ভ্রমর কইও গিয়া : 05
এক দুপুরে আলতাফের বন্ধু মনজুরের স্ত্রী রুবিনা আসে আমার কাছে। গল্প করতে। কাছেই বাড়ি। কাজ নেই। স্বামী দুবাই গেছে। অবসর কাটে না। আমার সঙ্গে অবসর কাটাতে এসেছে।
রুবিনা ঠোঁটে হাসি চেপে বলে–ভাবী, বাচ্চা টাচ্চা নিচ্ছেন না, আরও এনজয় করে পরে নেবেন বুঝি?
–এনজয় মানে?
রুবিনা অপ্রস্তুত হয়। স্বামী স্ত্রীর ‘এনজয়’ কী তা যদি বিবাহিত মেয়ে হয়ে বুঝতে পারি তবে তো করবার কিছু নেই তার।
সে কাটিয়ে নিয়ে বলে–হুম, লুকোনো হচ্ছে! রুবিনার সঙ্গে আমি সোয়াসদি, ভিডিও কানেকশন, স্কাই রুমের খাবার এসব নিয়ে কথা বলি। তুচ্ছ কথা বার্তা। ও এসব কথায় থাকে না। নাটাই থেকে সুতো ছাড়ে আমাকে ওড়ায়। চোখ ছোট করে হাসে। বলে–আলতাফ ভাই কি রাতে খুব জ্বালায় আপনাকে?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিই–হ্যাঁ।
রুবিনা বিছানায় আরাম করে বসে। বলে–কটা পর্যন্ত?
–মানে?
–মানে কটায় ঘুমোতে দেয়?
হেসে বলি–ঘড়ি দেখি না।
–তার মানে অনেকক্ষণ চলে! মনজুর তো একঘন্টার আগে শেষ করে না। রুবিনার ঠোঁটের কোণে হাসি ঝিলিক দেয়।–আলতাফ ভাইএর সময় কি রকম?
ও রসালো কিছু আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছে। কিন্তু এসব কথা কি করে বলতে হয়, এসব কী ভাষায় বর্ণনা করা যায়, আমি জানি না। আলতাফ আমাকে শেখায়নি কিছু। আমি চুপ হয়ে থাকি। রুবিনা আমার হাত টেনে কাছে বসায়। বলে–এত লজ্জা কিসের? আমাদের সঙ্গে মিশলে লজ্জা কোথায় পালায়, বুঝবেন। আমার জিভ তো অনেক ভাল, লিপি ভাবীর সঙ্গে কথা বললে যে কী অবস্থা হবে। ও এত স্ল্যাং জানে। রুবিনা জোরে হেসে ওঠে। আমি অবাক হয়ে দেখি কী প্রশান্তি ওর সারা মুখে। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করি, আমি নিজেই প্রস্তুত ছিলাম না এই প্রশ্নটি করবার জন্য–আচ্ছা একঘন্টার কথা কী যেন বললেন!
রুবিনা চায়ে চুমুক দিয়ে আবার হাসে, বলে–মিনিমাম আধঘন্টা, ম্যাক্সিমাম একঘন্টা তো হয়ই।
–কী হয় একঘন্টা?
–কী আবার? যা করে পুরুষলোকে। আমারও পিক আসতে আধঘন্টা এক ঘন্টা লাগে। কখনও কখনও অবশ্য দশ পনেরো মিনিটেও হয়।
–পিক মানে?
–অরগাজম।
–অরগাজম মানে?
–অরগাজম জানেন না?
–না তো!
আমার চোখে অপার কৌতূহল। রুবিনার আরও পাশে সরে আসি। তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়। বলে-ইজ ইট?
মাথা নেড়ে বলি-হ্যাঁ।
–ওহ সো কিড ইউ আর! আলতাফ ভাই বলে না কিছু?
–না।
–অরগাজম মানে কী আপনি বুঝতে পারছেন না? ওই যে সারাশরীরে একধরনের ফিলিংস হয়। তীব্র এক ভাল লাগা যাকে বলে। এরপর ঘুম নেমে আসে।
–আমার তো শরীরে একটা কষ্ট হয়। ঘুম হয় না। সারারাত ছটফট করি। রুবিনা চমকে ওঠে। বলে–বলছেন কী ভাবী! আপনি ছটফট করেন, আর আলতাফ ভাই কী করেন?
–ওর ঘুম ভাল হয়।
রুবিনার বিস্ময় কাটে না। যেন ভূতুড়ে একটি গল্প শুনছে সে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে ‘আহারে’ বলে আমাকে জড়িয়ে জিহ্বায় চুকচুক শব্দ করে। নিজেকে বড় অসহায় লাগে। বড় একা। বড় বঞ্চিত।
আবার সে জিজ্ঞেস করে–ওরকম হয় না? খুব একটা ভাল লাগা সমস্ত শরীরে? কখনও হয়নি?
আমি অসহায় মাথা নাড়ি। ভাল লাগার তীব্র কোনও বোধের সঙ্গে আমি কখনও পরিচিত নই। আমাকে আলতাফ এরকমই ভাবতে শেখায় ব্যাপারটি এক তরফা ওর আনন্দের জন্য। এ থেকে যে আর কিছু জোটে তা আলতাফ আমাকে বলে না। আলতাফ কি জেনেও বলে না নাকি সে জানেই না, বুঝি না।
রুবিনা যাবার সময় বলে–আপনারা ডাক্তার দেখান ভাবী। আলতাফ ভাইকে বলবেন ডাক্তার দেখানো জরুরি।
আমার মাথায় এই একটি ব্যাপার ঘোরে। ঘুরতেই থাকে। আমাকে মুক্তি দেয় না কিছুতে। জগতের আর কিছুতে আমার মন বসে না।
আলতাফ এলেই আমি নরম কণ্ঠে বলি–আমার একটা কথা তুমি রাখবে?
–কী কথা?
–আগে রাখবে কি না বল।
–আগে তো শুনি।
–চল ডাক্তারের কাছে যাই।
–কেন ডাক্তার কেন?
–আমাদের দুজনেরই ডাক্তার দেখানো উচিত।
–তোমার ইচ্ছে হলে তুমি দেখাও, আমার দরকার নেই।
–আমার মনে হয় তোমারই প্রব্লেম। ডাক্তার দেখালে যদি ঠিক হয় তবে যাব না কেন আমরা, বল?
–হীরা, প্রব্লেম আসলে তোমার। তুমি পেয়েছ কী বল তো? সংসারে মন নেই তোমার। সারাদিন এক চিন্তা। অফিস থেকে ফিরে তোমার হাসি মুখ কদিন দেখি বল। আমি তো তোমাকে এ ধরনের মেয়ে ভাবিনি। এত খারাপ তুমি এ তো আমি বিয়ের আগে জানতাম না। তোমার আসলে মেন্টাল প্রব্লেম। তোমারই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার। পড়ালেখা কম করেছ, বিদ্যা নেই বুদ্ধি নেই। সারাদিন সেক্স সেক্স সেক্স। যত্তসব।
আলতাফের মুখ চোখ লাল হয়ে ওঠে রাগে। আমি মনে মনে বলি–তার চেয়ে তুমি ছুঁয়ো না আমাকে। তুমি আমার ভেতরে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বেলে দাও, নেভাও না। আমি কেবল পুড়ে মরি।
আলতাফ চেঁচাতে থাকে–তুমি কী ভাব আমি বুঝি না কেন তুমি এমন কর। কেন তুমি এসব বিষয় এত জানো, এত কেন অভিজ্ঞতা তোমার!
–বল, কেন করি? আমি ঠাণ্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি।
–এতদিন সবাই অভিযোগ করেছে। মেয়ে উদাসিন থাকে, মেয়ে সারাদিন কী যেন ভাবে। আমি গা করিনি। এখন বুঝি তোমার এসব অভিজ্ঞতা আগে থেকেই আছে। তোমার এক্সপোজার ছিল। এখনও তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, বাজে মেয়েদের মত বাজে জিনিস নিয়ে ভাববে না। অন্তত আমার বাড়িতে তোমার এইসব নষ্টামি চলবে না। মনে মনে বলি–আমি তো ভাবতে চাই না। তুমি আমাকে রাতে রাতে ভাবাও। তুমি না ভাবালেই আবার আমি আগের মত হাসব। তোমার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করব কখন আসবে। কখন এসে বলবে হীরে আমার, মানিক আমার। আমি তোমার জন্য ঘর ভরে রজনীগন্ধা সাজিয়ে রাখব। তুমি খুব খুশি হবে, বলবে আমার লক্ষী সোনা বউ তুমি আমার প্রাণ, তোমাকে ছাড়া আমি বোধহয় মরেই যাব গো। তুমি যে আমাকে ভালবাস তা দূর থেকে বলবে, কাছে আসবে না, ছোঁবে না আমাকে। আমি তোমার স্পর্শ ছাড়া আর সব চাই। তাহলেই আমার আর কোনও প্রব্লেম হবে না।
রাতে শুতে চাই অন্য বিছানায়। আলতাফ মানে না। সে দাঁড়ায় এসে অন্য বিছানার সামনে। বলে-ওঠ। কণ্ঠে আদেশ তার। উঠতেই হবে। রক্তচক্ষু স্বামী দাঁড়িয়ে আছে পাশে, পঁড়িয়ে থাকুক। আমি বলি–আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
–ঘুম পাক তবু ওঠ। বিয়ে করেছি আলাদা বিছানায় থাকবার জন্য নয়।
আলতাফ আমার হাত ধরে টেনে তোলে। নিয়ে যায় পাশের ঘরে। বিছানায়। পাতলা নাইটি পরা আমার। একটানে খুলে ফেলে। একসময়, বিয়ের পর কদিন, এই স্পর্শই কী ভীষণ আনন্দ দিত, সবটুকু হোক, কিছুটা হলেও তা দিত। অথচ আলতাফের সেই হাত, সেই হাতের স্পর্শই এক বিবমিষা জাগায় ভেতরে। আলতাফের গোঙানোকে লাগে যেন কাদা পেয়ে শুয়োর ঘোৎ ঘোৎ করছে। চুমু দিতে চায়। মুখ সরিয়ে নিই। আমি যে এই সব চাচ্ছি না, এসব যে আমার ভাল লাগে না–তা আমার শরীরের নির্লিপ্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিই তাকে।
সে তার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আমাকে পিষে ফেলতে চায়। মুখ থেকে ভুরভুর করে দুর্গন্ধ বের হয়। বিড়বিড় করে বলে–তোমার অডাসিটি দেখে আমি অবাক হই। কি না করেছি তোমার জন্য, বন্ধু বান্ধবের বাড়িতে আড্ডা, ঘোরাঘুরি, চায়নিজ খাওয়া, ভেবেছিলাম তোমাকে ব্যংকক সিঙ্গাপুরও নিয়ে যাব এমাসে। এত করি, আর
সে বলে আমার নাকি দোষ!
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি–তোমারই দোষ। আমি রুবিনা ভাবীর কাছে সব শুনেছি।
–মনজুরের বউ এসেছিল?
–হ্যাঁ, বলল মনজুর নাকি অনেকক্ষণ থাকে।
–মানে?
–মেয়েদেরও নাকি অরগাজম হয়।
–এসব কি ওই মহিলা শিখিয়ে দিয়ে গেছে?
আমি কথা বলি না। আলতাফের কথায় মনে হয় দোষ যেন তার নয়, দোষ রুবিনার। রুবিনার দোষেই আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আলতাফ ঝট করে উঠে যায় বিছানা থেকে। আড়চোখে লক্ষ্য করি প্রচণ্ড অস্থিরতা তার মধ্যে। বাথরুমে ঢুকে সে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। মাথা ধোয়, মাথায় পানি ঢাললে মন নাকি শান্ত হয়, তাই। আলতাফ মন শান্ত করছে। মেয়েদের যে অরগাজম হয় তা যেন আলতাফ প্রথম জানল। আলতাফের কি হয় ওইসব রুবিনা যা বলেছিল? কী জানি বুঝিও না। ও বলেও না কিছু। আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে ব্যাপারগুলো। অষ্পষ্ট ঠেকে সব। যেন কী একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে স্বামী-স্ত্রীতে। বড় রহস্যময় সব। এ যদি কোনও দেওয়াল হয় আমি ভেদ করতে পারিনি। আমার কাছে সবই দুর্বোধ্য লাগে। নাগাল পেতে চাই, দূরের লাগে সব। আলতাফের কাছে বুঝতে চাই। এমনও হয়েছে আমি তাকে বলেছি তোমাকে আমি দেখতে চাই পুরোটা।
–মানে? কি দেখবে?
–তোমার শরীর। আমি সামান্য লজ্জিত না হয়েই বলি।
–আমার শরীরে দেখার কী আছে?
–আছে।
আলতাফ রাগ হয় আমার কথায়। বলে রুবিনারই কাজ এসব বুঝি। ও তোমাকে উল্টোপাল্টা কী সব বুঝিয়েছে। বাজে মেয়েলোক।
–স্বামীর শরীর আমি দেখব না? বউরা কি দেখে না?
–তুমি কী ইঙ্গিত করছু আমি কি বুঝি না?
–হ্যাঁ বোঝ। আজকাল একটু বেশিই বোঝ তুমি।
আলতাফ লুঙ্গিখানা কষে পড়ে। সিগারেট ধরায়। ঘন ঘন ফোঁকে। ঘর ধোয়ায় ভরে যায়। এয়ার কুলার চলে ঘরে, এর মধ্যেই ঘাম ঝরে আলতাফের। ভনভন করে একটি মাছি ঘোরে। রাতে মাছি আসে কোত্থেকে! কানের কাছে মাছিটি ভন ভন করতেই থাকে। আমি কোথায় তাড়াব তাকে। এই ঘরের ভেতরই সে ঘুরবে। ভনভন করে ঘুরবে।
আলতাফকে দেখতে চাইলাম। চাইতেই পারি। ওর এত ক্ষেপে উঠবার কারণ কী। নাকি লজ্জা পেয়েছে। নাকি ভয়! একটির পর একটি সিগারেট সে পুড়তে থাকে। আমার পক্ষ থেকে কী করলে আলতাফ খুশি হবে জানি না। আর ওকে খুশি করবার সব দায়িত্ব আমারই বা কেন? আমি তো এমনও ভাবতে পারি আমি যা চাই তার কতটুকু পালন করছে আলতাফ! একটি প্রশ্নও মনে উঁকি দেয়। আলতাফ কেন এমন রিয়েক্ট করল। তার সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখবার অধিকার কি আমার নেই? আমার গুলো সবই সে দেখছে, দলছে, পিষছে; তবে?
আলতাফকে ঠিক আমি বুঝতে পারি না। সেদিন সারারাত সে আর ঘুমোল না। তাকে দেখাতে বলেছিলাম, দেখাল না। যোজন দূরত্ব নিয়ে শুয়ে থাকল। বুঝি না, দেখালে কী ক্ষতি হত ওর। ও তো পঙ্গু নয়, স্ত্রীর আবেগের সামান্য মূল্য ও দিল না। আমার কেমন সন্দেহ হয়। আলতাফের কোনও শারীরিক ত্রুটি আছে কি? আমার দুশ্চিন্তা ঘোচে না। কিন্তু একটি ব্যাপার বুঝি, আলতাফ আমাকে যেন কিছু লুকোয়। একদিন হঠাৎ বাথরুমে ঢুকেই দেখি আলতাফ কিছু একটা লুকোচ্ছে, শিশি টিশি জাতীয়। বললাম কী হাতে তোমার? বলল ও কিছু না এমনি। কিছু না হবে কেন? স্পষ্ট দেখলাম কিছু। আমাকে লুকিয়ে আলতাফ ওই শিশি গুলো নিয়ে কিছু করে এরকম মনে হয়েছিল আমার। তারপর লক্ষ্য করতাম শোবার আগে বাথরুমে ও অনেকক্ষণ সময় ব্যয় করে। জিজ্ঞেসও করেছি কত, কী কর অতক্ষণ ওখানে? আলতাফ মুখ গম্ভীর করে বলে কী করি তা দেখাতে এখন তোমাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে হবে। তাই না?
আলতাফকে আমার সন্দেহ হয়। সে কেন ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। সে কেন আমাকেও দেখাতে চায় না শরীর? তার কি কোনও প্রব্লেম শরীরে? আমার দুশ্চিন্তা ঘোচে না। ওর যা কিছু, আমি কেন জানব না সব? আমি তো একটু একটু করে আমার আনন্দ বেদনা সবই জানিয়েছি তাকে। আমি যদি অবাধে উমুক্ত হতে পারি, তার বেলায় বাধা কেন?