মহালয়া
আগামীকাল সকালে মহালয়া। বেলতলা দূর্গামণ্ডপ থেকে আগমনীর গান ভেসে আসছে। আঞ্জুমানআরা বেগম উরফে অঞ্জু নীলাচল আবাসনের তিন কামরার ঘর থেকে গান শুনতে শুনতে নস্টালজিক হয়ে পড়লো। মনে পড়ছে দুই বছর আগেকার কলকাতায় থাকা দিনগুলোর কথা।
স্বামী মেহতাব ‘লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো” কোম্পানিতে কর্মরত ছিল ডিব্রুগড়ে। কোম্পানি ‘এরিয়া ম্যানেজারে’র পদে পদোন্নতি দিয়ে কলকাতার অফিসে পাঠিয়ে দিলো। লোকে ভয় দেখালো, কলকাতায় নাকি মুসলমানদের বাড়ী ভাড়া পেতে বিড়ম্বনা হয়। কিন্তু অঞ্জুদের তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। মেহতাবের সহকর্মী রাকেশ গুপ্তার উদ্যোগে সহজেই ঘর পেয়ে গেলো লেকগার্ডেনের গীতাঞ্জলি এপার্টমেন্টে। এখানে মিশ্র জনগোষ্ঠীর বাস। অচিরেই আপন করে নিল আবাসনের লোকজন অঞ্জু, মেহতাব আর ওদের তিন বছরের মেয়ে মেহেরউন্নিসাকে। বিশেষ করে রমলামাসীমা আর সবিতাবৌদি।
রমলামাসিমা হেসে বললো, অতো কঠিন নামে তোমায় ডাকতে পারবো না বাপু, আমি তোমাকে অঞ্জু বলেই ডাকবো, তোমার মেয়েকে ‘মোহর’। মোহর কার নাম জানো? বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী স্বর্গীয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নামে ডাকতেন।
সবিতাবৌদিও অঞ্জুকে আসামের মেয়ে বলে কাছে টেনে নিল। ওর মামার বাড়ী নাকি তেজপুরে ছিল। মামা মারা যেতেই যোগাযোগ কমে এলো। মামাতো ভাইরা কলকাতা এলেও হোটেলে ওঠে। কালভদ্রে দেখা করতে আসে। কালের নিয়মে সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কগুলোও কেমন আলগা হয়ে যায়।
মহালয়ার দিনগুলো আবাসনে উৎসবের পরিবেশ হতো। কাকভোরেই আবাসনের মাইকে বাজতো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ পালা। একটু বেলা হতেই পুরুষেরা ছুটতো গঙ্গার ঘাটে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া হতো সবাই মিলে সোসাইটির কমিউনিটি হলে। বিকেল হতেই কচিকাঁচারা ভীড় করতো কমিউনিটি হলের রঙ্গমঞ্চে। এইসব মঞ্চেই আগামী সময়ের সম্ভাবনাময় শিল্পীদের মঞ্চে নামার হাতেখড়ি হয়। কলকাতায় এসে অঞ্জু লক্ষ্য করেছে, সন্তানকে সঙ্গীত, নাচ অথবা খেলাধুলায় পারদর্শী করার প্রচেষ্টা থাকে প্রতিটি অভিভাবকের । আজ তাই সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতাগুলিতে বিশেষ করে সঙ্গীতে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পীদের জয়জয়কার। মোহরও একবার ছোটদূর্গা সেজেছিলো ‘আগমনী ‘নৃত্যনাট্যতে।
মনে পড়ছে, প্রথম পুজোতে সপ্তমীর সকালে মাসীমার ডাকে অঞ্জু চলে এসেছে দূর্গামণ্ডপে। অঞ্জুকে দেখতে পেয়ে মাসীমা বলে উঠলো। দেখতো বাপু সবার কান্ড। এদিকে পুজোর সময় হয়ে এলো, কারো কোনো হুস নেই। এসেতো অঞ্জু। হাত লাগিয়ে ঝটপট বেলপাতাগুলো বেছে ফেলো। অঞ্জু ইতস্ততভাবে অস্ফুট আওয়াজে বলল, আমি কি পারবো? বসতো,খুব পারবে, মাসীমার কণ্ঠে ধমকের সুর। সত্যি যদি জাতিভেদ, ধর্মভেদ না থাকতো, তবে পৃথিবীটা আরও কতো সুন্দর হতো।
এমনই করে হাসিখুশিতে পুজোর দিনগুলো কেটে গেল । দশমীর সিঁদুরখেলা দেখে অঞ্জু বেশ আনন্দ পেলো। সন্ধ্যায় বিজয়াদশমীর অনুষ্ঠানে সবাই অঞ্জুকে কিছু অভিনয় করার জন্য চেপে ধরলো। অগত্যা অঞ্জু ও মোহর মিলে একটি বিহুগীত গেয়ে নেচে পরিবেশন করলো। অঞ্জুর এই গুণের কথা কারো জানা ছিলো না। সবাই অন্যধারার অনুষ্ঠান দেখে বেশ উপভোগ করলো।
এইভাবে একদিন শেষ হয়ে এলো কলকাতার সোনার দিনগুলি। মেহতাব আবার গুয়াহাটির অফিসে বদলি হয়ে আসামে ফিরে এলো। দু’বছর কেটে গেছে, তবুও অঞ্জুর মনে এখনো ভেসে বেড়ায় কলকাতার দিনগুলোর স্মৃতি।
ইতিমধ্যে আগমনীর গান শেষ হয়েছে। মণ্ডপ থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে….।