ভ্রমর কইও গিয়া : 16
মনজু কাকা বলেছেন বাবা ফোন করেছেন তার অফিসে। আসবেন। আমার প্রসঙ্গে কোনও কথা হয়নি। আমি কিন্তু অনুমান করি বাবা সব জেনেই আসছেন। আমি এর মধ্যে আরও একটি জিনিস ভেবে নিই, তা হল, কাজি অফিসে গিয়ে আলতাফের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলব। ঝুলে থাকা ব্যাপারটি আমাকে হঠাৎ হঠাৎ জ্বালায়। একদিন ছুটি নেব অফিস থেকে। সারাদিনে তালাকনামার কাগজপত্র পুরণ করব আর সেলেব্রেট করব দিনটি। তালাক নামা পেয়ে আলতাফের কী রকম রাগ ধরবে ভেবে আমার বেশ আনন্দ হয়। নিশ্চয় সে রাগে ফুলে উঠবে। ফুঁসে উঠবে। হাত কামড়াবে। সারা বাড়ি দাপাবে। ওর মা বলবে মেয়ের সাহস কত, আগেই বলেছিলাম মেয়ে খারাপ, আলতাফের মা বিশ্বাস করবেন ছেলে তার সৎ সাহসী সমর্থ পুরুষ আর চরিত্রহীন হলাম আমি; তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আলতাফই একমাত্র জানে তার দোষ দুর্বলতা। সে-ই জানে তাকে ছেড়ে যাবার কী কারণ আমার। যেদিন তালাকের কাজ করব, আমি সিদ্ধান্ত নিই, দিনটি আমি উদযাপন করব। অনেকদিন পর শাড়ি পরব, সাজব। সঙ্গে সেদিন কায়সার থাকলে ওকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াব। দুপুরে কোথাও খাব।
এরকম যেদিন ভাবলাম, তার পরদিন অফিস থেকে ফিরেই দেখি কায়সার আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সে টিউশনি ঠিক করে এসেছে আমার জন্য। তিনটে টিউশনিতে টাকা পাব আড়াই হাজার! চাকরিটি ছেড়ে দেওয়া যে ভাল আমাকে বোঝাতে এসেছে সে। চাকরিটি সময় বেশি খায় বলেই ওর আপত্তি। কায়সারের সঙ্গে সেদিন হাঁটতে হাঁটতে কাটাবনের মোড় অবধি যাই, সে আমাক দু’হাত ভরে রজনীগন্ধা কিনে দেয়, এত ফুল, ফুলের এত সুবাস আমি রাখব কোথায়! মনে পড়ে কতবার আলতাফকে বলেছিলাম অফিস থেকে ফেরার পথে রজনীগন্ধা এনো। আলতাফ বলেছিল দুর ওসবে পোকা হয়। পোকা হোক, তবু তো সুগন্ধ দিচ্ছে, মৃত্যু আছে বলে আমরা কি জীবনকে গ্রহণ করি না! গ্রহণের আনন্দ আলতাফ একেবারেই বোঝে না। আলতাফ আমাকে জয় করতে চেয়েছিল ওর অগাধ বিত্ত দিয়ে, ওর সৌন্দর্য দিয়ে; পারেনি। আর কায়সার তার আহামরি রূপ ছাড়াই, বিত্ত ছাড়াই আমাকে জয় করে ফেলেছে। আমি অভিভূত হচ্ছি দিন দিন। একদিকে কায়সার, আরেক দিকে পুরো জগৎ। আমার সামনে আর সব ধুসর হয়ে যায়। আমি অনেকদিন ভাল করে চুল আঁচড়াই না, ভাল কাপড় পরি না, মনে হত কী প্রয়োজন এইসবে! জীবন তো শেষ হয়ে গেল, গ্লানিময় জীবন। অথচ আশ্চর্য–চুল এখন শ্যাম্পু করে উড়িয়ে দিই, আড়ং থেকে জামা কিনে আনি, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যখন দেখি, কায়সারের চোখ দিয়ে দেখি। কায়সার একদিন বলে–তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। শুনে আমার লজ্জাও লাগে আবার ভালও লাগে। আমার ভাল লাগার কোনও সীমা থাকে না। দিন রাত আমি ডুবে থাকি অতল ভালবাসায়। আমি বুঝি আমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। আমি ভুলে যাচ্ছি আমি একটি রক্ষণশীল ঘরের মেয়ে। আমার একটি স্বামী আছে। এখনও আমি আইনত তার কাছে বাধা, এখনও সে ইচ্ছে করলে এক পাড়া মানুষের সামনে আমার ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আমার শক্তি নেই বাধা দেবার। লোকে বলবে স্বামী যখন, তার তো অধিকারই আছে অবাধ্য স্ত্রীকে যেমন করেই হোক বাগে আনবার।
এর মধ্যে বাবা আসেন অফিসে। এসে আমাকে দেখে যত তাঁর অবাক হবার কথা তত হন না। আমি অনুমান করি তিনি জানেন আমি এই অফিসে কাজ করি। আমার চোখে চোখ পড়ে তার। চোখ নামিয়ে সোজা ঢুকে যান মনজু কাকার রুমে। রুম থেকে বেরিয়ে আসেন ঘণ্টাখানেক পর। এম ডির পাশের রুমেই আমি বসি, আমাকে ডিঙিয়েই তাঁকে যেতে হবে। আমি ভেবেছিলাম তিনি আমার সামনে দাঁড়াবেন এবং অড কোনও সিচুয়েশনে আমাকে পড়তে হবে। আমি প্রস্তুত ছিলাম যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য। তিনি যদি আমাকে উঠে যেতে বলেন, আমি যাব না। তিনি যদি আলতাফের প্রসঙ্গ টানেন, বলব আমি তাকে ডিভোর্স দিচ্ছি। তিনি যদি বলেন চাকরি করা চলবে না, আমি বলব আমি চাকরি করবই। আমি প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে আমি কী করব কী করব না সেটা আমি বুঝব। যদি বলেন বাড়িতে চলে আয়, হোস্টেলে থাকা চলবে না, সে ক্ষেত্রেও বলব যেদিন আমার ইচ্ছে করে সেদিন যাব। আমাকে জোর করলে আমি যাব না। আমাকে জোর করলে আমিও জোর করব। গায়ের শক্তি যতটা খাটানো যায়, খাটাব। যদি ভয় দেখান, কী ভয় দেখাবেন আর! এই অফিসের লোক, অফিসের বাইরের লোকেরা বাবার যুক্তি মেনে নেবেন জানি। বলবেন বাবা তো আমার ভালর জন্যই করছে। আমি মানব না। অভিভাবকরা একটি নির্দিষ্ট ছকে মেয়েদের ভাল চান। সেই ছকে নিজের জীবনকে ফেলে নিজেকে আমি অনেক অপমান করেছি। বাবার বা কোনও অভিভাবকের সাধ্য নেই বোঝেন যে এই অপমানের প্রকৃতি ঠিক কী রকম। আমি যদি বলি স্বামী আমাকে সুখ দিতে পারছে, যে সুখ আমি তাকে দিতে পারছি–তবে এমন উত্তর আসতে পারে কী দরকার পার্থিব সুখ টুখের, মেয়ে হয়ে এত সুখের আশা করা ঠিক মানায় না, অসভ্যের মত শোনায় অর্থাৎ নির্লজ্জ মেয়েরা স্বামীর সুখ ছাড়াও নিজের সুখের কথা ভাবে। আমি ভাবব না কেন? আমি নিজের সুখের জন্য উদগ্রীব হলে খারাপ দেখায় আর আলতাফ যখন উন্মাদ হয়ে ওঠে আমাকে পিষে একটু সুখ পাবে বলে কই কেউ তো তাকে খারাপ বলে না বরং আমি বাধা দিলে বলে তোমার বাধা দেওয়া উচিত নয়। কেবল স্ত্রীরই কি দায়িত্ব স্বামীকে সুখী করবার! এই নিয়ম যত বড় বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই তৈরি করুন আমি মানতে রাজি নই। দু’জনের মধ্যে যদি ভালবাসা না থাকে তবে লোকে কী বলবে ভয়ে আমি সেই ভালবাসাহীন নরকে বাস করব–এ আমার দ্বারা কখনও সম্ভব নয়। ‘লোক’ একটা ভেগ টার্ম। লোকের ভয় দেখিয়ে মেয়েরা যা করতে চায় তা করতে দেওয়া হয় না, এতে কিছু নপুংসক, অর্থলোভী, স্বার্থপর, হিংসুক, ঈর্ষাকাতর, অবিবেচক পুরুষ আনন্দ লাভ করে। আর কিছু নয়। আমি অবাক হই বাবা আমার টেবিলের সামনে না দাঁড়িয়ে চলে যান। পরে মনজু কাকা যখন রুম থেকে বের হন, তিনিও আমাকে কিছু বলেন না কিন্তু আমি অনুমান করি আমাকে চকরি থেকে বাদ দেওয়ার আদেশ বা অনুরোধ আমার বাবা করেছেন। ইতিমধ্যে আমি কাজ শিখে গেছি। মনজু কাকা কি ডিসিশান নেবেন আমার ব্যাপারে জানি না। যে ডিসিশানই নেন, আমি যেন সবকিছুর সামনে নিজের জোর নিয়ে দাঁড়াতে পারি নিজের জন্য আমি এরকমও একটি সিদ্ধান্ত নিই।
সেদিন সারাদিন বৃষ্টি। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসে কায়সার। আমি হোস্টেলের রুমে বসে চাকরিটির কথা ভাবছিলাম। মনজু কাকা এখনও জানাননি কিছু। যা কিছুই জানান আমি ভড়কে যাব না। আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল থাকব। এরকম ভাবতে ভাবতেই কায়সারের সঙ্গে গেটে দেখা করতে যাই। তাকে বলি–আজ চলে যাও, আজ কোথাও বসে কথা বলবার জায়গা নেই।
কায়সার বলে–উঁহু, এই চমৎকার দিনে তোমাকে ছাড়া ভালই লাগবে না, চল ভিজি।
ভেজার কথা উঠতেই আমার মন নেচে ওঠে। বলি–চল।
দু’জনে রাস্তার তাবৎ লোকের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে মহসিন হলের কাছে এলে কায়সার বলে–রুমে গিয়ে চল সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খাই।
অমি বলি–সঙ্গে চা, কেমন?
