Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভাঙন || Humayun Azad

ভাঙন || Humayun Azad

বিক্রমপুর ভাঙছে, ভাঙতে ভাঙতে বিক্রমপুর ছোটো হয়ে এসেছে
শিশুর মুঠোর মতো, এবং বিক্রমপুরের দক্ষিণ জুড়ে
শিশুর মতোই কাঁদছে ঘরবাড়ি, মসজিদ, কলার সবুজ পাতা,
নারকোল গাছের সারি। শুনতে পাচ্ছি তাদের বিলাপের ঐকতান,
দেখতে পাচ্ছি নারকোল বাগান ভেসে যাচ্ছে খলখল ক’রে, শুনতে পাচ্ছি
পদ্মায় ভেঙে পড়ছে টিনের ঘরের চাল; আর সন্ধ্যায় পদ্মার পশ্চিম পারে
সূর্যটা এমনভাবে কাঁপছে যে মনে হচ্ছে দুই বিঘে আকাশ নিয়ে ভেঙে প’ড়ে
ভেসে যাবে পদ্মার পানিতে। পদ্মা সুবোধ বালক বা সুশীলা বালিকা
নয়, পদ্মা ভয়ঙ্কর আদিম আর্য রূপসী, ভাঙার সময়ও অপূর্ব সুন্দরী।
ছেলেবেলায় এক বিকেলে আমি পদ্মাপারে দাঁড়িয়ে ছিলাম,
আমাকে নিয়েই ভেঙে পড়েছিলো পদ্মার খাড়া পার; আর আমি ভাঙতে
দেখেছি ভাগ্যকূল, বাঘড়া, কেদারপুর, মাওয়া, জশিলদা, কবুতরখোলা,
কান্দিপাড়া; শুনেছি বেপারি বাড়িতে কদমা পাগলার কবরটি নিয়ে দিঘলি
ঝাঁপিয়ে পড়েছে পদ্মায়। ভাগ্যকূলে কুমারবাহাদুরের বাড়িটা আমার
ছেলেবেলা জুড়ে বটগাছের মতো কাৎ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো
ভেঙে পড়বে ব’লে; আমি গ্রাম ছেড়ে চ’লে আসার পরই সেটিকে
সম্পূর্ণ গ্রহণ করে পদ্ম। ওই বাড়িটিকে আজো আমি দেখি।
তবু আমি পদ্মাকে কখনো ভালো না বেসে পারি নি, আমার রক্তের মধ্যে
প্রচণ্ড গতিতে বয়ে চলে পদ্মার ঘোলা জল, ঢেউ, জলভ্রমি, রুপোলি ইলিশ,
বোয়াল, পাঙ্গাশ, আর প্রচণ্ড ভাঙন। আমার ছেলেবেলায় বহুবার পদ্মা ঢুকে
গিয়েছিলো ভাগ্যকুল বাজারের ভেতর; কামারগাঁর বাঁশবন
কাঁপিয়ে বয়ে গিয়েছিলো পদ্ম, এবং রাড়িখালে আমি ঘরের কেবিনে ব’সে
খাটালে বর্শি ফেলে ধরেছি পুঁটি, ট্যাংরা, গোলশা, এবং একটি হলদে
ঢোঁড়া সাপ টোপ গিলে আমাকে আধঘণ্টা ধ’রে দেখিয়েছিলো
তার জিমন্যাস্টিক্স। আমরা তখন অপেক্ষা করতাম পদ্মার জন্যে,
বোশেখ এলেই অপেক্ষা করতাম কখন আসবে পদ্মা ধানখেতে, পুকুরে,
খেলার মাঠে, আড়িয়ল বিলে; জ্যৈষ্ঠ আসতে না আসতেই পাটখেত ভ’রে,
দলঘাস কাঁপিয়ে, সন্ধ্যার বোয়ালকে উত্তেজিত ক’রে আসতো পদ্মা
পুকুরে, মাঠে, খেতে, আড়িয়ল বিলে। আমরা অপেক্ষা করতাম,
আমরা প্রস্তুত থাকতাম, আমরা ভালোবাসতাম, আমরা কামনা
করতাম। এখন কেউ আর অপেক্ষা করে না পদ্মার জন্যে,
পদ্মাকে বন্ধ্যা করার জন্যে চক্রান্তে পাগল সবাই, পদ্মাকে সরকার এখন
রাজা আর প্যান্থার পরতে শেখাচ্ছে। কোথায় সেই খালগুলো?
কোথায় নাগনন্দী, ভাগ্যকূলের খাল? মান্দ্রার খাল?
কান্দিপাড়া, বাঘড়ার খাল? বিক্রমপুর এখন পদ্মার প্রকাশ্য শত্রু।
এখন আর খাল বেয়ে আসে না পদ্মার ঘোলা জল, আসে না
রুপোলি শস্যগুলো; খালের কাটাল উজিয়ে আর পদ্মার দিকে বয়ে
চলে না ডিমভরা ছাটাচিংড়ি, খসখসে নরম বেলে; বিক্রমপুরে এখন আর
বর্ষা আসে না, জোয়ার আসে না, পদ্মা আসে না; আসে আকস্মিক
বন্যা, পদ্মার পার জুড়ে শুরু হয় তাণ্ডব, ভাঙন। এসব কি পদ্মার

প্রতিহিংসা? বন্য ক্রোধ? পদ্মা এখন ইলিশহীন, পদ্মার ভেতরে এখন ইলিশ
নেই, পদ্মার ঢেউয়ের ওপর আর ইস্টিমার নেই; এখন আর বিক্রমপুরের
কোনো বালকের শেষরাত মুখর হয় না ইস্টিমারের সুদুর সিটিতে,
জেগে জেগে কোনো কিশোর আর স্বপ্ন দেখে না। তারা ভুলে গেছে
পদ্মায় সাঁতার কাটতে, নৌকো বাইতে; নৌকোর থেকে ভাঙা নড়োবড়ো
বাস তাদের অনেক প্রিয়। কাশবন নয়, এখন তাদের বুকে স্বপ্ন
জাগায় কোরিয়া, জাপান, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, জেদ্দা। বিক্রমপুরকে
শুধু পদ্মাই ভাঙছে না, ভাঙছে দিনার, ইয়েন, ডলার, আর কতো
বিচিত্র মুদ্রা। বিক্রমপুরে এখন ঠাণ্ডা ডাবের থেকে অনেক সুলভ কোকাকোলা,
রাখালের বাঁশরির থেকে সুলভ এখন হিন্দি সিনেমার গান।
ভাঙছে বিক্রমপুর, শব্দ শুনছি, পদ্মাপারের মতো ভাঙছে বিক্রমপুর;
আমি দেখতে পাচ্ছি ভেঙে পড়ছে নারকোল গাছের সারি, টিনের রঙিন ঘর,
মমিনার মরিচ খেত, ভেঙে পড়ছে আঙিনায় কিশোরী
আর ধানখেতে দাঁড়ানো কিশোর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *