ভ্রমর কইও গিয়া : 14
দরজায় তালাবন্ধ করে রাখা হয় আমাকে। বাবা বলেন–আমার মেয়ে হয়ে যা তা করে বেড়াবে, এ আমি সহ্য করব না।
দরজার তালা খুলে মা আমাকে তিনবেলা খাবার দিয়ে যান। এ যে কী অসহনীয় অবস্থা তা আমি ছাড়া আর বুঝবে কে। আমার কান্নাও পায় না আজকাল। বরং জেদ হয়। ভীষণ এক জেদ হয় আমার। এইসব আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। দরজা ভেঙে বেরোব, এ আমার শক্তিতে কুলোবে না, শরীরের শক্তিতে না পারি, মনের শক্তিতে কখন দরজা খুলে বেরিয়ে যাই, বেরিয়ে চাকরি বাকরি করি, পড়াশুনা করি, যেমন খুশি থাকি, যেমন ইচ্ছে বাঁচি।
শনিবার পার হয়ে যায়। আমার বেরোনো হয় না। আলতাফের পরামর্শে আমাকে আটকে রাখা হচ্ছে এরকম ধারণা করি। আমার বাবা মা আমার ব্যাপারে নির্মম জানি কিন্তু এত নির্মম তা আমার বিশ্বাস হয় না। এভাবে আটকে থাকব আমি কতদিন, আমাকে তো বেরোতেই হবে। বাড়িতে ফিসফিস বলাবলি হয় আমি যেহেতু লতিফ নামের এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যেতে চাচ্ছি, তাই আমাকে আটকে রাখা হচ্ছে। এসবের কোনও প্রতিবাদ করতেও আমার ঘৃণা হয়। তাদের ভুল একদিন ভাঙবেই, যদি মন বলে কিছু থাকে তাদের, অনুতপ্ত হবে নিশ্চয়। ঘরের দু’একটা বই নাড়া চাড়া করি। পড়ায় মন বসে না। লেখায়ও না, লিখতে গেলেই দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে, কাকে লিখব, কে আছে আমার আপন। খুব দুঃখের রাতে কার কথা ভেবে চোখের জল ফেলব, এমনিই নিঃস্ব আমি, এমনই একা; আমাকে এই সভ্য দেশে, একটি সভ্য শিক্ষিত পরিবারে তালাবন্ধ করে রাখা হয়, কথা বলবার, চলবার, ফিরবার সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
একদিন দুপুরে মা ভাত নিয়ে ঘরে ঢুকতেই, তখন সাতদিন কেটেছে আমার ঘরবন্দি জীবন, আমি মাকে এক ঝটকায় সরিয়ে চলে যাই ঘরের বাইরে। বাঘের অরণ্য থেকে হরিণ যেভাবে পালায়, আমিও উধশ্বাসে ছুটি, কোথায় যাব কোনদিকে যাব না ভেবেই ছুটতে থাকি। পরনে আমার মলিন জামা কাপড়। রাস্তার লোকের চোখে কৌতূহল উপচে পড়ে, একটি মেয়ে এমন দৌড়োয় কেন। পেছনে ফিরি না। পেছনে আমার ধরবার জন্য ছুটে আসছে কিনা বুনো মোষের দল–ফিরে দেখি না। একটি স্কুটার নিয়ে সোজা চলে আসি পাপড়িদের বাড়িতে। পাপড়ি অবাক হয় না। সব জানবার পর বলে–নো প্রবলেম, তুই থাক কদিন আমাদের বাড়িতে। দুর্গতি যেমন আমার জীবনে বারবারই আসে, হঠাৎ হঠাৎ সাফল্যও কোত্থেকে জানি না হাতের মুঠোয় চলে আসে। চারদিক বিরূপ যখন, তখনই দেখি কারও প্রসন্ন মুখ। সকলেই যখন ফিরিয়ে নেয় চোখ, ধু ধু শূন্যতার ভেতর কেউ হয়ত বাড়ায় তখন ভালবাসার হাত। পাপড়ির বাবা শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান মানুষ। আমাকে বললেন সাহস যখন করছ, মাঝপথে থেমে যেও না। গন্তব্যে পৌঁছুবার চেষ্টা করো। ইচ্ছে থাকলে কী না হয়। বাধা তো থাকবেই পদে পদে। এগোয় তো অনেকেই, বাধা পেয়ে বেশির ভাগই থেমে যায়।
পরদিন সকালে মতিঝিল যাই, চাকরিটি আমার প্রয়োজন। মনজু কাকা আমাকে বসিয়ে রেখেই এপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি করে দিতে বলেন এডমিনিস্ট্রেশান অফিসার জালাল সাহেবকে। ছোট কাজ, আত্মীয় বলে খাতির নেই। টেলিফোন অপারেটর কাম অফিস এসিসটেন্ট। বেতনও খুব বেশি নয়। তিন হাজার টাকা।
মনজু কাকা বলেন–এত কম টাকায় তোমার হবে তো?
আমি খুশিতে ফেটে পড়ি। বলি–কোনও দিন কি এত টাকা আমি উপার্জন করেছি? এরচেয়ে বেশি টাকা হাতে পেয়েছি। কিন্তু সে ছিল অন্যের টাকা।
মনজু কাকা আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তিনি আমাকে উইশ করেন। অফিসের এক লোক ডেকে কাজ বুঝিয়ে দিতে বলেন। আমার জীবনে বড় একটি পরিবর্তন ঘটল বটে। একভোকেট মতিন চৌধুরির মেয়ে, ইঞ্জিনিয়ার আলতাফ হোসেনের স্ত্রী একটি। ফার্মে টেলিফোন অপারেটর কাম অফিস এসিসটেন্টের কাজ নিয়েছে–লোকে অবাকই হবে, হোক। লোকেরা কেবল অবাক হতেই জানে। আমি যখন যন্ত্রণায় মরে যেতে থাকি অক্ষম পুরুষের আলিঙ্গনে, তখন কেউ অবাক হয় না। আমি যখন স্বামীর চড় লাথি খেতে থাকি, অবাক হবার লোক পাই না। আমাকে যখন পরকিয়া প্রেমের দায়ে ঘরে বন্দি করা হয়, কে অবাক হয়?
চাকরিটি শুরু করে দিই। আমার আশংকা হয়, বাবা কখনও খবর পেয়ে অফিসে চলে আসতে পারেন এবং মনজু কাকাকে সব কিছুর জন্য দোষী করতে পারেন। মনজু কাকা কিন্তু কোনও আশংকা করেন না। এসব ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা কমই হয় আমার। আমি যখন বললাম বাড়িতে সবাই বিট্রে করছে। তিনি বললেন–তুমি যেটা ভাল বোঝ কর। বাড়ির মানুষদের ক্ষেপিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারবে কিনা ভেবে দেখ। হুট করে ভাবলে কাজ করবে আর কদিন পর জানালে করবে না, ব্যাপারটি ঠিক নয়। আমি তাঁকে বলেছি আমি যা ভাবছি তা করবই। আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবার কোনও কারণ নেই।
চাকরি তো জুটেছে কিন্তু একটি সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে, বাসস্থান সমস্যা। পাপড়ির বাড়িতে অনেকদিন হয়ে গেল। এবার পাততাড়ি গুটানো প্রয়োজন। কর্মজীবী মহিলা। হোস্টেলের কথাই ভাবি। চাইলাম আর হয়ে গেল–এত সহজ নয় ব্যাপারটি। আপাতত মালার রুমে কদিন থাকাই স্থির করি।
যা চাই তা হয়ত হয় না। কিন্তু অনেক কিছুই হয়ে যায়। মালা আমাকে ফিরিয়ে দেয় না। অফিস থেকে এডভান্স কিছু টাকা নিই। তা দিয়ে কিছু জামা কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনি। হয়ে যায়, হবে না কেন, বরং অমল এক আনন্দ হয়। ব্যাপারটি কেবলই এডভেঞ্চার অনেকই মনে করতে পারে, আমার কাছে কিন্তু তা নয়। আমার কাছে জীবনের মানে খোজা। জীবন কোথায় কতদুরে পড়ে আছে তা খুঁজে আনা, খুঁটে খুঁটে দেখা। জীবনে অপার রহস্য আছে বৈকি। ক’দিন আগেই যা। আমি কল্পনাও করতে পারি নি, তাই দেখি হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে। আমাকে কোথাও থামাতে পারছে না কেউ।
হোস্টেলের সিটের জন্য পাপড়িকে নিয়ে চেষ্টা চালাই, নীলক্ষেতের হোস্টেল। পাপড়িরও চেনা দু’জন সিনিয়র মেয়ে ছিল ওখনে। ওরাই ফর্ম টর্ম নিয়ে দেয়। আমার ইন্টারভিউ হয়, কেন থাকতে চাচ্ছি, ম্যারেড কী আন ম্যারেড, ম্যারেড যদি স্বামী কোথায়, কী করে ইত্যাদি। আমি স্পষ্ট জানাই স্বামী একজন আছে, তবে ছেড়ে দিচ্ছি তাকে, তার সঙ্গে ঘর সংসার করবার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। কেন নেই এই প্রশ্ন যখন করা হয়, বলি লোকটি একটি প্রতারক। প্রতারক কী ধরণের, সে কী আরও কোনও বিয়ে করেছে, টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছে? এসবের একটিরও উত্তর হ্যাঁ হয় না। ওরা বুঝে পায় না প্রতারণা আর কী ধরনের হতে পারে। আমারও ইচ্ছে করে না নিজের দুঃখ কষ্টের কথা খুলে ভেঙে বলি ওদের, আর যে না ভুগেছে এই যন্ত্রণায়, সে কিছুতে যে বুঝবে না যন্ত্রণাটি কী ভীষণ, তা আমি বেশ ভাল করেই বুঝি। শেষ অবধি সিট মেলে। সব পেয়ে যাই, যা চাই। চাকরি পাওয়া হল। থাকা, খাওয়া, পরার চিন্তা দূর হল। অফিসের কাজ শিখতে আমি প্রবল আগ্রহ বোধ করি। পেছনে কী হচ্ছে দুটো বাড়িতে, ভাবতে চাই না। যা হয় হোক, আমার কী। পেছনের কারও জন্য আমার কোনও মায়া হয় না।
পাপড়ি একদিন বলে–তোর বাবা ফোন করেছিলেন।
–কী বললি?
–বললাম হীরা চলে গেল কেন? ও তো বাড়ি থেকে পালানোর মেয়ে ছিল না। তো উনি বললেন তোর নাকি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
আমি হো হো করে হেসে উঠি। ওঁরা যে আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন, তাতে আমার . এতটুকু করুণা হয় না। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বাড়িতে এই জন্য যাইনি, খুঁজে পেয়ে টানা হেঁচড়া করবেন, খামোকা ঝামেলা। আর আমার বন্ধুদের বাড়ি খোজা তো ওঁদের মানায় না। ওঁরা খুঁজবেন লতিফের বাড়ি। লতিফ কোথায় গেল, আমাকে নিয়ে কোথায় ঘর বাঁধল এসব খবর নিশ্চয় ওঁরা নিয়েছেন। বেচারা।
মনজু কাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম। ট্রান্সফরমার তৈরি হয়। দেশ বিদেশ দৌড়াদৌড়ি তার। হয়ত ব্যস্ততার জন্য বা আমার অনুরোধ রক্ষা করেই তিনি আমাদের বাড়িতে খবরটি জানাননি। একবার খবর পেলেই খামচে ধরে নিয়ে খাঁচায় পুরবে। খাঁচার কষ্ট আমি জানি। ও পথে আমি জীবন থাকতে যাব না। হোস্টেলে খাবার কষ্ট হয়, মাপা খাবার, তবু মনে হয়, এই কী অনেক নয়? এই আমার প্রথম উপার্জন। সারাজীবন, পরের পয়সায় মাছ মাংস খাওয়ার চেয়ে নিজের পয়সায় ডাল ভাত খাওয়া অনেক আনন্দের। কেউ আমাকে খাওয়ার খোটা দেবে না, কারও সামনে আমার নত হতে হবে না, কেউ আমাকে ইচ্ছে হলে পেটাবে না, কেউ আমাকে ইচ্ছে হলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে না। ইচ্ছে হলে বিছানায় শরীর নিয়ে খেলা করবে না, যে খেলার পরে আমার কেবল একতরফা হার। আমি হারব, আমি মার খাব, আমি তবুও থেকে যাব তাদের ইচ্ছের হাতে বন্দি, যেন তারা ভাল বলে, যেন তারা গাল টিপে লক্ষী মেয়ে বলে, যেন তারা একটি পুতুলকে যেমন সাজিয়ে গুজিয়ে বলে–সুন্দর, তেমন সুন্দর বলে।
অফিসে কাজ তেমন নেই। টেলিফোন রিসিভ করা, ফাঁইল পত্র গুছিয়ে রাখা, এমডির রুম থেকে সাইন করে নিয়ে আসা ইত্যাদি। এসব কোনও পরিশ্রমের কাজ নয়। ফাঁকে ফাঁকে বিএ পরীক্ষা দেবার কথা ভাবি। হোস্টেলে এত মেয়ে, অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, এ অন্য এক জগৎ, আমার একা লাগে না। হোস্টেলের অনেক মেয়েই চাকরির ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা করে। আমি কিছু বই পত্র সংগ্রহ করি। এত ব্যস্ততা আমার জীবনে আর আসেনি। সকাল নটায় অফিস, পাঁচটায় ফেরা, ফিরে কখনও হোস্টেল, কখনও রোকেয়া হল, পাপড়ির বাড়িতে আড্ডা দিতে যাওয়া–সময় যে কী করে চলে যায়, বুঝি না।
সব কিছুর পর আমি যখন রাতে ঘুমোতে যাই, আমার শরীর জেগে ওঠে শুভ্র বিছানায়। আমার ইচ্ছে করে কোনও এক সক্ষম পুরুষের স্পর্শ পেতে। হোস্টেলে সুফিয়া নামে এক মেয়ে আছে, ডিভোর্সি মেয়ে। সে ফাঁক পেলেই তার অতীতের কথা পাড়ে। স্বামীটি খুব শরীর চাইত তার, এত বেশি ছিল তার কামনার আগুন, সুফিয়ার পক্ষে সম্ভব হত না তার তৃষ্ণা মেটানো। স্বামী গণিকাগমন করত, এ নিয়ে ঝগড়া, ঝগড়া বাড়তে বাড়তে ছাড়াছাড়ি। সুফিয়ার ঠিক উল্টো আমি, কামনার আগুন আমাকেই জ্বালিয়েছে। সে আগুনে পুড়ে আজ ছাই হয়েছি আমি অথবা খাঁটি সোনা।