হোক ভয়ংকর, তবু সুন্দর
তারপর মাস তিনেক কেটে গেছে। কলকাতায় ফিরে এসেছি, এখন আবার ইস্কুলে যাই। সামনেই পরীক্ষা, খুব পড়াশুনা করতে হচ্ছে। অনেকদিন পড়াশুনো বাদ গেছে তো!
তবু প্রায়ই কাশ্মীরের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে হয় স্বপ্নের মতন। গল্পের বইতে যে রকম পড়ি, সিনেমায় যে-রকম দেখি-আমার জীবনেও সে-রকম ঘটনা ঘটেছিল। অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না।
এক একবার ভাবি, সেই পাইথনটা গুহার একেবারে ভিতরের দিকে না থেকে যদি বাইরের দিকে থাকত? যদি আমি পড়ে যাওয়া মাত্রই কামড়ে দিত? তাহলে এখন আমি কোথায় থাকতাম? সেই কথা ভেবে নতুন করে ভয় হয়। কিংবা তাঁবুর মধ্যে সূচা সিং-এর দলবল যখন আমার মুখ বেঁধে রেখেছিল, তখন ওরা তো আমাকে মেরে ফেলতেও পারত!
কী সব ভয়ংকর দিনই গেছে। হোক ভয়ংকর, তবু কত সুন্দর। আমাকে যদি আবার ঐ রকম জায়গায় কেউ যেতে বলে, আমি এক্ষুনি রাজি! আবার ঐ রকম বিপদের মধ্যে পড়তে হলেও আমি ভয় পাব না! ঐ কটা দিনের অভিজ্ঞতাতেই যেন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।
রিণি আমার ওপর খুব রেগে গেছে। আমরা ঐ রকম একটা অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছিলাম, আর ওরা বসে ছিল শ্ৰীনগরে-এই জন্য ওর রাগ। কেন আমরা ওকে সঙ্গে নিইনি! আমি বলেছি, যা যা ভাগ। তোকে সঙ্গে নিলে আরও কত বিপদ হত তার ঠিক আছে! সূচা সিং-এর রাগী মুখ দেখলেই তুই অজ্ঞান হয়ে যেতিস!
রিণি মন থেকে বানিয়ে বানিয়ে সূচা সিং-এর রাগী মুখের একটা ছবি এঁকেছে। সেটা মোটেই সূচা সিং-এর মতন দেখতে নয়, বক-রক্ষসের মতন।
সিদ্ধাৰ্থদার হাতে বুকে এখনও প্লাস্টার বাঁধা। সিদ্ধাৰ্থদা পাহাড় থেকে অনেকখানি গড়িয়ে পড়েছিলেন সূচা সিং-কে সঙ্গে নিয়ে। সূচা সিং-এর দেহের ভারেই সিদ্ধাৰ্থদার বুকের তিনটে পাঁজরা ভেঙে গিয়েছিল, আর ডান হাতটা ছেচে গিয়েছিল খানিকটা! সিদ্ধাৰ্থদা এখন আস্তে আস্তে ভাল হয়ে উঠছেন। সিদ্ধাৰ্থদার গর্ব এই, তবু তো তিনি একবার অন্তত সেই মহা মূল্যবান ঐতিহাসিক জিনিসটা ছুতে পেরেছিলেন।
সূচা সিং-ও বেঁচে গেছে। তারও চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে–এখন সে জেলে। সূচা সিং-এর ফুটফুটে ছেলেমেয়ে দুটির কথা ভেবে আমার কষ্ট হয়। ওরা যখন বড় হয়ে শুনবে, ওদের বাবা একজন ডাকাত, তখন কি ওদের খুব দুঃখ হবে না? চোর-ডাকাতের ছেলে-মেয়েরা নিশ্চয়ই খুব দুঃখী হয়।
কাকাবাবুও সেদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওঁকে তখন ধরাধরি করে খুব সাবধানে নিয়ে আসা হয়েছিল কুদ নামে একটা জায়গায়। সেখানে একজন ডাক্তার পাওয়া গিয়েছিল ঠিক সময় মতন। কারনেল দত্তা যে আমাদের কত সাহায্য করেছিলেন তা বলে বোঝানো যায় না। কাকাবাবু অবশ্য দু তিনদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন খানিকটা। তারপরই আবার সেই পাথরের মুখ খুঁজতে বেরিয়েছিলেন।
সূচা সিং যেখান থেকে বাক্সটা ছুঁড়ে দিয়েছিল, সেখান থেকে ওটা ঝিলম নদীতেই পড়ার কথা। কিন্তু তিনদিন ধরে ঝিলম নদীর অনেকখানি এলাকা জুড়ে খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে, পাওয়া যায়নি। সেই পাহাড়টার সব জায়গাও তন্নতন্ন করে খোঁজা বাকি থাকেনি। অমন মূল্যবান জিনিসটা কোথায় যে গেল, কে জানে?
কাকাবাবু আমাকে বারণ করেছেন, ওটার কথা কারুকে বলতে। কারণ, এ রকম একটা ঐতিহাসিক ব্যাপারের সত্যি সত্যি প্ৰমাণ না পেলে কেউ বিশ্বাস করে না। আমার কিন্তু সবাইকে ডেকে ডেকে শোনাতে ইচ্ছে করে।
আমার এখনও ধারণা, কাঠের বাক্সটা সহজে ড়ুবে যাবে না। ঝিলম নদীর তীরে কোথাও না কোথাও একদিন ওটাকে আবার খুঁজে পাওয়া যাবে। সেদিন আমাদের কথা সবাই বিশ্বাস করবে।