ভ্রমর কইও গিয়া : 03
সারারাত কী করে আলতাফ আমার সঙ্গে? কিছু কি করে? কিছু তো করে না, করবার চেষ্টা করে শুধু। বিয়ের পর পর আমি অনেকদিন তার চেষ্টায় সাহায্য করেছি। সে বলেছে–এরকমই হয়। সব ছেলেদেরই হয়।
–কিন্তু আমার এমন লাগে কেন? আমার প্রশ্নে এক তাল সরলতা থক্থক্ করে।
-–কি লাগে? আলতাফ জিজ্ঞেস করে।
–এমন অস্থির অস্থির?
–ও তোমার প্রব্লেম।
–আমার প্রব্লেম?
–হ্যাঁ।
আলতাফ যখন বলে এটা আমার প্রব্লেম, আমি বুঝে পাই না প্রব্লেম কী করে আমার হয়। বড় লজ্জা হয়। অপরাধবোধও কাজ করে আমার মধ্যে। কিছুতে মন বসে না কোনও কাজে। রাতে ও যখন বাতি নিভিয়ে শুতে আসে; আমার, আমি লক্ষ্য করি দ্রুত বাস পড়ছে। অপরাধবোধ থেকে একধরনের সিটিয়ে থাকা ব্যাপার ঘটে আমার মধ্যে। আলতাফ শুয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে–’বউ আমার বউ সোনা, আমার হীরে, হীরের টুকরো বউ।‘ বলে বলে আমার ঠোঁটে ও গাঢ় করে চুমু খায়। যখন চুমু খায়, আমি বুঝে পাই না আমার এমন লাগে কেন। কোথায় যেন, কেমন যেন ভাল লাগে। যখন বলে–’হীরে আমার, গায়ে এটা কী পড়েছ, খুলে ফেল তো। আমার খুলতে হয় না, ও নিজেই খুলে দেয়। খুলেই বহুদিনের না খাওয়া ভিখিরি সামনে গরম ভাত পেলে যেমন গোগ্রাসে খায়, তেমন আমাকে, আমার সর্বাঙ্গ ও খায়। আমার সারা শরীর শিরশির করে। লজ্জা ভয় অপরাধবোধ টোধ কিছুই থাকে না। কোথায় যেন, কেমন যেন বড় ভাল লাগে আমার। আমি ওকে দু হাতে জড়িয়ে ধরি। ও যখন আমার স্তনজোড়ায় মুখ ঘসে, আমি নিজেই অবাক হই অবচেতনে আমার কণ্ঠের ‘আহ আহ শব্দ শুনে। আমার এত কেন ভাল লাগে! আলতাফও গোঙায় খুব, গোঙাতে গোঙাতে আমার সারা শরীরে ও হাত বুলোয়, চুমু খায়। আমি বুঝি, আমার কোথায় যেন জলের স্রোত নামছে, আমি ঘেমে উঠছি, ভরে উঠছি। আমি ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরি। ও আমার শরীরের সঙ্গে মিশে যেতে চায় কিন্তু কী একটা হয় ওর, ও হঠাৎ, আমি কিছু বুঝে উঠবার আগে, আমার গায়ের ওপর নেতিয়ে পড়ে। আমার তখনও দ্রুত বাস পড়ছে। তখনও আমার শরীরের ভেতর ভীষণ এক সমুদ্র গর্জে উঠছে। আলতাফ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। আর আমি ছটফট করি। এপাশ ওপাশ করি। আমার অস্থির লাগে। আলতাফ নাক ডাকে। আমার প্রব্লেম কোথায়, খুঁজে বেড়াই। খুঁজে পাই না। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় এই যে অস্থির লাগে এটিই বোধহয় প্রব্লেম। আমার তো শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। আমার যে ঘুম আসে না!
প্রব্লেম কি তবে এই ঘুম না আসাই! আলতাফের ঘুমের শব্দ শুনি আর আমার অস্থিরতা বাড়ে। ইচ্ছে হয় ওর মত আরাম করে ঘুমোতে, ওর মত তৃপ্তি নিয়ে। ওর মত কোনওদিকে না ফিরে। কে ঘুমোল কে ঘুমোল না এ নিয়ে যেমন ওর ভাববার সময় নেই, আমারও যদি সময় না হত। আমি যদি নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার কপালে চুমু খায় আলতাফ। আমার তখন এত ভাল লাগে যে রাতে খামোকা ঘুম না হওয়ার জন্য নিজের ওপরই রাগ হয়। উঠে ওর জন্য পরাটা মাংস করা, জামা জুতো এগিয়ে দেওয়া, দরজায় দাঁড়িয়ে ওর অফিসে চলে যাওয়া দেখতে বড় ভাল লাগে আমার। গোপনে সুদর্শন যুবকটির জন্য অদ্ভুত এক ভালবাসা জন্মায়।
আলতাফ আমাকে প্রায় বুঝিয়ে ফেলে যে–এরকমই হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরকম ঘটনাই ঘটে। তবে আমার যে অস্থিরতা, এগুলো হচ্ছে আমার দোষ। দোষ কাটাতে চাই, অস্থিরতা কমাতেও। অস্থিরতা তো আর কমে না, লুকিয়ে ঘুমের ওষুধ খাই। অফিসে খাটাখাটনি বেশি হলে আলতাফ যেদিন সকাল সকাল শুয়ে পড়ে, সেদিন আমি লক্ষ্য করেছি আমার কোনও যন্ত্রণা হয় না। আমি দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ি। আসলে ও চুমু টুমু না খেলে, কাপড় জামা খুলে সারা শরীরে উষ্ণ হাত না বুলোলে আমার ভেতরে যে খুব গোপনে একটি সমুদ্র জাগে, সেটি জাগে না। আর না জাগলে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে না।
এরকম চলে দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত। এরকম অস্পষ্ট, অপুষ্ট একটি সম্পর্ক আমাকে সরিয়ে দেয় অন্ধকারে বাড়ানো আলতাফের হাত, ঠোঁট। আমি সেদিন বলেছি–আমার ভাল লাগছে না। শরীরে হাত দিও না শুধু শুধু।
–মানে? আলতাফ চমকে ওঠে আমার আচরণে।
–আমি ঘুমাব। পাশ ফিরে শান্ত কণ্ঠে বলি।
–আরেকটু পরে ঘুমোও। একসঙ্গে ঘুমোব দুজন। আলতাফ তার দিকে আমাকে টেনে নিয়ে বলে।
–না তুমি জানোও না তুমি যে একা ঘুমোও আমার ঘুম হয় না। বিরক্ত লাগে।
–বল কী? … তোমার সমস্যাটা ঘুচল না তা হলে!
–সমস্যা আমার না কি তোমার আগে ভেবে দেখ।
আমি লক্ষ্য করে অবাক হই আমার কণ্ঠে আগের সেই বিনয় নেই। একটু যেন রূঢ় শোনায় কথাগুলো।
আলতাফ বলে–তোমার শরীরে হাত দিতে না করছ আমাকে?
যেন অসম্ভব একটি কথা আমি বলেছি এমন তার গলার স্বর।
-হ্যাঁ করছি। আমি পাশ ফিরে চোখ বুজে উত্তর দিই। এসব কথাবার্তার চেয়ে আমার যে ঘুমিয়ে পড়া জরুরি তা বোঝাতে চাই। আলতাফ মানে না। জিজ্ঞেস করে-কেন?
–জানি না।
–তোমাকে জানতে হবে। আঁঝাল কণ্ঠস্বর আলতাফের।
আমি চুপ করে থাকি। আর আলতাফ হেঁচকা টানে খুলতে থাকে আমার শাড়ি। আমি এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলি–এসব আমার ভাল লাগে না।
–আমি তোমার স্বামী, মাইণ্ড ইট। এসব ভাল লাগতেই হবে। আলতাফের কণ্ঠস্বর কঠিন শোনায়।
আমি অস্বীকার করছি না সে আমার স্বামী। তাকে আমার ভাল লাগে একথাও সত্যি, যখন সে অফিসের জন্য কাপড় চোপড় পরে, নাস্তার টেবিলে বসে, যখন হাত নেড়ে হেসে চলে যায় দেখতে ভাল লাগে। ব্যস। যখন ফিরে আসে, গল্প করে, হাসে–ভাল লাগে কিন্তু ভাল লাগে না আমার শরীরখানায় আঙুল ছোঁয়ালেই, শরীরে হাত দিলে শরীর আমার অস্থির হয়, অস্থিরতা কেন ভাল লাগবে আমার? নিজের শরীরকে প্রবোধ দেব এত ক্ষমতা আমার নেই। এত ক্ষমতা আমি অর্জন করিনি। যদি ঘুমিয়ে থাকি, আমি তো আর বলছি না ঘুমের মধ্যে আমি এই চাই সেই চাই; কিন্তু যদি জাগাও আমাকে, জাগলে আমার নানা কিছু চাই, আমি স্নান করব খাব বেড়াব খেলব। যদি নানা কিছুর ব্যবস্থা না করতে পারো, তবে দয়া করে আমাকে জাগিও না।