কায়সার হেসে বলে–নিশ্চয়ই। পারলে ভুনা খিচুড়ি বেঁধে খাব।
আমার ভাল লাগে খুব। কায়সারের সঙ্গে আমার ইচ্ছেগুলো অনেকটা মিলে যায়। ও আবার ভাল গান গাইতে জানে। চা খেতে খেতে ওর গান শোনা গেলে মন্দ হয় না। একটি সিঙ্গল খাট, টেবিল বোঝাই এলোমেলো বইপত্র। মশারিটি ঝুলে আছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কায়সারের রুমটি। সে একটি তোয়ালে হাতে দিয়ে বলে–মাথাটা মুছে নাও। ঠাণ্ডা লাগবে।
তোয়ালে হাতে নিয়ে বলি–চা খাওয়াও আর গান শোনাও।
কায়সার হিটারে কেটলি চাপায় আর ভরাট গলায় গায় ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে, বাহির হয়ে এসো’ ….
টেবিলের কোণা ঘেসে দাঁড়িয়ে দু একটি বই এর পাতা উল্টাই। আর কায়সারের চা বানাবার আয়োজন দেখি। তার ঘরে আসবার আহবান সে এত গভীর করে করে যে তার গানের লয় তাল হয়ত শুদ্ধ হয় না, কিন্তু গানে আমি প্রাণ খুঁজে পাই। দু’কাপ চা হাতে নিয়ে এসে সে বলে–কী এখনও মাথাটা মুছলে না, জ্বর হলে বুঝবে।
আমি বলি–হোক, আমার খুব জ্বর হোক। তুমি আমাকে দেখতে যাবে। আমার কপাল ছুঁয়ে জ্বর দেখবে। কাছে বসবে, বলবে ভাল হয়ে যাও। শুনে আমার খুব ভাল লাগবে। হোক না, খুব জ্বর হোক আমার।
আমার কণ্ঠে কী ছিল জানি না কায়সার মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। পলক না ফেলা চোখ। আমারও জ্বরের ঘোর কাটে যখন আমার হাতদুটো ধরে সে বিছানায় বসায়। ওর শরীর ভেজা। বুকের সঙ্গে লেগে সপসপ করছে ভেজা শার্ট। ও আমার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে আমার মাথা মুছিয়ে দেয়। মাথা থেকে মুখ, মুখ থেকে বুক, আমার সমস্ত শরীর ও তোয়ালে দিয়ে মোছে। আমার ভেজা শরীরে ওর উষ্ণ হাতের স্পর্শ এসে লাগে। আমি চোখ বুজে ওর উষ্ণতাটুকু উপভোগ করি। বারবার কেঁপে উঠি। ও আমার ঠোঁটে গাঢ় চুমু খায়। আমি আর নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে রাখতে পারি না। ছড়িয়ে দিই। গোলাপ যেমন ফুটতে গিয়ে পাপড়িগুলো ছড়ায়, তেমন। ঘরে আর নেই কেউ। দুজন মাত্র মানুষ আমরা। শরীর জেগে ওঠে ঘামের গন্ধমাখা কায়সারের আলুথালু বিছানায়। আমি ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওর ভেজা বুকে মুখ রেখে বুক ভরে শ্বাস নিই। নেব না কেন? আমাকে কে বাধা দেবে? ভালবাসার কাছে, নিজের গভীর গাঢ় ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবার যোগ্য আমি তো হয়েছিই। ধুম বৃষ্টির জলে ভালবাসা মিশে এমন এক সুগন্ধ আনে যে আমি সেই সুগন্ধ থেকে আর মুখ তুমি না। কায়সারের লোমশ বুক থেকে আমার মুখ তুলতে ইচ্ছে করে না। ও আমাকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে রাখে। তারপর কী হয় আমি ঠিক বুঝতে পারি না, দু’জন মানুষ ভালবাসতে বাসতে কোথায় হারিয়ে যাই। হারিয়ে যেতে যেতে বুঝি আমার পিপাসা মিটছে। পিপাসা মিটছে আমার।
আমার শরীর কতকাল কিছু যেন চেয়েছিল, খরার জীবনে জল চেয়েছিল সামান্য, আর হঠাৎ না চাইতেই অবাধ বৰ্ষণ জোটে সুখের। পিপাসা মিটছে আমার। এক শরীর পিপাসা। ঊষর জমি জুড়ে জলপতনের শব্দ, ফসলের সবুজ দোলা, আমি হারাই অন্য এক অচেনা জগতে। কী ঘটে আমার শরীরে বুঝি না, পিপাসা কেন মিটছে তাও বুঝি না, পিপাসা যখন মিটছে আমি কায়সারের পিঠ আঁকড়ে ধরি প্রচন্ড সুখে, শির্ষসুখে; ওর পিঠে আমার দশ নখের দাগ বসে যায়।