয়াছি বলিয়া স্মরণ হইল না।
নন্দদুলালবাবুর দিকে একটা ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, তিনি আবার লেখায় মন দিয়াছেন। পার্কারের কলম দ্রুতবেগে কাগজের উপর সঞ্চরণ করিয়া চলিয়াছে, পাশের টেবিলে দোয়াতদানিতে আর একটা মেটে লাল রঙের পার্কারের ফাউণ্টেন পেন রাখা আছে, লেখা শেষ হইলেই বোধ করি দাগ দেওয়া আরম্ভ হইবে।
হইলও তাই। পাতাটা শেষ হইতেই নন্দদুলালবাবু কালো কলম রাখিয়া লাল কলমটা তুলিয়া লইলেন। আঁচড় কাটিয়া দেখিলেন, কালি ফুরাইয়া গিয়াছে–তখন টেবিলের উপর হইতে লাল কালির চ্যাপ্টা শিশি লইয়া তাহাতে কালি ভরিলেন, তারপর গম্ভীরভাবে নিজের লেখার মণিমুক্তাগুলি চিহ্নিত করিতে লাগিলেন।
আমি মুখ ফিরাইয়া লইয়া ঘরের অন্যান্য জিনিস দেখিতে লাগিলাম। আলমারিটাতে কিছু ছিল না, শুধু কতকগুলো অর্ধেক ঔষধের শিশি পড়িয়াছিল। মোহন বলিল, সেগুলো তাহারই প্রদত্ত ঔষধ। ঘরে দু’টি জানালা, দু’টি দরজা। একটি দরজা দিয়া আমরা প্রবেশ করিয়াছিলাম, অন্যটি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, ওদিকে স্নানের ঘর ইত্যাদি আছে। সে ঘরটাও দেখিলাম; বিশেষ কিছু নাই, কয়েকতা কাচা কাপড় তোয়ালে তেল সাবান মাজন ইত্যাদি রহিয়াছে।
জানাল দু’টা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া জানা গেল, বাহিরের সহিত উহাদের কোনো যোগ নাই, তাছাড়া অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে। ব্যোমকেশ থাকিলে কি ভাবে অনুসন্ধান করিত তাহা কল্পনা করিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু কিছুই ভাবিয়া পাইলাম না। দেয়ালে টোকা মারিয়া দেখিব কি না ভাবিতেছি–হয়তো কোথাও গুপ্ত দরজা আছে–এমন সময় চোখে পড়িল দেয়ালে একটা তাকের উপর একটা চাঁদির আরতদানি রহিয়াছে। সাগ্রহে সেটাকে পরীক্ষা করিলাম; তাহার মধ্যে খানিকটা তুলা ও খোপে খোপে আতর রহিয়াছে। চুপি চুপি অরুণকে জিজ্ঞাসা করিলাম–“উনি আরত মাখেন নাকি?”
সে অনিশ্চতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল–“কি জানি। বোধহয় না; মাখলে তো গন্ধ পাওয়া যেত।”
“এটা কতদিন এঘরে আছে?”
তা বরাবরই আছে। বাবাই ওটা আনিতে ঘরে রেখেছিলেন।”
ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম, লেখা বন্ধ করিয়া নন্দদুলালবাবু এই দিকেই তাকাইয়া আছেন। মন উত্তেজিত হইয়া উঠিল; খানিকটা তুলা আতরে ভিজাইয়া পকেটে পরিয়া লইলাম।
তারপর ঘরের চারিদিকে একবার শেষ দৃষ্টিপাত করিয়া বাহির হইয়া আসিলাম। নন্দদুলালবাবুর দৃষ্টি আমাকে অনুসরণ করিল; দেখিলাম তাঁহার মুখে সেই শ্লেষপূর্ণ কদর্য হাসিটা লাগিয়া আছে।
বাহিরে আসিয়া আমরা বারান্দায় বসিলাম। আমি বলিলাম–“এখন আপনাদের কয়েকটা প্রশ্ন করিতে চাই, কোনো কথা গোপন না করে উত্তর দেবেন।”
অরুণ বলিল–“বেশ, জিজ্ঞাসা করুন।”
আমি বলিলাম–“আপনারা ওঁকে সর্বদা নজরবন্দীতে রেখেছেন? কে কে পাহারা দেয়?”
“আমি, অভয় আর মা পালা করে ওঁর কাছে থাকি। চাকর-বাকর বা অন্য কাউকে কাছে যেতে দিই না।”
“ওঁকে কখনও ও জিনিস খেতে দেখেছেন?”
“না–মুখে দিতে দেখিনি। তবে খেয়েছেন তা জানতে পেরেছি।”
“জিনিসটার চেহারা কি রকম কেউ দেখেছেন?”
“যখন প্রকাশ্যে খেতেন তখন দেখেছিলুম–জলের মত জিনিস, হোমিওপ্যাথিক শিশিতে থাকত; তাই কয়েক ফোঁটা সরবৎ কিম্বা অন্য কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে খেতেন।”
“সে রকম শিশি ঘরে কোথাও নেই–ঠিক জানেন?”
“ঠিক জানি। আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।”
“তাহলে নিশ্চয় বাইরে থেকে আসে। কে আনে?”
অরুণ মাথা নাড়িল–“জানি না।”
“আপনারা তিনজন ছাড়া আর কেউ ও-ঘরে ঢোকে না? ভাল করে ভেবে দেখুন।”
“না–কেউ না। এক ডাক্তারবাবু ছাড়া।”
আমার জেরা ফুরাইয়া গেল–আর কি জিজ্ঞাসা করিব? গালে হাত দিয়া ভাবিতে ভাবিতে ব্যোমকেশের উপদেশ স্মরণ হইল; পুনশ্চ আরম্ভ করিলাম–“ওঁর কাছে কোনো চিঠিপত্র আসে?”
“না।”
“কোনো পার্সেল কি অন্য রকম কিছু?”
এইবার অরুণ বলিল–“হ্যাঁ–হপ্তায় একখানা করে রেজিস্ট্রি চিঠি আসে।”
আমি উৎসাহে লাফাইয়া উঠিলাম–“কোথেকে আসে? কে পাঠায়?”
লজ্জায় ঘাড় নীচু করিয়া অরুণ আস্তে আস্তে বলিল–“কলকাতা থেকেই আসে–রেবেকা লাইট নামে একজন স্ত্রীলোক পাঠায়।”
আমি বলিলাম–“হুঁ–বুঝেছি। চিঠিতে কি থাকে আপনারা দেখেছেন কি?”
“দেখেছি।” বলিয়া অরুণ মোহনের পানে তাকাইল।
আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম–“কি থাকে?”
“সাদা কাগজ।”
“সাদা কাগজ?”
“হ্যাঁ–খালি কতকগুলো সাদা কাগজ খামের মধ্যে পোরা থাকে–আর কিছু না।”
আমি হতবুদ্ধির মত প্রতিধ্বনি করিলাম–“আর কিছু না?”
“না।”
কিছুক্ষণ নির্বাক হইয়া তাকাইয়া রহিলাম; শেষে বলিলাম–“ঠিক জানেন খামের ভিতর আর কিছু থাকে না?”
অরুণ একটু হাসিয় বলিল–“ঠিক জানি। বাবা নিজে পিওনের সামনে রসিদ দস্তখত করে চিঠি নেন বটে কিন্তু আগে আমিই চিঠি খুলি। তাতে সাদা কাগজ ছাড়া আর কিছুই থাকে না।”
“প্রত্যেক বার আপনিই চিঠি খোলেন? কোথায় খোলেন?”
“বাবার ঘরে। সেইখানেই পিওন চিঠি নিয়ে যায় কিনা।”
“কিন্তু এ তো ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! সাদা কাগজ রেজিস্ট্রি করে পাঠাবার মানে কি?”
মাথা নাড়িয়া অরুণ বলিল–“জানি না।”
আরো কিছুক্ষণ বোকার মত বসিয়া থাকিয়া শেষে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া পড়িলাম। রেজিস্ট্রি চিঠির কথা শুনিয়া মনে আশা হইয়াছিল, যে ফন্দিটা বুঝি ধরিয়া ফেলিয়াছি–কিন্তু না, ওদিকের দরজায় একেবারে তালা লাগানো। বুঝিলাম, আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপার সামান্য ঠেকিলেও আমার বুদ্ধিতে কুলাইবে না। ‘তুলা শুনিতে নরম কিন্তু ধুনিতে লবেজান।’ ঐ বিষজর্জরিতদেহ অকালপঙ্গু বুড়া লম্পটকে আঁটিয়া ওঠা আমার কর্ম নয়–এখানে ব্যোমকেশের সেই শানিত ঝক্‌ঝকে মস্তিষ্কটি দরকার।
মলিন মুখে, ব্যোমকেশকে সকল কথা জানাইব বলিয়া বাহির হইতেছে, একটা কথা স্মরণ হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম–“নন্দদুলালবাবু কাউকে চিঠিপত্র লেখেন?”
অরুণ বলিল–“না, তবে মাসে মাসে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠান।”
“কাকে পাঠান?”
লজ্জাম্লান মুখে অরুণ বলিল–“ঐ ইহুদি স্ত্রীলোকটাকে।”
মোহন ব্যাখ্যা করিয়া বলিল–“ঐ স্ত্রীলোকটা আগে নন্দদুলালবাবুর–”
“বুঝেছি। কত টাকা পাঠান?”
“এক শ টাকা। কিন্তু কেন পাঠান তা বলতে পারি না।”
মনে মনে ভাবিলাম–পেনশন। কিন্তু মুখে সে-কথা না বলিয়া একাকী বাহির হইয়া পড়িলাম। মোহন রহিয়া গেল।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress