এক কাপ চা
আমাদের খাটিয়া আর সব জিনিসপত্তর পড়ে রইল পাহাড়ের ওপরে, সাধুবাবার আশ্রমে। আমরা ফিরে এলুম ডক্টর চিরঞ্জীব শাকসেনার গাড়িতে।
মিংমা আর আমি নেমে গেলুম আরেরা কলোনির কাছে। কাকাবাবু যাবেন ভিখুসিংকে নিয়ে হাসপাতালে।
ছোড়দি তো আমাদের ফিরতে দেখে অবাক। এত তাড়াতাড়ি আমাদের অ্যাডভেঞ্চার শেষ হয়ে যাওয়ায় আমিও বেশ একটু নিরাশ বোধ করছি। ভেবেছিলুম ভীমবেঠকা পাহাড়ে অন্তত দিন সাতেক থাকা হবে। জলের কলসি-টলসি কেনা হল, কোনও কাজে লাগল না। বেশ লাগছিল। কিন্তু ওখানে থাকতে।
তাছাড়া খুনিরাও তো ধরা পড়ল না!
রত্নেশদা, ধীরেনদা, নিপুদারা সবাই অফিসে। দীপ্ত আর আলাও স্কুলে গেছে। দুপুরে কিছু করার নেই, আমি তাই খেয়ে-দেয়ে ঘুমোলুম। মিং ঘুমোয় না, ও সারা দুপুর খেলা করল কুকুরটাকে নিয়ে।
কাকাবাবু ফিরলেন বিকেলে। উশকো-খুশকো চুল, ক্লান্ত চেহারা। মনে হয় সারাদিন কিছুই খাননি। সঙ্গে একটা বিরাট ব্যা।গ ভর্তি অনেক রকম কাগজ আর বইপত্তর।
বিকেলের দিকে খবর পেয়ে ধীরেনদা ছুটে এলেন কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন,কী হল, কাকাবাবু, খুন ধরা পড়ল না?
কাকাবাবু বললেন, খুনি ধরা তো আমার কাজ নয়। ভীমবেঠকার সঙ্গে যে ঐ তিনটে খুনের সম্পর্ক আছে, তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে। এখন পুলিশ খুনিদের খুঁজে বার করবে। খুনের মোটিভ বা কারণটা জানা গেলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।
ধীরেনদা বললেন, যাঃ। আমরা খুব আশা করেছিলুম। আপনিই ওদের শাস্তি দেবেন।
কাকাবাবু মুচুকি হেসে বললেন, নাঃ, এবারে আর তা হল না। এক হিসেবে ধরতে পারো, এবারে আমার হার হল। ঐ সব সাংঘাতিক খুনির সঙ্গে আমি পারব কেন! পুলিশই পারতে পারে।
ধীরেনদা বললেন, এখানকার পুলিশ-আমার অত বিশ্বাস নেই।
কাল থেকে ভীমবেঠকার ঐ গুহাগুলোও পুলিশ পাহারায় থাকবে, যাতে ওখানে কেউ আর খোঁড়াখুড়ি করতে না পারে। সে ব্যবস্থা আমি করে এসেছি।
কাল থেকে? যদি আজ রাত্তিরেই ওরা এসে কিছু করে যায়?
সেটাও সরকারের দায়িত্ব। তবে…
কাকাবাবু কথা বলতে-বলতে থেমে চুপ করে রইলেন। একটু ভেবে আবার বললেন, তবে এমনও হতে পারে, কাল থেকে পুলিশ হয়তো পুরো ভীমবেঠক পাহাড়ই ঘিরে রাখবে, কোনও লোককেই যেতে দেবে না। আমাদের জিনিসপত্রের কী হবে? সেগুলো আনব কী করে? বিশেষত আমার ট্রান্সমিশান সেটটাও ওখানে পড়ে আছে।
আপনাকে নিশ্চয়ই যেতে দেবে। তা কখনও হয়?
বলা তো যায় না! বরং এক কাজ করা যাক, এই তো সবে সন্ধে হচ্ছে, এখনই গিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে আসা যাক। আমার ট্রান্সমিশন সেটুটা হারালে খুব মুশকিল হবে?
সেটা এমনি ফেলে এসেছেন?
সাধুবাবার কাছে জমা দিয়ে এসেছি। ধীরেন, তোমার গাড়ির ড্রাইভার আছে না?
আমিই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
না, না, তার দরকার নেই। তোমাকে যেতে হবে না। ড্রাইভার থাকলেই হবে, আমরা যাব। আর আসব।
তা হয় না, কাকাবাবু, এই রাত্তিরে আপনাকে আমরা একলা যেতে দেব না। আমি যাবই আপনার সঙ্গে।
ধীরেন, তুমি জানো না। ঐ সন্তুকে জিগ্যেস করো, আমি একবার না বললে আর হ্যাঁ হয় না। আমি বলছি, তোমার যাবার দরকার নেই।
আপনি কেন একথা বলছেন, আমি জানি। আপনি ভাবছেন, আমার যদি কোনও বিপদ হয়, তাহলে আমার স্ত্রী আর ছেলেরা আপনাকে দোষ দেবে! যে ড্রাইভার বেচারা যাবে, তারও স্ত্রী আছে, দুটো বাচ্চা আছে। তার বিপদ হলেও সেই একই ব্যাপার। তা ছাড়া আপনি না থাকলেও আমি মাঝে-মাঝে এরকম বিপজ্জনক ঝুঁকি নিই। চলুন, আর দেরি করে লাভ নেই, বেরিয়ে পড়া যাক।
তুমি যাবেই বলছ? বেশ! তুমি ফায়ার আর্মস চালাতে পারো? তোমার আছে কিছু?
এক কালে আমার শিকারের শখ ছিল। কিন্তু এখন তো বন্দুক পিস্তল কিছু নেই আমার। একটা বড় ছুরি আছে। ওঃ হ্যাঁ, রত্নেশের তো রাইফেল আছে, সেটা নিতে পারি?
তাই নাও। একটা কিছু হাতিয়ার সঙ্গে রাখা ভাল।
মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লুম। কাকাবাবু কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন একটা ব্যাগ।। ভীমবেঠকায় পৌঁছবার আগেই নেমে এল অন্ধকার। এখানকার রাস্তা অবশ্য অন্য অনেক পাহাড়ি রাস্তার মতন তেমন বিপজ্জনক নয়। হেডলাইট জেলে ধীরেনদা সাবধানে চালাতে লাগলেন গাড়ি।
কালকের মতন আজও সাধুবাবা চোখ বুজে ধ্যানে বসেছেন।
কাকাবাবু বললেন, এখন ওঁকে ডাকা ঠিক হবে না। একটুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক।
আশ্রমের পেছন দিকে আমাদের গোটানো খাটগুলো পেয়ে গেলুম। কিন্তু স্টোভ আর অন্যান্য জিনিসপত্র কিছু নেই। সেগুলো হয়তো সাধুবাবা আশ্রমের মধ্যে রেখে দিয়েছেন। কিন্তু সাধুবাবার অনুমতি না নিয়ে আশ্রমের মধ্যে ঢোকা উচিত নয়।
আমরা সকালে চলে যাওয়ার সময় সাধুবাবাকে একটা খবরও দিয়ে যেতে পারিনি। উনি কী ভেবেছেন, কে জানে!
নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলুম এদিক ওদিক। আজ আর তেমন অন্ধকার নয়, আকাশ বেশ পরিষ্কার।
ধীরেনদা চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলেন, সাধুজির ধ্যান কখন ভাঙবে? যদি সারারাত উনি ঐরকম বসে থাকেন?
ধীরেনদা এই কথা বলার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কালকের মতন গোরুটা দুবার ডেকে উঠল, হামবা! হামবা!
তারপরই সাধুবাবা বললেন, ব্যোম ভোলা, মহাদেও, শঙ্করজি!
আশ্চর্য! সত্যিই তো দেখা যাচ্ছে, এই গোরুটা একদম ঠিক ঘড়ির মতন।
কাকাবাবু বললেন, নমস্কার, সাধুজি?
সাধুজি বললেন, রায়চৌধুরীবাবু, আপলোগ আচানক চলে গ্যয়ে ম্যায় শোচ্ত হুঁ-
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমরা পাহাড়ের নীচে নেমে গিয়েছিলুম, তাই আপনাকে আর খবর দিতে পারিনি। আমার জিনিসপত্র–
সাধুবাবা জানালেন যে, সেগুলো আশ্রমের মধ্যে আছে। ভেতরে ঢুকে তিনি একে-একে সবই এনে দিলেন।
কাকাবাবু সাধুবাবাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানাবার পর জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা! সাধুজি, আমরা চলে যাবার পর আর কেউ এসেছিল? আপনার নজরে কিছু পড়েছে?
উনি দুদিকে মাথা নাড়লেন।
জানেন, সাধুজি, এই পাহাড়ে গুপ্তধনের হদিস পাওয়া গেছে?
সাধুবাবা হিন্দিতে বললেন যে, গুপ্তধন? তা বেশ তো! তাতে ওঁর কিছু যায় আসে না। ওঁর তো কোনও জিনিসে প্রয়োজন নেই।
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নমস্কার, সাধুজ। আবার পরে এলে দেখা হবে।
মালপত্রগুলো সব নিয়ে আসা হল গাড়ির কাছে। ওপরের কেরিয়ারে বাঁধা হল খাটগুলো। আমরা গাড়িতে উঠে বসেছি, কাকাবাবু তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। উনি যেন শেষবারের মতন দেখে নিচ্ছেন পাহাড়টাকে। কিন্তু আবছা অন্ধকারে কিছুই দেখবার নেই। অবশ্য। অন্ধকার গুহাগুলোর দিকে তাকিয়ে আজও আমার গা ছমছম করছে।
কাকাবাবু বললেন, এত দূর এলুম। যখন, একবার গুপ্তধনের খোঁজ করে যাব
ধীরেনদা জিজ্ঞেস করলেন, কাকাবাবু, আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে, এখানে গুপ্তধন আছে? আমি কিন্তু এখনও ঠিক-
তোমাকে কেন আনতে চাইনি জানো ধীরেন? গুপ্তধন পেলে তোমাকেও ভাগ দিতে হবে, সেই জন্য!
আমি আর ধীরেনদা দুজনেই অবাক। কাকাবাবুর মুখে এরকম কথা আমি কখনও শুনিনি। উনি গুপ্তধনের জন্য লোভ করবেন, তা হতেই পারে না।
কাকাবাবু বললেন, মিংমা, চলো তো আমরা একবার নীচের সেই গুহাটা থেকে ঘুরে আসি। ধীরেন আর সন্তু এখানে অপেক্ষা করুক।
ধীরেনদা বললেন, আপনি এই অন্ধকারের মধ্যে এতখানি নীচে নামবেন? এ যে অসম্ভব ব্যাপার।
অসম্ভব বলে আবার কিছু আছে নাকি? ছবির ভাষার যে সঙ্কেত তা আমি বুঝতে পেরে গেছি। সেটা সত্যি কিনা। আজই আমি একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই। কাল থেকে পুলিশ পাহারা দেবে-তোমরা দুজনে এখানে অপেক্ষা করো বরং…
ধীরেনদা কাকাবাবুকে থামাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। কাকাবাবু যাবেনই গুপ্তধনের সন্ধানে। তাহলে ধীরেনদা আর আমারও এখানে বসে থাকার কোনও মনে হয় না।
এবার আমার সত্যিকারের ভয় করতে লাগল। হোঁচটি খেয়ে পড়া কিং নীচে গড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তো আছেই। তা ছাড়া কে কোথায় লুকিয়ে আছে, ঠিক নেই। যে-কেউ পাথর ছুঁড়ে কিংবা গুলি করে আমাদের মেরে ফেলতে পারে।
ঠিক হল সবাই যাব, একসঙ্গে, পরস্পরকে ছুঁয়ে থেকে। আমার আর মিংমার হাতে টর্চ, সামনে রাইফেল হাতে ধীরেনদা, একদম পেছনে রিভলভার হাতে কাকাবাবু!
নামতে নামতে এক-একবার কোনও শব্দ শুনেই চমকে উঠছি আমরা। হয়তো আমাদেরই পায়ের শব্দ কিংবা পায়ের ধাক্কায় ছিটকে-যাওয়া কোনও নুড়ি। মাথার ওপর দিয়ে শান-শন করে উড়ে গেল একদল বাদুড়। এই অন্ধকারের মধ্যে ক্রাচে ভর দিয়ে পাথরের ওপর দিয়ে নামা যে কত শক্ত, তা আমরা বুঝব কী করে! দুপায়ে ভর দেওয়া সত্ত্বেও প্রায়ই হড়কে যাচ্ছে আমাদের পা, কাকাবাবু কিন্তু একবারও পিছলে গেলেন না।
বেশি নীচে নামতে হল না। মাঝামাঝি এসে এক জায়গায় কাকাবাবু দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, দ্যাখ তো, সন্তু, সামনের গুহাটার নম্বর কত?
কোনও-কোনও গুহার বাইরে আলকাতরা দিয়ে নম্বর লেখা আছে বটে। এখানে একটা গুহার বাইরে লেখা আর এস ফিফটি টু।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে দ্যাখ আর এস ফিফটি ফোরটা কাছাকাছি হবে।
টর্চের আলো ঘোরাতেই এক জায়গায় দুটো আগুনের মতন চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
আমি চমকে উঠতেই ধীরেনদা বললেন, ওটা নিশ্চয়ই কোনও পাখি। হ্যাঁ, এই তো প্যাঁচাটা এত আলো দেখেও নড়ে-চড়েনি। একদৃষ্টি চেয়েছিল আমাদের দিকে। আমি আর মিংমা হুস-হাস করতে অনিচ্ছার সঙ্গে উড়ে গেল। গুহাটার মধ্যে খুব ভাল করে দেখলুম যে, আর কিছু নেই। তারপর ঢুকে পড়লুম সেটার মধ্যে।
এক দিকের দেয়ালে দেখলুম, পর পর কয়েকটা মানুষের ছবি, আর দুটো জন্তুর, খুব সম্ভবত মোষের।
আমি বললুম, হ্যাঁ, কাকাবাবু, ছবি আছে।
কটা মানুষ?
তেরোটা।
অন্য দেয়াল দ্যাখ।
আরেকটি দেয়ালেও এক সার মানুষ রয়েছে। এখানে আছে পাঁচটা। পেছন দিকের দেয়ালে নটা।
সে-কথা কাকাবাবুকে জানাতে উনি বললেন, ভাল করে ছাদটাও দেখতে।
হ্যাঁ, ছাদেও ছবি আছে অনেকগুলো। এখানেও তেরোটা।
কাকাবাবু বললেন, তাহলে কত হল? চল্লিশ না? ঠিক আছে। এবারে বেরিয়ে আয়।
শরীরটা একবার কেঁপে উঠল আমার। চল্লিশ মানুষ! গুপ্তধনের সংকেতে চল্লিশজনের উল্লেখ আছে। তা হলে কি এখানেই আছে সেই গুপ্তধন?
কাকাবাবু পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে টর্চের আলোয় দেখে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, মিলেছে। আমি দুপুরে মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে এসেছি, কোন গুহায় কত ছবি আছে, তার লিস্ট আছে সেখানে। দুটো মোষের ছবিও দেখিসনি?
হ্যাঁ। দেখেছি, কাকাবাবু!
এবার দ্যাখ তো, পাশের গুহাটায় কী আছে?
সে-গুহাটায় ঢুকে দেখলুম, সেখানে আর কোনও ছবি নেই, শুধু দুটো মোষের ছবি।
কাকাবাবু নিজের ঝোলা-ব্যাগ থেকে একটা শাবল বার করে উত্তেজিতভাবে বললেন, আর একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না! এই দুটো গুহার মাঝখানেই আছে সেই গুপ্তধন। চটপট গর্ত করে দেখতে হবে।
প্ৰথমে ধীরেনদা চেষ্টা করলেন শাবল দিয়ে গর্ত খোঁড়বার। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে কিছু মাটিমেশানো জায়গাও আছে। সেখানে ছাড়া অন্য জায়গায় শুধু শাবল দিয়ে গর্ত খোঁড়া প্রায় অসম্ভব। ধীরেনদা খানিকটা খুঁড়বার পর মিংমা ওঁর হাত থেকে শাবলটা নিয়ে জোরে-জোরে গর্ত খুঁড়তে লাগল। বেশ কিছুটা গর্ত করার পর ঠং-ঠাং শব্দ হতে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও, আমি দেখছি।
তিনি গর্তটার পাশে বসে পড়ে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। কিছুই নেই, শুধু কঠিন পাথর।
কাকাবাবু দ্বিতীয়টাও পরীক্ষা করে দেখে বললেন, আর-একটা খুঁড়ে দ্যাখো, কিছু এখানে থাকতে বাধ্য।
তৃতীয় গর্তটা অনেকখানি গভীর হল। এক সময় কাকাবাবু মিংমাকে বললেন, ব্যস, আর না। সরে এসো, আমি ভেতরটা খুঁজে দেখছি। সবাই টর্চ নিভিয়ে দাও তো একবার, কিসের যেন শব্দ পেলাম।
বড়-বড় পাথরের ফাঁকে আকাশের আলো আসে না, টর্চ নেভাতেই আমরা ড়ুবে গেলাম ঘুট-ঘুটে অন্ধকারে। সবাই কান খাড়া করে রইলাম।
দুরে যেন শুকনো পাতা ভাঙার শব্দ হল। কেউ যেন হাঁটছে। তবে আওয়াজটা এত ক্ষীণ যে, মনে হয়, যে-ই হাঁটুক, সে আছে বেশ দূরে, কিং শেয়াল-টেয়ালের মতন ছোট কোনও প্রাণী।
একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কাকাবাবু ফিসফিসিয়ে বললেন, একটু টর্চ জ্বলো একবার। মনে হয় কী যেন পেয়েছি!
কাকাবাবু হাতটা তুললেন, তাতে একটা ধাতুর মূর্তি। প্রায় এক-হাত লম্বা একটা মানুষের মতন।
কাকাবাবু দারুণ উত্তেজনার সঙ্গে বললেন, এই তো, সোনার মুর্তি। আমার ধারণা এরকম চল্লিশটা মূর্তি এখানে পোঁতা আছে। এর এক-একটার দাম কত হবে বলে তো, ধীরেন?
ধীরেনদা এত অবাক হয়ে গেছেন যে, কথাই বলতে পারছেন না। সত্যিই গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি। আমরা। এই তো দেখা যাচ্ছে একটা কত বড় সোনার মূর্তি। টর্চের আলোয় গাটা ঝকঝকি করছে।
কাকাবাবু বললেন,অন্তত লাখ দুএক টাকা এই একটারই দাম হবে। যথেষ্ট হয়েছে, চলো এবার। বেশি লোভ করা ভাল নয়। আমরা বে-আইনি কাজ করছি। তা ছাড়া যে-কোনও মুহূর্তে বিপদ হতে পারে।
মিংমাকে তিনি বললেন চটপট গর্তগুলো বুজিয়ে দিতে। তারপর আমরা ফেরার পথ ধরলাম। এত জোরে উঠতে লাগলুম যেন কেউ আমাদের তাড়া করে আসছে। গুপ্তধন নিয়ে পালাচ্ছি বলে ধকধক করছে বুকের মধ্যে।
বিনা বিপদেই আমরা পৌঁছে গেলুম ওপরের রাস্তার দিকটায়। কাছে আসবার পর ভয় কেটে গেল। অন্ধকার গুহাগুলোর আশেপাশে যে-কেউ আমাদের আক্রমণ করতে পারত। কিন্তু এখানে সে ভয় নেই। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা, আমাদের কাছে একটা রাইফেল আর রিভলভার আছে।
গাড়িটাতে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগলুম খানিকক্ষণ। তারপর কাকাবাবুর কাছ থেকে মুর্তিটা নিয়ে সবাই দেখলুম ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে। মূর্তিটা বেশ ভারী। এতকাল মাটির তলায় ছিল, কিন্তু একটুও ভাঙেনি, শুধু রংটা একটু কালো হয়ে গেছে। তবু বোঝা যায় জিনিসটা সোনার।
ধীরেনদা বললেন, এবার তা হলে কেটে পড়ি আমরা?
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের খিদে পায়নি? এত পরিশ্রম হল? আমার তো খিদেয় পেট জুলছে।
ধীরেনদা বললেন, ওবায়দুল্লাগঞ্জে হোটেল খোলা থাকতে পারে। চলুন, সেখানে খেয়ে নেবেন।
গাড়ির সামনের ঘাসের ওপর বসে পড়ে কাকাবাবু ক্ৰাচ দুটো এক পাশে সরিয়ে রাখলেন। তারপর বললেন, ভাবছি পথে কোনও বিপদ হবে কি না! পাহাড় থেকে নামবার পথে যদি কেউ আমাদের গাড়ি আটকায়? একটা পাথরের চাই। গড়িয়ে দেয়? পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলের আড়াল থেকে কেউ যদি আমাদের দেখে থাকে–আমাদের সঙ্গে এত দামি জিনিস-। তার চেয়ে এক কাজ করলে তো হয়, রাত্তিরটা আমরা এখানেই থেকে যাই, সঙ্গে তো স্টোভ আর চাল-ডাল আছেই, মিংমা খিঁচুড়ি রাঁধবে।
ধীরেনদা বললেন, সারা রাত এখানে থাকবেন?
কেন, অসুবিধের কী আছে?
আমি যদি খুব জোর গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যাই?
তাতে বিপদ আরও বাড়বে। রাস্তার মাঝখানে পাথর ফেলে রাখলে আমাদের গাড়ি উলটে যাবে! তার চেয়ে বরং এখানে সারা রাত জেগে পাহারা দেব। সেই তো ভাল?
বাড়িতে কিছু বলে আসিনি। ওরা চিন্তা করবে। ভেবেছিলুম, রাত দশটার মধ্যে ফিরব?
এখনই তো দশটা বেজে গেছে। তোমাদের বাড়িতে খবর দেবার ব্যবস্থা আমি করছি। থানায় খবর দিচ্ছি, ওরা তোমার বাড়িতে জানিয়ে দেবে।
কাকাবাবু ওয়্যারলেস ট্রান্সমিশান সেটটা খুললেন। সেটাতে কড়কড় শব্দ হতেই উনি বললেন, রায়চৌধুরী স্পীকিং, ফ্রম দা ভীমবেঠক হিলস…রায়চৌধুরী…
মিংমা এই সব কথাবার্তা শুনে গাড়ি থেকে স্টোভটা বার করে জ্বেলে ফেলেছে। কাকাবাবু বললেন, আগে একটু চা করো। তারপর খিঁচুড়ি-টিচুড়ি হবে।
জলের কলসিগুলো কিন্তু সাধুবাবার আশ্রমের কাছে রয়ে গেছে।
ধীরেনদা বললেন, চলো সন্তু, তুমি আর আমি ধরাধরি করে একটা কলসি এখানে নিয়ে আসি। দিব্যি জ্যোৎস্না উঠেছে, আমাদের মুনলিট পিকনিক হবে।
আমি বললুম, ধীরেনদা, আপনার একবারও বুক কাঁপেনি? আমার তো এখনও বুকের মধ্যে দুম-দুম হচ্ছে। গুপ্তধনের জন্য গর্ত খোঁড়ার সময় সব সময় মনে হচ্ছিল, কারা যেন লুকিয়ে-লুকিয়ে আমাদের দেখছে। এই বুঝি গুলি চালাল।
তোমার তাই মনে হচ্ছিল? আমার এখন কী মনে হচ্ছে জানো? রাত্তিরে যখন থেকেই যাওয়া হল, তখন আর-একবার ওখানে গেলে হয় না?
আবার যেতে চান?
আরও কত জিনিস আছে দেখতুম! সত্যি, গুপ্তধনের একটা সাঙ্ঘাতিক নেশা আছে।
যারা গুপ্তধন খুঁজতে যায়, তারা কেউ সাধারণত প্ৰাণে বাঁচে না।
এর মধ্যে তিনজন খুন হয়েছে। কে জানে, তারাও আলাদাভাবে এখানে গুপ্তধনের জন্য এসেছিল কি না! এসে হয়তো কিছু পেয়েওছিল, খুন হয়েছে সেই জন্য!
তবু আপনি বলছেন, আবার যাব!
তবু ইচ্ছে করছে যেতে। তা হলেই বুঝে দ্যাখো কী রকম নেশা?
জলের কলসিগুলো বাইরেই পড়ে আছে। সাধুবাবা ঘুমোতে গেছেন। আমি আর ধীরেনদা একটা কলসি দুজনে ধরে তুললাম।
সেটাকে ধরাধরি করে কিছুটা নিয়ে এসেছি, এমন সময় কোথায় যেন প্রচণ্ড জোরে দুম-দুম করে দুটো শব্দ হল। ঠিক যেন কামানের আওয়াজ কিংবা বোমা ফাটার মতন।
দুজনে এতই চমকে গিয়েছিলুম যে, হাত থেকে পড়ে গেল। কলসিটা। দুজনেরই মনে হল, কাকাবাবুর কোনও বিপদ হয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে ছুটলুম গাড়ির দিকে।
কাকাবাবুও আমাদের চিন্তায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমরা এসে পৌঁছবার পর কাকাবাবু বললেন, যাক, তোমরা এসেছ, নিশ্চিন্ত! মিংমা, তোমার আর খিঁচুড়ি রাঁধতে হবে না, আমরা একটু বাদে ফিরে যাব।
হাতের সোনার মূর্তিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, এটারও আর কোনও দরকার নেই।
ধীরেনদা বললেন, কী হল ব্যাপারটা?
কাকাবাবু হেসে বললেন, ওটা সোনার মূর্তি নয়। সাধারণ লোহার মূর্তির ওপর পেতলের পাত মোড়া!
ধীরেনদা চোখ একেবারে কপালে তুলে বললেন, আপনি ঐ গুপ্তধনের জায়গায় এই লোহার মূর্তি পেয়েছেন? গর্তের মধ্যে?
কাকাবাবু হাসলেন।
মূর্তিটা গর্তে ছিল না। ছিল আমার ঝোলায়। অন্ধকারের মধ্যে গর্তে লুকিয়ে তারপর তোমাদের তুলে দেখিয়েছি। ওটা গুপ্তধনের জায়গাও না, ওখানে আমি দুটো ফাঁদ পেতে রাখতে গিয়েছিলাম। আমার কায়দাটা কাজে লেগে গেছে দেখছি। এক্ষুনি দেখতে পাবে। ওরে মিংমা, চা-টা অন্তত তৈরি করে ফ্যাল।
মিংমা ফ্ল্যাস্কের জল নিয়ে সসপ্যানে চাপিয়ে দিল।
ধীরেনদা মাটি থেকে মূর্তিটা তুলে নিয়ে বললেন, আমার আগেই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি সে-রকম কথা একবার ভাবিওনি। গর্তের মধ্য থেকে বেরুল-কাকাবাবু, আমি কিন্তু ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। এখনও। বোমা ফাটল কোথায়? কারা ফাটল?
আমি ফাটালাম!
আপনি?
বোসো, বলছি। আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম যে, যারা গুপ্তধনের লোভে মানুষ খুন করেছে, তারা আজ রাতেই কিছু একটা হেস্তনেস্ত করার চেষ্টা করবে। কাল থেকে পুলিশ-পাহারা বসবে। আজ রাতে, অন্ধকারের মধ্যে যদি ঐ গুহা আর জঙ্গলে আট-দশটা লোকও লুকিয়ে থাকে, তাহলেও তাদের ধরা সম্ভব নয়। অন্ধকারে খুঁজে পাবে কী করে? তাই আমি একটা ফাঁদ পাতলুম। অনেক চেষ্টা করে আজ দুপুরে এখানকার আর্মির কাছ থেকে আমি দুটো মিথেন বোমা জোগাড় করেছি। কোনও লোহার জিনিস দিয়ে ছুলেই এই বোমা ফেটে যায়। তখন দুশো ফুটের মধ্যে যত মানুষ থাকবে সবাই অজ্ঞান হয়ে যাবে। যেখানে আমরা গুপ্তধন খুঁজতে গিয়েছিলাম, ওখানে গুপ্তধন থাকার কোনও কথাই নয়। তবু ওখানে গর্ত খুঁড়িয়ে একটাতে এই রকম আর-একটা পেতলের মূর্তি, আর দুটোতে দুটো বোমা আমি লুকিয়ে রেখে এসেছি তখন। জানতুম, আড়াল থেকে কেউ-না-কেউ আমাদের লক্ষ করবেই। ঠিক সেটাই হয়েছে। ঐ শোনো?
এবার জঙ্গলে শোনা গেল অনেক হুইশেলের শব্দ, মানুষের গলার আওয়াজ। আর বড়-বড় ফ্লাশলাইটের আলো ঝলসে উঠল। কৌতূহল সামলাতে না-পেরে আমরাও এগিয়ে গেলুম খানিকটা।
প্রায় কুড়িজন পুলিশ মিলে বয়ে নিয়ে এল আটজন ঘুমন্ত বন্দীকে। আমি চমকে উঠলুম তাদের মধ্যে প্রথমেই সাধুবাবাকে দেখে।
ধীরেনদা বললেন, ইশ, সাধুবাবা পর্যন্ত লোভ সামলাতে পারেননি?
কাকাবাবু বললেন, ইনি আসল সাধুবাবা নন। আগের বার এসে দেখেছিলাম দুজন সাধুকে। ও ছিল চেলা। আসল বড় সাধুবাবা কাশীতে তীর্থ করতে গেছেন।
পুলিশের অফিসার বললেন, আরও তিনজনকে চিনতে পারা গেছে। একজন মিউজিয়ামের দারোয়ান, একজন পুলিশের লোক, আর এই যে গোঁফওয়ালাটিকে দেখছেন, এ সেই কুখ্যাত ডাকাত রামকুমার পাধি, খুনগুলো সম্ভবত এই করেছে। ভোজালি দিয়ে মুণ্ডু কেটে ফেলা এর স্টাইল। ওর নামে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা আছে।
কাকাবাবু বললেন, আর সবাইকেও চিনতে পারবেন ঠিকই। সবই এক জাতের পাখি। এদের একটু চাপ দিলেই জানতে পারবেন, কোথায় এরা সুন্দরলালের ছেলে প্ৰেমকিশোরকে আটকে রেখেছে। সম্ভবত প্ৰেমকিশোরের মুখ থেকেই এরা প্রথমে ব্যাপারটা জানতে পারে। তার কী সাঙ্ঘাতিক পরিণতি!
পুলিশ অফিসারটি বললে, স্যার, আপনি যে অসাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে এরকমভাবে ওদের ধরতে আমাদের সাহায্য করবেন…
কাকাবাবু সে-কথা না-শুনে মিংমার দিকে ফিরে বললেন, কই রে, তৈরি হল না এখনও? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। এখন ভাল করে এক কাপ চা খেতে চাই।