Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভয়ংকর সুন্দর || Sunil Gangopadhyay » Page 8

ভয়ংকর সুন্দর || Sunil Gangopadhyay

বিপদের রাত্রি অনেক দেরি করে শেষ হয়। সারা রাত কম্বল মুড়ি দিয়ে খাটের ওপর বসেছিলাম। চোখ ঢুলে আসছিল, তবু ঘুমোইনি। আস্তে আস্তে যখন সকাল হল, তখন মনের মধ্যে একটু জোর পেলাম। দিনের আলোয় অনেকটা সাহস আসে। মনে মনে ঠিক করলাম, ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করে। কোনও লাভ নেই। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, কাকাবাবুকে খুঁজে বার করতে হবে।

কিন্তু আমি একলা একলা কী করব? কেউ কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? বাচ্চা ছেলে বলে হয়তো আমার কথা উড়িয়ে দেবে। কাকাবাবুর মতন একজন বয়স্ক জলজ্যান্ত লোক হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই সূচা সিং-এর হাত আছে তাতে। কাকাবাবু থাকতে থাকতে মূর্তিটা নিতে সাহস করেননি। কাকাবাবুর সঙ্গে রিভলভার থাকে। তাই কাকাবাবুকে আগে সরিয়ে তারপর জিনিসটা নিয়ে যাওয়া হল! সূচা সিং-এর অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি, ওঁর বিরুদ্ধে আমার কথা কে শুনবে?

আমাদের পাশের তাঁবুতে কয়েকজন জামান ছেলেমেয়ে থাকে। একটু একটু আলাপ হয়েছিল। ওদেরও বলে কোনও লাভ নেই, ওরা বিদেশি, কী আর সাহায্য করতে পারবে? চট করে মনে পড়ে গেল সিদ্ধাৰ্থদার কথা। সিদ্ধার্থদা, সিন্ধাদি, রিণি-ওরা কি অমরনাথ থেকে ফিরেছে? হয়তো এর মধ্যেই ফিরে শ্ৰীনগর চলে গেছে। এর মধ্যে কদিন কেটে গেল-অমরনাথ থেকে ফিরতে কদিন লাগে—সেটা আর কিছুতেই হিসেব করতে পারছি না। খালি মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, অমরনাথ থেকে ফিরলে নিশ্চয়ই প্লাজা হোটেলে উঠবে, সেখানে খবর পাওয়া যাবে।

কাকাবাবু বলেছিলেন, কোনওক্রমেই তাঁবু থেকে না বেরুতে। কিন্তু যে-জন্য বলেছিলেন, তার তো আর কোনও দরকার নেই। আসল জিনিসটাই চুরি হয়ে গেছে। আমাদের তাঁবুতে আর দামি জিনিস বিশেষ কিছু নেই। কাকাবাবু টাকা পয়সা কোথায় রাখতেন। আমি জানি না—সেগুলোও বোধহয় ডাকাতরা নিয়ে গেছে। হোটেলের বিল কী করে শোধ হবে কে জানে! সিদ্ধাৰ্থদাদের না পেলে চলবেই না।

হেঁটে হেঁটে গেলাম প্লাজা হোটেলে। সেখানে কোনও খবরই পাওয়া গেল না। সিদ্ধাৰ্থদারা হোটেল ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন অমরনাথ—ফিরে এসেছেন কিনা। ওঁরা জানেন না। ফেরার পর রিজার্ভেশনও করা নেই। এর মধ্যে ফিরে এসে অন্য হোটেলেও উঠতে পারেন বা শ্ৰীনগরে চলে যেতে পারেন। আবার এখনও ফিরতে নাও পারেন, অথাৎ আমি কিছুই জানতে পারলাম না। তবে, পোপোটলাল নামে একজন পাণ্ডা গিয়েছিলেন ওঁদের সঙ্গে-তার খোঁজ পেলে সব জানা যেতে পারে। পাণ্ডাজী যদি ফিরে থাকেন, তবে তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া যাবে সব খবরাখবর। পোপোটলালের ঠিকানা? ঠিকানা কিছু নেই-বাজারের কাছে গিয়ে খোঁজ করলে লোকে বলে দেবে।

নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম প্লাজা হোটেল থেকে। কোথায় এখন পোপেটলালকে পাব? মানুষ হারিয়ে গেলে পুলিশকে খবর দিতে হয় শুনেছি। কাকাবাবুর কথা পুলিশকে জানাতে হবে।

পহলগ্রামের রাস্তা দিয়ে এখন কত মানুষজন হাঁটছে, কত আনন্দ সবার মুখে চোখে। আমার বিপদের কথা কেউ জানে না। আমাকে কেউ ডেকে জিজ্ঞেস করল না, খোকা, তোমার মুখটা এমন শুকনো দেখছি কেন? তোমার কি কিছু হয়েছে? আমারই বয়েসী কত ছেলে-মেয়ে হৈ চৈ করতে করতে যাচ্ছে বেড়াতে। আমার কেউ চেনা নেই। কলকাতায় বাবাকে টেলিগ্রাম করব? বাবা আসতে আসতে যে সময় লাগবে ততদিন আমি একা

হাঁটতে হাঁটতে বাস ডিপোর দিকে চলে এসেছিলাম। দু একটা দোকানে জিজ্ঞেস করেছি। পোপোটলালের খবর। কেউ কিছু বলতে পারেনি। এখন খুব টুরিস্ট আসার সময়-দোকানদাররা খদের সামলাতেই ব্যস্ত—আমার কথা ভাল করে শোনার পর্যন্ত সময় নেই। হঠাৎ দেখলাম একটা বাসের জানলায় রিণির মুখ। এক্ষুনি বোধহয় বাসটা ছেড়ে দেবে। আমি প্ৰাণপণে দৌড়তে লাগলাম, হাত পা ছুঁড়ে ডাকতে লাগলাম, রিণি, রিণি!

বাসটা ছাড়েনি। রিণি আর স্নিগ্ধাদি বসে আছে। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম, সিদ্ধাৰ্থদা কোথায়?

স্নিগ্ধাদি বললেন, ও আসছে এক্ষুনি। তুই ওরকম করছিস কেন রে, সন্তু?

রিণি বলল, কাল সারাদিন তোকে খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না। ভাবলাম তোরা চলে গেছিস। আমরা পরশু ফিরেছি। অমরনাথ থেকে। এবার পহলগ্ৰামে আমরাও তাঁবুতে ছিলাম।

কাল সারাদিন আমি তাঁবুতে বসে ছিলাম, আর ওদিকে ওরা আমাকে খুঁজছে। লীদার নদীর ধারে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা তাঁবু— হয়তো আমাদেরটার কাছাকাছি ওরা ছিল, আমি টের পাইনি। এর কোনও মানে হয়?

একটু দম নিয়ে আমি বললাম, সিদ্ধার্থদাকে আমার ভীষণ দরকার। এক্ষুনি। স্নিগ্ধাদি, তোমাদের এই বাসে যাওয়া হবে না। নেমে পড়ো, শিগগির নেমে পড়ে।

স্নিগ্ধাদি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, কী হয়েছে কী? আমাদের তো বাসের টিকিট কাটা হয়ে গেছে, মালপত্র তোলা হয়ে গেছে।

আমি বললাম, তোমরা আগে নেমে পড়ে, তারপর সব কথা বলছি।! সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে। কাকাবাবু হারিয়ে গেছেন। আমাদের তাঁবুতে-

রিণি হি-হি করে হেসে উঠে বলল, কাকাবাবু হারিয়ে গেছেন? অতবড় একটা লোক আবার হারিয়ে যায় নাকি? বল তুই-ই হারিয়ে গেছিস, তোর কাকাবাবুই তোকে খুঁজছেন।

আঃ, মেয়েদের নিয়ে আর পারা যায় না। রিণিটা একদম বাজে মাকৰ্ণ। দরকারী কথার সময়েও হাসে। ভাগ্যিস এই সময় সিদ্ধাৰ্থদা এসে গেলেন।

আমি সিদ্ধার্থদাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে যত সংক্ষেপে সম্ভব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। সিদ্ধার্থদা ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, এ তো সত্যি সাঙঘাতিক ব্যাপার। আমাদের সব মালপত্র উঠে গেছে, শ্ৰীনগরে লোক অপেক্ষা করবে। অথচ তোমাকে এক ফেলে যাওয়া যায় না। কী করা যায় বলে তো? এক্ষুনি ঠিক করতে হবে, দেরি করার সময় নেই! আচ্ছা, এক কাজ করা যাক।

ততক্ষণে বাসটা স্টার্ট নিয়েছে, কণ্ডাক্টর হুইসল। বাজাচ্ছে ঘন ঘন। এ সব জায়গায় বাসে নিয়মকানুন খুব কড়া। সিদ্ধাৰ্থদা জানলার কাছে গিয়ে স্নিগ্ধাদিকে বললেন, শোনো, তোমরা দুজনে চলে যাও শ্ৰীনগরে। এখানে একটা ব্যাপার হয়ে গেছে—আমি সন্তুর সঙ্গে থাকিছি-একদিন পর যাব।

স্নিগ্ধাদি তো কথাটা শুনেই উঠে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, পাগল নাকি! আমরাও থাকব তাহলে। কণ্ডাক্টরকে বলো-

সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, লক্ষ্মীটি, আমার কথা শোনো। শ্ৰীনগরে তো সব ঠিক করাই আছে, তোমাদের কোনও অসুবিধা হবে না। তোমরা এখানে থাকলেই বরং অসুবিধা হবে। আমি একদিন পরেই আসছি।

বাস ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে, সিদ্ধাৰ্থদা সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা হেঁটে গেলেন বোঝাতে বোঝাতে। সিন্ধাদি আমাকে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কী হয়েছে বল তো সন্তু? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! এই সন্তু, তুই চুপ করে আছিস কেন?

কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ঐটুকু সময়ে-সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, যা হয়েছে পরে শুনতে পাবে। চিন্তা করো না, আমি কালকেই যাচ্ছিা!

তারপর বাস জোরে ছুটিল, রিণি হাত নাড়তে লাগল।

সিদ্ধাৰ্থদা যে প্রথম থেকেই আমার কথায় গুরুত্ব দিলেন, বেশি কিছু জিজ্ঞেস না করেই থেকে যাওয়া ঠিক করলেন, সে জন্য সিদ্ধার্থদার কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। সময় এত কম ছিল— ওর মধ্যে কি সব বুঝিয়ে বলা যায়?

বাসটা চলে যাবার পর সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, চলো, কাজ শুরু করা যাক! তোমার কাকাবাবু কাল সকালবেলা তাঁবু থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি? তোমাকে কোনও খবর না দিয়ে তিনি কোথাও চলে যাবেন, তা হতেই পারে না!

আমি জোর দিয়ে বললাম, তা হতেই পারে না!

হুঁ! একটা জলজ্যন্ত লোক তা হলে যাবেই বা কোথায়?

সূচা সিং-

সূচা সিং? সে আবার কে?

সূচাসিং নামের একজন লোকের সঙ্গে কাকাবাবুর ঝগড়া হয়েছিল। সেই লোকটাই তাঁবুর মধ্যে রাত্তিরবেলা আমাকে-

সিদ্ধাৰ্থদা ভুরু কুঁচকে সব শুনলেন। চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। আমার মনের ভেতরের ভয়ের ভাবটা অনেকটা কেটে গেছে। সিদ্ধার্থদাকে যখন পিয়েছি, তখন একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। যতক্ষণ একা ছিলাম, ততক্ষণ কী যে অসহ্য একটা অবস্থা-।

সিদ্ধার্থদা জিজ্ঞেস করলেন, থানায় খবর দিয়েছ? দাওনি? চলো, আগে সেখানেই যাই।

থানায় দুজন অফিসার ছিলেন, তাঁদের নাম মীর্জা আলি আর গুরুবচ্চন সিং। খাতির করে বসতে বললেন আমাদের, মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলেন। তারপর মীজ আলি বললেন, বহুৎ তাজবীকী বাৎ! এখানে এরকম ঘটনা কখনও ঘটে না। দিনের বেলা একটা লোক উধাও হয়ে যাবে কী করে? তাছাড়া সূচা সিং-এর নামে তো কেউ কোনওদিন কোনও অভিযোগ করেনি।

গুরুবচ্চন সিং বললেন, আপনাদের তাঁবু থেকে কী কী চুরি গেছে? দামী चिनिনা না না छिल १

আমি আমতা আমতা করে বললাম, কাকাবাবুর একটা রিভলভার ছিল, সেটা তিনি নিয়ে বেরিয়েছিলেন কি না জানি না-সেটা পাচ্ছি না। আর কিছু টাকা পয়সা–

কত?

আমি তা জানি না।

ক্যামেরা-ট্যামেরা?

ছিল না। একটা দূরবীন ছিল, সেটা নেয়নি।

আশ্চর্য, এর জন্যই দিনেরবেলায় একটা লোককে…রাত্তিরবেলা তাঁবুতে ঢুকে…এখানে এ রকম কাণ্ড…ঠিক আছে, চলুন। এনকোয়ারি করে দেখা যাক—

পোস্ট অফিসে গিয়ে জানা গেল, কাকাবাবু সেখানে টেলিগ্ৰাম করতে যাননি। আগের দিন মাত্র তিনজন টেলিগ্রাম করতে এসেছিল, তার মধ্যে কাকাবাবুর মতন চেহারার কেউ ছিল না। দুজনই তাদের মধ্যে মহিলা, আর একজন স্থানীয় লোক। অথাৎ, যা হবার তা এখানে আসবার আগেই হয়েছে। আমাদের তাঁবুতে তদন্ত করে পুলিশ বুঝতে পারলেন, সেখানে ঢুকে লণ্ডভণ্ড করা হয়েছে, কিন্তু অপরাধীর কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। সাধারণ চোর ডাকাত যে নয়, তা সহজেই বোঝা যায়। বাইনোকুলার, অ্যালার্ম ঘড়ি, পেন—এসব কিছুই নেয়নি। যে-ট্রাঙ্কটা চোররা ভেঙেছে, সেটার মধ্যেই একটা মানি ব্যাগ ছিল কাকাবাবুর, সেটাও চোরদের চোখে পড়েনি। সূচা সিং-এর গ্যারেজে গিয়ে শোনা গেল, সূচা সিং বিশেষ কাজে মাটন গেছে, বিকেলেই ফিরবে। মীর্জা আলি হুকুম দিলেন সূচা সিং ফিরলেই যেন থানায় গিয়ে দেখা করে।

কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর গুরুবচ্চন সিং বললেন, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনাদের কাকাবাবুকে নিশ্চয়ই খুঁজে বার করব। মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমারও আলাপ হয়েছিল, খুব ভাল লোক-আমাদের সরকারের অনেকের সঙ্গে তাঁর চেনা জানা আছে, পহেলগ্ৰামে তাঁর কোনও বিপদ হবে, এতে পহ্নলগ্রামের বদনাম। সূচা সিং যদি দোষী হয়, তা হলে আমাদের হাত সে কিছুতেই এড়াতে পারবে না। শাস্তি পাবেই। আপনারা বিকেলে আবার খবর নেবেন। আমরা সব জায়গায় পুলিশকে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।

পুলিশদের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর সিদ্ধাৰ্থদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু, সকাল থেকে কিছু খেয়েছ? মুখ তো একেবারে শুকিয়ে গেছে। অত চিন্তা করো না?

এতক্ষণ খাওয়ার কথা মনেই পড়েনি। সিদ্ধাৰ্থদার কথা শুনেই বুঝতে পারলাম, কী দারুণ খিদে পেয়েছে! সেই মিষ্টির দোকানটায় ঢুকলাম। কাকাবাবুর সঙ্গে বাইরে যাবার সময় আমরা প্রত্যেকবার এখানে জিলিপি খেতাম। কাকাবাবু আজ নেই! কাকাবাবু কোথায় আছেন, কে জানে! আমার বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল।

আমি সিদ্ধাৰ্থদার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কাকাবাবু বলেছিলেন, পাথরের মুণ্ডুটার কথা আমি যেন কোনও কারণেই কারুকে না বলি। সেইজন্য পুলিশকে বলিনি। কিন্তু সিদ্ধাৰ্থদাকেও কি বলা যাবে না? সিদ্ধাৰ্থদা তো আমাদের নিজেদের লোক। সিদ্ধাৰ্থদার সাহায্য ছাড়া আমি একা কী করতে পারতাম? তাছাড়া সিদ্ধাৰ্থদা ইতিহাসের অধ্যাপক, উনি ঠিক মূল্য বুঝবেন।

আমি আস্তে আস্তে বললাম, সিদ্ধাৰ্থদা, পুলিশকে সব কথা আমি বলিনি।

আমাদের একটা দারুণ দামি জিনিস চুরি গেছে—

কী?

আমরা সম্রাট কণিষ্ক-র মুণ্ডু আবিষ্কার করেছিলাম।

কী বললে? কার মুণ্ডু?

আস্তে আস্তে সব ঘটনা খুলে বললাম সিদ্ধাৰ্থদাকে। সিদ্ধাৰ্থদা অবাক বিস্ময়ে শুনলেন সবটা। তারপর ছটফট করতে লাগলেন। বললেন, কী বলছ তুমি, সন্তু! এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ইতিহাসের দিক থেকে এর মূল্য যে কী দারুণ তা বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু সেটা এরকমভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? অসম্ভব! যে-কোনও উপায়েই হোক, ওটা বাঁচাতেই হবে।

দোকানের বিল মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে সিদ্ধাৰ্থদা আবার বললেন, তুমি ঠিক জানো, রাত্তিরবেলা সূচা সিং-ই ঢুকেছিল? সেই ওটা নিয়ে গেছে?

আমি জোর দিয়ে বললাম, আঙুল কাটা দেখেই আমি চিনেছি। তাছাড়া, ওটার কথা আর কেউ জানে না। সূচা সিংও জানত না–ও কাঠের বাক্সটা খুলে দেখতে চেয়েছিল, ওর ধারণা ওর মধ্যে দামি কিছু জিনিস আছে।

সূচা সিং ঐ একটা পাথরের মুখ নিয়ে কী করবে? ইতিহাস না জানলে, ওটার তো কোনও দামই নেই। সূচা সিং ওর মূল্য কী বুঝবে? সে নিতে চাইবেই বা কেন?

সেটা আমিও জানি না। কিন্তু সিদ্ধাৰ্থদা, ওর সব সময় ধারণা, কাকাবাবু এখানে সোনার খোঁজ করতে এসেছেন। ওর সেই সোনার জন্য লোভ।

কিন্তু যখন বাক্সটা নিয়ে দেখবে, ওতে দামি কিছু নেই, সোনা তো নেই-ই, তখন নিশ্চয়ই কাকাবাবুকে ছেড়ে দেবে। শুধু শুধু তো কেউ কোনও মানুষকে মারে না বা আটকে রাখে না।

কাকাবাবু বলছিলেন, বিদেশের মিউজিয়ামগুলো জানতে পারলে নাকি ওটার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা দাম দিতে চাইবে।

তার আগে তো জানতে হবে, মুণ্ডুটা করে! সেটা সূচা সিং জানবে কী করে? সূচা সিংকে সে কথা জানাওনি তো?

না। সেইজন্যই বোধহয় কাকাবাবুকে আটকে রেখেছে।

কাকাবাবু নিশ্চয়ই বলে দেবেন না?

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সিদ্ধাৰ্থদা আপনমনেই বললেন, শুধু পুলিশের ওপর নির্ভর করলেই হবে না। আমাদেরও খোঁজ করতে হবে। ঐ পাথরের মুণ্ডুটার মূল্য পুলিশও বুঝবে না। ওটাকে রক্ষা করতে না পারলে-সন্তু, তুমি কিছুক্ষণ একলা থাকতে পারবে? আমি একটু দেখে আসি—

না, সিদ্ধার্থদা, আমিও আপনার সঙ্গে যাব। একলা থাকতে আমার ভয় করবে।

দিনের বেলা আবার ভয় কি?

না, আমি আপনার সঙ্গে যাব। আচ্ছা, সিদ্ধার্থদা, এমন হতে পারে না যে সূচা সিং আসলে নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে আছে। পুলিশকে ওর লোেকরা মিথ্যে কথা বলেছে?

তা মনে হয় না। পুলিশ তো যে-কোনও মুহুর্তেই সার্চ করতে পারে। তবু একবার গিয়ে দেখা যাক।

দু-একটা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই সূচা সিং-এর বাড়িটা জানা গেল। বেশ বড় দোতলা বাড়ি, সামনে একটা ছোট্ট বাগান। বাগানে একজন মহিলা কাজ করছিলেন। কাশ্মীরি মেয়ে-কী সরল আর শান্ত তাঁর মুখখামা। দুটি ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলা করছে। মহিলা বোধহয় সূচা সিং-এর স্ত্রী। সূচা সিং-এর কাশ্মীরি বউ সেকথা শুনেছিলেন। বাড়িটা দেখলে মনে হয় না—এটা কোনও বদমাইস লোকের বাড়ি।

সিদ্ধাৰ্থদা বাগানের গেটের সামনে গিয়ে খুব বিনীতভাবে বললেন, বাহিনজী, শুনিয়ে?

মহিলা একবার চোখ তুলে তাকালেন আমাদের দিকে। কোনও উত্তর দিল না!

সিদ্ধার্থদা, আবার ডাকলেন, বাহিনজী একটা বাত শুনিয়ে!

মহিলাটি এবারও কোনও উত্তর দিলেন না, আমাদের দিকে তাকালেন না। বুঝতে পারলুম, বাইরের কোনও লোকের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে ওঁকে। বাচ্চা ছেলে দুটি জুল-জুল করে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে।

সিদ্ধাৰ্থদা, কিন্তু হাল ছাড়লেন না। এবার গলার আওয়াজ খুব করুণ করে বললেন, বাহিনজী, এক গিলাস পানি পিলায়েঙ্গে? বহৎ পিয়াস লাগা!

জল খেতে চাইলে কেউ কোনওদিন না বলতে পারে না। বিশেষত মেয়েরা। মহিলা এবার আমাদের দিকে তাকালেন। বাড়ির ভেতর গিয়ে এক গেলাস জল এনে নিঃশব্দে এগিয়ে দিলেন সিদ্ধাৰ্থদার দিকে।

সিদ্ধাৰ্থদা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, হামকো নেই, এই লেড়কাকো দিজিয়ে?

তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, নে খেয়ে নে! মাথা ঘোরা কমেছে!

আমি তো অবাক! তবু কোনও কথা বললাম না। সেই ঠাণ্ডার মধ্যেই বাধ্য হয়ে এক গেলাস জল খেয়ে নিতে হল। সিদ্ধাৰ্থদা সূচা সিং-এর বৌকে বললেন, এই ছেলেটার মাথা ঘুরছে। এর খুব শরীর খারাপ লাগছে হঠাৎ। কী করি বলুন তো? মাথায় জল ঢেলে দেব?

সূচা সিং-এর স্ত্রী-র দয়া হল। বাগানে একটা কাঠের বেঞ্চি ছিল,সেটা দেখিয়ে বললেন, ওর ওপর শুইয়ে দিন?

সিদ্ধাৰ্থদা, আমাকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে রুমাল দিয়ে হাওয়া করতে করতে বললেন, আজই শ্ৰীনগরে গিয়ে একে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। সূচা সিং যদি একটা গাড়ি দেন–

মহিলা বললেন, না, উনি বাড়ি নেই। গাড়ি ভাড়া নিতে হলে আপনারা গ্যারেজে গিয়ে দেখতে পারেন।

গ্যারেজে খালি গাড়ি নেই। একটা মাত্র আছে-কিন্তু সিংজীর হুকুম ছাড়া সেটা পাওয়া যাবে না।

কিন্তু উনি তো পহলগ্ৰামে নেই এখন!

সিদ্ধাৰ্থদা মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, আমাদের খুব দরকার ছিল। সিংজী কবে ফিরবেন? আজ ফেরার কোনও চান্স নেই? খুব দূরে কোথাও গেছেন কি?

খুব দূর নয়। দেওগির গাঁয়ে আমাদের একটা বাড়ি আছে, সেখানে গেলেন কাল। কবে ফিরবেন সে কথা তো কছি বলেননি।

দেওগির গ্রামটা কোথায় যেন? মাটন-এর কাছেই না?

না, ওদিকে তো নয়। সোনমার্গের রাস্তায়। লীদার নদী ছড়িয়ে বাঁদিকে গেলেই।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাম শুনেছি। দেওগির তো খুব সুন্দর জায়গা! সিদ্ধাৰ্থদা রীতিমত গল্প জমিয়ে নিলেন। ছেলেমেয়ে দুটো আমাদের কাছে এসে বড় বড় টানা টানা চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। আমাদের দিকে।

আমার মনে হল, মানুষের লোভ জিনিসটা কী বিচ্ছিরি! সূচা সিং-এর এই তো এত সুন্দর বাড়ি, আট-নখানা গাড়ি ব্যবসায় খাটাচ্ছে—তবু সোনার জন্য কী লোভ! সোনার লোভেই কাকাবাবুকে আটকে রেখেছে কোথাও। কাল রাত্তিরে আমাদের তাঁবুতে চুরি করতে গিয়েছিল। পুলিশ যখন ওকে ধরে ফাঁসি দেবে, তখন ছেলেমেয়েগুলো কাঁদবে কী রকম! শুনেছি। আগেকার দিনে কাশ্মীরে কেউ চুরি করলে তার নাক বা কান বা হাত কেটে দিত।

একটু বাদে আমরা সূচা সিং-এর স্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। খানিকটা দূরে চলে আসার পর সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, সন্তু, একবার দেওগির গিয়ে দেখবে নাকি? সূচা সিং-এর বউকে বেশ সরল মনে হল, বোধহয় মিথ্যে কথা বলেনি।

পুলিশের কাছে জানাবেন না?

হ্যাঁ, জানাব। ওরা যদি গা না করে আমরা নিজেরাই গিয়ে দেখে আসব একবার।

আবার আমরা থানায় গেলাম। পুলিশের লোকেরা সব শুনে বললেন, আপনারা এত ধৈৰ্য হারাচ্ছেন কেন? আজি সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখুন।

মীর্জা আলি বললেন, সূচা সিংকে কালকেই আপনাদের সামনে হাজির করাব, কোনও চিন্তা নেই।

গুরুবচ্চন সিং বললেন, কী খোকাবাবু, আংকল-এর জন্য মন কেমন করছে?

থানা থেকে বেরিয়ে এসে সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, চলে আমরা নিজেরাই যাই। একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে।

কিছুতেই আর গাড়ি পাওয়া যায় না। এখন পুরো সীজন-এর সময়, গাড়ির খুব টানাটানি। শেষ পর্যন্ত একটা গাড়ি পাওয়া গেল, কিন্তু সেটা আমাদের নামিয়ে দিয়েই চলে আসবে। সিদ্ধাৰ্থদা এত ব্যস্ত হয়ে গেছেন যে তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, ফেরার সময় যা হোক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবেই! কী বলো, সন্তু?

দেওগির গ্রামের কাছাকাছি বড় রাস্তায় আমরা গাড়িটা ছেড়ে দিলাম। জায়গাটা ভীষণ নির্জন। রাস্তায় একটাও মানুষ নেই। রাস্তার দুপাশে ঘন গাছপালা। ফুল ফুটে আছে অজস্র। ময়না। আর বুলবুলি পাখি উড়ে যাচ্ছে ঝাঁক বেঁধে। কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে একটা সরু ঝরনা, তার জলের কলকল শব্দ শোনা যায় একটানা।

দুজনে মিলে হাঁটতে লািগলাম কিছুক্ষণ। সূচা সিং-এর বাড়িটা কী করে খুঁজে পাওয়া যাবে বুঝতে পারছি না। কারুকে জিজ্ঞেস করারও উপায় নেই। তবু আমার কেন যেন মনে হতে লাগল, কাকাবাবু এখানেই কাছাকাছি কোথাও আছেন। এই রকম মনে হবার কোনও মানে নেই। তবু এক এক সময় মনে হয় না? সিদ্ধাৰ্থদা, আর আমি দুজন রাস্তার দুদিক দেখতে দেখতে হাটছি। খানিকটা বাদে হঠাৎ আমি রাস্তার পাশে একটা জিনিস দেখে ছুটে গেলাম। কাকাবাবুর একটা ক্ৰােচ পড়ে আছে। আমার শরীরটা কী রকম দুর্বল হয়ে গেল, চোখ জ্বালা করে উঠল। কাকাবাবু তো ক্রাচ ছাড়া কোথাও যান না। এটা এখানে পড়ে কেন? তাহলে কি কাকাবাবুকে ওরা

সিদ্ধাৰ্থদা, সেটা দেখে বললেন, এটা তো অন্য কারুরও হতে পারে। ক্রাচ তো এক রকমই হয়। সন্তু, তুমি ঠিক চিনতে পারছি?

হাঁ, সিদ্ধাৰ্থদা। কোনও ভুল নেই। এই যে মাঝখানটায় খানিকটা ঘষাটানো দাগ? সিদ্ধাৰ্থদা, কী হবে?

আরে, তুমি আগেই ভয় পাচ্ছ কেন? পুরুষ মানুষের অত দুর্বল হতে নেই। শেষ না-দেখা পৰ্যন্ত কোনও জিনিস মেনে নেবে না। একখানা ক্রাচ পড়ে আছে, আর একটা কোথায় গেল?

আর একটা কাছাকাছি কোথাও পাওয়া গেল না। সিদ্ধাৰ্থদা সেটাকে তুলে হাতে রাখলেন। তারপর বললেন, আর একটা ব্যাপারও হতে পারে। কাকাবাবু হয়তো ইচ্ছে করেই এটা ফেলে দিয়েছেন–চিহ্ন রাখবার জন্য। ওঁর খোঁজে যদি কেউ আসে, তাহলে এটা দেখে বুঝতে পারবে। পাশ দিয়ে এই যে সরু রাস্তাটা গেছে, চলে এইটা দিয়ে গিয়ে দেখা যাক।

সেই রাস্তাটা দিয়ে একটু দূরে যেতেই একটা বাড়ি চোখে পড়ল। দোতলা কাঠের বাড়ি। কোনও মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। সাবধানে আমরা এগোলাম বাড়িটার দিকে। সিদ্ধাৰ্থদা খুব সাবধানে তাকাচ্ছেন চারদিকে। হঠাৎ আমার কাঁধ চেপে ধরে সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, ঐ দ্যাখো বলেছিলুম, ঐ যে আর একটা ক্রাচ।

একটা গোলাপের ঝোপের পাশে দ্বিতীয় ক্ৰাচটা পড়ে আছে। সিদ্ধাৰ্থদা সেটাও তুলে নিলেন। আর কোনও সন্দেহ নেই। ঠিক জায়গাতেই এসে গেছি।

সিদ্ধাৰ্থদা মুখখানা কঠিন করে বললেন, আিৰ্হ, একটা লোককে লুকিয়ে রাখার পক্ষে বেশ ভাল জায়গা! কেউ টের পাবে না।

আমি ফিসফিস করে বললাম, সিদ্ধাৰ্থদা, এখন ফিরে গিয়ে চট করে পুলিশ ডেকে আনলে হয় না?

এখন পুলিশ ডাকতে যাব? ততক্ষণে ওরা যদি পালায়? এসেছি। যখন, শেষ না দেখে যাব না।

কিন্তু ওরা যদি অনেক লোক থাকে?

তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি সন্তু?

না, না, ভয় পাইনি—

ক্রাচ দুটো দুজনের হাতে থাক। বেশ শক্ত আছে, দরকার হলে কাজে লাগবে।

কয়েকটা গাছের আড়ালে আমরা কিছুক্ষণ লুকিয়ে রইলাম। বাড়িটাতে একটাও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। সোজা কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। পাশাপাশি তিনখানা ঘর, তার মধ্যে ডানদিকের কোণের ঘরটা তালাবন্ধ। আমি বললাম, হয়তো সবাই এখান থেকে আবার অন্য কোথাও চলে গেছে।

সিদ্ধাৰ্থদা গম্ভীরভাবে বললেন, তা হতেও পারে। কিন্তু না দেখে তো যাওয়া যায় না।

সিদ্ধাৰ্থদা, প্ৰায় সন্ধে হয়ে আসছে। এরপর আমরা ফিরবই বা কী করে?

সে ভাবনা পরে হবে। ফিরতে না পারি ফিরব না। কণিষ্কর মাথাটা আমি একবার অন্তত দেখবই।

একটু সন্ধে হতেই আমরা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। এখনও কারুর দেখা নেই। পা টিপে টিপে উঠে গেলাম কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ির পাশের ঘরটাই তালাবন্ধ, পাশের জানলা দিয়ে ভেতরে উঁকি মারলাম। অন্ধকার, ভাল দেখা যায় না। মনে হল যেন একটা চৌপাই-তে একজন মানুষ শুয়ে আছে। চোখে অন্ধকার একটু সয়ে যেতেই চিনতে পারলাম—কাকাবাবু!

সিদ্ধাৰ্থদা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় বললেন, চুপ?

তারপর তালাটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। তালাটা পোল্লায় বড়। সিদ্ধার্থদা বললেন, তালাটা বড় হলেও বেশি মজবুত নয়। সস্তা কোম্পানীর তৈরি। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, ওরা এরকম একটা বাজে। তালা লাগিয়ে রেখেছে। কেন! বাড়িতেও আর কেউ নেই মনে হচ্ছে।

সিদ্ধাৰ্থদা ক্ৰাচের সরু দিকটা ঢুকিয়ে দিলেন তালাটার মধ্যে। তারপর খুব জোরে একটা হ্যাঁচকাটান দিতেই তালাটা খুলে এলো।

সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, দেখে কি মনে হচ্ছে, আমার তালা ভাঙার প্র্যাকটিস আছে? আমি কিন্তু জীবনে এই প্ৰথম তালা ভাঙলাম।

ততক্ষণে আমি দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলেছি। ফিসফিস করে ডাকলাম, কাকাবাবু, কাকাবাবু!

সঙ্গে সঙ্গেই আমার মাথায় একটা প্ৰচণ্ড ধাক্কা লাগল। আমি ছিটকে পড়লাম ঘরের মধ্যে। সিদ্ধার্থদাও পড়লেন এসে আমার পাশে। দাড়াম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

সিদ্ধাৰ্থদা প্রথম আঘাতটা সামলে নিয়েই চট করে উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে গিয়ে টেনে দরজাটা খোলার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। দরজাটা ওপাশ থেকে কেউ টেনে ধরে আছে। একটু ফাঁকও হল না। ধাক্কাধাব্ধি করে নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন সিদ্ধার্থদা।

কাকাবাবু ততক্ষণে উঠে বসেছেন। শূন্য দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, কে?

ঘরের মধ্যে আলো বেশি নেই, কিন্তু মানুষ চেনা যায়। কাকাবাবু আমাদের চিনতে পারছেন না! কাকাবাবুকে কি ওরা অন্ধ করে দিয়েছে! পর মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম, কাকাবাবুর চোখে চশমা নেই। চশমা ছাড়া উনি অন্ধেরই মতন।

আমি বললাম, কাকাবাবু, আমি সন্তু। আমার সঙ্গে সিদ্ধাৰ্থদা—।

কাকাবাবু শান্তভাবে বললেন, তোমরা আবার এরকম বিপদের ঝুঁকি নিলে কেন?

আমি দেখলাম কাকাবাবুর ডান হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ছুটে গিয়ে কাকাবাবুর পাশে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে মেরেছে ওরা?

কাকাবাবু বললেন, ও কিছু না। তোমরা নিজেরা না এসে পুলিশকে খবর দিলে পারতে। এরা বিপজ্জনক লোক।

সিদ্ধাৰ্থদা বেশ জোরে চেঁচিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমরা পুলিশকে খবর দিয়েছি। পুলিশ আমাদের পেছন পেছনই আসছে।

জানলার বাইরে একটা হাসির আওয়াজ শোনা গেল। জানলায় দেখলাম সূচা সিং-এর বিরাট মুখ। সূচা সিং প্রথমেই বললেন-। না, বললেন না, বলল। ওকে আমি মোটেই আর আপনি বলব না। একটা ডাকাত, গুণ্ডা! আমার কাকাবাবুকে মেরেছে!

সূচা সিং বলল, কী খোকাবাবু, তোমার বেশি লাগেনি তো? একটা ছোট্ট ধাক্কা দিয়েছি।

সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, আমার কিন্তু খুব জোরে লেগেছে। আমাকে কী দিয়ে মারলে? লাঠি দিয়ে? অতবড় চেহারাটা নিয়ে লুকিয়ে ছিলে কোথায়?

সূচা সিং বলল, এই ছোকরাটি কে খোকাবাবু? একে তো আগে দেখিনি।

আমি কিছু বলার আগেই সিদ্ধাৰ্থদা বলে উঠলেন, আরও অনেককে দেখবে। পুলিশ আসছে একটু পরেই।

সূচা সিং আবার হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, আসুক, আসুক! অনেক জায়গা আছে। এ বাড়িতে খানাপিনা করুন, আরামসে থাকুন, কই বাত নেই! রাত্তিরে শীত লাগলে কম্বল নিয়ে নেবেন—ঐ খাটের নীচে অনেক কম্বল আছে।

কাকাবাবু খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পায় পায় হেঁটে গেলেন জানলার দিকে। গম্ভীরভাবে বললেন, সূচা সিং, আমার চশমাটা দাও! চশমা নিয়ে তোমাদের কী লাভ?

সূচা সিং খানিকটা অবাক হবার ভাব দেখিয়ে বলল, চশমা? আপনার চশমা কোথায় তা আমি কী করে জানব! হয়তো আসবার সময় কোথাও পড়েটড়ে গিয়ে থাকবে।

না, তোমার লোক জোর করে আমার চশমা খুলে নিয়েছে।

তাই নাকি! খুব অন্যায়!

চশমাটা এনে দিতে বলো।

সে তো এখন এখানে নেই! এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, আপনাকে তো এখন পড়ালিখা করতে হচ্ছে না!

কাকাবাবু হতাশভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমার মনে হল, যেন কণিষ্কর মুণ্ডু কিংবা আর সবকিছুর থেকে চশমাটাই এখন ওর কাছে সবচেয়ে বড় কথা!

সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, পুলিশকে আমি এই জায়গাটার নাম বলে এসেছি। আজ হোক কাল হোক পুলিশ এখানে ঠিক এসে পড়বে।

সূচা সিং বলল, আসুক না! পুলিশকে আমি পরোয়া করি না?

কাকাবাবু বললেন, সূচা সিং, তুমি আমাদের শুধু শুধু আটকে রেখেছ। আমাদের ছেড়ে দাও।

প্রোফেসারসাব, আপনাকে ছেড়ে দিতে কি আমার আপত্তি আছে? আপনাকে এক্ষুনি ছেড়ে দিতে পারি। আপনি আমার কথাটা শুনুন।

তোমার ধারণা ভুল। আমি সোনার খবর জানি না।

ঠিক আছে। এখন আপনার নিজের লোক এসে গেছে, বাতচিত করুন। দেখুন, যদি আপনার মত পাল্টায়—

সূচা সিং, পাথরের মুণ্ডুটা আমার কাছে দিয়ে যাও। ওটা যেন কোনওরকমে নষ্ট না হয়। ওটা তোমার কোনও কাজে লাগবে না।

ঠিক থাকবে, সব ঠিক থাকবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress