Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin » Page 12

ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin

বাবা বলছেন–আলতাফ ভাল ছেলে। ও কেন তোকে মারবে?

মা বলছেন–মেরেছে যখন কোনও কারণ আছে নিশ্চয়।

আমি অবাক হই ওঁদের নির্বুদ্ধিতায়। প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয় না। তবু মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়–দোষ ওরই।

বাবা, মা, এমন কী দাদাও আমাকে বলছেন–কোন কারণ ছাড়া আলতাফ মারবে কেন? দোষ না করলে কেউ মারধোর করে? আলতাফ তো আর অশিক্ষিত ছেলে নয়।

রাতেই টেলিফোন করে আলতাফ, বাবাকে বলে–কেমন আছেন আব্বা। আপনার মত আদর্শবান মানুষের মেয়ে যে কেন এমন হল আমি ভাবতে পারছি না। আমার ফ্রেণ্ড সারকেল সব জেনে গেছে ব্যাপারটা। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে। তো আমি বলে যাচ্ছি এসব ঠিক নয় আর আমার স্ত্রীর ব্যাপার আমি বুঝব। আর কতদিন এভাবে সামাল দেব জানি না। মানুষ তো আমি, কী বলেন? লতিফের সঙ্গে সে শুয়েছে। কী করে পারল সে আমি বুঝি না।

বাবা মা মুখ চুন করে বসে থাকেন। অনেক রাত পর্যন্ত বাড়িতে মিটিং চলে। মামারা আসেন, কাকারা আসেন, তারা সবাই একটি সিদ্ধান্তে আসেন, সে হল আমার মাপ চাইতে হবে আলতাফের কাছে। সিদ্ধান্তটি আমাকে জানানো হলে আমি বলে দিই, মাপ আমি চাইব না।

কেন আমি মাপ চাইব না? এত সাহস আমি কোথায় পেলাম? এইসব জানতে চাওয়া হয় আমার কাছে। আমি বলি–জানি না কোথায় পেলাম সাহস। তবে সাহর্স পেয়েছি। সাহস থাকা তো ভাল।

বাড়ির সবাই অবাক হয়, ভালই তো ছিল মেয়েটি, কোনও ‘ব্যাড রেকর্ড’ ছিল না, তার এমন চরিত্র খারাপ হল কবে? চরিত্র যে আমার খারাপ হয়েছে এ ব্যাপারে ওরা নিশ্চিত। কপালে আমার সুখ সইল না–এ নিয়ে ওরা দুঃখ টুখও করে।

আমি কাউকে বোঝাতে পারি না আলতাফের প্রবলেমের কথা। মাকে হয়ত বলা যেতে পারত, কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছে হয় না। তিনি ভেবেই নিয়েছেন দোষ আমার। যে মানুষ আমাকে এতটা অবিশ্বাস করতে পারেন, তাঁকে আমার গভীর গোপন সমস্যার কথা বলতে রুচি হয় না, হয়ত সব শুনে বলেও বসতে পারেন, দোষ আমারই। তাকে তো আর একজন অক্ষম পুরুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে হয়নি, রাতের পর রাত নিঘুম কাটাতে হয়নি। তিনি কী করে বুঝবেন শরীরের যন্ত্রণা এক সোমখ নারীকে কতটা উন্মাদ করে। শরীর ভরে কী ভীষণ তৃষ্ণা থাকে অতৃপ্ত নারীর, তা পরিতৃপ্ত নারীরা বুঝবে কেন। আমি সারাদিন এ বাড়িতেও একটি নিঝুম ঘরে বসে থাকি। এখানেও আমার বড় একা লাগে।

ফুপুও আগের মতন তেমন কেয়ার করে কথা বলেন না। কণ্ঠস্বরে তাচ্ছিল্য টের পাই। একদিন বলেন–তোমার ভবিষ্যত ভেবে দুঃখই লাগে।

আমি বলি–দুঃখ লাগার কী আছে।

ফুপু বলেন–ভাবছি, এই স্বামী যদি তোমাকে না নেয় তবে কী গতি হবে তোমার!

–স্বামী নিতে চাইলে আমি যাব, কে বলেছে তোমাকে?

–স্বামীর ঘরে যাবে না তো কোথায় যাবে?

–যেখানেই যাই, ওই বাড়িতে আর না।

বাড়িতে ফিসফিস আলোচনা চলে স্বামীর বন্ধুর প্রেমে পড়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। সেই ছেলেকে এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি। সারাদিন আমি সেই ছেলের ভাবনায় মগ্ন থাকি। আমি আগের সেই উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলেছি। বাড়ির কাউকে আমার ভাল লাগে না। ফোনেও বোধহয় সেই ছেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। ইত্যাদি।

বাবা একদিন জিজ্ঞেস করলেন–ছেলেটা কে?

আমি বললাম–কোন ছেলে?

–যেই ছেলে নিয়ে গণ্ডগোল, সেই ছেলে।

–কোন ছেলে নিয়ে গণ্ডগোল?

–লতিফ। লতিফ না কী একটা নাম!

–জানই ত কী নাম। সবই যখন জানো তখন আর জিজ্ঞেস করা কেন।

–আমরা এখন সমাজে মুখ দেখাব কী করে? তোরই বা কী হবে। বাবা চশমার কাঁচ মুছে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন।

–আমি পড়াশুনা করব। কলেজে ভর্তি হব।

–কলেজে যে পড়বি আলতাফ জানে??

–তার জানার কী দরকার!

–সে না চাইলে পড়বি কী করে?

–আমি আমার জন্য পড়ব। সে না বললে আমি পড়ব না এ কেমন কথা!

–এটাই কথা। বিয়ের পর স্বামীর অনুমতি ছাড়া কিছু করতে হয় না।

–আমি তো ওই বাড়িতে যাব না কখনও। এখানে থাকব। যথেষ্ট জোর নিয়ে কথা কটি বলি।

–এখানে তোকে রাখবে কে শুনি?

–কেন, তাড়িয়ে দেবে নাকি?

–বাড়াবাড়ি অনেক সহ্য করেছি। আর করব না। কাল আলতাফ আসবে নিতে। একটি কথা না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠবি। আর কোনও ঝামেলা করবি তো আমি তোর গলা কেটে ফেলে আসব। এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই অনেক ভাল। বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে রাগে।

–আমি যদি কাল না যাই কী হবে?

–তুই যাবি। তোর ঘাড়ে যাবে। বাবা এমন সুরে কথা বলেন তাকে আমার চিনতে কষ্ট হয়। এই মানুষটি কি সত্যিই আমার বাবা? তিনি আমাকে জোর করে এক বাড়িতে পাঠাবেন, আমি সেখানে ভাল থাকি না জেনেও? কেবল বিয়ে হয়েছে এই একটি কারণেই? বিয়েটা কি এতই সাংঘাতিক কিছু যে আমাকে সব ছেড়ে, আমার শৈশব কৈশোর আমার স্বপ্ন সাধ বিসর্জন দিয়ে বিয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে? একা ঘরে সারাদিন এই দুঃসহ সম্পর্কের কথা ভেবে আমার এ কথাই মনে হয় কোনও সম্পর্কেই আসলে শর্ত থাকা উচিত নয়। শর্ত থাকা মানেই অবিশ্বাস, শর্তভঙ্গের ইচ্ছে। সম্পর্ক হবে উদার আকাশের মত। আকাশের সঙ্গে মেঘের কি কোনও চুক্তি থাকে যে তাকে এই গতিতে উড়তে হবে? সে হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়। সে অবাধ সুখে মাতে।

আলতাফ আসবে বলে বাড়িতে তুমুল উৎসব শুরু হয়। তার জন্য মুরগীর রোস্ট, পোলাও, কোরমা, কাবাব, কোপ্তা নানা রকম খাবার তৈরি করা হয়। রান্না ঘরে ব্যস্ত সারাদিন মা, ফুপু। বাবা বলছেন–জামাই আসবে। বাড়িতে আরও ক’জনকে আসতে বলি। আলতাফ আসবে বলে মামা কাকারাও আসেন। তাঁরাও একসঙ্গে খাবেন। এত আদর কেন আমি বুঝি, আমাকে যেন আলতাফ নিয়ে যায়, আমি যেন আবার স্বামীর সংসারে ভাল মানুষের মত থাকতে পারি, আমার যেন মাথার ওপর একটা ছাতা থাকে, নিরাপত্তা থাকে। লোকে যেন মন্দ কথা না বলতে পারে। লোকে যেন বলতে না পারে মেয়েটি স্বামীর ঘর করতে পারে নি। স্বামীর ঘর করতে পারাটিই মেয়েদের প্রধান যোগ্যতা ভাবা হয় কিনা।

সন্ধের দিকে আসে আলতাফ। বেশ সেজেগুঁজেই আসে। সুট টাই লাগিয়ে। ছেলে হিসেবে দেখতেও যে সে চমৎকার তা আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়াই বোধহয় তার ইচ্ছে। বাবা মা কাকা মামাদের পা ছুঁয়ে সালাম করে। ওঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। সোফায় দুঃখী মুখ করে বসে থাকে। মা বাবা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বলেন–বাবা, আমাদের তুমি মাপ করে দাও। মেয়েকে তালা বন্ধ করে ঘরে রেখে দাও। সে এখন তোমাদেরই। বিয়ের পর কী আর আমাদের কোনও অধিকার থাকে। ওর ওপর তোমারই সব অধিকার। তুমি ওকে শাসন কর। মেয়ে আগে ছিল আমাদের, এখন তোমার কাছেই সমর্পণ করেই দিয়েছি। অন্যায় করলে তুমি ওকে শাসন কর, মানুষ কর। বয়স অল্প, বোঝেনি যা করেছে। ওকে বোঝালৈই বুঝবে। ছোট মানুষ……

আলতাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–ওর জন্য আমি কত কিছু করি। সেদিনও বায়তুল মোকাররমে গিয়ে এক জড়োয়া সেটের অর্ডার দিয়েছি। এই দেখুন বলে আলতাফ পকেট থেকে একটি জুয়েলারি দোকানের স্লিপ বের করে দেখায়।

আমার বেশ হাসিই পায়। সে আমাকে সোনার নেকলেস গড়িয়ে দেবে বলে তার বশংবদ দাসি হতে হবে আমাকে? আলতাফের আচরণ লক্ষ্য করে আমি বিস্মিত হই। সে সবার সঙ্গে এত বেশি নম্র কণ্ঠে কথা বলে, এত ধোয়া তুলসি পাতা সে সাজে, আমারই ভুল করে মনে হয় আমিই বোধহয় দোষ করেছি। আমার অন্যায়ের কারণেই বোধহয় আলতাফ আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

আলতাফ খায় দায়, সবার সঙ্গে সমাজ, রাজনীতি, পরিবার ইত্যাদি বিষয়ে গভীর আলোচনা করে এবং শুনে অবাক হই আলোচনায় আলতাফের কথাই সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ জোরালো এবং বুদ্ধিদীপ্ত শোনায়। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আলতাফ আমার কাছে আসে। বলে–হীরা চল।

কণ্ঠে সোহাগ তার। মনে মনে আলতাফকে বাহবা দিই। এই সোহাগ ছিল কোথায়। এদ্দিন!

–চল মানে? আমি জিজ্ঞেস করি।

–চল, এখন থেকে ভাল ভাবে থাকবে এই শর্তে নিয়ে যাচ্ছি। আব্বা আম্মা তো তাই বললেন যে তুমি এখন আমার কথা শুনবে। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ।

বাবা মা দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঢুকে বললেন–চুল টুল আঁচড়ে নে। ভাল ভাবে থাকতে হবে। এরপর যদি গণ্ডগোলের কথা শুনি তবে আর রক্ষে নেই।

আলতাফের সামনে বাবা মার অপরাধি মুখ। যেন আমাকে সে নিয়ে যাবে বলে তারা কৃতার্থ। যেন আলতাফ লতিফের সঙ্গে আমি প্রেম করবার পরও এ বাড়িতে এসে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে।

আমি শুয়েছিলাম। শোয়া থেকে না উঠেই বলি–আমি যাব না।

–যেতে হবে।

–যাব না তো বললাম। কণ্ঠে আমার আশ্চর্য দৃঢ়তা কাজ করে।

যাব না তো যাবই না। আমাকে টানা হেঁচড়া করেও কোনও লাভ হয়নি। আমি যাইনি। আমি যাচ্ছি না দেখে আলতাফের গা কাপছিল রাগে। নিজের বাড়ি হলে ও আমাকে ছিঁড়ে ফেলত। এ বাড়িতে মাথা নিচু করে বাবা মাকে বলেছে–আপনারা পরে নিয়ে আসুন না হয়। যদি এখন থেকে ভাল হয়ে চলে তবে আমি কেন আপত্তি করব বলুন। আমি কষ্ট করে চলব। আমার আর কী। আমার জীবনের আর মূল্য কী বলুন। আমি তো ওর জন্যই। ওর কী করে সুখ হবে তাই ভাবি। ওর যেন কোনও কষ্ট না হয় সেই চেষ্টাই দিনরাত করে যাচ্ছি। বলতে বলতে আলতাফের চোখে জল চলে আসে।

আলতাফ চলে যাবার পর শুরু হয় আমার ওপর নতুন রকম অত্যাচার। মা কাঁদো কণ্ঠে বলেন–এই মেয়ে জন্ম দিয়ে আমি পাপ করেছি। ভেবেছিলাম মেয়ে সুখি হবে। সবাইকে গর্ব করে বলতে পারব মেয়ে আমার ইঞ্জিনিয়ারের বউ। মা মিহি সূরে কাঁদতে থাকেন। বাবা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। মামা কাকারা বলেন–বিয়ের পর স্বামীর ঘরই আসল ঘর। মান অভিমান একটু আধটু হয়েই থাকে। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এদিকে আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এ বাড়িতেও আমি থাকব না। কোথাও চলে যাব। এ বাড়িটিকে, আমার জন্ম থেকে চেনা বাড়িটিকেও আমার অচেনা মনে হয়, পর মনে হয়। বাসযোগ্য মনে হয় না। আমি যে আলতাফের সঙ্গে না গিয়ে অত্যন্ত অন্যায় একটি কাজ করেছি তা আমাকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেয় এই বাড়ির সদস্যরা। আমি অসহায় বোধ করি। ছটফট করি ভেতরে ভেতরে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress