Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin » Page 11

ভ্রমর কইও গিয়া || Taslima Nasrin

লতিফ আবারও আসে একদিন। হঠাৎ বিকেলে। বলে–ভাবী, আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম।

–আমার সঙ্গে? আমি অবাক হয়ে বলি–আমার সঙ্গে কী গল্প?

–খুব খালি খালি লাগছিল তো, তাই।

–খালি খালি কেন। বন্ধু বান্ধব নেই?

–সবসময় বন্ধু বান্ধব ভাল লাগে না। লতিফ সোফায় আরাম করে বসে বলে।

আমি কি কথা বলব খুঁজে পাই না। শাশুড়ি একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেছেন কে এসেছে; কার সঙ্গে কথা বলছি। আমি পড়েছি মুশকিলে। লতিফ হৈ হৈ করে ঢোকে। ভাবী ভাবী বলে ডাকে, আমাকে সামনে আসতেই হয় অগত্যা। কিছু একটা বলতে হয় বলেই বলা–বিয়ে করছেন না কেন? বিয়ে করে নিলেই তো পারেন! বউ নিয়ে বেড়াবেন। ঘুরবেন। একা একা লাগবে না।

–বিয়ে? পাত্রী কোথায় বিয়ে করার? আমার কী আর আলতাফের ভাগ্য? চাইলাম, আর সুন্দরী বউ পেয়ে গেলাম!

লতিফের কথাগুলো আমার ভাল লাগে না। আলতাফ যে বলেছিল একদিন লতিফ একটা লোফার। লতিফ একটা লোলুপ লুম্পেন। লতিফ হয়ত তাই। তা নয়ত সে আমাকে কেন বলছে তার খালি খালি লাগে! সে কি তার শূন্যতা ভরাট করতে এসেছে আমার কাছে? লতিফ আলতাফের মত লম্বা নয়, অমন সুন্দর স্বাস্থ্য আর চেহারা নেই তার। তবু দেখতে মন্দ লাগে না। হাসিতে উজ্জ্বলতা আছে তার। কামানো গালের সবুজ আভা তাকে অন্যরকম দীপ্তি দেয়। আলতাফ যে এত সুদর্শন পুরুষ, আলতাফের মধ্যে এই পৌরুষ যেন অনুপস্থিত। লতিফের দিকে আমি অপলক তাকিয়ে থাকি। লতিফও আমার চোখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়। আমি ভুলেই যাই আলতাফ আমাকে নিষেধ করেছে লতিফের সঙ্গে কথা বলতে, লতিফের সামনে আসতে। কেন আমি তার সামনে আসব না? আমি কি অন্যায় করেছি? আলতাফ আমাকে কিনে নিয়েছে? আমি তার দাসী বাদি কিছু?

–কী ভাবী, মন খারাপ নাকি? লতিফ মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি–না মন খারাপ হবে কেন!

–আপনি কি এরকমই কম কথা বলেন?

–বোধহয়।

–হেঁয়ালি করছেন কিন্তু।

–লতিফ ভাই, আসলে শরীরটা আমার ভাল লাগছে না। জ্বর জ্বর লাগছে। আমি বরং শুয়ে থাকি গিয়ে। আসলে যত না শরীর খারাপ লাগা, মন খারাপ লাগা তার চেয়ে বেশি।

হঠাৎ লতিফ উঠে এসে আমার কপালে হাত রাখে–কই জ্বর? জ্বর তো নেই।

আমি কপাল সরিয়ে নিই না। লতিফ বলে–ও আপনার মনের জ্বর।

গে থাকে। ওর উষ্ণ করতলের নিবিড় স্পর্শ। আলতাফ তো কত ঘেঁয় আমাকে, গা এমন কেঁপে ওঠে না তো কখনও! আমি উঠে দাঁড়াই। বলি–আপনি বসুন, আলতাফ এসে যাবে এক্ষুণি। আমি বরং উঠি, একটু বিশ্রাম নেব।

আলতাফ দেখলে গালাগাল করবে এরকম কোনও ভয় আমার মনে কাজ করেনি। লতিফের আচরণই আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। আমি উঠব উঠব ভাবছি তখনই আলতাফ আসে। ওকে রেখে আমি চলে যাই বেড রুমে। আলতাফ লতিফের সঙ্গে গল্পগুজব সেরে যখন ঘরে আসে, আমি শুয়েছিলাম। বিকেলটা ঘরে কাটাতে আমার ভাল লাগে না। ভাল না লাগলেও ঘরেই কাটাতে হয়। স্বামী ছাড়া বের হওয়া নিষেধ আর স্বামীও একেবারে ছেড়ে দিয়েছে আমাকে নিয়ে কোথাও বের হওয়া। ঘরে ঢুকেই সে বলে–কী আজ যে বড় পালিয়ে এলে? ধরা পড়ে গেছ লজ্জায়?

