মাকড়সা
বাঙালির আনন্দের উৎসব দুর্গা পুজো। মহালয়ার পরেই দুর্গা পুজো।তিতলি
নতুন জামা নিয়ে ঠাকুমার কাছে রোজই একটা
করে পরে দেখে বলে কোনটা কোনদিন পরবে,
মিলিয়ে পুঁথির মালা চুরি সব গুছিয়ে রাখে।
ঠাকুমার কাছে নানা গল্প শুনতে ভালবাসে।ঠাকুমার সাথে বসে ভোরবেলা
মহালয়ার দিনে টিভিতে দুর্গতিনাশিনী দেখে।
কৌতূহলী ১২ বছরের তিতলি বুঝতে পারে না কেন মা দুর্গা দশহাতে দশ অস্ত্র নিয়ে থাকেন? সে কথা ঠাকুমার কাছে জানতে চায়।মা দুর্গার আসার আনন্দে মাতোয়ারা সকলেই। কাশ ও শিউলি ফুলে সেজে ওঠে চারিদিক। বাজিয়ে ঢাক ও কাঁসর ধ্বনির আওয়াজে প্রান প্রতিষ্ঠা হয় মা দুর্গার। মৃন্ময়ী মা ধীরে ধীরে চিন্ময়ী রূপ ধারণ করেন। মায়ের দশ হাতে শোভা পায় দশটি অস্ত্র। ঠকুমা বলেন শঙ্খ, সাপ, তীর-ধনুক, ত্রিশূল, চক্র, পদ্ম,খড়্গ, অশনি,অগ্নি ও দন্ড এই সবকটি অস্ত্রের সাহায্যেই মা অসুর নিধন করেন। দশটি অস্ত্ররই আলাদা মানে।
শঙ্খ হল সৃষ্টির প্রতীক। পুরাণ মতে শঙ্খ থেকে উৎপন্ন শব্দেই প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে এই জীব জগতে।
চক্র অর্থাৎ আবর্তন। সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে রয়েছেন মা। তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে চলেছে সমস্ত জগৎ।
দেবীর হাতের পদ্ম বার্তা দেয় পাঁকের মধ্যে থেকেও পদ্মের রূপে মুগ্ধ সকলে। মায়ের আশীর্বাদে অসুরকূলও ভিতরের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়।
খড়্গ বা তলোয়ারের ধার আসলে মানুষের মগজাস্ত্রের বুদ্ধির ধার। বুদ্ধি দিয়েই যাতে সমাজের সমস্ত বৈষম্য ও অশুভকে মানুষ জয় করতে পারে।
মনুষের শরীরের ভিতরে যে অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে তারই প্রকাশ ঘটে ধনুর টঙ্কারে।মানব দেহে সেই শক্তির সঞ্চার করতেই মা দুর্গা নিজের হাতে তীর-ধনুক বহন করেন।
মানুষ তমঃ, রজঃ, এবং সত্ত্ব তিনটি গুনের সমন্বয়ে তৈরি।এই তিনটি গুণকেই নির্দেশ করে ত্রিশূলের তিনটি ফলা।
দণ্ড হল আনুগত্য, ভালোবাসা, এবং ভক্তির প্রতীক।
মা দুর্গার হাতের অশনি দৃঢ়তা এবং সংহতির প্রতীক। এই দুই গুণের মাধ্যমেই জীবনে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন মানুষ।
চেতনার নিম্ন স্তর থেকে উচ্চ স্তরে প্রবেশ এবং বিশুদ্ধ চেতনার চিহ্ন এই সাপ।
দেবীর এক হাতে থাকে অগ্নি। এই অগ্নি জ্ঞান এবং বিদ্যার প্রতীক।
বুঝলে কিছু দিদিভাই?
হুম ঠাম্মা। একদম পরিষ্কার।
আচ্ছা তিতলি দিদিভাই কখনো তুমি মা দুর্গার মুখ ভালো করে দেখেছ ? যদি লক্ষ না করে থাক তবে এবার একটু খেয়াল করে দেখো।
কেন ঠাম্মা, কি এমন আছে মায়ের মুখে?
এবার তুই ভালো করে দেখবে কিন্তু।
কৌতূহল বেড়ে যায় তিতলির।
তিতলির মামার বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়।মহালয়ের
পরেই মামাবাড়ি চলে যায়। ঠাকুরের গায়ে রং থেকে শুরু করে চোখ মুখ আঁকা সাজপোষাক
শোলারকাপড় পড়া সবটাই সেখানে বসে থেকে সে দেখে।
তিতলি দেখল মায়ের কপালের নীচে নাকের কাছে একটা চিহ্ন আঁকছে।
দেখে খুব অবাক হল। আগে তো সে খেয়াল করে
দেখেনি।বাড়ি গিয়ে ঠাম্মার কাছে এর মানে জানতে হবে।
ঠাম্মার ডাক শুনে তিতলি ছুটতে ছুটতে এসে চিৎকার করে বলে ওখানে মাকড়সা।
কোথায় দিদিভাই মাকড়সা?
দেখলাম কপালে।
কার কপালে?তোমার কপালে? কই, নেই তো।
দেখলাম মা দুর্গার কপালে।
কি দেখলে, জ্যান্ত না আঁকা?
না ঠাম্মা আঁকা।
ওটার মানে কি ঠাম্মা।
এটা মহামায়ার প্রতীক।
তাই দুর্গা পুজোর সময় বাড়ি থেকে মাকড়সা তাড়াতে নেই।আমি আমার ঠাকুমা দিদিমার কাছেও তাই শুনেছি।
কেন ঠাম্মা?
বিশ্বাস মাকড়সা রূপে দেবীর আগমন হয় বাড়িতে ।
কেন মাকড়সার রূপকে দেবীর রূপ বলে?
আসলে মায়ের রূপের মধ্যে এই মাকড়সার চিহ্নের মধ্যে দিয়ে মায়াকে চিত্রিত করে দেবী যে মহামায়া তাই বোঝানো হয়েছে।
তাই নাকি ঠাম্মা?
হ্যাঁ দেখবে তুমি, মাকড়সা নিজে জাল বুনে তার মধ্যে নিজে আটকা পড়ে না। মহামায়াও মায়ার সৃষ্টি করে চলেন কিন্তু নিজে তাতে আবদ্ধ হয় না।
আমরা সকলকে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ।কিন্তু মা
মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ নন।
বাহববা এতো ব্যাপার ঠাম্মা?
হ্যাঁ রে পাগলি বড় হলে আরও জানতে পারবি।
কি জানতে পারব?
মহামায়া হলেন স্বয়ং ব্রহ্ম। যিনি মায়া বিস্তার করেছেন তিনি মায়ার মধ্যেই আছেন কিন্তু মায়ার ঊর্ধ্বে তিনি।
তিতলি শুনে অবাক বিস্ময়ে ঠাম্মার মুখের দিকে
তাকিয়ে রইল।