প্রথম বুঝতে পারি নি কী বলছে সে। পরে বুঝলাম লতিফের সামনে থেকে উঠে আসা নিয়ে বিদ্রূপ করছে।

–ধর তাই। আমার কণ্ঠে আশ্চর্য নির্লিপ্তি।

–আজ তো শুয়েছিলে তোমরা, তাই না?

–শোয়া মানে?

–লতিফের সঙ্গে শোওনি তুমি বলতে চাও?

–বাজে কথা বলো না।

আলতাফের চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বের হয়। সে বলে–সেদিন তো লতিফ বলেছিল আমার জন্য সে এসেছে। আজ কার জন্য এসেছে? আজও কি বলতে চাও আমার জন্য? তুমি নিশ্চয়ই তাকে ডেকে এনেছ।

–আমি ডাকিনি।

–মিথ্যে কথা বলো না। তোমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব আমি। পেয়েছটা কী। আমাকে সে মানুষ পেয়েছ? কেন শুয়েছিলে ওর সঙ্গে বল।

আলতাফ আমার চুল ধরে হেঁচকা টান দেয়। বলে–হারামজাদি, তুই আমার জীবন নষ্ট করেছিস। আমার সুন্দর সংসার ছাড়খাড় করে দিয়েছিস তুই। তোকে আমি আস্ত রাখব না।

আমি চুল ছাড়াতে চাই, পারি না।

আলতাফ দাঁতে দাঁত ঘষে জিজ্ঞেস করে-শুয়েছিলি তুই? লতিফের সঙ্গে শুয়েছিলি কি না বল। এই বিছানায় শুয়েছিলি? সে বিছানার চাঁদর বালিশ তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করে আছে কিনা কোনও শোবার আর সঙ্গমের দাগ। আমার এত কষ্ট হয়, এত কষ্ট যে আমি বুঝতে পারি না আমরা কী বলা উচিত, কী করা উচিত। কান্না কণ্ঠে বলি–আমি শুইনি ওর সঙ্গে, বিশ্বাস কর।

আমার চোখ ফেটে জল নামে। তবু আলতাফ আমার চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে নামায় বিছানা থেকে, সারাঘরে ঘোরায় আর চিৎকার করে বলে-শুয়েছিলি কেন বল। তুই আমার বউ, তুই আরেক লোকের সঙ্গে শুবি কেন? বেশ্যা কোথাকার! একটা বেশ্যাকে আমার পুষতে হচ্ছে! খুব মজা পেয়েছিস ওর সঙ্গে শুয়ে, খুব মজা? তোর মজা আমি ঘোচাব। আমার সঙ্গে মজা পাও না। মজার জন্য গোপনে লোক ডেকে আনন। তোকে আমি বুঝি না ভাবিস। আমার সঙ্গে শুতে গেলেই তোর এত নাক সিটকানো কেন? আমার বাড়িতে পর পুরুষ ডেকে বেশ্যাগিরি করছিস! আলতাফ বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। হাউমাউ করে কান্না। এ কী অদ্ভুত রূপ তার! আলতাফ কাঁদছে। যখন কাঁদছে, আমার চুল থেকে সরিয়ে নিয়েছে হাত। চুলের গোড়ায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। আমার ভেতরে তবু ক্রোধ কেন জন্মায় না? এমন ক্রোধ যেন আমি আলতাফকে সবটুকু শক্তি দিয়ে মেঝেয় ফেলে কটা লাথি কষাতে পারি। গলা টিপে ধরতে পারি যেন ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আলতাফের জন্য আমার মায়া হতে পারত, মায়া হয় না। কান্নায় ওর ফুলে ফুলে ওঠা শরীর খামচে ধরে বলি-হ্যাঁ, শুয়েছি। শুয়েছি আমি, কী করবে তুমি? ওই লোকের সঙ্গে শুয়েছি। একশবার শোব। হাজারবার শোব আমি। তুমি এখন কাদো, আরও কঁদো, কেঁদে কেঁদে মরে যাও।

আলতাফ চেস্ট আব ড্রয়ারে উবু হয়ে ছিল। আমার কথায় মুখ তুলে বলে–এতক্ষণে সত্যি কথা বেরোল তাহলে। কতদিন থেকে শুচ্ছিস, বল। আলতাফের কোথায় গেল কান্না, কোথায় কী, সে দাঁত নখ বের করে আমাকে কামড় দিতে ছুটে আসে।

–অনেকদিন। যেদিন থেকে দেখলাম তুমি অক্ষম, সেদিন থেকে শুচ্ছি। কী করবে তুমি, আরও মারবে? মারো। আলতাফকে চেনা যায় না। হিংস্র জন্তুর মত তার দাঁত, নখ চোখ।

–কবার শুয়েছিস, বল। আমার দুটো বাহু শক্ত হাতে চেপে সে বলে।

–অনেকবার। হিসেব নেই। আমারও রাগ ধরে গেছে। শোয়ায় কী হয় আমিও দেখে ছাড়ব। নিজের সঙ্গমের শক্তি নেই, সে এসেছে অন্য পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম অবরোধ অভিযানে। যতসব স্বার্থপর হিংসুক কুটিল জটিল ক্লীব।

–শুধু কি লতিফের সঙ্গে, নাকি আরও কারও সঙ্গে? আলতাফের চোখে মুখে হিংসেগুলো দাপায়।

আমারও জেদ চেপে যায়। বলি–আরও অনেকের সঙ্গে।

–তুই এত বাজে মেয়ে। বাজারের বেশ্যা তুই। আর তোকে কিনা আমার বউ পরিচয় দিতে হয় সমাজে। এক্ষুণি বের হ বাড়ি থেকে। এক্ষুণি। আমার চোখের সামনে তোর মত পাপী স্বৈরিণীর মুখ যেন না দেখি। বদমাশ মাগি। বের হ। বের হ আমার বাড়ি থেকে।

-–ঠিক আছে যাচ্ছি।

আমি কাপড় চোপড় নেবার জন্য আলমারিতে হাত রাখি। হঠাৎ পেছন থেকে এক লাথি এসে পড়ে পিঠে। সামলাতে না পেরে আলমারির শক্ত কাঠে কপাল গিয়ে পড়ে। মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। রিমরিম করে ওঠে সমস্ত শরীর।

আলতাফ দ্রুত বাস ফেলে। রাগে সে কঁপে। আমি একটি মাঝারি ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে বলি–যাচ্ছি।

আমার একবারও মনে হয় না স্বামীর ঘর থেকে বের হওয়া উচিত নয়। আলতাফের জন্য, আলতাফের বাবা মার জন্য, এই বাড়ির জন্য আমার কোনও মায়া হয় না। বরং মনে হয় এই নরক থেকে পালাতে পারলে আমি বাঁচি। সদর দরজা খুলে বেরিয়ে যাই। কেউ আমাকে বাধা দেয় না। বাইরে পা দিয়ে, আমার বেশ ফুরফুরে লাগে। যেন এতদিনে আমার একটা গতি হল। আমি বুক ভরে শ্বাস নিই। বাইরের আলো হাওয়া জানালার ফাঁক ফোকর গলে যা ভেতরে যেত, সেইটুকুই পেয়েছি। এত বড় একটা আকাশ কতদিন দেখি না। এত বড় জগত, এখানে আমাকে এখন বাধা দেবার কেউ নেই। আমার যেমন ইচ্ছে আমি চলব। পেছনে ফিরতে আমার ইচ্ছে করছে না। পেছনে আমি ফিরব না। আমি সামনে হাঁটতে থাকি। কতদিন হাঁটি না আমি। কত দীর্ঘদিন আমি একটি বন্ধ ঘরে দম আটকে কাটিয়েছি। ভাবলে মায়া হয়, নিজের ওপরই মায়া। হাঁটতে থাকি। সামনে যানবাহন কিছু একটা পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। আবারও বাস নিই বুক ভরে। নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে মনে হয়। হাতের ব্যাগটিকেও ভার ভার লাগে। এটি নিয়ে আসাই উচিত হয়নি। কোথাও ফেলে দেওয়া যায় না? রাস্তায়? নির্ভার রাখতে চাই নিজেকে। দূর, কী আর আছে এর ভেতর গুটিকয় কাপড় ছাড়া? ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। দিই না ফেলে? কী হবে! কী হবে এই সব তুচ্ছ বৈষয়িক জিনিসে?

ঠিক ঠিকই আমি ফেলে দিলাম কাপড়ের ব্যাগ। হাতে আর কোনও বোঝা নেই। মনেও নেই। মুক্ত আমি, মুক্ত আমি শরীরে মনে। এরকমই তো চেয়েছিলাম। এরকম মুক্ত নির্ভার জীবন। এরকম স্বাধীন সুস্থ জীবন। আহ, কী ভীষণ ভাল লাগা। আমার এক মামা বাম রাজনীতি করত, জেল খেটেছিল একবার, এক বছর মত জেলে কাটাবার পর যেদিন বেরিয়ে এল, চারদিক তাকাচ্ছিল শুধু। কী দেখছ মামা জিজ্ঞেস করলে বলেছিল–পৃথিবীটা কী সুন্দর তাই না?

আমার সেরকমই লাগছে। পাশে কেউ নেই, থাকলেও আমিও বলতাম–বাইরে এত বড় জগৎ রেখে বোকা ছাড়া কেউ বসে থাকে ঘুপচি ঘরে! এত আলো রেখে কেউ পড়ে থাকে অন্ধকারে? এত মানুষ রেখে বাইরে, কেউ পড়ে থাকে এমন একা, আমি যেমন ছিলাম! এই আকাশ এখন আমার। আমারই তো। এই যে পথ, এই পথে আমার যেমন ইচ্ছে হাঁটব। আমি যেদিকে খুশি যাব। অন্ধকার নেমে আসছে, আমার কোথাও ফিরবার তাড়া নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress